ইতালির ফুটবল লীগে ফাটকা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন পাওলো রোসি। দু বছর সাসপেণ্ড থাকার পর লীগে তিনটি ম্যাচ খেলেই বিশ্বকাপের জন্য ইতালি দলে স্থান পান। ম্যানেজার এনজো বেয়ারজোতের এমনই তার প্রতি আস্থা যে, প্রাথমিক পর্বে তিনটি ম্যাচেই ড্র করা ইতালির এই স্ট্রাইকার খারাপ খেলা সত্ত্বেও তাকে তিনি বসিয়ে দেননি। হঠাৎই খুলে গেল রোসির খেলা। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ইতালি ৩—০ জিতল তাঁর হ্যাটট্রিকে। সেমিফাইনালে পোল্যান্ড হার ২—০ এবং এবারও গোল দুটি রোসির। এর আগে বোনিয়েকের হ্যাটট্রিকে পোল্যান্ড ৩—০ হারিয়েছিল বেলজিয়ামকে।
পশ্চিম জার্মানির মূল স্ট্রাইকার অধিনায়ক রুমেনিগেও মার খেয়ে খেয়ে জখম হয়ে যান। সেমিফাইনালে প্রথমার্ধেই ফ্রান্স ১—৩ এগিয়ে যাওয়ায় নিরুপায় ডারওয়েল বাজি ধরার মতই আহত রুমেনিগেকে নামিয়ে ফল পেলেন। ৩—৩ হল রুমেনিগে ও ফিশারের দেওয়া গোলে। টাইব্রেকারে ফল যখন ৪—৪, জার্মান গোলকিপার শুমাখার একটি কিক আটকে দিয়ে মোট ৮—৭ গোলে জিতে জার্মানিকে ফাইনালে যেতে সাহায্য করেন।
ফাইনালের বিরতির সময় পশ্চিম জার্মানির সুইপার উলি স্টিয়েলাইক ম্যানেজার ডারওয়ালকে বললেন, যদি জখম থাকা রুমেনিগেকে বসান না হয় তাহলে ইতালির কাছে হারতে হবে। ডারওয়াল কথাটা অগ্রাহ্য করেন। মাদ্রিদের বার্ণাবু স্টেডিয়ামে খেলার ফল তখন ০—০। ইতালির সেরা ফরোয়ার্ড আন্তাোননি আহত থাকায় খেলছেন না। স্ট্রাইকার গ্রাজিয়ানি চোট পেয়ে মাঠ ছেড়ে গেছেন এবং কাব্রিনি একটা পেনাল্টি নষ্ট করেছেন। এতেই পশ্চিম জার্মানির ম্যানেজার বুঝে গেছেন ইতালি এবার ভেঙে পড়বে। স্টিয়েলাইক জবাব দেন, ‘ইতালির কাছে ঠকবেন না। ওদের হারাতে হলে আমাদের দরকার এগারোজন পুরো ফিট খেলোয়াড়। রুমেনিগে ফিট নয়। কিছু একটা করুন।’
ম্যানেজার কিন্তু খোঁড়া রুমেনিগেকেই মাঠে রাখলেন এবং ইতালি ৪৪ বছর অপেক্ষার পর তৃতীয়বার ৩—১ গোলে বিশ্বকাপ জিতে নিল। ইতালির ৭০ বছর বয়সী প্রেসিডেণ্ট সান্দ্রো পার্তিনি ছেলেমানুষের মত লাফালেন যখন রোসি, তারদেল্লি এবং আলতোবেলি জার্মান রক্ষণ ভেঙে খেলার শেষদিকে তিনটি গোল করলেন। একটি গোল শোধ দিয়েছিলেন জার্মানরা। তৃতীয় স্থান পায় পোল্যাণ্ড ৩—২ গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে। ৫২টি ম্যাচে মোট গোল হয়েছিল ১৪৬। সর্বোচ্চচ ব্যক্তিগত গোলদাতা হন রোসি—৬টি গোল। সর্বাধিক গোল দেয় ফ্রান্স—২০টি।
১৯৮৬ মেক্সিকো
১৬ বছর পর মেক্সিকোয় দ্বিতীয়বার অনুষ্ঠিত হল চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা। যোগ্যতা বাছাই পর্বে ১১১টি দেশ খেলেছিল। ৩০৮ ম্যাচে ৮৩৫ গোল হয়। অপরাজিত থেকে চূড়ান্ত পর্বে আসে ব্রাজিল, ইংল্যাণ্ড এবং নবাগত কানাডা ও আলজেরিয়া। পশ্চিম জার্মানি সহজে পৌঁছলেও একটা রেকর্ড হারিয়েছে। কোনও বিশ্বকাপেই তারা বাছাই পর্বে কোন ম্যাচ হারেনি, এবার পর্তুগালের কাছে ১—২ গোলে একটি হেরেছে। তারা ১৯৩০ ও ১৯৫০ বিশ্বকাপে খেলেনি, এছাড়া বাকি এগারোটিতেই চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে, ইতালিও এগারোবার উঠল আর ব্রাজিল তো তেরোটি বিশ্বকাপেই চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। এবারের বিশ্বকাপে মেক্সিকোয় আসায় ব্যর্থ হয় দু’বারের রানার্স হল্যাণ্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়া, একবারের রানার্স সুইডেন। প্রথমবার চূড়ান্ত পর্বে খেলছে কানাডা, ডেনমার্ক ও ইরাক।
দীর্ঘপথ পেরিয়ে ইরাক এল মেক্সিকোয়। ইরান ও ইরাকে তখন যুদ্ধ চলায় ফিফা নির্দেশ দেয় ওই দুই দেশের জমিতে বাছাই পর্বের খেলা না হয়ে নিরপেক্ষ দেশে হবে। ইরান তা মানতে রাজি না হওয়ায় খারিজ হয়ে যায়। ইরাক তার ঘরের ম্যাচগুলি খেলে জর্ডানের সঙ্গে কুয়েতে, কাতারের সঙ্গে কলকাতায়, সিরিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবে। দশটি ম্যাচে ২৬ গোল দিয়ে তারা যে রেকর্ড করেছিল সেটা নষ্ট হয় লেবানন নাম প্রত্যাহার করায়। এর ফলে দুটি ম্যাচ ও ১২টি গোল বাদ যায় আর সর্বাধিক গোল দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে ওঠার নতুন রেকর্ড স্থাপনের সুযোগ পেয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। তারা ২২ গোল দিয়েছে।
এবারের বিশ্বকাপে নকআউট পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হল। ২৪টি দল প্রথমে ছয়টি গ্রুপে লীগ খেলবে। প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দুটি দল অর্থাৎ ১২টি দল আর তৃতীয় স্থানাধিকারী দলগুলির থেকে সেরা চারটি দল নিয়ে মোট ১৬ দলের মধ্যে দ্বিতীয় রাউণ্ডের নকআউট খেলা হবে।
প্রথম রাউণ্ড গ্রুপ লীগে ২৪টি দল মন্থর বিরক্তিকর ফুটবল খেলল শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ডেনমার্ক তাদের একটি ম্যাচে জোর দেয়। রুশীরা ৬—০ হাঙ্গেরিকে আর ডেনরা ৬—১ উরুগুয়েকে হারায়। নয়তো ১১টি ম্যাচ ড্র হয়, ৮টি ম্যাচে ফল হয় ১—০। ৩৬ ম্যাচে হল ৮৪ গোল। কোরীয়দের সঙ্গে প্রথম খেলায় মারাদোনার উপর অবৈধ বলপ্রয়োগ ঘটলেও তিনি মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। ৩—১ গোলে আর্জেন্তিনা জেতে। ব্রাজিল ১—০ স্পেনকে হারায় সক্রাটেসের গোলে। জিকোর চোট থাকায় তাকে খেলান হয়নি। চোট থাকায় রুমেনিগে মাত্র শেষ দশ মিনিট মাঠে নামেন উরুগুয়ের সঙ্গে ১—১ খেলায়। আলজেরিয়ার গোলকীপার দ্রিদের অসাধারণ খেলা ব্রাজিলকে কারেকার একমাত্র গোলটি ছাড়া আর সাফল্য দেয়নি। জিকোকে এই ম্যাচেও খেলান হয়নি। তৈমুমি এবং বুদারবালার মত বিশ্বমানের দু’জন খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করে মরক্কো পর্তুগালকে ৩—১ হারিয়ে অপরাজিত থেকে গ্রুপ শীর্ষে রইল। তাদের নীচে ইংল্যাণ্ড, পোল্যাণ্ড ও পর্তুগাল। দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য শুধু বালগেরিয়ার সঙ্গে ১—১। জিকো অবশেষে ব্রাজিলের তৃতীয় ম্যাচে উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে শেষ কয়েক মিনিট খেললেন এবং দেখালেন তিনি তাঁর দক্ষতার কিছুই হারাননি। আইরিশ গোলকীপার প্যাট জেনিংসের এই দিনই ছিল ৪১—তম জন্মদিন। বিশ্বকাপে তাঁর শেষ খেলায় তিনটি গোল খেয়ে অপ্রতিভ হলেও বিশ্বের সবথেকে বেশি, ১১৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ফুটবলারের মর্যাদাও সংগ্রহ করলেন। প্রিবেন এলকেয়ার ও মিখায়েল লুডরাপের খেলা দেখে অনেকেই ডেনমার্ককে সম্ভাব্য বিজয়ী রূপে ভাবতে শুরু করলেন। ইংল্যাণ্ডের গ্যারি লিনেকার হ্যাটট্রিক করলেন পোল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে খেলার ৩৬ মিনিটের মধ্যেই। ডেনমার্ক ২—০ পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে তাদের নিয়ে রূপকথা রচনার উপাদান আর একটু সরবরাহ করল।