১. মৃতদেহ তিনটে
০১.
মৃতদেহ তিনটে প্রথম দেখেছিল হরিণডুবি গ্রামের সোনারু মাঝি। হেমন্তের কুয়াশা মাখা ভোরে সোনারু তার ছাগল চারটেকে নিয়ে জয়ন্তী নদীর শুকনো খাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল।
রোজই যায়। নদীর চর ধরে পশ্চিমদিকে কিছুটা এগোলে দেখা যায়, এক জায়গায় কিনারা থেকে জঙ্গল একটু পেছু হটে গেছে। সেইখানটাতেই, বন আর বালির চরার মাঝখানে পলিমাটির এক ফালি জমি কচি সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে। ওই ঘাসজমিটায় ছাগলগুলোকে চরতে দিয়ে সোনারু বসে থাকে। থাকতেই হয়, চলে এলে হয় না। বক্সা টাইগার রিজার্ভের গা ঘেঁষা এইসব গ্রামে কখনও-সখনও জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ চলে আসে, আর ছাগল চিতাবাঘের প্রিয় খাদ্য। হল্লা করলে বাঘ পালায়। ছাগল বাঁচে। সেইজন্যই বসে থাকা। আর, ঘন্টা দেড় দুই সোনারু এখানে বসে থাকলে সংসার কিছু অচল হয়ে যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, আশি বছরের বুড়ো যদি মরেই যায়, তাতেও কারুর কিছু যাবে আসবে না।
সত্যি কথা বলতে গেলে এটাও বলতে হয়, সোনারু নয়, ছাগল চারটেই সেদিন প্রথম বুঝেছিল ঘাসজমির ওপর অস্বাভাবিক কিছু পড়ে আছে। তারা ওই জায়গাটায় পৌঁছিয়ে জমিতে পা গেঁথে সোনারুকে পেছনদিকে টানছিল। মা মা আওয়াজ করে ওদিকে যাবার ব্যাপারে প্রবল অনিচ্ছা জানাচ্ছিল।
ব্যাপারটা কী? এ শালারা ঘাবড়ায় কী দেখে? ভাবল সোনারু। ছানিপড়া চোখদুটো কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই খয়েরি পলি আর সবুজ ঘাসের মধ্যে থেকে আলাদা করে সে দেখতে পেল উর্দি পরা তিনটে মানুষের চেহারা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে।
মরা মানুষের পড়ে থাকার মধ্যে একটা বিশেষ ভঙ্গি থাকে–সে চিৎ হয়েই পড়ুক আর উপুড় হয়ে। কাউকে বলে দিতে হয় না যে, দেহটায় আর প্রাণ নেই। কেমন যেন ন্যাতানো ভিজে তুলোর পুতুলের মতন হয়ে যায় শরীরটা। সোনারুকেও বলে দিতে হল না যে, লোকগুলো আর বেঁচে নেই। সে ছাগল চারটেকে সামনে তাড়িয়ে নিয়ে, আশি বছর বয়সে যতটা দৌড়নো যায় ততটাই দৌড়ে, গ্রামের বটতলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং রিভারবেডের দিকে একটা হাত তুলে অর্থহীন চিৎকার ছাড়তে লাগল। ততক্ষণে রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারা সোনারুকে একটু শান্ত করে তার কাছ থেকে গোটা ঘটনাটা শুনল।
তারপর নদীর তীরে সেই ঘাসজমিটাকে ঘিরে মানুষের বৃত্ত তৈরি হল। ফিরতি মানুষজনের মুখে মুখে ফিসফিস করে খবরটা ছড়াতে লাগল–জয়ন্তীর তীরে তিনটে ফরেস্টগার্ডের লাশ পড়ে আছে। তিনটে ফরেস্টগার্ড…মরে গেছে।
এইভাবে সেদিন সকালে সোনারুর বটতলায় আগমনের বড়জোর পনেরো মিনিটের মধ্যেই খবরটা ছড়াতে ছড়াতে পৌঁছে গেল গ্রামের প্রান্তে ঘন শাল জঙ্গলের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা হরিণডুবি বিট অফিসের ভেতর। সেখানে তখন ছিলেন বিট-অফিসার সজল দত্ত আর দুজন ক্লার্ক জীবন সিং আর গোপিনাথ মন্ডল। তারা তিনজনেই দৌড়লেন নির্দিষ্ট জায়গায় এবং যা দেখলেন তাতে তাদের মাথা ঘুরে গেল। জীবন আর গোপিনাথকে ওখানে পাহারায় রেখে সজলবাবু আবার দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এলেন বিট অফিসে এবং আর.টি.সেট চালু করে বক্সা টাইগার রিজার্ভের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার প্রমিত ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
প্রমিতের বয়েস আঠাশ। অরিজিনালি কলকাতার ছেলে। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসে যোগ দেবার পরে প্রথম তিন বছর কাজিরাঙায় কাটিয়ে তারপর দু-বছর হল বি.টি.আর-এ পোস্টিং পেয়েছে এবং হরিনডুবি বিটের দায়িত্বে রয়েছে। প্রমিত কাজ-পাগল ছেলে এবং দক্ষ অফিসার হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। সর্বোপরি যেহেতু সে এখনও বিয়ে থা করেনি তাই তার হাতে অফিসকে দেওয়ার মতন সময়ও প্রচুর। আলিপুরদুয়ারে বি.টি.আর-এর অফিস আর প্রমিতের কোয়ার্টার প্রায় পাশাপাশি। প্রতিদিনের মতন সেদিনও সকাল সাড়ে আটটাতেই সে অফিসে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল। রেডিয়ো অপারেটর যে মুহূর্তে বলেছে, স্যার, হরিণডুবি কলিং, সেই মুহূর্তেই সে গিয়ে কল রিসিভ করেছে।
উলটোদিক থেকে সজলবাবু ভয়ে এবং উত্তেজনায় খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না, তবে এইটুকু বলতে পেরেছিলেন যে তিনজন ফরেস্টগার্ড তাদের নাম বাবুয়া, সন্দীপ আর বিমল–তারা খুন হয়েছে।
সজলবাবুর মুখে এইটুকু শুনেই প্রমিত আর একমুহূর্ত দেরি করেনি। তখনি জিপ বার করে নিজেই ড্রাইভ করে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল হরিণডুবি। যাবার পথেই আলিপুরদুয়ার থানাকে ঘটনা সম্বন্ধে ইনফর্ম করে তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অকুস্থলে পৌঁছতে অনুরোধ করে এসেছিল। পুলিশ ঘটনার গুরুত্ব বুঝে দেরি করেনি। ও.সি. আলিপুরদুয়ার রতন বৈদ্যের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটা ফোর্স প্রমিতের পেছন পেছনই হরিণডুবি পৌঁছেছিল। তখন ঘড়িতে ঠিক নটা কুড়ি। হরিণডুবি বিট-অফিসের কম্পাউন্ডে গাড়িগুলো রেখে তারা সবাই জয়ন্তীর তীরে সেই জায়গাটায় পৌঁছেছিল যেখানে একের সঙ্গে অন্যের সামান্য দুরত্ব রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শুয়েছিল তিনজন ফরেস্ট গার্ড বিমল, বাবুয়া আর সন্দীপ।
এই তিনজন ফরেস্টগার্ডের সঙ্গে প্রমিত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধুর মতন সময় কাটিয়েছে। বক্সার কুখ্যাত পোচারদের হাত থেকে অরণ্যকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রমিতই এই তিনজন স্পেশালি ট্রেইনড় যুবককে ভারতের বিভিন্ন রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে খুঁজে এখানে নিয়ে এসেছিল। এদের তিনজনের কম্যান্ডো ট্রেনিং-এর ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল। বিনিময়ে এই তিন যুবক গত একবছর ধরে বি.টি.আর-কে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল। ওদের দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পোচিং আর কাঠ চুরি।
সেই সকালে প্রমিত অবিশ্বাসের চোখে তার তিন নির্ভরযোগ্য যোদ্ধার মৃতদেহের দিকে চেয়েছিল। ওরা তিনজনেই চিৎ হয়ে পড়েছিল। তিনজনেরই বুকে একটা করে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। প্রমিত কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সামনাসামনি লড়াইয়ে ওদের কেমন করে কেউ এত পরিষ্কারভাবে মারতে পারে। এ তো মেশিনগানের শট নয় যে, ওরা প্রস্তুত হবার আগেই এলোপাথারি গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল। এ তো রীতিমতন টিপ করে, সময় নিয়ে, মারা হয়েছে।
কেমন করে…কেমন করে কেউ ওদের সামনে এসে, সেই সময়টা দিয়েও, বেঁচে ফিরে যেতে পারে! ওরা কী করছিল তা হলে? কেন উলটে মারেনি সেই আগুয়ান ঘাতককে?
এই প্রশ্নের ভার মাথায় নিয়ে হরিণডুবি বিট-অফিসের কাঠের বাড়িতে ফিরে এসেছিল প্রমিত। মৃতদেহগুলোকে পোস্টমর্টেমের জন্যে শিলিগুড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে ও.সি রতন বৈদ্যও এসেছিলেন তার সঙ্গে। প্রমিতের সামনেই তিনি ইন্টারোগেট করেছিলেন দুই ক্লার্ক জীবন সিং আর গোপিনাথ মণ্ডলকে। বিট-অফিসার সজলবাবুর সঙ্গেও অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন তিনি। সেই কথাবার্তায় যা জানা গিয়েছিল, তা রহস্যকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল।
বিট-অফিসের পেছনে ছোট্ট লিভিং-কোয়ার্টারে রান্নাঘর আর বাথরুম ছাড়া দুটো মাত্র কামরা। তার একটায় থাকতেন নিহত তিন ফরেস্টগার্ড, আর অন্যটায় থাকতেন বিট-অফিসার সজল দত্ত। তৃতীয় কোনও ঘর না থাকায় জীবন সিংহ আর গোপিনাথ মণ্ডল অফিসঘরের মেঝেতেই রাতে বিছানা পেতে শুতেন। লিভিং কোয়ার্টারের ঘরদুটোর পেছনদিকেও যেমন দরজা আছে তেমনি আরও একটা দরজা আছে অফিসঘরের দিকে। যখন ফরেস্টগার্ডরা গভীর রাতে সারপ্রাইজ চেকিং-এ বেরোতেন, তখন পেছনের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে তারা অফিসঘরের মধ্যে দিয়েই বেরোতেন, কারণ সে ক্ষেত্রে, তারা বেরিয়ে যাবার পরে, জীবনবাবু কিম্বা গোপিনাথ মণ্ডল আবার ভেতর থেকে দরজায় খিল দিয়ে দিতে পারতেন। এই ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ছিল। বেশি।
ঘটনার আগের রাতে ওরা যে যার নির্দিষ্ট ঘরেই ঘুমোচ্ছিল। এমন সময় অনেকদূর থেকে ভেসে আসা দুটো রাইফেল ফায়ারিং-এর আওয়াজে ওদের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। একটা ফায়ারিং-এ ওরা জেগে ওঠে। তার প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে দ্বিতীয় গুলির শব্দটা ভেসে আসে।
এমনিতে এই হেমন্তমাসে, যখন জঙ্গলের প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জমিগুলোতে পাকা ফসল বিছিয়ে আছে, তখন সারারাতই সেই ফসল নষ্ট করতে আসা হাতির পালকে তাড়াবার জন্যে এদিক ওদিকে ক্র্যাকার ফাটানো হয়। অনভ্যস্ত কানে ক্র্যাকারের আওয়াজ থেকে রাইফেলের গুলির আওয়াজ আলাদা করে চেনা কঠিন। কিন্তু হরিণডুবি বিট-অফিসে যারা ছিল তারা জঙ্গলের সমস্ত আওয়াজকে খুব ভালো করে চিনবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা শুধু যে গুলির আওয়াজকেই আলাদা করে চিনতে পেরেছিল তাইই নয়, সেই আওয়াজ জঙ্গলের ঠিক কোনখান থেকে এসেছে সেটা বুঝে নিতেও তাদের অসুবিধা হয়নি, বিশেষত, ওই দ্বিতীয় গুলির আওয়াজটা থেকে, যখন তাদের মাথা থেকে ঘুমের ঘোর সরে গেছে।
ওদের সন্দেহ ছিল না যে, ওই গুলির আওয়াজ এসেছে জঙ্গলের প্রান্তে জয়ন্তী নদীর বেড-এর ওপর থেকে। তার মানে পোচাররা জঙ্গলে ঢুকবার ধান্দা করছে।
জয়ন্তীর যে পাড়ে হরিণডুবি, তার ঠিক অন্য পাড়েই ভুটান। ও পাড়ে, নদীর কিনারার সামান্য জায়গা বাদ দিয়ে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। ভুটান-গভর্নমেন্টের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই ওই জায়গাটার ওপর। ওটা সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তাঞ্চল।
আর এ কথা সকলেই জানে যে, সন্ত্রাসবাদী আর চোরাশিকারি এখন সমার্থক। ভারতের বিভিন্ন বনাঞ্চলে টেররিস্টরাই চোরাশিকারের কাজটা করে, বিশেষ করে এই উত্তরপূর্ব ভারতের বনগুলোয়। এইভাবেই ওরা সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালাবার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করে। হাতির দাঁত, গন্ডারের খড়গ কিম্বা বাঘের চামড়ার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা জহরতের চেয়েও বেশি। ওইসব প্রাণীর দেহাংশ বিদেশে, বিশেষ করে চীনের চোরাবাজারে বিক্রি করে টেররিস্টরা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ কেনে। এইভাবেই বোরো জঙ্গিদের হাতে এককালের অপরূপ মানস স্যাংচুয়ারি ছারখার হয়ে গেছে। লোয়ার অসমের এই টাইগার-স্যাংচুয়ারিতে আজ একটিও ডোরাকাটা বাঘ বেঁচে আছে কি না সন্দেহ। পোচারদের এর পরের লক্ষ বক্সা টাইগার রিজার্ভ। এই বনাঞ্চলও নানান দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী আর দুমুল্য কাঠের গাছের জন্যে বিখ্যাত। আর সেই ধনাগারে ঢুকবার সবচেয়ে সহজ রাস্তা জয়ন্তীর বেড পেরিয়ে হরিণডুবির মধ্যে দিয়ে। এর আগেও বহুবার এইভাবে জঙ্গলে ঢুকে লুঠপাট চালিয়ে গেছে চোরা শিকারিরা। বিগত এক বছরে, বিমল, বাবুয়া, সন্দীপেরা আসবার পর থেকে ওরা তিনজনে সিংহবিক্রমে চোরাশিকারিদের আটকাচ্ছিল। কাল রাতে গুলির আওয়াজ শুনে ওদের কারুর সন্দেহ থাকে না যে, কিছুদিন চুপচাপ কাটানোর পরে আবার পোচাররা জঙ্গলে ঢুকে জংলি জানোয়ার মারছে। তিন ফরেস্টগার্ড দ্রুত সাজপোশাক পরে নিয়ে ওদের মোকাবিলায় রওনা হয়ে যায়। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে দরজায় খিল তুলে দেন দুই ক্লার্কের মধ্যে একজনজীবন সিংহ। ও.সি. রতন বৈদ্যের প্রশ্নের। উত্তরে তিনি জানান, তখন রাত ঠিক দেড়টা।
সজলবাবু, জীবন কিম্বা গোপিনাথ, প্রত্যেকেই ওই তিন ফরেস্টগার্ডের বলবীৰ্য্য সম্বন্ধে এতটাই সংশয়হীন ছিলেন যে, তারা তারপরেই আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন। তারা জানতেন, পোচারদের সঙ্গে এনকাউন্টার যদি হয়ই, তাতে বিমল বাবুয়ারা একশোবারের মধ্যে একশোবারই জয়ী হবে। গত একবছরের নানান ঘটনা তাদের সেরকমটাই বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল।
কাজেই ঘণ্টাখানেক বাদে আবার যখন পরপর তিনটে ফায়ারিং-এর শব্দ ভেসে আসে তখন ঘুম ভেঙে গেলেও ওরা কোনও দুশ্চিন্তা করেনি। বিশেষত এবারের আওয়াজগুলো এসেছিল অনেকদুর থেকে, সম্ভবত নদীর অপর পাড়ে, ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে। তার মানে, ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিলেন, বিমল বাবুয়ারা ওদের তাড়িয়ে ছেড়েছে। পালাতে পালাতে টেররিস্টরা গুলি ছুড়ছে।
এর পরে সারারাত আর কোনও গুলির শব্দ পাওয়া যায়নি।
সকালেও যখন বিমল বাবুয়ারা ফিরল না তখনও ওরা কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা করেনি। কারণ একবার বেরোলে ওই তিনজন ফরেস্টগার্ড সাধারনত পুরো বিট টহল দিয়ে আসত; পোচারদের মধ্যে দুয়েকজন তো এদিকে ওদিকে ছিটকে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, তাই। এমন টহলদারীতে প্রচুর সময় লাগে। সজলবাবুরা নিশ্চিন্তমনেই অফিস খোলার উদ্যোগ করছিলেন। এমন সময় গ্রামবাসীদের মুখে সেই দুঃসংবাদ এসে পৌঁছয়–ওরা তিনজনেই মারা পড়েছে।
যেখানে মৃতদেহ পড়েছিল সেই জায়গাটার আশেপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে তল্লাশি চালান রতন বৈদ্য এবং তার সহকর্মীরা। তাদের এই উদ্যেগ সম্পূর্ণ বিফলে যায়নি। যেখানে বিমল সন্দীপ আর বাবুয়ার মৃতদেহ পড়েছিল, তার থেকে কিছুটা দূরেই রিভারবেডের ওপর পাওয়া যায় দুটো কার্তুজের খোল। তার মানে ওইখানে দাঁড়িয়েই প্রথম দুটো গুলি চালানো হয়েছিল যে দুটো গুলির আওয়াজ শুনে বিমলরা বেরিয়ে এসেছিল। গুলি চালানোর জায়গাটা সম্বন্ধে বিমলদের আন্দাজ কত নির্ভুল ছিল, এটা তার প্রমাণ।
কিন্তু এটা বুঝতেও প্রমিত কিম্বা রতন বৈদ্যের বেশি সময় লাগেনি যে, ওই দুটো গুলি কাউকে মারার জন্যে চালানো হয়নি। ধু ধু শূন্য রিভারবেডের মধ্যে রাত দেড়টার সময়ে মারার মতন কোনও মানুষ বা প্রাণীকে পাওয়া মুস্কিল। ওই গুলিদুটো চালানো হয়েছিল ঠিক ওই জায়গায় তিন ফরেস্টগার্ডকে টেনে আনার জন্যে। শব্দের উৎসটাকে যাতে ফরেস্টগার্ড তিনজন নির্ভুলভাবে চিনে নিতে পারে, সেইজন্যই সম্ভবত, দুবার গুলি চালানোর মধ্যে পাঁচ মিনিট গ্যাপ রাখা হয়েছিল।
এবং এই প্ল্যান একশোভাগ সাকসেসফুল হয়েছিল। বিমল, বাবুয়ারা কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর সময়েই জানত তাদের ঠিক কোনখানটায় যেতে হবে, ঠিক কোনখান থেকে ভেসে এসেছে গুলির শব্দ।
ওরা রিভারবেডের কাছাকাছি এসে বুকের ওপর শুয়ে পড়েছিল। কারণ জঙ্গলের বাইরে, খোলা জায়গায় উঠে দাঁড়ানোর মানে রিভারবেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনও ঘাতকের সামনে সহজ টার্গেট হয়ে যাওয়া। ওরা নদীর তীর অবধি বুকে হেঁটে, ক্রল করে এগিয়েছিল। ওদের শরীরের ভারে দুমড়ে নুয়ে পড়া ঘাস থেকে ওই সরীসৃপ-গতির ব্যাপারে রতন বৈদ্যের লোকজন নিশ্চিত হয়েছিল। তারপর নিশ্চয় ওরা ভালো করে চেয়ে দেখেছিল, চারপাশে কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কি না। দেখে নিয়েছিল দুদিকের রিভারবেড, যেখানে একটা পাখিরও লুকিয়ে থাকার মতন কোনও আড়াল নেই। দেখে নিয়েছিল নিশ্চয় নদীর অপর তীরটাকেও। সেই অহল্যা জমিতেও একটাও গাছের আড়াল ছিল না যেখানে কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। অপর তীরের পাহাড়গুলোকে ওরা নিশ্চয় দেখতে পায়নি। কারণ গতকাল ছিল দ্বিতীয়া, আকাশে চাঁদ ছিল নামমাত্র, বাতাসে ছিল হালকা কুয়াশার চাদর, এবং রাত ছিল গভীর। অর্থাৎ নদীর তীরভূমির ওপাড়ে আর কিছু ওদের চোখে পড়ারই কথা নয়।
যুক্তি বলে, একই কারণে ওই পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মানুষের পক্ষেও ওদের দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়।
অথচ পেয়েছিল।
এক বা একাধিক রাইফেলধারী শার্প-শুটার নদীর অন্যপাড়ের পাহাড়ের ওপরে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই তিন ফরেস্টগার্ডকে এতটাই নিখুঁতভাবে দেখতে পেয়েছিল যে, তারা অনায়াসে ওদের হৃদপিণ্ড ছুঁড়ে দিতে পেরেছিল।
হ্যাঁ, যে বুলেটগুলোতে ওদের মৃত্যু হয়েছে সেগুলো যে উলটোদিকের ওই পাহাড়ের মাথা থেকে ছুটে এসেছে সে ব্যাপারে ও.সি. রতন বৈদ্য এবং প্রমিত ব্যানার্জি দুজনেই নিশ্চিত। প্রথম কারণ জীবনবাবু, গোপিনাথবাবুদের সাক্ষ্য–যেখানে ওরা বলেছেন পরের তিনটে ফায়ারিং এর শব্দ ভেসে এসেছিল অনেক দূর থেকে।
দ্বিতীয়ত, নদীর বেড কিম্বা অপর পাড়ের তীরভূমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আগে যে দুটো বুলেটের কার্তুজের কথা বলা হয়েছে তা ছাড়া অন্য কোনও কার্তুজের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার মানে পাহাড়ের ওপরে কোথাও সেগুলো পড়ে আছে।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ মৃতদের শরীরের বুলেটের ক্ষতের চেহারা। তিনজনের বুকে যেখানে বুলেটগুলো ঢুকেছে সেখানে ক্ষতের আকৃতি গোল নয়–লম্বাটে। এরকমটা একমাত্র তখনই হয় যখন বুলেট শরীরে ঢোকে কোণাকুণি ভাবে, ওপর কিম্বা নীচ থেকে। এক্ষেত্রে নীচ থেকে আসার কোনও জায়গা নেই। অতএব ধরে নেওয়া যায় পাহাড়ের মাথা থেকেই নীচের দিকে কোণাকুণিভাবে ছুটে এসেছিল বুলেটগুলো। তাছাড়া বুলেট যতদূর থেকে আসে, তত ক্ষতের চারিপাশে জমে থাকা বারুদের পরিমাণ কমে যায়। এক্ষেত্রে বিমল বাবুয়াদের বুকের ক্ষতের চারিপাশে বারুদের দাগ একেবারেই ছিল না। এই বুলেটগুলো সন্দেহাতীতভাবে বহুদূরের পথ পেরিয়ে এসেছিল।
যে প্রশ্নটার উত্তর প্রমিত এবং রতন বৈদ্য কেউই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা হল, অমন কুয়াশা আর অন্ধকারের মধ্যে শু্যটাররা কেমন করে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বিমল, সন্দীপ, বাবুয়াদের দেখতে পেল? নাইট ভিশন টেলিস্কোপিক সাইট-এর কথা একবার ওদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু ওরা জানত পৃথিবীর আধুনিকতম টেলিস্কোপিক সাইটের রেঞ্জও ওই দূরত্বের দশভাগের একভাগ।
জিপের দিকে ফিরতে ফিরতে প্রমিত বলল, কয়েকটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না মিস্টার বৈদ্য।
কী বলুন তো? বছর চল্লিশের বুদ্ধিমান মানুষটি বললেন।
আজ দিনের আলোয় আমরা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম। শুধু আমরা কেন, সকাল থেকে অজস্র গ্রামবাসীও ঘুরে গেছে ওখানে। কিন্তু একটাও গুলি ছুটে আসেনি।
আজ বলে নয়, এত বছরের মধ্যে কোনওদিন ওইদিকের পাহাড় থেকে গুলি ছুটে আসেনি–না দিনে, না রাতে। না আসাটাই স্বাভাবিক। দুদিকের তীরভূমির মধ্যে যা দূরত্ব তাতে গুলি ছুঁড়লে গুলির অপব্যয়। টার্গেটকে যেখানে দেখতে পাওয়া যায় না সেখানে যা হয় আর কি।
আজ প্রথম ওদিক থেকে গুলি ছুটে এল, তাও রাতে। এবং সেই গুলি টার্গেটে হিট করল। তার মানে ওরা কি দিনের চেয়ে রাতে ভালো দেখতে পাচ্ছে? যদি কোনও যন্ত্রের সাহায্যে এমন ক্ষমতা ওরা পেয়ে থাকে, তাহলে সেই যন্ত্র দিনের বেলায় ব্যবহার করছে না কেন? তাহলে তো অনেক বেশি শিকার পেয়ে যেত। আরও অনেকগুণে টেরিফাই করে দিতে পারত আমাদের।
রতন বৈদ্য বললেন, জানি না এর উত্তর কবে খুঁজে পাব। তবে আপাতত আজ থেকেই আপনি ওদিকের জঙ্গলে, মানে যেখান থেকে ভুটান পাহাড় দেখা যায় সেদিকে লোক যাতায়াত বন্ধ করে দিন। দিনে এবং রাতে।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রমিত বলল এটাই পোচাররা অনেকদিন ধরে চাইছিল– আমাদের ভয় পাইয়ে দিতে, আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে। আমি ওদের চারজনকে নিয়ে একটা ফাইট দিচ্ছিলাম। যুদ্ধটা আজকে শেষ হয়ে গেল। শুধু যদি বুঝতে পারতাম, কোন অস্ত্রের কাছে হারলাম!
.
০২.
বাবুয়া সন্দীপেরা যেদিন খুন হল তার পরে আরও চারটে দিন কেটে গেছে। মাঝের দিনগুলোয় মিডিয়ায় প্রবল হইচই হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে। উত্তরবঙ্গে তো বটেই, কলকাতার কাগজগুলোতেও একসঙ্গে তিনজন ফরেস্টগার্ডের খুন হওয়ার খবর যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রমিতকে প্রথম দুদিনে বেশ কয়েকবার টিভি ক্যামেরা ফেস করতে হয়েছে। প্রত্যেকবারই প্রবল। অস্বস্তি নিয়ে সে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিল। মিডিয়ার সামনে নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হয়েছিল তার।
সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রমিতের প্রশ্নোত্তরের পালাটা ছিল মোটামুটি এইরকম—
কারা মারল ওই তিনজনকে?
প্রমিত জানাতে বাধ্য হয়েছিল, এর উত্তর সে জানে না।
পরের প্রশ্ন–এই ঘটনার পরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কর্মীদের সুরক্ষার জন্যে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
প্রমিত বলেছিল, আপাতত আমরা নাইট-পেট্রোলিং বন্ধ রাখছি।
প্রমিতের এই উত্তর শুনে সাংবাদিকদের মুখগুলো বাঁকা হাসিতে ভরে গিয়েছিল। ছদ্ম বিনয়ের সঙ্গে তারা প্রশ্ন করেছিল তাহলে কি স্যার মাথায় যন্ত্রণা হলে মাথাটা কেটে ফেলাই একমাত্র রেমিডি? নাইট-পেট্রোলিং বন্ধ হয়ে গেলে বন্যপ্রাণীগুলোকে চোরাশিকারিদের হাত থেকে কে বাঁচাবে?
টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল প্রমিতের। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল–এই বনকে আমি আপনাদের থেকে কম ভালোবাসি না। গত দুবছর আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে এই জঙ্গলে দিন রাত পড়ে থেকেছি সে শুধু মাইনের টাকা কটার জন্যে নয়, ওই ভালোবাসার টানে। বলতে ইচ্ছে করছিল–যে তিনটে ছেলের খুন হওয়ার খবর পেয়ে আপনারা আজ এখানে এসেছেন, তাদের আমিই সারা ভারতের ফরেস্ট সার্ভিস থেকে বেছে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। রাতের পর রাত আমি ওদের সঙ্গে এই জঙ্গলের রাস্তায় গুঁড়ি মেরে হেঁটেছি, ওদের এই জঙ্গল চেনাবার জন্যে। একটা পাঁউরুটি ছিঁড়ে চারজনে ভাগ করে খেয়েছি; একই বোতল থেকে জল। একটা বোল্ডারে হেলান দিয়ে বসে চারজনে সারারাত রিভারবেডের ঘাসজমির দিকে চেয়ে থেকেছি, যাতে বন্য জন্তুরা নিরাপদে গ্রেজিং করে ভোরবেলা জঙ্গলে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব? এইভাবে যেখানে টেররিস্টরা নিখুঁত লক্ষে মানুষ মারছে, সেখানে রাতের পর ওদিকে কারুর পা ফেলা মানে তো আত্মহত্যা করা।
সেসব কিছুই বলেনি প্রমিত। সরকারি কর্মীর আচরণবিধি মেনে শান্ত থেকেছে। বলেছে, আর একটু সময় দিন আমাদের। এভরিথিং উইল কাম আন্ডার কন্ট্রোল।
বলেছে বটে এ কথা। কিন্তু সে নিজেও জানে না কেমন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে হরিণডুবি বিট-কে, বক্সা টাইগার রিজার্ভকে।
তবে গতকাল থেকেই প্রমিত বুঝতে পারছিল যে, মিডিয়ার কৌতূহল অনেক কমে এসেছে। স্বাভাবিক। এক খবর নিয়ে বেশিদিন বাণিজ্য হয় না।
প্রমিত আজ সকাল নটা নাগাদ নিজের মারুতি জিপসিটা নিয়ে জলপাইগুড়ি গিয়েছিল। গিয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলার ডেপুটি সুপারিন্টেডেন্ট অফ পুলিশ দেবেশ কাশ্যপের ফোন পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। দশটার মধ্যে দেবেশ কাশ্যপের বাংলোয় পৌঁছিয়ে গিয়েছিল প্রমিত। বাংলোতেই আসতে বলেছিলেন কাশ্যপসাহেব। সেখানেও তাঁর একটা অফিস আছে, ডিস্ট্রিক্টের। যে-কোনও বড় মাপের অফিসারের যেমন থাকে।
দেরাদুনের মানুষ দেবেশ কাশ্যপ নিজে একজন প্রকৃতি প্রেমিক। উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটা প্রকৃতি সংরক্ষণ উদ্যোগের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তাদের নানান ভাবে সাহায্য করেন। পোচারদের হাতে ফরেস্টগার্ডদের এই অসহায় মৃত্যু তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল, তাই তিনি নিজে থেকেই এই কেসটার তদন্তভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
প্রমিতের সঙ্গে দেবেশ কাশ্যপের আগে থেকেই যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রমিত ঘরে ঢোকা মাত্র তিনি সাদরে তাকে ডেকে বসালেন। জানালেন, গতকালই পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিকের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। সেসবের থেকে এমন কিছুই জানা যায়নি যা ঘটনাটার ওপর নতুন করে আলোকপাত করে। জানা জিনিসকেই ওইসব রিপোর্ট কনফার্ম করেছে মাত্র। যেমন হাই ভেলোসিটি বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে ওই তিনজনের। বুলেটগুলো এসেছে ভুটান সীমান্তের নো-ম্যান ল্যান্ডের দিক থেকে। প্রত্যেকের জন্যে একটাই বুলেট–যেন বুলেটের গায়ে বাবুয়া বিমলদের নাম লিখে পাঠানো হয়েছিল।
কাশ্যপ সাহেব চিন্তিত মুখে বলে চললেন বুঝলেন মিস্টার ব্যানার্জি, অ্যাকচুয়াল ওয়ারফেয়ারের সময় ফাইটার-প্লেন বম্বিং শুরু করার আগে মার্কার-প্লেন টার্গেটের কাছে উজ্জ্বল। আলোর বোমা ফেলে চলে যায়, যাতে বহুবারদের টার্গেটে হিট করতে অসুবিধে না হয়। ভেবেছিলাম এক্ষেত্রেও বাবুয়া কিম্বা সন্দীপদের ওপর কেউ জোরালো আলো ফেলেছিল; ওদের এক্সপোজ করে দিয়েছিল নদীর উলটোদিকে অপেক্ষা করে থাকা টেররিস্টদের কাছে। কিন্তু বোধহয় আমার সেই চিন্তা ঠিক ছিল না।
প্রমিত মাথা নীচু করে মন দিয়ে কাশ্যপ সাহেবের কথা শুনছিল। সে কোনও মন্তব্য করল না।
কাশ্যপ সাহেব বলে চললেন–ভেবেছিলাম ডেড বডিগুলোর আশেপাশে রিভারবেডের বালিতে পায়ের ছাপ পাব। বিশ্বাসঘাতকের পায়ের ছাপ। কিম্বা রঙমশালের মতন কোনও আলো ছড়ানো জিনিসের অবশিষ্টাংশ। কিন্তু না। কিচ্ছু পাইনি। আই ওয়াজ রং। আমার ট্রেইটর থিয়োরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
প্রমিত মুখ তুলে বলল, কিছু মনে করবেন না কাশ্যপ সাহেব। আপনি যদি বিমল, বাবুয়া আর সন্দীপের ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানতেন তাহলে শুরুতেই ট্রেইটর থিয়োরি নাকচ করে দিতেন।
একজন অর্ডারলি ট্রেতে করে দুটো প্লেটে আলুর পরোটা, সজি আর আচার নিয়ে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে ধূমায়িত চা। দেবেশ কাশ্যপ ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে বেরোবেন এবং বোঝাই যাচ্ছে প্রমিতকে না খাইয়ে তিনি ছাড়বেন না। প্রমিতেরও বেশ খিদে পেয়েছিল। সে বেশি ভদ্রতা না করে প্লেট টেনে নিল।
দেবেশ কাশ্যপ একটুকরো পরোটা মুখে পুরে বললেন, তাই! কেমন ছিল ওদের ব্যাকগ্রাউন্ড?
প্রমিত খেতে খেতেই বলে চলল–আমি আর চিফ কনজার্ভেটর অফ ফরেস্ট অরিন্দম বসু সারা ভারতের ফরেস্ট সার্ভিস ক্যাডার থেকে খুঁজে খুঁজে ওই তিনজনকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা ছিল যাকে ইংরিজিতে বলে হ্যান্ড-পিক।
বাবুয়াকে নিয়ে এসেছিলাম মধ্যপ্রদেশ থেকে। ওর আসল নাম ছিল বাবুলাল মুন্ডা। বস্তারের একটা জঙ্গলঘেরা গ্রামেই ও জন্মেছিল। জঙ্গলকে তাই ও হাতের পাতার মতন চিনত। জঙ্গলের ভেতরে ওর চলাফেরা ছিল ঠিক চিতাবাঘের মতন দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দ। কানহার জঙ্গলে পোচারদের সঙ্গে বাবুয়ার যুদ্ধটা ছিল প্রায় একার যুদ্ধ। ফরেস্ট সার্ভিসের লোকেরাও অনেকে পয়সার লোভে পোচারদের সাহায্য করত। তবু লড়াইটাতে বাবুয়াই জিতছিল।
সন্দীপ সিং ইউ পির ছেলে কুমায়ুনের। করবেট ন্যাশনাল পার্কের পোচাররা শুধু সন্দীপকে খুন করবার জন্যেই তিন তিনবার স্টাফ কোয়ার্টারে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সন্দীপকে খুন করা তো দূরের কথা, ওকে দেখতে পাওয়াও অসাধ্য ব্যাপার ছিল। পোকামাকড়ের মতন ক্যামুফ্লেজিং জানত সন্দীপ। গাছের গুঁড়ির গায়ে কিম্বা শুকনো পাতার স্কুপের মধ্যে চোখের পলক ফেলবার আগে হারিয়ে যেত ও। অনুসরণকারীরা সন্দীপের অবস্থান টের পেত অনেক দেরিতে। ততক্ষণে সন্দীপের রিভলবারের বুলেট তাদের পিঠে ঢুকে গেছে।
আর বিমল? বিমল বর্মনকে খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হয়নি। ও ছিল কাজিরাঙায়। বিমলের স্পেশালিটি ছিল বুশ-ক্র্যাফট। একটা ভাঙা গাছের ডাল কিম্বা মাড়িয়ে যাওয়া পাতার। চিহ্ন ধরে কেউটে সাপের মতো বুকে হেঁটে এগিয়ে যেত বিমল। তাকে ফলো করত বাকি ফরেস্ট গার্ডরা। আর এইভাবে একসময় ওরা ঠিক পৌঁছে যেত চোরা শিকারিদের কোনও লুকনো ডেরায়। অতর্কিত আক্রমণে পাকড়াও করে ফেলত তাদের। চোরাশিকারিদের পেতে রাখা লুকনো ফাঁদ বা বুবি ট্র্যাপ খুঁজে বার করার কাজেও বিমলের এই আশ্চর্য বুশ-ক্র্যাফট কাজে লাগত। বিমল যেন গন্ধ শুঁকেই বার করে ফেলত কোথায় গভীর গর্তের ওপর লতাপাতার পাতলা আস্তরণ বিছিয়ে ওরা তৈরি করেছে হাতি মারার মরণফাঁদ কিম্বা কোথায় বাঘের যাতায়াতের পথে গাছের ডালের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা আছে লুকনো বন্দুকের ট্রিগার যাতে পা দিলেই গুলি ছুটবে আর মুখ থুবড়ে পড়বে বনের রাজা। এমন কত ফাঁদ যে খুঁজে বার করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে বিমল, কত বন্যপ্রাণী যে ওর জন্যে পুরো আয়ুটা জুড়ে বেঁচে থাকতে পেরেছে, তার হিসেব নেই।
পেপার ন্যাপকিনে আঙুলের ডগাগুলো মুছে নিয়ে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল প্রমিত। তারপর বলল, বুঝতেই পারছেন কাশ্যপসাহেব, এই তিনজনকে জঙ্গলের রাস্তায় অনুসরণ করা মানে আত্মহত্যা করা। যে কাজ শঙ্খচূড় সাপে পারেনি, হাতিতে পারেনি, চিতাবাঘে পারেনি, সে কাজ কেমন করে কোনও মানুষে পারবে বলুন তো?
ওদের খুন করবার একমাত্র উপায় ছিল যেভাবে করা হয়েছে ঠিক সেইভাবেদূর থেকে, অন্ধকারের আড়াল নিয়ে, কাপুরুষের মতন। না, কাশ্যপসাহেব, কোনও ট্রেইটর ওদের ধারে কাছে ছিল না। এমন কি, যে লোকটা রিভারবেড়ে দাঁড়িয়ে ফাঁকা বুলেটের আওয়াজ করেছিল, সে-ও যে বহু আগেই চম্পট দিয়েছিল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ওরা পৌঁছনো অবধি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বিমল বাবুয়াদের হাত থেকে সে বাঁচত না। আমরা তখন একটাই লাশ পেতাম, তিনটে নয়।
দ্যাটস্ ট্রু। এনি ওয়ে, আমরা কিন্তু সেই কানা গলিতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনও ব্রেক থ্র পেলাম না। চিন্তিত মুখে বললেন কাশ্যপ সাহেব। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, মিস্টার ব্যানার্জি! আপনার সেই রিসর্ট-ওয়ালির কী খবর? মিসেস বিনতা মেহরা?
আমার রিসর্ট-ওয়ালি বলবেন না স্যার, প্লিজ। মুখটা তেঁতো করে বলল প্রমিত। বিনতা মেহরা যে জগতে চলাফেরা করে, তার দশমাইলের মধ্যে পৌঁছবার ক্ষমতা এই সামান্য সরকারি চাকুরে প্রমিত ব্যানার্জির নেই। আর তার সে ইচ্ছাও নেই।
মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কিন্তু তাকে তো প্রমিত ব্যানার্জির কাছে আসতে হয়েছিল। আর একটা ইনফর্মেশন আপনাকে দিয়ে রাখি। বিনতা মেহরার অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে একটা হল, সে আদমখোর। মানুষখেকো। পুরুষমানুষ অবশ্যই। হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান দেখলে বিনতা তার জাতপাত, অর্থগৌরব কিছু দেখে না। আপনি বিনতাকে পছন্দ নাও করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে ওর অপছন্দ হবার কোনও কারণ দেখছি না।
প্রমিত দেবেশের কথায় হাসতে পারল না। ব্যাজার মুখে বলল, ওনার কাজটা করে দেওয়ার জন্যে প্রচন্ড পলিটিকাল প্রেসার আসছে। তবে যতক্ষণ চিফ কনজার্ভেটরের চেয়ারে অরিন্দম বসু আছেন, আর এখানে আপনি আছেন, ততক্ষণ মিসেস মেহরার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু আমরাই যদি না থাকি?
কাশ্যপসাহেবের কথায় অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল প্রমিত। মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কি জানেন তো মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি যাদের ওপর ভরসা করছেন তাদের পারচেজ হয়তো করা যায় না, কিন্তু সরিয়ে দেওয়া তো যায়? যে গভর্মেন্ট-সার্ভেন্ট পথের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার এফিসিয়েন্সির ওপরে একটা কালো দাগ লাগিয়ে তাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেওয়াটা ইন্ডিয়ায় খুব পপুলার গেম। বিনতা মেহরাদের মতন লোকেরা এই খেলাটা খুব ভালো জানে। আর সেই কিস্তিমাতের লক্ষেই বোড়ের একটা চাল হয়তো তিনজন ফরেস্টগার্ডের মৃত্যু।
কথাটা উড়িয়ে দিতে পারল না প্রমিত। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিডিয়ার অস্বাভাবিক মাতামাতির কথা। কলকাতার কাগজগুলো কেমন করে সেদিন ওই রিমোট জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটার কথা অত তাড়াতাড়ি জানতে পেরেছিল? কেউ কি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওদের টিপস দিয়েছিল? সম্ভব, সবই সম্ভব।
ওদের ব্রেকফাস্ট হয়ে গিয়েছিল। পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিক রিপোর্টের একটা করে কপি ব্রাউন খামে ভরে প্রমিতের হাতে তুলে দিলেন দেবেশ কাশ্যপ। তারপর হ্যাঁঙ্গার থেকে নিজের ইউনিফর্মের টুপিটা নিয়ে মাথায় ঠিক করে বসাতে বসাতে আগের কথার সূত্র ধরেই বললেন, আমি কিন্তু সন্দেহের আওতা থেকে ওই মহিলাকে বাদ দিচ্ছি না মিস্টার ব্যানার্জি। এই জঙ্গলে যদি টেররিস্টদের সাহায্যকারী কেউ থাকে, তাহলে এভরি পসিবিলিটি যে সেটা ওই মহিলা। বিকজ শী হ্যাঁজ হেভি স্টেক ইন দ্যা অ্যাফেয়ার।
বাংলো থেকে বেরিয়ে দেবেশ কাশ্যপ আর প্রমিত ব্যানার্জি যে যার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের গাড়িতে ওঠার আগে কাশ্যপ নীচু স্বরে প্রমিতকে বললেন, যদি সন্দেহজনক কিছু দ্যাখেন বা শোনেন, তা হলে আমাকে ওভার ফোন জানাবেন।
নিশ্চয়ই। বলল প্রমিত। তারপর সে নিজের জিপসি জিপের দরজা খুলে ভেতরে উঠে বসল। জিপসি রওনা দিল আলিপুরদুয়ারের দিকে। লম্বা সফরটার বেশিরভাগ জুড়ে তার মাথার মধ্যে খেলা করতে থাকল কাশ্যপ সাহেবের ঢুকিয়ে দেওয়া সন্দেহটা।
বিনতা মেহরা…বিনতা মেহরা! সত্যিই কি ওই সুন্দরী মহিলাটির এই হত্যালীলায় কোনও হাত আছে? সে-ই কি নাচাচ্ছে মিডিয়াকে?
প্রমিতের মনে পড়ে গেল, মাত্রই পনেরো দিন আগে ওই মহিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের কথা।
.
০৩.
সেদিন প্রমিত বিনতা মেহরাকে চোখে দেখার আগে তার শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেয়েছিল।
ভোরবেলা আলিপুরদুয়ারের প্রান্তসীমার নির্জন এক মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতন ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ সেরে, ততোধিক নির্জন রাস্তা ধরে নিজের কোয়ার্টারে ফিরছিল প্রমিত। তার। পরিধানে ছিল দুধ সাদা টি-শার্ট আর গাঢ় নীল টেনিস-শর্টস্। ব্যায়ামের পরে তখন তার শিরায় শিরায় জোরদার রক্ত সঞ্চালন, ফলে মেজাজ ছিল ফুরফুরে। বড় বড় স্টেপ ফেলে হাঁটতে হাঁটতে প্রমিত শুনছিল রাস্তার দুপাশের বিশাল বিশাল গাছগুলোর ডালপালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা অজস্র পাখির বৃন্দগান। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিল সে–তাজা অক্সিজেনের জন্যে তো বটেই, তবে তার চেয়েও বেশি শিশু ফুলের গন্ধের জন্যে। রাস্তার ধারের দানবাকৃতি শিশু গাছগুলোয় ফুল এসেছিল। ঈশ্বরের প্রসাধনীর মতন গুঁড়ো-গুঁড়ো মিহি সবুজ ফুলে ছেয়েছিল গাছতলা।
কিন্তু রাস্তা থেকে নিজের বাড়ির বারান্দায় পা দেওয়া মাত্র অন্য এক অচেনা গন্ধের ধাক্কায় প্রমিতের বুক থেকে ফুলের গন্ধ মুছে গেল। অবাক প্রমিত বুঝতে পারল সেই সুগন্ধ ভেসে আসছে তারই পরদাফেলা ড্রইংরুমের অন্দর থেকে।
পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকল প্রমিত। সোফায় এক বছর পঁয়ত্রিশের দীর্ঘাঙ্গী মহিলা বসেছিলেন। প্রমিতকে দেখে তিনি কেবল হাতের ওয়াইল্ডলাইফ ম্যাগজিনটা কোলের ওপর ভাঁজ করে রাখলেন, আর কিছু না।
নমস্কার করলেন না। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন না। প্রমিতের ঘরে তার উপস্থিতির কোনও ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না। শুধু চর্চিত হাস্কি গলায় জিগ্যেস করলেন, আপনি ডি এফ ও, মিস্টার ব্যানার্জি?
তার প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই প্রমিত একটা জিনিস খেয়াল করেছিল–মহিলার অঙ্গে সেই মুহূর্তে যত টাকার জিনিস ছিল তত টাকা অনেক মধ্যবিত্ত সারা জীবন চাকরি করে জমাতে পারে না। সোনালি জরির কাজ করা ঘিয়ে সিল্কের শাড়িটার দাম সে আন্দাজ করতে পারল না, তবে মহিলার হাতে, কানে এবং আঙুলে যে রত্নপাথর আর প্লাটিনামের হালকা গয়না গুলো আছে সেগুলোর দাম সব মিলিয়ে লাখ পাঁচেক টাকার কম হবে না। বাঁ-হাতের মুঠোয় আলতো করে ধরে রাখা ওয়েফার থিন মোবাইলটার দামও নিঃসন্দেহে লাখের ঘরে। ঘড়ির ব্র্যান্ডটা দূরে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝতে পারল না প্রমিত, তবে তার ডায়াল এবং স্ট্র্যাপে গাঁথা হিরেকুচির ঝলক তার চোখ এড়ালো না। আর সোফায় নামিয়ে রাখা হোয়াইট লেদারের পার্স আর পায়ের কাছে খুলে রাখা একই রঙের স্লিপার, দুটো জিনিসের ওপরেই ক্রিশ্চিয়ান ডিয়রের পৃথিবীবিখ্যাত লোগগা। শুধু ওই দুটো জিনিসের দামে একটা ভারতীয় মোটরগাড়ি কেনা যায় মনে মনে ভাবল প্রমিত।
আরেকটা জিনিসও না ভেবে পারল না প্রমিত, মহিলা কাকে দেখাবার জন্যে এই জনবিরল মফস্বলে এত সাজগোজ করে বেরিয়েছেন? যে সাজ পার্কস্ট্রিটের সন্ধেবেলায় চলে তা কি আলিপুরদুয়ারের ভোরবেলায় পরা যায়!
একেই ইংরিজিতে বলে স্টিংকিং রিচ। এনার গা থেকে পয়সার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, এবং রুচিহীনতার সেই দুর্গন্ধ শানেল ফাইভের সুগন্ধেও ঢাকা যাচ্ছে না।
প্রমিত খেয়াল করল মহিলার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। বাঁকা হাসি। হাসিটার মানে বুঝতে অসুবিধা হল না প্রমিতের। কোনও শিকারি যখন একইসঙ্গে নিজের সাফল্যের আনন্দ আর নিহত শিকারের প্রতি করুণায় হাসে, তখন দুরকম হাসি মিশে গিয়ে এই হাসিটা তৈরি হয়। এই মহিলা যিনিই হন, ইনি প্রমিতকে তার সামনে এরকম বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছেন সেও তার নিত্য নতুন শিকারের তালিকায় এক নতুন সংযোজন, আর ওনার এই ভাবনাটা শুধু পয়সা থেকে আসছে না। পয়সা ছাড়াও ওনার অন্য অস্ত্র আছে। ওনার যৌবন। সে যৌবনে হয়তো সামান্য ভাটার টান লেগেছে, তবুও তা মোহিনী। আর সেটা উনি বিলক্ষণ জানেন। স্বেচ্ছাস্থলিত আঁচলের আড়াল থেকে জেগে থাকা বুকের গভীর খাঁজ, স্লিভলেস ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে থাকা দুই সুডৌল বাহু এবং নাভি থেকে নীবিবন্ধ অবধি বিস্তৃত মাখনরঙের উপত্যকা–এই সবই ওনাকে আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। উনি আলুলায়িত ভঙ্গিতে বসে এই মুহূর্তে শরীরের সেই মাদক মানচিত্রের ওপর প্রমিতের চোখের দ্রুত নড়াচড়া দেখছেন, উপভোগ করছেন। ভাবছেন প্রমিত ঘায়েল হয়েছে।
কিন্তু সেই ভাবনাটা ভুল। আকর্ষণ নয়, প্রমিতকে প্রথম থেকেই ওনার উপস্থিতি বিকর্ষণ করছিল। ভালো লাগছিল না প্রমিতের। কেন, তা সে ঠিক বলতে পারবে না। হয়তো ওনার নিজের সম্বন্ধে অত্যন্ত নিশ্চিত ভঙ্গিটাই এর কারণ, কিম্বা পয়সা দেখানোর নির্লজ্জ ধরণটা।
যাই হোক, ওনার এই আত্মবিশ্বাসটা ভেঙে দেওয়া দরকার–প্রমিত ভাবল।
সে তাই উলটোদিকের সোফায় বসে সকালের নিউজপেপারটা হাতে তুলে নিল, তারপর সেটাকে মুখের সামনে মেলে ধরল। সেই অবস্থাতেই নিস্পৃহ গলায় জবাব দিল, হ্যাঁ, আমিই ডি এফ ও, প্রমিত ব্যানার্জি। আপনার পরিচয়টা? কাগজের আড়াল থেকেও প্রমিত অনুভব করতে পারছিল ভদ্রমহিলার মুখের ভাব কত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
ডেলিবারেট অপমানটা সামলাতে একটু সময় নিলেন ভদ্রমহিলা, তবে একটুই। বোঝা যায় প্রতিদিন বহু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সামলে উনি অভ্যস্ত। বড় জোর দশ সেকেন্ড চুপ করে থেকে তারপর উত্তর দিলেন, আমি বিনতা মেহরা। আমার নাম আপনি শুনে থাকবেন। মারমেড বিজনেস গ্রুপ..ওটা আমাদেরই। আমার স্বামী অতুল মেহরা ছিলেন ওই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা।
পরিচয়টা শুনে প্রমিত মনে মনে একটু সচকিত হলেও শরীরী ভাষায় সেটাকে ফুটে উঠতে দিল না। একইভাবে কাগজটা মুখের সামনে ধরে রাখল। মারমেড গ্রুপের নাম কে না জানে? হেৰ্থ-চেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইমপোর্ট এক্সপোর্ট, হোটেল, এবং সর্বোপরি কনস্ট্রাকশন বিজনেস–বহু ব্যবসার মালিক ওই গ্রুপ। অতুল মেহরা নামটা বছর দুয়েক আগে অবধি খবরের কাগজে প্রায় রোজই দেখা যেত। ছবিও কখনও সিএম-এর সঙ্গে, কখনও পি এম-এর। তারপরেই মারা যান ভদ্রলোক। কিন্তু প্রমিত যতদূর মনে করতে পারছে, তিনি তো মারা গেছেন বেশ বুড়ো বয়সেই। সত্তরের ওপরে বয়েস হয়েছিল। ইনি তো তাহলে সেই বৃদ্ধের তরুণী ভায্যাই ছিলেন দেখা যাচ্ছে।
আমি একটু অফিসিয়াল কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম।
মুখের সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে প্রমিত দেখল ইতিমধ্যে বিনতা মেহরা সোজা হয়ে বসেছেন। আঁচল টাঁচলও যথাস্থানে ফিরে এসেছে। প্রমিত তার চোখে চোখ রেখে বলল, অফিসিয়াল কাজ? তাহলে বাড়িতে কেন? দশটার পর অফিসে আসবেন।
প্লিজ, ব্যানার্জি সাহেব। নটায় বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট। আমাকে আজ কলকাতায় পৌঁছতেই হবে। সেইজন্যই বাধ্য হয়ে আপনাকে বাড়িতে ডিস্টার্ব করলাম। তাছাড়া আমাদের কথার মধ্যে এমন কিছু প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে, যেগুলো অফিসের কলিগদের সামনে বলাটা মুস্কিল হবে।
প্রমিত স্বভাবতই ভদ্রলোক। বেশিক্ষণ অভদ্রতা করতে পারে না। তার ওপর ভদ্রমহিলা অল্প দু-একটা কথাতেই তার মনে কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সে বলল, বেশ বলুন, কী বলবেন।
বিনতা মেহরা প্রথমে একটা অত্যন্ত দামি কাগজে ছাপা ব্রশিওর প্রমিতের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি জানেন নিশ্চয়ই, মারমেড বিজনেস গ্রুপের নানান ফিল্ডে ব্যবসা আছে। তার মধ্যে একটা হল হোটেলের ব্যবসা। আমাদের স্টার হোটেল সারা ভারতের সবকটা বড় সিটিতেই ছড়ানো আছে। এমনকি দুবাই আর সিঙ্গাপুরেও আমাদের হোটেল রয়েছে। এই ব্রশিওরটায় আপনি সেগুলোর ডিটেইলস্ পাবেন।
প্রমিত ব্রশিওরটা উলটেপালটে দেখে একটু অবাক হয়েই বলল, কিন্তু আমার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?
সেটাই এক্সপ্লেন করছি। রিসেন্টলি আমরা একটা নতুন ভেঞ্চারে নেমেছি। আমরা না বলে আমি বলাই ভালো। কারণ, মারমেডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে আমার আত্মীয়েরা থাকলেও হেমিংওয়ে টুরর্স-এর মালিকানা আমার নিজের। হ্যাঁ, আমার নতুন প্রোজেক্টের নাম দিয়েছি হেমিংওয়ে ট্যুর। ভালো হয়নি? আমার এক প্রফেসর বন্ধু আছেন, বাঙালি। উনিই নামটা সাজেস্ট করলেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে না কি খুব জঙ্গল ভালোবাসতেন।
ও, এটা কি জঙ্গলের সঙ্গে রিলেটেড কোনও প্রোজেক্ট না কি?
এগজ্যাক্টলি মিস্টার ব্যানার্জি। আপনি ঠিক ধরেছেন। এইজন্যে বাঙালিদের আমি এত ভালোবাসি। এত শার্প দিমাগ হয় আপনাদের। আমার বন্ধুদের মধ্যে মেজরিটিই বাঙালি।
প্রমিত বুঝতে পারছিল না এর মধ্যে শার্প দিমাগের কি দেখলেন বিনতা মেহরা। তবে তেল দেওয়ার চেষ্টাটা সে দিব্যি বুঝতে পারছিল, এবং সেইজন্যেই আশঙ্কিতও হচ্ছিল। কি জানি এর পরে কী ধরনের রিকোয়েস্ট আসবে। সে চুপ করে থেকে বিনতাকে কথা বলে যেতে দিল। বিনতা বলে চললেন–
অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ব্যাপারটা নিশ্চয় আপনি জানেন। আফটার অল, জাঙ্গল ইজ ইয়োর ব্রেড অ্যান্ড বাটার। হেমিংওয়ে ট্যুরিজম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর কন্ডাক্ট করে। আমাদের মেজরিটি ক্লায়েন্টস হল ফরেনার্স। তাদের আমরা ভারতের বনে, জঙ্গলে, দুর্গম পাহাড়ে, অজানা সমুদ্রতটে বেড়িয়ে আনি। দে ডু নট সিক কমফর্টস্। ওরা শুধু অ্যাডভেঞ্চার চায়। নির্জন তুষারপ্রান্তরে তাঁবুর মধ্যে শুয়ে কল্পনা করবে, তাঁবুর বাইরে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে ইয়েতি। ব্রিটিশ আমলের পরিত্যক্ত ফরেস্ট বাংলোয় রাত্রিবাস করবে; বাঘের গর্জনে মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যাবে। এইরকম সব খেয়াল আর কি।
প্রমিত একটু একটু আন্দাজ করতে পারছিল বিনতা মেহরা কোনদিকে কথাটিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
একটু চুপ করে থেকে বিনতা সরাসরি সেই প্রসঙ্গে চলে এলেন ব্যানার্জি সাহেব। আপনার এই বক্সা প্রোজেক্টের সীমানায় এমন একটা জায়গা রয়েছে যেটার মতন অপূর্ব অ্যাডভেঞ্চার স্পট আর হয় না। ঘন জঙ্গল আর নদীর মাঝখানে টিলার মাথায় প্রাচীন কেল্লা। সামনে ওয়াটার হোল। সেখানে সন্ধেবেলা হাতি, গউর, সম্বর-হরিণ অ্যান্ড ওয়াইল্ড বোরস্ সবাই জল খেতে আসে। রাত নামলে এমন নিঃশব্দ হয়ে যায় চারিদিক যে, গাছের পাতা খসে পড়ার আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যায়। অ্যান্ড অ্যাবাভ অল, দেয়ার ইজ আ মিথ–ওই কেল্লাটাকে ঘিরে একটা অদ্ভুত লোককথা চালু আছে যে, একদিন ওই কেল্লার রাজা আবার ফিরে আসবেন। সেই রাজা, যিনি মারা গেছেন আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, তাই না? মাই ক্লায়েন্টস উড পে এনিথিং…জাস্ট এনিথিং ফর হ্যাঁভিং চান্স টু স্পেন্ড আ নাইট দেয়ার। মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি আমাকে ওই শিরোমণির গড়ে একটা হোটেল খোলার ব্যবস্থা করে দিন। বড় কিছু নয়, জাস্ট কটেজেস।
প্রমিতের হতবাক মুখের দিকে চেয়ে মাঝখানেই কথা থামিয়ে দিয়েছিলেন বিনতা মেহরা। তারপর আস্তে আস্তে জিগ্যেস করলেন, কী হল মিস্টার ব্যানার্জি? আমি কি অ্যাবসার্ড কোনও প্রোপোজাল দিয়েছি?
নিজেকে সামলাতে পারেনি প্রমিত। ক্রোধে আর ঘৃণায় হিস হিস করে উঠেছিল তার গলার স্বর। সেইভাবেই বলেছিল–অ্যাবসার্ড কথা বলেছেন কি না সেটা আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না? আপনি জানেন না, বক্সা একটা ন্যাশনাল পার্ক, এর সীমানার অংশটুকু বাদ দিলে, বাকি যে কোনও জায়গায়, যে-কোনও রকমের কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি আইনত নিষিদ্ধ? আপনি জানেন না, একসময়ে ওই বনের মধ্যে ডলোমাইটের খনি ছিল, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তী গ্রাম অবধি রেললাইন ছিল, তাও একই কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইসব বড় বড় প্রোজেক্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, আর আজ আপনি ফরেনার্সদের সার্কাস দেখাবার জন্যে সেই জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলতে চাইছেন! সাহস তো কম নয় আপনার!
কিন্তু আমি তো যতদূর জানি, শিরোমণির গড় ফ্রিঞ্জ এরিয়ার মধ্যে পড়ছে। ওসব জায়গায় বিজনেস-অ্যাক্টিভিটি বারণ নয় তো?
বারণ নয়, বাট ইন রেস্ট্রিক্টেড ম্যানার। নিয়ন্ত্রিতভাবে বিজনেস অ্যাক্টিভিটি চলতে পারে। তাও, সেইসব ব্যবসা যেগুলো ইকো-ফ্রেন্ডলি। যেগুলোর মধ্যে দিয়ে লোকাল পিপলের কিছু লাভ হয়। আর আপনি যা করতে চাইছেন তা তো স্ট্রেটওয়ে বনকে ধ্বংস করা।
তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। শিরোমণির গড় সম্বন্ধে লোকাল পিপলের মনে স্ট্রং সেন্টিমেন্ট কাজ করে–জানেন সে কথা? ওটা ওদের কাছে তীর্থস্থান। কোনওভাবেই ওই জায়গার…
বিনতা মেহরা প্রমিতকে তার কথার মধ্যে বাধা দিয়ে বললেন, ফরগেট বাউট লোকাল পিপল। ও ব্যপারটা আমি দেখে নেব।
তার মানে? প্রমিত বিনতার মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইল।
এই পৃথিবীতে সমস্ত কিছুই পারচেজেবল মিস্টার ব্যানার্জি। তীর্থস্থানও তার বাইরে পড়ে না। নাউ টেল মি অ্যাবাউট ইয়োর প্রাইস-সিলিং।
অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে প্রমিত বিনতার দিকে চেয়ে রইল। এই মহিলা কি জানেন, ইনি কী বলছেন?
বিনতার মধ্যে অবশ্য কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি এমন একটা খেলা খেলছেন যে খেলায় সম্ভবত আজ অবধি তিনি কখনও হারেন নি। তাই চোখের পাতাটি অবধি না ফেলে, অত্যন্ত সহজ সুরে তিনি বললেন, আপনাকে আমি এই প্রোজেক্ট থেকে যা ইনকাম হবে স্ট্রেট অ্যাওয়ে তার টেন পার্সেন্ট দেব। মাসে এক লাখের কম হবে না।
গেট আউট!
আরও বেশি দিতে পারতাম, কিন্তু আপনাদের এখানকার সবকটা রাজনৈতিক দলের নেতারা বখরা চেয়ে বসে আছে। তবে আমি বলছি, দুবছরের মধ্যে দ্যা অ্যামাউন্ট উইল বি ডাবল।
আই সে গেট আউট!
মার্কামারা হাস্কি গলায় বিনতা বললেন, উত্তেজিত হচ্ছেন কেন মিস্টার ব্যানার্জি? আপনাকে দিয়ে কাজটা না হলে অন্য কাউকে দিয়ে করাব। মাঝখান থেকে আপনি একটা হ্যান্ডসাম অফার মিস করবেন। ভেবে দেখুন।
আমিও আপনাকে বলে দিচ্ছি মিসেস মেহরা, আজকের পরে আর কোনদিন বক্সা টাইগার রিজার্ভের বাউন্ডারির মধ্যে আপনাকে দেখতে পেলে ট্রেসপাসিং-এর জন্যে ফাটকে পুরে দেব। নাউ, গেট লস্ট।
শান্তভাবেই সোফা ছেড়ে উঠে বিনতা মেহরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রমিত অবাক হয়ে দেখল, তিনি গেটের সামনে পৌঁছন মাত্র যে সাদা টয়োটা-টা রাস্তার বাঁক ঘুরে তার সামনে এসে দাঁড়াল, সেটা তার খুব চেনা। এখানকার এক পাওয়ারফুল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে সে ওই গাড়িটায় চড়ে ঘুরতে দেখেছে।
সেদিনই প্রমিত বুঝতে পেরেছিল, শিরোমণির গড়ে হোটেল বানানোর স্কিমটা বিনতা মেহরা খুব সহজে ছাড়বে না। লড়াইটা সে চালিয়ে যাবে, কারণ তার পেছনে সৈন্যদল রয়েছে।
আর প্রমিত জানে না সে পেছনে কতজনকে পাবে, কতজন শিবির বদলে চলে যাবে উলটোদিকে। এ দেশে সরকারের পক্ষ নিয়ে লড়তে গেলে যেমনটা হয়।
হঠাই প্রমিতের জিপটা প্রচন্ড দুলে উঠল। সেই ঝাঁকুনিতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল প্রমিত। দেখল জিপ ডিমা নদীর শুকনো খাত পেরোচ্ছে। এখন এই হেমন্তের শেষে নদীর বুকে একফোঁটাও জল নেই। নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে জিপ। তবে বর্ষার ফ্ল্যাশ ফ্লাডে এই শুকনো নদীরই যে কি রূপ হয়, তা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন অনতিদূরে বালির চড়ায় সার সার কয়েকটা কংক্রিটের থাম দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই থামগুলোর মাথায় কয়েকবছর আগেও একটা ব্রিজ ছিল। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমিত রাজাভাতখাওয়ায় পৌঁছে গেল। তিন বছর আগে, প্রথম দর্শনেই, আরণ্যক এই ছোট্ট শহরটার শান্ত রূপ প্রমিতকে মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতা আজও তার কাটে নি। শহরে ঢুকবার একটু আগে রাস্তা আর রেললাইনের মাঝখান দিয়ে একটা ছোট ঝোরা বয়ে চলে, নাম চৈতন্যঝোরা। যাতায়াতের পথে প্রত্যেকবারই প্রমিত জিপ থামিয়ে ওই ঝোরার ধারে একটা বড় পাথরের ওপর কিছুক্ষণ বসে। তাকে ঘিরে ল্যানটানা আর বন-ধুতরোর ঝোপে মধ্যে কলকল করে ঘুরে বেড়ায় বুলবুলি পাখির ঝাঁক। পাথরে ধাক্কা খেয়ে চৈতন্যঝোরার জল শিরশির শব্দে বয়ে যায়। প্রজাপতিরা নির্ভয়ে গায়ে মাথায় এসে বসে। সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মন থেকে ধুয়ে চলে যায়।
প্রমিতের ড্রাইভার অশোক রাই নেপালি ছেলে, তবে শিলিগুড়িতে জন্ম এবং কর্ম বলে জলের মতন বাংলা বলে। প্রমিতের এই জায়গাটা সম্বন্ধে অনুরাগের কথা সে জানে। চৈতন্যঝোরার কাছে এসে সে ঘাড় ঘুরিয়ে জিগ্যেস করল, দাঁড়াব স্যার?
দাঁড়া। প্রমিত জিপের দরজা খুলে মাটিতে পা দিয়ে মাথার ওপর দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল।
ঠিক তখনই দুজন লোক একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
.
০৪.
আলিপুরে আপনার অফিসে গিয়ে শুনলাম জলপাইগুড়ি গেছেন। জানি, এই পথ দিয়েই ফিরবেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম। দুজনের মধ্যে যে ছেলেটির বয়েস একটু বেশি, সে এগিয়ে এসে কথাগুলো বলল। বলল, প্রমিতের প্রায় গায়ের ওপর দাঁড়িয়ে। দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর চোখের চাউনিতে পরিষ্কার ঔদ্ধত্য ফুটে বেরোচ্ছে।
ছেলেটিকে প্রমিত খুব ভালো করে চেনে। ওর নাম মধু…মধু বর্মন।
যে-কোনও রিজার্ভ ফরেস্টেরই দুটো ভাগ থাকে–একটা ফ্রিঞ্জ-এরিয়া বা প্রান্তিক অঞ্চল, আরেকটা কোর-এরিয়া বা কেন্দ্রীয় অঞ্চল। বক্সা টাইগার রিজার্ভও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু পাখি, হরিণ, বাঁদর, আর ছিটকে আসা হাতির পাল ছাড়া বক্সার প্রান্তিক অঞ্চলে বিপন্ন প্রজাতির বণ্যপ্রাণী বিশেষ থাকে না। তাই বনদফতর এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিতভাবে কিছু মানুষকে বসবাস আর কৃষিকাজের সুযোগ দেয়। যে আসে তাকেই যে দেয় এমন নয়। তাদেরই দেয়, যারা বনদফতর তৈরি হবার আগে থেকে তো বটেই, ভারতরাষ্ট্র তৈরি হবারও অনেক আগে থেকে, হয়তো রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকেই পুরুষানুক্রমে এই অরণ্যে বসবাস করে আসছে। সারা ভারতের সমস্ত বনভূমিতেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এমন বনবাসীদের অস্তিত্ব রয়েছে। আর্য ঋষিদের রচিত মহাকাব্যগুলোতে এদেরই কিরাত, রাক্ষস প্রভৃতি নামে দেগে দেওয়া হয়েছে। বনবাসকালে আর্য রাজকুমারদের প্রধান প্রমোদ তথা কর্তব্য ছিল এই অনার্য কিরাত বা রাক্ষসদের নিধন করা।
মধু বর্মন এমনই এক আরণ্যক গ্রামের অধিবাসী। বক্সার ফ্রিঞ্জ এরিয়ায় ঘন শালবনে ঢাকা সেই গ্রামটার নাম বেশ অদ্ভূত–চকচকি। কে জানে, ওই নামের মানে কী।
টাইগার রিজার্ভের প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এরকম দশ বারোটা গ্রামে সাকুল্যে হয়তো সাত আট হাজার নারী পুরুষ বাস করে। প্রমিত তাদের সামান্য কয়েকজনকেই চেনে। কারণ তারা স্বভাবতই লাজুক, সঙ্কুচিত। চিতল হরিণের মতই তারা গাছপালার আড়াল থেকে ভীত চোখে ভদ্রলোকেদের লক্ষ্য করে। ভদ্রলোকেদের হাতে অনেক পুরুষ ধরে সয়ে আসা অত্যাচার তাদের ওইরকম ব্যবহারই শিখিয়েছে।
যে তাদের হয়ে সামনে আসে, সে ওই মধু বর্মন।
মধু বর্মন নিজের গুণেই বনবাসী মানুষদের নেতা হয়ে উঠেছে। গত দুবছরের মধ্যে প্রমিত অনেকবার তাকে তার জাতের লোকেদের হয়ে বনদফতরের অফিসে দরবার করতে দেখেছে। কখনও জঙ্গলে শালপাতা কুড়োবার সময়সীমা বাড়াবার জন্যে দরবার করতে এসেছে, আবার কখনও হাতিতে ফসল খেয়ে গেলে ক্ষতিপূরণ চাইতে এসেছে। ছেলেটা ছোটবেলায় জলপাইগুড়ির একটা মিশনারি স্কুলে মাধ্যমিক অবধি লেখাপড়া করেছিল, তাই ইংরিজি আর হিন্দি দুটো ভাষাতেই ভালো লিখতে পড়তে পারে। সেই বিদ্যা দরখাস্ত লেখার সময়ে বা ফরেস্টের অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার সময়ে কাজে আসে। ফলে আরণ্যক গ্রামের মানুষদের লিডার হতে মধুর সময় লাগেনি।
প্রমিতের যেটা খারাপ লাগে সেটা হল, নিজের এই বিশেষ অবস্থানের ফায়দাটা মধু বর্মন পুরোদস্তুর তুলে নিচ্ছে। সাত-আট হাজার মানুষ, আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে সাত আট হাজার ভোট মেশিনের বোতামে রাখা আঙুল, মধুর কথায় নড়ে-চড়ে। এই সত্যটা জানে বলেই রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইলেকশনের আগে মধুকে নিয়ে নিলামের ডাক ওঠে। মধুকে যে কিনতে পারবে, ওই সাত-আট হাজার ভোট তার বাঁধা।
ফলে তিরিশ বছর বয়েস হওয়ার আগেই মধু বর্মনের আলিপুরদুয়ারে সুন্দর দোতলা বাড়ি, যদিও সে বাড়ির অস্তিত্ব তার জঙ্গলের প্রতিবেশীরা জানে কি না সন্দেহ। একটা এনফিল্ড বাইক। এটিও সে রাজাভাতখাওয়ায় রেখে দিয়ে পায়ে হেঁটে চকচকি গ্রামে ঢোকে। তা ছাড়া ভারত ভুটান সীমান্তে বেনামে একটা কমলালেবুর বাগানও রয়েছে। আর সম্ভবত এই সব সম্পত্তির সাদা টাকায় উৎস দেখাতে কাজে লাগবে বলেই একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরিও করে দেওয়া হয়েছে তার জন্যে। প্রমিতের নিজের অফিসে এদিকের কয়েকজন লোক কাজ করেন। তারাই। প্রমিতকে মধুর সম্বন্ধে এই সব খবর সরবরাহ করেন।
হাতিতে ফসল নষ্ট করলে ফসলের মালিককে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তার থেকেও যে মধু বর্মন পয়সা সরায়, তা প্রমিত একবার হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। মুস্কিল হচ্ছে মধুর অক্ষরজ্ঞানহীন প্রতিবেশীরা কিছুই ধরতে পারে না। তারা মধুকে তাদের রক্ষাকর্তা মনে করে। অন্ধের মতন বিশ্বাস করে তাকে।
প্রমিতের ঘোর সন্দেহ, বক্সার কাঠ পাচার চক্রের সঙ্গেও যোগ রয়েছে এই লোকটার। ওর মতন লোভী মানুষের পক্ষে সেটাই স্বাভবিক।
এই মধু বর্মনকে তার জন্যে ফাঁকা রাস্তায় অপেক্ষা করতে দেখে স্বভাবতই প্রমিতের মনটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল। তবু সে বিরক্তি গোপন করে বলল, অপেক্ষা করছ কেন মধু? কিছু বলবে?
অবশ্যই বলব। বলব বলেই তো এসেছি। ঝাঁঝিয়ে উঠল মধু বর্মন। শিরোমণির গড়ের থেকে পবিত্র জায়গা আমাদের কাছে আর কিছু নেই। সেই জায়গা আপনার জন্যে মানুষের রক্তে অপবিত্র হল।
এ কথা ঠিক যে, যে জায়গাটায় বিমল, বাবুয়াদের খুন করা হয়েছে সেই জায়গাটার গা ঘেঁষেই উঠে গেছে শিরোমণির গড়ের টিলা। তবু, আক্রমণটা যে এইদিক থেকে আসবে তা ভাবতে পারেনি প্রমিত। সে একটু হকচকিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, আমার জন্যে মানে?
হ্যাঁ, আপনার জন্যেই। অভদ্রের মতন চেঁচিয়ে উঠল মধু। বহুদিন ধরে আপনার কাছে দাবি করে আসছি শিরোমণির গড়কে আমার জাতের লোকেদের হাতে ফিরিয়ে দিতে। যদি সে কথা শুনতেন তাহলে আজ ওই জায়গায় লোক গমগম করত। খুন খারাবি হতে পারত না।
প্রমিত শান্তভাবে বলল, তা হয় না মধু। কেন হয় না তা তোমাকে আগেও অনেকবার বুঝিয়েছি। শিরোমণির গড় টাইগার রিজার্ভের ফ্রিঞ্জ এরিয়ার মধ্যে পড়ে। ওটা সবার জন্যে খুলে দেওয়া যায় না। কিন্তু তোমরা যারা জঙ্গলের গ্রামে থাক, তাদের তো ওখানে যেতে আমরা কোনওদিন বাধা দিই নি। কারণ আমরা খুব ভালো করেই জানি, জঙ্গলের গ্রামগুলোয় তোমরা। যারা থাকো, তারা জঙ্গলের ভালোমন্দ আমাদের মতন বাইরের লোকের থেকে অনেক ভালো বোঝে। জঙ্গলকে তোমরা কিছু কম ভালোবাসো না।
কিন্তু তুমিই বল, শয়ে শয়ে তীর্থযাত্রী যদি ওই ভাঙা গড়ে জমায়েত হয় তাহলে তারা কি তোমাদের মতন জঙ্গলকে বাঁচিয়ে, জঙ্গলের জন্তুদের বাঁচিয়ে চলাফেরা করতে পারবে? এতে বন্যপ্রাণীদের যেমন ক্ষতি হবে, তেমন ক্ষতি হবে তোমাদেরও। তারপর ওদের সঙ্গে মিশেই কোর-এরিয়ায় ঢুকে পড়বে কাঠচোর কিম্বা পোচাররা।
আপনি কিন্তু জেনে বুঝে আমাদের অপমান করছেন ব্যানার্জি সাহেব। গ্রামবাসীদের আপনি চোর বলছেন। পেপাচার বলছেন। এরপর অশান্তি শুরু হলে আমাকে দোষ দেবেন না।
প্রমিত পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, মধু তাকে প্ররোচিত করছে। ওর একমাত্র লক্ষ্য, তাকে রাগিয়ে বেফাঁস কিছু বলিয়ে নেওয়া, আর সেটাকে ইস্যু করে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলা। একবার সেরকম অশান্তি শুরু হলে প্রমিতকে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে মধু বর্মণের দ্বারস্থ হতেই হবে।
তখন সেই শান্তির জন্যে কী মূল্য চাইবে মধু? সেইটাই ঠিক আন্দাজ করতে পারছিল না প্রমিত। সেটা জানবার জন্যেই তাকে আরও কিছুক্ষণ এই নীচ লোকটার সঙ্গে ভদ্রতার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে। সেইরকম মনস্থ করেই একটু ভীতু সুরে প্রমিত বলল, তোমার মতন লিডার থাকতে হরিণডুবিতে অশান্তি কেন হবে, মধু? তুমি কী চাইছ তাই বল না।
মধু বোধহয় মনে মনে ভাবল, হাতি কাদায় পড়া একেই বলে। এই ব্যানার্জি সাহেব তার কত দুনম্বরী প্রোপোজাল পুরোটা না শুনেই তাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে। আর এখন, যেহেতু তিনটে গার্ড মারা গেছে, কাগজে, টিভিতে হইচই হচ্ছে, তাই ওই লোকেরই সুর কত নরম হয়ে গেছে। কথাটা পাড়ার এটাই ভালো সময়।
মধু গলা নামিয়ে বলল, বিনতা ম্যডামকে শিরোমণির গড়টা দিয়ে দিন ব্যানার্জিসাহেব।
প্রমিতের নিখুঁত অভিনয়েও প্রায় চিড় ধরতে যাচ্ছিল। অতি কষ্টে রাগটা গিলে নিয়ে সে বলল, এতদিন তোমার জাতের লোকেদের হাতে শিরোমণির গড়কে দিয়ে দিতে বলছিলে, তার না হয় একটা কারণ বুঝতে পারছিলাম। সেখানে তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের জাতের ইতিহাস, জাতের অতীত গৌরবের ব্যাপার ছিল। কিন্তু হঠাৎ বিনতা ম্যাডামকে দিয়ে দিতে বলছ কেন? তিনিও তো আমার মতনই বাইরের লোক।
গোঁয়ারের মতন মাথা নীচু করে মধু বলল, তা হোক। উনি কথা দিয়েছেন, ওখানে রিসর্ট খুললে আমাদের অনেকগুলো লোককে চাকরি দেবেন–গার্ডের চাকরি, গাইডের চাকরি…
তোমার নিজের লোকেরা আপত্তি করবে না? তারা বলবে না, ওই গড়ে রাজা শিরোমণি যখন ফিরে আসবেন, তখন তিনি যদি দ্যাখেন গড় সারিয়ে হোটেল হয়ে গেছে, তখন তিনি কোথায় যাবেন?
ওদের বোঝাবার দায়িত্ব আমার। চাকরি পেলে অতীতকে ভুলতে সময় লাগবে না।
হঠাৎ চৈতন্যঝোরার নৈঃশব্দকে ভেঙে খান খান করে দিয়ে চিৎকার করে উঠল প্রমিত বোঝাবার দায়িত্ব তোমার, তাই না? তুমি বোঝাবে যে, ওই রিসর্টে সাত আট হাজার লোককে চাকরি দেবেন ম্যডাম, আর তার বদলে যে জঙ্গলটা যুগ যুগ ধরে তোমাদের ভাত কাপড় যুগিয়ে যাচ্ছে, সেই জঙ্গলটাকে বিক্রি করে দিতে হবে। তুমি খুব ভালো করেই জানো মধু, একবার ওখানে রিসর্ট চালু হয়ে গেলে, বিনতা মেহরা তোমার লেংটি পরা জাতভাইদের ওই শিরোমণির। গড়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবেন না। দেখলেই কুকুর লেলিয়ে দেবেন ওদের পেছনে। তোমার অবশ্য তাতে কিছু যাবে আসবে না। তুমি তখন হয়তো শিলিগুড়ির কোনও বারে বসে ওই মেহরাদের সঙ্গেই কাবাব হুইস্কি খাবে। আমাকে চাপ দিয়ে কাজটা করানোর জন্যে বিনতা মেহরার কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছ মধু?
প্রমিতের হঠাৎ রূপ বদলে, এবং তার চেয়েও বেশি তার কথাগুলোর ধাক্কায়, স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মধু বর্মন। তার সঙ্গীও একটু পেছনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছিল। ওদের দুজনেরই একটু আগের সেই ঘাড় তুলে দাঁড়াবার ভঙ্গিটা একেবারেই পালটে গেছে।
ঘৃণাভরে ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রমিত বলল, টাকাটা বিনতা মেহরাকে ফিরিয়ে দিও। বোলো, কাজটা সম্ভব নয়।
মধু আর তার সঙ্গী হঠাৎ উলটোদিকে ফিরে রাস্তার বাঁকে মোড় নিল। সেইখানেই নিশ্চয় ওদের বাহনটা রাখা ছিল। একটু বাদে মোটরবাইকের শব্দ দ্রুত মিলিয়ে গেল শহরের দিকে।
সেদিন আর চৈতন্যঝোরায় সময় কাটানো হল না প্রমিতের। মধু আর তার সঙ্গী চলে যাওয়ার পর জিপের পেছনের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সে অশোক রাইকে বলল, চল অশোক।
অশোক জিগ্যেস করল, কোথায় যাব স্যার?
সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিতে পারল না প্রমিত। সে কি এখন আলিপুরদুয়ারে বি.টি.আর এর অফিসে ফিরবে? হয়তো তাই যাওয়া উচিত। প্রতিদিন অজস্র ফাইল তার মতামতের জন্যে ওখানে আসে। একদিন কাজ না করলেই অনেক কাজ জমে যায়। কিন্তু আজ একদম অফিসে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না প্রমিতের। তার চোখে ভাসছিল অফিসের বারান্দায় পেতে রাখা বেঞ্চিতে দাঁতে শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে বসে থাকা তিন বিধবার মূর্তি। তাদের চোখে শূন্য দৃষ্টি। তাদের আশেপাশে দু-তিনটে শিশু ঘোরাঘুরি করছে, কখনও তারা ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদছে, কখনও আপনমনে খেলা করছে। মায়েদের হুঁশ নেই। অফিসে ঢুকতে বেরোতে গত কয়েকদিন ধরেই বারবার প্রমিত ওই তিন সদ্য স্বমীহারা রমণীর মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে, আর প্রত্যেকবারই সে দ্রুত পায়ে আড়াল খুঁজে পালিয়ে যাচ্ছে ওদের সামনে থেকে। অফিসের ভেতরে সে হেডক্লার্ককে ডেকে হাতজোড় করে বলছে, দেখুন না দত্তবাবু, বিমল, সন্দীপদের ডেথ গ্র্যাচুইটির টাকাগুলো একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া যায় কিনা। ওরা তাহলে যে যার দেশে ফিরতে পারে।
চেষ্টা করছি তো স্যার। বোঝেনই তো, অ্যাবনর্মাল ডেথ। ফাইল কলকাতায় গেছে, সেখান থেকে ফেরত আসবে। তবে না।
দত্তবাবুর কথার সত্যতা বোঝে প্রমিত। কিন্তু সে কি করে অন্য কাউকে বোঝায়, অনুযোগহীন ওই তিন বিধবার শুন্যদৃষ্টির সামনে দিয়ে যাতায়াত করার সময় তার নিজের কি ভীষণ ক্লান্ত লাগে। মনে হয়ে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার শরীর মাটির ওপর ভেঙে পড়তে চায়।
তাহলে কি সে হরিণডুবি বিট অফিসে গিয়ে বসে থাকবে? কিন্তু সেখানেও তো বিমল বাবুয়াদের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে। ওই বিট-অফিসের গেট খুলেই রাতের পর রাত সে ওই তিন সহকর্মীর সঙ্গে নৈশ প্রহরায় বেরিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে ওই বিট অফিসেই ফিরে এসেছে। ওই অফিসের টালি ছাওয়া বারান্দাতে স্টোভ জ্বেলে চা করে খেয়ে ক্লান্ত চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়েছে চারজন একসঙ্গে। ওখানে গেলে এই সবই মনে পড়বে।
বাকি থাকে তার নিজের কোয়ার্টার। কিন্তু সেই ব্যাচেলর কোয়ার্টারেই বা কে আছে, যে তার মাথার মধ্যে জমে থাকা এই গভীর বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে? যার সঙ্গে দুটো অন্য কথা বলে সে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে থাকবে ভয়াবহ মৃত্যুর কথা? সেখানেও তো ঘরগুলো শূন্যতায় হা হা করছে।
না, কেউ নেই।
প্রমিতের মায়ের কথা মনে পড়ল। কলকাতা থেকে মাকে কয়েকদিনের জন্যে আনিয়ে নেবে? একটা ফোন করবে দাদাকে? তরপরেই মনে হল না, থাক। এবার যাওয়ার সময় মা বলেই গিয়েছিল, সামনে তোতনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা রয়েছে। সেটা শেষ না হলে আর এদিকে আসতে পারবে না। তোতন দাদার ছেলে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা-বউদি দুজনেই চাকরি করে বলে ওর স্কুল যাওয়া, স্কুল থেকে ফেরত আসা এবং খাওয়া দাওয়া, সবটাই মায়ের হাতে৷ এই সময়ে মাকে নিয়ে চলে আসা মানে দাদা-বউদিকে বিপদে ফেলা।
শেষ অবধি আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিল প্রমিত। কলকাতার অফিসের সঙ্গে একটু যোগাযোগ করে দেখা যাক বিমলদের ডেথ-বেনিফিটের টাকাগুলো তাড়াতাড়ি আনানো যায় কি না।
প্রমিত সিটের ওপর সোজা হয়ে বসে বলল, আলিপুরদুয়ার চল অশোক।
.
০৫.
আচ্ছা, আমার তাহলে এখন কী হবে?
প্রমিত আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। সবে সকাল নটা বাজে। ভিজিটরদের ভিড় তাই একেবারেই নেই। জানলা দিয়ে প্রমিত দেখছিল, অফিস কম্পাউন্ডের মাঠে দুটো খঞ্জন পাখি দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে ওই পাখিদুটো ঠিক এই মাঠটিতেই মাইগ্রেট করে চলে আসে। সময় বা জায়গায় এতটুকু হেরফের। হয় না। গত দু-বছরে ওদের চিনে গেছে প্রমিত। পাখিদুটোর দিকে তাকিয়ে প্রমিত পরিযানের রহস্যের কথাই ভাবছিল। এমন সময়ে হঠাৎ ওই প্রশ্নে সে চমকে মুখ ফেরাল। দেখল দরজার কাছে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়েস বড় জোর তেইশ চব্বিশ বছর হবে। খুব রোগা, খুব ফরসা। এত ফরসা যে গলার কাছটায় নীল শিরা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট মুখে কালো লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমাটা বড্ড ভারী লাগছে। মেয়েটার পরণে ব্লু জিনস এবং হাতা গোটানো সাদা কটনের শার্ট। এই কালার কম্বিনেশনটার মধ্যেও একটা স্কুল ইউনিফর্মের ছাপ আছে, যেটা মেয়েটার বয়েসকে আরও কমিয়ে দেখাচ্ছে।
প্রমিতকে নিরুত্তর দেখে দরজা পেরিয়ে ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এসে আবার জিগ্যেস করল মেয়েটি আমি তা হলে কী করব এখন?
চশমার ফ্রেমটা বোধহয় একটু ঢিলে হয়ে গেছে, বারবার চোখের সামনে থেকে নেমে যাচ্ছে, আর মেয়েটা সেটাকে দু-আঙুলে যথাস্থানে তুলে দিচ্ছে। কিম্বা এমনও হতে পারে যে, যুবতী মেয়েটা তার বালিকাসুলভ চেহারায় এইভাবে কিঞ্চিৎ ভারিক্কীভাব আনবার চেষ্টা করছে। মনে মনে হেসে ফেলল প্রমিত। মেয়েটার চেহারা এবং হাবভাবে যে একটা কমিক্ ব্যাপার আছে, সেটা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।
আসুন, এখানে বসে বলুন আপনার সমস্যাটা কী? তা না হলে আমি বলব কীভাবে, আপনি কী করবেন? প্রমিত হাতের ইঙ্গিতে তার উলটোদিকের চেয়ারগুলোর মধ্যে একটা দেখিয়ে দিল মেয়েটাকে।
চেয়ারে বসার পরেও মেয়েটা ইতস্তত করছিল। যেন কোথা থেকে কথাটা শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। প্রমিত তাকে সাহায্য করল–আপনার নামটাই বলুন আগে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্রমিতের প্রস্তাবটা যেন লুফে নিল মেয়েটি। আমার নাম দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত। পুরো নামটা অবশ্য কেউই বলে না। দ্যুতি বলেই ডাকে সক্কলে।
এইটুকু বলেই ব্যস, আবার চুপ। মোটা লেন্সের মধ্যে দিয়ে বড় বড় দুটো চোখ মেলে ঘরের চারপাশের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ বাদে প্রমিত বাধ্য হয়ে বলল, কী যেন একটা সমস্যার কথা বলছিলেন।
অফিসের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা বক্সার ম্যাপের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটি বলল, কই? সমস্যার কথা বলিনি তো।
তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এইভাবে বলল, ও, হ্যাঁ। আপনারা যে জঙ্গলে ঢোকা বারণ করে দিলেন, আমি এবার কী করব তাহলে?
ব্যাপারটা সামান্য হৃদয়ঙ্গম হল প্রমিতের। বিমল, বাবুয়ারা মারা যাবার পরেই প্রথম স্টেপ যেটা সে নিয়েছে, সেটা হল হরিণডুবি থেকে উত্তরদিকে কারুর যাতায়াত বারণ করে দিয়েছে। ওইদিকেই ভূটান সীমান্ত, ওইদিকেই বিপদ। এমনিতে তাতে কারুর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়, কারণ ওদিকে কোনও লোকালয় নেই। মাঝেমধ্যে শিলিগুড়ি কিম্বা কলকাতা থেকে ভ্রমণপিপাসু ছেলেমেয়েদের দল আসে। জয়ন্তীর জলধারার পাশ দিয়ে, ভুটানপাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওই স্বর্গের মতন সুন্দর পথে কিছুটা ট্রেক করে আসে তারা। একমাত্র তাদেরই এখন আটকে দেওয়া হচ্ছে। ওরা বাদে সোনারু মাঝির মতন লোকাল লোকজন, যারা বিভিন্ন প্রয়োজনে জঙ্গলে যেত, তারা নিজেরাই ওই ঘটনার পরে এমন ভয় পেয়ে গিয়েছে যে, উত্তরের জঙ্গলের দিকে পা বাড়াবার কথা মুখেই আনছে না। প্রমিত জিগ্যেস করল, আপনি কি কোনও ট্রেকিং দলের সঙ্গে এসেছেন?
আবার বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে প্রমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি, মানে দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত। যেন ট্রেকিং শব্দটাই সে এই প্রথম শুনল। তারপর বলল, না তো। আমি একাই এসেছি। আমি রিসার্চের কাজে এসেছি।
এই একটা কথাতেই মেয়েটার পরিচয় পরিষ্কার হয়ে গেল প্রমিতের কাছে।
যেদিন বিমল বাবুয়াদের ওই দুর্ঘটনা ঘটল, ঠিক তার দুদিন আগে কলকাতা থেকে তাদের দফতরের এক বড়কর্তার একটা ফ্যাক্স এসে পৌঁছেছিল তার কাছে। তাতে বলা হয়েছিল ওই বড়কর্তার এক ঘনিষ্টা আত্মীয়া কলকাতা থেকে কি যেন রিসার্চের কাজে বক্সার জঙ্গলে ঘুরতে চায়। তাকে যেন প্রমিত সবরকমের সাহায্য করে। কলকাতা থেকে এ ধরনের অনুরোধ, বা বলা ভালো প্রচ্ছন্ন আদেশ, বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবারই আসে। প্রতি ক্ষেত্রেই প্রমিত যা করে, এবারেও তাই-ই করেছিল। ফ্যাক্সের কপিটা তার অফিসের বড়বাবু দত্তবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিল, টেক প্রপার অ্যাকশন, দত্তবাবু! দেখবেন, আমার চাকরিটা যেন থাকে।
ভাইবেন না সার! আপনের চাকুরি না থাকলে আমারটাও কি রইব? পান-খাওয়া দাঁতে মিচকে হেসে দত্তবাবু কাগজটা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। ঝানু লোক। অতিথিদের সুখসুবিধের ব্যবস্থা কিভাবে করতে হয় সঅঅব জানেন। প্রমিত নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছিল। আর তার পরেই তো প্রমিতের প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মকে তছনছ করে দিল টেররিস্টদের তিনটে গুলি। মাঝের এই কটা দিনে সে আর সেই রিসার্চ ওয়ার্কারের কোনও খবরই নিতে পারেনি।
বেশ লজ্জিত হয়ে পড়ল প্রমিত। এই মহিলা…না, মেয়েটি এসেছে পাঁচদিন হয়ে গেল। এর মধ্যে একবার অন্তত তার উচিত ছিল, দত্তবাবু একে কোথায় রেখেছেন, ঘোরাঘুরির কী ব্যবস্থা করেছেন সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া।
মনে মনে জিভ কেটে প্রমিত বলল, আপনিই কি মজুমদার সাহেবের আত্মীয়া? কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পি এইচ ডি করছেন?
মজুমদার সাহেব? মেয়েটা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ও, বুধোজ্যাঠার কথা বলছেন? হ্যাঁ, উনি আমার বাবার পিসতুতো দাদা।
প্রমিত নিজেকে সামলাতে পারল না। তাদের দফতরের দোর্দন্ডপ্রতাপ অফিসার সমীর মজুমদারকে বুধোজ্যাঠায় পর্যবসিত হতে দেখে হেসেই ফেলল।
হাসছেন কেন? মেয়েটা পরম গাম্ভীর্যের সাথে প্রশ্ন করল।
নেভার মাইন্ড। তা, দ্যুতিদেবী…
ইসসস! মেয়েটা নাক কুঁচকোলো। দেবী আবার কী? দ্যুতি, দ্যুতি। শুধু দ্যুতি। সবাই তাই বলে। আমার আড়াইবছরের বোনঝি অবধি আমাকে ডুটটি বলে ডাকে। মেয়েটা সম্ভবত ভাইঝির কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই ফিক করে একটু হাসল। প্রমিত দেখল, হাসলে ওর গজদাঁত দেখা যায়। হাসিটা নিঃসন্দেহে সুন্দর, এবং বেশিরভাগ সুন্দর জিনিসের মতনই–দুর্লভ।
প্রমিত ক্ষণেকের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে বলল, বেশ বেশ। তা দ্যুতি, আপনাকে কি আমাদের লোকেরা জঙ্গলে যেতে দিচ্ছে না?
হ্যাঁ। এদিকে আমার ছুটি ফুরিয়ে আসছে। কী হবে এখন?
কিছু একটা করতে হবে। আপনি বুধোজ্যাঠার ভাইঝি বলে কথা। আচ্ছা, আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কোথায়?
হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোয়।
আর আপনার কাজটা কী ধরণের? কোথায় যেতে হবে?
দ্যুতি আবার থতমত খেল। বলল, কোথায় যেতে হবে তা তো জানি না। জ্যেঠু বলেছিলেন আপনার কাছেই পরামর্শ নিতে। তবে যে কাজটার কথা ভেবেছি সেটা আপনাকে বলতে পারি।
বলুন।
এখানকার আদিবাসীদের ফোকটেলস্ নিয়ে কাজ করব। ওদের নানারকম রূপকথা, ব্রতকথা, মিথ…
ছেড়ে দিন।
মানে! কথার মধ্যে এইভাবে হঠাৎ বাধা পেয়ে দ্যুতি চোখ বড় করে বোঝবার চেষ্টা করল প্রমিত ইয়ার্কি মারছে কি না।
প্রমিত কিন্তু খুব সিরিয়াস গলাতেই আবার বলল, প্রোজেক্টটা ছেড়ে দিন, প্লিজ! আমি এমনিতেই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছি। তার চোখে মধু বর্মনের হিংস্র মুখটা ভেসে উঠল।
সে দ্যুতিকে বুঝিয়ে বলল–আসলে ব্যাপারটা কি জানেন তো? এই মুহূর্তে এখানে জঙ্গলের গ্রামগুলোয় যারা থাকে তাদের সঙ্গে আমাদের, মানে ফরেস্টের লোকজনের সম্পর্কটা নানান কারণে বেশ স্ট্রেইনড় হয়ে রয়েছে। ওদের মধ্যে কয়েকটা খারাপ লোক যেন তেন প্রকারেণ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একটা গণ্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করছে। এই সময়ে ধরুন আপনি কোনও একটা ফরেস্ট ভিলেজে কাজ করতে গেলেন। ওরা জানতে পারল, আপনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের কারুর আত্মীয়া, আমাদের অতিথি। জানতেই পারে, অসুবিধে কিছু নেই। আমাদের অফিসে ওদের নিত্য যাতায়াত। তখন ওরা আপনার সামান্য কোনও ত্রুটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে দেবে–আমাদের ধর্মে আঘাত করা হয়েছে, আমাদের বিশ্বাসে আঘাত করা হয়েছে…এইসব আর কি।
প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে আড়ি হলে একটা ছোট্ট মেয়ের মুখ যেমন অন্ধকার হয়ে যায়, প্রমিতের এই কথায় তেমনই ম্লান হয়ে গেল দ্যুতির মুখ। প্রমিত সেটা খেয়াল করে দুঃখিত হল। সে বেশ বুঝতে পারছিল, তার কথাগুলো ওই পড়ুয়া মেয়েটার স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে।
কিন্তু প্রমিতেরই বা উপায় কী? এই মুহূর্তে হরিণডুবির চারিদিকে যে টালমাটাল পরিবেশ তার মধ্যে কি একজন বহিরাগতা মেয়েকে একা ছেড়ে দেওয়া যায়? তবু প্রমিত খুব দ্রুত একটা। রাস্তা বার করার চেষ্টা করছিল যাতে দ্যুতি তার কাজটা করতে পারে। কোনও বড়সাহেবকে খুশি করার জন্যে প্রমিত এটা করছিল না। সে বুঝতে পারছিল, উলটোদিকে বসে থাকা ওই মেয়েটা বড্ড বেচারি, বড্ড কমজোরি। বইয়ের পাতায় যা লেখা আছে তার বাইরে ও দুনিয়াটাকেই খুব বেশি জানে না। কিন্তু একইসঙ্গে মেয়েটা বড্ড ভালো।
সেইজন্যেই প্রমিত চাইছিল দ্যুতির কাজটা না আটকাক।
ঠিক সেই সময়েই জানলার ঠিক বাইরের মোরাম বিছানো রাস্তায় খড়মড় শব্দ তুলে একটা জলপাই রঙের বোলেরো ভ্যান খুব স্মার্টলি বাঁক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সেইদিকে তাকিয়ে প্রমিতের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, কি আশ্চর্য! মিস্টার শইকিয়ার কথাটা মাথায় আসেনি কেন?
তারপর দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলল, দ্যুতি শুনুন।
উ! যথারীতি মেয়েটা এইটুকু সময়ের মধ্যেই তার নিজের চিন্তায় তলিয়ে গিয়েছিল। প্রমিতের ডাকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে সাড়া দিল।
মনে হয় আপনার জঙ্গলে যাওয়ার…মানে যাওয়ার এবং নিরাপদে ফিরে আসার একটা উপায় করতে পারব।
এইটুকু সময়ের মধ্যে প্রমিতের মতামত বদলে যাওয়ায় দ্যুতি স্বাভাবিকভাবেই একটু অবাক হল। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে বলতে না দিয়ে প্রমিত দরজার দিকে নির্দেশ করল।
দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকছিলেন বোলেরোর মালিক হাস্যোজ্জ্বল এক পুরুষ। লম্বা, চওড়া, স্বাস্থ্যবান। চকোলেট রঙের ট্রাউজারের ওপর গোলাপি পিন স্ট্রাইপ ফুল স্লিভ শার্ট। ঘন চুলে সামান্য কিছু রুপোলি আঁচড়। বয়েস পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে। ঢুকতেই তার দিকে প্রমিতের বাড়ানো হাতটা দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুখের হাসিটা একইরকম রইল।
তাকে দেখিয়ে প্রমিত দ্যুতিকে বলল, মি ডক্টর রূপেন শইকিয়া, বক্সা টাইগার রিজার্ভের একজন বড় বন্ধু। আপনাকে ওনার সঙ্গেই গেঁথে দেব। উনি সঙ্গে থাকলে ক্ষ্যাপা হাতিও আপনাকে শুড় তুলে সেলাম দিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেবে।
কার সামনে আমাকে এইভাবে গ্লোরিফাই করছেন সেটা জানতে পারলে ভালো লাগত। হাতের অ্যাটাচিটা পাশে নামিয়ে রেখে একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসলেন রূপেন শইকিয়া। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খাঁটি সেগুনের আলিশান চেয়ার অবধি সেই ওজনে মচমচ করে উঠল। মিস্টার শইকিয়ার চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি দ্যুতির দিকে।
মিট মিস দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত…দ্যুতি। আমাদের মজুমদার সাহেবের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে তো? ডেপুটি চীফ কনজার্ভেটর সমীর মজুদার? ওনার আত্মীয়া। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পি এইচ ডি অ্যাসপায়ারান্ট। সাবজেক্ট অ্যানথ্রোপলজি, মানে নৃতত্ব। বাংলাটা ঠিক বললাম তো?
দ্যুতি ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
উনি এখানে এসেছেন ফিল্ড ওয়ার্ক করবেন বলে।
আচ্ছা, আচ্ছা। রূপেন শইকিয়া দু-হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন দ্যুতিকে। তারপর যোগ করলেন, আমি কিন্তু আপনি আজ্ঞে চালাতে পারব না। তোমার বয়েসি অনেক ছাত্রী ছিল। আমার।
দ্যুতি কথাটা ভালো বুঝতে পারল না। ইনি কি প্রফেসর?
প্রমিত দ্যুতিকে বলল, দ্যুতি, ডক্টর শইকিয়ার সঙ্গে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। আপাতত এইটুকু জেনে রাখুন। ডক্টর শইকিয়া এখানে এলে হরিণডুবি বাংলোতেই ওঠেন। মানে, আগামী কদিন উনি আপনার পাশের ঘরেই থাকবেন। ওনার সম্বন্ধে বাকিটা ওনার কাছ থেকেই ধীরেসুস্থে শুনে নেবেন। ওনার ভাণ্ডারে জঙ্গল নিয়ে অজস্র গল্প আছে। আপনার রিসার্চের কাজেও তার কিছু কিছু লেগে যেতে পারে।
রূপেন শইকিয়া হাত নেড়ে বললেন, আরে ধুর, ওসব কিছু না। তুমি আমার সঙ্গে এসো দ্যুতি। আমি এই টেন্ডার পেপারগুলো অফিসে জমা দিয়েই বেরিয়ে পড়ব। তারপর আমরা একসঙ্গেই হরিণডুবিতে ফিরব। কাল সকালে আমি তোমাকে জঙ্গলে নিয়ে যাব। তার আগে আজ সন্ধেবেলা তুমি আমাকে তোমার ফিল্ড-ওয়ার্কের প্ল্যানটা বুঝিয়ে দেবে, কেমন?
দ্যুতি ইতস্তত করে বলল, জঙ্গলে ঢুকবেন? কিন্তু রেস্ট্রিকশন?
জবাবটা দিল প্রমিত। বলল, ও রেস্ট্রিকশন ডক্টর রূপেন শইকিয়ার জন্যে নয়। এই জঙ্গল আর জঙ্গলের লোকজনকে উনি নিজের ঘরের লোকের থেকেও ভালো করে চেনেন। নিজেকে কেমন করে বাঁচাতে হবে সেটাও। ভালো কথা, মিস্টার শইকিয়া। আপনার সঙ্গে আমার একটু অন্য ব্যাপারে কথা ছিল।
রূপেন শইকিয়া প্রমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, বললেন, বিমল, বাবুয়াদের মার্ডার নিয়ে কি?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল প্রমিত। মুখে বলল, ডিটেইলস তো আপনাকে ফোনে বলেছি। আমি কিন্তু এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি একবার জায়গাটা দেখবেন?
রূপেন শইকিয়া বললেন, হ্যাঁ, সে দেখতে আর অসুবিধে কোথায়? কাল ভোরবেলা তাহলে চলে আসুন না হরিণডুবি। আমি, আপনি আর দ্যুতি একসঙ্গেই জঙ্গলে ঢুকব। যাবার পথে ওই জায়গাটাও একবার ঘুরে যাব। তবে, আপনি যেখানে কিছু বুঝতে পারছেন না, সেখানে আমি আর নতুন করে কী বলব বলুন তো? এই বলে, অ্যাটাচি-কেসটা হাতে নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আচ্ছা, আজ আমি একবার অফিসটা ঘুরে তাহলে বেরিয়ে পড়ছি। চল। দ্যুতি।
এই প্রথম অন্তর্মগ্নতার ডুবজল থেকে মাথা তুলে দ্যুতি একটু বেশিক্ষণ প্রমিতের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে কোনও ধন্যবাদ দিল না। তবে চেয়ার ছেড়ে উঠবার সময় আবার সেই খুশির হাসি হেসে বলল, কাল ভোরে দেখা হচ্ছে তা হলে?
সিওর।
এত নিশ্চিত স্বরে প্রমিত গত কয়েকদিনে কোনও কথা বলেনি।
২. চকচকি গ্রাম
০৬.
চকচকি গ্রামের গুলাবি নার্জিনারির রূপেন শইকিয়ার মতন ব্যবসা নেই। দেবদ্যুতি সেনগুপ্তর মতন গবেষণার কাজও তার কাছে স্বপ্ন। সে এক পঁয়ত্রিশ বছরের আদিবাসী রমণী–গরিব, ক-অক্ষর গোমাংস। তবু দ্যুতি বা রূপেনের মতন গুলাবিরও বড় প্রয়োজন ছিল হরিণডুবির। উত্তরের জঙ্গলে যাওয়ার। কারণ ওই জঙ্গলেই একটা টিলার মাথায় রয়েছে তাদের তীর্থ– শিরোমণির গড়। সেই গড়ে আজও, মৃত্যুর পাঁচশো বছর পরেও, অধিষ্ঠান করেন রাজা শিরোমণি। ওদিকে গুলাবির দেড় বিঘে জমিতে মকাইদানা পেকে টুসটুস করছে। শিরোমণি ছাড়া সেই ফসলকে শেষ অবধি রক্ষা করেন কে?
গুলাবি তাই আজ শিরোমণির গড়ে চলেছে। তার ডান হাতে একটা ধারালো দা। বাঁ হাতের আঙুলে দড়ির ডগায় ঝুলছে একটা গোলা পায়রা। গুলাবি আজ শিরোমণির গড়ে পায়রা বলি চড়াবে। বলি চড়িয়ে রাজা শিরোমণিকে জোড়হস্তে বলবে, রাজা! তোমাকে তো নতুন। করে কিছু বলার নেই। ঘরে খাবার মুখ ছয়খানা। তাদের অর্ধেক বছরের খোরাক ওই দেড়বিঘে জমির মকাইদানা, তাও যদি গোলায় ওঠে, তবেই।
বনের ধারে জমি। ফসল খেয়ে যাবার জন্যে বুনো শুয়োর আছে, সজারু আছে, এমনকি টিয়াপাখিও বড় শত্রু। একটু অন্যমনস্ক হলেই এরা সব তছনছ করে দিয়ে চলে যাবে। তবু ঠাকুর, দিন নেই রাত নেই মেয়ে মরদে পালা করে জেগে, খালি টিনের ক্যানেস্তারা বাজিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এদের হাত থেকে ফসল বাঁচানো যায়। কিন্তু ক্ষেতের ওপর একবার যদি মহাকাল বাবাদের দৃষ্টি পড়ে, তা হলে আর কোনও উপায় নাই। এক রাতের মধ্যে সমস্ত ফসল খেয়ে ছড়িয়ে, শুড়ে দাঁতে জমি নতুন করে চষে দিয়ে তারা ভোরবেলা গা দোলাতে দোলাতে জঙ্গলে ফিরে যাবে। পেছনে পড়ে থাকবো আমরা ছটি প্রাণী, সারা বছর উপোসের চিন্তা নিয়ে।
তাই এইটুকুই প্রার্থণা শিরোমণিমহারাজ, তোমার হাতির পালের নজর থেকে আমার ওই একটুকরো জমিকে তুমি রক্ষা কর।
গুলাবি চকচকি গ্রাম থেকে বেরিয়েছিল দুপুরবেলায়। সংসারের সমস্ত কাজ সেরে তার আগে আর পারেনি। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ সে গ্রামের লাগোয়া হালকা জঙ্গল ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছিল বি.টি.আর-এর কোর-এরিয়ার গহন অরণ্যের মধ্যে। কিছুদূর অবধি ফরেস্টের লোকেদের গাড়ি চলাচলের মতন সরু পিচরাস্তা ছিল। একটা জায়গার পর তাও শেষ হয়ে গেল। এরপর শুধুই জন্তুদের পায়ে পায়ে তৈরি শুড়িপথ। সেই শুড়িপথ ধরেই এগিয়ে চলেছিল গুলাবি। বেলা সবে হয়তো একটা, কিন্তু গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে নীচে যেটুকু আলো চুঁইয়ে পড়েছে। তার রং এখনই মরা হলুদ। গুলাবি এই বনেরই মেয়ে। এইসব জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে, ব্যাঙের ছাতা কুড়িয়ে তার ছেলেবেলা কেটেছে। তবু তারও একটু ভয় ভয় করতে লাগল। অন্য কোনও কারণে নয়, ওই বুনো হাতিদের কথা ভেবেই। শিরোমণির গড়ের টিলাটা বেয়ে যতই সে ওপরে উঠতে লাগল ততই তার নাকে আসতে লাগল পাকা চালতার গন্ধ। এই টিলার ঢালে অনেকটা জায়গা জুড়ে বুনো চালতার জঙ্গল রয়েছে। আর কে না জানে, পাকা চালতা মহাকালবাবাদের কত প্রিয়?
বনের মেয়ে গুলাবির আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে একটু বাদেই তার সামনের ঘন। জঙ্গলের আড়াল থেকে শাঁখের আওয়াজের মতন হাতির হুঙ্কার ভেসে এল কাঁআআআঁঅ্যাঁ।
এটা সাবধান করে দেওয়ার ডাক। গুলাবির উপস্থিতি ওরা বুঝতে পেরেছে, আর বুঝতে পেরেই তার উদ্দেশ্যে চেতাবনি পাঠিয়েছে–এদিকে আর এক পা-ও বাড়িয়ো না হে। ভালোমানুষের বেটি! আমরা এমনিতে ভদ্র। কিন্তু খাওয়ার সময় বিরক্ত করা পছন্দ করি না। আর জানো তো, রাগলে আমাদের মতন বাজে জানোয়ার সারা পৃথিবীতে আর নেই?
জানে বই কি, খুব ভালো করে সে কথা জানে গুলাবি নার্জিনারি। ছোটবেলা থেকে কম আত্মীয়বন্ধুকে সে ক্ষ্যাপা হাতির পায়ের তলায় থেঁতলে মরতে দেখেছে না কি? হাতির ডাক শোনা মাত্রই তাই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সোজা রাস্তা ছেড়ে টিলার বাঁ-দিকের ঢাল বেয়ে অনেকটা ঘুরে আবার ওপরে উঠতে শুরু করল। ঘুরপথে যাওয়ার সময়েই সে মাথা তুলে দেখতে পেল একটা ছেলে পাথর বাঁধানো মূল রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পুরো শরীরটা দেখতে পেল না গুলাবি, শুধু নীল ট্রাউজারটুকুই চোখে পড়ল।
কেউ নিশ্চয়ই আমারই মতন পুজো দিতে এসেছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে। ফিরে যাওয়ারই তো সময় এখন। তার মতন এত দেরি করে এই ঘোর বনে কে আসে? ভাবল গুলাবি।
মাঝখানে ঘন বাঁশবনের আড়াল থাকায় ছেলেটা তাকে দেখতে পায়নি। তা ছাড়া ওরও পুরো মন এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই ওই হাতির হুঙ্কারের দিকেই পড়ে রয়েছে।
ঘুরপথে টিলার খোলা জায়গাটায় যতক্ষণে সে উঠে এল ততক্ষণে হেমন্তের বেলা ঢলতে শুরু করে দিয়েছে। নীচে তাকিয়ে সে দেখল শিরোমণির গড়ের জলাশয়টাতে বনচরদের বৈকালি। জলপানের জন্যে যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। ওর চোখের সামনেই জল খাওয়ার জন্যে নেমে এল দশ বারোটা বুনো মহিষ বা গউর। তাদের হাঁটু অবধি সাদা লোমের মোজা। একজোড়া ময়ুর তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে করতে আকাশছোঁয়া চিকরাসি গাছের মগডালের দিকে উড়ে গেল; চিতাবাঘ বা বনবেড়ালের মাংশাষী থাবার নাগাল এড়াতে ওখানেই ওরা রাতটা কাটাবে।
পায়ের দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল গুলাবিকে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। ভাঙা পাথরের ইট। কিছু কিছু গাঁথনি এখনও, এই পাঁচশো বছর পরেও, মাটির ওপর খাড়া রয়েছে। রয়েছে আকাশের দিকে অর্ধেকটা উঠে হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়া সিঁড়ি, কুঁয়োর মতন বিরাট পাথরে বাঁধানো গহুর।
এই অনেকখানি অটুট স্থাপত্যের জন্যেই গুলাবির মতন মানুষেরা বিশ্বাস করে, শিরোমণির। গড়ের রাজা আবার ফিরে আসবেন। তিনি আসা মাত্র আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে এই গড়। লোকলস্কর, সিপাহি, বরকন্দাজে গমগম করবে এই টিলা। বুনো জন্তুরা পালাবে, বন পরিষ্কার হয়ে যাবে, আর সেই সঙ্গে পিছু হাঁটবে সময়।
পিছু হাঁটতে হাঁটতে সময় পৌঁছে যাবে পাঁচশো বছর আগের বক্সায়, যখন রাজা শিরোমণি ছিলেন আসাম থেকে নেপাল, ভুটান থেকে কোচবিহার অবধি বিস্তৃত এক বিরাট ভূখণ্ডের প্রভূ, আর এইখানে ছিল তার রাজপ্রাসাদ। এখানে তখন জঙ্গল ছিল না মোটেই, ছিল এক ভারী শহর। আর রাজা শিরোমণি তো তাদেরই লোক ছিলেন, ছিলেন তাদেরই মতন মঙ্গোলয়েড আদিবাসী। আদিবাসীরাই ছিল তার খাস প্রজা। তাই গুলাবির মতন মানুষরাও সেদিন আবার। ফিরে পাবে তাদের হারানো জমি জায়গা–যে সব উর্বর একলপ্তের জমি বছরের পর বছর ধরে সমতলের মানুষেরা এসে তাদের কাছ থেকে ছলে বলে কৌশলে কেড়ে নিয়েছে। তখন বনচরের জীবন ছেড়ে, রিক্সাওলার জীবন ছেড়ে, মালির জীবন, বেশ্যার জীবন ছেড়ে আবার তারা কৃষিকাজে ডুবে যাবে। তখন তারা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের আলো ঝলমল রাস্তায়। হংকং মার্কেটে বাজার করবে, দামি হোটেলে কবজি ডুবিয়ে মাংসভাত খাবে। শহরের মেয়েদের মতন ব্লাউজের নীচে লালরঙের একটা ছোটজামা পরবে গুলাবি। আর হ্যাঁ, সবার আগে হাতি খেদানোর জন্যে একটা ইলেকট্রিকের বেড়া বানাবে তার জমিটার কিনারা বরাবর।
সুখস্বপ্নে বিভোর গুলাবি সমতল জমিটার ঠিক মাঝখানটায় একটা উঁচু পাথরের চাতালের দিকে এগিয়ে চলেছিল। সে জানে ওই চাতালটাকেই বলা হয় শিরোমণির থান। ওখানেই লোকে বলি চড়ায়, সে নিজেও এর আগে অনেকবার চড়িয়েছে। যেতে যেতে সে দেখছিল কত মূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকেভাঙা পাথরের মূর্তি সব। কোনোটা সৈন্যের মূর্তি, কোনওটা নর্তকীর। পাথরের সিংহাসন, পাথরের অলঙ্কৃত কড়িবরগা। গুলাবি তার বাপদাদাদের মুখে শুনেছে, যেদিন রাজা শিরোমণি ফিরবেন, সেদিন ওইসব পাথরের মূর্তিতেও প্রাণ ফিরে আসবে। গুলাবি মনে। প্রাণে বিশ্বাস করে সেই কথা। শুধু সেই নয়, তার জাতের সবাই। সেই বিশ্বাসেই তারা আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকে, সেই বিশ্বাসেই তারা বুনো হাতির সামনে দাঁড়িয়ে কোঁচড় থেকে ক্র্যাকার বার করে মাটিতে আছড়ে ফাটায়। সেই বিশ্বাস বুকে নিয়েই গুলাবির জাতের লোকেরা ভয়ংকর জাঙ্গল ম্যালেরিয়ায় পালে পালে মরে। মরতে মরতেও বক্সার জঙ্গলকে আঁকড়ে ধরে থাকে। কোত্থাও যেতে চায়না এই জঙ্গল ছেড়ে। কারণ এই জঙ্গলই ভ্রমরকৌটোর মতন লুকিয়ে রেখেছে। তাদের প্রাণভোমরাকে, তাদের শিরোমণির গড়কে।
মধু বর্মনের মতন দুয়েকজনের বিশ্বাস শুধু অন্যরকম। কিন্তু তারা গ্রামের কারুরই আপনজন নয়। নেহাত দায়ে অদায়ে ঠেকলে ওদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। পেটে একটু বিদ্যে আছে কি না তাই।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গুলাবি পৌঁছে গিয়েছিল পাথরে বাঁধানো গোল চাতালটার কাছে। জায়গাটা আসলে চারপাশে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা পাথরের বেদি। একসময়ে এইখানেই না কি রাজা শিরোমণির সিংহাসন পাতা থাকত। তাই এখনও এইখানে এসেই তারা মনস্কামনা জানায়। জায়গাটা একটু ঢালু মতন, একটু এবড়ো-খেবড়ো। সারা রাতের শিশির বোধহয় পাথরের খাঁজে জমে থাকে, তাই শ্যাওলায় ঢেকে আছে পথটা। গুলাবির প্লাস্টিকের চটি একবার স্লিপ কাটল সেই শ্যাওলার ওপর। সে সাবধানে মাথা নীচু করে শেষ পথটুকু পেরোল। তারপর মাথা তুলে তাকাল পাঁচিলটার ওপাশে, আর তাকানো মাত্রই তার বুকের রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল।
গুলাবির দিকে পিছন ফিরে তিনটে লোক বসে আছে বেদিটার ওপর। টাকা দেওয়া নেওয়া হচ্ছে। বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা। দুজনকে সে চেনে–চকচকি গ্রামের নেতা মধু বর্মন আর তার বডিগার্ড ঝুপা।
যে লোকটা অ্যাটাচি থেকে টাকার থাকগুলো ওদের হাতে তুলে দিচ্ছে তাকে চিনতে পারল না গুলাবি। এ দেশের লোক নয়।
যাই হোক, ওদের কারবারে গুলাবির কিছু এসে যায় না। তাকে নিজের মানতের কাজটা সারতে হবে। গুলাবি একটু গলা তুলেই প্রশ্ন করল, কী খবর হে মধুবাবু? বিজনেসে খুব কামাচ্ছ। মনে হচ্ছে যে।
তিনটে লোকই চমকে উঠে মুখ ঘোরাল।
হাসতে হাসতে গুলাবি উঠে পড়ল চাতালে। দাঁড়াল একেবারে ওদের মুখোমুখি।
যে লোকটা টাকা দিচ্ছিল সে দাঁতে দাঁত চিপে কেটে কেটে বলল, শুয়োরের বাচ্চা রাকেশকে যে নীচের রাস্তাটা পাহারা দিতে বললাম, সে গেল কোথায়? কথাগুলো পরিষ্কার কানে এল গুলাবির, আর এই প্রথম সে বুঝতে পারল কোথাও একটা গোলমাল আছে। যে ছেলেটাকে সে পাশ কাটিয়ে এল সে তাহলে পাহারাদার রাকেশ। কিন্তু পাহারা কেন? কেনই বা এই নির্জন জায়গায় ওরা টাকা দেওয়া নেওয়া করছে।
মধু বর্মন ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে আসছে তার দিকে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে। আরও কমছে…আরও। গুলাবি দেখতে পাচ্ছে মধুর মুখে একটা অন্যরকমের হাসি। হাসি নয়, যেন ঘন লালা ঝরে পড়ছে। একদম শেষ মুহূর্তে কে যেন গুলাবির বুকের মধ্যে হেঁকে উঠল গুলাবি তোর বড় বিপদ। পালা গুলাবি, পালা!
কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। মধু বর্মনের ডান হাতের মুঠি পুরো শক্তি নিয়ে আঘাত করল গুলাবির রগের ঠিক মাঝখানে। জ্ঞান হারিয়ে পাথরের চাতালের ওপর আছড়ে পড়ল গুলাবি।
এইবার বাকি দুজনও এগিয়ে এল। ঝুপা মধুকে জিগ্যেস করল, একে কি খতম করে দেব গুরু?
তা ছাড়া উপায় কী? শালি অনেককিছু দেখে ফেলেছে।
ঝুপা পকেট থেকে একটু ভাঁজ করা ছুরি বার করে অচৈতন্য গুলাবির দিকে এগিয়ে যাওয়ামাত্রই তৃতীয়জন তাকে হাত বাড়িয়ে থামাল। বলল, আবার এইসব খুনখারাপি কেন? জায়গাটা গরম হয়ে যাবে যে।
তুমি থাম। ঝটকা মেরে তার হাতটা সরিয়ে দিল মধু। যত গরম হয় তত লাভ। ছ্যাঁকা। খেয়ে শালা প্রমিত ব্যানার্জি যাতে দৌড়ে পালাবার পথ না পায় সেই ব্যবস্থাই করছি। এই ঝুপা, মাগিটার হাত-মুখ বাঁধ। কী দিয়ে বাঁধবি আবার জিগ্যেস করছিস? শাড়িটা আছে কী করতে?
ইঙ্গিত বুঝতে ঝুপার অসুবিধে হল না। ততক্ষণে রাকেশ বলে সেই ছেলেটাও কথাবার্তার আওয়াজে ওপরে উঠে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে দুজনে মিলে গুলাবির শরীর থেকে সমস্ত কাপড় ছিঁড়ে ওকে নগ্ন করে ফেলল। ধর্ষণের সময় গুলাবির জ্ঞান ফিরে এসেছিল, কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় তার কিছু করার ছিল না। চারটি পুরুষপুঙ্গব একে একে তার ওপরে অত্যাচার চালিয়ে শেষে অবিকল পাঁঠা জবাইয়ের ঢঙে তার গলার নলিটা কেটে দিয়ে নেমে গেল নীচে।
ওরা চলে যাওয়ার পরেও গুলাবির নিথর শরীরের আশে পাশে ডানা বাঁধা পায়রাটা লেঙচে লেঙচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হতেই একটা প্যাঁচা এসে সেটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল।
.
০৭.
পরেরদিন প্রমিতের জিপসি যখন হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ঘড়িতে বাজে ছটা। ভোরের লজ্জারুণ মুখে তখনও কুয়াশার হালকা ওড়না।
হরিণডুবি বাংলোটা জয়ন্তীর একেবারে তীর ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছিল। নদীর বুকেও। তখনো কুয়াশা জমাট বেঁধে রয়েছে।
বাংলোর সামনের দিকে, মানে নদীর দিকে মুখ করে চওড়া বারান্দা। সেখানে একটা টি-টেবলের দুপাশে দুটো বেতের চেয়ারে বসে চা পান করছিল দ্যুতি আর রূপেন শইকিয়া। গাড়ি থেকে নেমে কাঠের গেটটা খুলে প্রমিত নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে সেই দিকে এগিয়ে গেল। প্রমিতকে দেখে রূপেন উঠে দাঁড়িয়ে সাদরে ডেকে নিল তাকে। দ্যুতি কি করবে ঠিক করে উঠতে না পেরেই যেন চশমাটাকে আঙুলের ঠেলায় চোখের ওপর তুলে দিল। প্রমিত একটা চেয়ারে। বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলোর বেয়ারা তার সামনে চায়ের পেয়ালা আর বিস্কিটের প্লেট রেখে গেল।
চায়ের কাপে একটা বড় চুমুক দিয়ে তৃপ্তির আওয়াজ করল প্রমিত। তারপর চেয়ারে গাটা এলিয়ে আরাম করে বসল। এই স্নিগ্ধ ভোর, এই কুয়াশায় ভেজা ঘাসপাতার তাজা গন্ধ আর অজস্র পাখির গান তার মনের ওপর গত পাঁচদিন ধরে জমে থাকা বিষণ্ণতার পরতটার ওপর ডাস্টার বোলাচ্ছিল। আস্তে আস্তে আগের মতন উজ্জ্বল আর আনন্দময় হয়ে উঠছিল তার অন্তরাত্মা।
প্রমিতের হাবভাব লক্ষ করে রূপেন শইকিয়া বললেন, আরেকটু পরেই বেরোই না কি মিস্টার ব্যানার্জি? এই কুয়াশায় রিভারবেড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে। পাথরে লেগে মোবিল ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে যেতে পারে। মনে হয় আধঘন্টার মধ্যে রোদ উঠে যাবে, তখনই না হয় বেরোব আমরা। ততক্ষণে বরং আমরা ব্রেকফাস্টটা করে নিই। তাহলে ফিরবার তাড়া থাকে না।
প্রমিতের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে রূপেন শইকিয়া ব্রেকফাস্টের কথা বলবার জন্যে বাংলোর পেছনে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রমিত তার বাঁ-পাশে বসে থাকা দ্যুতির দিকে ফিরে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আপনার কাজের ব্যাপারে মিস্টার শইকিয়ার সাথে কথা হয়েছে?
হুঁ। বড় করে ঘাড় হেলালো দ্যুতি। উনি আমাকে একটা আদিবাসী গ্রামে নিয়ে যাবেন বলেছেন। কী যেন বললেন গ্রামটার নাম…চিনাকুড়ি, হ্যাঁ, হা, চিনাকুড়ি। ওখানে মেচ ট্রাইবরা থাকে। ওদের গাঁওবুড়োর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন বলেছেন মিস্টার শইকিয়া। ওই গাঁওবুড়োরাই আমাকে বলে দেবেন জেনারেশন আফটার জেনারেশন ওরা কোন সব ফোক লোর শুনেছেন…
দ্যুতির বাক্যস্রোতকে বাধা দিয়ে প্রমিত বলল, আপনি পারবেন মিশতে?
প্রমিতের এই কথায় এক নিমেষে দ্যুতির মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল, পারব না, না? আমি জানি, আমার কমুনিকেশন স্কিল খুব পুওর। ভালো কথা বলতে পারি না।
এবার প্রমিতের অপ্রস্তুত হওয়ার পালা। সে কোনওরকমে বলল, না, না, আমি তা মিন করিনি। আসলে আমি আদিবাসীদের নিজস্ব কাস্টমসগুলোর কথা বলতে চাইছিলাম। সেগুলো না জানলে ওদের সঙ্গে মেশা একটু মুশকিল তো। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। ওইজন্যেই তো আপনাকে মিস্টার শইকিয়ার সঙ্গে ট্যাগ করে দিয়েছি। উনিই আপনাকে গাইড করবেন।
প্রমিত জানত দ্যুতি এই কথার পরেও তাকে ধন্যবাদ জানাবে না। জানালোও না।
দ্যুতিকে প্রথম দেখবার পর থেকেই প্রমিতের মনে একটা সন্দেহ হচ্ছিল। সেই সন্দেহটা মিলিয়ে নেবার জন্যে সে ডাকল, দ্যুতি!
উ? দ্যুতি সাড়া দিল।
একটা কথা জিগ্যেস করব, যদি কিছু মনে না করেন?
করুন।
আপনার পরিবারে কারা আছেন? মানে মা, বাবা, ভাই…
বাবা আছেন। আর স্টেপ মাদার। তবে ফ্যামিলির সঙ্গে আমার অ্যাটাচমেন্ট খুব কম। মা মারা যাবার পর থেকেই আমি হোস্টেলে থেকেছি, মানে আমার যখন সাতবছর বয়েস তখন থেকেই।
প্রমিতের সন্দেহটা মিলে গেল। এটিকেট ব্যাপারটা মানুষের সহজাত নয়। ওটা সংসারের অন্যদের দেখে শিখতে হয়। দ্যুতি সংসারে থেকেছে খুব কম।
তবে এটিকেট ব্যাপারটা প্রমিতের কাছে কখনওই খুব জরুরি কিছু বলেও মনে হয়নি। তার চেয়ে সিনসিয়ারিটির দাম অনেক বেশি। আর এই মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এর কোনও ভান নেই। একদম শিশুর মতন স্বচ্ছ চোখের তারা। শুধু সেই চোখের দৃষ্টি বইয়ের পাতা ছেড়ে ওঠে খুব কম।
বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না? তারপর কি যেন? এত যে সুধা কেন সৃজিলে বিধি, যদি আমারি তৃষাটুকু পুরাবে না?–ধুর বাবা, কতবছর আগে যে শেষবার গীতবিতান নিয়ে বসেছি, মনে থাকে না কি অত? বনে থেকে থেকে একটা জংলিই হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে, থেমে যাওয়া কথাবার্তা আবার শুরু করার জন্যে প্রমিত দ্যুতিকে জিগ্যেস করল, ডক্টর রূপেন শইকিয়ার জীবনকথা শুনলেন? ইন্টারেস্টিং না?
কেমন করে শুনব? ঠোঁট উলটে বলল দ্যুতি। উনি নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেন না কি? খালি গাছপালা, জীবজন্তু আর আদিবাসীদের কথাই বলে যান। সে সব শুনতেও ভালো লাগছিল, কিন্তু…
দ্যুতির কথা শুনে প্রমিত হেসে বলল, কোয়াইট লাইকলি। ডক্টর শকিয়ার মতন ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধে কিছু বলবেন এটা ভাবা যায় না। আচ্ছা, ওনার কিছুটা বায়োগ্রাফি আমিই বলে দিচ্ছি। একসঙ্গে যখন কয়েকদিন কাটাবেন তখন এটুকু জেনে রাখা ভালো।
উনি পাঁচবছর আগে গুয়াহাটি কলেজে বটানির লেকচারার ছিলেন। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামলেন। ব্যবসাটা খুব ইন্টারেস্টিং ফরেস্ট প্রোডাক্টস-এর ব্যবসা। আমাদের এই ডুয়ার্সের জঙ্গলে নানান লতাপাতা গাছগাছড়া পাওয়া যায় যাদের দারুণ মেডিসিনাল ভ্যালু আছে। তা ছাড়াও কোনও গাছের ফল থেকে সুগন্ধী পাওয়া যায়, কোনও ফুলের পাপড়ি থেকে দারুন রং তৈরি হয়। আমিও সব জানি না। কিন্তু মিস্টার শইকিয়া জানেন। উনি নিত্য নতুন বই জার্নাল ঘাঁটাঘাঁটি করে এইসব খুঁজে বার করেন। এসব জিনিসের বেশিরভাগটাই বাইরে রপ্তানি হয়ে যায়। ভারতের থেকেও বিদেশের মাটিতে এইসব জিনিসের চাহিদা বেশি। ইওরোপ আমেরিকা যে ক্রমশ ন্যাচারাল প্রোডাক্টের ভক্ত হয়ে উঠছে জানেন নিশ্চয়ই?
আমরা মিস্টার শইকিয়াকে এইসব ফরেস্ট প্রোডাক্ট সংগ্রহ করার লাইসেন্স দিই। এতে আমাদেরও একটা উপকার হয়। আরণ্যক গ্রামগুলোর অনেক মানুষকে উনি এই গাছগাছড়া সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। ভালো পেমেন্ট দেন তার জন্যে। মানুষগুলো এরকম একটা ভালো জীবিকা খুঁজে পেয়েছে বলে গত কয়েকবছরে জঙ্গল কেটে চাষ করা কিম্বা জঙ্গলের মধ্যে গরু চরানোর মতন ক্ষতিকর ব্যাপারগুলো কমে গেছে। চোরাশিকারেও আগে লোকাল লোকেদেরই কাজে লাগানো হত। এখন ডক্টর শইকিয়ার থেকে ভাত কাপড়টা পেয়ে যাচ্ছে। বলে ওরা চোরাশিকারিদের মুখের ওপর না বলে দিতে পারছে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমিত বলল, ডক্টর শইকিয়ার গুয়াহাটির বাড়িতেও আমি এক দুবার গিয়েছি। বিশাল বাড়ি, বিরাট বাগান। বোঝাই যায়, ব্যবসা করে উনি ভালোই পয়সা করছেন। কিন্তু উনি নিজে যে ঘরটায় থাকেন সেই ঘরটা দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। একটা চৌকি ছাড়া আর আসবাব বলতে কিছু নেই। আর বই রয়েছে, মাটি থেকে ছাদ অবধি ঠাসা বই আর বইনানা বিষয়ের, নানান ভাষার। সেইজন্যেই মনে হয়, এই ব্যবসাটা উনি বোধহয় ওই গ্রামের লোকগুলোর জন্যেই করেন। ওদের মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্যে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে দ্যুতি বলল, অদ্ভুত লোক, তাই না?
.
আধঘণ্টা পরে সত্যিই প্রমিতকে দুঃখিত করে রোদ উঠল। কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল নদীর চর। রূপেন শইকিয়াও পিঠে একটা রুকস্যাক নিয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ডাক দিলেন–চলুন মিস্টার ব্যানার্জি, চল দ্যুতি। আর দেরি করলে আমার সবকটা জায়গায় যাওয়া হবে না।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমিত ভাবল, কি বিচ্ছিরি কাজ। এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে তাকে এখন একটা রক্তমাখা বধ্যভূমি দেখতে যেতে হবে। এনিওয়ে, ওয়ান শু্যড ওবে দ্যা কল অফ ডিউটি।
প্রমিত জিপসির ড্রাইভিং-হুঁইলে বসল। রূপেন শইকিয়া দ্যুতিকে নিজের গাড়িতে ডেকে নিলেন।
রূপেনের গাড়িতে উঠে দ্যুতি জিগ্যেস করল, এখন কোথায় যাব আমরা?
একটা গ্রামে যাব। গ্রামটার নাম দিবাং, রাভাদের গ্রাম। ওখানে তুমি তোমার কাজ করবে, আমি আমার কাজ…
আপনার কাজ মানে? একটু কৌতূহলি গলায় প্রশ্ন করল দ্যুতি।
দিবাং গ্রামের কাছে একটা বড় জলা আছে। সেখানে গ্রামের লোকেদের দিয়ে সিট্রানেলা চাষ করাবার কথা ভাবছি। সিট্রানেলা জান তো? একরকমের বুনো ঘাস। পেষাই করলে ওর পাতা থেকে সুগন্ধী তেল পাওয়া যায়। কীটনাশক হিসেবে দারুণ কাজ করে। মার্কেট-ভ্যালু অনেক।
তারপর কি খেয়াল হতেই রূপেন শইকিয়া জিভ কেটে বললেন, ইস ছি ছি! তোমার পাস পেপারে বটানি ছিল বললে তো। দ্যাখো তোমাকে আমি ট্রিানেলা চেনাচ্ছি। আমারও হয়েছে মতিভ্রম।
.
আর কথা না বাড়িয়ে দ্যুতিকে নিয়ে বোলেরোয় স্টার্ট দিলেন রূপেন শইকিয়া। পেছন পেছন নিজের জিপসি চালিয়ে আসছিল প্রমিত। সে নিজের গাড়িটাতেই যাচ্ছিল, কারণ, খুনের জায়গাটা দেখেই সে আলিপুরদুয়ারে ফিরে যাবে, কিন্তু ডক্টর শইকিয়াদের তারপরেও আরও ঘোরাঘুরি রয়েছে।
ছোট-বড় নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে টাল খেতে খেতে গাড়িদুটো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল সেই নদীর তীরের ঘাসজমিটায়। প্রমিত আর রূপেন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। দ্যুতি বসে রইল গাড়িতেই। তার কোলে অ্যানথ্রোপলজির বিদেশি জার্নাল। সেটার পাতাতেই ওর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ। ওরা দুজন কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, সে সব কিছুই প্রশ্ন করল না সে।
গাড়ি থেকে নেমে উলটোদিকের ভুটানপাহাড়ের সারির দিকে তাকালেন রূপেন শইকিয়া। তারপর প্রমিতকে জিগ্যেস করলেন, আপনি সিওর মিস্টার ব্যানার্জি যে, গুলিগুলো ওই পাহাড় থেকেই ছোঁড়া হয়েছিল?
প্রমিত বলল, তাছাড়া আর কি হতে পারে বলুন। বিমল বাবুয়ারা তো রিভারবেডে কিম্বা নদীর ওই তীরে কাউকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে ওভাবে বোকার মতন দুপায়ের ওপর উঠে দাঁড়াত না। শুয়ে শুয়েই তাকে গুলিতে খতম করে দিত। তার মানে যারা গুলি করেছে। তারা ওই পাহাড়ের ওপরে লুকিয়ে ছিল। আর তা ছাড়া ফরেনসিক রিপোর্টও বলছে গুলিগুলো ছোঁড়া হয়েছে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে। ওই দূরত্বে পাহাড় ছাড়া আর কী আছে বলুন?
কিন্তু ওই রাতে…নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ওদের দেখল কেমন করে?
সেইটাই তো আমারাও ভেবে পাচ্ছি না, মিস্টার শইকিয়া। আপনি শুধু একজন বিজনেসম্যান কিম্বা স্কলার নন, ভালো শিকারিও। আপনি ভেবে দেখুন না, যদি কিছু কিনারা করতে পারেন।
রূপেন শইকিয়া অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সেই ঘাসজমির ফালিটা অবধি চলে। গেলেন। পেছন পেছন প্রমিত। বাবুয়া সন্দীপদের শরীরের চাপে থেঁতলে যাওয়া ঘাসগুলো এই কদিনে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। রক্তের দাগ ঢাকা পড়ে গেছে নতুন করে উড়ে আসা ধুলোমাটির নীচে। সেইখানে দাঁড়িয়ে প্রমিত উলটোদিকে পাহাড়গুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে হঠাৎ আত্মমগ্ন গলায় ডাকল, মিস্টার শকিয়া।
কিছু বলছেন?
আপনার চোখের দৃষ্টি কেমন?
লোকে তো বলে বাজপাখির মতন।
এবং আমি জানি আপনি একজন ক্র্যাকশট, বন্দুক হাতে আপনার টিপ ফসকায় না। তাহলে বলুন তো, এই মুহূর্তে আমি যদি আপনার হাতে একটা স্নাইপারস রাইফেল দিয়ে দিই, উইথ টেলিস্কোপিক সাইট, এবং আপনাকে বলি ওইই দূরে পাহাড়টার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষের হৃদপিণ্ডে গুলি করতে, আপনি পারবেন?
প্রমিতের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে রূপেন শইকিয়া তাকালেন পাহাড়ের দিকে। সমস্ত জায়গাটাই ডলোমাইট পাথরের একঘেয়ে ছাই রঙে চোবানো। রুক্ষ্ম পাথরের ওপর রোদ পড়ে ঠিকরে আসছে, ধাঁধা লেগে যাচ্ছে চোখে। রূপেন শইকিয়া দেখলেন এতদুর থেকে আলাদা করে কোনও আকৃতিই বোঝা যাচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত সুরেই বললেন, না মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি আমাকে সবরকম ইকুইপমেনটস দিয়ে দিলেও পারব না। টেলিস্কোপিক সাইট ওই ডিস্ট্যান্সে কোনও কাজে আসবে না। বেস্ট সাইটের পাল্লাও আড়াইশো মিটারের বেশি হয় না। এ তো তার দশগুণ। আর, যেখানে টার্গেটটাকে দেখতেই পাচ্ছি না, সেখানে হিট করব কেমন করে?
আচ্ছা বেশ। এবার ধরুন রাতের ঘন অন্ধকারের মধ্যে, যখন আর কিছু দ্যাখা যাচ্ছে না, সেই সময়ে ওই পাহাড়টার মাথাতেই হঠাৎ একটা ছোট্ট বাল্ব জ্বলে উঠল। তখন পারবেন, ওই বাল্বটায় মারতে?
অবাক চোখে প্রমিতের দিকে তাকিয়ে রূপেন শইকিয়া বললেন, পারব। একটা বড় ব্যারেলের রাইফেল লাগবে, আর পয়েন্ট থ্রি উইনচেস্টার কিম্বা পয়েন্ট সেভেন রেমিংটন ম্যাগনামের মতন হালকা বুলেট…হ্যাঁ, তখন দশবারের মধ্যে দশবারই মারতে পারব। কারণ, তখন চারিদিকের অন্য সব আকৃতি হারিয়ে যাবে। চোখের সামনে থাকবে শুধু টার্গেট। আর কিছু নয়।
আচ্ছা এবার ভাবুন তো, সেই পরিস্থিতিটাই যদি উলটে যায়। ওই পাহাড়ের মাথায় টেররিস্টরা যদি দ্যাখে এদিকে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে শুধু তিনটে আলোকিত মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে?
কথাটা মনে হল রূপেন শইকিয়ার বেশ মনঃপুত হল। তিনি গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, হুঁ, একমাত্র এইভাবেই রহস্যটার ব্যাখ্যা করা যায়। কেউ ওদের গায়ে তীব্র আলো ফেলে ওদের টার্গেট বানিয়ে দিয়েছিল।
প্রমিত বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়ল। বলল, এই ব্যাখ্যাটাই পুলিশও দিচ্ছে মিস্টার শইকিয়া। ইন ফ্যাক্ট, ওরা ওদের তদন্তও এই লাইনেই চালাচ্ছে। কিন্তু এই থিয়োরিটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?
কেন? বিশ্বসযোগ্য নয় কেন? রূপেনকে অসন্তুষ্ট দ্যাখাল।
আপনি মনে মনে একবার সিচুয়েশনটা ভেবে দেখুন। প্রথমত, ওদের গায়ে আলো ফেলার কাজটা যে করবে তাকে ওদের ফলো করে আসতে হবে। রাতের জঙ্গলে ওদের মতন মানুষকে ফলো করার কাজটা মানুষখেকো বাঘের পক্ষেও কঠিন, কারণ তখন চোখ নয়, মানুষ কান দিয়ে দেখে। পায়ের তলায় একটা কুটো পড়ে ভেঙে গেলে যে শব্দ হয়, রাতের অরণ্যে সেই শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যায়। আর সেরকম একটা কুটোও না মাড়িয়ে কেউ ওদের ফলো করে এসেছে এটা একরকম অবিশ্বাস্য।
দ্বিতীয়ত, যদি কেউ ততটা সফলভাবে ওদের ফলো করে এসেই থাকে, সে নিজে ওদের না মেরে অত ঝামেলা করে গায়ে আলো টালো ফেলতে যাবে কেন?
তৃতীয়ত, বিমলদের রিফ্লেক্স ছিল চিতাবাঘের মতন। গায়ে আলো পড়া মাত্র ওদের পক্ষে যেটা স্বভাবিক ছিল সেটা হল পেছনদিকে ঘুরে গিয়ে আলোর উৎসে গুলি করা। ওরা তা করেনি। মৃত্যুর সময় ওদের মুখ ছিল ভুটান পাহাড়ের দিকে ফেরানো। তার মানে, ওদের পেছনের দিকে সন্দেহজনক কিছুই ঘটেনি।
রূপেন শইকিয়া হতভম্ব মুখ করে বললেন, তাহলে কি নদীর ওপাড় থেকে তীব্র সার্চলাইট…
কথা শেষ করার আগেই প্রমিত বলল, অসম্ভব। বক্সার আশেপাশে কম মানুষ বাস করে না, আর তাদের অনেকেই এই হেমন্ত মাসে হাতি তাড়ানোর জন্যে সারারাত ফসলের ক্ষেতে বসে থাকে। সেই রাতেও ছিল। আপনি যা ভাবছেন সেরকম হলে, আকাশে আলোর ছটা কারুর না কারুর চোখে পড়তই এবং আমরা জানতে পারতাম।
ওরা দুজন ঘাসজমিটার কাছ থেকে রওনা হয়ে, ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রমিতের গাড়ি অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। গাড়ির সিটে উঠে দরজাটা টেনে বন্ধ করে প্রমিত বলল, আমি নিজেও খুব কনফিউজড মিস্টার শইকিয়া। হয়তো টেররিস্টদের হাতে অত্যাধুনিক কোনও নাইট ভিশন বায়নোকুলার চলে এসেছে, যার হদিস আমরা রাখি না। তা ছাড়া আর কী হতে পারে বলুন?
গাড়ির জানলায় রাখা প্রমিতের হাতের ওপর নিজের হাতটা আলতোভাবে রেখে রূপেন শইকিয়া বললেন, মিস্টার ব্যানার্জী, ভেঙে পড়বেন না। আমিও আপনার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। এ রহস্য আমি ভেদ করবই।
থ্যাঙ্কস। আপনারাও আর দেরি করবেন না। রওনা হয়ে যান। আর যেভাবে হোক সন্ধের আগে বাংলোয় ফিরে যাবেন। রাতকেই এখন বেশি ভয় পাচ্ছি। যে অন্ধকার আমাদের আড়াল দিত, সেই অন্ধকারই আমাদের ঘাতক হয়ে গেছে।
কথাটা বলে প্রমিত গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আলিপুরদুয়ারের দিকে রওনা হয়ে গেল। তার গাড়িটা যখন রূপেনের পার্ক করে রাখা বোলেরোকে পেরিয়ে যাচ্ছে তখন প্রমিত একবার গাড়িটাকে স্লো করে পেছনের সিটে পাঠমগ্না দ্যুতিকে ডাকল–হাই!
দ্যুতি মুখ তুলে তাকাল।
টেক কেয়ার। ডক্টর শইকিয়ার থেকে আলাদা হবেন না কখনও।
লাজুক হেসে দ্যুতি বলল, ঠিক আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।
ছড়িয়ে থাকা বোল্ডারে বিপজ্জনক ভাবে দুলতে দুলতে প্রমিতের জিপ এগিয়ে যাচ্ছিল। সেইদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ দ্যুতি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকল–শুনুন।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল প্রমিতের গাড়ি। সেও জানলা দিয়েই মুখ বাড়িয়ে পেছনে তাকাল। কী হল?
আপনিও সাবধানে যাবেন।
.
০৮.
দ্যুতি আর রূপেনকে বিদায় দিয়ে প্রমিত হরিণডুবি বিট-অফিসে গিয়ে কিছু ফাইলপত্রের কাজ সারল এবং তারপর সে যখন আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসের কম্পাউন্ডে গাড়ি ঢোকাল তখন বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে।
কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেই প্রমিত দেখল অফিসের সামনে বেশ কিছু লোকের একটা জটলা। লোকগুলো সকলেই আদিবাসী; মহিলা পুরুষ মিলিয়ে প্রায় একশোজন হবে। কিন্তু কেন এসেছে ওরা? বুঝতে পারল না প্রমিত। আজ তো কোনও লাইসেন্স বিতরণের দিন নয়।
প্রমিত এটাও খেয়াল করল যে, লোকগুলো অস্বাভাবিক নীরব। ওদের ভাবভঙ্গিতেও কেমন যেন কাঠিন্য। লোকগুলোর চোখের দৃষ্টি সারাক্ষণ তার গাড়ির গতিপথ অনুসরণ করে যাচ্ছে।
গাড়িটাকে ধীর গতিতে অফিসের আরও একটু কাছে নিয়ে আসতেই সে দেখতে পেল জটলাটার অন্যপাশে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর জটলাটার মাঝখানে মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে, তা নির্ভুলভাবে একটি মৃতদেহ। সাদাকাপড়ে মোড়া একটা লাশ ঠিক তার অফিসের বারান্দার নীচে মাটিতে শোয়ানো রয়েছে।
এই অবধিই দেখতে পেয়েছিল প্রমিত। এরপরেই সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে জমাট নৈঃশব্দকে চুরমার করে একটা, মাত্র একটাই গলা, চিৎকার করে উঠল–মারো!
সেই একটা শব্দই মুহূর্তের মধ্যে একশো গলায় ছড়িয়ে পড়ল। একটা বড় পাথর প্রমিতের জিপের উইন্ডস্ক্রিনটাকে চুরমার করে তার পাশে এসে পড়ল। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে দুটো কাজ একইসঙ্গে করল প্রমিত–চাবি ঘুরিয়ে জিপটার স্টার্ট বন্ধ করে দিল, আর মাথাটা নীচু করে নিজে বসে পড়ল সিটের নীচে। ততক্ষণে অসংখ্য পাথর এসে পড়ছে তার জিপের ছাদে। লোহা আর পাথরের সংঘাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে বসেও প্রমিত বুঝতে পারছিল মার মার শব্দ করে ভিড়টা ক্রমশ এগিয়ে আসছে, ঘিরে ধরছে তার গাড়িটাকে। ঠিক এই সময়েই আরও একটা পাথর ড্রাইভিং-সিটের পাশের জানলা দিয়ে ঢুকে সজোরে প্রমিতের কপালে আঘাত করল। চেতনা আর অচেতনার মাঝখানে দুলতে দুলতে প্রমিত বুঝতে পারল পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করেছে। কোলাহলটা ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে। সে পকেট থেকে রুমালটা বার করে কপালে চেপে ধরল। সাদা রুমালটা দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল। প্রমিত টলতে টলতে নেমে এসে জিপের বডিটায় ভর দিয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে আদিবাসী মেয়ে পুরুষের জটলাটা পুলিশের তাড়ায় ফরেস্ট অফিসের কম্পাউন্ডের বাইরে পালিয়েছে। ফাঁকা চত্বরটায় তখন শুধু প্রমিত আর সেই কাপড়ে ঢাকা শবদেহ।
ওটা কার মৃতদেহ?
একটা বলিষ্ঠ হাত এসে প্রমিতের কম্পমান শরীরটাকে জড়িয়ে ধরল। প্রমিত পাশ ফিরে দেখতে পেল ডিএসপি দেবেশ কাশ্যপের গম্ভীর মুখ। কাশ্যপ সাহেব বললেন, স্যরি ব্যানার্জি। ওরা যে আপনার সঙ্গে কোনও কথা বলবার আগেই এত ভায়োলেন্ট হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। হতোও না, যদি না একটা স্কাউলে ওদের ইন্সটিগেট করত। প্রথম মারের ডাকটা সেই-ই দিয়েছিল। অ্যান্ড দেন দ্যা মব কট ইট আপ। বুঝতে পারছি না, শয়তানটা কে?
ওটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। মধু বর্মণের লোক এ কথা নিশ্চিত। তবে ওর সমস্ত চ্যালার মুখ তো আপনি চেনেন না। কাজেই অইডেন্টিফাই করতে পারবেন না। কিন্তু এবার আসল কথাটা বলুন। মৃতদেহটা কার?
ভেতরে চলুন, সব বলছি।
কেন, ভেতরে যাব কেন? ওদের ভয়ে? গোঁয়ারের মতন মাটিতে পা গেঁথে দাঁড়াল প্রমিত।
আরে না না। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। আপনার কপালে দুয়েকটা স্টিচ দরকার মনে হচ্ছে। সেটা তো এখানে দাঁড়িয়ে হবে না।
হাঁটতে গিয়ে প্রমিত বুঝতে পারল সে পায়ে জোর পাচ্ছে না। দেবেশ কাশ্যপের শরীরের ওপর ভর দিয়েই সে অফিসঘরে নিজের চেম্বারের ভেতর ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। চার পাঁচজন সহকর্মী এগিয়ে এল। তাদের সকলেরই চোখে উদ্বেগ। ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে ওর হাতে পুরু একটুকরো তুলো ধরিয়ে দিল।
থ্যাঙ্ক ইউ তারাপদ। ম্লান হেসে প্রমিত রক্তমাখা রুমালটা পাশের লিটার-বিনে ফেলে দিয়ে তুলোর টুকরোটা দিয়ে কপালের ক্ষতস্থানটা চেপে ধরল। সে বুঝতে পারল, ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতিটা এবার কপাল থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সে চোখ তুলে সহকর্মীদের দিকে তাকাল। বলল, আপনারা কাজে যান। তেমন কিছু হয়নি আমার। চিন্তা করবেন না।
ফরেস্ট অফিসের কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে অসন্তুষ্ট স্বরে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে তাদের হেড-অফ-দা-অফিসের ওপর এই আক্রমণের ঘটনাকে তারা ভালো চোখে দেখছে না। প্রমিত উদ্বিগ্ন মনে ভাবল, ওনারা প্রতিশোধের কথা ভাবছেন না তো? যারা এইমাত্র তাকে মেরে গেল, প্রমিত জানে, তারা নিজেরাই মার খাওয়া মানুষ। কোনওরকম প্রতিশোধের যোগ্যই তারা নয়।
কিন্তু সে নিজে কী দোষ করল? ওরা তাকে মারল কেন?
ঘর ফাঁকা হওয়ামাত্র প্রমিত দেবেশ কাশ্যপকে আবার জিগ্যেস করল, কী হল বলুন তো, মিস্টার কাশ্যপ? ওরা কার মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল? হাতিতে মেরেছে কাউকে?
না মিস্টার ব্যানার্জি। মানুষে। প্রথমে রেপ করেছে, তার পরে খুন। কাল রাতের ঘটনা। আজ ভোরে ওর আত্মীয়রাই বডি রিকভার করেছে। তারপর এই আনরেস্ট। বলছিল, আপনার সঙ্গে কথা না বলে পোস্টমর্টেমের জন্যে বড়ি ছাড়বে না। আমি থু-আউট সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম, চাইছিলাম পিসফুলি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে। পারলাম না।
ওঃ ভগবান! আইডেন্টিফাই করা গেছে মেয়েটাকে?
হ্যাঁ। চকচকি গ্রামের মেয়ে, নাম গুলাবি নার্জিনারি। কাল দুপুরে একা একাই শিরোমণির গড়ে পুজো দিতে গিয়েছিল। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল ওখানে পৌঁছতে। ওখানেই গ্যাং-রেপড় হয়েছে।
ওখানে, মানে শিরোমণির গড়ে? আতঙ্কিত প্রমিতের তুলে ধরা হাতটা কপাল থেকে খসে পড়ল। এক ফোঁটা তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ল তার ক্ষতমুখ থেকে। সেদিকে দৃকপাত না করেই সে দেবেশ কাশ্যপের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, বলুন মিস্টার কাশ্যপ। শিরোমণির গড়ে একটা মেয়ে রেপড় হয়েছে? খুন হয়েছে? শিরোমণির গড়ে?
প্রমিতের আতঙ্কের কারণটা বুঝতে দেবেশ কাশ্যপের একটুও অসুবিধে হচ্ছিল না। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
প্রশ্নটা করার সময়ে প্রমিত নিজের চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উত্তরটা পাবার পর আবার সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল তার শরীরের ভেতরে কোনও হাড়ের কাঠামো নেই। ইতিমধ্যে একজন স্থানীয় ডাক্তার ঘরে এসে প্রমিতের কপালের ক্ষতস্থান সেলাই করে দিয়ে গেলেন। অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে, ব্যথা কমানোর একটা ওষুধও তখনই খাইয়ে দিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বলে গেলেন যে ব্যথার তাড়সে একটু পরে জ্বর আসতে পারে। এলে যে ওষুধ খেতে হবে তাও লিখে দিয়ে গেলেন তিনি।
ডাক্তারবাবু যতক্ষণ ঘরে ছিলেন ততক্ষণ প্রমিত আর কোনও কথা বলেনি; চোখ বুজে চেয়ারের পিঠে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে শুয়েছিল। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে সে দেবেশ কাশ্যপকে বলল, এরপর কী হবে বুঝতে পারছেন?
দেবেশ কাশ্যপ কোনও উত্তর দিলেন না।
এরপর মধু বর্মন এবং তার অনুগামীরা আমার ওপর শকুনের মতন ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওরা বলবে, আজ ওখানে হোটেল গড়ে উঠতে দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।
এবারেও দেবেশ কাশ্যপের দিক থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া এল না। অবশ্য প্রমিত কোনও প্রতিক্রিয়া চাইছিল না বোধহয়। সে স্বগতোক্তির ঢঙে বলে চলল, মিডিয়াও আমাকে ছাড়বে না। একটা জায়গায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর দুটো এরকম ঘটনা। অ্যাডমিনস্ট্রেটর হিসেবে। আমাকে তো তারা কাঠগড়ায় তুলবেই।
প্রমিত চোখ বুজেই বুঝতে পারল দেবেশ কাশ্যপের ভারী হাতটা আলতোভাবে তার কাধ ছুঁল। কাশ্যপ বললেন, নিজেকে অপরাধী করবেন না ব্যানার্জি। দায় কি আপনার একার আছে? আমার নেই? ল অ্যান্ড অর্ডার তো আমারই এক্তিয়ারে। সে কথা যদি বলেন তো আমিও। মিজারেবলি ফেইল করেছি।
প্রমিত বলল, না, মিস্টার কাশ্যপ। আপনি ভালোই জানেন জঙ্গলের মধ্যে নাইট-পেট্রলিং করার ক্ষমতা আপনার পুলিশবাহিনীর নেই, ওটা আমারই দায়িত্ব। অথচ ট্র্যাজেডি দেখুন, বিমল বাবুয়ারা মারা যাবার পর থেকেই সেই নাইট-পেট্রলিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। একেই বলে উভয় সংকট। রাতে জঙ্গলে ঘুরলে ফরেস্টগার্ডরা মরবে। আর রাতপাহারা বন্ধ থাকলে গুলাবির মতন মেয়েরা মরবে। পশুপাখির কথা ছেড়েই দিন।
.
প্রমিতের একটা অনুমান নির্ভুল প্রমাণিত হল। দেবেশ কাশ্যপ বেরিয়ে যাবার একঘণ্টার মধ্যে কলকাতার তিনটে টিভি চ্যানেলের উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিরা তাদের টিম নিয়ে আলিপুরদুয়ারে প্রমিতের অফিসে পৌঁছে গেলেন। কলকাতা এবং শিলিগুড়ির চার পাঁচটা সংবাদপত্রের সাংবাদিকও ছিলেন। প্রমিত মনে মনে হিসেব করে দেখল, ওর মাথায় স্টিচ পড়ার আগে এরা গুলাবির মৃত্যুর খবর পেয়েছে। তা না হলে এত দ্রুত এতটা পথ পেরিয়ে এখানে চলে আসা সম্ভব নয়।
এদের মধ্যে দৈনিক দিনকালের মহিলা-সাংবাদিক স্পষ্টই জিগ্যেস করলেন, শিরোমণির গড়ে মারমেড গ্রুপের কটেজ বানানোর প্রস্তাবটায় আপনি রাজি হচ্ছেন না কেন, মিস্টার ব্যানার্জি? তাহলে তো জায়গাটার একটা সিকিউরিটি থাকে। এমপ্লয়মেন্ট জেনারেটেড হয়।
প্রমিত পরিবেশ দূষণের কথা বলতে গেল, কিন্তু তুখোড় সাংবাদিকটি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন– দ্যাট ইজ নট ইওর লুক আউট মিস্টার ব্যানার্জি। তার জন্যে পরিবেশ মন্ত্রক রয়েছে। আপনি। তাদেরই বিচার করতে দিন না।
সাংবাদিক নয়, মহিলার গলায় মারমেডের উকিলের সুর শুনতে পেল প্রমিত৷ সে ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, হয়তো শেষ অবধি আমাদের সেইরকম ডিসিশনই নিতে হবে।
মহিলার মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল।
প্রমিতও হাসল, তবে মনে মনে। সে জানত, দৈনিক দিনকালের মালিকানা মারমেড বিজনেস গ্রুপের হাতে।
.
সন্ধের সময় প্রমিতের অনুমানের বাকিটাও মিলে গেল। আজ সে অফিস থেকে অনেক আগেই ফিরে এসেছিল। তার বৃদ্ধ হেল্পিং-হ্যান্ড গণেশদা তাকে এক গ্লাস হরলিকস করে দিয়েছিল। তাই খেয়ে সে চুপ করে শুয়েছিল নিজের ঘরে। সেই সময়েই তার মোবাইলে মধু বর্মনের ফোনটা এল। মধু বর্মন সাপের মতন হিস-হিস করে উঠল ব্যানার্জি সাহেব, আমার কথাটা যদি মেনে নিতেন, তাহলে এভাবে আমাদের ওই তীর্থ আমাদেরই জাতের মেয়ের রক্তে লাল হয়ে যেত না।
তার উত্তরে মধুকেও আজ একই কথা বলল প্রমিত, যে কথা সে দুপুরে মিডিয়ার লোকজনকে বলেছিল। আমাকে আর দু-চারটে দিন ভেবে দেখার সময় দাও মধু। মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনার দরকার আছে।
হ্যাঁ, দেখুন দেখুন! তাড়াতাড়ি দেখুন। মধুর গলায় পুরোপুরি প্রভুত্বের স্বর। প্রমিতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোন কেটে দিল।
.
এর কিছুক্ষণ পরেই প্রমিতের জ্বরটা এল।
গণেশদা সন্ধে সাতটা নাগাদ রাতের রুটি তরকারি বানিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। প্রমিত একটা ঘোরের মধ্যে শুনল, যাবার সময় সে বলে গেল, দাদাবাবু, আমি বেরোলাম। দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।
তবু দরজা খোলাই পড়েছিল সারা রাত। জ্বরের ঘোরে প্রমিতের মনে হচ্ছিল সে তাদের ভবানিপুরের বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছে। জানলা দিয়ে দুপুরের রোদ এসে যেন তার মাথা মুখ পুড়িয়ে দিচ্ছিল। সে কতবার বলল, মা, জানলাটা বন্ধ করে দাও। মা, জানলাটা…। কিন্তু মা কি কাজে ব্যস্ত কে জানে। এক বুক অভিমান নিয়ে আস্তে আস্তে অচৈতন্য হয়ে গেল প্রমিত।
.
০৯.
শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে প্রায় পনেরো একর জায়গার ওপর বছর দুয়েক হল গড়ে উঠেছে। এক নতুন বিলাসবহুল হোটেল। বাগান, সুইমিংপুল, পার্কিং-লট দিয়ে সাজানো হোটেল জেতবন।
ছতলা জেতবনের সর্বোচ্চতল জুড়ে একটিই সুইট তিনটি বড় ঘর, লাউঞ্জ, ডাইনিং রুম, কিচেন নিয়ে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিলাসবহুল বাসস্থান। পুঞ্জ পুঞ্জ নরম আপহোলস্ট্রি দিয়ে মোড়া সোফাসেট, টিক-উড-এর ডাবলবেড, ফরাসি ক্রিস্টালের ল্যাম্পশেড, রেশমমসৃণ দেওয়ালে আইভরি ফ্রেমে বাঁধানো মুঘল মিনিয়েচারস্-এর প্রতিলিপি এবং বেত আর ধাতুর আরও অজস্র আসবাবে চোখ ধাঁধানো গৃহসজ্জা। এক কথায়, ধনী বিশ্বের যে-কোনও পাঁচতারা হোটেলের সমগোত্রীয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে জেতবনের এই প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট। এখানে। যারা থাকতে আসে তারাও বিশ্বনাগরিক প্রধানত ব্যবসায়ী কিম্বা ডুয়ার্সে শু্যটিং করতে আসা কোনও বলিউড ফিল্মস্টার। ক্বচিৎ কখনও খুব বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা।
আজ এই হেমন্তের সন্ধ্যায় যে দুজন মানুষ প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের লাউঞ্জে বসে আছে তাদের অবশ্য ঠিক এই হোটেলের কাস্টমার বলা চলে না। তাদের মধ্যে একজন তো মালিকপক্ষেরই লোক–বিনতা মেহরা, আর অন্যজন তারই অতিথি, মধু বর্মন।
হ্যাঁ, হোটেল জেতবনের মালিকানা বিনতার মারমেড গ্রুপেরই হাতে। আর সেইই আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে মধু বর্মনকে। মধুর বডিগার্ড ঝুপা হোটেল থেকে একটু দূরে একটা ভাড়া করা টাটা সুমোর মধ্যে বসে অপেক্ষা করছে। বিনতার সঙ্গে কাজ শেষ হলে সে মধুকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার ফিরবে।
সন্ধেটা সুন্দর। জেতবনের লাউঞ্জের উত্তরমুখি কাচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের বুকে সন্ধ্যা নামছে। আকাশে তারা ফুটছে, পাহাড়ি গ্রামগুলোতেও আলো জ্বলে উঠছে। অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর, মুছে যাচ্ছে দু-ধরনের আলোকবিন্দুর মাঝের সীমারেখা। মনে হচ্ছে, একটাই চুমকিগাঁথা কালো ভেলভেটের চাদর যেন মাটি থেকে আকাশ অবধি পাতা আছে।
বাইরের ওই শান্ত সৌন্দর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরের কনসিলড সাউন্ড সিস্টেমে খুব নীচু পারদায় বাজছে কেনি জি-র স্যাক্সোফোন। বিনতা মেহরা আর মধু বর্মনের মাঝখানে পিতলের কাজ করা জয়পুরি সেন্টার টেবলের ওপর নামানো আছে দুটি স্ফটিক স্বচ্ছ সুরাপাত্র। সোনালি সুরার গভীর থেকে বুদবুদ উঠছে অজস্র, অনর্গল।
তবে এ কথা নিশ্চিত যে, এই সব শান্ত সৌন্দর্যের কোনও প্রভাবই ঘরের দুই মানব মানবীর মনের ওপর পড়েনি। ওদের মধ্যে এখন একটা যুদ্ধ চলছে। দুজনেই যাকে ইংরিজিতে বলে ন্যাস্টি মুডে রয়েছে।
সেই মুডেরই প্রকাশস্বরূপ, বিন ওয়াইন গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে সেটাকে এত জোরে সেন্টার টেবলের ওপর নামিয়ে রাখল যে, কিছুটা মদ চলকে টেবিলের ওপর পড়ল। তারপর সে কোলের ওপর খসে পড়া আঁচলটাকে বুকের ওপর জড়ো করে, সামান্য টলোমলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। নীচে তাকাল। দেখল, নীল সুইমিংপুলের ধারে প্রমোদলোভীদের ভিড়। ট্রের ওপর খাদ্য পানীয় সাজিয়ে দ্রুত পায়ে যাতায়াত করছে হোটেলের বেয়ারারা। বারবিকিউ কাউন্টার থেকে ভেসে আসা ঝলসানো মাংসের সুঘ্রাণ এত ওপরেও উঠে আসছে।
কিন্তু বিনতার কিছুই ভালো লাগছিল নানা আলো, না পানীয়, না খাদ্যের সৌরভ।
দেখেই বোঝা যাচ্ছিল একই অবস্থা মধুরও। না হলে অত দামি ফরাসি সুরায় চুমুক দিয়ে কেউ অমন মুখবিকৃতি করেনা। সে চোখ তুলে তাকাল পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিনতার দিকে। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বিনতার প্রশস্ত নিতম্ব, সরু কোমর আর প্রায় নগ্ন পিঠের দিকে। কামে, রীরংসায় জ্বলে গেল তার বুক। আঃ, একবার যদি ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া যেত ওই বিছানায়! ঠিক এই সময়েই বিনতা তীব্র মোচড়ে ঘুরে দাঁড়াল আর তার চোখ সরাসরি পড়ল মধুর কামুক চোখের ওপর। সেই দৃষ্টি চিনতে বিনতার ভুল হল না। সে ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে বলল, রেপিস্ট…মাডারার! তোমাকে আমি এই কাজ করতে বলেছিলাম?
মানে? মধুও আহত সাপের মতন ফোঁস করে উঠল। যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর! যা হয়েছে তাতে আপনার উপকার হয়েছে কি হয়নি বলুন।
সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। বাট ইউ নো, আমরা বিজনেস কমুনিটির লোক, কাজ উদ্ধার করার জন্যে ব্রাইব দিই, পলিটিকাল-প্রেসার অ্যাপ্লাই করি, সেগুলো আলাদা কথা। খুনখারাপি করি না। আর রেপ! ও মাই গড। একটা বেচারা মেয়ে…কোন জানোয়ার করেছে। ওই কাজ?
আমি জানি না। মধু ঘাড় গোঁজ করে বলল।
না, জানো না! ইউ স্কাউন্ডেল! ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে বলল বিনতা মেহরা। তারপর বারান্দা থেকে সেন্টার টেবল অবধি দূরত্বটা আবার টলোমলো পায়ে পেরিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ল ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে তুলে নেবার জন্যে। এর ফলে বিনতার সুডৌল দুই স্তন মধুর নাগালের মধ্যেই উন্মোচিত হল। ক্রোধ আর কামে মেশা এক জান্তব তাড়নায় মধু ঝট করে হাত বাড়িয়ে বিনতার হাতের কব্জি চেপে ধরে বলল, গালাগাল দেবেন না বলছি। যা করেছি তার দাম চুকিয়ে দিন। চলে যাচ্ছি। বিনতার হাত ধরে একটা টান দিল মধু নিজের দিকে। পরক্ষণেই বিনতা দেখল, মধু বর্মন তাকে এক হাতে চেপে ধরেছে নিজের বিশাল জানুর ওপর। অন্য হাতটা তার বুকে। অবাক বিনতা অস্ফুট স্বরে একবার ডাকল, মেফিস্টো!
মধু ঠিক বুঝল না কী হল। সে শুধু দেখল বিনতার ওই ডাকে ভেতরের ঘর থেকে একটা ঝড় ছুটে এল। পরমুহূর্তেই যেন গরম লোহার অনেকগুলো শিক গেঁথে গেল তার কাঁধে। মধু দুটো হাতই বাড়িয়ে দিল সেই মূর্তিমান শমনকে সামলানোর জন্যে, যে ততক্ষণে তার গলার দিকে তাক করেছে।
মধুর মুঠির থেকে মুক্ত বিনতা নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে মধুকে বলল, মেফিস্টো হল খাঁটি জার্মান ব্রিডের ডোবারম্যান পিনসার। কিলার ডগ। তোমার গলার নলি ছিঁড়ে নেবে ও।
মধু দুহাতে সেই খুনে কুকুরকে আটকাতে আটকাতে কাতর গলায় কোনওরকমে বলতে পারল, সরান। আপনার পায়ে পড়ছি একে সরান!
বিনতা এবার ঘরের দরজাটা খুলে দেয়ালের একটা পিয়ানো সুইচে চাপ দিল। বাইরে কোথাও একটা বেল বাজল।
মধু বর্মনের নিজের চেহারা যে কোনও মাপকাঠিতেই বিশাল, তবে বিনতা মেহরার ডাকে যে লোকটি ঘরে ঢুকল তার পাশে মধুকে বাচ্চাছেলের মতন লাগছিল। হোটেল-প্রহরীর পোশাক পরা দৈত্যাকার লোকটার তৎপরতা অবশ্য অবাক করে দেওয়ার মতন। ঘরে ঢুকেই ব্যাপারটা কী হয়েছে বুঝে নিতে তার এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগল না। একহাতে সে মেফিস্টোর গলার বকলশ ধরে তাকে টেনে সরিয়ে নিল, অন্য হাতে মধুর জামার কলার ধরে তাকে প্রায় ঝোলাতেই ঝোলাতেই ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে একবার মধুর দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বিনতার কাছে কোনও একটা কাজের অনুমতি চাইল। বিনতা দ্রুত ঘাড় নেড়ে তাকে নিবৃত্ত করল। বোঝা গেল, মধু বর্মন খুন হওয়ার হাত থেকে আপাতত। বেঁচে গেল।
তবে আহত হওয়াটা যে সে আটকাতে পারেনি সেটা টের পাওয়া গেল, যখন ঝুপা তাড়াহুড়ো করে তিনবাত্তি মোড়ের একটা সরবতের দোকান থেকে বরফ কিনে নিয়ে নিয়ে তাদের গাড়ির মধ্যে ঢুকল। গাড়ির পেছনের সিটে মধু বর্মন শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। তার শরীরের বেশ কয়েকটা জায়গায় কালশিটের দাগ। তার মধ্যে একটায় ঝুপা বরফ ঘসে দিতেই জ্বলুনির চোটে মধু চিৎকার করে উঠল, অ্যাইইই শুয়োরের বাচ্চা। মেরে ফেলবি না কি আমাকে?
এই সবই হচ্ছে প্রমিতের ওপর গ্রামবাসীদের আক্রমণের পরদিনের ঘটনা।
আগের দিন দ্যুতি আর রূপেন শইকিয়া তাদের কাজ সেরে বিকেল বিকেলই জঙ্গল। থেকে হরিণডুবি বাংলোয় ফিরে এসেছিল। কিন্তু হরিণডুবিতে না আছে মোবাইলের টাওয়ার, না টিভি। ফলে প্রমিতের ওপর আক্রমণের ঘটনা জানলো তারা পরদিন সকালে, হরিণডুবি বিট-অফিসের বিট অফিসার সজল দত্তের কাছে, যিনি আবার জেনেছিলেন অফিসের আর টি সেটে। ঘটনাটা জানার পরেই রূপেন শইকিয়া কালক্ষেপ না করে নিজের বোলেরোয় রওনা হয়ে গেলেন আলিপুরদুয়ারের দিকে। বেরোবার আগে একবার শুধু বলেছিলেন দ্যুতি, তুমি যদি চাও, তাহলে আমার লোকেদের বলে দিতে পারি, তোমাকে কালকের ওই গ্রামটাতেই আবার নিয়ে যাবে। ওখানে তুমি কাজ করতে পারো।
দ্যুতি এই কথা শুনে অসম্ভব অবাক চোখে রূপেনের দিকে তাকাল। তারপর খুব অস্ফুট স্বরে বলল, প্রমিতদার এই অবস্থা, আর আমি আজ কাজ করব! আমি যাব আপনার সঙ্গে। রূপেনের মনে হল তার চোখদুটো একটু ছলছলে।
তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন নিশ্চয়, নিশ্চয়। চল, তাহলে রওনা হয়ে পড়ি।
ওরা যখন প্রমিতের বাংলোয় পৌঁছেছিল তখন সকাল আটটা। মফস্বল শহরের মন্থর জীবনছন্দে তখনও ঘুমের আবেশ জড়িয়ে রয়েছে। প্রমিতের বাংলোটাও যেন হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। বাংলোর রোয়াক পেরিয়ে রূপেন শইকিয়া আর দ্যুতি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। কলিংবেলের দিকে হাত বাড়িয়েও রূপেন হঠাৎ থমকে থেমে গেলেন। বললেন, এ কি! দরজাটা খোলা কেন? মিস্টার ব্যানার্জি তো এসব ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার।
মিস্টার ব্যানার্জি।–একটা হাঁক দিয়ে রূপেন একটু ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লাদুটোকে ঠেলে খুলে ভেতরে ঢুকলেন, পেছনে পেছনে দ্যুতি। দরজা আলগা পেয়ে একটা ভাম রাতের বেলাতেই ঢুকে পড়েছিল কোয়ার্টারের মধ্যে। কোথা থেকে একছড়া কলা টেনে নিয়ে এসে প্রমিতের সামনের ঘরের মেঝেতেই সেগুলোকে খেয়ে চটকে ভুস্টিনাশ করছিল। এখন চালাক জন্তুটা দুজন মানুষের শব্দ পেয়ে চট করে ওদের পাশ কাটিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেল।
মিস্টার ব্যানার্জি। আবার ডাক দিলেন রূপেন শইকিয়া। তারপর খুব অবাক হয়েই স্বগতোক্তি করলেন, কী ব্যাপার! বাড়িতে কেউ নেই না কি! পরমুহূর্তেই ওনারা পৌঁছে গেলেন। ভেতরের সেই ঘরটায় যেখানে খাটের ওপর অদ্ভুতভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল প্রমিত। তার পরণে তখনো অফিসের পোশাক।
দ্যুতি একটা অস্ফুট আওয়াজ করে দৌড়ে গিয়ে খাটের পাশে বসে পড়ল। একটা হাত একবার প্রমিতের কপালে চুঁইয়েই শক লাগার মতন টেনে নিল। বলল, দেখুন, প্রমিতদার গা জুরে পুড়ে যাচ্ছে।
মাই গড! ইনি এই ভাবে সারা রাত পড়ে আছেন! রূপেন শইকিয়া পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে বললেন দত্তবাবু বলছেন? শুনুন, যেভাবে হোক একজন ডাক্তারকে তুলে নিয়ে আপনাদের ব্যানার্জি সাহেবের কোয়ার্টারে চলে আসুন। এক্ষুনি। উনি খুব অসুস্থ।
পরের কয়েকটা ঘন্টা প্রমিতকে নিয়ে সকলেরই খুব উদ্বেগের মধ্যে কাটল। একবার মনে হয়েছিল হয়তো হাসপাতালেই ভরতি করতে হবে। কিন্তু দুপুরের পর থেকে জ্বরটা নেমে গেল, আচ্ছন্ন ভাবটাও কেটে গেল আস্তে আস্তে। ডক্টর সোম, যিনি প্রমিতকে দেখছিলেন তিনি বিছানার পাশের চেয়ারটা সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একজন কাউকে খুঁজছিলেন, যাকে পরবর্তী শুশ্রূষার নির্দেশগুলো দিয়ে যেতে পারেন। তাঁর দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই এসে স্থির হল ঘরের মধ্যে একমাত্র মহিলা, দ্যুতির মুখের ওপর।
দ্যুতিও এগিয়ে এল ডক্টর সোমের দিকে। বলল, হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যান কি করতে হবে।
ডক্টর সোম বললে, ঘাটায় ইনফেকশন হয়ে গেছে। সেইজন্যই জ্বরটা এত বেড়েছিল। আমি আজ তো একবার ড্রেস করে দিয়ে গেলাম। কাল আবার এসে ড্রেস করে দিয়ে যাব। তার মধ্যে এই ওষুধগুলো চলবে।
দত্তবাবু ডক্টর সোমের হাত থেকে প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ কিনতে চলে গেলেন। দ্যুতি বুঝে নিল কখন কীভাবে সেসব ওষুধ খাওয়াতে হবে। ঠিক হল সেইই আপাতত প্রমিতের কাছে থাকবে। রূপেন শইকিয়া তার অন্যান্য কাজকর্ম সেরে, সন্ধেবেলায় হরিণডুবি ফেরার পথে দ্যুতিকে তুলে নিয়ে যাবেন। আর রাতে প্রমিতের কাছে থাকবে গণেশদা। সে আজ বাড়ি ফিরবে না।
সকলেই চলে গেল। ঘরে রইল শুধু দ্যুতি আর প্রমিত। কিছুক্ষণ খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে দ্যুতি প্রমিতের রোগক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বেশ খানিকটা দ্বিধা কাটিয়ে ডাক দিল, প্রমিতদা!
প্রমিত বিছানার পাশের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। সাড়া দিল না। একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্যুতি উঠে পড়ল। বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির অন্যপ্রান্তে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াল। গণেশদা সেখানে নেই, সম্ভবত পেছনে কুঁয়োতলায় জামাকাপড় কাঁচতে গেছে। দ্যুতি নিজেই গ্যাস জ্বেলে জল গরম করল। তারপর তাকের ওপরে রাখা হরলিকস-এর শিশিটা নামিয়ে এক গ্লাস হরলিকস বানিয়ে নিয়ে আবার প্রমিতের ঘরে ঢুকল। বিছানায় পাশে দাঁড়িয়ে আবারও ডাকল, প্রমিতদা!
এই বার প্রমিত আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে দ্যুতির দিকে তাকাল।
দ্যুতি হরলিকস-এর গ্লাসটা একটা টুলে নামিয়ে রেখে প্রমিতের পিঠে হাত দিয়ে বলল, একটু উঠুন। প্রমিত বাধ্য ছেলের মতন উঠে বসল। দ্যুতি দুটো বালিশ তার পিঠের পেছনে গুঁজে দিয়ে তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর গ্লাসটা প্রমিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে নিন!
এবারও প্রমিত বিনা বাক্যব্যায়ে তার নির্দেশ মেনে নিল। দ্যুতি বুঝতে পারল, প্রমিত কোনোভাবেই অন্য কোনোরকম কথাবার্তায় জড়িয়ে পড়তে চাইছে না। চাইছে না তার মাথার ভেতর অবিরাম যে চিন্তার জাল বোনা চলছে তাতে কোনও ছেদ পড়ুক। খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে দ্যুতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাংলোর পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসল। কতক্ষণ বসে বসে শুনল নিস্তব্ধ দুপুরে কুঁয়ো থেকে জল তোলার ধাতব শব্দ। দেখল বাতাবি লেবুর গাছে দুটো দুর্গাটুনটুনি নেচে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। এখনই একটা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কথা প্রমিতদাকে।
ঘরে ঢুকে দ্যুতি দেখল, সে যেভাবে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই বসে আছে প্রমিত। তার চিন্তামগ্ন দৃষ্টি একইভাবে জানলা দিয়ে বাইরে দিকে ফেরানো। দ্যুতি তাকে নীল ক্যাপসুলটা খাইয়ে চুপচাপ বাইরে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎই তাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে প্রমিত ডাকল–দ্যুতি!
অবাক হয়ে দ্যুতি ফিরে তাকাল।
তুমি দুপুরে কী খাবে? কোথায় খাবে?
হঠাৎই চোখে জল চলে এল দ্যুতির। এই লোকটা সবার কথা এত ভাবে কেন? কেন এর বুকে এত মায়া?
সে কোনওরকমে প্রমিতকে বলল, আপনাকে এখন সে সব ভাবতে হবে না। আমি গণেশদার সঙ্গে খেয়ে নেব। আপনি ঘুমোন।
চোখের জল আড়াল করতে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে গেল দ্যুতি।
.
১০.
তারপর কেটে গেছে আরও দুটো দিন। এই দুদিনেও প্রতিদিন সকালে দ্যুতি চলে এসেছে আলিপুরদুয়ারে প্রমিতের কোয়ার্টারে। ফিরেছে রূপেন শইকিয়ার সঙ্গে সন্ধেবেলায়।
তৃতীয়দিনে প্রমিত ঘোষণা করল–আর নয়। সেইদিন থেকেই দ্যুতিকে দ্যুতির কাজ করতে হবে, তাকে তার কাজ। অর্থাৎ সে অফিস জয়েন করবে, এবং দ্যুতিকে ফিরে যেতে হবে তার ফিল্ডওয়ার্কে।
দ্যুতি তার স্বভাবসিদ্ধ স্বল্পভাষায় যতটা পারা যায় প্রতিবাদের চেষ্টা করল। বোঝাতে চাইল প্রমিতের কপালের ক্ষতটা এখনও শুকোয়নি, শরীরও দুর্বল। অতএব সে যেন আরও দু-একদিন ছুটি নেয়। সে আরও বোঝাতে চাইল যে, তার গবেষণার কাজে যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল ততটা সময় লাগবে না। কারণ, রূপকথা, লোককথা সম্বন্ধে যতটা তথ্য পাবে বলে দ্যুতি কলকাতায় বসে ভেবেছিল, এখানে এসে, দুদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বুঝতে পারছে, ততটা পাবে না। অতএব তার হাতেও সময় এখন উদ্বৃত্ত এবং সে সেই সময়টা অনায়াসে প্রমিতের জন্যে দিতে পারে।
প্রমিত রাজি হল না। দ্যুতি কালো ফ্রেমের ভারী চশমাটা দু-আঙুলে কপালের ওপর ঠেলে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল, তারপর কোনও কথা না বলে রূপেন শইকিয়ার গাড়িতে ফিরে গেল হরিণডুবির দিকে।
তিনদিন অনুপস্থিত থাকার পরে অফিসে পৌঁছে প্রমিত প্রথমে ঘণ্টা দুতিন কোনওদিকে চাইবার ফুরসত পেল না, এত কাজ জমে গিয়েছিল টেবলে। তারপর হঠাই তার কাজগুলো শেষ হয়ে গেল। শেষ ফাইলটা তার পিওন কানুবাবুর হাতে তুলে দিতে গিয়ে প্রমিত দেখল আকাশে অসময়ের হালকা মেঘ জমেছে। অদ্ভুত এক হলুদ আলোয় ছেয়ে গেছে চরাচর। তার। হঠাৎই কেমন যেন মনকেমন করে উঠল। অশোক রাইকে ডাকল না, নিজেই জিপসিটা চালিয়ে নিয়ে প্রমিত বেরিয়ে পড়ল অনির্দিষ্ট পথে। হাইওয়ে পার হয়ে ঢুকে পড়ল টাইগার রিজার্ভের মধ্যে।
বনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির গতি কমে যায়। রাস্তা এখানে নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি। সামান্য অযত্নেই অরণ্য এগিয়ে এসে গ্রাস করে নেয় মানুষের যাতায়াতের পথ। আদিম সব মহাবৃক্ষ থেকে বড় বড় ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। কখনও তা হাতিতে ভেঙেছে, কখনও ভেঙে পড়েছে পরগাছার ভারে। পড়ে আছে হাতির বিষ্ঠাও। তার ওপরে ঝাঁক বেধে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র প্রজাপতি। এইসবের মাঝখান দিয়ে সাবধানে জিপ চালিয়ে চলেছিল প্রমিত। কোথায় যাচ্ছিল তা সে নিজেও জানত না। কিছুদূর যাওয়ার পরে সে সেই দুই রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছল, যেখান থেকে ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে জয়ন্তী গ্রামের দিকে, আর সোজা পথটা শেষ হয়েছে বক্সা পাহাড়ের নীচে সান্তারাবাড়ি গ্রামে গিয়ে। ওই পথেই ভুটান থেকে পাহাড়ি লোকেদের পিঠের টুকরিতে চেপে সান্তারা, মানে কমলালেবু নামে সমতল বাংলায়। তাই গ্রামের নাম সান্তারাবাড়ি। প্রমিত সামান্য চিন্তা করে সান্তারাবাড়ির পথটাই ধরল।
একটা পাহাড়ি না পেরোনোর পরেই জঙ্গলটা ঘন হয়ে উঠেছে। সেখানেই হঠাৎ শুকনো পাতা মাড়িয়ে মানুষের দৌড়ে পালানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে জিপটাকে ব্রেক কষে দাঁড় করালো প্রমিত। তারপর নিজেও দৌড়ে গেল পলায়নপর পদশব্দের পিছনে। মানুষগুলোকে দেখতে পেল না প্রমিত, তবে তাদের ফেলে যাওয়া শালগাছের গুঁড়িটা দেখতে পেল। প্রমিতের সার্ভিস-রিভলভারটা সবসময়েই গাড়ির গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রাখা থাকে। চট করে সেই অস্ত্রটা বার করে এনে প্রমিত জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে গেল। ভালো করে গাছের গুঁড়িটাকে দেখে সে বুঝতে পারল, হাতকরাত দিয়ে কাটা হয়েছে গাছটাকে–ওইখানেই, সম্ভবত কাল রাত্রেই। বিশাল গুঁড়িটার গা থেকে তখনও কাঁচা রজন গড়াচ্ছে। এই গাছটার এত বড় হতে কম করে সত্তর আশি বছর সময় লেগেছিল, অথচ নষ্ট হল কত সহজে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রমিত গাড়িতে ফিরে এল। তার প্রিয় এই অরণ্য কদিনের মধ্যেই লুঠেরাদের স্বর্গভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক। বিমল বাবুয়াদের মৃত্যুর পর থেকেই এখানে। পাহারা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু যে এইভাবে অবাধে গাছ কাটা হচ্ছে তাই নয় কাল রাতেই খবর এসেছে ঘাঘরঝোরার দিকে একটা বড় সম্বর হরিণকে মেরে পোচাররা তার শিং সমেত মাথাটা কেটে নিয়ে পালিয়েছে। এসব আটকাবার একটাই উপায়, নাইট-পেট্রলিং আবার। চালু করা। কিন্তু অবশিষ্ট ফরেস্টগার্ডরা বিমল বাবুয়াদের মৃত্যুর পর থেকে এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে, তাদের দিয়ে সে কাজ এই মুহূর্তে হবে বলে মনে হয় না। প্রমিত কলকাতায় চীফ কনজার্ভেটর অরিন্দম বসুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল ব্যাপারটা নিয়ে। তিনিও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায়ের কথা বলতে পারছেন না। সময়কেই এখন সময় দিতে হবে, যাতে সে ওই তিনজনের মৃত্যুর স্মৃতির ওপর ধুলো ফেলতে পারে। কিন্তু সে সময়টা কতখানি? তার মধ্যে নতুন করে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেবে না তো?
প্রমিত গাড়ি ঘুরিয়ে জয়ন্তী গ্রামের দিকে ফিরে চলল। ওখানে তাদের একটা বড় আউটপোস্ট রয়েছে। সেখান থেকে কিছু লোককে এখানে পাঠাতে হবে গাছের গুঁড়িটা রিকভার করে ডিপোয় নিয়ে যাবার জন্য। তাড়াতাড়ি কাজটা না সারলে আবার ফিরে আসবে কাঠ চোরেরা। কুচবিহার বা আলিপুরদুয়ারের বাজারে ওই গুঁড়িটার দাম হবে কিছু না হলেও দু-লক্ষ টাকা। যারা কাজটা করেছে তারা অবশ্য পাঁচশো, হাজার টাকার বেশি পাবে না। তবু সেই টাকাটাই এই গরিব লোকগুলোর কাছে অনেক। সেই জন্যেই ওরা ফিরে আসবে, কাঁধে কাঁধে ওই বিশাল গুঁড়ি বয়ে নিয়ে চলে যাবে গ্রামের মধ্যে লুকানো ডিজেল মোটরে চলা বেআইনি করাতকলের উঠোনে।
জয়ন্তীতে এসে প্রত্যেকবারই প্রমিত কিছুক্ষণ গ্রামের বাইরে চা-জলখাবারের দোকানটায় দাঁড়ায়। এবারেও দাঁড়াল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার এই দোকানটায় এলে। দোকানের এই বড়সড় চালায় ঢাকা ঘরটা, এই পাকা মেঝে–এ সবই আসলে এক সময়ের এক রেলওয়ে স্টেশনের অংশ। এইখানেই অনেকবছর আগে ছিল জয়ন্তী রেল স্টেশন। তখন আলিপুরদুয়ার থেকে এই অবধি চলে আসত মিটার গেজের ট্রেন। এই দোকানের বেঞ্চিতে বসে উলটোদিকের গাছপালাগুলোর মধ্যে নজর মেলে চাইলে এখনও মরচে পড়া তার, লোহার খুঁটি এইসব দেখতে পাওয়া যাবে। সবই দূর অতীতের সেই ট্রেন চলাচলের চিহ্ন। বক্সাকে যখন কেন্দ্রীয় সরকার সংরক্ষিত অরণ্য বলে ঘোষণা করল, তখন দেশের আইন অনুযায়ী জঙ্গলের ভেতরের সমস্তরকম কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আলিপুর জয়ন্তী রেলপথ, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জয়ন্তী নদীর তীরে ডলোমাইটের খাদানগুলো।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এক ভাঁড় চা খেয়ে প্রমিত আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ফরেস্টের আউটপোস্টটার মধ্যে। সেখানে নিজের লোকজনকে কাঠচুরির জায়গাটা বুঝিয়ে দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে।
জঙ্গলে অন্ধকার নামে আচমকা। কিছুদূর যাওয়ার পরেই প্রমিতকে জিপের হেড লাইট জ্বালতে হল। ঘড়ি দেখল সাড়ে ছটা। নিজের অজ্ঞাতেই কখন যে সে হরিণডুবির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছিল জানে না। খেয়াল করল, যখন গাছপালার ফাঁক দিয়ে জয়ন্তী নদী আর নদীর ওপাড়ে পাহাড় দেখতে পেল। প্রমিত সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে জিপটাকে রাস্তার মধ্যেই দাঁড় করিয়ে দিল। অন্ধকারের ঘাতকদের সম্বন্ধে তার মনের মধ্যেও গভীর এক ভয় শেকড় গেড়ে বসেছিল। জিপের হেডলাইট জ্বেলে রেখে তাদের টার্গেট হওয়ার ইচ্ছে প্রমিতের ছিল না।
জিপটাকে দাঁড় করিয়ে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল প্রমিত।
এই পথ দিয়েই সেই রাত্রে বিমল বাবুয়ারা এগিয়ে গিয়েছিল। ওই নদীর তীরের ফাঁকা জমিটায় পৌঁছিয়ে ওরা শুয়ে পড়েছিল। তারপর বুকে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিল জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে বাইরে। আর তখনই..।
হঠাৎই প্রমিতকে ভীষণ চমকে দিয়ে রাস্তার অন্যপ্রান্তে একটা লোকের চেহারা জেগে উঠল। লোকটা মাথা নীচু করে আপন মনে নদীর দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। জিপটাকে সে লক্ষ করেনি। প্রমিত গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রাখা রিভলবারটার দিকে হাত বাড়িয়েও হঠাৎ হেসে ফেলে হাতটা গুটিয়ে নিল। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। এ সেই বুড়ো সোনারু মাঝি– যে লোকটা সবার আগে তিনজন ফরেস্টগার্ডের মৃতদেহ দেখেছিল। বুড়ো আরও একটু এগিয়ে আসতেই প্রমিত তার সামনে সামনে হেঁটে আসা ছাগল চারটেকেও দেখতে পেল। একই সময়ে বুড়োও মুখ তুলেই দেখতে পেল দাঁড়িয়ে থাকা জিপটাকে, আর দেখা মাত্র উলটোদিকে ঘুরে দৌড়নোর উদ্যোগ করল।
প্রমিত তাড়াতাড়ি জিপ থেকে নেমে হাঁক ছাড়ল–সোনারুকাকা! ও সোনারুকাকা! আরে ভয় পেলে না কি? আমি গো আমি, ডিএফও সাহেব। ভয় পাও কেন?
বুড়ো সোনারু একগাল হেসে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, অ্যাই দ্যাখো। আমি ভাবলাম বুঝি খুনেগুলো। প্রমিতের দিকে এগিয়ে এসে আভূমি নত হয়ে তাকে প্রণাম করল সোনারু।
প্ৰতিনমস্কার জানিয়ে প্রমিত বলল, তোমাকে কিন্তু জেলে পোরা উচিত সোনারুকাকা। তোমাদের না এই দিকে আসতে বারণ করেছি। কেন এসেছ? তুমিই তো সবথেকে ভালো জানেনা, একসপ্তাহ আগে কী হয়েছিল ওইখানে।
না এলে যে চলে না বাপ আমার। ফোকলা দাঁতে বলল সোনারু মাঝি। চাষের সময়। চারদিকে জমিতে ফসল। এখন ছাগলগুলো চরানোর ফাঁকা জমি পাই কোথায় মানিক? তাই আসতে হয়।
আর গুলি যখন তোমার পেট ফুড়ে দেবে, তখন কোথায় যাবে?
না বাপ, দেবে না। ওই পাহাড় থেকে আমাকে দেখা কি সোজা কথা? দেখবে, তবে না গুলি করবে।
তাহলে ওদের দেখেছিল কেমন করে? ওই বিমল, সন্দীপ ওদের?
বৃদ্ধ সোনারু এই বক্সাবনের ঘাসমাটির ওপর জন্মেছে। এই বনের ফলপাকুড়, পাখপাখালি, খরগোশের মাংস খেয়ে যুবক হয়েছে। এই বনের গাছের নীচে তার নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই অরণ্য থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে পেট ভরিয়েছে তার বংশধরদের। বনের ভেতরের জলাশয়গুলোর ধারের নরম মাটি যেভাবে জল খেতে আসা জীবজন্তুদের পায়ের ছাপে ভরে যায়, সেইভাবে সোনারুর মুখের চামড়ায় এই অরণ্য অজস্র দাগ কেটে গেছে। সোনারুর সঙ্গে কথা চালাবার সময় প্রমিতের মনের গভীরে হয়তো এই চিন্তাগুলো কাজ করছিল। নাহলে সে অন্ধকার বনপথে দাঁড়িয়ে তার সাথে এত কথা বলবেই বা কেন? তার মনে একটা ক্ষীণ আশা হয়তো ছিল–বুড়ো সোনারু তিন ফরেস্ট গার্ডের হত্যারহস্যের ওপর কোনও আলোকপাত করতে পারবে।
তবে প্রমিতের কথার উত্তরে সোনারু মাঝি যা বলল, তাতে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধেই প্রমিতের সন্দেহ জাগল। সোনারু বলল, ওই তিনটে ছেলে গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল গো। নাহলে খুনেগুলো ওদের দেখবে কেমন করে?
মানে!–সোনারুর কথা শুনে বিস্ময়ে প্রমিতের মুখ দিয়ে এ ছাড়া আর কোনও শব্দ বেরোল না। গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল মানে?
জঙ্গলের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে ওরকম অনেক কিছু হয়। ওই ছেলেগুলো বড় বেশি জঙ্গলের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করত। ওরকম করতে নাই। জঙ্গলকে একটু তফাতে রাখতে হয়। না হলে গায়ে আলকুশি লাগে, গা চুলকে লাল হয়ে যায়। কতরকমের গন্ধ পোকা আছে। গায়ে ঘষে গেলে দুর্গন্ধে তিষ্ঠোতে পারবে না। তেমনি গায়ে আলো লেগে যায়…
আলো লেগে যায়!
যায় বই কি। আমি তো এইখানে সন্ধেবেলা অবধি বসে থাকি। বসে বসে দেখি ওই শিরোমণির গড়ের পেছনের রাস্তাটা ধরে কখনও একটা বেজি দৌড়ে নেমে আসছে, কখনও একটা সাপ…
মুচকি হেসে প্রমিত বলল, বাবা, তোমার চোখের জোর তো এই বয়সেও সাংঘাতিক কাকা! এত দূর থেকে বেজি দেখছ, সাপ দেখছ! চোখ, না দূরবীন?
এমনিতে কি দেখতে পাই মাণিক? ওদের শরীরগুলো যে আগুনের মতন জ্বলে, তাতেই দেখতে পাই।
বুঝলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল প্রমিত। সে সোনারুর মুখ থেকে কড়া দিশি মদের গন্ধ পাচ্ছিল।
তারপর জিপে উঠতে উঠতে বলল, যাই হোক, তুমি সন্ধের পর এখানটায় ঘোরাঘুরি কোরো না।
আবার জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে বনের পথে চলল প্রমিত। মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই। সে জানে কোথায় যাওয়ার জন্যে সে বেরিয়েছে, কোথায় না গিয়ে সে আজ বাড়ি ফিরতে পারবে না।
দ্যুতিকে সে একটা ধন্যবাদ অবধি দেয় নি। সেই মেয়েটাকে, যে না কি এটিকেট জানে না।
সে নিজে জানে তো?
প্রমিতের মনে পড়ছিল, সংসারে অনভিজ্ঞ মেয়েটা কখনও তার মাথা ধুইয়ে দিতে গিয়ে সারা বিছানায় জল ফেলে একাকার করেছে। কখনও হাত চলকে সুপ ফেলেছে তার গায়ের ওপর। তবু চলে যাচ্ছে না তাকে ছেড়ে। হাঁ, তখনই গিয়েছে যখন সে তাকে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছে।
ধন্যবাদ দিতে হবে ওকে। ক্ষমা চাইতে হবে ওই মেয়েটার কাছে।
কিন্তু কেমন করে…কোন ভাষায় সে সব করবে প্রমিত?
.
হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোর সামনে যখন জিপটাকে দাঁড় করালো প্রমিত, তখন নদীর বুকে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। অন্ধকারে নদীর ওপাড়ের পাহাড়গুলোকে অলৌকিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে ওরা যেন গা মোড়ামুড়ি করছে, সামান্য হলেও সরে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে, আর সেইসব কথাবার্তা শীতল বাতাস হয়ে ধেয়ে এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ঘরের ভেতর মোমবাতির আলো।
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রমিত কম্পমান মোমবাতির সামনে বসে গভীর মনোযোগে খাতায় লেখাজোখা করছে যে মেয়েটা, তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাই, জীবনে এই প্রথম, প্রমিত ভীষণভাবে অনুভব করল, ওই যে মেয়েটা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে আছে, মোমবাতির আলোয় যার কপালের ওপর এসে পড়া ঝুরো চুলগুলোকে মনে হচ্ছে সোনার তার দিয়ে তৈরি, যার গলার কাছে একটা নীল শিরা দপদপ করছে আর যার বুকের ওপর থেকে খসে পড়েছে। অন্যমনস্ক ওড়না–ও দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত নয়, পিএইচডি অ্যাসপায়ারেন্ট নয়। ও এক নারী। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি, শরীরের প্রতিটি কোষে ও প্রমিতের থেকে আলাদা। ও ফিল্ডওয়ার্ক করতে এই হরিণডুবিতে আসেনি। ও এই হেমন্তের অরণ্যে এসেছে শুধু প্রমিতের জন্যে। যেভাবে মিলনপাগল পুরুষ তিমির ছুঁড়ে দেওয়া শব্দোত্তর তরঙ্গ চেতনায় ধারণ করে হাজার মাইল সমুদ্র পেরিয়ে ছুটে আসে তার সঙ্গিনী, সেই ভাবে শুধু প্রমিতের সঙ্কেতে সাড়া দিয়ে ও এখানে এসেছে। ও ওই পাহাড় নদী বনের সমান বয়সি এক আদিম সত্ত্বা, যেমন আদিম প্রমিত নিজে।
দ্যুতির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হয়তো তাকে কিছু বলে থাকবে। হঠাই সে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। বলল, একি প্রমিতদা। আপনি কখন এলেন! আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? আবার জ্বর এসেছে না কি আপনার?
ভীষণ ব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নেমে দ্যুতি এগিয়ে এল প্রমিতের দিকে। দ্যুতি একেবারে প্রমিতের বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল। প্রমিতের দুই করতল তার অজান্তেই দ্যুতির ছোট্ট সুন্দর মুখটাকে ঘিরে ধরল। সেই দুই হাতের উত্তাপে দ্যুতির গালের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছিল।
তার ভালো লাগছিল খুব।
৩. হরিণডুবি বনবাংলো
১১.
আরও ঘণ্টাখানেক পরের কথা।
হরিণডুবি বনবাংলোর বারান্দায় ঘনিষ্ট হয়ে বসে আছে প্রমিত আর দ্যুতি। রাত বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত। দ্যুতির গায়ে তাই একটা হালকা পশমের চাদর। প্রমিতও জিপের পেছনের সিট থেকে উইন্ডচিটারটা এনে গায়ে চাপিয়েছে।
প্রমিতের এখনও অবধি আলিপুরদুয়ারে ফেরার কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই গড়িমসির অছিলা অবশ্য একটা রয়েছে। রূপেন শইকিয়া এখনও তার জাঙ্গল ট্যুর সেরে ফেরেননি। তার সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা হবে না?
বারান্দায় বসে ওরা তাকিয়েছিল সামনের অন্ধকারের দিকে। দুটো নাইটজার পাখি মাঝে মাঝে বাগানের বেড়ার ওপর এসে বসছিল, আবার পরমুহূর্তেই কোনও পতঙ্গকে ধাওয়া করে উড়ে যাচ্ছিল। তাদের বড় বড় গোল গোল চোখ অন্ধকারে জুলজুল করে উঠছিল। দিনকানা এই পাখিগুলো যতক্ষণ আকাশে আলো থাকে ততক্ষণ জঙ্গলের রাস্তায় ঝরা পাতার রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে মাটিতে বুক চেপে শুয়ে থাকে। তাড়া দিলেও নড়তে চায় না। তখন দেখলে কে বলবে অন্ধকার নামলে এই পাখিগুলোই এমন তড়িৎগতির নিপুন শিকারি হয়ে উঠতে পারে! প্রমিত পাখিদুটোকে দেখতে দেখতে ভাবছিল, ওই দূরের পাহাড়ের ওপর এমনই কিছু রাতশিকারি মানুষ রয়েছে, অন্ধকারেই যারা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ওদেরও কি নাইটজারের মতন অন্ধকারে চোখ জ্বলে?
একটু আগেই প্রমিত আর দ্যুতি একে অন্যের কাছে নিজেদের ভালোবাসার কথা জানিয়েছে। চরিতার্থ হয়েছে ওদের প্রেম। তবু এমন সময়ে দুই যুবক যুবতীর মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আশা করা যায় ওদের মধ্যে তা দেখা যাচ্ছে না। করণটা সহজেই বোধগম্য। বড় দুঃসময়ে ওরা একে অন্যের কাছে এসেছে।
মন হাতড়ে লঘু কথা খুঁজতে গিয়ে হঠাই প্রমিতের মনে পড়ল আজ কিছুক্ষণ আগে জঙ্গলের রাস্তায় সোনারু মাঝির সেই প্রলাপ। সে নিজের মনেই হেসে উঠল।
কী হল, হাসছ যে? তার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিগ্যেস করল দ্যুতি।
প্রমিত হাসতে হাসতেই বলল, সোনারু মাঝি কী বলছিল জানো? বলছিল বিমল বাবুয়ারা জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল। সেইজন্যে টেররিস্টরা অন্ধকারের মধ্যে ওদের দেখতে পেয়েছিল।
দ্যুতি অল্প হাসল। কোনও জবাব দিল না।
তারপর যা বলল, শুনলে তো তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। বলল, ও না কি শিরোমণির গড়ের পেছনের রাস্তায় মাঝে-মাঝেই অমন আলোমাখা বেজি কিম্বা সাপ দেখতে পায়।
প্রমিতের এই কথাটা শুনে দ্যুতি কিন্তু হাসতে পারল না, বরং ভারি অস্বস্তি নিয়ে বলল, জানো, এই কথাটা শুনে আমার কি যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছে না। এরকমই একটা গল্প যেন কোথায় শুনেছিলাম! আলোর পাখির গল্প।
কোনও রূপকথার গল্পে বোধহয়। তোমার তো ওটাই কাজ রূপকথা খোঁজা। বাদ দাও না। মনে করেই বা কী হবে? আমার দুর্দশা নিয়েই এখন অনেক গল্প লেখা যায়। আমি আর নতুন গল্প কী শুনব?
দ্যুতি চুপ করে গেল। আজই প্রথম, প্রমিত তার গত কয়েকদিনের সমস্ত উদ্বেগের কথা তার কাছে উজাড় করে দিয়েছে। তিন সহকর্মীর রহস্যময় পরিস্থিতিতে মৃত্যুর কথা, শিরোমণির গড়ের দিকে বিনতা মেহরার এগিয়ে আসা থাবার কথা, এবং শেষ অবধি সেই লোকগুলোর কথা, যারা কদিন আগেও ব্যানার্জি সাহেবকে তার বড় দিল-এর জন্যে শ্রদ্ধা করত, অথচ গুলাবি নার্জিনারির মৃত্যুর পরে যারা পাথর মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
পাথরটা প্রমিতের কপালে লাগেনি, লেগেছে বুকের ভেতরে। আর দ্যুতি নিজেও যন্ত্রণাটা নিজের বুকের মধ্যে অনুভব করছিল। তাই সে আর এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ পালটাবার জন্যে বলল, মিস্টার শইকিয়ার কী হল বল তো? রাত নটা বাজতে চলল, এখনও উনি ফিরলেন না।
প্রমিত চট করে একবার নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তো ভাবছি.. নাঃ, আর বোধহয় ভাবতে হবে না। ওই যে তিনি এসে গেছেন।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। গাড়িটা জিগজ্যাগ রাস্তার বাঁক নিতে-নিতে এগিয়ে আসছে। একটু বাদেই গাড়িটা বনবাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল। প্রমিত এবং দ্যুতি অবাক হয়ে দেখল সেটা মোটেই রূপেন শইকিয়ার বোলেরো নয়, হরিণডুবি বিট অফিসের উইলি জিপ। জিপ থেকে লাফিয়ে নামলেন বিট-অফিসার সজল দত্ত, তারপর জোরে পা চালিয়ে বাংলোর বারান্দায় এসে উঠলেন। বললেন, স্যার আলিপুরদুয়ার পুলিশ স্টেশন থেকে কাশ্যপ সাহেব আর টি সেটে কল করেছিলেন। কি যেন একটা জরুরি ব্যাপার জানানোর জন্যে আপনাকে একবার ডাকছেন।
কথাটা শুনে প্রমিত চোখের দৃষ্টিতে দ্যুতির কাছ থেকে বিদায় নিল। তারপর লাফ মেরে বারান্দা থেকে নেমে দৌড়ল নিজের জিপসির দিকে। সজল দত্ত বাংলোয় ঢোকার ঠিক তিন মিনিট বাদে প্রমিতের জিপসি দ্রুত কয়েকটা বাঁক নিয়ে বনের পথে মিলিয়ে গেল, এবং পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় সেই জিপসিকে দেখা গেল আলিপুরদুয়ার পুলিশ স্টেশনের দরজায়।
থানার উঠোনটা পেরোনোর সময়েই প্রমিত দেখল একটা বড় দশ চাকার ট্রেলার সেখানে পুলিশ পাহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। গড়িটায় প্রায় খান আষ্টেক বিশাল গাছের গুঁড়ি, যাকে বলে লিগ, লোড করা আছে। অভ্যস্ত চোখে প্রমিত এটাও দেখে নিল যে, প্রত্যেকটা লগের গায়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হ্যাঁমারিং-এর ছাপ রয়েছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে বন থেকে যত লগ বেরোয় সবার গায়ে লোহার ধারালো ছাঁচ দিয়ে মার্কা আর নম্বর খোদাই করে দেওয়া হয়, যাতে পরিবহনের সময় মিলিয়ে দেখে নেওয়া যায় যে, বিল কিম্বা চালানে যে কাঠের কথা লেখা আছে সেই কাঠই গাড়িতে যাচ্ছে কিনা। একেই বলে হ্যামার-মার্কিং।
হ্যামারিং-এর মার্ক দেখে প্রমিত তাই একটু অবাক হল। মার্কাগুলো অরুণাচলের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। কিন্তু যাই হোক, চোরাই কাঠ তো নয়। তাহলে দেবেশ কাশ্যপ গাড়িটাকে আটকালেন কেন?
কাশ্যপ সাহেবের ঘরে ঢুকে প্রমিত দেখল দুটো লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা ওই ট্রেলারের ড্রাইভার আর খালাশি। দেবেশ কাশ্যপ, ওসি রতন বৈদ্য আর অন্য দুজন পুলিশ অফিসার মন দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা অনেকগুলো ছোট ছোট প্লাস্টিকের পাউচ নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন। প্রমিত ঘরে ঢুকতে দেবেশ কাশ্যপ বাকি তিনজন পুলিশ অফিসারকে চোখের ইশারায় বাইরে যেতে বললেন। তারা যাবার সময় ওই ড্রাইভার আর খালাশিকেও তুলে নিয়ে গেল সম্ভবত লক্-আপের দিকেই।
ওরা বেরিয়ে যাবার পরে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, ব্যানার্জি সাহেব, একটা গাড়ি সীজ করেছি দেখেছেন বোধহয়।
হ্যাঁ, দেখলাম। কিন্তু কেন করেছেন বুঝলাম না। চোরাই কাঠ নয় বলেই তো মনে হচ্ছে। না কি ফেক হ্যামার মার্ক ইউজ করেছে?
না, মার্কাগুলো জেনুইন। অরুণাচল থেকে আসছে, শিলিগুড়ি যাবে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ইস্যু করা বিল, চালান আছে। আমরা বক্সিরহাট চেকপোস্ট থেকে চেজ করতে শুরু করেছিলাম। তুফানগঞ্জে পৌঁছে ধরেছি।
প্রমিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, জেনুইন কাগজপত্র, জেনুইন কনসাইনমেন্ট–তাহলে। ধরলেন কেন?
মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কাঠ ধরিনি তো। কাঠের মধ্যে লুকিয়ে যা নিয়ে আসছিল সেইগুলো ধরেছি। এই দেখুন, এইগুলো। তিনি আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা প্যাকেটগুলোর দিকে নির্দেশ করলেন।
প্রমিত টেবিলের কাছে গিয়ে প্যাকেটগুলো দেখল। প্রত্যেকটা প্লাস্টিকের পাউচের মধ্যে সাদা সাদা একরকমের গুঁড়ো ঠেসে প্যাক করা রয়েছে। এরকম প্রায় একশো-দেড়শো প্যাকেট ছড়িয়ে আছে টেবিলের ওপর।
দেবেশ কাশ্যপ পাশ থেকে বললেন, আন্দাজ করতে পারছেন, এগুলো কী? হেরোইন। পুরোনো গাছের গুঁড়ির মাঝখান বরাবর যে ফাঁপা গর্তটা থাকে, তার মধ্যে প্যাক করে নিয়ে আসছিল। আমাদের কাছে ইনফর্মেশন ছিল, তাই ধরতে পারলাম। না হলে কার বাবার ক্ষমতা আছে ধরে?
প্রমিত এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, তার মুখ থেকে কথা সরছিল না। সে বলল, অরুণাচলে হেরোইন তৈরি হয়?
না, না, অরুণাচলে হয় না। মায়ানমার থেকে অরুণাচলে স্মাগল করা হয়। মায়ানমারে আবার পৌঁছয় চায়না থেকে। ওইসব বর্ডারগুলোয় পাহারা দেওয়া খুব কঠিন জানেন তো? ভয়ানক গভীর জঙ্গল। স্থানীয় গরিবস্য গরিব মানুষজনকে ট্রান্সপোর্টের কজে লাগানো হয়। তারা বাঘের মুখের সামনে দিয়ে, সাপের ছোবল এড়িয়ে পায়ে হেঁটে এই বর্ডার থেকে ওই বডারে মাল আনা নেওয়া করে। তারপর একবার কোনওরকমে সেই মাল শিলিগুড়ির মার্কেটে পৌঁছে গেলে ছোট ছোট ভাগে পেডলারদের কাছে ছড়িয়ে যায়। তখন এ বস্তুকে ধরা অসম্ভব।
একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে প্রমিত বলল, এগুলোর দাম কেমন হবে?
এই টেবিলে এককোটি টাকার বেশি দামের হেরোইন আছে। এ বছরে এটাই বিগেস্ট হল। নারকোটিক ডিপার্টমেন্টের লোকদেরও খবর পাঠিয়েছি। এসে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যে।
প্রমিত তার ডান হাতটা দেবেশ কাশ্যপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশনস্। সত্যি আপনার মতন অফিসাররা…
আপনাকে কেন ডেকেছি জিগ্যেস করলেন না? প্রমিতের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে জিগ্যেস করলেন কাশ্যপ সাহেব।
কোনও বিশেষ কারণ আছে না কি? অবাক হয়ে বলল প্রমিত। আমি তো ভাবলাম কাঠ টাঠের ব্যাপার, তাই।
আরে ধুর মশাই। এই সামান্য কারণে আপনাকে আর টি সেটে যোগাযোগ করব? শুনুন, আমাদের আজকে আরও বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট আছে।
ওরে বাবা! এক কোটি টাকার হেরোইন উদ্ধারের থেকেও বড় অ্যাচিভমেন্ট!
ইয়েস স্যার! সেটা বলার আগে আপনাকে ড্রাগচক্রের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিই। না হলে অ্যাচিভমেন্ট বলছি কেন বুঝতে পারবেন না।
দেখুন, ড্রাগ ট্রাগ মাঝে মাঝেই এদিকে ওদিকে ধরা পড়ে। খবরের কাগজে সেসব বিবরণ পড়েন নিশ্চয়। কিন্তু যাদের ধরতে পারা যায় না, তারা হল এই ব্যাবসার মালিক। কেন ধরা যায় না জানেন? যে সিস্টেমে বাবসাটা চলে, তার জন্যে। সেটা একটা ইউনিক সিস্টেম। নামটা শুনে থাকবেন–ড্রাগ কার্টেল। ড্রাগ চক্র।
চক্র না বলে বৃত্ত বললেই আরও অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হয় অবশ্য। একটা নয়, সমকেন্দ্রিক অনেকগুলো বৃত্ত–যেরকম বৃত্ত তৈরি হয় পুকুরে একটা ঢিল ফেললে।
এই পুরো কার্টেলের একদম বাইরের পরিধিতে কাজ করে ড্রাগ-পেডলাররা। তারা হল। সোজা বাংলায় ফেরিওয়ালা। অন্ধকার গলির মুখে, বেশ্যাপল্লীর বারান্দায়, স্টেশন প্লাটফর্মের দূরতম প্রান্তে এরা ছেঁড়া নোংরা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকে। পকেটে থাকে চরস কিম্বা হেরোইনের পুরিয়া। নেশাড়ুরা জানে ঠিক কোনখানে কখন কোন পেডলারকে পাওয়া যাবে। তারা নেশার খোঁজে ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছিয়ে যায়।
এক-একটা এরিয়ার পেডলারদের কন্ট্রোল করে দুজন বা তিন জন এজেন্ট। এরা পেডলারদের হাতে মাল পৌঁছিয়ে দেয়, আবার তাদের কাছ থেকে বিক্রির টাকাও উশুল করে। পেডলারদের এলাকা দখলের লড়াইয়ে অস্ত্র সরবরাহ করে। কাউকে পুলিশে ধরলে তার ফ্যামিলিকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচায়। এইসব কাজের জন্যে এজেন্টরা কমিশন পায়।
এর পরে বৃত্তে থাকে ম্যানেজার। বেশ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মতন শোনাচ্ছে না ব্যাপারটা? সত্যিই ড্রাগের জগৎটা কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মতন প্রফেশনালিই চালানো হয়। যাই হোক, ম্যানেজারই বিদেশ থেকে নেশার জিনিস আমদানি করে, তার জন্যে যে বিপুল পরিমাণ টাকা লাগে তার ব্যবস্থা করে এবং অস্ত্র আমদানিও করে। ম্যানেজারের অনেকসময়েই অন্য জীবিকাও থাকে–কোনো সম্মানজনক জীবিকা–যার আড়ালে থেকে সে এই কাজগুলো চালায়।
এই থানার ঘরে বসেই একটা সত্যি কথা আপনাকে বলছি– পুলিশ এবং পলিটিকাল লিডারদের হাতে না রেখে একটা কার্টেলও তৈরি হতে পারে না। এ ব্যাপারেও সিসিলি এবং শিলিগুড়িতে তফাত নেই। সেই নেতা এবং অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বটাও ম্যানেজারের।
আর সমস্ত বৃত্তের কেন্দ্রে একটা ধূর্ত মাকড়শার মতন বসে থাকে মালিক কিম্বা কিং পিন। তার অস্তিত্ব জানে শুধু ম্যানেজাররা, আর কেউ নয়। হতে পারে সেই কিং-পিন নিজে একজন বিখ্যাত সমাজসেবী, রাজনৈতিক নেতা কিম্বা পুলিশ অফিসার। মুখোশের আড়ালে তার মুখটা সাধারণ লোক কোনও দিন খুঁজেই পাবে না। খুঁজে পেলেও বিশ্বাস করতে চাইবে না। কেউ।
বুঝলেন ব্যানার্জিসাহেব, আমরা যখন ড্রাগ ধরি, তখন আমাদের হাতে ধরা পড়ে এইসব ছুটকো ছাটকা পেডলাররা, কিম্বা বড়জোর কোনও এজেন্ট। আজকে যেমন ওই লোক দুটো…ওই ড্রাইভার আর খালাশি ফেঁসেছে। ওদের কাছ থেকে কার্টেল সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারব না, কারণ ওরা নিজেরাই একেবারে বাইরের পরিধির লোক। কেন্দ্রের ধারে কাছেও কোনওদিন যায়নি। তাই ওরা আর আমাদের কী ইনফরমেশন দেবে?
তবু আমরা জেনেছি, আর সেটাকেই বলছি বড় অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু…
কিন্তু কী, মিস্টার কাশ্যপ?
আজ আমরা এরকমই একজন কিং-পিনের খোঁজ পেয়েছিলাম। কিন্তু সে বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল। দুপুর থেকে তার সবকটা ডেন-এ ছাপ্পা মেরেছি। পাখি ভাগলবা।
তবে সে আর লুকনো গর্তের বাইরে আসবে না, আপনার সঙ্গে আর কলার তুলে কথা বলবে না, লোক খ্যাপাবে না শিরোমণির গড় হাত করার জন্যে। নামটা কি আর বলবার দরকার আছে?
কঠিন হয়ে উঠল প্রমিতের মুখ। সে রুদ্ধ স্বরে বলল, মধু বর্মন?
ইয়েস। এই নামটা শোনানোর জন্যেই আপনাকে ডেকেছিলাম।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রমিত বলল–মধু বর্মন সম্বন্ধে টিপ-অফটা কে দিল কাশ্যপ সাহেব?
বলতে পারব না। অ্যানোনিমাস কল ছিল, পাবলিক বুথ থেকে। তবে একদম ইনসাইডার–সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ট্রেলারের নম্বর, কখন কোথা দিয়ে ঢুকবে, কোথায় মাল লুকোনো আছে সব বলে দিয়েছিল। মধুর নামটাও সেই ইনফর্মারই বলেছিল। কথাগুলো যে মিথ্যা বলেনি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। মধুর ডেনগুলোর ঠিকানাও ঠিকঠাক দিয়েছে।
শুধু মধু সটকে গেল।
.
১২.
কটা বাজল?–পুরুষ কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল।
পাশ থেকে নারীটি রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ি দেখে উত্তর দিল নটা। তারপর যোগ করল–আমার খুব ভয় করছে।
–ভয় করছে? কিসের ভয়?
–কিসের আবার? ওয়াইল্ড অ্যানিমাল-এর। হাতি..বাঘ…।
নিশ্চিন্ত থাকো। তুমি যাদের নাম করলে, তারা নির্দিষ্ট রুটে ঘোরাফেরা করে। এই জায়গাটা সেই রুটের অনেক বাইরে।
তা ছাড়া আরও একটা ভয় রয়েছে। সেটাও তুমি ভালো করেই জানো।
– পাহাড়ের ওপাশ থেকে ছুটে আসা বুলেট?–গোপনীয়তার কথা ভেবেই নিশ্চয় চাপা স্বরে হাসল পুরুষটি। না হলে হা হা করেই হেসে উঠত। হাসি থামিয়ে বলল, এই অন্ধকারে?
–এইরকম অন্ধকারেই তো ওই লোকগুলো মরেছিল, ওই যে কী যেন নাম…?
–বিমল, বাবুয়া, সন্দীপ। বাদ দাও ওদের কথা। নিশ্চয় টর্চ জ্বেলে হাঁটছিল, কিম্বা..বিড়ি টিড়ি খাচ্ছিল। তোমার যদি অতই ভয় করছে, তা হলে এসো, বসে পড় এই ঘাসের ওপর।
–সেই ভালো। কিন্তু সাপ টাপ নেই তো?
–এই শীতে সাপ? তুমি কি বিলেত থেকে এলে? বসো বসো।
শাড়ির খসখস আওয়াজ শুনে বোঝা গেল নারীটি আজ্ঞা পালন করল।
–বেশ। এবার চট করে বলে ফেল, কী জন্যে ডেকেচ্ছ। আমার হাতে সময় বেশি নেই।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নারীটি বলল–যেটা জানতে চাইছি, সেটা হল, মধু বর্মনকে বলি চড়ালে কেন?
মধু ক্রমশ আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বিপজ্জনক পথে পা ফেলছিল। পয়সা আমিও চাই, কিন্তু অতটা রিস্ক নিতে চাই না। আমাকে এখনও অনেকদিন ধরে পয়সা রোজগার করে যেতে হবে। কেন, তা তুমি জানো। তাই আমার ছদ্মবেশ প্রয়োজন। মধু আর দুয়েকদিন বেঁচে থাকলে আমি এক্সপোজড হয়ে যেতাম। সেটা আমি গুলাবি খুন হওয়ার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর তা ছাড়া…
তা ছাড়া কী সেটা আমি জানি। মধু তোমার রাইভ্যাল হয়ে উঠছিল। ড্রাগ বিক্রির পয়সায় ও অল্পদিনেই প্রচুর ক্যাপিটাল জমিয়ে ফেলেছিল। সেই ক্যাপিটাল দিয়ে ও তোমার সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। চাকর থেকে মালিক হয়ে উঠছিল, ঠিক কি না?
আবারও চাপা স্বরে হাসল পুরুষটি। বলল–তুমি আমার সম্বন্ধে যতটা জানো, আমার স্ত্রীও অতটা জানে না।
নারীটিও হাসল। হেসে বললজগতের নিয়মই তাই। প্রেমিকা স্ত্রীয়ের থেকে এক পা এগিয়েই থাকে। তারপর একটু দ্বিধান্বিত সুরে বলল, তোমার চোরাশিকারের ব্যবসা এখন ফুলে ফেঁপে উঠবে, কারণ বনে কোনও পাহারা নেই। বাড়বে কাঠ চুরির ব্যবসাও…
বারবার চুরি, চোরা এই সব শব্দ গুলো ব্যবাহার কোরো না। শুনতে ভালো লাগে না।
–স্যরি। কিন্তু আমার কী হবে?
–মানে?
–মধু বর্মনকে তো সরিয়ে দিলে। এবার প্রমিত ব্যানার্জির ওপর চাপটা রাখবে কে? মধু এই ব্যপারটায় এত ভালো কাজ করছিল..খুব ক্ষতি হয়ে গেল আমার।
–যে তোমাকে তোমার নিজের হোটেলের ঘরে রেপ করতে গিয়েছিল, তার জন্যেও এত দরদ!
–ওটা এমন কিছু গর্হিত অপরাধ নয়। একলা ঘরে আমাকে দেখলে অনেকেই মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ওসবের সঙ্গে ব্যবসার সম্পর্ক নেই। তা না হলে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলাম কেন? ইন ফ্যাক্ট তোমাকে একটা কথা বলি–মধু যদি আমার হাতে শিরোমণির গড় তুলে দিতে পারত তাহলে আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম, ও সেদিন যা চেয়েছিল তা ওকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমিই তার উপায় রাখলে না। এখন বলো, আমার কী ব্যবস্থা করবে? এ কি, এ কি? এসব কি অসভ্যতা শুরু করলে?
উমমমম!
–আগে কাজের কথাটা শেষ করো। ব্যানার্জি সাহেবের ওপর তোমার যা ইনফ্লুয়েন্স তাতে তুমি যদি একবার বলো শিরোমণির গড়টা আমাকে দিয়ে দিতে, উনি মেনে যাবেন। কিন্তু তুমি কি সেটা বলবে?
সত্যিই আমার পক্ষে এরকম কিছু বলা মুশকিল। তা হলেই তো প্রশ্ন উঠবে, আমার কি ইন্টারেস্ট? আমার একটা প্রকৃতিপ্রেমিক ইমেজ রয়েছে, সেটা ভুলো না। এরকম প্রোপোজাল আমার মুখ থেকে বেরোনোটা সে ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়?
–তুমি তাহলে তোমার ইমেজ নিয়েই থাকো। নিজের ব্যবসা বাড়িয়ে যাও। শুধু মনে রেখ, এটা বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলে বলেই আমি এই প্রোজেক্টটার কথা ভেবেছিলাম। সরো, আমি উঠি।
প্লিজ, কতদিন পাইনি তোমাকে। আমি কথা দিচ্ছি, ব্যানার্জি সাহেবকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করব। যদি তা নাও পারি, অন্তত জঙ্গলের ল অ্যান্ড অর্ডারের বারোটা বাজানোর কাজটা তো চালিয়ে যেতে পারব। এখন একবার, একবার…
.
নিকষ অন্ধকারের মধ্যেও নারীশরীরের নগ্নতার আভা রজনীগন্ধার পাপড়ির মতন ফুটে উঠল। ঘাসজমির ওপর মিথুনরত সেই যুগলকে দেখে চিতল হরিণেরা অন্য বিচরণক্ষেত্রের দিকে পাড়ি জমালো। রাতের জঙ্গলের ফিসফাসের সঙ্গে মিশে গেল পুরুষটির ঘন শ্বাস আর রমণতৃপ্ত নারীটির শীৎকার।
একটু পরে আলিঙ্গন খুলে নারীটি বলল, সরো, উঠি। গাড়ি রয়েছে সেই রিভারবেডে। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছি।
পুরুষটি দ্বিরুক্তি না করে তার শরীরের ওপর থেকে দ্রুত গড়িয়ে সরে গেল। সরে গেল প্রয়োজনের চেয়েও অনেকটা বেশি, জঙ্গলের ভেতরেই যেন আবার।
সেইদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নারীটি প্রথমে উঠে বসল। তারপর খুলে রাখা শাড়ি সজ্জা একহাতে জড়ো করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জঙ্গলের দিকে তার মুখ, পিঠের দিকে ভুটান পাহাড়।
তারপরেই সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটির ওপরে। মৃত্যু আক্ষেপে থরথর করে কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল শরীরটা, যা তখনো নগ্ন।
ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে ফায়ারিং-এর শব্দটা এপাড়ে এসে পৌঁছল বুলেটের একটু পরে। মুচকি হেসে পুরুষটি বনের পথ ধরে হাঁটা লাগল হরিণডুবি বাংলোর দিকে।
.
১৩.
আজ আর ছাগলেরা নয়, সোনারু মাঝিই প্রথম দেখতে পেল বিনতা মেহরার মৃতদেহটাকে, কারণ আগের মৃতদেহগুলোর পরণে ছিল ঘাস মাটির সঙ্গে রং মেলানো ইউনিফর্ম, যা তার বুড়ো চোখে ধরা দেয়নি। কিন্তু আজ মেয়েটার শরীরে কিছুই ছিল না। সবুজ ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়া অনেকখানি কালো চুল, সাদা চামড়া আর এক দলা লাল রং–টকটকে লাল। না, সোনারুমাঝির একটুও অসুবিধে হয়নি দেখতে।
এবারেও বিট-অফিসার সজল দত্তই মৃতদেহটাকে আইডেন্টিফাই করলেন। কারণ তিনি এর আগে আলিপুরদুয়ারে তিন-চারবার এবং শিরোমণির গড়ে একবার বিনতা মেহরাকে দেখেছেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই একজন গ্রামবাসী বিনতা মেহরার গাড়িটাকে নদীর চরে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখে। দেবেশ কাশ্যপ এবং অন্যান্য দুয়েকজন পুলিশ অফিসার যারা তদন্তে এসেছিলেন তারা গ্রামবাসীদের প্রশ্ন করে জানতে পারেন, ওরা কাল রাত আটটা নাগাদ ওই গাড়িটার শব্দ পেয়েছিল। অন্ধকার আকাশে ছিটকে ওঠা হেডলাইটের আলোও কেউ কেউ ঘরের দাওয়ায় বসে দেখেছিল। তবে ওরা স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল ফরেস্টের জিপ নিয়ে কেউ কাজে বেরিয়েছে। তা ছাড়া আর কী-ই বা ভাববে?
বডি পোস্টমর্টেমের জন্যে জলপাইগুড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে দেবেশ কাশ্যপ যখন আলিপুরদুয়ারে ফিরলেন, তখন দুপুর হয়ে গেছে। তবে আগে তাকে অফিসের বাইরে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের সামলাতে হল।
এবারের কাজটা তার পক্ষে কঠিন হল না। তিনি শুধু একটা ইঙ্গিত দিলেন যে ভদ্রমহিলা মৃত্যুর ঠিক আগে শারীরিকভাবে কারুর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।
তার মানে? ফোঁস করে উঠল সাংবাদিকেরা। রেপ নয়, লাভ-মেকিং?
ঠিক তাই। মিসেস মেহরার শরীরে বলপ্রয়োগের কোনও চিহ্ন পাইনি, কিন্তু ওই পরেরটার চিহ্ন ছিল।
এর পরে দেবেশ কাশ্যপ স্তম্ভিত সাংবাদিকদের দিকে চেয়ে একটা নাতিদীর্ঘ আবেগঘন বক্তৃতা দিলেন, যার মূল কথা–বিনতা মেহরা ছিলেন আপনাদের সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত। ইন ফ্যাক্ট তার আত্মীয়েরা এখনও একটা সংবাদপত্র চালাচ্ছেন। কাজেই আমার অনুরোধ, এই মুহূর্তে এমন কিছু লিখবেন না, যাতে সেই পরিবারটির সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায়। তদন্ত শেষ হতে দিন, তারপরে আমিই আপনাদের ডেকে সব কথা জানাব।
সাংবাদিকরা পত্রপাঠ তাদের টেপরেকর্ডার এবং নোটবুক ব্যাগে পুরে ফেলে প্রস্থান করলেন।
পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পরদিনই পাওয়া গেল। অবজার্ভেশনের ওপর নির্ভর করে দেবেশ কাশ্যপ যা বলেছিলেন তার সবই মিলে গেল। বিনতার শরীরের ভেতর স্পার্ম পাওয়া গেছে, অত্যাচারের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সঙ্গমের পরেই তার পিঠে বুলেট এসে বেঁধে।
রিগর মর্টিসের ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু হয়েছিল দেহটা আবিষ্কারের কয়েকঘণ্টা আগে, তার মানে গভীর রাত্রিতে।
ফরেনসিকের রিপোর্ট আগেরটারই হুবহু কপি বুলেটটা এসেছিল অন্তত আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে, কৌণিকভাবে নীচু হয়ে–সোজা কথায় আগেও যেখান থেকে এসেছিল। নদীর ওপারের পাহাড় থেকে।
ঘাসের ওপর কোনও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি। নগ্ন শরীরে কোনও আঙুলের ছাপ পাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশ কুকুর এসেছিল। কিন্তু জঙ্গলের হাজার হাজার ফুল পাতা জন্তু জানোয়ার পাখির গন্ধের মধ্যে সে বেচারা বিনতার সঙ্গীর ঘ্রান হারিয়ে ফেলে এবং রণে ভঙ্গ দেয়।
প্রমিত দেবেশ কাশ্যপের অফিসে এসে পৌঁছল সন্ধেবেলা। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, তার চুলে বহুক্ষণ চিরুনি পড়েনি, শার্টের পেছনদিকটা ট্রাউজারের কোমর থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। এমনকী দেবেশ কাশ্যপ যখন তার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন তখন সে সেটাকে উলটোদিক করে ধরিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল।
দেবেশ কাশ্যপ তার অবস্থা দেখে বেশ জোর গলাতেই হেঁকে উঠলেনকাম অন ম্যান! এত ভেঙে পড়ছেন কেন?
ভেঙে পড়ব না? কী বলছেন আপনি? আমার চাকরির জায়গাটাতো বধ্যভূমি হয়ে গেল–কিলিং-ফিল্ড! পাঁচটা মার্ডার হল গত এক মাসে!
তো? মার্ডারগুলো আপনি করেছেন না কি? নিজেকে এত রেসপন্সিবল করবেন না তো।
প্রমিত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, কিন্তু কাশ্যপ সাহেব, একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছেন? যে দুজন মানুষকে আমরা টেররিস্টদের ডানহাত বাঁহাত ভেবেছিলাম। তারা দুজনেই শেষ হয়ে গেল। তার মধ্যে বিনতা মেহরা তো সরাসরি টেররিস্টদের গুলিতেই খুন হলেন। আর মধু বর্মন না পাত্তা।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কে সেই ইনসাইডার? বিমল বাবুয়াদের ফাঁদে ফেলার জন্যে কে সেদিন নদীর চরে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করেছিল? কে আপনাকে খবর দিয়েছিল ড্রাগ পাচারের? কে ছিল বিনতার গোপন প্রেমিক, যে বিনতাকে দূরের বন্দুকবাজদের নিশানা বানিয়ে দিল?
আর সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, যার সমাধান করতে পারলে আমার মনে হয়ে অন্য সবকটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব, সেটা হল, কেমনভাবে অন্ধকারেই সহজ হচ্ছে মানুষ মারার কাজ?
দেবেশ কাশ্যপের কাছে, বোঝাই যাচ্ছে, এর কোনওটারই উত্তর ছিল না। তিনি বললেন, বিনতার আত্মীয়েরা বোধহয় পলিটিক্যাল প্রেশার ক্রিয়েট করছে। শুনছি অপারেশন অল-ক্লিয়ারের ঢঙে ভারত ভুটান যৌথবাহিনী মিলে জয়ন্তীর ওপারের পাহাড়গুলোয় কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করবে।
প্রমিত বলল, তাতেও কিন্তু আমাদের ঘরের কাছের বিশ্বাসঘাতকটির গায়ে হাত পড়বে না। আর সে যতদিন থাকবে ততদিন এই টাইগার-রিজার্ভের পশুপাখি, গাছপালা এবং মানুষ কেউই নিরাপদ নয়। তাকে ধরার কাজটা আপনাকে আমাকেই করতে হবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমিত বলল, গত কয়েকদিনে ফ্রিঞ্জ এরিয়া একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আমি ভাবছিলাম আর দুয়েকদিন দেখে গ্রামবাসীদের জঙ্গলে যাতায়াতের পারমিশন দেব। বুঝতেই পারছেন, পাতা কুড়োনোর কিম্বা জড়িবুটি সংগ্রহের কাজ বন্ধ থাকলে ওদের পেট চলে না। ভাবছিলাম নাইট-পেট্রোলিংটাও আবার চালু করে দেব। ফরেস্ট গার্ডদের বুঝিয়েছিলাম, আমি নিজেও তাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, যে বিমল বাবুয়াদের মৃত্যু একটা স্ট্রে ইনসিডেন্ট, হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। বারবার ওরকম ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বিনতা মেহরার একইভাবে খুন হওয়াটা আমার সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল।
আমি অনির্দিষ্টকালের জন্যে নাইট-পেট্রলিং বন্ধ করে দিয়েছি।
আর জানেন, গত পনেরোদিনের মধ্যে পোচাররা একটা দাঁতাল হাতি আর তিনটে চিতাকে মেরেছে? প্রমিতের গলা ভারী হয়ে এল। সে আস্তে আস্তে দেবেশ কাশ্যপের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিল।
.
১৪.
গল্প এখানে হাওয়ায় ওড়ে, গল্প এখানে মাটির নীচ থেকে ব্যাঙের ছাতার মতন মাথা ফুড়ে ওঠে।
দ্যুতি মিনাজুড়ি গ্রামের একটা ভাঙাচোরা মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প শুনছিল। গল্প বলছিল এক খুনখুনে বুড়ি। তার বয়েস কত হবে তা সে নিজেও ঠিক বলতে পারছিল না, তবে এটা বলতে পারল যে কুচবিহারের রাজকন্যা মহারানী গায়ত্রীদেবীর বিয়ের বছরেই তারও বিয়ে হয়েছিল। নতুন বরের হাত ধরে এই জঙ্গল ভেঙে পায়ে হেঁটে সে কুচবিহার গিয়েছিল রাজকীয় বিয়ে দেখতে।
সে তো একাত্তর বছর আগের ঘটনা। বুড়ির বয়েস তাহলে আশির অনেকটাই ওপরে।
দ্যুতিকে কী গল্প শোনাচ্ছিল বুড়ি? শোনাচ্ছিল সেই একই গল্প যা একটু ওলোটপালট হয়ে এখানকার সব আদিবাসীদের মুখে মুখেই ফেরে–সেই অতীত গৌরবের গাথা, রাজা শিরোমণির অতিবিস্তৃত রাজ্যপাটের কথা।
সেল-ফোনের এমনিতে কোনও উপযোগিতা নেই এখানে, তবু দ্যুতি সেই যন্ত্রটাকে এনেছিল টেপ-রেকর্ডার হিসেবে কাজে লাগাবে বলে। কিন্তু ব্যাটারি চার্জ করার সুযোগ না থাকায় সেই কাজেও ভেবে চিন্তেই লাগাতে হয়। এই মুহূর্তেই যেমন, দ্যুতি মোবাইল অফ রেখে তার নোটবুকে বুড়ির কথার নোট নিচ্ছিল।
ঘরের আধো অন্ধকার দাওয়ায় বসে বুড়ি গল্প বলছে, আর বাইরে হেমন্তের দুপুরে নদীর চরে একজোড়া টিটিভ পাখি তীব্র স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা ব্যাপার দ্যুতি এই কদিনে বুঝে ফেলেছে, এখানকার সবকটা গ্রামই তৈরি হয়েছে একদিকে জঙ্গল আর অন্যদিকে জয়ন্তীনদীকে রেখে। বেঁচে থাকার জন্যে গ্রামবাসীদের ওই দুটিকেই প্রয়োজন।
বুড়ি একঘেয়ে সুরে বলে যাচ্ছিল রাজা শিরোমণির সঙ্গে অহম রাজার যুদ্ধের কথা, ভূটানের ভোট রাজার যুদ্ধের কথা। সেই কথকতায় সাল তারিখের বালাই নেই, সে সব দ্যুতিকে ফিরে গিয়ে ইতিহাস বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বার করতে হবে। তবে সব যুদ্ধেই রাজা শিরোমণি নিজের বীরত্বে আর দৈব অনুগ্রহে জিতেছিলেন।
রাজার পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন যেসব দেবতা অপদেবতারা তারাও দ্যুতির প্রায় অচেনা। যেমন বুড়ি বলে মাশানবাবার কথা। তার বর্ণনা থেকে দ্যুতি বোঝে সেই দেবতার সঙ্গে শিবঠাকুরের অনেক মিল–তেমনই জটাজুট, ভুড়ি, বাঘছালের কৌপিন। বাড়তির মধ্যে ওনার ডান হাঁটুর নীচে চেপে ধরা থাকে একটা বড় মাছ। তার মানে? শুনতে শুনতেই দ্যুতির মাথার মধ্যে নৃতাত্বিক প্রশ্ন পাক খায়। মাশানবাবা কি তবে তিস্তা তোর্সার ধীবরদের দেবতা?
যাই হোক, তারপরে রাজা শিরোমণির এক পত্নীর অনাচারের কারণে দেবতা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আদিবাসীদের এত বড় রাজ্যপাট ছারখারে গেল।
তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়। শেষ কথা হচ্ছে, রাজা শিরোমণি তার অভিশাপের মেয়াদ শেষ হলে আবার ফিরে আসবেন।
কোথায় ফিরবেন, তা তো দ্যুতি এতদিনে জেনেই ফেলেছে–ওই শিরোমণির গড়ে, যেখানে চালতা গাছে চালতা পাকলে বুনো হাতিদের মহোৎসব শুরু হয়। সাঁই সাঁই শব্দে বনভূমি সচকিত করে এক ডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে যায় গ্রেট হর্ণবিল। সেই শিরোমণির গড়েই না কি ফিরে আসবেন রাজা শিরোমণি। তাঁর সঙ্গে ফিরে আসবে পাইক বরকন্দাজ কামান মশাল; আলো হাসি গান; আদিবাসীদের সুসময়।
গল্পের এই জায়গাটায় পৌঁছে দ্যুতি একটু হেসে ফেলেছিল। বুড়ির সেটা চোখ এড়ায়নি। সে প্রশ্ন করল হাসছ কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
দ্যুতি এই সব গল্পের পেছনে ক্রিয়াশীল মনটাকে বুঝবার জন্যেই এখানে এসেছে। তাই বলল, না, বিশ্বাস হচ্ছে না তো। অতদিন আগে মরে যাওয়া মানুষজন ফেরে কখনও? তোমার বরও তো মরে গেছে। সে কি ফিরবে?
শোনো বেটি! রাজ্য শিরোমণির কথা আলাদা। হাত মুখ নেড়ে বলল বুড়ি। আমি নিজে দেখেছি…
কী দেখেছ?
দেখেছি রাজা শিরোমণি স্বর্গ থেকে এসে তার দুর্গবাড়িটি ঠিকঠাক আছে কি না দেখে যাচ্ছেন।
দ্যুতি আবার হেসে বলল। কীরকম দেখলে রাজা মশাইকে? গায়ে সোনার জামা? মাথায় হিরের মুকুট?
না না। সেসব এখন আসবে কোত্থেকে? তিনি এখনও শরীর ফিরে পাননি তো। অভিশাপ কাটেনি কি না।
তাহলে?
দেখলাম তার চলার পথে পায়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে–আলোয় আলোয়।
দ্যুতির শরীরটা এই কথায় মুহূর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে গেল। সে গলা নামিয়ে বলল, কী দেখলে? আলোয় আলোয় পায়ের ছাপ? কখন দেখলে? কোথায়?
কি বলব, যারেই বলি কেউই বিশ্বাস তো করে না। এই তো গতবছর শ্রাবণ মাসের ঘটনা। গিয়েছিলাম শিরোমণির গড়ে বলি চরাতে, নাতি হয়েছিল তো তাই। আমাদের এই গ্রাম থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটুখানি তো পথ, তাই দেরি করেই বেরিয়েছিলাম। তারপর ফেরার সময় কি বৃষ্টিটাই যে নামল, ভাবলাম একটু অপেক্ষাই করে যাই, বৃষ্টিটা একটু ধরুক। এই করতে করতে অন্ধকার নেমে এল। তখন দেখলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। বেরিয়ে পড়লাম।
গড়ের পেছনদিকটায় একটা খুঁড়িপথ আছে, একেবারে নদীর বুকে গিয়ে মিশেছে। ওই রাস্তাটায় গেলে পথ অনেকটা কম হয়। সমস্যা একটাই, পুরনো দিনের পাথর বাঁধানো রাস্তা তো, বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর পেছল আর এবড়ো খেবড়ো হয়ে রয়েছে। তা, যাই হোক, রাজা শিরোমণির নাম নিয়ে ওই রাস্তাতেই পা ফেললাম, আর তার একটু পরেই দেখলাম…। বুড়ি কথা থামিয়ে শিউরে উঠল।
কী দেখলে?
দেখলাম অনেকটা দূরে ওই রাস্তাতেই একটা একটা করে পরিষ্কার পায়ের ছাপ ফুটে উঠছে–যেমন জোনাকিপোকার আলো হয় না, ঠিক সেরকম আলোয় গড়া পায়ের ছাপ। একটা দুটো তিনটে…এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর পেছনের পায়ের ছাপগুলো একটু বাদে মুছে যাচ্ছে। আমি তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম….
মাসি! গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে দ্যুতি আর বুড়ি দুজনেই চমকে উঠল। রূপেন শইকিয়া কখন যে তার কাজ সেরে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ওদের দুজনের মধ্যে কেউই তা খেয়াল করেনি। তিনিই বললেন, এসব কি আজেবাজে গল্প শোনাচ্ছ দিদিমণিকে?
দ্যুতি প্রতিবাদ করল–না না। এই গল্পগুলোই তো আমি শুনতে চাই। এগুলোই আমার গবেষণার বিষয়।
ঠিক আছে, আবার পরে এসে শুনবে। আজ আমাকে অন্য এক জায়গায় যেতে হবে। তুমি এখন উঠে এস। রূপেনের এই স্বভাববিরোধী তিক্ত সুরে দ্যুতি বেশ অবাক হল। তবে সে আর তর্কও করল না। নোটবুক বন্ধ করে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রূপেনের পেছন পেছন তার গাড়িতে এসে বসল।
দ্যুতিকে হরিণডুবি বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে রূপেন আবার কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। দ্যুতি ঘড়ি দেখল, মাত্র সাড়ে তিনটে বাজে। সে ঠিক পনেরো মিনিট সময় কাটাল বারান্দায় এক কোণায় রূপেন শইকিয়ার গাছ গাছড়ার স্যাম্পেল প্যাকেটগুলো যেখানে জড়ো করা রয়েছে, সেইখানে। সেখান থেকে নিজের হ্যান্ডব্যাগটার মধ্যে একটা বড় প্যাকেট পুরে নিয়ে বাংলোর চৌহদ্দি পেরিয়ে দ্রুত পায়ে হরিণডুবি গ্রাম পেরোল। গ্রাম পেরিয়ে একেবারে হরিণডুবি বিট অফিসের দরজায় পৌঁছে দ্যুতি কড়া নাড়ল।
বিট অফিসার সজল দত্ত দ্যুতিকে দেখে বেশ অবাক হয়েই জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার ম্যাডাম, কোনও প্রবলেম হল না কি?
দ্যুতি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্ত ভাবল, যে কাজটা করতে চলেছে সেটা ঠিক হচ্ছে কি না। তার চোখে ভেসে উঠল প্রমিতের উদভ্রান্ত মুখটা, কপালে ব্যান্ডেজ। সে মনস্থির করে নিয়ে সজলবাবুকে বলল, না, প্রবলেম কিছু নয়। একবার আর টি সেটে আমাকে ব্যানার্জি সাহেবের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে হবে।
অফিসের বাইরের একজনের কথায় রেডিয়ো ট্রান্সমিটার চালু করবে কি না সে ব্যাপারে সজল দত্ত একটু ইতস্তত করছিলেন। দ্যুতি বলল, বিশ্বাস করুন ব্যাপারটা খুব জরুরি। তা না। হলে এরকম রিকোয়েস্ট করতাম না।
ঠিক আছে। ভেতরে আসুন। সজল দত্ত দ্যুতিকে পাশে বসিয়ে আলিপুরদুয়ার অফিসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলেন–
স্যার, মিস সেনগুপ্ত একটু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান, ওভার।
হ্যাঁ, ওনাকে দিন। কী ব্যাপার দ্যুতি?
দ্যুতি বলল, তুমি এক্ষুনি একবার আসতে পারবে?
কেন? কী ব্যাপার?
এখন কিছুই বলতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস কর, ব্যাপারটা খুব জরুরি। তুমি প্লিজ একবার এসো।
বেশ, আসছি। তুমি বাংলোতেই ওয়েট করো।
দ্যুতি হ্যান্ডসেটটা দত্তবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। প্রমিত বলল, ঠিক আছে দত্তবাবু, ওভার।
ওভার অ্যান্ড আউট।
দত্তবাবু বড় বড় চোখ করে দ্যুতির চলে যাওয়াটা দেখলেন। ব্যানার্জি সাহেবকে তুমি তুমি করে কথা বলছেন এই ম্যাডাম! চলে আসতে বলছে ওনার সঙ্গে দ্যাখা করবার জন্যে! ইসসস ছি ছি ছি। আগেই বোঝা উচিত ছিল। উচিত ছিল এক দুটো বড় সাইজের দেশি মুরগি বাংলোর রান্নাঘরে পাঠানো। অবশ্য সেরকম কিছু করলে, আর ব্যানার্জির্সাহেব সেটা জানতে পারলে, নিশ্চয় গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিতেন। এরকম অবস্থায় কী যে করণীয়? বুঝে উঠতে পারছিলেন না সজল দত্ত।
.
ঘন্টাখানেক পরে হরিণডুবি বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রমিতও একই কথা বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তার সামনেই দাঁড়িয়েছিল দ্যুতি। সারাদিন জঙ্গলের গ্রামে গ্রামে ঘোরার পরিষ্কার ছাপ তার চেহারায়। বোঝাই যাচ্ছে ফিরে এসে হাত মুখটা অবধি ধোয়নি। তবু প্রমিতের কথার কোনও জবাব না দিয়ে, তার হাত ধরে টানতে টানতে সে প্রমিতকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে এসে বলল, উঠে পড়ো। নিজেও এক মোচড়ে ড্রাইভিং-সিটের উলটোদিকে দরজাটা খুলে, প্রায় লাফ মেরেই গাড়িতে উঠে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, চল, চল, স্টার্ট দাও। একদম সময় নেই।
কোথায় যাব এবং কিসের সময় নেই?
যেতে যেতে সব বলেছি। তুমি আলিপুরদুয়ার চলো। কাশ্যপসাহেবের অফিসে। ওখানে গিয়েই সব বলব। তখনই বুঝবে, কেন বলছি একটুও সময় নেই।
দিন পনেরো আগে যে আত্মমগ্ন, থতোমতো খাওয়া মেয়েটাকে প্রথমবার তার অফিসের ভেতরে দেখেছিল, সেই মেয়েটাই যে কেমন করে এত বদলে গেল, তা ভেবে পায়না প্রমিত। দ্যুতিকে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। তার গলায় ফুটে বেরোচ্ছিল কর্তৃত্বের সুর। সেই সুরকে প্রমিত উপেক্ষা করতে পারেনা। সে গাড়িতে স্টর্ট দিয়েছিল। কিন্তু তখনই দ্যুতি তার হাত চেপে ধরে বলেছিল, একমিনিট। একটা ভুল হয়ে গেছে। গাড়িটা একবার থামাও।
অবাক প্রমিত গাড়ি থামাতেই দ্যুতি আবার লাফ মেরে দৌড়ে ঢুকে গিয়েছিল বাংলোর মধ্যে। একটু বাদেই ফিরে এসেছিল।
কী ভুলে গিয়েছিলে? প্রশ্ন করল প্রমিত।
বাংলোর কেয়ারটেকারকে বলে এলাম, রূপেন শইকিয়া ফিরে এলে তাকে বলতে যে আমার জ্যাঠামশাই, মানে যিনি তোমাদের বড়সাহেব, তিনি হঠাৎ কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ারে এসেছেন অফিসের কাজে, এবং আমাকে দেখতে চেয়েছেন। তুমি তাই গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে এসেছ। একটু কাঁচা মিথ্যে হয়ে গেল, কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায় এল না।
.
১৫.
দ্যুতি আর প্রমিত যখন জলপাইগুড়িতে দেবেশ কাশ্যপের বাংলোয় পৌঁছল, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। কাশ্যপ সাহেবকে রাস্তা থেকেই প্রমিত ফোন করে জানিয়েছিল যে তারা আসছে। তাই তিনি আর অন্য ভিজিটর রাখেননি।
তিস্তার বাঁধের ধারে সাহেবি আমলের বিশাল বাংলোটার বাগানে একটা মস্ত অর্জুন গাছ। তার ডাল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় উড়ে যাচ্ছিল নৈশ অভিযানে।
দ্যুতি তাড়াতাড়ি প্রমিতের সঙ্গে কাশ্যপসাহেবের ড্রইংরুম কাম অফিসে ঢুকে পড়ল।
তিনজনে সোফায় বসার পর দ্যুতি তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বার। করে দেবেশ কাশ্যপের হাতে দিল। প্যাকেটটার ভেতরে লাল আর খয়েরি মেশানো অদ্ভুতদর্শণ কিছুটা গুঁড়ো পদার্থ ছাড়া আর কিছু নেই।
কী এটা? দেবেশ কাশ্যপ হাতের তালুর ওপর সেই গুঁড়ো কিছুটা ঢেলে নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর সাবধানে গন্ধ শুঁকেও দেখলেন। শেষকালে হতাশ হয়ে বললেন, নাঃ, আমি তো বুঝতে পারছি না এটা কী।
প্রমিত হাতটা বাড়িয়েছিল। তার হাতে গুঁড়োটা চালান করে দিয়ে দেবেশ কাশ্যপ আবার বললেন, এটা কি জিনিস ম্যাডাম?
বলছি। তার আগে আপনি আমার একটা উপকার করুন।
বলুন।
আপনি বলেছিলেন মধু বর্মনের ডেনগুলোতে আপনারা রেইড করেছিলেন। আপনার লোকদের বলুন ওইসব জায়গায় যা কিছু পেয়েছে তার মধ্যে ঠিক এইরকম গুঁড়ো ভরতি প্যাকেট ছিল কি না জানাতে। যদি পেয়ে থাকে তাহলে সেটাকে যেন যত্ন করে রেখে দেয়।
সামনের কফিটেবল থেকে ল্যান্ডফোনটা তুলে নিয়ে দেবেশ কাশ্যপ কাকে যেন ঠিক সেইরকম নির্দেশ দিলেন। তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, আর?
বিমল, বাবুয়া, সন্দীপ আর মিসেস মেহরার জামাকাপড় এখনও পুলিশ কাস্টডিতেই থাকার কথা। ওগুলোকে আবার ফরেনসিক এক্সামিনেশনের জন্যে পাঠাতে হবে।
কী দেখতে হবে?
দেখতে হবে, ওই সব পোশাকে এই গুঁড়ো জিনিসটার কোনও ট্রেস পাওয়া যায় কি না।
আবারও ফোনে কিছু নির্দেশ গেল। তারপর দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতিকে বললেন, নাউ ইট ইজ ইয়োর টার্ন টু এক্সপ্লেইন! এসব কী হচ্ছে একটু বুঝিয়ে বলুন দয়া করে।
বলছি কাশ্যপসাহেব। তার আগে দুটো গল্প বলি। গল্পদুটো শুনেছিলাম কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে, বটানির পাস ক্লাসে। নন্দিনী ম্যাডাম আমাদের বটানির একটা অদ্ভুত ফেনোমেনন বোঝাতে গিয়ে এগুলো বলেছিলেন। ভাগ্যিস বলেছিলেন। তাই তো ব্যাপারটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।
সন আঠেরোশো চৌষট্টি। রাশিয়ার স্টারইয়া লাডোগার সেন্ট জর্জ চার্চের এক ব্যাভিচারী যাজক পানশালা থেকে আকণ্ঠ মদ খেয়ে চার্চে ফিরছিলেন। রাত হয়ে গেছে অনেক। চারিদিকে নিকষ অন্ধকার।
যাজকের পা টলছে। মনে তার প্রচণ্ড পাপবোধ। চার্চের প্রধান রোজই তাকে এই ব্যাভিচারের জন্যে তিরস্কার করছেন, ভয় দেখাচ্ছেন নরকবাসের, তবু তিনি কিছুতেই নেশা আর নারী থেকে দূরে থাকতে পারছেন না। ঈশ্বর তার এই জীবনধারাকে ক্ষমা করবেন?
ভাবতেই ভাবতেই তিনি যেন তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। অন্ধকার দিগন্ত থেকে একটা আগুনের গোলা নিঃশব্দে কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে সেই যাজকের দিকে ভেসে এল।
শয়তান! শয়তানই নিশ্চয় তার অনুচরকে পাঠিয়েছে তাকে টেনে হিঁচড়ে নরকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। যাজক তৎক্ষণাৎ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা শুরু করে দিলেন– হে প্রভু, রক্ষা কর, রক্ষা কর এই পাপীকে।
সেই প্রার্থনার জেরেই নিশ্চয়, আগুনের গোলাটা তাকে না ছুঁয়ে একটু দূর দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে অন্য দিগন্তে মিলিয়ে গেল। যাবার সময় খুব কাছ থেকে একবার তার চেহারাটা দেখতে পেয়েছিলেন সেই যাজক হাঁসের মূর্তি ধরে এসেছিল শয়তানের অনুচর। জ্বলন্ত এক রাজহাঁস।
দ্বিতীয় গল্পটাও অনেকটা একই রকমের। সেই রাশিয়ান যাজকের মতোই আতঙ্কে অধীর হয়ে গিয়েছিল এক ডাচ নৈশপ্রহরী। সময়টা উনবিংশ শতকের গোড়ায়। পাপুয়া নিউগিনিতে তখন ওলন্দাজরা সবে উপনিবেশ গড়ে তুলছে, আর নখে দাঁতে তাদের বাধা দিচ্ছে সেখানকার স্বাধীনতাপ্রিয় আদিবাসীরা। যখন তখন ডাচদের গড়ে তোলা ছোট শহরগুলোকে বিষাক্ত তীরধনুক নিয়ে আক্রমণ করছে তারা। তাদের ভয়েই শহরগুলোর সীমানার বাইরে সারা রাত নৈশপ্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এই গল্পের নায়ক ছিল তেমনই এক নৈশপ্রহরী।
সেই রাতটা ছিল মেঘে ঢাকা। চোখের দৃষ্টি চলে বেশি দূর। তাহলেও সেই নৈশপ্রহরীর একটুও অসুবিধে হল না পায়ের ছাপগুলো দেখতে।
কেন হবে? সেগুলো যে আগুন দিয়ে আঁকা পায়ের ছাপ। একটা একটা করে অমন জ্বলন্ত পায়ের ছাপ সমুদ্র থেকে উঠে ভিজে বালির বালিয়াড়ি পেরিয়ে আসছে শহরের দিকে। এ কোন অশরীরি সামুদ্রিক দানব তাদের শহরকে গিলে খেতে আসছে! প্রাণভয়ে চিৎকার করতে করতে প্রহরীটি শহরের লোকজনকে সতর্ক করতে দৌড়ল।
.
গল্প শেষ করে দ্যুতি মুচকি হেসে প্রমিতকে বলল, এরকম গল্প তুমি কদিন আগে একবার শোনোনি?
প্রমিত বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। সোনারু মাঝির মুখে। সে শিরোমণির গড়ের পেছনদিকের রাস্তায় কখনও কখনও আলোমাখা বেজি কিম্বা সাপকে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখেছে।
আমিও আজ এরকম একটা গল্প শুনেছি, মিনাজুড়ি গ্রামের এক বুড়ির কাছ থেকে। সে ওই একই রাস্তায় জ্বলন্ত পায়ের ছাপ দেখেছিল।
আমি বোধহয় এই গল্পগুলোর রেলেভ্যান্স একটু একটু ধরতে পারছি। জ্বলন্ত পায়ের ছাপ..জ্বলন্ত প্রাণী। জ্বলন্ত মানুষ হতে পারে না? যদি হয় তাহলে তো সে সহজ টার্গেট। রাতের টার্গেট, ইয়েস! রাতের টার্গেট। এরকম কি হতে পারে দ্যুতি? উত্তেজিত দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতির সামনে ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করলেন। কিন্তু দ্যুতি উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।
কাশ্যপসাহেব উত্তর দিলেন হ্যালো। তারপর কিছুক্ষণ ওদিককার কথা মন দিয়ে শুনলেন। শেষকালে বললেন, আচ্ছা সামন্ত, তুমি নিজেই তাহলে প্যাকেটটা একবার আমার কোয়ার্টারে নিয়ে চলে এসো।
ফোনটা নামিয়ে রেখে কাশ্যপসাহেব দ্যুতির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললেন, ইনক্রেডিবল। ইনস্পেক্টর সামন্তকে বলেছিলাম, মধু বর্মনের ঘরগুলো থেকে যে সব মাল সিজ করা হয়েছে, তার মধ্যে এই ডেসক্রিপশনের গুড়ো আছে কি না দেখতে। বলছে, আছে। নিয়ে আসছে।
দ্যুতি একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ওদের পোশাকেও এই গুঁড়োর চিহ্ন পাওয়া যাবে– বিমল বাবুয়াদের শার্টের বুকে। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, সত্ত্বার করার আগে যদি বিনতা মেহরার নগ্ন পিঠটা খুঁজে দেখা হত তাহলে সেখানেও পাওয়া যেত। আই অ্যাম সিওর অফ ইট। যখন গুলি চলে, তখন উনি ন্যুড ছিলেন। তাই ওনার পোশাকে নয়, ত্বকেই থাকত এই জিনিসটার রেসিডিউ।
আই হ্যাভ গট ইয়োর পয়েন্ট। বললেন দেবেশ কাশ্যপ।
মি টু। প্রমিত বলল তার মানে এই গুড়োটাই আলোকিত করে দিয়েছিল ওদের। কিন্তু এটা কী জিনিস দ্যুতি? কোথায় পেলে এই জিনিস?
কোথায় পেলাম? কাউকে বোলো না যেন। আজ আমাকে হরিণডুবি বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে মিস্টার শইকিয়া কোথায় যেন চলে গেলেন। সেই সময়টা কাজে লাগিয়ে আমি ওনার গাছ-গাছড়ার স্যাম্পেলের প্যাকেটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে এটা পেয়ে গেলাম আর কি। জানতাম অবশ্য, পাবো।
আর জিনিসটার পরিচয়?
বলছি, দাঁড়াও।
আমি একটু ইন্টারাপট করছি, দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতিকে বললেন। এটাকে আমার আদেশ। বলেই ধরতে পারো। এখন থেকে যতক্ষণ না পুরো অপারেশনটা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তুমি, তুমিই বলছি, আমার মেয়ের সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকবে। ও তোমার সমবয়সি, কাজেই কোনও অসুবিধে হবে না।
এখানে থাকতে বলছি কারণ, তোমাকে এখন এক দুদিন আমাদের খুব দরকার, অথচ হরিণডুবিতে তোমার ফিরে যাওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। আর…
একবার অপাঙ্গে প্রমিতের দিকে চেয়ে দেবেশ কাশ্যপ কথাটা শেষ করলেন মিস্টার ব্যানার্জি তোমাকে যাই বোঝান, ওনার কোয়ার্টারে রাত কাটানোটাও তোমার পক্ষে ইকুয়ালি বিপজ্জনক।
ছিঃ! লজ্জায় দু-হাতে মুখ ঢাকল দ্যুতি।
.
১৬.
পরের দেড়খানা দিন প্রমিত, দ্যুতি এবং সর্বোপরি দেবেশ কাশ্যপের প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। শুধু পুলিশ নয়, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট এমনকি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে অবধি চেতিয়ে তুলে বিভিন্ন কাজে লাগানো–এটা খুব সহজ কথা নয়।
বড় সাফল্য এল মধু বর্মন ধরা পড়ায়। তাকে জয়গাঁর একটা বস্তি থেকে তুলে আনল জলপাইগুড়ি পুলিশ। ইন্টারোগেট করলেন দেবেশ কাশ্যপ নিজে।
ইতিমধ্যে হরিণডুবির জঙ্গলে মারা পড়ল একটা টাস্কার, অর্থাৎ দাঁতাল হাতি, যার দাঁত দুটো চোরাশিকারিরা কেটে নিয়ে গেছে।
দেড়দিনের মাথায়, দুপুরের দিকে একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছোকরা হরিণডুবি বনবাংলোয় এসে রূপেন শইকিয়ার খোঁজ করল। রূপেন সেই মুহূর্তে বাংলোয় ছিলেন না। ছেলেটা অপেক্ষা করে রইল। রূপেনের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। ছেলেটা তাকে দেখেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখে তার কানে কানে কি সব বলে চট করে কেটে পড়ল।
ছেলেটা চলে যাওয়ার পরে দেখা গেল রূপেন শইকিয়া কিছুক্ষণ থম হয়ে বসে রইলেন। তারপর বাংলোর বেয়ারাকে ডেকে বললেন ঘর থেকে তার জিনিসপত্রগুলো বারান্দায় বের করে দিতে। তিনি তখনই বেরিয়ে পড়বেন।
একটু পরে দেখা গেল হরিণডুবি বনবাংলোর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রূপেন শইকিয়া বোলেরোর পেছনের দরজাটা খুলে সেখানে তার সংগৃহীত গাছপালার স্যাম্পেলের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে রাখছেন।
কিছুক্ষণ ধরে একটা অন্য গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দূর থেকে জঙ্গলের পথ ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছিল গাড়িটা। রূপেন শইকিয়া, কি জানি কেন, কাজ সারতে সারতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেইদিকে তাকাচ্ছিলেন। তার ভঙ্গিতে স্পষ্ট উদ্বেগ।
একটা বাঁক ঘোরার পরেই জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে গাড়িটা উঠে এল বাংলোর সামনের সোজা রাস্তাটায়। গাড়িটা নয়, গাড়িদুটো। একটা প্রমিতের জিপসি, আরেকটা পুলিশের উইলি জিপ। দুটো গাড়ি এসে বোলেরোর দুপাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। একটা গাড়ি থেকে নেমে এল প্রমিত এবং দ্যুতি, আরেকটা থেকে দেবেশ কাশ্যপ। তাদের দেখে গাড়ির ডিকিতে মাল তোলা বন্ধ রেখে, রূপেন শইকিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তার মুখে বেশ চওড়া হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আরে কী ব্যাপার? এই বিকেলে সবাই একসঙ্গে জঙ্গলে? এটা তো পিকনিকের সময় নয়।
কেন নয়, মিস্টার শইকিয়া? জঙ্গলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা প্রমিত ব্যানার্জি যখন নিজেই উপস্থিত, তখন এনি টাইম ইজ পিকনিক টাইম। চলুন!
শেষ শব্দটার মধ্যে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে, রূপেনের ঠোঁট থেকে হাসিটা সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল। তার জায়গায় জেগে উঠল স্পষ্ট প্রতিরোধ।
কোথায় যাব? দেখছেন না, আমি এখন বাড়ি রওনা হচ্ছি? যাওয়া টাওয়া সব আবার পরের বার হবে, নেক্সট টাইম। দেবেশ কাশ্যপের প্রতি তাচ্ছিল্যটা জোরদার করতেই যেন রূপেন বাঁ-হাতের এক জোরালো ধাক্কায় বোলেরোর পেছনের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। তারপর ঘাড় উঁচু করে এগিয়ে গেল গাড়ির সামনের দিকে, ড্রাইভারের সিটের দিকে।
পেছন থেকে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বাড়ি গিয়ে এখন কি কিছু লাভ হবে মিস্টার শইকিয়া?
মানে? রূপেনের প্রত্যয়ী ভঙ্গিটা এই একটা কথাতেই বদলে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন দেবেশ কাশ্যপের দিকে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?
মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বলতে চাইছি, এখন বাড়ি ফিরে তো মোটেই শান্তি পাবেন না। শুনলাম, ওরা আপনার বাড়ির সমস্ত ফার্নিচার এদিক থেকে ওদিক করে দিয়েছে, আলমারি থেকে সমস্ত কাগজ মেঝেতে নামিয়ে ফেলেছে, এমন কি বিছানার গদিগুলো অবধি না কি মাঝখান থেকে চিরে ফেলেছে।
কারা? অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাঁসে গলায় জিগ্যেস করলেন রূপেন শইকিয়া। তার চওড়া কাঁধ দুটো এই মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে শরীরের দুপাশে ঝুলে পড়েছে। শীতের দিনেও ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে।
সে কি, আপনি এখনও জানেন না! সি বি আইয়ের গোয়েন্দারা। ওরা কাল মাঝরাত থেকে আপনার গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া আর ইটানগরের তিনটে বাড়িতেই রেইড শুরু করেছে। আপনি যে ব্যাঙ্কের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাবেন, তার উপায়ও ওরা রাখেনি। সেখানেও আপনার তিনটে ব্যাঙ্কের লকার খুলে ওরা, মানে সি বি আইয়ের লোকেরা সব গয়নাগাটি, ক্যাশ টাকা এইসবের লিস্ট বানাচ্ছে।
তাই বলছিলাম কি এখন বাড়ি না ফিরে যদি একটু আমাদের সঙ্গে পিকনিক-ই করে। আসেন, তাহলে কেমন হয়?
কাশ্যপের চোখের ইশারায় জিপ থেকে দুজন বন্দুকধারী কনস্টেবল নেমে এসে রূপেনের দুদিকে দাঁড়াল। তবে বলপ্রয়োগের দরকার পড়ল না। রূপেন নিজে থেকেই তাদের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে জিপের পেছনের সিটে বসলেন। সামনের সিটে ড্রাইভারের আসনে বসলেন দেবেশ কাশ্যপ, তার পাশে একটু ঠাসঠাসি করেই প্রমিত আর দ্যুতি। প্রমিতের আর রূপেনের গাড়িদুটো হরিণডুবি বাংলোর সামনেই দাঁড়িয়ে রইল।
জিপটা রওনা হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরে রূপেন ডাকলেন, কাশ্যপ সাহেব! দেখা গেল তার গলায় পুরোনো দাপটের অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে।
বলুন! বললেন দেবেশ কাশ্যপ।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি এটাই যে, আমার দুটো বাড়ি আর তিনটে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে? ধনী হওয়াটা কি ক্রিমিনাল অফেন্স, যে আমাকে এইভাবে পুলিশ পাহারায় গাড়িতে তুললেন?
দেবেশ কাশ্যপ বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ক্রিমিনাল অফেন্সের অভাব কি, মিস্টার শইকিয়া? এখানে আসার আগে অবধি টেলিফোনে গুয়াহাটি থেকে যেটুকু জানতে পেরেছি, বলি। আপনার তিনসুকিয়ার বাড়ির একটা লুকনো সেলার থেকে চারটে চিতার চামড়া পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে একটা দুষ্প্রাপ্য ক্লাউডেড লেপার্ডের। সম্ভবত নামডাফা স্যাংচুয়ারি থেকে জন্তুটাকে মেরেছিল আপনার পোষা চোরাশিকারিরা। গুয়াহাটির বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে গন্ডারের খড়গ আর হরিণের শিং।
তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখা গেছে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে। দেখা গেছে ফরেস্ট প্রোডাক্ট রফতানি করে আপনার ব্যাবসায় যে পরিমান বিদেশী টাকা এসেছে অত পরিমাণ মাল আপনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে কেনেনই নি। তাহলে কিসের জন্যে টাকাটা পেলেন? জন্তুর চামড়া বিক্রি করে কি?
আবার উল্টো দিকে, ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি বহু টাকা পেমেন্ট করেছেন চীন আর প্যালেস্টাইনের কয়েকটা কোম্পানির নামে। ওই টাকা না কি আপনি দিয়েছিলেন ওদের কাছ থেকে মেশিন-পার্টর্স আমদানি করেছিলেন বলে। অথচ আপনার কোনও কারখানাই নেই।
চীন আর প্যালেস্টাইন থেকে কী নিয়ে এসেছিলেন মিস্টার শইকিয়া? এ কে ফর্টিসেভেন? ইনস্যাস?
আপনার দুপাশে পুলিশ বসিয়ে রাখাটা কি জাস্টিফাই করতে পারলাম, মিস্টার শইকিয়া? না না। আপনাকে এখনই এর কোনোটার ব্যাখ্যা দিতে হবে না। জেলখানায় বসে এসবের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর বানানোর চেষ্টা আপনি করবেন। ও, বলা হয়নি বুঝি, আপনার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আমার পকেটেই রয়েছে।
রূপেন শইকিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে অ্যারেস্ট করে কোর্টে প্রোডিউস করলেই ভালো হত না? অ্যাটলিস্ট আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা পেতাম। তা না করে, এখন কোন ছেলেখেলা করবার জন্যে আমরা নদীর দিকে যাচ্ছি? তেঁতো স্বরে জিগ্যেস করলেন রূপেন শইকিয়া।
সত্যিই ততক্ষণে গাড়িটা জঙ্গল ভেঙে সেই রাস্তাটায় এসে উঠেছে, যার শেষ মাথায়, বনের শেষে, জয়ন্তীর জলের চিকিমিকি দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। জঙ্গল জেগে উঠছে। শুরু হয়ে গেছে নাইটজারদের অবিরাম টঙ্ক টঙ্ক চিৎকার, ঝিঁঝিপোকাদের কনসার্ট। শিরোমণির গড়ের দিক থেকে একবার একটা দাঁতালের ক্রুদ্ধ চিৎকারও শুনতে পাওয়া গেল।
ওই নদীর কিনারাতেই গত পনেরোদিনে চারটে মানুষ খুন হয়েছে। এইরকম অন্ধকারের মধ্যেই।
গাড়িটা সেই কিনারা থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে দেবেশ কাশ্যপ ঘুরে তাকালেন রূপেন ইকিয়ার দিকে। তারপর বললেন, মিস্টার শইকিয়া, আরও একটা ক্রিমিনাল অফেন্সের কথা আপনাকে বলা হয়নি। সেইটা বলব বলেই এখানে নিয়ে এলাম আপনাকে। দেখুন, আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই ঘন জঙ্গলে ঢাকা টিলাটা, যার মাথায় শিরোমণির গড়ের ধ্বংসাবশেষ। আপনার সামনে কুয়াশায় মোড়া জয়ন্তী নদীর বিস্তীর্ণ চর। নদীর ওপাড়ে এক পাল প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভুটান পাহাড়ের সারি, উত্তুরে হাওয়া যেন ওদেরই নিশ্বাস। এই তো সেই রঙ্গমঞ্চ, যেখানে আপনি এক নারকীয় নাট্যপালার সূচনা করেছিলেন।
সুন্দর এগিয়ে চলেছিল সেই নাটকটা। আপনি যেমনটা ভেবেছিলেন সেইভাবেই নিশ্চয় শেষ হত। শুধু গন্ডগোলটা কোথায় হয়ে গেল জানেন? আপনার স্ক্রিপ্টে নাম ছিল না এমন একটি চরিত্র মাঝখান থেকে ঢুকে পড়ল। একটি নারী চরিত্র নাম দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত, দ্যুতি। সে আসার পরেই গল্পটা আপনার হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল।
এইখানে দাঁড়িয়ে, এই মুহূর্তেই আমরা আপনার সেই নাটকটার ওপর যবনিকা ফেলব। আর নাটকের শেষ সংলাপগুলো শুরু করার সম্মান আর কে-ই বা পেতে পারে, দ্যুতি ছাড়া?
নাও দ্যুতি শুরু কর!
.
১৭.
দ্যুতি বলল, ডক্টর শইকিয়া, আপনাকে কিছু শেখানোর স্পর্ধা আমার নেই। আপনার পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। শুধু আমার ধারণাগুলো সত্যি কি না সেটুকু জানবার জন্যেই আপনাকে এই কথাগুলো বলছিঃ
আপনিও নিশ্চয় ক্লাসরুমে আপনার ছাত্রছাত্রীদের কখনও শুনিয়েছেন স্টারইয়া লাডোগার জ্বলন্ত রাজহাঁসের গল্প, কিম্বা নিউগিনির সমুদ্রতটে জ্বলন্ত পায়ের ছাপের রহস্য। অবাক ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ক্লাসের শেষদিকে এসে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন এই আপাত অলৌকিক ব্যাপারগুলোর পেছনে কেমনভাবে কাজ করেছিল এক ন্যাচারাল ফেনোমেনন, যার নাম বায়োলুমিনিসেন্স।
বায়োলুমিনিসেন্স বা জৈবপ্রভা জীবজগতের এক আশ্চর্য ঘটনা। এই পৃথিবীতে প্রায় এগারোশো প্রাণী এবং উদ্ভিদ নিজেদের শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরণ করতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ জোনাকি।
এই ধরণের জীবদের মধ্যে সংখ্যায় যারা সবচেয়ে বেশি তাদের নাম পেরিডিনিয়ান– সমুদ্রে বসবাসকারী খুব ছোট একধরনের উদ্ভিদ। উত্তেজিত হলে পেরিডিনিয়ানের শরীর থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয়। অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে একটা জাহাজ যখন এগিয়ে যায়, তখন কখনও কখনও দেখা যায় তার দুধারে জলতল আলোয় ঝলমল করে উঠছে। এ আর কিছুই নয়, কোটি কোটি উত্তেজিত পেরিডিনিয়ানের জৈবপ্রভা। রাতের সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে ডুবুরিরা মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হয়ে দেখেন তাদের হাত পায়ের প্রত্যেকটা নড়াচড়ায় কেমন করে আলোর ঢেউ ফুলে ফেঁপে উঠছে। এ-ও ওই পেরিডিনিয়ানের ম্যাজিক।
নিউগিনির সমুদ্রতটে ঢেউয়ের সঙ্গে সেদিন অমন কোটি কোটি পেরিডিনিয়ান আছড়ে পড়েছিল। যখনই কোনও জেলে তাদের মাড়িয়ে গেছে তখনই তাদের উত্তেজিত শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে। আমাদের বেচারা নৈশ প্রহরীটি তাকেই ভেবেছে দানবের পায়ের ছাপ।
পেরিডিনিয়ানের মতনই উজ্জ্বল আলো ছড়াতে পারে নানা ধরনের ব্যাঙের ছাতা, বা ফাঙ্গাস। অন্ধকার নামার পরে অনেকসময়ে একটা পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় তার গায়ে আগুন ধরে গেছে। তা নয়, আসলে ওই গুঁড়ির গায়ে গজিয়ে ওঠা ছত্রাকরা ছড়িয়ে দিচ্ছে জৈবপ্রভা।
এমনই ছত্রাক নিশ্চয় গজিয়ে উঠেছিল যাজকের দেখা সেই রাজহাঁসটার বাসায়। সেই ছত্রাক থেকে পাখিটার পালকে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল আলো ছড়ানো গুড়ো। সাধারন বুনো হাঁসটাকেই সেই আলো যাজকের চোখে বানিয়ে দিয়েছিল যমদূত।
ডক্টর শইকিয়া, এই জঙ্গলের আদিবাসীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। আপনি তাদের ঘরের লোক। কাজেই শিরোমণির গড় সম্বন্ধে নানান অলৌকিক গল্প আপনার অজানা থাকতেই পারে না। আপনিও কখনও না কখনও নিশ্চয় শুনেছিলেন ওই ধ্বংসাবশেষের পথে ফুটে ওঠা জ্বলন্ত পায়ের ছাপ কিম্বা আলোকিত ছেটখাটো প্রাণীদের কথা।
আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছিলেন যে আলোকিত বাঘ কিম্বা হাতি দেখতে পাওয়ার কথা ওরা কেউ বলে না। বলে বেজি কিম্বা সাপের কথাযারা মাটির সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে চলাফেরা করে।
দুইয়ে দুইয়ে চার করতে আপনার সময় লাগেনি। আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিরোমণির গড়ের পেছনের ওই পরিত্যক্ত পেছল পথে নিশ্চয় এমন কোনও উদ্ভিদের আবাদ আছে যারা বায়োলুমিনিসেন্ট; উত্তেজিত হলে জোরালো আলো ছড়ায়। আপনি খুঁজে বার করেছিলেন সেই উদ্ভিদ। খুব ছোট একধরনের ফাঙ্গাস, লালে আর খয়েরিতে মেশানো রঙ। মাটিতে পড়ে থাকলে মাটির থেকে আলাদা করে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু চাপ দিয়ে যদি একে ডলে দেওয়া হয় তাহলে কিছুক্ষণের জন্যে তীব্র লাল আলো ছড়িয়ে দেয় এই কণাগুলো। আর যখন অনেক এমন ফাঙ্গাস একসঙ্গে দলে যায় তখন মনে হয় যেন আগুন ধরে গেল সেই জায়গায়।
আমার ধারণা এই প্রজাতিটি বক্সার এই অঞ্চলে ছাড়া আর কোথাও হয় না। আপনিই এর আবিষ্কারক। কিন্তু আপনি বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে একে তুলে ধরলেন না। আবিষ্কারকের সম্মানের চেয়ে বড় প্রলোভন কাজ করল আপনার মনে। আপনি একে ব্যবহার করলেন মানুষ মারার ফাঁদ পাতবার কাজে। এমন এক জায়গায় এই ছত্রাককে ছড়িয়ে দিলেন, যেখান দিয়ে ফরেস্টগার্ডরা বুকে হেঁটে যাবেই। যাতে যায় সেই ব্যবস্থাও করলেন, দুবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলেন ওই ফাঙ্গাসের আবাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আপনার ফাঁদে পা দিল বিমল বাবুয়ারা।
ওরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাবধানে এগিয়ে গেল। সামনে ফাঁকা রিভারবেড। ওখানে চারিদিক না দেখে বেরিয়ে পড়া যাবে না। ওরা শুয়ে পড়ল, ক্রল করে এগিয়ে গেল নদীর সীমানা অবধি। না, কেউ কোথাও নেই। ওরা উঠে দাঁড়াল।
ওরা অবাক হয়ে দেখল, ওদের শরীরের সামনের দিকটা আগুনের মতন উজ্জ্বল লাল আভা ছড়াচ্ছে কাঁধ থেকে পা অবধি।
উল্টোদিকের পাহাড়ে নিশ্চয় অত্যাধুনিক রাইফেল নিয়ে তৈরিই ছিল ঘাতকের দল। বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই তাদের বুলেট এসে শুইয়ে দিল তিন ফরেস্টগার্ডকে।
.
এবার আমি বলি। বললেন দেবেশ কাশ্যপ। কারণ, এই কথাগুলো আজকেই গুয়াহাটি থেকে আসা রিপোর্টে জানতে পেরেছি। দ্যুতি বা প্রমিত এখনও জানে না।
বিনতা মেহরার বিয়ের আগের নাম বিনতা বড়ুয়া। উনিও অসমের মেয়ে। বিয়ের পরেও মারমেড গ্রুপের নর্থ-ইস্টের প্রোজেক্টগুলোই উনি দেখতেন। সম্ভবত এই সময়েই আপনার সঙ্গে ওনার আলাপ, এবং আলাপ থেকে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের মধ্যে কোথাও প্রেম ছিল না, ছিল বিশুদ্ধ লেনাদেনার সম্পর্ক। শারীরিক লেনদেন এবং আর্থিক। বিনতার সুপুরুষে আসক্তি সর্বজনবিদিত, আর আপনি যে সুপুরুষ এ কথা তো অন্ধেও স্বীকার করবে। আর্থিক লেনদেনের পুরো হিসেবটা এখনও পাই নি। তবে বিনতাদের এক্সপোর্ট হাউসের মাধ্যমেই যে পশু-চামড়ার বেশ কিছু গোপন কনসাইনমেন্ট বাইরে গেছে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।
বিনতার উপকার করার জন্যে ততটা নয়, যতটা আপনি হরিণডুবির ভরাডুবি ঘটানোর জন্যে বিনতাকে এখানে টেনে এনেছিলেন। হ্যাঁ, আপনিই ওকে শিরোমণির গড়ের বর্ণনা দিয়েছিলেন; ওর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন এখানে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম গড়ে তোলার মতলব। আপনাদের সার্ভিস-প্রোভাইডারদের কাছ থেকে মোবাইলের যে কলগ পেয়েছি, তার থেকে সেরকমই জানা যাচ্ছে। আপনি চেয়েছিলেন বক্সা টাইগার রিজার্ভের আঁটোসাঁটো দেওয়ালে একটা বড় ফাটল ধরাতে। সেই ফাটলটাই হত ওই হেমিংওয়ে রিসর্ট। ভবিষ্যতে ওই পথেই আপনার চোরাকারবার আরও মসৃণ হয়ে উঠত।
একই মতলবে আপনি দলে টেনেছিলেন ড্রাগ ব্যবসায়ী মধু বর্মনকে। মধু আর বিনতার জোড়া আক্রমনের সামনে ধ্বসে যাক বক্সার প্রতিরোধ–এটাই ছিল আপনার মনোগত বাসনা।
মধুকে ইন্টারোগেট করেছি। ওই ফাঙ্গাসের গুঁড়ো মধুই আপনাকে জঙ্গল থেকে জোগাড় করে দিত। তার বিনিময়ে আপনি ওকে পয়সা দিতেন। প্রচুর পয়সা। সেরকমই এক লেনদেনের সময়ে বেচারি গুলাবি শিরোমণির গড়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে তাকে মরতে হল। এই সবই মধুকে ইন্টারোগেট করে জানতে পেরেছিলাম।
মধু যেটা ভুল করেছিল সেটা হল, ও গোঁয়ারের মতই সবই চেয়েছিল। নিজের ড্রাগের ব্যবসার জন্যে জঙ্গলের প্রহরাহীন পথ, বিনতার আর আপনার ব্যবসার হিস্যা…আর বিনতার শরীর।
তাই, আমার ধারণা মধু বর্মনকে আপনিই ফাঁসিয়েছেন। এর পেছনে শুধু ব্যবসায়িক আক্রোশ নয়, যৌন ঈর্ষাও কাজ করেছিল। মধুরও ধারণা তাই।
আর তারপর আপনি হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু মধু নয়, বিনতাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কারণ বিনতার ডানহাত মধুকে আপনি ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। অথচ শিরোমণির গড় নিয়ে প্রমিত ব্যানার্জিকে চাপে ফেলার মতন জায়গায় আপনি নিজে নেই, সেখানে আপনাকে প্রকৃতিবান্ধব ভাবমূর্তি বজায় রেখে চলতে হয়। আপনার ভয় হল, বিনতা যদি কোনোভাবে আপনার আসল রূপটা আমাদের কাছে প্রকাশ করে দেন? অবশ্য বিনতা মেহরা শুধু আপনার চোরাশিকারের ব্যবসার কথা আর টেররিস্টদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগের কথাটাই জানতেন। বিমল বাবুয়াদের আপনি কিভাবে মেরেছিলেন, তা উনি জানতেন না। জানলে নিজে মরতেন। না।
সাধারনত খুন করলে সবারই ধরা পড়ার একটা ভয় থাকে। সেটাই অনেক সময় ক্রাইমটা ঘটিয়ে ফেলার থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে। আপনি কিন্তু একেবারে নিশ্চিত ছিলেন যে, কেউ আপনাকে ধরতে পারবে না। কারণ, গুলি চলছে কোথা থেকে, আর আপনি কোথায়? অতএব আপনি নিশ্চিন্তে চতুর্থ খুনটির প্রস্তুতি নিলেন।
কিন্তু বিনতার তো কম্যান্ডো ট্রেনিং নেই। সে স্বেচ্ছায় ওই ফাঙ্গাস আবাদের ওপর বিমল বাবুয়াদের মতন বুকে হেঁটে কোথাও যাবে না। তাহলে উপায়?
এক ধরণের মাকড়শার কথা শুনেছি যাদের মধ্যে স্ত্রী-প্রাণীটি সঙ্গমের শেষে পুরুষটিকে মেরে ফেলে। আপনি কাছাকাছি একটা কাজ করলেন। এমন জায়গায় বিনতা মেহরার সঙ্গে মিলিত হলেন যাতে মিলনের শেষে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আলোয় ঝলমল করে উঠল তার আদুল পিঠ। তারপরে যা হল আমরা সকলেই জানি।
বিনতার শরীর থেকে সংগৃহীত যে স্পার্মের স্যাম্পেল আমাদের কাছে রাখা আছে, পরশু অবধি জানতাম না কোন পুরুষের স্পার্মের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখব। এখন জানি।
জঙ্গলের রাত গাঢ় হয়ে উঠছিল। জেগে উঠছিল জঙ্গল। জেগে উঠছিল ঝিঁঝির শব্দে, হাতির চিৎকারে। জেগে উঠছিল দেবেশ কাশ্যপের জিপের আশেপাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ভেসে আসা নানান নিশাচর প্রাণীর যাতায়াতের খসখসানিতে।
বিশাল বিশাল শাল সেগুনের গুঁড়িগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে নদীর চরের নীলচে কুয়াশা হুহু করে ঢুকে আসছিল অরণ্যের অন্দরে। দ্যুতি তার ওড়নাটা কান মাথা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে প্রমিত অবাক হয়ে ভাবল, এই ক্ষীণজীবী মেয়েটাই কি এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল! আশ্চর্য!
.
আপনি কিছু বলবেন না মিস্টার শইকিয়া? কোনও ফাঁক নেই, কোনও ভুল নেই আমরা এতক্ষণ যা বললাম তার মধ্যে?
রূপেন শইকিয়া উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি সেইভাবেই তাকিয়ে রইলেন। তার শরীর একটুও নড়ল না। দেবেশ কাশ্যপের এই প্রশ্নে শুধু তার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল–
আমার একটা আট বছরের মেয়ে রয়েছে জানেন? সে তার বাবাকে ভাবে সুপারম্যান। পৃথিবীর যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে একা লড়ে যেতে পারে।
আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন আমি সামান্য একজন স্কুলশিক্ষক। তবু অনুরাধা, মানে আমার স্ত্রী প্রচণ্ড গর্বিত হয়েছিল একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষের স্ত্রী হতে পেরে। আজও সে আমার ধনদৌলত নয়, আমার বিদ্যার গরবেই গরবিনী।
আমার বৃদ্ধ বাবা এখনও বেঁচে আছেন। জীবনে যত জনহিতকর কাজ করেছি, বিশ্বাস করুন, তার সবটাই ফাঁকি ছিল না। সবটাই যে নিজের ধান্দায় করেছি তা নয়। অনেকটাই করেছি বাবাকে খুশি করার জন্যে।
এমন কি বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, টেররিস্টদের সঙ্গে প্রথম যখন যোগাযোগ করি সেটাও ওদের আদর্শের প্রতি সহমর্মিতা থেকে, অন্য কিছু নয়।
কিন্তু তারপরে কী যে হয়ে গেল! পয়সার নেশা ভূতের মতন ঘাড়ে চেপে বসল। আর তার সঙ্গে ছিল আপনাদের বোকা বানাবার নেশা। এই যে নিজে আড়ালে থেকে একটা আস্ত সাম্রাজ্য শাসন করছি, পুলিশ মিলিটারি সবাইকে ঘোল খাওয়াচ্ছি–এত ভালো লাগত এই ব্যাপারটা যে কি বলব।
হ্যাটস অফ টু ইউ দ্যুতি। ইনফর্মেশন অনেকের কাছেই থাকে। কিন্তু সেই ইনফর্মেশনগুলোকে কাজে লাগাতে পারে কজন? তুমি যে এত তাড়াতাড়ি বায়োলুমিনিসেন্সের ব্যাপারটা ধরে ফেলবে বুঝিনি। তোমার চেহারার মধ্যে এমন একটা সাদামাটা ব্যাপার আছে যেটা খুব মিসলিডিং। আমি…আমি স্বীকার করছি, তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম। না হলে নিজেই কখনও তোমাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরি? সেটাই আমার একমাত্র ব্লান্ডার।
তবু তুমিও একটা খুব ভাইটাল ব্যাপার ধরতে পারোনি দ্যুতি। সেটা ধরতে পারলে তোমরা বুঝতে পারতে আমারও একজন বস রয়েছেন। তিনি তোমাদেরও বস। ডাবল-এজেন্ট কথাটা শুনেছ? তিনি সেই ডাবল-এজেন্ট।
দ্যুতি, প্রমিত এবং দেবেশ কাশ্যপ একসঙ্গে বলে উঠলেন–কে?
আমি বললেই কি বিশ্বাস করবে? প্রমাণ লাগবে না? প্রমাণ রয়েছে ওইখানে। ওই ঘাসজমির মধ্যে, যেখানে বিনতা গুলি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল। মিস্টার কাশ্যপ, অনুমতি দিন, একবার নামি। আপনি, আপনার গার্ডরাও চলুন না আমার সঙ্গে। পালাতে তো পারব না।
এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে নিয়ে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বেশ, চলুন।
ওরা সকলেই গাড়ি থেকে নামল। দুজন গার্ডকে দুদিকে নিয়ে সামনে সামনে যাচ্ছিলেন ডক্টর শইকিয়া। পেছনে দেবেশ কাশ্যপ। তারও পেছনে দ্যুতি আর প্রমিত পাশাপাশি।
হঠাৎ ঘাসজমিটার কাছাকাছি এসে বিদ্যুতের মতন সেই ঘাসজমির ওপর লাফিয়ে পড়লেন ডক্টর রূপেন শইকিয়া। তারপর ছফুটের ওপর লম্বা, ভারী শরীরটা নিয়ে বিশাল একটা মাছের মতন পিছলোতে পিছলোতে চলে গেলেন নদীর কিনারায়।
গার্ড দুজন তাকে গুলি করবার জন্যে বন্দুক উঠিয়েছিল। দেবেশ কাশ্যপ তাদের হাত ধরে থামালেন। বললেন, না। এর আর দরকার হবে না। একজন অনুতপ্ত মানুষকে আত্মহত্যার সুযোগটা দাও।
ওদের বিস্মিত চোখের সামনে জয়ন্তীর তীরে দাঁড়িয়ে উঠলেন রূপেন শইকিয়া। তার। বুকটা তখন রক্তছত্রাকের প্রভায় আগুনের মতন জ্বলছে। এক মুহূর্ত পরেই কাটা কলাগাছের মতন জমির ওপর আছড়ে পড়ল তার শরীর।
রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে ভুটান পাহাড় থেকে ভেসে এল একটাই মাত্র ফায়ারিং-এর শব্দ। একটাই।
আরও একটু পরে ডক্টর শইকিয়ার বুকের ওপর থেকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল মরণবিভা।