এবং মার্কেট ভিজিট

 

উৎসর্গ
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের করকমলে।

লেখকের কথা

ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী তাঁর ”রোমন্থন” নামের অসামান্য আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনাটির শুরুতে লেখকের বক্তব্যের শীর্ষনাম দিয়েছিলেন ‘প্রারম্ভিক মুখব্যাদান’, যুক্তি ছিল মুখখোলাকে মুখবন্ধ বলা নিতান্তই অর্থহীন। প্রাজ্ঞ পণ্ডিতপ্রবর যে কথা বলে অনায়াসে পার পেয়ে গেলেন, এবং তাবৎ পাঠকেরা ”কেয়াবাৎ, বহোত খুব” বলে সোল্লাসে শাবাসি দিয়ে উঠলেন, এই অর্বাচীন সে কথা বললে অনেক রসিকজনই যে আমার মুখ বন্ধ রাখার পক্ষেই মত দেবেন এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

কিন্তু লেখককে কিছু কৈফিয়ত দাখিল করতেই হয়। যদিও প্রকাশক মশাই এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কয়েকটা পাতা ফালতু ফালতু নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু প্রথা। তাছাড়া জাতে বাঙাল, কথা কইবার সুজুক পাইসি, ছারুম ক্যান?

আমার লেখা বই বার হবে এ স্বপ্ন আমি কোনওদিন দেখিনি। বস্তুত লেখক হবার ইচ্ছে বা লেখক তকমাটির প্রতি মোহ, দুটির কোনওটিই আমার কখনো ছিল না, আজও নেই। আমি চাকরিজীবী ছাপোষা মধ্যবিত্ত। নিজের চাকরি,যৎসামান্য পড়াশোনা আর নিভৃত গৃহকোণটি নিয়ে ভারি সুখেই ছিলাম। এহেন দুর্মতি যে কখনও হবে তার কোনও পূর্বলক্ষণই ছিল না। ছোটবেলায় ভারি রুগ্ন ছিলাম বলে খেলাধূলায় বিশেষ সুবিধা করতে পারতাম না। সেই বয়সে বড়দের চোখরাঙানি তাও মেনে নেওয়া যায়, সমবয়সীদের টিটকিরি মেনে নেওয়া বড়ই দুঃসহ। ফলে আমাকে একটা নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিতে হয়। সেই জগতের একচ্ছত্র অধিপতি রাজা রায়চৌধুরী বলে একটা খোঁড়া লোক, সঙ্গী হিসেবে দুই দাদা, প্রদোষ মিত্র এবং ভজহরি মুখুজ্জে। সে জগতে ষষ্ঠীঠাকুরুন ধরা পড়ার ভয়ে ক্ষীরের পুতুলের বদলে একটি ষেটের বাছা দিয়ে যান, সে জগতে এক বাচ্চা রিপোর্টার আর তার পোষা কুকুর শেখায় যে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই সত্যিকারের সাহস। সেই জগতে আরও ছিল ভারি মিষ্টি কিছু ভূত, কবরে শুয়ে থাকা এক পাগলা সাহেব, পাতালঘরে এক্সপেরিমেন্ট করা এক বৈজ্ঞানিক, পুরোনো মায়াভরা কিছু গ্রামগঞ্জ যেখানে সদাসর্বদাই নানা মজার কাণ্ড ঘটে চলেছে।

আর এসবের মধ্যে ছিলেন গোল চশমা পরিহিত এক ভদ্রলোক, তাঁরই বানানো এক আশ্চর্য দুনিয়া নিয়ে।

সুকুমার রায়।

সেই নিজের বানানো জগৎ থেকে আজও পরিত্রাণ পাইনি, পাওয়ার যে খুব ইচ্ছে আছে তাও নয়। আমি পাঠক, পাঠক হিসেবেই ভারি তৃপ্ত ছিলাম।

এমন সময়ে, আমি তখন ঠিক কচিটি নই, চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছি, এমন সময়ে ফেসবুক নামের সোশ্যাল মিডিয়াটি এসে দুদিনের মধ্যে জনচিত্ত জয় করে বসলো। পোস্ট, স্টেটাস, লাইক, শেয়ার, এই বহুলপ্রচলিত শব্দগুলির সংজ্ঞাই গেলো বদলে।

সমাজজীবনে ফেসবুক আদি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার অভিঘাত নিয়ে ইতিমধ্যে গবেষণা চলছে, আরও নিশ্চয়ই চলবে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ফেসবুকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো আমরা যারা স্কুল ও কলেজ জীবনের পর বাংলা ভাষা পড়া বা লেখা ভুলেই গেছিলাম, তাদের ফের ফেসবুকের লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের দিকে টেনে আনা। আমার এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক এর নাম দিয়েছেন মুক্তগদ্য। বস্তুত ফেসবুকের দৌলতে এমন কিছু চমৎকার গদ্য বা পদ্য পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে যা আক্ষরিক অর্থেই মণিমুক্তোর সমান।

এমন সময় নিজেরও বাংলা অক্ষরে ফেসবুকে কিছু লেখার বাসনা দুর্মদ হয়ে ওঠে। কবে এবং ঠিক কি কারণে এই ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ আবেগটির উদ্ভব ঘটে, বলা মুশকিল। তবে মোটামুটি আজ থেকে বছরখানেক আগে হবে, যখন আমি প্রথম বাংলা অক্ষরে কিছু লিখি। ততদিনে আমি বেশকিছু সাহিত্যমূলক গ্রুপেও ঢুকেছিলাম। তাদেরই একটিতে অসীম সাহসে ভর করে আমি দুয়েকটি নিজস্ব অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করি। আমার এক প্রাচীনা বান্ধবী (না তিনি বয়সে প্রাচীনা নন, প্রাচীনকাল থেকে আমার বান্ধবী) ‘তুমি ঠিক যে ভাবে কথা বলো, সেভাবে লেখো’ গোছের পরামর্শ দেন। খুব সম্ভবত আমার আজন্মকালের ছ্যাবলামির ওপর তাঁর ঐকান্তিক আস্থা ছিল। আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম বেশ কিছু লোকজন পছন্দ করছেন। দু একজন গুরুস্থানীয় লোক উৎসাহ দিতে লাগলেন। ফলে এই উদ্বাস্তু গরীব বাঙাল উত্তেজনায় ফেটে পড়ে ‘যায় যদি জীবন চলে’ স্লোগান তুলে মহোৎসাহে লেখালেখি শুরু করে দিলেন!

আদতে আমি সেলসের লোক, দশ বছরের ওপর হলো এ লাইনে আছি। দেশ দেখেছি প্রচুর, লোক দেখেছি আরও বেশি। অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে, ভারতবর্ষ নামের এই ভূখণ্ডকে চিনেছি আরও নিবিড়ভাবে। সেসব অভিজ্ঞতাই এক এক করে ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’ গল্পের আকারে লেখার চেষ্টা করেছি বার বার। এছাড়াও কিছু ছোটগল্প, আমার শিশুকন্যার সঙ্গে আমার কিছু চিত্তাকর্ষক আলোচনাও রয়ে গেছে একইসঙ্গে।

তারপর বছরখানেক কেটে গেছে। নিজের টাইমলাইনে এবং বিভিন্ন গ্রুপে আজন্মসঞ্চিত ইয়ার্কি ফাজলামি গুলো লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করেই চলেছি। অনেকেই বাংলাসাহিত্যের কমলবনে এই মত্তমাতঙ্গের বালখিল্য বিচরণ দেখে শোকসাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন, অজ জাতীয় প্রাণীর পক্ষে হলকর্ষণ যে তেমন সুফলপ্রদ নহে, মিষ্টভাষে এ কথা বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন নি। এহ বাহ্য, যেসব মহাত্মনদের চিন্তা সদাসর্বদাই তূরীয়মার্গে বিচরণ করে, সেই তাঁরা এহেন অপরিসীম ঔদ্ধত্যের পেছনে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের কালো হাত দেখে চ্যাটরুমে চ্যাটচ্যাটে থিসিস অবধি নামিয়ে ফেলতে ছাড়েননি!

এসব দেখে ভারি দুঃখ হলো। মহাতপাঃ নবারুণ বাঙালি জাতিকে অসহায় ছাড়াও আরেকটি সুচিন্তিত এবং মনোহারী আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অধম অতি দ্রুত সেই আখ্যার সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে বেশি সময় নেন নি। ফলে যাবতীয় খেচর, উভচর এবং জলচর বাঙালির সার্বিক মঙ্গলার্থে ভাবলাম এসব লেখা একত্রে বই হিসেবে প্রকাশ করলে কেমন হয়? কয়েকজন বন্ধুবেশী শত্রু খুবই উৎসাহ দিতে থাকলেন, সেসব শুনে নিজেকে মুজতবা আলি কি নবনীতা দেবসেনের সমকক্ষই বোধ হতে লাগলো।

কিন্তু বই প্রকাশ করতে প্রকাশক দরকার, তদুপরি ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’র যুক্তি প্রকাশনা জগতে চলে না। আর তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকরা আমার মতন অর্বাচীনের বই ছাপাবেন, এহেন দুরাশা স্বপ্নেও করিনি। তবে এই দেখে আশা হয়েছিল যে কয়েকজন উৎসাহী যুবক বাংলা প্রকাশনা ব্যবসার মরা গাঙে তরী ভাসাতে রাজি হয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁদের নিবিড় আগ্রহ সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁদেরই একজন, দ্য কাফে টেবল-এর অরিজিৎ ভদ্র, যেদিন নিজে থেকে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন, যেদিনই ঝট করে মনে পড়ে গেছিলো কবিগুরু একবার বলেছিলেন বটে, প্রকাশকের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ!

যাই হোক অরিজিতবাবুর সৌভাগ্য অক্ষয় হোক, কলেজ স্ট্রীটের সামনে ওঁর মর্মরমূর্তি স্থাপিত হোক, এই নাদান বালকের প্রথম বইটি তাঁরই কৃপায় প্রকাশিত হয়েছিল, এ কথা জীবনান্তেও ভুলব না।

বইটি বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট থাকার পর দীপ প্রকাশনের কর্ণধার দীপ্তাংশু পুনঃপ্রকাশের জন্য বইটি চেয়ে বসলেন। আমি তাঁকে অনেক করে বোঝালাম যে এই বই আর বিক্রি হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। একে এসবের অধিকাংশই সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে লেখা, সেসব কাঁচা হাতের কলমবাজি দেখলে নিজেরই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। তাছাড়া বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে আছি যে চিন্তাশীল সারস্বত সমাজে কল্কে পাব। সেখানে বিভিন্ন তাৎপর্যসন্ধানী তত্বভুবনে আশ্চর্য স্বকীয়তায় ঋদ্ধ বিশ্লেষণপদ্ধতি এবং তৎসন্নিহিত মগ্নচৈতন্যে নিবিষ্ট বীক্ষাভুবন- এসব গুরু গম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে। সেই থেকে নিজের কথাবার্তায় ভাবভঙ্গিতে একটা উদাস ইন্টেলেকচুয়াল ভাব আনার চেষ্টায় আছি। সেখানে এসব সস্তা ছ্যাবলামি করলে ব্র্যাইন্ড ভ্যালু লিক করে যাবে না?

কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই শুনলেন না, রাতবিরেতে ফোন করে খুব কড়া গলায় শাসাতে লাগলেন। ফলে ”তোমার ভুবনে মা’গো এত চাপ” ইত্যাদি ভেবেটেবে মাভৈঃ বলে পাণ্ডুলিপিখান পাঠাতেই হল।

যাই হোক, অলমিতি বিস্তারেণ। অনেক প্যাচাল পাড়ার পর আপাতত এখানেই এই মনোলগ শেষ করলাম। আশা করি সুধী জনগণ বইটা বুকে তুলে নেবেন, বুকে না নিয়ে অন্ততপক্ষে হাতে তুলে নিলেও হবে। ভালো লাগলে জানাবেন, আর খারাপ লাগলে অতি অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকবেন, ঠাণ্ডা লাগাবেন না, দেখে রাস্তা পার হবেন আর হ্যাঁ, পরের বার মার্কেটে গেলে অধমের কথা মনে করতে ভুলবেন না কিন্তু!

 

 

 

 

 

 

 

 

কিপটে

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই একটু ফিক করে হেসে ফেললেন প্রিয়নাথ সান্যাল।

সকালটা ভারী চমৎকার আজকে। ঝিরিঝিরি প্রসন্ন বাতাস বইছে চারিপাশে। পোষা নেড়ি মিষ্টি দরজার কাছে ভারি মনোরম ভাবে শুয়ে। নরম মিঠে রোদ চারিপাশে মিহি গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে আছে।

ভারী অলস ভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙলেন প্রিয়নাথ, সংগে একটা খুব তৃপ্তির হাই।

কাল খুব জোর বাঁচা গেছেন উনি। প্রায় সারাদিন ধরে ছোটবোন সুবর্ণা এসে হাতে পায়ে ধরে সে কি কান্নাকাটি। কি না, ওর একমাত্তর ছেলে, শিবরাত্তিরের সলতে, তার কিডনি পাল্টানো হবে, আর তার জন্যে লাখ চারেক টাকা চাই।

শুনেই তো প্রিয়নাথের আত্মারাম খাঁচাছাড়া। একটা দুটো টাকা নয়, চার চার লাখ? বলি চারের পর কতগুলো শূন্য হয় কোন আন্দাজ আছে তোর?

এই যে তুই কারুক্কে না বলে বেজাতের ওই ছোকরা মাস্টার কে বিয়ে করে ভাগলবা হলি, এতো বড় কেলেঙ্কারি বাপ মায়ের মাথায় চাপিয়ে, বলি আমার ভরসায় করেছিলি? আর সে বাবুও যে স্কুলে টুকলি আটকাতে গিয়ে পটলোত্তলন করলো বিয়ের বছর তিনেকের মধ্যেই সেটা কি আমার সংগে কন্সাল্ট করে করেছিল নাকি র‌্যা? এখন যদি দুদিনের মধ্যে অপারেশন না করলে ছোকরা ফুড়ুৎ হয়, তবে সেটা কোন আইনে আমার দায়িত্ব হিসেবে বর্তায় শুনি?

ভাবতেই গা টা রি রি করে ওঠে প্রিয়নাথের। চাআআআর লাআআআখ টাকা! মামদোবাজি, নাকি? নাকি উনি কি দানছত্তর খুলে বসেছেন ? বলি সবাই ভেবেছেটা কি অ্যাঁ? হুঁঃ, কার কোথায় কে ছেলে মরছে, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কার পড়াশুনা হচ্ছে না, কোন ভিখিরির ছেলের ক্যান্সার, সবার জন্যেই শালা ওনার পেছন খুলে দিতে হবে নাকি,যত্তসব।

শেষে সুবর্ণা মাথা নিচু করে জলভরা চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন প্রিয়নাথ। উফফ, কি কষ্টেই টাকাগুলো বাঁচাতে পেরেছেন উনি। আজ বড় সুখের সকাল!

আনন্দে একটু ফিক করে হেসেই ফেললেন এলাকার ডাকসাইটে কিপটে প্রিয়নাথ সান্যাল। অবশ্য উনি নিজেকে কিপটে বলেন না, বলেন হিসেবী। বছর পাঁচেক বাদে বাদে হাওড়ার মঙ্গলা হাট থেকে জামাকাপড় হিসেব করেই কেনেন,সুবিধা এই যে প্যান্ট, বিছানার চাদর আর দরজার পর্দা একইসঙ্গে হয়ে যায়। তবে খাওয়ার শখটা পুরোমাত্রায় বজায় রেখেছেন উনি, সে স্বীকার করতে ওনার সমালোচকরা বাধ্য, মাছ তো দুহপ্তায় একদিন খাওয়া হয়ই। উনিশ ”বছর আগে কেনা সেকেন্ড হ্যান্ডে কেনা টিভিটার অবস্থা যদিও কহতব্য নয়, ক্যাটরিনা ক্যাইফ কে গোবিন্দার মতন দেখায়, হাশিম আমলাকে উসেইন বোল্ট। তবে ঘোরাঘুরি কিন্তু লেগেই আছে। এই তো বছর পাঁচেক আগে মন উচাটন হওয়াতে ডানলপ থেকে দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গেছিলেন,পুরো তিরিশ টাকা খরচা করে! সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে? আরো যদি ওঁর বাড়িতে অন্ধকার থাকা নিয়ে কথা ওঠেই, তবে জেনে রাখা ভালো যে ইলেক্ট্রিক আলোতে ওনার মাথা ধরে, খুব দরকার ছাড়া আলো জ্বালান না, মোদ্দা কথা অকারণে কাউকে হতচ্ছেদ্দা করাটা ঠিক না। রাতের দিকটা আলো বলতে মোমবাতিই ভরসা বটে, তবে তাতে আরেকটা সুবিধা যে রাত্তিরে আলো আঁধারিতে শুধু গামছা পড়ে থাকলেই চলে। আর দাড়ি কামানোর পর বুরুশের সাবান ফেনা দিয়ে যদি উনি স্নান করেনই, তাতে কার কি হে? হপ্তায় একদিন সাবান আর শ্যাম্পু না করলে কি মান থাকে রে ভাই? এক খরচায় তিনটে কাজই হয়ে যায়, দাড়ি, শ্যাম্পু আর সাবান, হপ্তায় একদিন।

এই এতো এতো খরচাপাতির পর যদি কেউ বেমক্কা চাআআআর লাখ টাকা চেয়ে বসে, কার মাথা ঠিক থাকে দাদা, আপনিই বলুন?

উফফ, পরশুই ব্যাংকে গিয়ে দেখে এসেছেন মাত্তর সাতানব্বই লাখের মতন জমেছে,গরীবের বুকের রক্ত জল করে জমানো খুদকুঁড়ো বললেই চলে, তার থেকে বুকের পাঁজর খসানো চার চারটে লাখ টাকা, মা গো, স্রেফ দান করে দেওয়া?

মা ত্তারা ব্রহ্মময়ী, মা গো, তুমিই বাঁচিয়েছ মা!

চোখ বুজে হাত জোড় করে একটা প্রণামই ঠুকে দিলেন প্রিয়নাথ। তারপর চোখ খুলেই হাঁ।

ঠিক ওনার সামনে চেয়ারে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। ফর্সা গায়ের রঙ, কেঁকড়ানো চুল, রোগা দোহারা শরীর। ভারি মিষ্টি দেখতে। চোখে একটু দুষ্টুদুষ্টু ভাব, নিখুঁত করে কামানো গোঁফদাড়ি। চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে হাত তুলে নমস্কার করলেন ভদ্রলোক, ‘গুড মর্নিং প্রিয়নাথ বাবু। কেমন আছেন?’

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মিনিট তিনেক হাঁ করে ছিলেন প্রিয়নাথ, পরে খেয়াল হতে সন্তর্পণে মুখটা বুজিয়ে নেন, স্খলিত ন্ট্রে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কে মশাই? ঘরে ঢুকলেন কি করে?’

একটু অপ্রস্তুত হলেন বোধহয় ভদ্রলোক। গলা খাঁকড়ে বলেন ‘ইয়ে হঠাৎ এইভাবে এসে পরেছি বলে সরি স্যার। কিন্তু না এসে উপায়ান্তর ছিলো না বলেই, মানে খুব বাধ্য হয়েই আর কি, হেঁ হেঁ’।

‘হেঁ হেঁ মানে? বলি এটা কি মশাই ধর্মশালা না আপনার তালুইমশাইএর বৈঠকখানা? কোন আক্কেলে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়লেন মসাই? চুরি ডাকাতির মতলব নাকি?’

‘অ্যাঁ? আরে ছিছিছি….রামো রামো, কি বলছেন মশাই? একটু না বাড়িতে ঢুকেই পড়েছি, তাবলে একেবারে চোর জোচ্চর ভেবে বসলেন? বলি ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই একটা আমার?’

‘ইঃ, ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির এয়েচেন রে। এই সাতসকালে চুপিসাড়ে টুকটুক করে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়ার মানেটা কি অ্যাঁ? পুলিশ ডাকবো নাকি দাদা?’

ভদ্রলোক পুরো কেতরে উঠলেন ‘ প্লিজ পুলিশ ডাকবেন না, কিছুতেই না, ন্না ন্না ন্না’।

খুবই সতর্ক হলেন প্রিয়নাথ। রোগাভোগা শরীর, ঝাঁপিয়ে পড়লে মনে হয় কবজা করতে বেশি অসুবিধা হবে না। বন্দুক ফন্দুক নিয়ে আসে নি তো আবার? মাওবাদী কি সন্ত্রাসবাদী নয় তো? ওদের নাকি অসাধ্য কিছু নেই, যেখানে পারছে ঢুকে বন্দুকফন্দুক চালিয়ে, খুনখারাপি করে, সে একাকার কাণ্ড…

গলা খাঁকড়ে নেন উনি, সন্দেহজনক কারও সামনে যে বসে আছেন সে নিয়ে কোন সন্দেহই নেই, মাওবাদীও হতে পারে, বা পাকিস্তানের এজেন্ট। ছদ্মবেশী বারাক ওবামা হলেই বা আটকাচ্ছে কে? খুবই সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করেন,’ ঝেড়ে কাসুন তো মশাই। বলি মতলবটা কি? আমার বাড়িতে কিন্তু একটা ফুটো কড়িও পাবেন না, আগে ভাগে বলে রাখলুম। বরং একটা ছেঁড়া গামছা আছে, সতের বছরের আগে কিনেছিলুম, অ্যান্টিক হিসেবে ভ্যালু কম নয়, সেইটে দিতে পারি, নিয়ে মানে মানে বিদায় হন দিকিন’।

ভদ্রলোক একবারে হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘আরে ন্না ন্না, ছি ছি, আমাকে ইয়ে ভেবেছেন নাকি? ছ্যা ছ্যা’ তারপর ঘাড়নাড়া থামিয়ে খুবই লজ্জিত ভাবে মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে থাকেন ও ভারি মৃদুস্বরে বলেন ‘ দেখুন ব্যাপারটা বলতে আমার খারাপই লাগছে, কিন্তু কি করি বলুন তো, এদিকে না বললেই নয়। আপনি কিন্তু স্যর কথা দিন কিছু মাইন্ড করবেন না প্লিজ’।

‘দেকুন ন্যাকা মেনিমুখো ম্যাদামারা লোকজন আমার মোটে পচ্ছন্দ নয়। বাঙালি কবিদের এইরকম অম্বলে ভোগা পেটরোগা ম্যাদামারা ন্যাকাপনা থাকে। তা মশাই কি কবি নাকি?’

‘আরে ধুর। লজ্জা দেবেন না। সে বলতে গেলে একবার দুবার ছোটবেলায় লিখেছিলাম বটে, শুনবেন নাকি দুটো লাইন?’

এই বলেই ভদ্রলোক উদাস ভঙ্গিমায় খুবই দরদ দিয়ে আবৃত্তি করতে থাকেন, বেশ হাত পা খেলিয়ে, পয়ার ছন্দে,

‘পাতায় পাতায় ঝড়ে নিশার শিশির/ তাতে কি বা যায় আসে আমার পিসির।

স্কুলে যেতে ভয় করে শীত ও সামার/ সুযোগ পেলেই যাই বাড়িতে মামার।

(সেথা) আচার পাহারা দেয় রামন মিশির/

নিশীথে বানানো আচার আমার পিসির।’

কি ভাব! কি ভাষা!! খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন প্রিয়নাথ, চোখে জল। তারপর লুঙ্গির খুঁট তুলে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন ‘ আহা, আহা, বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো। মশাই যে বেশ নামজাদা কেউকেটা একজন তা পষ্ট বুজতে পারচি। সেই মাইকেল কি নবীন সেন, তারপর এই আপনি। বলি পরের বছরকার নোবেলের দিকে তাগ করচেন নাকি? জমিয়ে করুন দিকিন, দেখবেন যেন ফস্কে না যায়, হেঁ হেঁ। তা এমন গণ্যমান্য ব্যাক্তিটি সক্কাল সক্কাল আমার কাচে যে? আর তাছাড়া মহাশয়ের নামখানি যে বলতে হচ্চে যে এবার। কি করা হয় মহাশয়ের? থাকেন কোথায়? জোড়াসাঁকোর দিকে নয় তো? হ্যা হ্যা হ্যা’।

‘ইয়ে, আমি একজন লোকপাল স্যার। সাউথ থেকে আসছি’

‘লোকপাল?মানে লোকপাল বিল? সে কি পার্লানেন্টে পাস হয়েচে নাকি? যাঃ জানতে পারলুন না যে? টিভিটাও মাইরি…. খবর শোনাচ্ছে না অর্শের বিজ্ঞাপন, বোঝাই যায় না। আর সাউথ থেকে মানে? গড়িয়া না ব্যায়লা?’

‘আরে না না সাউথ, মানে একদম সাউথ’

‘সে কি? এমন চমৎকার ঝরঝরে মিঠে শান্তিপুরী বাঙলা বলছেন যে?’

‘আরে লজ্জা দেবেন না স্যার, আমি এমনিতেও খুবই লাজুক মানুষ, হেঁ হেঁ।’

‘বাঃ বাঃ। আই অ্যাম ভেরি ইম্প্রেসড ইয়াং ম্যান। এই বয়েসেই অত ওপরে উঠেচ, পার্লামেন্টারি ব্যাপারে আচো, অন্য ভাষাও এত চমৎকার বলচ, অথচ এত বিনয়। গুড গুড, এই দ্যাকো, আবার তুমি বলে ফেল্লুম। কিচু মনে কোর না বাপু, বয়সে ছোটই হবে আমার থেকে, কি বল?’

‘আরে সে তো বটেই, সে তো বটেই, হেঁ হেঁ।’

‘তা বাপু নাম গোত্তর কিচু বল। আমরাও ভারি সাউথ ইন্ডিয়ানদের ইয়ে করি, বুজলে। কি কালচারাল ইয়ে, আর কি ফটাফট ইংরেজি, আদ্দেক তো বুজতেই পারি না, হেঁ হেঁ। এই তো পাশের ফ্ল্যাটে রঙ্গনাথনদা থাকেন। ভারি মাই ডিয়ার লোক। এই তো ইচ্ছে আছে এই ডিসেম্বরেই একবার ওদিকে..’

‘আজ্ঞে আমার নাম কৃতান্তকুমার আদিত্য’, ভারি বিনয় সহকারে বলেন ভদ্রলোকটি।

‘বাহ বাহ। একটু সেকেলে বটে, তবে কিনা চমৎকার। বুঝলে বাবা, আমরা তো পুরোন যুগের লোক, আমাদের এই রকম নামই পচুন্দ। বাহ বাহ। তা আমাদের ইস্কুলে পড়াতেন অরূপ আদিত্য, হাওড়ার প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়, তা তেনার কেউ হও নাকি? না বলচ? তা বেস। তা বাবাজীবন এয়েচ কি করতে সেটা তো খোলসা করে বলতে হচ্চে এবার।’

একটু গলাটা খাঁকড়ে নেন কৃতান্তবাবু, তারপর খুবই মিষ্টি হাসিমুখে বলেন ‘এবার একটু উঠতে হচ্ছে যে স্যার। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’

মুহূর্তে চনমনে হয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ। নেমন্তন্ন নাকি? অথবা কাঙালিভোজন? নাকি হরিসংকীর্তন? নাকি কোন সভাসমিতি? ও হো, এ সেই ‘নিখিল বংগ কৃপণচূড়ামণি সমিতি’র সংবর্ধনা নয় তো?

যাক, একবেলার খাবার খরচটা বেঁচে যাচ্ছে তাহলে!! যদিও মুখে একটু বিব্রতভাব বজায় রাখেন,

‘সে কি? কোতায়? এই সক্কাল সক্কাল? ধুর বাপু হুট করলেই যাওয়া যায় নাকি? বলি একটা সময় বলে তো বস্তু আচে না কি? আমার যে আরও দশটা কাজ আচে বলি সে কথাটাও তো ভাবতে লাগে?’

‘ইয়ে, বলছিলাম কি স্যর, এইটাই আপনার সময় ঠিক হয়েছে। একটু কষ্ট করে গা তুলতে হচ্ছে যে স্যর।’

‘মানে, এসব কি ভাই? না গেলে কি করবে?’ একটু ঘাবড়েই যান প্রিয়নাথ।

‘না গিয়ে আপনার একদম উপায় নেই স্যর। সত্যি বলছি।’ কথাগুলো কাতর অনুনয়ের মতই শোনায়।

‘দ্যাখো বাপু, ইয়ে জ্বালিও না বেশি। আমি তোমাকে ইনভাইট করে আনিনি একটুও। তুমি এখন যেতে পারো। দুগগা দুগগা।’ বিরক্তিসহকারেই বলেন প্রিয়নাথবাবু।

একটু ম্লান হাসেন আগন্তুক, ‘আমাকে কেউ ইনভাইট করে না স্যর। আমি বিনা ইনভিটেশনেই আসি। এসে বরং আমিই ইনভাইট করি’।

প্রিয়নাথ এতক্ষণ যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছিলেন। শেষ কথাটা শুনে ধন্দে পড়ে গেলেন। ছোকরা চায় কি?

‘তোমার কতা কিচুই বুঝছি না হে?’

‘কেন? এই সহজ জলবত্তরং কথাটা পাকা মাথায় খেলছে কেন বলুন তো? ‘

খানিকক্ষণ ভ্রুকুটিকুটিল চোখে চেয়ে রইলেন প্রিয়নাথ। সকাল সকাল মশকরা ওনার মোটে পছন্দ না। কিন্তু কি একটা কথা মনের ওপর ঘাই মেরে উঠতে চাইছে, উনি ধরি ধরি করেও ধরতে পারছেন না।

তরিৎগতিতে সোজা হয়ে উঠে বসলেন উনি, ‘নামটা কি বললে আরেকবার বলতো বাপু’।

বিনয়ে প্রায় ঘাড় বেঁকে গেলো ভদ্রলোকের, ‘আজ্ঞে, কৃতান্তকুমার আদিত্য। ডাকনাম একটা আছে অবশ্য, তবে কিনা এই নামটাই ভেবেচিন্তে…… ‘

থরহরি কেঁপে উঠলেন প্রিয়নাথ,

‘আ আ আ আপনি মানে.. আ আ আপনি ‘

‘এই দ্যাখো, আবার আপনি আজ্ঞে কেন? তুমিটাই তো দিব্যি মিষ্টি শোনাচ্ছিল’।

‘প্রভু, প্রভু, ক্কি সৌভাগ্য। আপনি…

‘সে কি স্যর, সৌভাগ্য কি বলছেন? আমাকে দেখলেই তো বেশিরভাগ লোক কেঁ কেঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আপনার কিন্তু স্যর, সাহস হ্যাজ, মানতেই হবে। এখনো টসকান নি, এ বড় সহজ কথা নয় কিন্তু। মাইরি বলছি’।

প্রিয়নাথ সোজা বুটপদ্মে উপুড় হয়ে পড়েন, ‘দয়া প্রভু, দয়া করুন।’

‘এই দ্যাখো। দয়া করার আমি কে? আর দয়া করার আছে টাই বা কি?’ প্রিয়নাথ কে ধরে সস্নেহে বিছানায় বসিয়ে দেন উনি ‘ইউ হ্যাড আ লং ফুলফিলিং লাইফ। এখন দিব্যি হাসতে হাসতে আপনার তো টা টা বাই বাই করার কথা। নিন, ঝটপট রেডি হয়ে পড়ুন তো’।

ককিয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ, ‘ফুলফিলিং লাইফ? কি বলছেন প্রভু? সারা জীবন ভালো খাইনি, পড়িনি। কোত্থাও ঘুরতে যাইনি, আনন্দ করিনি। কিসের ফুলফিলিং লাইফ প্রভু ?’

ফেঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালেন আগন্তুক,শিকনিটা জামার হাতায় মুছে ফেলেন, ‘তা সেগুলো করতে কি কেউ বারণ করেছিল স্যার? কি বলি বলুন তো? ইচ্ছে কি আমারই করে স্যর এইসব করতে। কিন্তু ডায়রি তে যে লেখা আজই আপনার দিন। অর্ডার এসে গেছে স্যর। নিন উঠে পড়ুন। মন দুর্বল করে ফেলাটা কোন কাজের কথা নয়। ওতে শ্লেষ্মা, পিত্তবিকার, উদুরি, অম্লশূল, এসবের ঝামেলা থাকে। রেডি হয়ে নিন স্যর। চুলটা আঁচড়ে নেবেন নাকি? নাকি থাক? বেশ একটা ক্যাজুয়াল বিউটি হাবভাব নিয়েই যাবেন? তাহলে তাই চলুন স্যর,এগোন যাক? ‘

‘কোন চান্স নেই প্রভু? কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না?’

‘কি যে বলেন। এ কি রাজধানী এক্সপ্রেসের রিজার্ভেশন নাকি, যে মিনিস্টার কোটায় একটা ব্যবস্থা করে দেবো?’

‘কিছু একটা করুন স্যর। এতদিন ধরে এত্ত কষ্ট করলাম, কিচ্ছু ভোগ করতে পারবো না?’

‘উমম, না ই তো মনে হচ্ছে’।

‘ইয়ে, প্রভু, শুনুন না। বলি সাতানব্বইয়ের হাফ কত হয়।’

‘এইটে কি অংক কষার সময় স্যার? ক্যালকুলেটরটাও হারামজাদা চিতু ঝেঁপে দিয়েছে লাস্ট উইক, কিন্তু জেনে হবেটাই বা কি?’

‘আমি বলছি প্রভু, উনপঞ্চাশের একটু কম। ওই পুরোপুরি উনপঞ্চাশই ধরুননা।’

‘ধরলুম। তো? ‘

‘বলছি কি, পুরো উনপঞ্চাশই, না পাকাপাকি পঞ্চাশই আপনার প্রভু। কড়কড়ে হার্ড ক্যাশ, আধঘণ্টার মধ্যে গরমাগরম… খিড়কি দরজা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ুন, কেউ জানবেও না যে আপনি এসেছিলেন। প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখবেন একটু’।

যমরাজ পাক্কা এক মিনিটের জন্যে বিঘতখানেক হাঁ করে চেয়ে রইলেন, তারপর কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছে হাঁ টা বুজিয়ে স্খলিতস্বরে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে ঘুষ দিচ্ছেন নাকি স্যর?’

‘আ হা হা, ঘুষ কেন হবে? প্রণামী বলুন স্যর। এই যে ঠাকুর দেবতা দেখলেই আট আনা এক টাকা করে দানবক্সে ফেলতুম, সে কি ঘুষ প্রভু? এইটে বরং আপনাকে সরাসরি দিচ্ছি। আপনিও হ্যাপি, আমিও হ্যাপি।’

উদাস হয়ে পড়েন যমরাজ ‘কি আর বলবো স্যর। আপনি বোধহয় এখনো আমাদের অপারেটিং মডেলটা বুঝে উঠতে পারেন নি। আমাদের ওদিকে ভিজিলেন্সও যেমন হারামি, অডিটও তেমনই ত্যাঁদড়। আমারই কি ইচ্ছে করে না একটু ভালোমন্দ খেয়ে পড়ে থাকতে?’ ধরে আসা গলাটা খাঁকড়ে পরিষ্কার করে নেন যমরাজ, ‘ আপনি বরং উঠুন স্যর, আমার আরো দুটো কাজ আছে আজ, ইশশ, বড্ড লেট হয়ে গেলাম।’

‘প্রভু প্রভু, জাস্ট একটি বছর’

‘উঁহু’

‘একটা মাস অন্তত দিন’।

‘নাঃ’

‘ এক সপ্তাহ?’

‘স্যর, এ কি কোলাঘাটের ইলিশ?’

‘লাস্ট প্রভু, একটা দিন, জাস্ট একটা দিন, তারপর হাসি মুখে’

‘বেকার সময় নষ্ট করছেন স্যর। চটি পরেই যাবেন বলছেন? চলুন তাহলে, দুগগা দুগগা।’

‘একটা মিনিট প্রভু, প্লিজ প্লিজ’।

‘উফফ, বড্ড জ্বালান মশাই। নিন উঠুন’, এই বলে যমরাজ একটা হাত দিয়ে ওনার ঘাড়ে ধরতেই জ্ঞান হারালেন প্রিয়নাথ বাবু।

***************

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন প্রিয়নাথ। সকালে তীব্র আলোয় চোখটা কুঁচকে গেলো। সারা গা ঘামে ভিজে জবজব করছে।

স্থির হয়ে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।

স্বপ্নটা যদি সত্যিই হত? সত্যিকারের সত্যি হত? সত্যিই যদি কোনমুহুর্তে ডাক এসে যায় বিনা নোটিশে একদিন, তখন কি করবেন প্রিয়নাথ এই ঐশ্বর্য নিয়ে?

আর যার নোটিশ এসে গেছে আগে থেকে? ঢাক ঢোল বাজিয়ে? এবং যে নোটিশ ফিরিয়ে দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা প্রিয়নাথ রাখেন, তার বেলা?

মনে হল কেউ যেন জীবনের দাবাখেলায় একটা কিস্তিমাতের চাল চেলে দিয়ে কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করছে প্রিয়নাথের হাবভাব, ঠেঁটের কোণে একটা বিদ্রূপের হাসি ঝুলিয়ে, যেন জিজ্ঞাসা করছে, ”এবার কি করবে প্রিয়নাথ, এবার?”

উঠে দ্রুত নিজের আলমারি হাঁটকাতে থাকেন উনি,আহ চেকবইটা কোথায় গেলো?

কোথায় যেন ভর্তি আছে সুবর্নার ছেলে? আহ,নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। এখানেই কাগজের টুকরোটা রেখেছিলেন না?

পাগলের মতন সবকিছু ওলটপালট করে খুঁজতে থাকেন প্রিয়নাথ। দাবার চালটাকে পালটা ফিরিয়ে দেওয়া খুব জরুরি।

এক্ষুণি।।

 

ডিলেমা

বিপিন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না!

অথচ অফার লেটারটা হাতে পেয়ে কিন্তু বিপিন ভারি খুশিই হয়েছিল। সে কথা বিপিনের স্পষ্ট মনে আছে।

নাহ, গল্পটা প্রথম থেকেই খুলে বলি।

বিপিন, বিপিনচন্দ্র শাসমল আমাদের কলেজে পড়তো। ছেলে হিসেবে চমৎকার, দিলদার বন্ধুঅন্তপ্রাণ। শুধু মা সরস্বতীর সঙ্গে পার্মানেন্ট ফৌজদারি মামলা এই আর কি! তা মা শেষতক সামান্য আড়চোখে কৃপাদৃষ্টিপাত করাতে ছোকরা পাশটাশ করে ভারি খুশি হয়ে আমাদের একদিন খাইয়ে দিল। উঃ, সে কথা মনে পড়লে এখনো জলে জিভ আর কৃতজ্ঞতায় হৃদয় আর্দ হয়ে ওঠে!

যাগগে। বিপিন কলেজ পাশ করে ঢুকলো সেলসের চাকরিতে। তারপর যা হয়, একদিন বিয়েও করে ফেলল বাড়ির কথামত।

টুকটাক করে মন্দ কাটছিল না। শুধু তখনো ছেলেপিলে না হওয়াতে একটু মরমে মরে থাকতো এই আর কি। আমরা বন্ধুরা অবিশ্যি উৎসাহ দিতাম, ‘ এমনি এমনি কি এসব হয় রে পাগলা, এর জন্যে কঠোর পরিশ্রম লাগে, দিনরাত মেহনত করতে হয়’। মুশকিল এই যে আমাদের কথামত দিনরাত মেহনত করতে গেলে বিপিনকে খাবারদাবার ছেড়ে শুধু ইয়াকুতি হালুয়ার ওপরেই থাকতে হয়, খুব স্বাভাবিক কারণেই সেটা শোভনও না সম্ভবও না।

যাই হোক, এদিকওদিক টুকটাক ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে একদিন বিপিন দেখলো, ইয়া আল্লা, মার দিয়া কেল্লা!! খোদ হিন্দুস্থান লিভারে চাকরির অফার! ভালো মাইনে, প্রচুর পার্কস ইত্যাদি ইত্যাদি। নাচতে নাচতে বিপিন পুরোন কম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে অ্যাক্সেপ্টেন্স লেটার পাঠিয়ে আমাদের অলিপাবে বেধড়ক মাল খাওয়ালো। আমরাও যাবতীয় ঈর্ষা বুকে চেপে ‘হেঁ হেঁ, ইউনিলিভার খুউপ ভালো কম্পানি। তেরা তো লাইফ বন গ্যায়া ইয়ার’ ইত্যাদি বলে চোখ, এমন কি কপাল অবধি মাল খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরলুম।

সব গল্প প্রায় শেষ, শুধু মেডিকেল টেস্টটাই বাকি, এমন সময়ে বিপনে পুরো ঘেঁটে গেলো!

মেডিকেল টেস্টের জন্যে অ্যাপোলো থেকে বাড়ি এসে ব্লাড, ইউরিন সব নিয়ে গেছিল। তার পরদিন বাকি টেস্টগুলোর জন্যে হাসপাতালে গেছে, ডাক্তারবাবু নাম শুনেই বিপিনকে বগলদাবা করে সোওওজা নিজের কেবিনে!

‘ক্কি ব্যাপার স্যার?’, বিপিন ভারি আকুল হয়ে শুধোলে।

ডাক্তারবাবু টেস্টের রিপোর্ট পড়তে পড়তে আধখানা রিডিং গ্লাসের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন ‘দিনে কত পেগ হয়?’।

বিপিন ‘ন্না ন্না স্যার, হরলিক্স আর চন্নামেত্ত ছাড়া আর কিচ্চু খাইনা, মাইরি বলছি’ বলতে যাচ্ছিল, শেষে ডাক্তারবাবু খুনে দৃষ্টিতে তাকাতে মিউমিউ করে বলল, ‘ওই আ-আড়াই থেকে তিন পেগ স্যার’।

ডাক্তারবাবু হিমশীতল গলায় বললেন ‘ক্রিয়েটিনিন, ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল তিনটেই মাথা উঁচু করে দেখতে হচ্ছে যে মশাই, টঙে চড়ে বসে আছে যে। কিন্তু যেটা ভয়ের কথা, সেটা হচ্ছে যে ইউরিনে প্রোটিন পাওয়া গেছে’।

খুব খুশি হল বিপিন, ‘সে তো খুউউপ ভালো কথা স্যার, মানে আমার শরীরে হেবি প্রোটিন আচে, নয়?’

ডাক্তারবাবু পেপারওয়েটটা তুলে নিয়েছিলেন খুব সম্ভবত ছুঁড়ে মারবেন বলে। কি মনে হতে সেটা রেখে বললেন, ‘না, নয়। এর মানে আপনার কিডনি ঠিকঠাক কাজ করছে না। এমত অবস্থায় ট্রিটমেন্ট না করিয়ে তো আমি আপনাকে ফিট সার্টিফিকেট দিতে পারছি না মশাই’!!

বিপিন খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে হাঁউমাউ জুড়ে দিল। অলরেডি আগের কম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছে। এখন এই তুচ্ছ কারণে যদি এইটা হাতছাড়া হয়,ফ্যামিলি নিয়ে পথে বসা ছাড়া বিপিনের আর কি উপায় আছে,সেটা ক্ষমাঘেন্না করে ডাক্তারবাবুই বলে দিন না হয়!

যা হোক, ডাক্তারবাবু বললেন যে সক্কাল সক্কাল ইউরিন নেওয়া হয়েছিল বলে হয়তো একটুখানি প্রোটিন ঘুমচোখে পথ ভুলে ধাঁ করে এসে পড়েছিল। উনি আরেকবার সুযোগ দেবেন। কাল সকালে আরেকবার ইউরিন স্যাম্পল নিতে লোক যাবে। বিপিন যেন খুব করে জলটল খেয়ে ঘুমোতে যায়, ইত্যাদি নানা সদুপদেশ দিয়ে রেহাই দিলেন।

তা সেদিন বিকেলে ঘটনাচক্রে একটু অলিপাবে গেছি গলা ভেজাতে, গিয়ে দেখি সে মক্কেল তুম্বোপানা মুখ করে এক কোণে বসে আছে। গিয়ে পিঠ চাপড়ে বল্লুম ‘কি বে, হাঁড়িপানা মুখ করে বসে আছিস যে বড়? বউ বকেছে?’ বলতেই সে ছোকরা ভেউভেউ করে উঠলো। সে কি কেলেঙ্কারি! কি বলে কিছুই বোঝা যায় না। শেষে জলটল খাইয়ে একটু ঠান্ডা করাতে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল।

আমি অবাক হয়ে বল্লুম, ‘এ আর এমন কি ব্যাপার? কাল সকালে ইউরিন নিতে এলে বউয়েরটা দিয়ে দিস। ওরা তো আর দেখতে যাচ্ছে না টয়লেটে কে যাচ্ছে!’

ছোকরা পাক্কা আড়াই মিনিট হাঁ করে চেয়ে রইলো। তারপর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চুমুটুমু খেয়ে একাকার কান্ড! আমার বিলটাও জোরজার করে ওইই দিল, আমি আর না করতে পারলুম না!

যাই হোক। পরামর্শ মেনে সমস্ত কাজকম্ম সুসম্পন্ন করে, পরের দিন হাসিমুখে বিপিন গেছে অ্যাপোলোতে, রিপোর্ট নিয়ে নতুন অফিসে সাবমিট করেই শ্বশুরবাড়ি যাবে এই প্ল্যান, ডাক্তারবাবু ওকে দেখেই ফের বগলদাবা করে কেবিনে।

‘ইয়ে আবার কি হল স্যার? সব কিচু ঠিকঠাক আচে তো এইবার?’

রিপোর্ট পড়তে পড়তে রিডিং গ্লাসের ওপর দিয়ে ফের তাকালেন ডাক্তারবাবু, বললেন ‘বাকি সব তো ঠিকই আছে, তবে কি না…..’

একটু ভীত স্বরে বিপিন বলল ‘ইয়ে, তবে কি ডাক্তারবাবু?’

‘আপনি কি জানতেন যে আপনি প্রেগন্যান্ট?’

হাসবে না কাঁদবে,বিপিন সত্যিই বুঝে উঠতে পারলো না!

 

দাম্পত্য

গত মাস ছয়েক ধরে লেকটাউন এলাকায় কোন কাক বা চিল দেখা যাচ্ছে না।

ব্যাপারটা প্রথমে মাস তিনেক আগে, এক ছুটির দিনে, খেয়াল করেন সুরেশচন্দ্র আগরওয়াল। শঙ্কিত স্বরে গিন্নীকে ডেকে বলেন, ‘ডাভড়ি, লারল তিন হফতা হুঁ কোঈ কাগলোকো নি দিখিও’। জবাবে গিয়ারসি দেবি অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে তিনতলার ফ্ল্যাটের দিকে দেখিয়ে দেন। নতুন আসা বংগালি মোটেয়ার-লুগাই দুটিই যে এই অনর্থের কারণ, সেটাও জানাতে কসুর করেন না।

সুরেশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রসওয়ার্ড পাজল করতে বসেন।

সুজন আর স্নিগ্ধার বিয়েটা হয়েছিল খুব ধুমধাম করেই। দুপক্ষের জ্যোতিষীরাই ঘাড় নেড়ে রায় দিয়েছিলেন যে এই বিয়ে রাজযোটক হতে বাধ্য। স্নিগ্ধার বাপের বাড়ি বলতে গেলে বেশ বড়লোক, দেওয়া-থোওয়াতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নি। মোটমাট দুজনের সংসার সুখের করে তুলতে কোনও পক্ষের চেষ্টাতেই কোন ত্রুটি ছিলো না।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো বিধি শুধু বামই নয়, পুরো নন্দীগ্রামের সিপিএম।

প্রথম দিন থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেছিলো যে এই বিয়ের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। তেল এবং বেগুন, আদা এবং কাঁচকলা, সাপ এবং নেউল, এরা বরং একে ওপরের প্রতি অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহানুভূতিশীল। নাইট বালবের রঙ থেকে শুরু করে পর্দার ডিজাইন, ননদের ছেলের স্কুলের খরচ দেওয়া থেকে রাত জেগে কোপা ফুটবল ম্যাচ দেখা, আগ্নেয়গিরির পারদ দিনে দিনে ক্রমেই উর্ধমুখী হয়ে উঠছিল।

সবাই আশঙ্কিত হয়ে ফাইনাল শো ডাউনের জন্যে অপেক্ষা করছিলই। তবে বেশীদিন অপেক্ষা করতে হল না। সবার সম্মিলিত আশঙ্কাকে সম্মান জানিয়ে বিয়ের মাস ছয়েক বাদেই সেই ডি ডে সগৌরবে উপস্থিত!

সেদিন ছিল স্নিগ্ধার বেস্ট ফ্রেন্ড অনুপমের বিয়ে। বিয়ে বউভাত মিলিয়ে ছবি ভিডিও তোলা হয়েছিল কম নয়। সেসব সেভ করার জন্য খুব সম্ভবত বাধ্য হয়েই স্নিগ্ধা সুজনের হার্ড ড্রাইভ থেকে এগারো বছর ধরে জমানো সাড়ে সাতশ জিবি র মুভি কালেকশন ( সানি লিওনি থেকে সিটিজেন কেন, অ্যানিমেশন মুভিজের পুরো সেট) ডিলিট করে দেয়।

জবাবে সুজন বিশেষ কিছু করেনি। শুধু স্নিগ্ধার দুটো দামি বেনারসি পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানি লছমনকে কেটে লুঙ্গি করে পরার জন্য দিয়ে আসে।

এর পরে সংসার করা সত্যিই ভারি মুশকিল। সেইদিনই স্নিগ্ধা বাপের বাড়ি চলে আসে। আর মিউচুয়াল ডিভোর্স দিতে সুজনের বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিলো না।

কিন্তু মাঝখান থেকে বাধ সাধলেন দুই মা। স্নিগ্ধার মা যতই হাপুস নয়নে বলুন,’মেয়েকে মানুষ করতে পারিনি দিদি,ক্ষমা করে দিন’, সুজনের মা ততই বিব্রত হয়ে বলতে থাকেন ‘আরে না না, বৌমা ঠিক বুঝতে পারেনি, বাচ্চা মেয়ে তো। ওটা কোন ব্যাপারই না। আর আমার ছেলেরও বাঁদুরে বুদ্ধি দেখুন, অমন দামি শাড়ি তুই লুঙ্গি করে পরতে বলে এলি?’

এইসব পর্ব পেরিয়ে, ম্যারেজ কাউন্সেলরের পরামর্শ মেনে দুজনকে ধরেবেঁধে তুলে দেওয়া হল জগন্নাথ এক্সপ্রেসে। দুটো দিন ওরা একত্তর কোথাও নিরিবিলিতে কাটিয়ে এলে কিছু হলেও হতে পারে এই আশায়।

ট্রেন ছাড়তেই স্নিগ্ধা সুজনের উল্টোদিকে এসে বসল। প্রথম থেকেই এই ”দুদিন গিয়ে কোথাও ঘুরে আয় না” ন্যাকামিটায় ওর গা জ্বলছিল। এইভাবে বিয়ে বাঁচিয়ে এই হরিবল লোকটার সংগে থাকতে হবে? জঘন্য। ইরিটেটিং।

বিরক্তিসহ ও তাকিয়েছিল বাইরের দিকেই। সুজন একটা ছ’শ এম.এল স্প্রাইটের বোতলে আধাআধি ভদকা আর স্প্রাইট মিশিয়ে এনেছিল। সেটাই অল্প চুমুক দিতে দিতে কাঁটা সিরিজ পড়ছে এমন সময় পাশের কামরা থেকে এক মধ্যবয়স্ক দম্পতি সবেগে এসে ওদের পাশে বডি ফেললেন।

দুজনের মধ্যে যিনি মহিলা, সেই ফর্সা, পৃথুলা এবং পাঁচ ফুট উচ্চতার ষাট ছুঁইঁছুঁই সুন্দরী গিন্নীটি স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন ‘কিচু মনে করেন নি তো?’

সঙ্গী ষাটোর্ধ ভদ্রলোকটি গাত্রবর্ণে ঘোরকৃষ্ণ। দোহারা চেহারার মানুষটি উচ্চতায় ছফুটের সামান্য বেশীই হবেন। তিনি রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে কাঁচাপাকা গোঁফের ডগা নাচিয়ে বললেন, ‘মনে করনের ত কিসুই দেহি না। আমরা হইলাম গিয়া বোনাফায়েড প্যাসেনযার। আমাগো সীট পাইয়া বইয়া পরসি। মনে করনের আসেডা কি হেতে?’

মহিলা একবার শ্যেনদৃষ্টিতে ভদ্রলোককে মেপে নেন। তারপরে মধুমাখা স্বরে কিঞ্চিৎ লঙ্কার ঝাঁজ মিশিয়ে বলে ওঠেন ‘ওইভাবে হুড়যুদ্দ করতে করতে কারও গায়ের ওপর এসে পড়লে সরি বলতে হয়। তোমাকে ছোটবেলায় তোমার মা বাবা শেকায় নি?’

‘হে হে, ওইরকম ফুডবল মার্কা বডি হইলে ত গরাইয়া যাইবই। উনি সবই বোযসেন। তোমারে আর কওন লাগবো না’।

বলেই ভদ্রলোক গিন্নির দিকে দৃকপাত না করে সুজনের পাশে বসে চোখ টিপে জিজ্ঞাসা করেন ‘কি খাইতাসেন? বাকার্ডি না স্মারনফ? হে হে। আমিও লইয়া আইসি, পেপসি দিয়া ওল্ড মঙ্ক , বোযলেন নি?’

ভদ্রমহিলা অত্যন্ত স্থির গলায় বলেন ‘নিজের গুনপনার পরিচয় দেবার আগে লোকে অন্তত নিজের নামটুকুন বলে। ওনার নাম জিগ্যেস করেচ? নাকি উটেই আগে ছোঁকছোঁক, ককন খুলে বসবে। আর পারিনা বাপু’।

ভদ্রলোক হঠাত খুব গম্ভীর হয়ে রুমাল পকেটে ঢুকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলেন’ মীট মিস্টার প্রশান ভট্টারিয়া। এক্স চিফ প্রোডাকশন ম্যানেযার অফ ভারত মেশিনারি। ইঞ্জিনিয়ার ফ্রম শিবপুর বি ই কলেয। থার্টি ফাইভ ইয়ার্স অফ আনপ্রিসিডেন্টেড এক্সাম্পল অফ…..’

‘ওফফ, এই সুরু হল বুড়োর। এই ছিলুম, ওই ছিলুম। অমুক সায়েব আমার ইঞ্জিরি দেকে এই বলেচিলো, ওমুক কনফারেনে ওই পেয়েচিলুম। বাঙাল বিয়ে করে যে কি গোকখুরি করেচি মা যে কি বলি। একটা সাট্টিপিকেটের জন্যে এমন হাবাতে মার্কা হা পিত্যেশ কাউকে করতে দেকিনি বাপু’

‘বলি বোঝবা কি কইর‌্যাব? তোমাগো ফেমিলিতে ল্যাখাপড়ার চল আসে নাকি কিসু? বউবাযারে দুইখান সোনার দোকান দুইডা বাদ দিয়া কি আসে কও দেহি? ভাইগুলা ত এক একডা খাডাশ। পয়সার গরমে ত্যাল ম্যাকম্যাক করে।’

‘আহাহা…. ঢং দেকে বাঁচিনে বাপু। কি দেমাক কি দেমাক। বলি আমাদের ত নাকি কিচুই ছিলো না। তা কি দেকে নেংচে নেংচে এলে হ্যাংলার মতন?’

‘দ্যাহ রমা, দ্যাট হ্যাপেনড বিকজ অফ আওয়ার প্যারেন্টস। বুল্টির বিয়ার গয়না গড়াইবার লগে আমার ছুডকাকা আমারে লইয়া তোমাগো দোকানে গেসিল। তা আমার রূপ (হালকা হাসি) দেইখ্যা আর ডিগ্রীখান শুইন্যা তোমার বাবার হ্যাসরপ্যাসর দেইখ্যাই তো হ্যা হ্যা হ্যা…..’

‘ইসস ম্যাগো, আবার সেই বিচ্চিরি হাসিটা হাসচে দ্যাকো’

এই পর্যায়ে সুজন প্রায় হামলে পড়ে। হাত বাড়িয়ে বলে ‘সুজন বসু, বাড়ি লেকটাউন। এরিয়া সেলস ম্যানেজার অফ হাইজিন অ্যান্ড কেয়ার কম্পানি। মীট মাই ওয়াইফ স্নিগ্ধা, ফ্রম যাদভপুর, মাস্টার্স ইন কম্প্যারেটিভ লিটারেচার। আর আমাদের প্লিজ তুমি করে বলুন। আপনারা বয়সে অনেক বড়’।

বৃদ্ধ উল্লসিত হয়ে ওঠেন ‘বাহ বাহ, যাদবপুরের মাইয়া, মাস্টার্স করস, হ্যা হ্যা,… দেখলা গিন্নি, বাঙালগুলা কেমুন আউগাইয়া যাইতাসে’।

‘তুমি থামো বাপু। তা বাছা, তোমাদের দেশগাঁ কোতায়? লেকটাউনতো হালে হয়েচে, জত্ত মেড়োগুলো আসর বসিয়েচে ওখানে। তা বাপু বাপ পিতেমোর ভিটেটি কোতায়?’

সুজন খুব কুণ্ঠিত স্বরে বলে ‘বাঁকুড়া,’ শুনেই প্রৌঢ়া একগাল হাসি হেসে বলেন ‘সে তো আমাদেরও গাঁ তো ওদিকেই। বলি গাঁয়ের নামখানি কিচু জানা আচে?’

সুজনের গলা শুকিয়ে যায়। ওরা বাঁকুড়ার বাসিন্দা নামেই, গত পঞ্চাশ বছর ধরে ওরা কলকাতার লোক। গ্রামের নামটা মুখস্থই ছিলো, কিন্তু এঁদের দেখে মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছে, নামটা কিছুতেই মনে আসছে না।

ওদিকে ভদ্রলোক দিব্যি স্নিগ্ধার সংগে আলাপ জমিয়ে নিয়েছে ‘দ্যাশ যানি কোথায় কইলা ? বিক্রমপুর? হ্যা হ্যা, আমাগো ইয়ে ত কাসেই, সাভার। আহা হা হা। কত্ত যমি নদি পুহইর আসিল আমাগো। সে যদি একবার যাইতাম…..’

এতক্ষনে অরিন্দম কহিলা বিষাদে….

ভদ্রমহিলা বীরদর্পে এদিকে ফেরেন, মিষ্টিস্বরে হুল ফুটিয়ে বলেন ‘বলি এইসপ গুল ঝেড়ে আর কদ্দিন চলবে বল দিকিন? জমি পুকুর ওবদি না হয় বুঝলুম, বলি নদী কি করে কারও সম্পত্তি হয় নাকি বাপু? আর সব্বারই তো শুনি ওদিকে নাকি গাদা গাদা জমিদারি ছিল। বলি বাংলাদেশে এত জমি আচে? নাকি ওদিকে এক ডেড় কাঠাতেই জমিদারি পাওয়া জেত? কি জানি বাপু, ইদিকে তো দু দশ খান গাঁ না হলে আমরা জমিদার বলে মানতেই চাইতুমনি। বলে সুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে নিঃশব্দে হাসতে থাকেন।

বৃদ্ধ ঈষৎ গরম হয়ে বলেন, ‘দ্যাখো, দ্যাশ তুইল্যা কথা কইবা না। জানো আমরা কত কষ্ট কইর‌্যাঈ…’

কথা শেষ হতে দেন না বৃদ্ধা, কলকল করে ওঠেন ‘ওনার কতা একবর্ণ বিশ্বেস কোরনি বাপু। বুড়ো জন্মেচে এদিকে, সাতচল্লিশের পরেই। ওপার থেকে এদেসে এসেচিলেন আমার শ্বশুরমসাই, ছিলেন ইসকুল মাসটার। আহা, অমন লোক আর হবে না বাবা, সাক্ষাৎ ঈশ্বরতুল্য মানুষ। আর আমার ছিলেন আমার শাশুড়ি, সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। যা কষ্ট ওনারা করেচেন। এনারা তো ওই যা হোক করে ডিগ্রী বাগিয়ে এক একজন হনু হয়েচেন, সে উনি, আমার দ্যাওর, ননদ সব একেকজন সেয়ানা নাম্বার ওয়ান….’

-‘দ্যাহো রমা, এইসব ইন্টারনাল কথা এদিক ওদিক কওন ঠিক না।’

‘আহা হা হা হা। মুচ্ছো যাই আর কি। নকশা দেকে বাঁচিনে। নেহাৎ আমার সহজ সরল বাপ ডিগ্রী দেকে…’

‘হ্যা হ্যা হ্যা। হেইডাই তো হইল কথা। বোযলা মা, ডিগ্রী। হ্যান্ডসাম তো সিলামই, হে হে হে (‘মরণ, বুড়োর আদিক্যেতা দ্যাকো’) তারপর বোযলা কিনা, এয়াগো ফ্যামিলিতে তো ল্যাখাপড়ার তেমুন চল নাই (‘মাজে মাজে ইচ্চে করে বুড়োর মুকে নুড়ো জ্বেলে দিই’), তা শ্বশুরমশয় আমার হাত ধইর‌্যা কইলেন, ”দ্যাহো প্রশান্ত, আমার মাইয়াডা তে মানুষ হয় নাই”…

‘দ্যাকো, অনেক্কন ধরে সুনচি এসব। এরপর কিন্তু টিটি ডেকে টেরেন থেকে নামিয়ে দেবো, সত্যি বলচি’।

এতক্ষণে স্নিগ্ধা এদের খুনসুটি উপভোগ করতে শুরু করেছিল। ওর মনের গভীরে জমে থাকা মালিন্য কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এই বুড়োবুড়ির কথাকাটাকাটির গভীরে কোথাও অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত একটা ভালোবাসার চোরাটানও আছে। হয়তো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।

সুজন জিজ্ঞেস করে ‘আপনারা কি কোনও কাজে যাচ্ছেন ? নাকি এমনি, আমাদেরই মতন ছুটি কাটাতে?’

ছুটি কাটানোর কথা শুনে স্নিগ্ধা একবার ওর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে নেয়। কিছু বলে না।

‘সে আমরা বচ্ছরে দুইবার শ্রীক্ষেত্রে আসি বাপু। বাবা জগন্নাথের পেসাদ নিয়ে ঘরে ফিরি’

-‘এইগুলা এক একখান হোক্স, বোযলা। এইসব পূযাফুযা সব ফালতু। লোক ঠকানের কায়দা আর কি। ছুডবেলা থেইক্যা দেখতাসি….’

-‘দেখো, ঠাকুর দেবতা নিয়ে বাজে কতা একদম বলবে না। বামুনের ছেলে, সান্ধ্যাহ্নিক টুকু করো না, বাসি কাপড়ে খেতে বস, পইতে দিয়ে মশারির দড়ি করেচ। কি ভাবচো, এসব উনি দেকেন না?’

-‘তা আমারডা ছাড়ান দাও। তোমারটা তো দ্যাহেন। তা হেইডা দিয়া রুপুর ভালো কিছু হইলো নাকি?’

হঠাৎ দুজনেই চুপ করে যান। ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। ট্রেন তখন খড়গপুর পৌঁছেছে। ভদ্রলোক শশব্যস্ত হয়ে ‘খাওনের লগে কিসু পাওয়া যায় কি না দেহি’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে যান।

স্নিগ্ধা এসে সুজনের পাশে এসে বসে, কেন জানি না গা’টা একটু শিরশির করছিলো ওর। ইচ্ছে করছিলো এদিকে এসে বসতে।

ট্রেন খড়গপুর ছাড়ালে প্রশান্তবাবু এক চাঙারি কচুরি আলুরদম আর চারটে ডিমসিদ্ধ নিয়ে ফিরে আসেন। প্রসন্ন মুখে বলে ‘খাইয়া দ্যাহ। হে হে হে। অম্রেতো, বোযলা, অম্রেতো। লিপিড প্রোফাইলের কথাডা ভুইল্যা যাও।’

সুজন মৃদু আপত্তি করে। ‘আহা আপনি আবার কেন এত কষ্ট করে….’

ভদ্রলোক দাবড়ে দেন, ‘আরে খাইয়া দ্যাহো। বড় বড় শেফেদের এয়াদের কাস থেইক্যা কসুরি বানানো শেখন লাগে।’

সবাই সেই মুহূর্তে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে চাঙারির ওপর।

স্নিগ্ধা আর সুজন একই চাঙারি থেকে কচুরি খেতে থাকে। হাতে হাত ঠেকে যায়, কাঁধে কাঁধ, আঙুলে আঙুল।

ওদিকে খেতে খেতে প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা একবার আড়চোখে কর্তাটির দিকে তাকিয়ে নেন,

-‘তেলেভাজা আর ডিম খাচ্চ খাও। কিন্তু বেসি বাড়াবাড়ি যদি দেকিচি, তক্ষুনি কিন্তু সরিৎ ডাকতারকে ডেকে সুদু গলা ভাত খাওয়াবো, বলে রাকলুম’।

-‘হেইডাই দিও, সংগে যদি এক চামচ মরিচ বাটা, কসুর লতির তরকারি আর গিমা শাগের বড়া ভাইজ্যা দাও গিন্নি, দুইখান চুমা এহনই দিতে পারি হে হে হে’।

বৃদ্ধা মুহূর্তে রাঙিয়ে ওঠেন, ‘নোলা দ্যাকো বুড়োর। আর কতাবাত্রার কি ছিরি। মুকের কোন আড় নেই ‘।

সুজন হেসে ফ্যালে। স্নিগ্ধা সামান্য অপ্রস্তুত হয়। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করে ওঠে ‘ওঁর বুঝি ওসব খাওয়া বারণ?’

খানিকক্ষণ চুপ থেকে মুখ খোলেন বৃদ্ধা, ‘তিন তিন বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গ্যাচে ওনার। শেষ বার তো যমের মুক থেকে সরিৎ ডাক্তার একাই টেনে এনেচিল। টানা একমাস হাসপাতালেই সংসার গুচিয়ে বসেছিলুম,’ বলেই হাত জোড় করে প্রণাম ঠোকেন উনি, ভগবান না ডাক্তারবাবু, কার উদ্দেশ্যে সেটা বোঝা যায় না অবশ্য।

তবে তার পরেই তাঁর গলায় আগুন ঝরে পড়ে,’তাও কি বুড়োর হুঁস বলে আচে কিচু? ছাইপাঁশ গেলা কি কিচু কমতি আচে? আবার অমন দেবতুল্য ডাক্তারকে বলে কি না, ”রেগুলার কাস্টমারদের কিছু ডিস্কাউন দেবেন না?” কী বলবো বাছা, কিচুই না পেয়ে শেষে একমুঠো নজেন আর ডাক্তারবাবুর একটা নতুন পেস্কিপশন লেকার খাতা তুলে এনেচেন উনি, বচ্ছরকার বাজারের হিসেব রাকার জন্যে। কি বেয়াক্কেলে লোক ভাই কি বলবো, হাড় মাস কালি করে দিলে এক্কেবারে’

-‘হ, নিযের কথাডা কও। হাডু দুইখান তো পুরাই ইন্ডিয়ার ইকনমি, খালি ন্যাতাইয়া ন্যাতাইয়া পড়ে। ডাইন চক্ষুখান তো গ্যাসেই। আমি কই কি একখান কালো কাপড় বাইন্ধা রাখো, পুরাই পাইরেট লাগবো’অনে, পাইরেট অব ক্যারিবিয়ার মত পাইরেট অফ বাগবাজারিয়া। পার্ফেক্ট অ্যাটায়ার ফর ইউ। হে হে হে হে। বোযলা মা, আমারে ভালোমানুষ দেইখ্যা একখান ডিফেক্টিভ বউ হ্যান্ডওভার কইর‌্যা। দিসিল..’

ভদ্রমহিলা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। ‘এই নিয়েই তো চল্লিশটা বচ্ছর তোমাদের বাঙাল ফ্যামিলির সেবাযত্ন করে গেলুম। বলি তোমার ননদ দ্যাওরদের মানুষ করলো কে? কোন খেয়ালটা রাকতে শুনি? নিজের বোনের বিয়ের দিন বরের ছোটমামাকে বলনি ‘বিয়া ত দিতাসেন, পোলায় গবর্মেন্টের অফিসার, চুরিচামারির অভ্যেস নাই তো?’, বলি এসব ঝামেলা কে সামলায়? আমার দ্যাওরের আশি বছরের বিধবা শাশুড়ি ঠাকুমাকে তুমি সর্দি হয়েচে সুনে গরম জলে রাম না হুইস্কি গুলে খাওয়াওনি? ছি ছি ছি, কি কেলেঙ্কারি’।

ভদ্রলোক একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েন, ‘আহা, অর লগেদুইখান তুলসিপাতাও ত দিসিলাম গ্লাসের উপর’।

-‘দ্যাকো, একদম মাতা গরম করাবে না।’

-‘হে হে গিন্নি, রাগ কর ক্যান। তুমি ছিলা বইল্যাই ত বাইচ্যা আসি। কই কি তিরিশ বচ্ছর তো হইয়াই গ্যালো। ন্যাক্সট সাত জনমের লাইগ্যা তো উপরওয়ালার কাসে তোমার নামখান লেইখ্যা ডিমান্ড ইন্ডেন্ট যমা দিয়াই রাখসি। এহন দ্যাখার কে আগে উপরে গিয়া ইন্ডেন্টখান ফাইল করে। হ্যা হ্যা হ্যা। মনে হয় আমার চান্সডাই বেশি। কি কও?’

-‘যত্তসব অলুক্ষুনে কতা’

স্নিগ্ধা সুজনের পাশে ঘনিয়ে আসে। ‘আপনাদের ছেলে মেয়ে?’

-‘তার কথা কইও না মা। কুলাঙ্গার। একখান শিক্ষিত হামবাগ’

-‘দ্যাকো, যেকানে সেকানে নিন্দে করবে না রুপুর। হিরের টুকরো ছেলে আমার’।

-‘করুম, হাযার বার করুম। হিরা নয়, কয়লা।’

সুজন খুব ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞেস করে ‘কি করেন উনি’।

বৃদ্ধার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে’ ও তো খুউপ ভালো ছেলে বাবা। খড়গপুর আই আই টি থেকে খুব ভালো পাসটাস করে এখন অ্যামেরিকা তে আচে। বুজলে, ওকানেই মাস্টার করে, ডাক্তার হয়ে রিসাচ করে’।

-‘ট্রেইটর। কুইসলিং। লাস্ট টেন ইয়ার্স দ্যাশে আয় নাই। মায়-বাপেরে দ্যাহনের কুনো ইসস্যাই নাই। হি ইস টু বিযি টু টক টু হিস পেরেন্টস ইভেন ওয়ান্স ইন আ মান্থ। এক বোচা নাক জাপানিরে বিয়া কইর‌্যা বাসসা কাসসা লইয়া ভালই আসে। আমাগো কথা মনেই পড়ে না।’

-‘আহা। ওদের কত কাজ বল দিকিন। রাতদিন খাটাখাটনি…’

-‘তাহইলে কালও ”অরে কতদিন দেহিনা ”বইল্যা কান্দতাসিলা ক্যান?’

বৃদ্ধা চুপ করে যান।

বয়স্ক লোকটি উঠে ট্রাভেল ব্যাগ থেকে একটা চাদর বার করে স্ত্রীর গায়ে জড়িয়ে দেন। ‘ঠান্ডা লাগাইয়ো না’।

স্নিগ্ধা কোন কথা খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে ‘ওনার বুঝি ঠান্ডার ধাত?’

‘হ, তবে কিনা আমার অ্যাকশনটা হইল গিয়া পুরাই সেল্ফিশ, বোঝলা না? বুড়ি কাল মইর‌্যাধ গ্যালে এই বুড়াডারে দেখবো কেডা? হ্যা হ্যা হ্যা’

বৃদ্ধা কপট রাগত দৃষ্টিতে তাকান। তারপর কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করেন ‘ওসুদের ব্যাগটা কই? এখন তোমার দুটো ট্যাবলেট খাওয়ার কতা না?’

-‘রাখসিলা কই?’

-‘কেন? তোমার ওই নীল হাতব্যাগটার মদ্দ্যে। সেটা কোতায়?’

বৃদ্ধ উদাস মুখে বসে থাকেন।

-‘কতা কানে জাচ্চে না?’

-‘যাইব কই? হোটেলে গিয়া খুইজ্যা দেখুম’অনে’।

-‘পথে এসো। ব্যাগটাতো পাসের বারির বান্টিকে ফুটবল খেলার জন্যে দিয়ে এসচিলে। ভাগ্যিস ওর মা এসে নিয়ে গেসলো। এই নাও। এখন মুখটা খোল দিকিন। এই যে, হ্যাঁ……’

পরম মমতায় উনি চল্লিশ বছরের সুখ দুঃখের সাথী ভদ্রলোকটির মুখে ট্যাবলেট দিয়ে জল ঢেলে দিতে থাকেন।

সেইদিন রাতে, সুজনের বুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে ‘বিয়ে করলেই খুব ঝগড়া হয়, না?’

সুজন আধো ঘুমে বলে ‘হুঁ’।

-‘ঝগড়া করাটা কি খুব ইম্পর্ট্যান্ট?’

-‘হ্যাঁ’

-‘হ্যাঁ?’

-‘হ্যাঁ। তবে কি না আরও ইম্পর্ট্যান্ট হল ঝগড়া করতে করতে এক সঙ্গে বুড়ো হওয়াটা।’

স্নিগ্ধা হয়ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাত করে সুজনের ঠোঁট ওর ঠোঁটের ওপর নেমে আসায় আর কিছুই বলে উঠতে পারে না ও।

তখন অবশ্য বেশি কিছু বলার কথা ওর মনেও ছিলো না।

আর মনে থাকলেও তখন তাতে কিছু এসে যায় না।

 

 

 

 

বসন্ত

দোলযাত্রা’র পুণ্য প্রভাত। সক্কাল সক্কাল দাঁতটাত মেজে, অতি সুপ্রসন্ন মেজাজে বাহুবলী স্টাইলে আরাম করে সোফায় বসে প্রাতরাশের অপেক্ষা করছি, এমন সময় মনে হলো আইলা, আজ হোলি না?

ভাবতেই নোলাটা কেমন স্যাক স্যাক করে উঠলো বুঝলেন? হায়, আজও কী দরিদ্র কায়স্থসন্তানের কপালে সেই রুটি আর ঢেঁড়সসেদ্ধ? আজও কি ঈশ্বর আমার প্রতি সদয় হবেন না? আজও কি গরীবের পেট মুক্তন্ট্রে বলে উঠবে না, ”হামে চাহিয়ে আজাদি, ঢেঁড়সসেদ্ধসে আজাদি…?” দেশ জাতি সমাজ সবই কি আজ অত্যাচারী শাসকের কবলে? হায় বন্ধু, মানবতা আজ কোথায়? কোথায় সেই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষসম ”অচ্ছে দিন?” নিপীড়িত শোষিত নিষ্পেষিত অত্যাচারিত ভুখা পেট কি আজকে বিপ্লবের ধ্বজা তুলে ধরে গেয়ে উঠবে না, টু আর্মস সিত্রোঁয়ে..

এইসব ভেবেটেবে মনটা ভারী নরম হয়ে এসেছে, আরেকটু পর কেঁদে ফেলবো ফেলবো অবস্থা, এমন সময় মনে হলো একবার চান্স নিয়ে দেখি নাকি? বলা যায় না, ঈশ্বরবাবু যদি আজ তেনার বার্থডে উপলক্ষ্যে ইস্পেসাল কিছু অ্যারেঞ্জ করে রাখেন? মানে বেড়ালের ভাগ্যে কশ্চিৎ কদাচিৎ এমন সৌভাগ্যের উদয় হয় বটে। তবে আমি এমনিতে ঘরপোড়া গরু কি না, তাই এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে একটা রাজসিক হাঁক পাড়লাম, ‘কই হে, আমার ব্রেকফাস্ট কই? দেখো, লুচিগুলো যেন ফুলকো ফুলকো হয়, আর আলুরদমটা মাখোমাখো। আশা করি জানো যে আমাদের বাড়িতে গাওয়া ঘি ছাড়া লুচি ভাজা হয় না। মোহনভোগটা একবাটিই দিও। আর হ্যাঁ, নলেনগুড়ের ”আবার খাবো” টা ভুলো না যেন।’

বলেই চট করে চোখটা বন্ধ করে ফেললুম।

ছোটবেলা থেকেই আমার এই এক স্বভাব। বিপদ আসন্ন দেখলেই চোখটা বুজে ফেলি। মানে যা হয় হোক, আমাকে তোর আর দেখতে হচ্ছে না!

কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে ঈশ্বর বললেন ‘ওহে খোকা, আজ হাম তোমার উপর সুপ্রসন্ন হ্যায়। কেয়া মাংতা হ্যায় চট করে বলে ফেল দিকিনি। আজ আমার আবার একটু তাড়া আছে।’

দৈববাণীর মতই রান্নাঘর থেকে সুমধুর কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘শুধু গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি খাবে গো? তার সঙ্গে একটু কমলালেবুর পায়েস আর রাবড়ি দিই? নাকি লুচির বদলে ঘিয়ে ভাজা পরোটাই করে দেবো? আর কালকে ওপরের মাসিমা বর্ধমানের সীতাভোগ দিয়ে গেছেন, খাবে নাকি?’

আমি তো মাইরি, ভালো বাংলায় যাকে বলে, টোটাল স্তম্ভিত ! নিজের গায়ে জোরসে চিমটি কেটে নিজেই লাফিয়ে উঠলাম। এ কি সত্য? নাকি স্বপ্ন?

জিভের জলটা সুরুৎ করে টেনে নিয়ে বললাম, ‘ইয়ে, আর দুপুরে কী হয়েছে আজ?’

রান্নাঘর থেকে সুরলহরী ভেসে এলো, ‘দুপুরে? মাখো মাখো ছানার ডালনা দিয়ে রাধাবল্লভী, তারপর দেরাদুন রাইসের সঙ্গে তেলতেলে গোটা কপি দিচ্ছি। চিতল মাছের পেটি আছে বেশ তেলঝাল দিয়ে। ও হো, তেলকইয়ের কথাটা বোধহয় বলিনি, না? তা সেই তেলকইয়ের পর কষা কষা মাটন রোগনজোশ আর আউধের পোলাও , শেষপাতে মোল্লারচকের লালদই, সূর্য মোদকের জলভরা তালশাঁস আর নলেন গুড়ের আইসক্রিম। আর হ্যাঁ, এর সঙ্গে জয়নগরের মোয়াও রাখবো কি?’

বলা বাহুল্য, এরপর কেঁদে না ফেললে কান্নাকাটি ব্যাপারটা থাকার কোনও মানেই হয় না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ধরা গলায় বললাম, ‘আর রাতে?’

‘রাতে তো মোর্গমসল্লম আর আরসালানের স্পেশাল বিরিয়ানির অর্ডার দিয়েছি। তারপর ফিরনি। আর শেষে রসমাধুরী, মালাই চমচম আর নাহুমের প্লাম কেক। এতে তোমার হয়ে যাবে না সোনা?’

চশমা খুলে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জলটা মুছে নিলাম। আহা, আজ আকাশটা কী সুন্দর, বাতাসে কী সুমধুর ইয়ে, মধুবাতা ঋতায়তে, মধুঃক্ষরন্তি সিন্ধবাঃ..

‘আর শোনো না, অলিপাব থেকে তোমার প্রিয় ওই চিকেন আ লা কিয়েভ না কি একটা আছে না? ভাজা চিকেনের মধ্যে মাখনের পুর দিয়ে? ওইটা অর্ডার করলে বাড়িতে দিয়ে যাবে না গো?’

এবার ফেঁৎ ফেঁৎ করে নাকটা ঝেড়ে ফেলতে গিয়েই কেমন একটা কুটিল সন্দেহ হতে লাগলো, বুঝলেন। একই দিনে এত ভাগ্যোদয়, মানে এ যে সৌভাগ্যের ষাঁড়াষাঁড়ি বান ডেকেছে রে ভাই! বলি কপালটা একটু রয়েসয়ে খুললে হতো না? এই রেটে খুললে তো শেষমেষ কপাল হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে দেখছি। সেটাই কি খুব ভালো দেখাবে, অ্যাঁ?

সন্তর্পণে প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলাম, ‘হ্যাঁ গো, ইয়ার্কি করছো না তো?’

ওধার একটা ছোট সাইজের পরমাণু বোমা উড়ে এসে কানের কাছে ফেটে পড়লো, ‘ইয়ার্কিটা কে শুরু করেছে শুনি? যার কোলেস্টেরল দুশো আশি, ট্রাইগ্লিসারাইড চারশোর ওপর, ব্লাড প্রেশার একশো পঞ্চাশ বাই একশোয় চড়ে বসে আছে সে কোন আক্কেলে লুচির কথা বলে শুনি? আর মিষ্টি? তোমার লজ্জা করে না মিষ্টির কথা বলতে? ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে তোমার মিষ্টি খাওয়া বারণ, তা সত্ত্বেও কোন আক্কেলে তুমি কাল পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে নিতাই সুইটস থেকে দুটো সন্দেশ খেলে?’

ব্যাঘ্রগর্জনে চিঁ চিঁ করে বল্লুম, ‘কই, খাই নি তো।’

‘খাও নি? বটে? ফের মিথ্যে কথা? হ্যাংলা বাঙাল কোথাকার। আমার ন” কাকু নিজের চোখে দেখেছে তোমাকে সন্দেশ খেতে। বলো তুমি খাওনি?’

সোফার কোণে সেঁধিয়ে গেলুম একেবারে। এবার থেকে দেখছি ন” কাকু, সেজো পিসে, সিধু জ্যাঠা এইসব দেখেশুনে…

ঠকাস করে একটা প্লেট উড়ে এসে পড়লো সামনে, কড়া করে সেঁকা দুটো পাঁউরুটি, সঙ্গে দুকুচি শশা আর গাজর!

‘সেদিন যে ব্লাড টেস্ট করালে, তার রিপোর্টটা আনা হবে কবে শুনি?’

আমি উদাসমুখে পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে আকাশের কাক গুণতে থাকি।

‘কথা কানে যাচ্ছে না?’

‘ইয়ে, আজকে ওদের আপিস বন্ধ, হোলিতে ওদের ছুটি থাকে কি না।’

‘ফের বাজে কথা?’ চোখ পাকিয়ে বললেন তিনি, ‘ওরাই ফোন করে বলেছিলো না হোলির দিন রিপোর্ট নিয়ে আসতে?’

‘অ্যাঁ? ইয়ে, আজ কার্তিকী অমাবস্যা না অলাবু ত্রয়োদশী, কি একটা আছে না? আজ পাঁজিপুঁথি মতে ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আনা নিষিদ্ধ যে?’

‘দেখো, একদম কথা ঘোরাবে না। যাও গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে এসো। আর শোনো, এই হলো বাজারের ফর্দ। দু কিলো আলু, এককিলো পেঁয়াজ, পাঁচশো শশা…’ এই বলে একটা লম্বা ফর্দ আমাকে ধরিয়ে দেন তিনি। শেষে বলেন, ‘আর হ্যাঁ, নিতাই সুইটস থেকে আড়াইশো পনীর আনবে। আর যদি শুনেছি চুরি করে মিষ্টি খেয়েছো..।’

হাঁ হাঁ করে উঠতেই হয়, ‘আহা চুরি করে খাবো কেন? ছিঃ, আমাকে তুমি এই ভাবলে? জানো আমি কোন বাড়ির ছেলে? আমি চুরি করে মিষ্টি খাবো? কভি নেহি, আমি পয়সা দিয়েই মিষ্টি খাবো। ভদ্রলোকের এক কথা।’

‘না আ আ’ ঘরের মধ্যে বজ্রপাতের কড়ক্কড় শব্দ, ‘তুমি মিষ্টি খাবে না। বুঝেছো?’

বুঝতেই হয়। বোঝা ছাড়া এই অসার জীবনে আর কীই বা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি বলুন তো?

তা টুকটুক করে বাজারপত্তর সেরে নিতাই সুইটসে গিয়ে দাঁড়াতে হলো। শোকেস জুড়ে থরেথরে মিষ্টির ভাঁড়ার। আমাকে দেখে তাদের সে কি হাঁকাহাঁকি, ‘আমি নলেন গুড়ের কালাকাঁদ বলছি স্যার, একটু দেখবেন,’ ‘ওহে খুড়ো, বলি কাল ছিলে কই? এই সবে ভিয়েন থেকে এয়েচি। এট্টুসখানি হবে নাকি?’, ‘আরে দাদা যে, হেঁ হেঁ হেঁ, খবরটবর সব ভালো? তা আজ দেখছি আমার এই শ্রীঅঙ্গে এরা আবার একপরত আমসত্ত্ব দিয়েছে। চেখে দেখবেন নাকি একবার?’ রসকদমগুলো তো কেঁদেই ফেললো, ‘কী অপরাধ করেছি কত্তা, যে আপনার শ্রীপাকস্থলীতে ঠাঁই দেওয়া থেকে আমাদের এভাবে বঞ্চিত করছেন?’ ওদিকে সরভাজার প্লেট থেকে যেটা ভেসে এলো সেটাকে আপনারা খোশবাই বলে ভুল করতে পারেন, আমার তো স্পষ্ট মনে হলো বিরহী যক্ষের দীর্ঘশ্বাস!

তবে শাস্ত্রে বলেছে পিঠে খেলে কোনওমতেই পেটে সয় না। ফলে শকুন্তলাত্যাগে উদ্যত নিঠুর নিদয় দুষ্মন্তের মতো গম্ভীর গলায় দোকানীকে বললুম, ”আড়াইশো পনীর দে খোকা।”

বলে খোকার দিকে তাকিয়ে আমি থ!

খোকা দেখি আকাশের দিকে, থুড়ি রাস্তার মোড়ের দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছে আর মোবাইলে কী যেন খুটুর খুটুর করছে। এই যে জলজ্যান্ত একশো কিলো ওজনেরর একটি গন্ধমাদন পর্বত তেনার সামনে দাঁড়িয়ে, ”ওহে খোকা পনিরং দেহি মে” করে চিল্লে যাচ্ছে তার প্রতি কোনও ইয়েই নেই?

ব্যাপার কি? একে আমি নয় নয় করে নয় বচ্ছর ধরে চিনি। অতীব ভদ্রসভ্য ছেলে। আমার সঙ্গে একবার স্কচ নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনার পর গভীর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে একটি অসামান্য উক্তি করেছিল, ‘দাদার বডিতে এডুকেশন আছে।’ সেই থেকে ছোঁড়াকে আমি বিশেষ স্নেহই করি। সে আজ আমার দিকে এমন লোষ্ট্রবৎ অবজ্ঞানিক্ষেপ করে কেন?

তার ওপর চোখফোখ দেখে বুঝলুম, হুঁ, কেস প্রায় স্যুটকেস! অমন ফ্যালফ্যালে চোখ সচরাচর মুক্তপুরুষটুরুষদের হয়। এ ছোকরার তো সেদিকে মতি আছে বলে খবর পাইনি! তবে?

বেশীক্ষণ অবশ্য এর উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হলো না। ছোকরার আকুলনয়ান অনুসরণ করে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি স্টেট ব্যাঙ্কের মোড় থেকে খর্বনাসা, পীতাঙ্গী এবং সামান্য পৃথুলা এক সুন্দরীশ্রেষ্ঠা এদিকেই গজেন্দ্রাণীগমনে হেঁটে আসছেন। তাঁকে দেখে আমি একবার খোকার দিকে আড়নয়নে চেয়ে নিলাম। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী তার দিকে দিব্যভঙ্গিমায় হেঁটে আসছেন, এক হাতে বরমাল্য, অন্য হাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্যাশবাক্সের চাবি!

ধীরে, অতি ধীরে সে মদালসনেত্রা বিপণিসমীপে উপস্থিত হলেন। তারপর এক দিলতোড় কটাক্ষবাণ হেনে জিজ্ঞেস করলেন, ”আপ ক্যায়সে হ্যাঁয় বাবলুজী?”

এতদিন পরে বঁধুয়া এলে, দেখা না হইতো পরাণ গেলে! ধীরেধীরে বাবলুকুমারেরর সর্বাঙ্গে স্বেদ কম্প আদি পূর্বরাগের সমস্ত লক্ষ্মণ ফুটে উঠতে লাগলো। চোখে সেই ভুবনমোহন হাসি, যে হাসি একদা উত্তমকুমার হাসতেন বলে অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা ভঙ্গীতে শ্রীবাবলু তাঁর স্বরে পোয়াটাক মধু এবং কয়েক পেগ ভালোবাসা মিশিয়ে বললেন, ‘ম্যায় অ্যাকদম ঠিক হ্যাঁয় সঙ্গীতাজী, আপনি ক্যামন হ্যায়?’

সেই সুলোচনা, সুকেশী, পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী মহিলাটি মাধুরীসমহিল্লোলে বডি কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপ তো খবর হি নেহি লেতে হোঁ। আব পুছনে সে কেয়া ফায়দা? ম্যায় আপসে বাত নেহি করতি, যাও।’

‘হেঁ হেঁ হেঁ, ক্যায়সে খবর নিই? আপনে তো পিছলি বার আপকা নাম্বার নেহি দিয়া। ইনবক্সে কত বাত করেগা?’

‘চল, ঝুটা কহিঁকা।’

বুকটা কেমন হু হু করে উঠলো, জানেন? আহা রে, তোর সঙ্গে দেখা হইতো যদি সখী, লত্তুন যৈবনেরই কালে… তাহলে কি আর গাজরসেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে হতো এখন?

আমার সে চিন্তার মাঝেই সেই বরবর্ণিনী বলে উঠলেন, ‘ইয়ে কেয়া আপকা দুকান হ্যাঁয়?’

দুকান এঁটো করা হাসি উড়ে এলো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম আপনা দুকান হ্যায়।’

‘মতলব আপ হালওয়াই হো? হি হি হি…’

সেই ইয়র্কারের সামনে আমাদের বাবলুকুমার পুরো এলবিডাব্লুকুমার হওয়ার মতো মুখ করে বসে রইলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণ সুরে সানাই বাজতে লাগলো, ”কানু কহে রাই , কহিতে ডরাই, ধবলী চরাই মুই..”

ভদ্রমহিলার বোধহয় সে ভ্যাবলাকান্তকে দেখে কিঞ্চিৎ করুণা হলো, দয়ার্দচিত্তে তিনি বললেন ”ধান্দা করনা আচ্ছা হ্যায়। আপ বেঙ্গলি লোগ তো সির্ফ নোওকরি করতে হো।”

আমি গম্ভীরমুখে এই সাম্প্রদায়িক কুমন্তব্যের বিরুদ্ধে একখানা আড়াই পাতা ডায়লগ নামাতে যাবো, এমন সময় শ্রীবাবলু তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, ‘মোট্টে না। এই তো হাম ক্যামন বিজনেস কর রাহা হ্যায়। ইধর আপনা মিঠাই খুব ফেমাস হ্যায়। স্বাদুষ্ট ওউর তন্দুরুস্ত।’

স্বাদুষ্ট বলে কোনও শব্দ হয় কি না, এ নিয়ে একটা কুটিল সন্দেহ মনের মধ্যে পাকিয়ে উঠতে থাকে। আর মিঠাই তন্দুরুস্ত কী করে হয় সেটাও বুঝে উঠতে পারি না।

এদিকে শ্রীমতী তখন হেসে কুল পাচ্ছেন না। উচ্ছ্বল ঝর্ণার মতো সে হাসি কালিন্দীর ফুটপাথে লুটিয়ে পড়লো। ‘তন্দুরুস্ত তো হ্যাঁয়, লেকিন মিঠাই নেহি, হলওয়াই।’

বাবলুকুমারকে দেখে মনে হলো জীবনে এই প্রথম নিজের বরতনুটি নিয়ে সামান্য লজ্জিত হলেন। ব্রীড়ানত মুখে বললেন, ‘ম্যায় মোটা নেহি হুঁ, সামান্য হেলদি হুঁ, এই যা।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজি হতে শতবর্ষ আগে এরকমই এক শনিবারের বারবেলায়, নন্দন চত্ত্বরে ঝোপের আড়ালে বসে, এমনই এক সামান্য স্থূলাঙ্গী মহিলাকে নেহাত আদর করেই ‘মুটকি সোনু’ বলে ডাকার পর ঝাড়া আধঘন্টা ধরে অনেক নতুন নতুন জন্তু জানোয়ারের নাম জানতে পেরেছিলাম। তার সঙ্গে আরও দুটো নতুন ইংরেজি শব্দ শিখেছিলাম, বডি শেমিং আর মিসোজিনি!

‘আপ জিম উম মে জয়েন কিঁউ নেই করতে?’ মহিলাটি এবার শোকেসের ওপর আরও ঘন হয়ে আসেন, ‘লেকটাউনমে মেরে চাচা কা বেটা এক নয়া জিম খোলা হ্যাঁয়। একদম টপ টু বটম আপটুডেট, চকাচ্চক। বোলো তো বাত করওয়া দেতা হুঁ। ডিসকাউন্ট ভি দিলা দুঙ্গি।’

স্তম্ভিত হয়ে মহিলার দিকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইলুম, কী ডেঞ্জারাস জিনিস রে ভাই! ডেট করতে এসে ভাইয়াকে কাস্টমার ভেট দেওয়ার ফিকির করছে?

তবে আমার আশ্চর্য হওয়ার আরও বাকি ছিলো। মহিলা আরও বলতে লাগলেন, ‘লেকিন সির্ফ জিম করনে সে নেহি হোগা। আপকো ডায়েটিং ওগ্যারাহ ভি করনা পড়েগা। অয়েলি ফুড ইনটেক ইজ দ্য মেইন রিজন ফর অবেসিটি।’

এইবার আর চুপ থাকা গেলো না, গলা খাঁকড়ে বলতে বাধ্য হলুম, ‘কথাটা কিন্তু উনি খারাপ বলেননি বাবলু, স্পেশ্যালি ওই ওবেসিটির ব্যাপারটা। কথাটা উনি যখন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছেন তখন এ বিষয়ে….’

বলেই থমকে যাই। মানে থমকাতে বাধ্য হই বললেই চলে!

বাপ রে! সে কী অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি, সে কী ভয়াল কুটিল চাউনি! মনে হচ্ছে আমাকে জ্যান্ত রোস্ট করা হবে নাকি কুচিয়ে ভর্তা করা হবে সে নিয়েই ভদ্রমহিলা সামান্য দ্বিধায় রয়েছেন। নইলে নরকের যে আঁচে আমার ইন্তেকাম হওয়া উচিত, সেখান থেকে একটা জ্বলন্ত নুড়ো এনে এক্ষুনি আমার মুখে গুঁজে দিলে ব্যাপারটা বেশ খোলতাই হতো বলে ওঁর ধারণা। একটু আগেই যাকে হেলেন অফ ট্রয় মনে হচ্ছিলো, এখন তাকে গডেস অফ ভয় বলেই বেশী ঠাহর হতে থাকে।

এতক্ষণে বাবলুকুমারের টনক নড়ে। দু’মিনিটে ফটাফট দেড়শো গ্রাম পনীর ওজন করে, আমার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে, পেমেন্ট নিয়ে চাপা, খুনী স্বরে দুটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে, ‘দাদা, ফুটুন।’

আমিও ফুল হয়ে ফুটে যাই। এপ্রিল ফুল হয়ে, এই ঘোর বসন্তেই। প্রেম যে এত হিংস্র আর অসহিষ্ণুহতে পারে তা এদের না দেখলে জানতেই পারতুম না! হায়, এ মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ না…

এই ভাবতে ভাবতে কাউন্টার ছেড়ে চলে আসছি, এমন সময় সেই বাবলুকুমারীর শেষের কথা গুলো শুনে পা’দুটো ভারখয়ানস্কের তুষারাবৃত উপত্যকার বুকে নাছোড় আইস অ্যাক্সের মতই আটকে গেলো।

স্বকর্ণে শুনলাম সেই মোহিনী আমাদের নধরকান্তি নদের নিমাইকে স্বাস্থ্যসম্বন্ধিত সৎপরামর্শ দিচ্ছেন, ‘ব্রেকফাস্টমে ইয়ে সব পুরি সবজি, মিঠাই ওগ্যারাহ খানা বন্ধ করনা পড়েগা বাবলুজী। মতলব আগর আপ ইয়ে রিলেশন কে বারে মে সিরিয়াস হ্যায় তো।’

কোন সে দিগন্তের ওপার থেকে আমাদের ভোলাভালা ছেলেটার বিস্মৃতপ্রায় আবছা স্বর ভেসে এলো, ‘হাঁ হাঁ সঙ্গীতাজী। বোলিয়ে না, কেয়া কেয়া করনা পঢ়েগা। আপকো তো মালুম হ্যায়..’

‘মর্ণিং মে সির্ফ টু স্লাইস ব্রেড, উইদাউট বাটার। উসকে সাথ থোড়াসা কিউকাম্বার অ্যান্ড ক্যারট মিক্স…’

কেউ নিজের পায়ে কুড়ুল মারে, কেউ নিজের পা”টা কুড়ুলের ওপর মারে। ফলাফল একই।

আড়াইশো পনীর আর গাদাগুচ্ছের স্বাস্থ্যসম্মত সবজি সমেত বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুনি বাড়ির সামনে কোন বেরসিক হতভাগা মাইকে রোবিন্দসংগীত চালিয়েছে, ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে..এত পাখি গায়…’

বসন্ত, মাই ফুট!

 

 

সেলেব্রিথ্রি

বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে যে বছর আমি ইঞ্জিনিয়ারিঙের ডিগ্রি অর্জন করি, সেটা ছিলো ২০০২। তার একবছর আগে জনৈক আট্টা এবং তাহার সহযোগীরা বোধহয় খানিকটা অন্যমনস্ক হয়েই ওয়ার্ল ট্রেড সেন্টারে দু-দুটি সস্তার প্লেন ঢুকিয়ে দিয়ে এই মরজগতের যাবতীয় জিহাদিদের চোখে দোসরা তারেক বিন জিয়াদ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে পড়েছেন। তদুপরি হোপ এইট্টিসিক্স থেকে শুরু করে তারামায়ের পদাশ্রয়ী, ‘ভোটে বাইরের লোক নিয়ে আসা আমাদের ঐতিহ্য’খ্যাত বীরবিপ্লবী শ্রীসুভাষও মৃদুমন্দ হাস্যধ্বনিসহ ‘আহা, এহেন অসামান্য কাজ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতুম’ বলে এতদ্দেশীয় গুপ্তজিহাদিদের বিপুল হর্ষবর্ধন করছেন, এমন সময় আমরা, মানে কলেজে আমাদের ব্যাচের শচারেক ইঞ্জিনিয়ারিং এর লোকজন দেখলুম ভারি আতান্তরে পড়েছি!

আগে গোটা ব্যাচের আদ্ধেক চাকরি করতে যেত, আদ্ধেক যেত উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে। সেই বাজারে আদ্ধেক নয়, আমাদের মতন গুটিকতক শিকেয়-ছেঁড়া-চাকরি প্রাপ্তদের ছেড়ে, বেশিরভাগ ক্লাসমেটই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগমনে ব্রতী হয়। এইখানে বলে রাখা ভালো যে এইরকম ”উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগমনের” ইচ্ছেঠাকুরুণ যে আমার মনেও বাসা বাঁধেননি তা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমার দৃঢ় ধারণা ছিলো আমার ফাইনাল মার্কশিট দেখে বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে যে বিপুল হাস্যরোল উঠবে, সেই কলতরঙ্গ যদি কোনক্রমে গঙ্গা পেরিয়ে এদিকে আসে, তো বাড়িতে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে ধোলাই অনিবার্য। জিআরই আর টোয়েফল পরীক্ষা দেওয়ার ফিজের টাকাটা যে পকেটে ছিলো না সেটাও ঘটনা বটে, আর বোনের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও ঘাড়ের ওপর ছিল, সেটাও মনে রাখতে আমি বাধ্য। তবে কিনা কাঁহাতক আর ‘ও গো, আমি কি গরীব আর অসহায় ছিলুম সে আর বলে বোঝাতে পারবো না’ বলে করুণাফুটেজ খাওয়া বিবেকে পোষায় মশাই?

তা আমার সেই সেই পুণ্যপদাশ্রয়ী বন্ধুবর্গ সেইসব বিশ্ববিশ্রুত বিদ্যালয়সমূহে, আণ্ডার দোজ হ্যালোওড পোর্টালস, অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়াছিলো। তারই দুচারিটি স্মৃতিকথা সামান্য ঝাড়পোঁছ করে আপনাদের সামনে রাখলুম। এ সবই যাকে বলে সুনি হুই কাহানিঁয়া, সুহৃদ পাঠকবর্গ প্রমাণ চেয়ে বুকে দাগা দেবেন না বলেই বিশ্বাস!

সেলেব্রিওয়ানঃ

ঘটনার নায়িকা আমার এক অনিন্দ্যসুন্দরী বান্ধবী। না, তাই বলে অমন সন্দেহনয়নে তাকাবার কিছু হয়নি। উচ্চতায় ফুটচারেক,(এবং প্রস্থেও তদ্রূপ) সেই বীরাঙ্গনাটিকে আমরা কলেজেই ঝাঁসির রানীর দ্বিতীয় সংস্করণ বলে অভিহিত করতাম। বস্তুত, পান থেকে চুনের ফেঁটামাত্রেক উৎক্ষেপণে তেনার যা যা রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখেছি সে আর কহতব্য নহে। জাত্যংশে রাজপুতানি সেই রায়বাঘিনীর আঁচরের কিছু দাগ এই অধমের শ্রীথোবড়াতেও রয়ে গেছে স্বীকার করতে লজ্জা নেই।

তাই সেই তিনি তখন অনেকানেক মহাত্মার হৃদয়ে বিরহবেদনা উদ্রেককান্তে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে একটি ফুল স্কলারশিপ বাগিয়ে হেথায় সগৌরবে পাড়ি দেন, এই ঘটনা তখনকার।

নেহাত অপ্রয়োজনীয়ই হবে, তবুও এখানে বলে রাখা শ্রেয় যে ভদ্রমহোদয়া নিজেদের পড়াশোনার লেভেল নিয়ে সামান্য ওভারপ্রোটেক্টিভ ছিলেন। আর ফলিত গণিতবিদ্যায় মহিলাটির কিঞ্চিৎ বুৎপত্তি ছিলো। তিনি গেম থিওরি নামক একটি দুরূহ কিন্তু অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বিষয়ে কথঞ্চিৎ জ্ঞানবর্ধনমানসে কালাপানির ওপারে পাড়ি জমান।

তা গিয়ে বোধহয় এক দুসপ্তাহ হয়েছে। মোটামুটি তখনও গুছিয়ে বসা হয়নি। এক বিকেলে তিনি ক্যাম্পাসে হাঁটতে বেরিয়েছেন। খানিকক্ষণ পর তিনি আবিষ্কার করেন যে তেনার কফিতেষ্টা পাচ্ছে বেশ।

তা টুকটুক করে ক্যাম্পাসের মধ্যেই যে কফিশপটি আছে সেখানে গিয়ে দেখেন যে এক আজব দৃশ্য!

কফিশপের কাউন্টারের সামনে প্রচণ্ড রোগা এবং তালঢ্যাঙা লম্বা এক ভদ্রলোক কফি, চিনি, দুধ এসব নিয়ে খুবই চিন্তাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার বন্ধুনিটি কাছে গিয়ে বুঝলেন ভদ্রলোক কফিতে কতটা চিনি এবং দুধ মেশালে ব্যাপারটা খোলতাই হবে সেসব নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বিড়বিড় করছেন নিজের মনেই, একবার চিনির পরিমাণ মাপছেন, আরেকবার চামচ তুলে নিয়ে কিসব ভাবছেন, মোটামুটিভাবে উনি কফি বানাচ্ছেন না পরমাণু বোমা হাবভাব দেখে বোঝার জো নেই!

আগেই বলেছি, ভদ্রমহোদয়া খানদানি রাজপুতানি, এইসব ছল্লিবল্লি তেনার বিলকুল নাপসন্দ। তিনি বোধহয় কফিশপের সেলসমহিলাটির চোখে ফুটে থাকা সশ্রদ্ধ সম্ভ্রমটি খেয়াল করেননি, কাছে গিয়ে পেছন থেকে সামান্য রূঢ়ভাবেই বলেন ‘বলি একটু না সরে দাঁড়ালে বাকিরাই বা কফি নেবে কি করে মশাই? আমরাও তো লাইনে আছি নাকি?’

ভদ্রলোক থতমত খেয়ে, ”এহেহে ভুল হয়ে গেছে, কিছু মনে করবেন না ভাই” টাইপের মুখ করে এদিকে ঘুরে দাঁড়ান, এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই চার ফুটিয়া মেয়েটির চোখ এবং ছফুটের ওপর লম্বা ভদ্রলোকটির বুক একই সমান্তরাল রেখায় চলে আসে, এবং মহিলার চোখের সামনে ভদ্রলোকের শার্টে আটকে থাকা পরিচয়জ্ঞাপক ব্যাজটি পরিস্ফুট হয়।

সেই ব্যাজে লেখা, ‘প্রফেসর জন ন্যাশ, প্রিন্সটন ইউনিভ’!

ফলিত গণিতবিদ্যার যে কোনও ছাত্রছাত্রীর পক্ষে এরপর দুম করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তার বদলে সেই রাজপুতকন্যাটি যা শুরু করে তাকে ইংরেজি ভাষায় নুইসেন্স ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সে ‘ও মাই গড জন ন্যাশ, ইউ আর জন ন্যাশ, মাই গুডনেস জন ন্যাশ ইন ফ্রন্ট অফ মি, ও মাই গড, ইউ আর জন ন্যাশ’ বলে মহা শোরগোল তুলে ফেলে। পরে সে অবশ্য স্বীকার করেছিলো যে ভদ্রলোকের মানসিক স্থিতির কথা ভেবে কাজটা উচিৎ হয়নি। কারণ এরপর ভদ্রলোক নাকি ভারি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, এবং ‘আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি দ্যাট আই অ্যাম জন ন্যাশ, ইট উইল নেভার হ্যাপেন এগেইন’ বলতে বলতে উল্টোবাগে দৌড় দেন!

বন্ধুনীটির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এরপর নাকি গেম থিওরির মোস্ট সেলিব্রেটেড পার্সোনালিটি, ”আ বিউটিফুল মাইণ্ড” খ্যাত নোবেল লরিয়েট প্রফেসর জন ন্যাশ পাক্কা দুদিন বাড়ির বাইরে বেরোননি!

সেলেব্রিটুঃ

এই ঘটনাটি টাইম অ্যান্ড স্পেসের কোন অনির্দেশ্য বিন্দুতে ঘটিয়াছিল তার বিশদ বিবরণ, বা কলাকুশলীদের নামধাম পুরোপুরিভাবে খুলে বলতে একটু অসুবিধে আছে। কারণ যাঁরা এই ঘটনার নায়কনায়িকা, সেই দুই কত্তাগিন্নিই নাসাতে উচ্চপদে কর্মরত, শুধু এটুকু বলতে পারি, তেনারা কেউই বঙ্গসন্তান নন।

তা স্থান, বলেই ফেলি, মিশিগানের এক ইউনিভার্সিটি। কাল, এক মেদুর বিকেলবেলা। উপরোল্লিখিত কত্তাগিন্নি ঠিক করলেন অনেকদিন হলো শরীরচর্চাতে ছেদ পড়েছে, একটু হাত পা খেলিয়ে না নিলে আর চলছে না! এই ভেবে তাঁরা ইউনিভার্সিটির স্যুইমিং পুল, যা আড়েবহরে যেকোনও অলিম্পিক পুলকে গুনে গুনে দশ গোল দিতে পারে, সেখানে স্যুইমিং কস্ট্যুম পরেটরে হাজির!

তা দুইজনেই যাকে বলে খাতেপিতে ঘরকে লোগ। ফলে সেই হোঁদলকুতকুত দোঁহাতে যখন পুলে বডি ফেললেন, ছোটখাটো একটা প্রলয়ই হয়ে গেলো প্রায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সুচিন্তিত বয়ান অনুযায়ী, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে মাঝেমধ্যে হারিকেন হলে আতলান্তিকে অমন অতলান্তিক ঢেউ ওঠে বটে। আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, সভয়ে অনেকেই পেছনে সরে গেলেন, ডাঙায় দাঁড়িয়েও নাইতে কারই বা ভালো লাগে বলুন?

তা দুইজনে বেশ করে নেয়েটেয়ে যখন উঠলেন, পুলের আদ্ধেক জল তখন চারিপাশের মেঝেতে ঢেউ খেলছে। তেনারা নিজেদের পারফরমেন্সে ভারি পরিতৃপ্ত হয়ে, স্যুইমিং কস্টিউমের ওপর তোয়ালেস্যুট জড়িয়ে আশেপাশের পুল।পরিদর্শনে বেরোলেন।

তা পাশের পুলে গিয়েই তেনারা আটকে গেলেন। একজন সাঁতারু ছাড়া আর কেউ নেই। তা সেই সাঁতারু ছোকরাটির বয়েস কুড়ির আশেপাশেই হবে, পেটানো পেশীবহুল শরীর, লম্বাটে মুখ। পাশে আরেকজন প্রৌঢ়, তাঁরও বেশ নজরকাড়া স্বাস্থ্য। প্রৌঢ়টি কোচ বা ট্রেইনর হবেন। ছেলেটি মাথা নিচু করে প্রৌঢ়টির কিছু উপদেশ শুনছে। উপদেশশ্রবণ শেষ হলে ছেলেটি ধীরেসুস্থে স্টার্টিং পয়েন্টে এসে দাঁড়ালো, এবং পুলে ঝাঁপ দিলো।

একফেঁটা জল উপচে পড়লো না, বিশেষ কোনও তরঙ্গ উঠলো না, মনে হলো একটি অভিজ্ঞ স্যামন কি কাতলামাছ যেন দ্বিপ্রাহরিক আহারান্তে পাড়া বেড়াতে বেরুলেন!

আমাদের দাদাবৌদি জুটি তো খুবই ইম্প্রেসড! দুইজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন আর মোহিত হতে লাগলেন। আহা, কি স্পিড, কি স্ট্যামিনা, কি অনায়াস মসৃণ ছন্দ। দুইজনেই খানিকক্ষণ বাদে আর থাকতে না পেরে, ‘বাহ বেটা, শাব্বাশ, জিতে রহো, নাজুক নাজুক’ ইত্যাদি বিভিন্নপ্রকার প্রশংসাসূচক এবং উৎসাহব্যঞ্জক শাবাশি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন। একবার তো ‘তণখা বঢ় জায়েগি তুমহারি’ বলতে গিয়েও চেপে গেলেন, বলা যায় না, পুল থেকে উঠে স্যালারি ইনক্রিমেন্টের চিঠি চেয়ে চেপে ধরলে?

তা দুইজনে তো যাকে বলে খুবই উত্তেজিত, ভাবছেন এমন চৌখস ছেলে এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে আগে তো জানতেন না। এমন সময় দেখলেন যে প্রৌঢ় ট্রেইনর ভদ্রলোক ওঁদের পাশেই দাঁড়িয়ে।

এঁরা তো দুইজনে ভদ্রলোককে ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন, আহা, কি তৈরি করেছেন ছেলেটাকে চাবুক, চাবুক! ভদ্রলোক অবশ্য ঘাড়ফাড় নেড়ে ‘আমি তেমন কিছুই করিনি’ বলতে চেয়েছিলেন, এঁরা শুনলে তো। তা সেই প্রবল প্রশংসাসুনামি থামলে দুইজনেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এমন ছেলেকে তো আরও বড় এরেনাতে প্রেজেন্ট করা উচিৎ, তাই না?’ ভদ্রলোক চিন্তিত মুখে বললেন, ‘বড় এরেনা? তা হবে, বড় এরেনাতেই ও সাঁতার টাঁতার কাটে’। শুনে দুইজনে আরও খুশি, ‘বাহ বাহ, বেশ বেশ। তা প্রাইজটাইজ কিছু পেয়েছে?’

শুনে ট্রেইনর সাহেব গভীর ভাবনায় ডুবে যান, এবং কর গুনে বিস্তর হিবেসনিকেশ করে খানিকক্ষণ পরে জানান, ‘তা ধরুন, এখনও অবধি মাইকেলের ষোলখানা অলিম্পিক মেডেল আছে, প্রাইজ হিসেবে খারাপ নয়, কি বলুন?’

সেলেব্রিথ্রিঃ

এই ঘটনাটিও আমার এক বন্ধুর। বন্দোপাধ্যায় উপাধিধারী ভদ্রলোকের পিতৃদত্ত নামটি চেপে গেলাম, কবে ফট করে নোবেল কি ফিল্ডস প্রাইজ পেয়ে যাবে, তখন এইসব কুচ্ছো ছড়াবার দায়ে পুলিস যদি আমাকে যদি দায়রায় সোপর্দ করে? তাছাড়া ইনি এমনিতেও খুবই লাজুক মানুষ, ফট করে গাঁজাখুরি গপ্পতে নায়ক হয়ে পড়াটা কিভাবে নেবেন বোঝা যাচ্ছে না!

তা ঘটনাটি যখন ঘটে তখন ভদ্রলোক ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, অস্টিনে পাঠরত। চলতি কথায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউটি,অস্টিন নামেই বিখ্যাত।

এই অসামান্য প্রতিভাধর বন্ধুটি অত্যন্ত দুর্বল, ক্ষীণতনু এবং কথাবার্তায় সামান্য ন্যাকা হওয়ার কারণে আমাদের কাছে খুবই প্যাঁক খেতেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার পর তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেলো। জনশ্রুতি এই যে এক নীলনয়না স্বর্ণকেশীর প্ররোচনায় তিনি জিমে যাতায়াত শুরু করেন এবং অত্যল্পকালের মধ্যে তার ঈপ্সিত সুফল দেখা দিতে শুরু করে।

তা এক প্রসন্ন বিকেলে বাঁড়ুজ্জেমশাই নিত্যনৈমিত্তিক পালোয়ানি কসরতান্তে ফিল করলেন যে শরীর তখনও কিছু চাইছে। অন্যভাবে নেবেন না কথাটা, মানে আরও খানিকক্ষণ গা ঘামাতে ইচ্ছা যাচ্ছে আর কি। তা ইতিউতি চেয়ে দেখলেন সামনেই ইউনিভার্সিটির টেনিস কোর্ট। যদিচ ভদ্রলোক কোনওদিন লুডোর বেশি কিছু খেলেননি, তবুও মনে করলেন যে দেখাই যাক না, এমন আর কি ব্যাপার, র‌্যাকেট দিয়ে বল পেটানোই তো, এর বেশি তো কিছু নয়। এই চিন্তা করে উনি ‘জয় বাবা বরিসনাথ’ তিনবার আউড়ে স্ট্রেট ঢুকে পড়লেন।

তা ঢুকে তো পড়লেন, গিয়ে দেখেন আর কোত্থাও কেউ নেই, কেবল একটি বছর বাইশের ছেলে, ছ ফুটের ওপর লম্বা, পেশীবহুল শরীর, একা একাই দেওয়ালে বল মেরে মেরে খেলছে। বলা বাহুল্য, ব্রাত্য সর্বহারাদের প্রতি বাঙালিদের একটা ন্যাচারাল সিমপ্যাথি আছেই, ফলে বাঁড়ুজ্জেবাবুর বুকটা এই একলা একলা খেলে যাওয়া সঙ্গিহীন শিশুটির দুঃখে হু হু করে উঠলো। তিনি একটা টেনিস র‌্যাকেট তুলে গলা খাঁকারি দিয়ে ছোকরাকে ডেকে বললেন, ‘আরে এই যে ভাই, তুম একলা একলা কিঁউ খেল রাহা হ্যায়? মেরে সাথ একদান খেলোগে?’

তখন খানিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছে, শেষ বিকেল। বন্ধুবর দেখলেন সে ছোকরা ভারি খুশি হয়ে ‘আরে কি সৌভাগ্য, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আসুন কত্তা একহাত হয়ে যাক ‘ বলে র‌্যাকেট হাতে কোর্টের অন্যপ্রান্তে দাঁড়ালো। আমাদের শ্রীবন্দোপাধ্যায় চলো কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই স্টাইলে র‌্যাকেট হাতে এপাশে দণ্ডায়মান হইলেন।

তা সে ছোকরা বোধহয় কিঞ্চিৎ শ্যাডো প্র্যাকটিসের মুডে ছিলো। বাঁড়ুজ্জেবাবু স্পষ্ট দেখলেন যে ছোকরা হাতও ওপরে উঠলো, র‌্যাকেটও নেমে এলো, কিন্তু কই, এদিকে তো বলটল কিছু এসে পৌঁছলো না! শ্যাডোই হবে, ভেবে ঈষৎ অন্ধকারে চোখটোখ কুঁচকে বাঁড়ুজ্জেবাবু ফের মনোনিবেশ করলেন।

ফের ছোকরা শ্যাডো করলো, সেই একই কেস, হাত উঠলো র‌্যাকেটও নামলো কিন্তু আমাগো বাবুর কাসে তো দেহি কিসুই আইয়া পৌঁসায় না!

চতুর্থবার শ্যাডো দেখার পর বাঁড়ুজ্জেবাবু খেয়াল করলেন, তাঁর রক্তে ঘুমন্ত বিদ্রোহী বাঙালটি আড়মোড়া ভাংছে। কাঙাল বলে হেলা করলেও করতে পারিস, তোরা হলি গে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী জাত। তা বলে বাঙাল বলেও হেলা? তোর ঘাড়ে কটা মাথা রে সোনামণি ?

পঞ্চমবারের বার সত্যিই ওঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। বড়দের সঙ্গে ফাজলামি হচ্ছে? বাড়িতে মা বাবা কি শিক্ষাই দিয়েছে, ছ্যাঃ! শিক্ষাদীক্ষা সংস্কার সভ্যতা, এ ছোকরা দেখা যাচ্ছে কিছুই শেখেনি! তিনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে হাতছানি দিয়ে ছোকরাকে নেটের কাছে আসতে বললেন। সে ছেলে সামান্য অবাক হয়ে বিনীতভাবে কাছে এসে দাঁড়াতেই তিনি চোখ পাকিয়ে বজ্রাদপি কঠোর ন্ট্রে ক্রোধে ফেটে পড়লেন, ‘এইও, তোমার তো দেখ রাহা হ্যায় যে খেলার কোনওরকম ইচ্ছাই নেহি হ্যায়! এতক্ষণ ধরে কেবল শ্যাডোই কর রাহা হায়, শ্যাডোই কর রাহা হ্যায়। হামকো কেয়া উজবুক সমঝা হ্যায় রে ব্যাটা?’

তা ধমকটমক শুনে সে ছোকরা কানটান চুলকে বললো, ‘ ক্যানো? শ্যাডো ক্যানো করবো? পাঁচটাই সার্ভিস করলুম তো, তুমি দেখতে পাওনি?’

শুনে বন্ধুবর তো স্তম্ভিত! মানে? প্রত্যেকবার ছেলেটি যে র‌্যাকেট নামিয়ে এনেছে তা হাওয়ায় হাওয়ায় নয়?

এতক্ষণে তাঁর হৃদয়ঙ্গম হয় যে আগের পাঁচবারই সার্ভই করা হয়েছে বটেক, কিন্তু তার যা অসামান্য গতি, বন্ধুবরের নশ্বর চোখে ধরা পড়ে নাই! তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কোর্টের বাইরে ইতোঃনষ্ট স্ততভ্রষ্ট অবস্থায় সেই পাঁচটি আগুনে গোলা পড়ে আছে!

খুব স্বাভাবিক ভাবেই খেলার আর মানে থাকে না এরপর, ওরকম বেগে একটা গোলা যদি বুকে বা মুখে এসে লাগে? তাছাড়া বেশ সন্ধেও হয়ে এসেছে তখন। বন্ধুটি র‌্যাকেট বগলে গুঁজে প্রথামাফিক নেটের ওপরে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠেন ‘ হেঁ হেঁ, কিছু মাইণ্ড নেহি করনেকা বাছা, বয়েস হয়েছে কিনা, চোখে সবকিছু আচ্ছাসে ঠাহর নেহি হোতা হ্যায়। তবে তুমহারা সার্ভিসমে বেশ জোর হ্যায় দেখছি। চালিয়ে যাও হে, কালেক্কে তুম লায়েক হোয়া, ইয়ে হামকো স্পষ্ট দেখতা হ্যায়। মেরা নাম বন্দোপাধ্যায়, ******* বন্দোপাধ্যায়’।

সে ছোকরা ভারি ভদ্র ও বিনয়ী বলতেই হবে, কারণ এর পরে সেও লাজুক হেসে হাত বাড়িয়ে বন্ধুর হাতটা খপ করে ধরে অমায়িক স্বরে নিজের পরিচয় দিলো,

‘আয়্যাম রডিক, অ্যাণ্ডি রডিক!’