সৌন্দর্য সম্বন্ধে এক এক জাতির এক এক রকম ধারণা। কোনো এক দেশের লোক গলা ফোলা মানুষকে খুব সুন্দর বলে মনে করে। ফুললে মানুষকে কত বিশ্রী দেখায় তা সবাই জানেন। দেখতে দেখতে সেই অদ্ভুত প্রকৃতির লোকগুলির রুচি এমন বদলে গেছে যে, যাদের গলা ফোলা নয় তাদেরকে তারা অসুন্দর বলে ঘৃণা করে। স্বামীর প্রতি যদি পত্নীর প্রেম শ্রদ্ধা না থাকে তা হলে হাজার সৌন্দর্যও চোখে লাগে না। গ্রামে-শহরে সব জাগাতেই এর অনেক হৃদয়বিদারক দৃষ্টান্ত আছে।
অনেক সময় রূপে গর্ব বালিকা ও যুবতীদেরকে অহঙ্কারী ও দাম্ভিক প্রকৃতির করে তোলে। রূপ না থাকলে হয়তো তারা বিনয়ী হবেন, চিত্ত স্বভাব সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু রূপের অভিশাপে মন ও স্বভাব তাদের কলঙ্কাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। কথা ও ব্যবহারেই মানুষকে বেশি করে মুগ্ধ করে। মানুষ যখনই বোঝে রূপের মধ্যে প্রেম, সহানুভূতি ও সুরুচির পরশ নেই তখন সে সরে পড়ে। ক্ষণিক আমোদের জন্যে মানুষ সে রূপ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে পারে, কিন্তু সে রূপকে শ্রদ্ধা করে সে মাথায় তুলে নেয় না।
নারীর সম্বন্ধে যে সব কথা বলেছি, পুরুষ সম্বন্ধেও সেই কথা বলা চলে। কুৎসিত বাহিরের অন্তরালে উন্নত পুরুষ আত্মাটা অপদার্থ নারীর কাছে সম্মান না পেতে পারে, কিন্তু উন্নত হৃদয়া নারী তাকে শ্রদ্ধা করেন, তাকে ভালবাসেন, তার জন্যে প্রাণ দেন। মনুষ্যত্বকে আদর করবার ক্ষমতা নারীদের মধ্যে প্রায়ই নেই, কারণ তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে জ্ঞান। তারা অনেক সময় পুরুষকে অন্ধের মতো মমতা করেন। উন্নত আত্মা ছাড়া অন্য কোথাও প্রেমের উন্মেষ হয় না, মনুষ্যত্বের প্রতিও শ্রদ্ধা বোধ জাগে না।
মানুষের ভুল আছে। স্বামী-স্ত্রীর ভুল হবে। একজন আর একজনের ভুল নিয়ে যদি অনবরত টানাটানি করেন, তা হলে সে হয় বড় দোষের কথা।
অনেক জায়গায় দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীতে সর্বদা ঝগড়া লেগে আছে। যেন দুই শত্রু এক পথের মাথায় হঠাৎ মুখোমুখি হয়েছেন, পুরনো রাগ মেটাবার জন্যে কোমর বেঁধে এখন তারা মারামারি করবেন। বিয়ের পর কিছুদিন ভালবাসার আদান-প্রদান, প্রণয়-চুম্বন, কবিতা পাঠ খুব চলতে থাকে, কিন্তু তারপর কঠিন ঘরকন্নার মাঝে সে প্রেম সোহাগ লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায়। একজন আর একজনের দোষ অন্বেষণেই ব্যস্ত থাকেন। পত্নীর কর্তব্য বাড়ির সকল কাজ গুছিয়ে নেওয়া, স্বামীর সকল রকম সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা। স্বামীরও উচিত পত্নীর কাজে নিয়ত ভুল না ধরা। অতিরিক্ত ভুল ধরলে মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়, বুদ্ধি নির্বুদ্ধিতায় পরিণত হয়। নারীর ভুল ধরে ধরে মানুষ তাকে আরও পাগল করে তুলেছে। নারীর স্বাধীনতা ও শক্তি অর্জন ছাড়া তার কল্যাণ অসম্ভব।
স্বামী যদি বাহিরের কাজে রাতদিন ঘুরে বেড়ান, পত্নীর সঙ্গে মোটেই মিশতে না পারেন তাহলে পত্নী অনেক সময় বিরক্ত হন। শুধু বাহিরের কাজে মজে থাকা এবং পরীর ভাবের প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি না রাখাটা দোষের।
তুমি একজন বড় দরের লোক, পত্নী তোমার মর্যাদা বোঝেন না, তোমার সঙ্গে সম্ভ্রম করে কথা বলেন না, দাসীর মতো পদ চুম্বন করেন না–এ ভেবে যদি তোমার মন পত্নীর প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে তাহলে বলবো তুমি হীন।
শুধু প্রেম করবার সময় পত্নীকে নিয়ে টানাটানি করা এবং বাকি সময় তার সঙ্গে অভদ্রতা করা বা তাকে কেবল কঠিন ভাষা প্রয়োগ করা নিচাশয়তা। বস্তুতঃ পত্নী যত ছোটই হোক, যত অপরাধই করুক তার সঙ্গে হাসিমুখে ছাড়া অন্যভাবে কথা বলা কাপুরুষতা।
শুধু একটি কারণে পুরুষ জাতি নারীর উপর বিরক্ত হতে পারেন–সে হচ্ছে নারীর ব্যভিচার। নারীর শ্রেষ্ঠ গৌরব। ওটা যদি থাকে তবে আর কোনো গুণ দরকার নাই। পত্নী অভিমানী, তিনি তোমাকে গালি দেন, সেবা সুখ দেন না। তার শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান নাই–এ সমস্ত কারণে পত্নীর উপর বিরক্ত হয়ো না। প্রয়োজন হলে নিজে রান্না করে খাবে তবু পত্নীর সঙ্গে ঝগড়া করবে না। পত্নীর সঙ্গে কলহ করবার মতো কাপুরুষতা আর নাই।
নারী-জীবনে আর একটা গুরুতর অপরাধ আছে–সেটা হচ্ছে স্বামীর কাছ ছাড়া হয়ে কোনো জায়গায় দীর্ঘদিন থাকা। স্বামীর বিন্দুমাত্র আপত্তিতে নারীর কোথাও যাওয়া নিষেধ। যে নারী স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চলে যেতে চায়, তাকে জোর করে ধরে রাখা ঠিক হবে না।
স্বামী যেমন পত্নীর অন্যায়কে মেনে নেবেন, পত্নীরও কর্তব্য স্বামীর ভুলকে তিনি ক্ষমা করবেন।
পুরুষের চরিত্রহীনতাকে নারী ক্ষমা করবেন কিনা, কেমন করে বলবো? পুরুষ যখন নারীর চরিত্রহীনতাকে ক্ষমা করতে পারেন না, নারীও তেমনি পুরুষের চরিত্রহীনতাকে ক্ষমা করতে পারেন না। এই বিশ্বাসহীনতার দ্বারা বিবাহের মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়। মানব-জীবনে হঠাৎ কোনো সময় যদি কোনো দুর্বলতা আসে, তবে সেজন্য স্বামী এবং পত্নী উভয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন–অনুতাপ ও পাপ স্বীকারে পাপের দোষ নষ্ট হয়ে যায়, এ যেন নারী-পুরুষ উভয়ের মনে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় চরিত্রহীনতার দোষে স্বামী পত্নীকে হত্যা করেন, কিন্তু একই অপরাধে কোনো নারী স্বামীকে হত্যা করেনি। পুরুষের বহু বিবাহ করবার ক্ষমতা আছে বলেই কি নারীদের দাবীর প্রতি এই অমর্যাদা?