১. মৃতদেহ তিনটে
০১.
মৃতদেহ তিনটে প্রথম দেখেছিল হরিণডুবি গ্রামের সোনারু মাঝি। হেমন্তের কুয়াশা মাখা ভোরে সোনারু তার ছাগল চারটেকে নিয়ে জয়ন্তী নদীর শুকনো খাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল।
রোজই যায়। নদীর চর ধরে পশ্চিমদিকে কিছুটা এগোলে দেখা যায়, এক জায়গায় কিনারা থেকে জঙ্গল একটু পেছু হটে গেছে। সেইখানটাতেই, বন আর বালির চরার মাঝখানে পলিমাটির এক ফালি জমি কচি সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে। ওই ঘাসজমিটায় ছাগলগুলোকে চরতে দিয়ে সোনারু বসে থাকে। থাকতেই হয়, চলে এলে হয় না। বক্সা টাইগার রিজার্ভের গা ঘেঁষা এইসব গ্রামে কখনও-সখনও জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ চলে আসে, আর ছাগল চিতাবাঘের প্রিয় খাদ্য। হল্লা করলে বাঘ পালায়। ছাগল বাঁচে। সেইজন্যই বসে থাকা। আর, ঘন্টা দেড় দুই সোনারু এখানে বসে থাকলে সংসার কিছু অচল হয়ে যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, আশি বছরের বুড়ো যদি মরেই যায়, তাতেও কারুর কিছু যাবে আসবে না।
সত্যি কথা বলতে গেলে এটাও বলতে হয়, সোনারু নয়, ছাগল চারটেই সেদিন প্রথম বুঝেছিল ঘাসজমির ওপর অস্বাভাবিক কিছু পড়ে আছে। তারা ওই জায়গাটায় পৌঁছিয়ে জমিতে পা গেঁথে সোনারুকে পেছনদিকে টানছিল। মা মা আওয়াজ করে ওদিকে যাবার ব্যাপারে প্রবল অনিচ্ছা জানাচ্ছিল।
ব্যাপারটা কী? এ শালারা ঘাবড়ায় কী দেখে? ভাবল সোনারু। ছানিপড়া চোখদুটো কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই খয়েরি পলি আর সবুজ ঘাসের মধ্যে থেকে আলাদা করে সে দেখতে পেল উর্দি পরা তিনটে মানুষের চেহারা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে।
মরা মানুষের পড়ে থাকার মধ্যে একটা বিশেষ ভঙ্গি থাকে–সে চিৎ হয়েই পড়ুক আর উপুড় হয়ে। কাউকে বলে দিতে হয় না যে, দেহটায় আর প্রাণ নেই। কেমন যেন ন্যাতানো ভিজে তুলোর পুতুলের মতন হয়ে যায় শরীরটা। সোনারুকেও বলে দিতে হল না যে, লোকগুলো আর বেঁচে নেই। সে ছাগল চারটেকে সামনে তাড়িয়ে নিয়ে, আশি বছর বয়সে যতটা দৌড়নো যায় ততটাই দৌড়ে, গ্রামের বটতলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং রিভারবেডের দিকে একটা হাত তুলে অর্থহীন চিৎকার ছাড়তে লাগল। ততক্ষণে রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারা সোনারুকে একটু শান্ত করে তার কাছ থেকে গোটা ঘটনাটা শুনল।
তারপর নদীর তীরে সেই ঘাসজমিটাকে ঘিরে মানুষের বৃত্ত তৈরি হল। ফিরতি মানুষজনের মুখে মুখে ফিসফিস করে খবরটা ছড়াতে লাগল–জয়ন্তীর তীরে তিনটে ফরেস্টগার্ডের লাশ পড়ে আছে। তিনটে ফরেস্টগার্ড…মরে গেছে।
এইভাবে সেদিন সকালে সোনারুর বটতলায় আগমনের বড়জোর পনেরো মিনিটের মধ্যেই খবরটা ছড়াতে ছড়াতে পৌঁছে গেল গ্রামের প্রান্তে ঘন শাল জঙ্গলের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা হরিণডুবি বিট অফিসের ভেতর। সেখানে তখন ছিলেন বিট-অফিসার সজল দত্ত আর দুজন ক্লার্ক জীবন সিং আর গোপিনাথ মন্ডল। তারা তিনজনেই দৌড়লেন নির্দিষ্ট জায়গায় এবং যা দেখলেন তাতে তাদের মাথা ঘুরে গেল। জীবন আর গোপিনাথকে ওখানে পাহারায় রেখে সজলবাবু আবার দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এলেন বিট অফিসে এবং আর.টি.সেট চালু করে বক্সা টাইগার রিজার্ভের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার প্রমিত ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
প্রমিতের বয়েস আঠাশ। অরিজিনালি কলকাতার ছেলে। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসে যোগ দেবার পরে প্রথম তিন বছর কাজিরাঙায় কাটিয়ে তারপর দু-বছর হল বি.টি.আর-এ পোস্টিং পেয়েছে এবং হরিনডুবি বিটের দায়িত্বে রয়েছে। প্রমিত কাজ-পাগল ছেলে এবং দক্ষ অফিসার হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। সর্বোপরি যেহেতু সে এখনও বিয়ে থা করেনি তাই তার হাতে অফিসকে দেওয়ার মতন সময়ও প্রচুর। আলিপুরদুয়ারে বি.টি.আর-এর অফিস আর প্রমিতের কোয়ার্টার প্রায় পাশাপাশি। প্রতিদিনের মতন সেদিনও সকাল সাড়ে আটটাতেই সে অফিসে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল। রেডিয়ো অপারেটর যে মুহূর্তে বলেছে, স্যার, হরিণডুবি কলিং, সেই মুহূর্তেই সে গিয়ে কল রিসিভ করেছে।
উলটোদিক থেকে সজলবাবু ভয়ে এবং উত্তেজনায় খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না, তবে এইটুকু বলতে পেরেছিলেন যে তিনজন ফরেস্টগার্ড তাদের নাম বাবুয়া, সন্দীপ আর বিমল–তারা খুন হয়েছে।
সজলবাবুর মুখে এইটুকু শুনেই প্রমিত আর একমুহূর্ত দেরি করেনি। তখনি জিপ বার করে নিজেই ড্রাইভ করে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল হরিণডুবি। যাবার পথেই আলিপুরদুয়ার থানাকে ঘটনা সম্বন্ধে ইনফর্ম করে তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অকুস্থলে পৌঁছতে অনুরোধ করে এসেছিল। পুলিশ ঘটনার গুরুত্ব বুঝে দেরি করেনি। ও.সি. আলিপুরদুয়ার রতন বৈদ্যের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটা ফোর্স প্রমিতের পেছন পেছনই হরিণডুবি পৌঁছেছিল। তখন ঘড়িতে ঠিক নটা কুড়ি। হরিণডুবি বিট-অফিসের কম্পাউন্ডে গাড়িগুলো রেখে তারা সবাই জয়ন্তীর তীরে সেই জায়গাটায় পৌঁছেছিল যেখানে একের সঙ্গে অন্যের সামান্য দুরত্ব রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শুয়েছিল তিনজন ফরেস্ট গার্ড বিমল, বাবুয়া আর সন্দীপ।
এই তিনজন ফরেস্টগার্ডের সঙ্গে প্রমিত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধুর মতন সময় কাটিয়েছে। বক্সার কুখ্যাত পোচারদের হাত থেকে অরণ্যকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রমিতই এই তিনজন স্পেশালি ট্রেইনড় যুবককে ভারতের বিভিন্ন রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে খুঁজে এখানে নিয়ে এসেছিল। এদের তিনজনের কম্যান্ডো ট্রেনিং-এর ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল। বিনিময়ে এই তিন যুবক গত একবছর ধরে বি.টি.আর-কে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল। ওদের দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পোচিং আর কাঠ চুরি।