প্রেমের অর্থ কর্তব্য কাজের প্রতি অবহেলা? ইটালীয় মহাকবি দান্তের বয়স যখন নয়–তখন তিনি বালিকা বিয়াট্রিসকে ভালবাসেন।
এই ভালবাসা দান্তের সারা জীবনটা স্বর্গে-মর্তে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল। বিয়াট্রিসের রূপ, তার কথা, তার জীবনের অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলি পর্যন্ত দান্তের হৃদয়-মন পরিপূর্ণ করে ফেলেছিল। বিয়াট্রিসের জন্য তার এই প্রেম তাকে অমর করে রেখেছে। আর যতদিন না পৃথিবীর শেষ হয় ততদিন মানুষকে আনন্দ দান করবে।
আমরা কতকগুলি হৃদয়ের বিনিময়ের কথা জানি।
কবি পিতারার্ক কোনো এক গীর্জায় গভীর অনুরাগ জেগেছিল যে, তিনি সে জন্যে একেবারে অধীর হয়ে যান। লরাকে আর একটি বার দেখবার জন্য তিনি কতবার গীর্জা ঘরের দুয়ারে এসে ঘুরে বেড়াতেন। হৃদয়-বেদনা কমাবার জন্য তিনি দেশে দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। লরার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেই ভদ্রলোক অনেক সময় লরাকে এত গালি। দিতেন যে, তাকে সেজন্যে কাঁদতে হতো।
লরাকে ভালো না বাসলে পিতারার্ক এত বড় কবি হতে পারতেন না। লরার মৃত্যু হলে তার স্বামী সে জন্যে কিছুমাত্র দুঃখিত হন নি। পিতারার্ক কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত তার দেবীর সাধনা করেছিলেন। এছাড়া তার জীবনে আর কোনো কাজ ছিল না।
কবি ও সাহিত্যিক শো এক বড়লোকের মেয়েকে ভালবেসেছিলেন। তার ফলে তাকে কারাগারে অবদ্ধ হতে হয়েছিল। সাত বছর কারাগারে বসে বসেই তার প্রিয়তমার নামে কবিতা রচনা করেছিলেন।
এই সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ এক গায়িকার জন্যে পাগল হয়েছিলেন কবি মেতাশী। এই চারুহাসিনী খুব বিত্তশালিনী ছিলেন। ইনি স্বামীর সঙ্গে যেখানেই বাস করতেন মেতাতাশীও সেখানে থাকতেন–উদ্দেশ্য তার প্রিয়তমার সঙ্গে তাঁর জগতে মিলন না হলেও তিনি তার মুখ দেখে তৃপ্ত হবেন। এই মহিলা যখন মারা যান তখন তার সমস্ত সম্পত্তি স্বামীর মৃত্যুর পর মেতাতাশী ভোগ করবেন–এই কথা লিখে দিয়ে যান। বেঁচে থাকতে যার সঙ্গলাভ করবার ভাগ্য মেতাতাশীর হয়নি, মরে যাওয়ার পর তার সম্পত্তি নিয়ে লাভ কি? কবি এ সম্পত্তি গ্রহণ করেন নি।
কেমিওন আঠার বছর বয়সে এক উচ্চ বংশের নারীকে ভালবাসেন। মর্যাদায় নিজেকে প্রিয়তমার সমকক্ষ করবার জন্যে তিনি সৈন্য শ্রেণীতে নাম লেখান। যুদ্ধ করে বীরের কীর্তি অর্জন করে যখন তিনি বাড়ি এলেন, তখন তাঁর প্রণয়িনী মৃত্যুশয্যা গ্রহণ করেন।
স্পেনের বিখ্যাত লেখক স্যার ডেটেস এক নারীকে ভালবাসেন। এই নারীর ভালবাসা লাভ করবার পর তিনি তাকে ত্যাগ করে অন্য নারীকে বিয়ে করেন।
ওয়েল্যাভের কবিত্ব প্রতিভার কারণ হতাশ প্রণয়। যদি সোফিয়াকে ভালবেসে তিনি প্রত্যাখ্যাত না হতেন তাহলে তার কবি হওয়া হতো না।
ডেনমার্কের কবি ইভান্ড ছিলেন হতাশ প্রেমিক। প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে অনেক মানুষ বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্যে নিজদিগকে উৎসর্গ করেন। যে মহান আনন্দ হতে তাঁরা বঞ্চিত হন তার। আস্বাদ পেতে চান তারা ত্যাগে, সেবায় আর দীন-দুঃখী ও আর্তের জন্য প্রাণপাত করে।
যে প্রেমিক হয়েছে, তার হৃদয় যেমন উন্নত ও উদার হয়; যে প্রেমিক হবার পথে দাঁড়িয়ে ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে, তার মনও কত বড় হয়ে যায়। প্রেম কত সুন্দর, কত পবিত্র। মানব আত্মার পক্ষে মহা কল্যাণকর এই প্রেমের সঙ্গে সম্বন্ধ না রেখে যারা নারীর সঙ্গে মিলিত হন তারা কত বড় হতভাগ্য।
পথের পাশে পতিতা রমণীর সাজসজ্জা দেখে মনে তরল ভাব আসে। যে ঐশ্বর্য নিয়ে নারী এ জগতে এসেছিল মানুষকে প্রেমের স্পর্শে মহৎ করে দিতে তা পয়সার বিনিময়ে বিক্রি! কি শোক ও দুঃখের কথা।
নারীর রূপের চরম সার্থকতা বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে ভালবেসে এবং বিশেষ কোনো মানুষের ভালবাসা পেয়ে। ফরাশি দেশে এক সময় এমন একটি অবস্থা হয়েছিল যে, মানুষ নারীকে শুধু ভোগের সামগ্রী মনে করতো। নারী-পুরুষ নিজেদের দুর্বলতা গোপনের জন্যে বিয়ে করতো। নারী সৌন্দর্যের এর চেয়ে অপব্যবহার আর কী হতে পারে?
জগতের অনেক প্রতিভাশালী ব্যক্তি নারীর রূপের দারুণ অপব্যবহার করে গিয়েছেন–তা ভেবে মনে আমাদের খুবই দুঃখ হয়।
যে নারীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পার, যার রূপের প্রতি মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বাসী না হয়ে থাকতে পার, সে রূপ স্পর্শ করবার অধিকার তোমার নাই।
যুবক বয়সে অনেক সময় মতিভ্রম উপস্থিত হয়। অপদার্থ হীনস্বভাব নারীর রূপ দেখে মুগ্ধ হবার পূর্বে খুব সতর্ক হওয়া চাই, কারণ রূপকে অতিক্রম করে যখন তার ভিতরের সঙ্গে তুমি পরিচিত হবে তখন মন তোমার বিদ্রোহী হয়ে উঠবে, জীবনে শান্তি থাকবে না–যেমন নারীই হোক একবার বিয়ে করলে তার ইচ্ছা ব্যতীত কিছুতেই তাকে ত্যাগ করা যায় না।
কবি গোল্ডস্মিথের এই প্রকার একবার মতিভ্রম উপস্থিত হয়েছিল। তাঁর বন্ধুরা কোনো রকমে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
যারা নারীর বাহির নিয়ে শুধু ডুবে থাকতে চায় তাদের কাছে নারীর ভিতরের রূপ দরকার হতে না পারে। ভিতরের মাধুরীকে বাদ দিয়ে যে পুরুষ হীন রমণী-রূপে ডুবে যেতে চায় তাকে খুব ছোট বলে মনে হয়। মানুষ প্রেম ছাড়া আর কিছু নয়–সে যে নারী পুরুষের গভীর অনুরাগের জমান মূর্তি। প্রেমের মূর্তরূপে মানব-শিশুকে জন্ম দিবার জন্যে খোদা। নারী-পুরুষের মাঝে এত অনুরাগ, এত আকর্ষণ দিয়েছেন। এই শুভ উদ্দেশ্যের কথা ভুলে নারীর রূপ ভোগ করবার জন্যে মানুষ ব্যস্ত। বিধাতার দানের কি পৈশাচিক অপব্যবহার।