বললুম, ধুস! ফুটবলম্যাচ পণ্ড হয়ে গেল।
ছোটমামা টেবিলে লণ্ঠন রেখে বললেন,-তাতে কী হয়েছে? যে আমার ঝাঁপুইতলা বনাম কঁকুড়হাটির খেলা! ও খেলা কি দেখার যোগ্য?
বলে উনি ফিক করে হসলেন। চাপাস্বরে ফের বললেন,–চল। বেরিয়ে পড়ি।
একটু অবাক হয়ে বললুম,–কোথায়?
ছোটমামা আরও চাপাস্বরে বললেন,–ফেরার সময় শর্টকাটে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ দিয়ে এলুম। বললে বিশ্বাস করবিনে পুঁটু, ঝড়বৃষ্টির চোটে বাগানের সব আম পড়ে গেছে। এই জষ্টিমাসের আম। বুঝলি তো? সবই গাছপাকা।
–অন্ধকারে কী করে দেখতে পেলেন ছোটমামা?
তুই একটা বোকর বোকা!–ছোটমামা একটু চটে গেলেন।–বিদ্যুতের ছটায় দেখলুম না? সারা বাগানের তলায় পাকা আম ছড়িয়ে আছে। চল। কুড়িয়ে আনি।
–কিন্তু ছোটমামা, বাগানে ভোলা আছে যে! ভোলা সাংঘাতিক লোক। ভোঁদা বলছিল, সিঙ্গিমশাই ভোলাকে নাকি তাঁর বন্দুকটা দিয়েছেন। দেখতে পেলেই
আমার কথায় বাধা দিয়ে ছোটমামা বললেন,–ভোঁদা তোর চেয়েও বোকা। সিঙ্গিমশাই বন্দুক দেবেন ভোলাকে ভোলা বন্দুক ছুঁড়তে জানে? তা ছাড়া বন্দুকটা বাড়িতে না থাকলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়িতে ডাকাত পড়বেই পড়বে, তুই জানিস? ওঠ। দেরি করা ঠিক নয়।
দোনামনা করে বললুম,–বন্দুক না পেলেও ভোলা খুব সাংঘাতিক লোক ছোটমামা! ওর গোঁফ আর চোখদুটো দেখলেই ভয় করে।
ছোটমামা আমার কথায় কান দিলেন না। কোত্থেকে একটা চটের থলে আর টর্চ নিয়ে এলেন। বললেন,-ভোলা এতক্ষণ খেতে গেছে। চলে আয়। আর শোন। জুতো খুলে ফ্যাল। খালি পায়ে যাব।
সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানটা গ্রামের শেষে মাঠের ধারে। বাগানের মধ্যিখানে একটা মাচার ওপর ছোট্ট ছাউনি আছে। ভোলা সেখানে বসে বাগান পাহারা দেয়। সে দারুণ ধূর্ত লোক। বাগানের আনাচে-কানাচে কেউ পা বাড়ালে কী করে সে টের পেয়ে যায় কে জানে! টের পেলেই এমন হক ছাড়ে যে পিলে চমকে যায়। গতমাসে কচি আম কুড়ানোর জন্য ভোঁদার সঙ্গে গিয়ে কী বিপদেই না পড়েছিলুম!
আমি তো দিশেহারা হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলুম। ওদিকে ভোঁদা ওর হাতে ধরা পড়ে সে এক কেলেঙ্কারি! ভোঁদাকে শাস্তিটা অবশ্যি দিয়েছিলেন ভোঁদার বাবা হাবুলবাবু! পাড়াসুদ্ধ লোকের সামনে কান ধরে ওঠবোস করানোর শাস্তি-ঘ্যা-ছা! ভেঁদা কিছুদিন বাড়ি থেকে লজ্জায় বেরুতে পারেনি। স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা।
সেই কথা ভেবে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু ছোটমামার অবাধ্য হওয়ার সাহসও আমার নেই। তাছাড়া ছোটমামা না থাকলে কে আমাকে শহরে কিংবা গঞ্জের মেলায় নিয়ে যাবে? পৃথিবীতে সবসময় কোথাওনা-কোথাও কত সুন্দর সব ঘটনা ঘটছে। ছোটমামা না নিয়ে গেলে আমি একা সেসব দেখতেই যে পাব না।
সন্ধ্যার অন্ধকার আজ বেজায় গাঢ়। আকাশের কোণায় দূরে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক। চারদিকে ব্যাঙ, পোকামাকড় তুলকালাম গান জুড়ে দিয়েছে। সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানের দিকে যত এগোচ্ছি, তত অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছে। ছোটমামা পায়ের কাছে সাবধানে টর্চের আলো ফেলে হাঁটছেন। তাঁর পেছনে থলে হাতে আমি হাঁটছি। কতক্ষণ পরে ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললেন, ভোলার কুঁড়েঘরটাতে লণ্ঠন জ্বলছে বটে, তবে বাজি রেখে বলতে পারি, ব্যাটাচ্ছেলে নেই।
–কী করে বুঝলেন ছোটমামা?
–দিঘির পাড়ে টর্চের আলো দেখলুম না? ভোলা ওখান দিয়েই তো খেতে যায়।
–ভোলার টর্চ আছে বুঝি?
–থাকবে না? তুই বড্ড বোকা পুঁটু! রাতবিরেতে টর্চ ছাড়া কেউ বাগানে পাহারা দিতে পারে? তবে আর কথা নয়। আয়, তোকে বাগানের শেষ দিকটাতে একখানে বসিয়ে রাখব আর আমি আম কুড়িয়ে আনব। চুপচাপ বসে থাকবি কিন্তু!
ছোটমামা কথাটা বলতে গিয়ে পারলুম না। ভোঁদা বলেছিল, ওই বাগানের কোন গাছে কবে কে নাকি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। আর ভূতটা এখনও আছে। তবে সে ভোলার ভয়ে বেরুতে পারে না। ভোলা বাগানে না থাকলে তবেই সে বেরিয়ে এসে লোকেদের ভয় দেখায়।
তো ছোটমামা ধমক দিলেন চাপাগলায়। চুপ! খালি ছোটমামা আর ছোটমামা! –বলে এবার আমাকে প্রায় টানতে-টানতে নিয়ে চললেন। জলকাদা জমে আছে ঘাসের ফাঁকে। পা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। প্রতিবারই ধমক খাচ্ছি। টর্চের আলোর দিকে চোখ রেখে হাঁটতে হচ্ছে।
ঠিক কথা। আসলে আমি সেই ভূতটার কথা ভেবে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিলুম। ভোলা যে এখন বাগানে নেই। কিছুক্ষণ পরে ছোটমামা আমাকে জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন,–তুই এইখানে বসে থাক। আমি গাছপাকা আম ছাড়া কুড়োব না। ওই দ্যাখ, কত পাকা আম।
টর্চের আলোয় হলদে কয়েকটা আম দেখতে পেয়েই আমি ভূতের ভয়টা ভুলে গেলুম। এইসব আম নাকি সেরা জাতের আম। একটুও আঁশ নেই। একেবারে ক্ষীরের সন্দেশের মতো নাকি স্বাদ।
থলে নিয়ে ভিজে ঘাসে বসে থাকা যায় না। তাই উঠে দাঁড়ালুম। ছোটমামা এদিক-ওদিক টর্চের আলা ফেলে পাকা আম কুড়িয়ে আনছেন। মিঠে গন্ধে আমার মুখে জল আসছে। কিন্তু এখন কি আম খাওয়ার সময়?
থলে প্রায় অর্ধেক ভরে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ছোটমামা বললেন,–এবার আমি যাচ্ছি বাতাসাভোগ গাছটার কাছে। খাসা আম! বুঝলি পুটু? তুই চুপচাপ বসে থাক। তবে কান খাড়া রাখবি কিন্তু! ভোলা বাগানে আসার সময় গান গাইতে গাইতে। আসে। শুনতে পেলেই তুই ডাকবি।