”আইন বলতে এখানে ক্রিকেটের আইন।” সত্যশেখর ফিল্মি ব্যারিস্টারদের মতো কাল্পনিক একটা চশমা চোখ থেকে খুলে ফেলার ভঙ্গি করল। ”ইয়েস, ক্রিকেটের আইন আমি দেখেছি। কোথাও লেখা নেই যে, মেয়েরা খেলতে পারবে না পুরুষদের টিমে।”
”বাট, এটা তো ক্রিকেটের একটা সাধারণ আইন। কিন্তু প্রত্যেক টুর্নামেন্টেরই কিছু নিজস্ব আইন তো থাকে।” রাজশেখর প্রায় চিফ জাস্টিদের মেজাজে কথাটা বললেন। প্রসঙ্গত, গত কুড়ি বছরে তিনজন চিফ জাস্টিসের সঙ্গে তাঁর তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল।
”হ্যাঁ থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কি কোনো লিখিত আইন আছে এই ম্যাচ সম্পর্কে?”
রাজশেখর কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন।
”না, আই অ্যাম শ্যূওর, কোনো লিখিত আইন নেই। শুধু কনভেনশনের উপর খেলা চলে আসছে। আর কনভেনশন তো যে—কোনো সময় ভাঙা যায়।”
”কিন্তু তার একটা কারণ থাকা দরকার। ইচ্ছেমতো যখন খুশি তো প্রথা ভাঙা যায় না। কালু ইচ্ছে করলেই স্পোর্টিং ইউনিয়ন বা কালীঘাটের হয়ে কি লিগ ক্রিকেট খেলতে পারবে? যদিও ওর যোগ্যতা আছে।”
কলাবতী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠতে পারল না যেহেতু তার গায়ের রঙ কালো। শুধু হাত তুলে বলল, ”আচ্ছা আচ্ছা, খুব হয়েছে। ভারী তো খেলি।”
”তোমার কথাটা ঠিকই, যখন খুশি প্রথা ভাঙা যায় না, কিন্তু আমি, তুমি আর কালু তিনপুরুষ একটা ম্যাচে খেলবে এটা কি একটা স্পেশাল অকেশন নয়? এটা তো একটা গৌরবের ব্যাপার এক্ষেত্রে কি…”
মুরারি এবং তার পিছনে আরও দুজন, বলরাম আর অপুর মা, প্রত্যেকের হাতে নানান আকারের নানান গড়নের চিনেমাটির স্টিলের, কাচের ও কাঁসার পাত্র দু’হাতে ধরা। একটার উপর আর একটা—কুতব মিনার, শহিদ মিনার, একটা তো পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো।
টেবলের অর্ধেকটাই ভরে গেল। ঝুঁকে রাজশেখর প্রত্যেকটা থেকে ঢাকনা তুলে নিতে নিতে জোরে নিশ্বাস টেনে, ”আহহহ” বলে মাথা নাড়তে লাগলেন। কখনও বললেন, ”ডিলিশাস”, কখনও ”আহ, মার্ভেলাস।”
সত্যশেখর করুণ চোখে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কলাবতীর চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। বেরিয়ে যাবার সময় মুরারি দুঃখভরা, বিষণ্ণ চোখ সবার মুখের উপর বোলাল।
”দাদু, এসব কী, অ্যাঁ, অ্যাত্তো…কই বলোনি তো আগে!”
”আগে বললে কি এমন মিষ্টি—অবাকটা পেতিস? আগে ভাজা দিয়ে শুরু, তুলে নে যত খুশি। মানিকতলা বাজারে টাটকা তপসেটা পেলাম, ইলিশটা শোভাবাজারের। কই, সতু, তোল তোল।”
সত্যশেখরের মুখটা দ্রুত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো হয়ে গেল। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ”নাহ, এসব খাবার দেখলেই এখন গা গুলিয়ে ওঠে। মুখরোচক নিশ্চয়ই, কিন্তু পেটের পক্ষে একদমই ভালো নয়।”
শুনতে শুনতে রাজশেখর খুশিতে বারদুয়েক মাথা ঝাঁকালেন।
”কাকা, কী বলছ তুমি! এই তো কদিন আগে…” কলাবতী থেমে গেল সত্যশেখরের কটমট চাহনি দেখে। তারপর বলল, ”না খাও না খাবে, আমি কিন্তু খাব।”
সত্যশেখর প্রচণ্ড অনিচ্ছায় বেগুনির মতো দেখতে ফিশ ওর্লির আধখানা আর ইলিশের পেটি থেকে একচিমটে ভেঙে নিল। তপসে ছুঁলই না। আলুর দমের একটা আলু মুখে দিয়েই ”ওরে বাবা কী ঝাল” বলে ফেলে দিল। আর রেজালার মাংসে লাগা ঝোল রুটি দিয়ে চেঁছে ফেলে তবেই মুখে ঠেকাল।
”এত তেল—মশলা—ঘি, পেটের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।” সত্যশেখর তার বাবার সামনে থেকে রেজালার পাত্রটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ”বাবা এসব তুমি খেও না, বরং তন্দুরি চিকেনটা নাও, ওতে ঘি—মশলা নেই।”
রাজশেখর বিস্ময় চাপতে চাপতে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। কলাবতী রেজালা শেষ করে আঙুলগুলো চাটতে চাটতে মটন চাপের প্লেটটার দিকে তাকিয়ে বলল, ”দাদু তুমি যে রয়্যালের গল্প করতে, সেখান থেকেই কি এনেছ?”
”নিশ্চয়, এখনও সেই টেস্ট, সেই ফ্লেভার।”
”কাকা যদি না খায়…খাবে তুমি?”
সত্যশেখর সভয়ে সঘৃণায় মাথা নাড়ল।
”তাহলে আমাকে সবটা দাও।”
রাজশেখর ভ্রূ তুলে গম্ভীরভাবে কলাবতীর দিকে পুরো প্লেটটাই এগিয়ে দিলেন। সত্যশেখরের করুণ চোখ যেন বলে উঠল: কালু করছিস কী? এই চাপ যে পরে চাপচাপ কচু, ওল, উচ্ছে, ঢ্যাঁড়স, কাঁচাপেঁপে হয়ে টেবলে ফিরে আসবে।
কলাবতীও অবাক হয়ে যাচ্ছে খাওয়ার প্রতি কাকার অরুচি দেখে। যে—সব জিনিস টেবলে সাজানো রয়েছে, কাকার তো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। প্রত্যেকটাই ওর প্রিয় খাদ্য, অথচ কেমন মনমরা হয়ে রয়েছে। দু আঙুলে চিমটি দিয়ে তুলে কোনোরকমে জিভে ঠেকিয়েই ফেলে দিচ্ছে, যেন নিম বা উচ্ছে। দিন পাঁচেক আগে কোর্ট থেকে ফেরার সময় নিজামের আঠারোটা শিককাবাব আর দশটা পরোটা এনে মুরারিকে দিয়ে গরম করিয়ে গ্যারাজে মোটরের মধ্যে বসে কাকা একাই বারোটা শিক আর সাতটা পরোটা শেষ করার পর চেম্বারে গিয়ে বসে। বাকিগুলো ছিল তার আর মুরারির জন্য। অথচ পাঁচদিনের মধ্যেই কী পরিবর্তন। হয়তো আজ জজের কাছে ধমক খেয়েছে, মন খারাপ, কিংবা ফেরার পথে গাঙ্গুরাম বা গোল্ডেন ড্র্যাগন কী ওয়ালডর্ফে ঘুরে এসেছে।
সত্যশেখর একটার পর একটা প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিল, আর কলাবতী সেগুলো টেনে নিল। দই আর কড়াপাক যখন এল, কলাবতীর তখন আইঢাই অবস্থা।
”কতদিন পর এমন দারুণ দারুণ জিনিস…উফ।”
কলাবতী হাঁফাচ্ছে। কপাল থেকে দরদর ঘাম চিবুকে নেমে এসেছে। সিলিং পাখার দিকে তাকিয়ে হাওয়াটা মুখে লাগাতে লাগাতে বলল, ”দাদু, তোমার ডায়েট চার্ট ফলো করতে করতে কাকার খিদে মরে গেছে, আর আমার খিদে বেড়ে গেছে।”