গ্রামের লোকের এতকাল ধারণা ছিল, যার বংশ যত গোলাম তৈরি করতে পারে সে তত শরীফ বা ভদ্রলোক। লোকে গল্পের সময় বলে থাকে, তার শ্যালক ডেপুটি বাবু, চাচা উকিল–অতএব তারা যে খুব ভদ্রলোক তাতে আর সন্দেহ কী? এই ধরনের জঘন্য চিন্তা জাতির দীনতা ও পাতিত্য প্রকট করে তুলেছে। পল্লীতে থেকে জমি চাষ কর, জ্ঞান ও সত্য জীবন অবলম্বন কর–তোমার স্বাধীনতা উন্নত ললাটকে আমি চুম্বন করবো। ঘুষ, মিথ্যা ও দাস জীবনের কলঙ্ক ছাপে তুমি উচ্চস্থান অধিকার করে বসেছ, ধিক তোমার জীবনের, ধিক তোমার অর্থে। সেই শুভদিন কবে আসবে, যেদিন পল্লীর মানুষ সত্যের সেবক হয়ে নীচতাকে ঘৃণা করতে শিখবে। অভাবগ্রস্ত দীন জীবনের উঁচু মাথাকে চাকর ভদ্রলোক হওয়া অপেক্ষা বেশি শ্লাঘার বিষয় বলে মনে করবে।
পল্লীতে যে সমস্ত মানুষ খুব আদর সম্মানে থাকেন, শহরে এলে তাদের কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। পল্লীতে থাকলে তার জীবন দেশের অনেক উপকারে আসতো, শহরে থাকাতে তা নিতান্তই নিরর্থক হয়ে গেছে।
বহু পণ্ডিত ও জ্ঞানী শহরে এসে সমবেত হন। যে মানুষের মূল্য পল্লীগ্রামে কেউ বোঝে নাই শহরের মানুষেরা তাকে বুঝে এবং সম্মান করে। গ্রামে অজানা অচেনা হয়ে বহু শক্তি নষ্ট হয়ে যায়–কেউ তাকে বড় করে তোলে না। বারুদে আগুন দিলে যেমন করে জ্বলে ওঠে, পণ্ডিত মানুষের সহবাসে প্রতিভাও তেমনি করে জ্বলে ওঠে।
এক সাধুকে এক ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, দেখ সাধু, আমি তোমার চেয়ে ভদ্রলোক। সাধু তখন বলেন–এতে তো আমার দুঃখ নেই। জগতে যত ভদ্রলোক হয় ততই ভালো। মন যখন ছোট ও অবনত থাকে, তখন সে মানুষের শক্তি ও গৌরব শক্তি স্বীকার করতে লজ্জা পায়। এই জন্যে দেখে থাকি, পল্লীর অনেক মানুষ ছোটর উন্নতি ও মঙ্গলে আনন্দ পান না, মহত্ত্ব ও গুণ স্বীকার করতে সঙ্কোচ, কুণ্ঠাবোধ করেন। যে শক্তি পল্লীতে অসাড় ও শক্তিহীন হয়েছিল শহরের গুণগ্রাহী পণ্ডিতমণ্ডলীর স্পর্শে এসে তা অনুরূপ তেজে জ্বলে ওঠে। বড় ও মহৎ যিনি, তিনি সত্যের জয়। যেখানেই মনুষ্যত্বের দীপ্তি তিনি চান দেখেন, সেখানেই তারা মাথা নত হয়ে পড়ে। এই মাথা নত করতে তার আনন্দ হয়। সত্য ও মহত্ত্ব স্বীকার করাই যে তার ধর্ম। দুষ্ট ও শয়তানের শুভ দেখলে মনে যদি বিরক্তি আসে তবে তা বিশেষ দোষের নয়।
প্রাচীনকাল হতে শহরে রাজার শাসন-কেন্দ্রের পীঠস্থান হতে সর্বপ্রকার মঙ্গলসূচিত হয়। রাজাসনের অপব্যবহার হয়েছে সত্য কিন্তু রাজার অর্থ সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটা প্রাণময় শক্তি। মানুষ নিজের মঙ্গলের জন্যে নিজেদের সত্যবুদ্ধি ও ন্যায় বিচারকে শরীরী করে উঁচুতে বসিয়ে রেখেছেন। রাজশক্তির নিকটে চিরকালই পণ্ডিতদল সমবেত হয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানালোচনা, ভাবের আদান-প্রদান ও নানা শুভ উদ্দেশ্যে তারা শহরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে এ কথাও বলে রাখি, যে পণ্ডিত বা যে দার্শনিক সম্মান ও অর্থ লালসায় রাজা সম্মুখে হীন হয়ে ব্যক্তিত্ব হারিয়েছেন তাঁর সাহিত্য ও জ্ঞান সাধনা বৃথা। জ্ঞানের সেবক যিনি, সত্য উদ্ধার যার জীবনের ব্রত, তাকে সর্বপ্রকারে সকল স্থানে, কি শহরের পল্লীতে স্বাধীনচিত্ত হয়ে থাকতে হবে।
শহরের সম্পদ দেখে গোটা জাতির অবস্থা সম্বন্ধে বিবেচনা করলে চলবে না। দেশের সমস্ত মানুষের মঙ্গল চাই। শহরের বিলাস-জীবন উচ্চ অট্টালিকা দেখে জাতির সাধারণ মানুষের কথা ভুলে থাকলে চলবে না।
শহর হচ্ছে গোটা জাতিটাকে শুদ্ধ ও বড় করে তোলবার জন্যে কতকগুলি ঋষি ও মানব সেবকের সাধনা নিকেতন। তাদের ঘিরেই নিয়ত একটা কর্ম কোলাহল বাজতে থাকে। এটা আসলে মানুষের সম্পদ আহরণের স্থান নয়।
মানুষের নিত্য নিত্য যতই নতুন বিধান হোক না সে কখনও মৃত্যু ও দুঃখের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। তার কোথাও সুখ নেই। মানুষের মধ্যে বড় রকমের দুঃখ অসন্তোষ জাগিয়ে দেওয়া চাই; তাহলেই আমাদের মুক্তি হবে। তৃপ্তির মাঝে জীবন নেই, চাই শহর পল্লী সকল মানুষের অতৃপ্তি ও বেদনানুভূতি ভর্তি-শুদ্ধির জন্যে একটা জীবনব্যাপী সংগ্রাম।
জনসন শহরে থাকতে বড় ভালবাসতেন। জসুয়া রেনলডস বলতেন, লণ্ডন শহর ছাড়া আর কোথাও কথা বলে আমি সুখ পাই নে।
মানুষ যদি তার চিন্তা ও ভাব কারো সঙ্গে বিনিময় না করতে পারে তাহলে তার জীবনে অনেক সময় সুখ থাকে না। বিয়ের পর স্বামী-পত্নীতে যে অমিল হয় তার কারণ অনেক এই।
প্রতিভাশালী ব্যক্তিরা পল্লীতে জীবনের প্রতিধ্বনি না পেয়ে শেষকালে শহরে এসে সমবেত হন। বহু সাহিত্যিক জীবনে অনেক কষ্টের দাগা পেয়েছেন, তবুও তারা শহর ত্যাগ করে পল্লীতে সুখ করতে যেতে পারেন নি।
শহরে আমাদের স্বাধীনতা খুব বেশি। কে কী বলবে, এ কথা বড় ভাবতে হয় না। পল্লীতে সমাজের ভয়ে অনেক সত্য কথা চেপে রাখতে হয়। পল্লীতেও যেদিন শহরের এই স্বাধীনতা লাভ করা যাবে, সেদিন আমাদের কী শুভ দিন, দাগা পেয়ে পণ্ডিতেরা যেদিন গ্রাম ছাড়বেন না সেদিন হবে আমাদের মুক্তির দিন, পল্লীতে বাস করেও আমরা জীবনের সকল সুবিধা পাবো, জীবনকে সার্থক করতে পারবো–সেই দিনের অপেক্ষা আমরা করছি। বিলেতে ও মার্কিন পল্লী তা পেরেছে।
৩. জীবনের ব্যবহার
১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ওহিও (Ohio) নদীর ধারে কতকগুলি ইংরেজ অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ কতকগুলি দেশী মানুষ তাদেরকে আক্রমণ করল। চারদিকে বেড়া ছিল, তার ভিতরে এসে আত্মরক্ষার জন্যে তারা প্রস্তুত হলেন। শত্রুর আক্রমণ বাধা দেওয়ার। জন্য বিশেষ আয়োজন ছিল না। দস্যুরা শিগগিরই তাদের বেড়া ভেঙ্গে সব লুট করে নিয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে সকলকেই খুন করে ফেলবে।