বন্ধুবিহারী ধাড়া উঠে দাঁড়ালেন। যাকগে মরুকগে! বিহিত করে হবেটা কী? এতদিন স্বচক্ষে ভূত দেখেননি। এবার দেখলেন। ব্যস, এবার থেকে আর বানিয়ে লিখবেন না। নাও, চলো–তোমার ডেরায় যাওয়া যাক। বাপস ডেরা খুঁজে পাওয়া কী যে প্রবলেম হয়েছে আজকাল। কো-অপরেটিভ হাউসিং করলে মন্দ হয় না বরং।
কথা বলতে-বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলেন। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম মিনিট দুই। তারপর টনক নড়ল। ঝটপট দরজা বন্ধ করে হন্তদন্ত হয়ে পাশের ঘরে গেলুম। ফের থানায় রিং করলুম। তেমনি দেরি করে সাড়া এল। বললুম,–আমি লেখক নকুড়চন্দ্র গুই বলছি। একটু আগে একটা লোকের কথা বলছিলুম
–লোকটা চলে গেছে তো?
–হ্যাঁ। কিন্তু একটা খবর জানতে চাইছি। লালবাজারে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর বন্ধুবিহারী–
–কাগজে খবর পড়েননি? ডাকাতাদের সঙ্গে সংঘর্ষে গতরাত্রে উনি মারা গেছেন।
এ পর্যন্ত শুনেই ফোন নামিয়ে রাখলুম। তারপর নাক এবং কান দুটো মলে প্রতিজ্ঞা করলুম, আর কখনও ভূতের গল্প লিখব না লিখব না–লিখব না…
সেই সব ভূত
আমাদের গাঁয়ে একসময় প্রচুর ভূত ছিল। শুধু রাতবিরেতে নয়, দিনদুপুরেও মাতারা একলা-দোকলা মানুষকে বাগে পেলে ভয় দেখিয়ে দুষ্টুমি করত। দুষ্টুমিই বলা উচিত। কারণ কখনও তারা কারুর ঘাড় মটকেছে বা ঠ্যাং ভেঙেছে বলে শুনিনি। তবে ভয়ের চোটে কেউ ভিরমি খেয়ে মারা পড়লে কিংবা দৌড়ে পালাতে গিয়ে কারুর ঠ্যাং ভাঙলে সেজন্য তো আর ভূতকে দায়ী করা চলে না। যার যা কাজ! ভূতের কাজটাই হল মানুষকে ভয় দেখানো। যে ভূত ভয় দেখায় না, সে আবার কীসের ভূত?
কথাটা বলতেন আমার বড়মামা।
বড়মামা রেলে চাকরি করতেন। ছুটিছাটায় আমাদের বাড়ি আসতেন। সাংঘাতিক সব ভূতের গল্প বলে আমাদের রক্ত জল করে ফেলতেন। গল্প শোনার পর আমরা যারা ছোট তাদের অবস্থা তখন শোচনীয়! কিন্তু তারপরই বড়মামা হো-হো করে হেসে বলতেন, ওরে। ভূতকে কখনও ভয় পাবি না। কারণ কী জানিস? মানুষ যেমন ভূতকে ভয় পায়, ভূতও মানুষকে খুব ভয় পায়। ভূত যদি ভয় দেখায়, তোরাও তাকে ভয় দেখাবি। দেখবি, ব্যাটাচ্ছেলে তক্ষুনি কেটে পড়েছে।
সেকথা শুনেও যে খুব একটা সাহস পেতাম, তা নয়। আমার তো খালি ভাবনা হতো, ভূত বড়দের ভয় পেতেও পারে, কিন্তু আমাদের মতো ছোটদের কি আর ভয় পাবে?
আমাদের বাড়ির পিছন দিকটায় ছিল একটা বাগান! তার ওধারে একটা ঝিল। ঝিলের ওধারে ছিল ঘন জঙ্গল। ঠাকুমা বলতেন, ঝিলের জঙ্গলে থাকে এক কন্ধকাটা। আর ঝিলের ধারে থাকে এক শাঁকচুন্নি। শাঁকচুন্নিটা রোজ রাত্তিরে আলো জ্বেলে ঝিলের ধারে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। কন্ধকাটা আলো সইতে পারে না। তাই সে এসে শাঁকচুন্নির সঙ্গে খুব ঝগড়া বাধায়। ঝগড়ার চোটে সারারাত্তির ঘুমোতে পারিনে।
ঠাকুমা থাকতেন বাড়ির পিছনের ঘরে। কখনও কখনও রূপকথা শোনার লোভে আমি ঠাকুমার কাছে শুতে যেতাম। রূপকথা বলতে বলতে ঠাকুমা হঠাৎ থেমে গেলে বলতাম, তারপর কী হল বলল না?
ঠাকুমা আস্তে বলতেন,–ওই আবার বেধেছে।
–কী বেধেছে?
–কন্ধকাটার সঙ্গে শাঁকচুন্নির ঝগড়া। শুনতে পাচ্ছিস না তুই?
–কই না তো!
জ্বালাতন!–বলে ঠাকুমা উঠে গিয়ে ওদিকের জানালাটা বন্ধ করে দিতেন। তারপর বলতেন,–এর একটা বিহিত করা দরকার। কালই মোনা-ওঝাকে ডেকে পাঠাতে হবে।
মোনা ছিল ভূতের ওঝা। ভূতগুলোর সঙ্গে নাকি বেজায় ভাব। তারা তাকে খুব সমীহ করে। একবার হল কী, সিঙ্গিমশাই রাত নটার বাসে শহর থেকে ফিরছেন। হাতে ছিল একভাড় রসমালাই। ঠাকরুনতলার বটগাছের কাছে যেই এসেছেন, অমনি গাছ থেকে ঝুপঝুপ করে কয়েকটা ছায়ামূর্তি লাফিয়ে পড়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। রসমালাইয়ের ওপর ভূতদের লোভ হতেই পারে। দেঁ-দেঁ করে তারা চেঁচাচ্ছিল।
এসব ক্ষেত্রে নিয়ম হল, দেব-দিচ্ছি করে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সিঙ্গিমশাই নিয়মটা ভুলে গিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালালেন। পালাতে গিয়ে পড়লেন একটা গর্তে। আর একটা ঠ্যাং-ও গেল ভেঙে। রসমালাইয়ের ভাড়টা হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল। ভূতেরা আহ্লাদ করে রসমালাই সাবাড় করল। সিঙ্গিমশাই যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সবই দেখলেন। কিন্তু কী আর করা যাবে?
তার কাতরানি রামুধোপা শুনতে পেয়েছিল। সে বেরিয়েছিল তার গাধাটাকে খুঁজতে। গাধাটার ছিল বিচ্ছিরি স্বভাব। প্রায় রাত্তিরেই দড়ি ছিঁড়ে খেলার মাঠে চলে যেত এবং পছন্দসই কোনও ভূতকে পিঠে চাপিয়ে ছুটোছুটি করত। আসলে রামুর গাধার সঙ্গে ভূতদের ছিল বেজায় গলাগলি, বন্ধুত্ব।
তো রামু সিঙ্গিমশাইকে কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। তারপর শহরের হাসপাতালে কয়েকমাস কাটিয়ে সিঙ্গিমশাই ফিরে এলেন বটে, কিন্তু একটি ঠ্যাং হাঁটুর ওপর থেকে বাদ। ক্রাচে ভর করে হাঁটতেন এবং নতুন নাম পেয়েছিলেন খোঁড়াসিঙ্গি।
খোঁড়াসিঙ্গি ভূতের ওপর খাপ্পা হয়ে মোনা-ওঝাকে তলব করেছিলেন। বলেছিলেন,–শুধু ঠাকরুনতলার নয়, গাঁয়ের সব ভূতকে গঙ্গার ওপারে তাড়িয়ে দিয়ে আয় তো মোনা। যা চাস, পাবি।
মোনা-ওঝা বলল,–তাড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে সিঙ্গিমশাই? কাউকে ভিটেছাড়া করা যে মহাপাপ। তা ছাড়া, ওদের সঙ্গে আমার কতকালের সম্পর্ক। যা বলি তাই শোনে। এ কাজ আমি পারব না সিঙ্গিমশাই।