গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের উপর রাজা, জমিদারদের কর্মচারীরা বিলক্ষণ অসদ্ব্যবহার করে থাকেন। সে অসদ্ব্যবহার সহ্য করে ভদ্র ও শিক্ষিত লোকের পক্ষে সেখানে বাস করা। কঠিন। রাজকর্মচারীরাও গ্রামবাসীদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করে থাকেন। মানুষকে দলিত ও লাঞ্ছিত করতে পারলেই যেন তাদের মনে আনন্দ হয়। সেখানে সবলেরা সর্বদা দূর্বলের রক্ত চুষে খাওয়াতেই জীবনের সার্থকতা অনুভব করেন।
গ্রামে নারীদের যে দুর্দশা হয়, তা আর বলে কী হবে? পল্লী-নরনারীর দুঃখ-বেদনা বোঝবার জন্য কার মাথা ব্যথা হবে।
ডাক্তার আরনডের পল্লীর জীবনের প্রতি একটা আন্তরিক টান ছিল। তিনি ছেলেদের নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। পল্লীর লতাপাতা, শ্যামল মাঠ, উঁচু গাছগুলি তাঁর প্রাণে আনন্দের ধারা ঢেলে দিত। প্রকৃতির মাঝেই তো আমরা জীবনের সন্ধান পাই–অনন্তের সঙ্গীত শুনি। হৃদয় যাদের বড় তারা প্রকৃতির শ্যামল মাধুরীর ভিতর থেকে জীবনের হাজার সম্পদ কুড়িয়ে নেন। কী হবে–ইট-পাথরে, দালানে, অর্থের কাঁড়ি দিয়ে? চাই শান্তি পাপের পরাজয়, মানব দুঃখের অবসান আর আত্মার পুলক।
কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ পল্লীমায়ের আদুরে সন্তান। মৃত্যু পর্যন্ত জগৎকে তিনি প্রকৃতি জননীর সঙ্গীত শুনিয়েছেন। মানুষ বিহ্বল হয়ে কবির সে গান শুনতে থাকবে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের বীণাধ্বনি নীরব হবার নয়।
সিডনী স্মীথ (Sydney Smith) গ্রামে বাস করে এডিনবরা রিভিউয়ের জন্যে প্রবন্ধ লিখতেন। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। শেষ জীবনে শহরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন; কিন্তু গ্রাম্য জীবনের আনন্দ ও তৃপ্তি হতে বঞ্চিত হয়েছিলেন বলে তিনি অনেক সময় দুঃখ করতেন।
দার্শনিক কার্লাইল পল্লীর অজ্ঞাত কুটিরে জন্মেছিলেন। তিনি জগৎকে যে চিন্তা সম্পদ দিয়ে গিয়েছিলেন, তার মূল্য হচ্ছে–বাল্যকালে তার সেই নির্জন পল্লীবাস। লেখাপড়ার জন্য তিনি কিছুদিন এডিনবরা শহরে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর হতেই তিনি পুনরায় পত্নীকে। নিয়ে এমন নিরালা নিভৃত স্থানে বাস করতেন যে, সেখানে যেতে হলে অপরিচিত লোককে বিলক্ষণ গ্রামের মাঝে যেয়ে তাকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল। কার্লাইল নিতান্তই একা একা বাস করতেন। তাঁর বাড়ির কাছে একটা জনপ্রাণী ছিল না, যার সঙ্গে খুলে তিনি একটু কথা বলতে পারেন। কাছে একটা পাদরী ছিলেন মাত্র, তার সঙ্গে আলাপ হতো। অবশিষ্ট সময় পরীর সঙ্গে আলাপ করে আর বই পড়ে তিনি কাটাতেন।
দেশে মন টেকে না–একথা অনেককেই বলতে শুনেছি। গ্রামের লোকগুলি অসভ্য ও নীচাশয়। রাস্তা-ঘাটগুলি কর্দমাক্ত–এ সমস্ত কথাও অনেকে বলে থাকেন। পল্লীকে ঘৃণা করে তারা বন্ধু-বান্ধবের কাছে প্রশংসা লাভ করতে চান; এটা ঠিক নয়। পল্লী যদি জঘন্য স্থানই হয় তবে তাকে বড় করে নিতে হবে। গ্রামের লোকগুলি যদি দুর্মতিই হয়, তবে দেশ ছেড়ে নিজের সুখ ও উন্নত মনটি নিয়ে পালিয়ে এলে চলবে না।
মান উন্নত হয়ে লাভ কী? যদি না মন অন্য মানুষকে উন্নত করতে পারে? জগতের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য এই ধরনের উন্নত মন দিয়ে পৃথিবীর কোনো উপকার হয় না।
অনেক জায়গায় দেখেছি বড়লোকেরা কতকগুলি লোককে বাড়ির পার্শ্বে দাস করে রাখে। নিজেদের বড়মানুষেতা অক্ষুণ্ণ করে রাখবার জন্যে কতকগুলি মানুষের জীবনকে কি ব্যর্থ করে দিতে হবে? ছোটলোক লেখাপড়া শিখলে ভদ্রলোকের সম্মান থাকবে না, এ কথা তারা বলে থাকেন। এরা যে কত বড় অমানুষ তা আর বলে কী হবে।
যে অর্থ মানব-কল্যাণ ব্যয়িত হয় না, যে ক্ষমতা মানুষের দাবি রক্ষার জন্যে অর্জিত হয় না, যে বিদ্যা মানুষকে সত্য ও ন্যায় মহিমা শোনাবার জন্যে লাভ হয় নাই–সে অর্থে, সে ক্ষমতা, সে বিদ্যার কোনো মূল্য নাই।
রোমান জাতি সর্বদাই গ্রাম্য লোককে ঘৃণা করতেন। ভদ্রলোক যারা তারা শহরে। থাকবে। নিম্নশ্রেণীর সাধারণ লোকদের জন্যে গ্রাম–এই ছিল তাদের ধারণা এবং জাতীয় প্রথা। মানুষকে যে মানুষ ঘৃণা করে, একজনের দাবি যে আর একজন অপহরণ করে, এর মূলে ঘৃণিত ও অপহৃত ব্যক্তির অনেকখানি দোষ দুর্বলতা থাকা সম্ভব; কিন্তু রোমানেরা যাদের গ্রাম্য ছোটলোক বলে ঘৃণা করতেন শেষকালে তারাই হয়েছিল জাতির চালক।
পল্লীর যে-সব মানুষ অবজ্ঞাত হয়ে থাকে, তাদের জাগরণ হয় তখন, যখন তারা জ্ঞানের স্পর্শে আসে। যে জাতি বা যে মানুষের মনে দাম্ভিক ও আত্মসর্বস্ব হয়ে তৃপ্তি আসে, তাদের স্থান খুব নিচে। এটা হচ্ছে পতনের পূর্ব লক্ষণ। অত্যাচারী জাতি বা অত্যাচারী মানুষ ছোটকে জ্ঞানান্ধ ও ছোট করে রাখতে চায়। পাপী ও পতিতকে ঘৃণা করতে আনন্দ বোধ করে। ছোটকে বড় করাই মনুষ্যত্ব ও বড় ধর্ম। এ জগতে যত মহাপুরুষ এসেছেন তারা দরিদ্র, হীন ও পতিতকে বড় করেই জীবনের দানকে সার্থক করেছেন।
পুস্তকে যা পড়ি তার চেয়ে কাজ হয় বেশি মুখের কথায়। কিন্তু জীবন্ত মানুষের মুখ থেকে যে ভাব ও শব্দ বের হয় তা বৈদ্যুতিক শক্তির মতো মনের উপর ক্রিয়া করে। পুস্তকও মানুষকে বড় করবার জন্যে নীরবে কাজ করতে থাকে, সাহিত্যের শক্তি অসাধারণ।
শহরের বাজারে এক শ্রেণীর দুর্মতি লোক দেখা যায় যাদের পতিত আত্মাকে রক্ষা করবার জন্যে কারো বেদনা নেই। জাতিকে শক্তিশালী করতে হলে এদের কানের কাছে। বড় কথা ও বড় চিন্তার ধ্বনি তুলতে হবে। মানব-আত্মাকে আঘাতের উপর আঘাত করতে। হবে। শাসনতন্ত্রে সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে ভালো করবার জন্যে বহু সমিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। পল্লীতে পল্লীতে গ্রামে গ্রামে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে; ছোট ও দুর্মতি লোকদের নিয়ে মনুষ্যত্বের কথা বলতে হবে! বিলেতে পতুিত মানুষের উদ্ধারের জন্যে বহু চরিত্রবান নারী-পুরুষ সেবক সেবিকা আছেন। আমাদের দেশে কি শহরে, কি পল্লীতে এরূপ কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। যে সামান্য শক্তি আছে, তাই নিয়ে–হে দেশের মানুষ, মানব সেবায় বেরিয়ে পড়। সভ্য জাতির সেবাধর্ম একটা স্বভাব। মানব কল্যাণই তার যাত্রাপথের সাধনা। ছোট, দরিদ্র, হীন, অবজ্ঞাতকে নিয়ে আজ আমাদের পাগল হতে হবে।