কোনও ইন্দ্রজাল নয়
সকল সময় নয়, মাঝে মাঝে তাকে মাঠে কিংবা
পার্কে দেখা যায়, একা একা
হাঁটেন, ভাবেন কী-যে সে-কথা জানে না কেউ, শুধু
অনুমান করে নেয় যে যার ধরনে। মনে হয়
কারও সঙ্গে বাক্যালাপে নন তিনি তেমন আগ্রহী। বোঝা যায়
বয়স হয়েছে বেশ, স্বাস্থ্যে ঘুণ ধরেছে আগেই।
যতদূর জানি, তিনি কখনও সবুজ গাছ, ঘাস, কখনওবা
নীল পাখি হয়ে যান, কোনও কোনও গাঢ় সন্ধ্যারাতে
জ্বলেন নেভেন জোনাকির রূপে আর
কখন যে পথের কুকুর হয়ে শহরের অলিতে গলিতে
একলা ঘোরেন মধ্যরাতে, পথিক পায় না টের। কখনওবা
প্রজাপতি হয়ে যান চোখের পলকে। এমনও তো হয়, তার
দু’টি চোখ ময়ূরের চোখ, মাথা ঈগলের হয়ে যায় আর
প্রবেশ করেন তিনি নিমেষেই কোনও কুষ্ঠরোগীর ভেতর।
হয়তো আহার করছেন বসে ডিনার টেবিলে
কারও আমন্ত্রণে চারু পরিবেশে, অকস্মাৎ হয়ে যান তিনি
শীর্ণকায় ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক; কখন যে
মৎস্য শিকারির কায়া করেন ধারণ, পুনরায়
জালবন্দি সামুদ্রিক মাছ রূপান্তরে, বোঝা দায়।
এই তো চরম ভোগী তিনি,
পরমুহূর্তেই তার পরম ত্যাগীর ভ্রাম্যমাণ সত্তা ফোটে এই ভাবে।
ভেবো না এসব ইন্দ্রজাল কোনও, এ পক্রিয়া
বাস্তব ডিঙিয়ে যাওয়া অপর বাস্তব
যার স্পর্শে কারও কারও চেতনাপ্রবাহে
পদ্মের মতোই ভাসমান কুললক্ষণ কবির।
১০.১.৯৯
খাতা আর কলমের বিবাদ
এই যে সারাটা সকাল আমার খাতার একটি খাঁ খাঁ পাতা
আর কলমের মধ্যে শুরু হ’ল রেষারেষি, তুমুল বাকবিতণ্ডা,
কে থামাবে এই হৈ হুজ্জত, এই চোখ রাঙানি, দাঁত-কটমটে
এই লড়াই? খাতার শাদা পাতা চায়, তার ধু ধু শূন্যতা শোভিত
হোক সবুজ লতাপতা, গোলাপ, চামেলি, লাল নীল পদ্ম,
আকাশের উদার নীলিমা, ঘাসবন, আর বাঁশবনের গাঢ় সবুজ
প্রিয়তমার দৃষ্টির কোমলতা, যা দিঘীসদৃশ, আর কোজাগরী
পূর্ণিমার ভরাট স্তব্ধতায়। অথচ আমার কলম আজ ভোরবেলা
শূন্য পাতার এই আবদারকে আজ এক বিন্দু আমল দিতেও
নারাজ। ঘাড় বাঁকিয়ে সে জেদ ধরেছে, খস্ খস্ করে লিখে
যাবে এমন কিছু পঙ্ক্তি যেগুলোয় থাকবে পাড়াগাঁ আর
শহর-ডোবানো হিংস্র খলখলে জল, মরা পশু, কলাগাছের
ভেলায় ভেসে-বেড়ানো, সর্বস্ব-হারানো মানুষ, দুঃখিনী
মায়ের বুকলগ্ন মৃত শিশু, বিপন্ন মানুষের উপচে-পড়া সকল
আশ্রয় কেন্দ্রের সাহায্য প্রার্থী ব্যাকুল, থরথর হাত,-
যেখানে ধর্ম, গোত্র, রাজনৈতিক আদর্শ বিচারের না-হক
বিলাসিতা গরহাজির; প্রলয়প্রতিম বিপর্যয়ে বিপন্ন মানুষ
শুধুই মানুষ। জেদী কলমের কথা শুনে আমার খাতার শূন্য পাতার
চোখ থেকে বেদনাশ্রু ঝরতে থাকে, যেন সে লখিন্দর-হারানো
বেহুলা, খাতার শূন্য পাতার বুকে ফুটতে থাকে কলমের আঁচড়।
১৩.৯.৯৮
চাদর
গোধূলি রঙের মিহি নির্ভার চাদর গায়ে একজন যোগী
এলেন আমার ঘরে খুব নিরিবিলি। আমি ছাড়া
জানতে পারেনি কেউ; আমার চেয়ার আর কেঠো
খাটকে উপেক্ষা করে মেঝেতে গায়ের
চাদর বিছিয়ে বসলেন। মুখে তার কথা নেই, উদাসীন
দু’টি চোখে যেন বহু শতাব্দী নীরবে
ক্রীড়াপরায়ণ, শীর্ণ, ঋজু শরীরের এক ধরনের দ্যুতি
আমাকে জাগ্রত করে। তাকালেন তিনি
সারি সারি পুস্তকের দিকে, ঠোঁটে তার মৃদু হাসি
ফোটে, সে হাসিতে কী-যে ছিল ঠিক বুঝতে পারিনি।
ছিল কি অবজ্ঞা কিছু? না কি উপহাস? ছদ্মবেশী তামাশার
আভাস ছিল কি কোনও? প্রজ্ঞা-উদ্ভাসিত মন তার কখন যে
কোন্ ছন্দে দুলে ওঠে, বোঝা দায়। উচ্চারণহীন
কোন্ কথা আমাকে বোঝাতে চান তিনি,
কী করে বুঝব এই অবেলায়? তবে কি আমার
সকল পুস্তক-পাঠ, সন্ধান, যা-কিছু
সামান্য অর্জন, সবই ব্যর্থ? বেদনার অস্তরাগ
আমাকে দখল করে। যোগী টেবিলের কাছে এসে আস্তে
আমার সকল পাণ্ডুলিপি, অমুদ্রিত কবিতা সংগ্রহ হাতে
তুলে নিয়ে একে-একে পুড়িয়ে ফেলেন। মুখে তার
সুহাস কাঠিন্য আর বলেন নিষ্পৃহ কণ্ঠস্বরে,-
‘ভেঙেচুরে নিজেকে নতুন করো বারবার, বাহুল্যের ঝুঁটি
ছেঁটে ফেলে বুকে নিয়ে প্রকৃত শাঁসের অরুণিমা সৃজনের
পথে হাঁটো নিত্যদিন, ফোটাও মৃত্যুর ঠোঁটে সজীব কুসুম’।
অনন্তর যোগী তার চাদর আমার গায়ে জড়িয়ে নিভৃতে
বেরিয়ে গেলেন হেঁটে, উন্মুক্ত শরীরে কাঁপে রৌদ্র আজ জ্যোৎস্নার ঝালর।
২২.১১.৯৮
ছয়তলা বাড়ি
ছয়তলা বাড়ি, বড় একা, চুপচাপ
দাঁড়িয়ে রয়েছে, রুক্ষ দরবেশ যেন। মাঝে মাঝে
ওর খুব কাছে যাই, প্রবেশ করি না। প্রবেশের
পথ নেই, সিঁড়ি নেই কোনও।
বারবার কাছে গিয়ে দেখি, আলো নেই,
মানবের সংলাপের পাই না হদিশ
কান পেতে রাখলেও। সেখানে বাশিন্দা আছে কিনা,
বোঝা দায়। কখনও কখনও
আলো জ্বলে ওঠে, অকস্মাৎ দপ করে নিভে যায়। ভ্রন্তিবশে
পাখিও বসে না জানালায় কিংবা ছাদে।
এতবার ছয়তলা বাড়িটার খুব কাছে গিয়ে
দাঁড়িয়েছি, অথচ কখনও
অন্য কোনও পথিকের সাক্ষাৎ মেলেনি। কী আশ্চর্য
যখনই সেখানে যাই, ভোরবেলা, প্রখর দুপুর,
অথবা বিকেলবেলা, নিমেষে সন্ধ্যার
গাঢ় ছায়া নেমে আসে। মনে হয়, আমার পা দু’টো
চকিতে জমিনে কবরস্থ, আমি কেমন আলাদা হতে থাকি।
ছয়তলা বাড়িটার অন্তঃস্থল থেকে
রহস্যের কণ্ঠস্বর ছাড়া
আজ অব্দি অন্য স্বর শুনতে পাইনি।
১৯.১২.৯৮
জীবনের মতোই
একটি পূর্ণিমা-চাঁদ জেগেছিল হৃদয়ে আমার
দু’বছর নয় মাস আগে। সেই চাঁদের কোণায়
মালিন্য দিচ্ছে কি লেপে কিংবা কোনও ফেউ চেটে
পুটে দ্রুত করছে সাবাড়? আমি কখনও তোমার
সদ্য-লাশ ডিঙিয়ে জুয়োর ধোঁয়াময় টেবিলের
চতুর খিলাড়ি হবো কিংবা কোনও মদের আড্ডায়
সোৎসাহে শামিল হবো স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে কেন
পূর্ণিমায় যখন তখন লাগে কালিমার দাগ?
অকুণ্ঠ কবুল করি, আমার স্খলন আছে কিছু;
তোমার নালিশ তীর-বেঁধা পক্ষিণীর আর্তনাদ
হয়ে ঘোরে আমার মাথায়। যত দাও অপবাদ,
যত কষ্ট দাও, জানি সেই কষ্ট দ্বিগুণ তোমাকে
পোড়ায়, রক্তাক্ত করে দিনরাত। এ-কথা নিশ্চিত
জীবনের মতোই তোমাকে আজও তীব্র ভালোবাসি।
৭.২.৯৭