সুশি বলল, ”আমি এইমাত্র ওকে পাউরুটি দিয়ে এলুম। ভূতেরা কি পাউরুটি খায়? ভূতেরা তো রামনাম শুনলে পালিয়ে যায়, জ্যাঠামশাই আপনি শুনবেন চলুন নিজেই রামনাম করবে।”
অকাট্য যুক্তি সুশির। ভূদেবের থতমত অপ্রতিভ মুখ দেখে সবাই উৎসাহ ফিরে পেল। ”চলুন, চলুন” বলে ওরা প্রায় টানতে টানতে ভূদেব খেটোকে শিবমন্দিরের কাছে নিয়ে এল।
সুশি গর্তের কাছে বসে বলল, ”সরা, এখন তোমায় প্রমাণ করতে হবে তুমি ভূত নও। তা হলে তোমাকে তোলার ব্যবস্থা হবে। আর ওঠার পর কাল তোমাকে ম্যাচ খেলে বি এস সি—কে জেতাতেই হবে। নয়তো বোলতার জনগণ মানে ভূদেবজ্যাঠা তোমাকে রক্ষার চেষ্টা করবেন না শ্যামাপুকুরের হাত থেকে। বুঝেছ ব্যাপারটা?”
”বুঝেছি। কিন্তু কী করে প্রমাণ করব আমি ভূত নই!”
”খুব সোজা কাজ। তুমি খুব চেঁচিয়ে রামধুন গাও যাতে ভূদেবজ্যাঠার কানে পৌঁছয়। উনি এখানে কাছাকাছি রয়েছেন। ভাল কথা, তুমি রামধুন জানো তো?”
”রঘুপতি রাঘব রাজারাম তো? প্রথম লাইনটা শুধু জানি।”
”ফাইন, ওতেই দু’বার রাম শব্দটা আছে। ও কে। এবার গাও।”
গর্তের মধ্য থেকে ভেসে উঠল সরার তারস্বরে চিৎকার, ”রঘুপতি রাঘব রাজারাম, পতিত পাবন সীতারাম।”
সুশি দেখল, ভূদেবের মুখে ভয়, বিস্ময়, আনন্দ সবিকছু মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে উঠছে। তাই দেখে সুশি বলল, ”সরা থামলে কেন। রিপিট করে যাও। কাজ হয়েছে। এই রামনামই তোমাকে পাতালঘর থেকে উদ্ধার করবে।”
সরা এর পর না থেমে প্রথম লাইনটা বারবার গাইতে লাগল। ব্যাংকাকা বললেন ভূদেবকে, ”দাদা এবার কি বিশ্বাস হচ্ছে পাতালঘরে ভূত নেই। গড়ের মাঠেও ভূত নেই।”
”ব্যাং, তা হলে এতকাল যা বিশ্বাস করে এসেছে বাপ—ঠাকুর্দারা, বোলতার জনগণ—সব মিথ্যে!”
ঘন্টু বলল, ”ভাগ্যিস, সরা পালাতে গিয়ে গর্ত দিয়ে পাতালঘরে পড়ে গেছল!”
খোকন বলল, ”যদি না ওই ভটভটির লোকগুলো তাড়া করত তা হলে সরা কি শিবমন্দিরের দিকে ছুটত?”
তরুণ বলল, ”ছুটলই বা, যদি না বাজ পড়ে দরজাটা ভেঙে যেত তা হলে কি এই গর্তটা তৈরি হত?”
কলাবতী বলল, ”এত ঘটনা যে ঘটল, নিশ্চয় এর পেছনে শিবঠাকুরের কোনও ইচ্ছা আছে। ব্যাংকাকা এই শিবের নাম কী?”
ব্যাংকাকা আমতা—আমতা করে বললেন, ”অফিশিয়াল কোনও নাম আছে কিনা জানি না, তবে এখানকার লোকে বলে গড়ের শিব।”
”গড়ের শিবের ইচ্ছেটা আমার মনে হচ্ছে,” কলাবতী থেমে গিয়ে পাঁচ সেকেন্ড পরে বলল, ”উনি কলেজে পড়তে চান। ভূদেবজ্যাঠা আপনার কী মনে হয়?”
ভূদেব খেটোর মুখে তখন চাপ থেকে রেহাই পাওয়ার প্রশান্তি। তিনি ছেলেমানুষের মতো উৎসাহে ছটফট করে উঠে বললেন, ”কলেজ পরে হবে, আগে চাই বংশীবদন। সুশি, ছেলেটা যে এখনও রঘুপতি করে চলেছে, ওকে থামতে বল। এবার ওকে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে, ব্যাং, একটা মই জোগাড় করো।”
সুশি গর্তের দিকে মুখ করে বলল, ”এই, এই এবার থামো। কাজ হয়েছে, এবার তোমাকে তোলার জন্য মই আসছে। জল তখনই বরং খেয়ো। মনে রেখো, বংশীবদনকে ফাইনালে তুলে দিতে না পারলে জনগণ তোমাকে আবার পাতালঘরে নামিয়ে দেবে।”
”আমি এখন কন্ডিশনে নেই, খেলব কী করে?”
বিরক্ত হয়ে সুশি বলল, ”কন্ডিশন ফন্ডিশন বোলতায় চলবে না। ওসব বোলচাল কলকাতায় মেরো।”
ব্যাংকাকা মই আনতে ছুটলেন। একটু পরেই জনার্দন একটা বাঁশের মই ঘাড়ে করে আনল। মইটা গর্তে নামানো হল। উঠে এল স্বরাজ দাস। চারদিকে ভীত চোখে তাকিয়ে সে প্রথমেই বলল, ”ওরা ধারেকাছে নেই তো?”
ভূদেব মুঠি শক্ত করে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, ”আরে, ভূতটুত এ—তল্লাটে কোনওকালে ছিল না, এখনও নেই। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? এই তো আমরা এখানে রয়েছি।”
”আজ্ঞে ভূত নয়, শ্যামপুকুর ক্লাবের ওরা। এই দেখুন আমার হাঁটু কাঁপছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।” বলতে বলতে সরা উবু হয়ে বসে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ওরা তাড়াতাড়ি তাকে তুলে বসাল, তারপর চ্যাংদোলা করে বাড়িতে এনে একতলার বৈঠকখানা ঘরের চৌকিতে শোওয়াল। ব্যাংকাকা সবাইকে সাবধান করে বললেন, ”খবরদার, সরার কথা এখন বোলতার কাকপক্ষী কেন, মশামাছিরাও যেন জানতে না পারে। বিদ্যুৎপুরের কানে গেলেই ওরা কলকাতা থেকে এগারোটা প্লেয়ার এনে টিম করে ফেলবে।”
ঘন্টু তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”জ্যাঠামশাই, সরা কত লাখ টাকার প্লেয়ার, জানেন? কলকাতার এগারোটা কেন, বাইশটা প্লেয়ার এলেও ওকে আটকাতে পারবে না।”
কাতরস্বরে সরা বলল, ”কিন্তু ওই মোটরবাইক দুটো এলে আমি কী করব!”
জনার্দন একটা জাগে জল আনল। সরা প্রায় এক নিশ্বাসে জাগটা শেষ করে বলল, ”আমার বাবাকে ডেকে আনবেন?”
”না, না, না।” ভূদেব আঁতকে উঠলেন, ”বাবা—টাবা এখন নয়। শুনলে না, মশামাছির কানে পর্যন্ত তোমার কথা যেন না পৌঁছয়। তুমি এখন এই বাড়িতে থাকবে। কোনও ভয় নেই এখানে। ব্যাং সদর দরজা বন্ধ করে হুড়কোটা দিয়া দাও।”
”আচ্ছা জ্যাঠামশাই,” কলাবতীর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেছে। ”সরা যদি চেহারায় একটু ভোল পালটায় তা হলে তো ওকে চিনতে পারবে না শ্যামপুকুরের লোকগুলো।”
”তার মানে?” ধড়মড় করে চৌকিতে উঠে বসল সরা।
কলাবতী ওকে সাহস দেওয়ার জন্য বলল, ”ধরো খেলা শুরুর দশ সেকেন্ড আগে তোমাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হল ক্লাবঘর থেকে ঢেকেঢুকে আড়াল করে নিয়ে গিয়ে। মাঠে তুমি সবসময় মধ্যিখানে থেকে খেলার চেষ্টা করবে, মাঠের সাইডের দিকে একদম আসবে না। দূর থেকে তোমার হাঁটুকে দানাপানি খাওয়াতে গেলে ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান শু্যটার আনতে হবে। আমাদের দেশে তেমন চ্যাম্পিয়ান কেউ নেই। সুতরাং—”