বুঝলাম,রেস্তরাঁ মালিক একটি বিশিষ্ট জ্ঞান গোঁসাই!
তবে কিনা ভেতরে ঢুকেই যেটা সবার আগে নজর কাড়ে, সেটা হচ্ছে দরজার ঠিক উলটোদিকের দেওয়ালে শ্রীরামকৃষ্ণের একটা প্রমাণ সাইজের বাঁধানো ছবি। যদিও অবাক হইনি বিন্দুমাত্র, আগেও দেখেছি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রচুর অনুসারী, বাঙালিদের থেকে বেশি বৈ কম নয়! বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম যে এটা আমাদের প্রচলিত অর্থে কোন রেস্তরাঁ নয়। একটা বাড়ির ড্রয়িংরুমে চার পাঁচটি চেয়ার টেবিল পেতে আয়োজন। রান্নাবান্না সবই লাগোয়া কিচেনে, ঘরোয়া পরিবেশে ঘরোয়া রান্নার ব্যবস্থা। এরকম অনেক দেখেছি সাউথের মফস্বল গুলিতে। নামজাদা রেস্তরাঁর থেকে কিছু কম ভীড় হয় না।
দরজার কাছে কাউন্টার, আর সেখানে যিনি কাউন্টার আলো করে বসে আছেন, দর্শনমাত্রে প্রতীতি জন্মায় যে ইনিই এখানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী!
ভদ্রমহিলার বয়েস ষাটের কাছাকাছি, কি তার ওদিকেই হবে, বিশাল শরীর, পুরো চেয়ারটাই যাকে বলে উপচে দখল করে বসে আছেন। কাশীর পেয়ারার মতন টকটকে ফরসা রঙ, নুন গোলমরিচের উরন্ত চুল, সোনার রিমলেস চশমা। গম্ভীর মুখে একটা বই পড়ে যাচ্ছেন। কথা বলুন না বলুন, সমীহের একটা সূক্ষ্ম মসলিনি বাতাবরণ যে ভদ্রমহিলাকে ঘিরে আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমি তো হাতটাত ধুয়ে বসেছি, সামনে থালার মধ্যে কলাপাতা রেখে দিয়ে গেছে, একগাদা ছোট ছোট বাটি চারিদিকে, তার মধ্যে বিচিত্র সব তরকারি, ঘিয়ের একটা বড় বাটি পাশেই, চামচসুদ্ধু, তার পাশে দুটো খোপওয়ালা একটা পাত্র, তার একটা খোপে হলদে বাদামি টাইপের পাউডার একটা (এরা বলে গান পাউডার) আরেকটা খোপে গাঢ় বাদামি কালো রঙের আরেকটা পাউডার, এরা বলে মিঠা নিমপাত্তা পাউডার, বেসিক্যালি কারিপাতা শুকিয়ে মশলা মিশিয়ে গুঁড়ো করে রাখা।
তারপর দেখি একটা কি ভেজিটেবল চপের মতন দিয়ে গেলো, বেশ মুচমুচে বেসনে দিয়ে ভাজা, আর একটা ইয়াব্বড় শুকনো লঙ্কা,চপচপে করে তেল দিয়ে ভাজা। সঙ্গে থপাৎ থপাৎ করে দুচামচ চাটনি। তারপর দেখি পরিবেশনকারী ভদ্রলোক একটা ভাতের বালতি নিয়ে হাসিমুখে আমার দিকেই আগচ্ছতি। খিদের মুখে গরম ভাতের গন্ধটা যা চরম ভালো লাগে কি বলবো, খিদেটা যেন দুনো হয়ে উঠলো। আমি আবার কদিনে সামান্য ছেঁড়াখোঁড়া তেলুগু শিখেছি। ছাগল যেমন নতুন শিং গজালে সবেতেই একটু ঘষে নেয়, আম্মো চান্স পেলেই একটু তেলুগু বলে নিচ্ছি, আশেপাশের পাবলিক সেই শুনে আবার বিলক্ষণ মজাও পাচ্ছে। তা এখানেও আমার ভেতরের সেই ভাষাবিদ হরিনাথ সুযোগ পেয়েই বলে উঠলেন ‘কুঞ্জম রাইস কাওয়ালে’, অস্যার্থ আমার একটু ভাত চাই। কুঞ্জম মানে কিছুটা বা একটু , কাওয়ালে মানে আমার চাই।
বলেই গর্বে ইতিউতি চাইছি, আশেপাশের লোকজন বেশ প্রশ্রয়যুক্ত অ্যাপ্রূভালের ভঙ্গিতে মৃদু হাস্যে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াচ্ছেন, এমন সময় দেখি অচানক সব্বাই গম্ভীর হয়ে ফের স্ব-স্ব ক্ষুৎপাত্রে মনোনিবেশ করলেন।
ক্কি কেস? ঘাড় ঘোরাতেই দেখি মালকিন স্বয়ং!! রিমলেস চশমার মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করছেন। চোখে চোখ পড়তেই চোস্ত ইংরেজিতে প্রশ্ন ‘হোয়ের আর ইউ ফ্রম’।
আমিও চোস্ততর ইংরেজিতে বল্লুম, ‘আপাতত ফ্রম বিজয়ওয়াড়া’।
ভ্রূধনু কুঞ্চিত হলো, ‘ দ্যটস নট দ্য আনসার। হুইচ পার্ট অফ ইণ্ডিয়া? নর্থ?’।
এই রে!! তামিলনাড়ুতে নর্থ ইণ্ডিয়ার হিন্দিভাষীদের একদম পছন্দ করে না লোকজন, স্বচক্ষে দেখা। এরা আবার সেদিককার নাকি? কোস্টাল অন্ধ্রতেও কি সেরকম হেনস্থা হতে হবে? ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে নাকি? খেতে অবধি দেবে না, অ্যাঁ? এদিকে আমার যে হেব্বি খিদে পেয়েছে মাইরি!
ততক্ষণে ভাত অবশ্য ঢেলে দিয়েছে পাতে। গরম ধোঁওয়া ওঠা ভাত, (এরা আবার পোচ্চুর ভাত খায়, সে পরিমাণ দেখলে আমরা বাঙালিরা মুচ্ছো যাবো), তার মধ্যেই আধবাটি ঘি প্রায় উপুড়হস্তেই দিয়ে গেছে, গন্ধেই মাইরি পেট চুঁইচুঁই করছে, আমি অত্যন্ত গভীর গলায়, বেশ ওজনদার গাম্ভীর্য সহকারে ( যাতে খাবারটি ফস্কে না যায়) বল্লুম ‘ আয়্যাম ফ্রম ইস্ট ইণ্ডিয়া’।
বলেই খেতে যাবো, ঝটিতি পরের প্রশ্ন, ‘ হুইচ স্টেট? বিহার অর আসাম?’
আ মোলো যা। তাতে আপনার কি মাসিমা? ওখানকার লোক হলে ফ্রি তে খাওয়াবেন নাকি? ঝত্তসব, সামনে মাইরি গরম ধোঁয়াওঠা ভাত, ঘি দিয়ে, ভাবচি ওই যে ভেজিটেবিল চপটা দিয়ে গেলো সেটা দিয়ে দু গরাস মুখে তুলি, এমন সময় এমন সিবিআই মার্কা এনকোয়ারি ভাল্লাগে না মাইইরি..
চপটা ভেঙে অত্যন্ত গাঢ় গলায় বল্লুম ‘ ওয়েস্ট বেঙ্গল’।
‘ হুইচ সিটি?’ মিস মার্পলকে এবার অসহ্য লাগছিলো।
‘ক্যালকাটা’ বলেই চপটার ভেতরটা দেখে সন্দেহ হলো। নারকেল নাড়ুর মতন দেখতে কেন রে?
‘হুইচ পার্ট অফ ক্যালকাটা?’
এইবার সোজা হয়ে বসে ভদ্রমহিলাকে অবলোকন করতেই হলো, যদি বলি কড়েয়া কি হরিদেবপুর, ইনি কি চিনবেন, অ্যাঁ? তাইলে এত কৌতূহল কিসের মাসিমা? যাগগে যাক, আমি চপটার খানিকটা মুখে দিয়ে সগর্বে বল্লুম, ‘লেকটাউন’, বলেই আমি ধাঁ,কা রণ চপটা হাকুচ মিষ্টি, অ্যাকচুয়ালি বড় নরমপাকের নারকেল নাড়ু,একগাদা গুড় দিয়ে বানানো, বাইরেটা বেসন দিয়ে ভেজে চপের আকার!!!