- বইয়ের নামঃ খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ
- লেখকের নামঃ অভীক সরকার
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ
কালিয়া মাসান
[দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু ঘুরতে গেছিল পুরুলিয়াতে। অরণ্যের মনােরম পরিবেশে হঠাৎ করে কোন ভয়ঙ্কর অভিশাপের বিষাক্ত ছােবল আছড়ে পড়ল তাদের মধ্যে? কলেজ স্ট্রিটের সেই রিকশাওয়ালাই বা কে, যার গা থেকে উড়ে আসে ছাইয়ের কণা? আজ থেকে দেড়শাে বছর আগে সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় কী ঘটেছিল এখানে? ছাইয়ের শরীর খুঁড়ে কে তুলে আনবে প্রতিষেধক রক্ত ?…কে বাঁচাবে অসুস্থ মেয়েটিকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে? ইতিহাস, রােমাঞ্চ, অলৌকিকের দুরন্ত মিশ্রণ কালিয়া মাসান।]
কৈফিয়ত
কালিয়া মাসানের ব্যাপারে আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন এক বন্ধু। অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে আড্ডা মারতে মারতে তিনি বলেছিলেন, মৃতদেহের ছাই মন্ত্রপূত করে তৈরি করা হয় ভয়ঙ্কর বিষ। এই নিয়ে কিছু একটা লেখার ইচ্ছে ছিলই। ফলে মায়াকানন পূজাবার্ষিকী-র সম্পাদক অর্ক পৈতণ্ডী যখন আমাকে একটি উপন্যাস লেখার অনুরোধ করেন, তখন আমি ভাবলাম কালিয়া মাসানই হোক সেই উপন্যাসের বিষয়। আরও ভেবেছিলাম যে একটি গল্প বলিয়ে চরিত্র তৈরি করব, যাঁর জবানীতে ঘটনাটা বলা হবে। তখনই দীপুপিসির কথা মাথায় আসে।
সব মিলিয়ে জন্ম নেয় কালিয়া মাসান। ২০১৮ সালের মায়াকানন পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় এই উপন্যাস এবং বেশ কিছু পাঠক তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসটি পড়ে আমাকে বেশ কিছু মূল্যবান উপদেশ দেন এবং বই আকারে বের করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই উপন্যাসটিই পরিমার্জিত হয়ে এই বইতে জায়গা পেয়েছে।
অভীক সরকার
রথযাত্রা ১৪২৬
কলকাতা
.
কালিয়া মাসান
খাতাটা ইনভিজিলেটরের হাতে তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক আশ্চর্য উল্লাস অনুভব করলাম।
আজ শেষ পেপার ছিল জিওগ্রাফির। খাতা জমা দিয়ে বাইরে এসে দেখি স্কুলের গেটের পাশের বুড়ো বটগাছটার নীচে সায়নী, অদ্রিজা, সায়ন্তন, কৌশিক, অতনু, আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে দেখেই হইহই করে উঠল সবাই।
আমিও চট করে সেই আড্ডায় শামিল হতে যাচ্ছি, এমন সময় ব্যাগের মধ্যে খড়ড়ড় করে মোবাইলটা আওয়াজ করে উঠলো। ফোনটা বার করে দেখি পলি, মানে আমার বোনের ফোন। কলটা অ্যাক্সেপ্ট করে ফোনটা কানে ঠেকাতেই যেন একটা গ্রেনেড ফেটে পড়ল কানের কাছে, ‘দাদা, এক্ষুনি বাড়ি চলে আয়, দীপুপিসি এসেছে।’
ব্যস, আর কিছু বলার দরকার ছিল না। আড্ডা গেল চুলোয়, আমি প্রায় উড়ে গিয়ে রহমান কাকুর রিকশায় ল্যান্ড করলাম। দীপুপিসি এবার প্রায় বছর দুয়েক পর আমাদের বাড়িতে এলেন। মানে গল্পের পুরো খনি নিয়ে এসেছেন পিসি! সমস্ত মন খারাপ মুহূর্তে উধাও!
এখানে দীপুপিসির পুরো পরিচয়টা দিয়ে রাখি। পিসির পুরো নাম দীপান্বিতা সরখেল। উনি কিন্তু আমার নিজের পিসি নন, বাবার কলেজের জুনিয়র। মানে বাবা যখন ফাইনাল ইয়ারে পড়তেন, দীপুপিসি সেই বছরই কলেজে ভর্তি হন। সেই সূত্রে আমরা সবাই দীপুপিসি বলে ডাকি। বাবা অবশ্য ইকোনমিক্সের লোক, দীপুপিসি জিওলজির। তবে অন্য স্ট্রিমের হলে কী হবে, দীপুপিসিও অধীরদা বলতে অজ্ঞান, আর বাবাও দীপুপিসিকে খুবই স্নেহ করেন। আর আমার মা তো বলতে গেলে দীপুপিসির বুজম ফ্রেন্ড!
অতএব এ-বাড়িতে মিস দীপান্বিতা সরখেলের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে কারও মনে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। পিসির বয়েস একচল্লিশ, হাইট পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি, আমার মতোই রোগা টিংটিঙে চেহারা, আর বয়েজকাট চুল। তবে দীপুপিসিকে দেখলেই যেটা সবার আগে নজরে পড়ে সেটা হল পিসির চোখদুটো। সবসময়ে কৌতুকে, ঔজ্জ্বল্যে, হাসিতে যেন হীরের টুকরোর মতো ঝকমক করছে। দীপুপিসি অবশ্য বছর বিশেক ধরে দেশের বাইরেই থাকেন। চাকরি সূত্রে একটা অয়েল এক্সপ্লোরেশন কম্পানির চিফ সায়েন্টিস্ট। পিসির বাংলায় কিন্তু এতদিন ধরে দেশের বাইরে থাকার কোনও ছাপই নেই। কথাবার্তা শুনলে মনে হয় উত্তর কলকাতার লোক, এক্ষুনি কলঘর থেকে নেয়ে এসে পান্তাভাত খেতে খেতে পাড়ার পুপুদি’র সঙ্গে গপ্প করছে!
পিসির আদত বাড়ি অবশ্য ভবানীপুরে। বছরের দশমাস পৃথিবীর নানা যায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে, এই এপ্রিল মে নাগাদ দুটো মাস কলকাতায় নিজের প্রাচীন পৈতৃক বাড়িতে থাকতে আসেন। এখানে এটা বলে রাখা ভালো যে দীপুপিসি বিয়ে শাদি করেননি, ফলে ছেলেমেয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
আগেই বলেছি, পিসি জিওলজিস্ট। কাজের সূত্রে অনেক বিচিত্র জায়গায় যেতে হয়েছে। অভিজ্ঞতাও হয়েছে প্রচুর। তারই দু-একটা পিসি মাঝেমধ্যে কালোজিরে-রসুন-পেঁয়াজ-আদাবাটা ইত্যাদি মাখিয়ে আমাদের শোনান। বাবা অবশ্য বলেন দীপুপিসি যা বলেন তার বেশিরভাগই গুল, পিসির উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কিন্তু পিসির গল্প বলার কায়দা এমনই চমৎকার, আর গল্পগুলোও এমনই রোমহর্ষক যে একবার শুনলেই পরের গল্পটা শোনার লোভে মনটা আঁকুপাঁকু করে।
বাড়ি এসে দেখলাম যা ভেবেছিলাম তার প্রায় দেড়া কেস। দীপুপিসি এসেছে শুনে পাশের ব্লক থেকে মিমি, সন্দীপন, অরিজিৎ, এরা সবাই এসে হাজির। আমাদের দোতলা বাড়ির ওপরের ফ্লোরটা একদম গমগম করছে মানুষজনে। মা তো হেবি খুশি, কাউকে খাওয়াতে পারলে মা আর কিচ্ছুটি চায় না। লুচিভাজার গন্ধ পাচ্ছি, পাশের ঘর থেকে বাবা টেলিফোনে চাপা গলায় কাউকে চিকেন কষার অর্ডার দিচ্ছে শুনলাম। লোকজন, হই হুল্লোড়, আড্ডা এসব আমার চিরকালই ফেভারিট। তার ওপর দীপুপিসি এসেছে মানে গল্পে আড্ডায় আজকের দিনটা পুরো জমজমাট।