- বইয়ের নামঃ কাউরীবুড়ির মন্দির
- লেখকের নামঃ অভীক সরকার
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, কল্পকাহিনী
কাউরীবুড়ির মন্দির
০. উৎসর্গ / ভূমিকা
উৎসর্গ
যিনি প্রথম আমাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন৷
আমার বড়মা স্বর্গতা মহামায়া সরকারের স্মৃতিতে৷
.
ভূমিকা
ভূমিকায় একটি কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে প্রথমে আমি উপন্যাস হিসেবে নয়, চেয়েছিলাম একটি বড় গল্প লিখতে৷
দুহাজার উনিশের অক্টোবর নাগাদ এক প্রসন্ন প্রভাতে দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার রূপাদি আমাকে ফোন করে বললেন পৌষ সংখ্যার জন্য একটি বড় গল্প লিখে দিতে৷ গরীবের কপালে এসব সৌভাগ্য কালেভদ্রে জোটে৷ আমিও কৃতজ্ঞথরথর চিত্তে তৎক্ষণাৎ ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে ফেললুম৷
কিন্তু ম্যান প্রপোজেস, গড ডিজপোজেস বলে একটা দামি কথা আছে৷ গল্পটা বেশ জমিয়ে সূত্রপাত করতে গিয়ে দেখি তাতেই শব্দসংখ্যা ছড়িয়ে চৌষট্টি! এরপর যতই এগোই গল্পের ধরতাই মোটামুটি এরিয়াডনের কুখ্যাত সুতোর বলের আকার নিতে থাকে৷ সে জটিল জাল উদ্ধার করতে শেষমেশ থিসিয়াসকে আসতেই হল৷ আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷
এখানে বলে রাখা ভালো কাহিনিগঠনের দিক থেকে এই গল্পটি আমার আগমবাগীশ সিরিজের অন্য গল্পগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা৷ কোনো প্রাচীন অভিশাপ বা অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো কাহিনি নয়, এই কাহিনির মূল উপজীব্য হল যৌন ঈর্ষা৷ একজন পুরুষের ওপর কামনার অধিকার নিয়ে দুই মানবীর দ্বন্দ্ব৷ তার প্রেক্ষাপটে রয়েছে উত্তর আসামের প্রাচীন জনজাতি দেওরিদের একটি শাখা পাতরগোঁয়্যাদের হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস, তাদের শিউরে ওঠা ধর্মীয় আচার৷ রয়েছে জঙ্গলের মধ্যে জেগে থাকা এক মন্দির, তাকে ঘিরে থাকা অজস্র মিথ৷
আর রয়েছে সেই মন্দির ঘিরে থাকা কাউরীদের দল৷
এখানে একটি কথা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার যে পাতরগোঁয়্যাদের ইতিহাস সংক্রান্ত অংশটি সম্পূর্ণরূপে আমার কল্পনাপ্রসূত, বাস্তবের সঙ্গে এর দূর দূর অবধি কোনো মিল নেই৷ একই কথা বলা যায় তাদের ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত ঘটনাবলী নিয়ে৷ পাতরগোঁয়্যারা সত্যিই দেওরিদের একটি হারিয়ে যাওয়া উপজাতি, এই তথ্যটুকু ছাড়া বাকি সমস্ত তথ্যাবলী আমার স্বকপোলকল্পিত, তাকে সঠিক বলে মেনে নিলে তা সত্যের অপলাপ হবে৷
কাহিনিটি শেষ পর্যন্ত একটি পঁয়ত্রিশ হাজার শব্দের উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়, এবং আমার সমস্ত আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে উপন্যাসটি রূপাদির পছন্দও হয়৷ যেদিন রূপাদি ফোন করে জানালেন যে তাঁরা এটি বই আকারে প্রকাশ করতে চলেছেন, স্বীকার করতে বাধা নেই সেদিন সত্যিই গায়ে কাঁটা দিয়েছিলো৷ জ্ঞান হওয়া ইস্তক যে প্রকাশনীর বই পড়ে আমার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়েছে, সেই ঐতিহ্যশালী দেব সাহিত্য কুটির থেকে আমার লেখা বই প্রকাশিত হবে সে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি৷ পূর্বপুরুষদের অসীম সুকৃতি ছাড়া এ সৌভাগ্য সম্ভব নয়৷
আপাতত আমার প্রাককথনের নটে গাছটির মুড়োলো৷ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি কোনো লেখা যে মুহূর্তে বই হিসেবে পাঠকের হাতে পৌঁছোয়, সেই মুহূর্ত থেকে তার মালিকানা পাঠকের৷ তিনি পড়েন বলেই লেখক লেখেন, নইলে মিথ্যে হতো সন্ধ্যাতারা ওঠা, মিথ্যে হতো কাননে ফুল ফোটা৷ আশা করি আমার আগের বইগুলির মতো এই উপন্যাসটিকেও পাঠককূল সাদরে গ্রহণ করবেন৷ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়ার আশায় রইলাম৷ আপাতত এখানেই বিরতি দিচ্ছি৷ অলমতি বিস্তারেণ, নমস্কার৷
অভীক সরকার
১৬ ডিসেম্বর ২০২০
১. নিবিড় ও গহিন অরণ্যের মধ্যে
নিবিড় ও গহিন অরণ্যের মধ্যে এক গাঢ় নিস্তব্ধ রাত৷ চারিদিক ছেয়ে আছে আদিম বনজ নৈঃশব্দ্যে৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই, প্রাণের কোনো সাড়া নেই, সময় এখানে মৃত, জীবন এখানে স্তব্ধ৷
অরণ্যের মধ্যে একটি অতি প্রাচীন মন্দির৷ তার আদিম পাথুরে গায়ে খোদাই করা আছে শতাব্দীপ্রাচীন অজানা ইতিহাসের প্রলেপ৷ সেই পাথরের গায়ে এই প্রাগৈতিহাসিক আদিম বনভূমির ছায়া এসে পড়ে, এসে পড়ে চাঁদের অপার্থিব জ্যোৎস্না৷ তারা ফিসফিস করে বলে যায় কত অজানা গল্প, কত গোপন দীর্ঘশ্বাসের কাহিনি৷
সেই মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ রয়েছে একটি অদ্ভুত মূর্তি, আমাদের চেনা মূর্তির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ মূর্তির সামনে জ্বলছে দুটি বড় বড় প্রদীপ৷ প্রদীপ দুটির মধ্যস্থলে বজ্রাসনে বসে আছেন একজন নারী৷ নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো অচঞ্চল তিনি৷ তাঁর শুষ্ক শানিত মুখে ক্লান্ত আনন্দশৈথিল্য৷ অনেক দুঃসাধ্য উপাসনার শেষে আজ তিনি জয়ী, আজ তিনি সিদ্ধ৷
‘‘মাই…তুই এসেছিস মাই?’’ নিজের মাতৃভাষায় ধীর ও শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন তিনি, জনহীন অরণ্যের বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ খেলে গেল অক্ষরমালাগুলি৷
কিছুক্ষণের স্থির স্তব্ধতার পর অন্ধকার রাত্রির বুক চিরে, পাতালের গহিন থেকে, অজানা নক্ষত্রলোক থেকে উঠে এল এক অলৌকিক অপার্থিব খনখনে স্বর—
‘‘আমাকে কে জাগালি রে মেয়ে? কে তুই?’’
‘‘আমি তোর দেওরি রে মাই৷ তোর মেয়ে৷’’
‘‘কী চাস মেয়ে? কেন জাগালি আমাকে?’’
‘‘আশীর্বাদ চাই মাই, নাগযক্ষিণীর আশীর্বাদ৷’’