”ঘুষ দিয়ে? না না মশাই, কাল আপনি ভাল করে খেলুন। দারুণ খেলুন। আচ্ছা করে জব্দ করে দিন।”
কমল দেখল, বিপুল ঘোষের সারা মুখ আন্তরিকতায় কোমল ও উজ্জ্বল।
”কাল অফিসে আসছেন তো?” দূর থেকে রণেন দাস প্রশ্ন করল।
”কেন?” কমল সচকিত হয়ে বলল।
”সেটা আপনি ভালই জানেন। তবে বলে রাখছি পাঁচটার আগে আপনাকে আমি ছাড়তে পারব না।”
”জানি আমি। তবে কাল আমি ক্যাজুয়াল নিচ্ছি।”
.
অফিস ছুটির পর শোভাবাজার টেন্টে আসা মাত্র কৃষ্ণ মাইতি হাত ধরে বলল, ”গুলোকে শিক্ষা দিতে হবে কমল। ব্যাটা টাকা মেরেছে কাজ হাসিল করে নিয়ে। পয়েন্ট চাই—ই চাই। তুই কিন্তু প্রধান ভরসা। ক্লাবের সবাই তোকে খেলানোর এগেনস্টে, আমি জোর করে বলেছি, কমলকে খেলাতেই হবে।”
নার্ভাস বোধ করল কমল। বিব্রত স্বরে বলল, ”কিন্তু কেষ্টদা, একা আমার ওপর এতটা ভরসা করবেন না, করা উচিত নয়। ফুটবল একজনের খেলা নয়।”
”তুই একাই এগারোজন হয়ে খেলতে পারিস, যদি মনে করিস খেলব। তা ছাড়া—মনে আছে সেই চাকরির কথাটা, পল্টু মুখুজ্যের মেয়ের চাকরি। যদি কাল একটা পয়েন্ট আনতে পারিস, গ্যারান্টি দিচ্ছি চাকরিটা হবে।”
কমল তর্ক করে কথা বাড়াল না। হঠাৎ সে ক্লান্ত বোধ করতে শুরু করল। অনেক কিছু নির্ভর করছে কালকের খেলার উপর। এখন যার সঙ্গেই দেখা হবে, সে মনের উপর একটা দায়িত্বের পাথর চাপিয়ে দেবে। কমল চেয়ার নিয়ে টেন্টের বাইরে বেড়ার ধার ঘেঁষে বসল।
ভরত এসে বলল, ”কমলদা, একটা কথা বলার ছিল। খুবই জরুরি, কিন্তু এখানে বলব না। আপনি বাইরে আসুন, মিনিট পাঁচেক পর আমি টাউন ক্লাব টেন্টের সামনে থাকব।”
এই বলেই ভরত হনহন করে বেরিয়ে গেল। অবাক হয়ে কমল চারপাশে তাকাল। ক্যান্টিনের কাছে সত্য আর দেবীদাস হাসাহাসি করছে। স্বপন একটু আলাদা দাঁড়িয়ে ঘুগনি খাচ্ছে। টেন্টের মধ্যে যথারীতি টেবিল ঘিরে গুলতানি। ভরতের কী এমন কথা থাকতে পারে যা একান্তে বলা দরকার!
কমল টাউন টেন্টের কাছে পৌঁছতেই অপেক্ষমান ভরত বলল, ”কমলদা, আমাদের দুজন কাল গট আপ হয়েছে।”
শোনামাত্র কমল জমে গেল। ”গট আপ! কারা?”
”আজ সকালে যাত্রীর লোক এসেছিল আমার বাড়িতে। সঙ্গে ছিল শম্ভু। টেরিলিন স্যুট করে দেবে যাত্রী। শম্ভু আর সত্য গোলাম আলিতে মাপ দিয়ে এসেছে।”
”তুই গেলি না?”
ভরত শুধু হাসল। কমলও হাসল। তারপর ভরতের পিঠ চাপড়ে বলল, ”এখন কাউকে বলিসনি এসব কথা। আগে খেলাটা হোক।”
”সলিলের কিছু খবর জানেন, আসে না কেন? ও থাকলে খানিকটা সামলানো যেত।”
”সলিল একটা কাজ পেয়েছে, খেলার জন্য আর সময় পায় না। হয়তো আর কোনও দিনই পাবে না। কিন্তু ভরত, বাটার সঙ্গে খেলার মতো অবস্থা কাল যেন হবে মনে হচ্ছে।”
”কী জানি!” অনিশ্চিত স্বরে ভরত বলল, ”আমাদের আর একটা ছেলেও নেই যাকে নামানো যায়। নইলে কেষ্টদাকে বলে সত্য আর শম্ভুকে বসিয়ে দেওয়া যেত।”
ম্লান হেসে কমল বলল, ”তা হলে কাল ভাগ্যের উপরই ভরসা করতে হবে।”
”হ্যাঁ, ভাগ্যের উপরেই।”
.
।।তেরো।।
যুগের যাত্রী ৫-০ গোলে শোভাবাজারকে হারাল।
অন্ধকার ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে কমল শুয়ে। অ্যালার্ম ঘড়ির টিকটিক শব্দ একটানা তার মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘা মেরে চলেছে। কমল হাত দিয়ে দু’কান চেপে অস্ফুটে কাতরাল। এখনও কানে বাজছে ভয়ঙ্কর চিৎকারগুলো। ঘড়িটা আছড়ে ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু পাঁচটা গোলের চিৎকার।
গ্যালারির মাঝখানের সরু পথ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় উপর থেকে তার মাথায় থুথু পড়ে, ইটের টুকরো লাগে পিঠে। একটা চিৎকারও শুনেছিল, ”কী রে কমল, অনুপমকে আটকাতে পারিস বলেছিলি না!”
আজ অনুপম তিনটি গোল দিয়েছে। তবে হ্যাটট্রিক হয়নি। কমল বিছানায় বার কয়েক কপাল ঠুকল। অজান্তে একটা গোঙানি মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
”কী গো কমল, যাত্রীর জার্সিকে ভয়ে কাঁপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা এবার ছাড়ো।”
গুলোদার হাসিখুশি মুখ আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো যেন বিছানার মধ্যে থেকে উঠে আসছে। বিছানাটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করা যায়, কিন্তু কথাগুলোকে।
”আমি কী করব, যিনি টিম করেছেন তাঁকে গিয়ে বলুন। বুড়ো প্লেয়ার দিয়ে যদি ফুটবল খেলাতে চান তা হলে খেলান। বলিহারি শখ! নিজেরও তো একটা আক্কেল—বিবেচনা থাকে।” সরোজ খেলা শেষে মাঠের উপর দাঁড়িয়ে একজনকে যখন কথাগুলো বলছিল, কমল মুহূর্তের জন্য দেখেছিল চাপা তৃপ্তির আমেজ তার চোখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।
খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই ভরত ছুটে গিয়ে মাঠের মধ্যেই শম্ভুকে চড় কষায়। শম্ভু লাথি মারে ভরতকে। দু’জনকে যখন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন চিৎকার করে শম্ভু বলে, ”গোল কি আমার দোষে হয়েছে? ওই লোকটা, ওই লোকটার জন্য।”
শম্ভুর আঙুল একটা ছোরার মতো উঠে কমলকে শিকার করে। কোনও দিকে না তাকিয়ে কমল মাঠ থেকে বেরিয়ে আসে।
”এত ভরসা করেছিলুম তোর ওপর। আমায় একেবারে ডুবিয়ে দিলি।” কেষ্টদার হতাশ এবং বিরক্ত কণ্ঠস্বরে কমলের চকিতে মনে পড়েছিল, অরুণার চাকরিটা বোধ হয় হল না!
মুখ দেখাবার উপায় কোথাও আর রইল না। বাটার সঙ্গে খেলাটাই আবার অনুষ্ঠিত হল। তবে যাত্রী আরও দক্ষ, আরও কঠিন এবং উদ্দেশ্যপরায়ণ। কমল চোখ বুজে এখনও দেখতে পাচ্ছে, অনুপম আর প্রসূন তার দু’পাশ দিয়ে ঢুকছে আর ফাঁকা মাঝ মাঠ দিয়ে বল নিয়ে উঠে আসছে যাত্রীর রাইট ব্যাক। স্বপন আর রুদ্র কোন দিকে কাকে আটকাবে ভেবে পাচ্ছে না। কমল স্থির করেছিল আজ সে অনুপমকে রুখবে। কিন্তু অনুপমের পাশাপাশি প্রসূন সব সময় ছিল তাকে ধাঁধায় ফেলার জন্য। যেখানেই বল প্রসূন সেখানে তার দলের খেলোয়াড়ের পাশে গিয়ে হাজির হয়েছে। শোভাবাজারের একজনের সামনে যাত্রীর দু’জন ফরোয়ার্ড সব সময়ই। লোক পাহারা দেবে না জমি আগলাবে কমল এই সমস্যা সমাধান করতে পারেনি লোকের অভাবে। এবং কেন এই অভাব ঘটল এক মাত্র সে আর ভরত তা জানে।