- বইয়ের নামঃ উচ্চ জীবন
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ উৎস প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
১. নারী-পুরুষ
এমন মানুষ নেই যার নারীর প্রতি একটা টান নেই … এ টান মোটেই দোষের নয়। যখন আকাশ থেকে আদি পুরুষ পৃথিবীতে এলেন, তখন তাঁর বড় শূন্য বোধ হতে লাগলো। খোদা তাঁকে এক পত্নী দিলেন–যিনি হলেন তার সঙ্গিনী ও বন্ধু।
নারী তো পুরুষের বন্ধু। আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বিপদ ঝঞ্ঝার চাপে পড়ে কাঁপছে, কাছে তোমার পত্নী রয়েছে; তার হাত ধরলে তোমার বুকে বিপুল উৎসাহ আসবে। একার পক্ষে সে আঘাত সহ্য করা তোমার সম্ভব হতো না।
যে কারণে বেঁচে আছ সেই শুভ উদ্দেশ্যকে সার্থক করবার জন্যে তুমি নারীর সঙ্গে মিলিত হতে পার–অন্য কোনো কারণে নয়। অসত্য ও পাপকে অবলম্বন করে যদি প্রতিষ্ঠা চাও, তবে নারীকে তোমার সঙ্গিনী হবার জন্য আহ্বান করো না–এ জন্যে নারীর সৃষ্টি হয় নি। তোমার পুণ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে নারী এসেছিল–তার সৌন্দর্য সুষমার অপব্যবহার করো না।
তারই নারীর সঙ্গে প্রেম করবার অধিকার আছে, যে নিজেকে সত্যের সৈনিকরূপে প্রচার করে। যে, এ জগতে পাপ ও অন্যায়কে দলিত করবার জন্যে বেঁচে আছে–সে মানুষ, সে মিথ্যার উপাসক নয়।
বড় কাজের পথে নারী অন্তরায় এ বিশ্বাস করো না। তোমাকে জয়যুক্ত করবার জন্যই তো নারীর আগমন। তোমার দুর্বল বাহুতে, তোমার ভাঙ্গা মনে শক্তি দেবার জন্যেই তো সে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে।
যে নারী স্বামীর সাধনা পথের সহায় না হয়ে অন্তরায় হয়েছেন তিনি তার নারী জীবনকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
লর্ড বেকন (Lord Bacon) বলেছেন, বিয়ে করলে বড় কাজ করবার ক্ষমতা থাকে না। রাতদিন তাকে ভাতের ভাবনা ভাবতে হয়–সে জীবনের কাজ কি করবে?
কতগুলি মানুষ সন্ন্যাসী থেকে মানব জাতির কল্যাণের জন্যে জীবন উৎসর্গ করুক, এ আমি চাই নি। সমাজের সেবায় কারো এত বড় ত্যাগ স্বীকারের আবশ্যকতা নেই। তিনি বড় হতে পারেন, কিন্তু তার এ নীরব জীবন দেখে আমার মনে কষ্ট হয়। আমি এ সেবা চাই নে।
পিতা, ভাই বা স্বামীরূপে যে মানব পরিবারে স্পর্শে আসে নাই। সে কোনো বিশেষ পথে জীবনকে সার্থক করতে পারে, কিন্তু মানুষের ব্যথা ঠিক ঠিক বোঝবার ক্ষমতা তার হয়তো হয় না। তার প্রকৃতিও তেমন সরস হয় না।
নারী পুরুষের রক্তে-মাংসে জড়িয়ে আছে, সে তাকে কেমন করে অস্বীকার করবে? দুঃখ বেদনা থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে যে বিয়ে করে না–সে কাপুরুষ। উপবাসক্লিষ্ট পরিবারের দুঃখদগ্ধ উপাসনা খোদার দুনিয়াকে বড় মধুর করে তুলেছে। নারী-পুরুষ মিলিত হলে যদি জগতের দুঃখ বাড়ে, বাড়ুক–সে দুঃখ-ব্যথাকে জয় করতে হবে। আগেই একেবারে দুঃখ হতে পালাতে চেষ্টা করো না–তা হলে খোদার সঙ্গে প্রেম করাটাই মিছে হয়ে যাবে।
জগতের অনেক বড়লোক চিরকুমারই ছিলেন। তাঁদের জীবনের বিশেষ কাজকেই যেন তাঁরা বিয়ে করেছিলেন। গ্যালিলিও, ডেকাটে এবং ক্যাভেনডিস (Cavendish) ছিলেন অবিবাহিত। ক্যাভেনডিস নারী জাতিকে বড় ঘৃণা করতেন। বাড়ির কোনো মেয়ে ভূত্যের তার সামনে উপস্থিত হওয়া একেবারে নিষেধ ছিল, হঠাৎ কোনো গতিকে সামনে পড়লে তার তখন চাকরি যেত। তিনি ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক-প্রাণ ছিল তার নীরস ও কঠিন, যেখানে একরত্তি ভালবাসা বা মায়া স্থান পেত না।
ঐতিহাসিক হিউম (Hume) গীবন ও মেকলেও বিয়ে করেন নি। গীবন (Gibbon) একবার ভালবাসায় পড়েছিলেন, কিন্তু পিতার আদেশে প্রণয়িনীকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যেখানে ভালবাসাটা তত গভীর নয়, সেখানেই কারো আদেশে এর হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।
জেরেমী বেনথাম Jeremy ventham) জীবনের প্রথম বয়সে এক নারীকে ভালবাসেন। বুড়োকালে যখন সেই বাল্য-প্রণয়িনীর কথা তার মনে পড়ত তখন তিনি বালকের মতো রোদন করতেন। ভালবাসার প্রতিদান না পেয়ে চিরকালই তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বড় দার্শনিক।
রাজনীতি বিশারদ পিট ফক্স (Pit Fox) কোনো নারীর পাণি গ্রহণ করেন নি। জীবনের সাধনার পথে পত্নী বাধা হবে ভেবে পিট কঠিন সংযম বরণ করে নিয়েছিলেন। যে নারীকে তিনি ভালবেসে ছিলেন তিনি ছিলেন খুব সুন্দরী। তাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ করতে পারেন নি, এজন্যে তাঁর প্রাণে বড় বেদনা বেজেছিল। তিনি ভাল করেছিলেন কি মন্দ করেছিলেন তা বলতে পারিনে : ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে খেলা করা ছিল পিটের জীবনের একটা মহা আনন্দের বিষয়।
চিত্রকর র্যাফেলো (Raphaelo) মাইকেল এঞ্জেলো (Michael Angelo) নারীকে আমল দেন নি। রেনলড়সের (Raymlods) ধারণা ছিল বিয়ে করলে ভালো চিত্রকর হওয়া যায় না। সৌন্দর্য ও রসবোধ নষ্ট হয়ে যায়। এক বন্ধু চিত্রকরকে বিয়ে করতে দেখে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, এই বারই তোমার চিত্র আঁকা শেষ হবে। বস্তুতঃ তাঁর এ মন্তব্যের মূলে কিছু সত্য থাকলেও চিত্রকর বন্ধুর বিয়ে করাতে বিশেষ। কোনো ক্ষতি হয় নি। কোনো বাস্তব সুন্দরীর স্পর্শে পাছে কল্পনা সুন্দরীর অন্তর্ধান হয় এই ভয়ে হয়তো বন্ধুকে সতর্ক করেছেন।
সঙ্গীতবিদ্যা বিশারদ বোভেন (Bethoven) যদি হতাশ প্রেমিক না হতেন তা হলে হয়তো তাঁর সঙ্গীত বিদ্যায় এত পারদর্শিতা ঘটত না। খুঁজেও সারা জীবন তিনি একটা মনের মানুষ পান নি। আশা ও আনন্দহীন হৃদয় নিয়ে তিনি গানের চর্চায় মন দিয়েছিলেন এবং তাতেই তিনি যথেষ্ট কীর্তি অর্জন করেছিলেন। অনেক নারীও চিরকাল কুমারী জীবন যাপন করে গিয়েছিলেন। কেউ হয়তো স্বাধীন থাকবার জন্যে, কেউ মানব সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দাম্পত্য জীবনের সুখ ও দায়িত্ব হতে দূরে থেকে অনেকে সাহিত্য ও জ্ঞানের সেবা করে জীবন কাটিয়েছেন, কেউ কেউ প্রথম জীবনে কোনো যুবককে ভালবেসেছিলেন, প্রতিদান না পেয়ে আর কোনোকালে বিয়ে করেন নি।