- বইয়ের নামঃ স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেচে আছি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
???
বিকেলের জাফরানি রোদে কলকাতা ক্ষণকাল
রূপচার্চা করে নেয় আনমনে আর
পথে যেতে যেতে খুব কাছ থেকে দেখি
বাগবাজারের চৌরাস্তায় গিরীশ ঘোষের বাড়ি
উদাস দাঁড়িয়ে আছে প্রবীণ স্তব্ধতা গায়ে মেখে। চারপাশে
তার কলরব বয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে; বড় একা,
নিশ্চুপ সে। কখনও কখনও মধ্যরাতে
বোধিদীপ্ত মদ্যপের মতো
নানা কথা বলে যায় অপরের শ্রুতির আড়ালে। কলকাতায়
ভোরের পা পড়লেই সেই বাড়ি স্তব্ধতায় ডোবে।
কোনও কোনও পথচারী নিঝুম বাড়ির
ভাষা বুঝে নেয় কোলাহলের মধ্যেও, শুনে ফেলে
নট আর নটীর সংলাপ আর গিরীশ ঘোষের
সুরাসিক্ত কণ্ঠস্বরে অক্ষরবৃত্তের পঙ্ক্তিমালা-
সেই পঙ্ক্তিমালা বাগবাজারের ঘরের, বাড়ির, শতকের
সীমানা ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে, সারা বাংলায় ছড়িয়ে যায়।
১১.১২.৯৮
অচিন মানুষ
ঘুমের ভেতর প্রায় রোজই এসে দাঁড়ায় কে এক
অচিন মানুষ; চেয়ে থাকে
প্রগাঢ় আমার দিকে কিছুক্ষণ, জাফরানি-রঙ
আলখাল্লা তার
হাওয়ায় ঈষৎ কাঁপে। বাউল বলেই চিনি তাকে,
হাতে একতারা, কাঁধে ঝোলা।
অনুরোধ করি না, তবুও কণ্ঠে মধুর খেলিয়ে দেয় সুর
অবলীলক্রমে, মুগ্ধতায় স্নান করে দেহমন।
ঘুমের ভেতর স্বপ্নে নাকি বাস্তবেই
এসে যায় সে বাউল আমার নিকট,
বোঝা দায়; শুধু আমি সুর হয়ে যাই
জাফরানি-রঙ আলখাল্লা আর একতারার কম্পনে, এই
বিশ্বাসে উদাস বাউলকে কখনও সাধক গুরু,
কখনও বান্ধব বলি, কখনওবা সখা।
আজ অব্দি একটিও কথা উচ্চারণ
করেন নি তিনি,
কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন
উদার দৃষ্টিতে, সেই দৃষ্টি স্পর্শ করে
অন্তরের পাতাল আমার, কখন যে তার সুর
আমার নিজেরই সুর হয়ে
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমকে আলিঙ্গন করে
তা বোঝার আগেই আমার
গায়ে জাফরানি-রঙ আলখাল্লা, হাতে একতারা,-
এবং আমার দ্বৈত সত্তা নক্ষত্রসভায় নৃত্যপর শুধু।
২৯.১২.৯৮
অনন্তের কোনও ছলাকলা
এই ছোট ঘর, এই প্রান্তিক বিনীত বুড়ো বাড়ি,
আবেগকম্পিত স্বরে বলে, ‘কখনও যেও না তুমি। এই গলি,
এই পথ সারাক্ষণ বলে, ‘কখনও যেও না তুমি। অনাথ
শিশু নিকেতনের দেয়াল, এই গাছ, শাখাশ্রয়ী পাখি, এই
গোলাপ, চামেলি, গন্ধরাজ, ক্যামেলিয়া
বলে বারবার,
‘আমাদের ছেড়ে তুমি কখনও যেও না। একজন মানবীর
প্রগাঢ় ব্যাকুল দু’টি চোখ বলে, তোমাকে দেব না যেতে, কবি।
আমি তো চাই না যেতে কস্মিনকালেও
এই প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে ছুড়ে অন্য কোনওখানে। নেই সাধ
কোনও লোভনীয় মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়াবার
পুরোনো গল্পের মোহে। এখানেই চিরকাল প্রাণের স্পন্দন,
ঝর্নার, ফুলের, প্রান্তরের, দিগন্তের,
নানান পাখির শোভা পেতে চাই। এখানেই চাই
দেখতে শিশুর হাসি, দয়িতার রূপ, চাই পেতে
বারবার গাঢ় আলিঙ্গন, চুম্বনের আর কবিতার স্বাদ।
অথচ অসীম নাস্তি শাসায় আড়াল থেকে, তীক্ষ্ণ অন্ধকার
কখনও সজীব ভোরবেলা, কখনও বিষণ্ন গোধূলিতে
ভীষণ খামচে ধরে; বিলুপ্তির ভাবনায় ঝটিতি তুষার-কণা ঝরে
মগজের কোষে কোষে। কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ি,
এবং খানিক পরে তোমার ছবির দিকে গভীর তাকিয়ে
কখনও বা কবিতার বই থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি
পড়ে ফের জীবনের স্পন্দিত শিরায় হাত রাখি, মনে হয়-
এই ঘর, এই দৃশ্যাবলী, বইপত্র, পদাবলী, এইসব প্রিয় মুখ
থেকে বিলুপ্তির শূন্যতায় কখনও মিশিয়ে দিতে
পারবে না অনন্তের কোনও ছলাকলা।
৬.১১.৯৮
অন্ধকারাচ্ছন্ন খেলা
এরই মধ্যে আমার বান্ধবদের ক’জনকে তুমি
কায়াহীন, ছায়াহীন করেছ হেলায়,
যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন খেলায়। এখন বারান্দায়
বসে আছি একা, বড় একা
ছড়িয়ে আবছা দৃষ্টি কিয়দ্দূরে। স্মৃতির প্যাঁচালো অলিগলি
ভেসে ওঠে- এর চোখ, ওর ঠোঁট, কারও হাত, কারও নাক,
কারও বা মাথার চুল, কিছু ছায়া-ছায়া কথা
মনে পড়ে। কেউ কি রেখেছে আস্তে হাত
আমার নিঝুম কাঁধে? কে আমাকে ব্যাকুল ডাকছে
ব্যালকনি থেকে? কার হাতে কম্পমান
কবিতার পাণ্ডুলিপি পাণ্ডুর জ্যোৎস্নায়? ফাঁকা পথে
কে একলা যাচ্ছে গেয়ে লালনের গান?
তুমি কি বাজাও ডুগডুগি অন্তরালে? সেই ধ্বনি
যে যাবে কেবল সে-ই শোনে। নাকি কোনও
কথাহীন কাহিনীর মায়ায় ভুলিয়ে
নিয়ে যাও দিকচিহ্নহীন পথে প্রত্যাবর্তনের অসম্ভবে?
একদিন আমাকেও তুমি নাস্তির আন্ধারে মুড়ে
নির্বিকার নিয়ে যাবে, কখন জানি না। কিছু হাহাকার আর
ভেজা চোখ পেছনে থাকবে পড়ে। তবে
এখনই করো না চুপিসারে আয়োজন
আমাকে হরণ করবার। আরও কিছুকাল এই
চেনা পৃথিবীতে থেকে নিজের গহনে ডুবে ডুবে
অরূপ রতন খুঁজে খুঁজে আর এই
গাছপালা, এই নদী, ফুল-পাখি, সবচেয়ে বেশি
প্রিয়জনদের মুখ বুকের ভেতর এঁকে নিতে চাই, আরও কিছু
কবিতা লেখায় মগ্ন থাকার সময় চাই হে কঠোর, নাছোড় তস্কর।
২৪.১১.৯৮
অভিন্ন মানুষ
অনেক অনেকক্ষণ ধরে সুদূরে চলেছি হেঁটে; অকস্মাৎ
মনে হ’ল, যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি। চারপাশে
বেবাক একই তো আছে-সেই
ঘরবাড়ি, সেই গাছ, সেই পথ এবং দোকানপাট, একই।
তাহ’লে এই যে সারারাত পথপরিক্রমা আর
বহুদূর যাওয়ার বিশ্বাস
হাত থেকে পাথুরে মেঝেতে ফস্কে-পড়া পিরিচের
মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? তাহ’লে কি এতক্ষণ শুধু
ছিল দৃষ্টিভ্রম নাকি নিজেকেই ভীষণ আটকে রাখা
ফাঁকির জন্মান্ধ ঊর্ণাজালে! এ বিভ্রম
থেকে মুক্ত হওয়া
কতটা সম্ভব আজ? দারুণ খরায়
বৃষ্টি হচ্ছে ভেবে পুলকিত আমি, অথচ বাইরে
বেরুলে পুড়তে থাকি চৈত্রের প্রখর চিতাগ্নিতে। অচিরেই
গায়ে ফোস্কা ফোটে,
ঠোঁটে ফেটে রক্ত ঝরে, চতুর্দিক থেকে
রাগী মোষ বাঁকিয়ে দুর্দান্ত শিং ধুলোম্লান পথে
তেড়ে আসে; গাছের পাতারা হয় শুয়োরের কম্পমান দাঁত!
দুপুরের ফতুর পুকুরে ঘুমে-হাঁটা
লোকের মতোই একজন জাল ফেলে;
নানারঙা কত যে মাছের মেলা তার এক্তিয়ারে
আসে আর উৎফুল্ল বাজারে নিয়ে যায়। মেলে ধরে
ক্রেতাদের সমুখে, সবাই বারবার
বিশদ পরখ করে বলে,-
সরাও তোমার মাছ এক্ষুণি, এসব
পচা মাছ কেনার মোটেও সাধ নেই আমাদের।
এ কেমন নিকিরি এখানে বসে আছে গোধূলিতে
নিঃসঙ্গ, বিমর্ষ, অবসন্ন? চুপচাপ, গালে হাত;
বাজারে কিছুই বিকলো না
বলে কি হতাশা তাকে ছুঁয়েছে এখন? কাছে গিয়ে
দেখি সে-তো অবিকল আমার মতোই। তাকে আমি
নিজের যমজ ভাই নিশ্চিত ঠাউরে
নিয়ে হাত রাখব ভায়ের হাতে? টেনে নেব বুকে?
বিস্ময়ের ঘোরে দেখি, আমি আর সে লোকটা অভিন্ন মানুষ।
১৮.১০.৯৮