- বইয়ের নামঃ হরিণের হাড়
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অদৃশ্য ছোরা
পর্যটনে কেটেছে সময়; হেঁটে হেঁটে কায়ক্লেশে
নিঃসঙ্গ ধূসরপ্রান্তে এসে গেছি। বসে থাকি একা,
অতীতের হাত কাঁধে, আমার চোখের জ্যোতি নিভে
যেতে চায়। সম্প্রতি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিশুত
রাতের গহন বাণী অক্ষরের আড়ম্বরহীন
আয়োজন ধরে রাখি। প্রাতঃকালে আকর্ষণ কমে
রচিত বাক্যের প্রতি। যেন আমি সম্পর্ক-রহিত
কবিতার সঙ্গে, ছন্নছাড়া আচরণে মেতে থাকি
কিছুক্ষণ, স্বাভাবিক মানুষের মতো পুনরায়
সমাজে প্রবেশ করে সমাজের বাইরের কেউ
হয়ে যাই খোলা আকাশের নিচে কিংবা বন্ধ ঘরে।
ভয়ঙ্কর চাদর আমাকে ঢাকে, অদৃশ্য ছোরার
ফলা থেকে রক্ত ঝরে, লুট হয় আমার নিঃশ্বাস;
খাতার পাতার সব অক্ষরে শোণিত চিহ্ন ফোটে।
অলৌকিক আলোর ভ্রমর
আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি? হায়েনা রাত্রিকে
দাঁতে ছিঁড়ে হেসে ওঠে, পথে শত শত
ট্রাক থেকে উপচে পড়ে লাশ।
যারা বেঁচে আছে তারা সব
শবের মতোই, হয়তো বা ভস্মমূর্তি, টোকা দিলে
ঝ’রে যাবে, কোথাও বাতির চোখ নেই।
দুঃসময় ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে ছোটে ইতস্তত,
তার চাবুকের ঘায়ে আর্তনাদ করে এ শহর
বাংলার রূপসী নদী, গ্রাম, শস্যক্ষেত সমুদয়;
মেঘের কিনারা থেকে চুঁইয়ে পড়ে অবিরল বিষাদের জল
এবং সন্তানহারা জননীর মতো শোকস্তব্ধ মুখে আজও
ব’সে আছে রাত্রিদিন আমার এদেশ।
ভঙ্গুর দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে পঙ্গু আর অন্ধের মিছিল,
শহরে ও গ্রামে দীর্ঘ থেকে
দীর্ঘতর হয় বিভ্রান্তির বহুরূপী ছায়া, ক্রূর
শক্রদের হট্ররোল বাড়ে ক্রমাগত আর মিত্রেরা নিঃসাড়,
চন্দ্রাহত রেস্তোরাঁয় অসার বচসা,
অজ্ঞানতা গ্রাস করে দশ দিক; মূঢ়তার মেঘে
ঢাকা প’ড়ে যায়
অগণিত শহীদের মুখ।
ঘাতকেরা আমাকে খুঁড়তে বলে আমারই কবর,
সম্ভবত সুসময় দেখা আর হ’লো না আমার।
শহীদেরা আজ শুধু অসহায় নাম, যা এখন কেউ আর
আবৃত্তির যোগ্য বিবেচনা
করে না তেমন?
বুঝি তাই মধ্যরাতের নূর হোসেনের কবরের
সোঁদা মাটি ফুঁড়ে কান্নাপ্রায়
আওয়াজ বেরোয়া-
“তবে কেন আমার তরুণ বুকে হায়েনার দাঁত বিদ্ধ হ’লো
তবে কেন আমার স্বপ্নেরা আজ শেয়ালের মলে
মিশে যায় অবলীলাক্রমে?
তবে কেন হায় মুক্তিযুদ্ধ শকুনের চঞ্চুতে কয়েদি হয়?”
বাংলার কবি আমি নগণ্য, গরিব;
আহত আমার ডানা, উড়তে অক্ষম
মেঘলোক; আমার হৃদয় পড়ে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়ে,
প্রিয় নূর, তোমার বুকের রক্ত নিরন্তর। আমার কবিতা
ভিজে ওঠে বার বার, ধুলো মুছে যায়,
স্বচ্ছ হয় পবিত্র চোখের মতো আর এবাদতে
আকাশকে ছোঁয়, পুনরায়
তোমার সাহসে জ্ব’লে ওঠে
আমার শব্দের পথে, বাড়ির কার্নিশে, নিসর্গের বুদোয়ারে,
তারুণ্যের বুকে, শুভ সমাবেশে অলৌকিক আলোর ভ্রমর।
আগন্তুক
কাঁধে মধ্যরাত্রিকে ঝুলিয়ে,
ফুসফুসে নিয়ে
অতিক্রান্ত পথের ধূসর দীর্ঘশ্বাস
বাড়ি ফিরি একা। সিঁড়ি ভেঙে
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে
বন্ধ ঘরে ঢুকে দেখি-আমার চেয়ারে
অচেনা কে একজন ব’সে আছে, উশ্কো-খুশ্কো গালে
ক’দিনের না-কামানো দাড়ি,
দু’ভুরুর মধ্যখানে অমাবস্যা নিথর, গহন।
কী নাম? প্রশ্নের পিঠে আগন্তুক শূন্য ঠোঁট থেকে
‘ব্যর্থতা’ শব্দটি
কেমন গড়িয়ে দিয়ে আমার সম্মুখে তুলে ধরে
এক সিট হলুদ কাগজ,
গাঢ় কালো কালিতে কী যেন লেখা, দ’লে-
মুচড়ে সে কাগজ ছুঁড়ে দিই বাজে কাগজের
ঝুড়িতে না প’ড়ে। অকস্মাৎ রূপান্তরে
আগন্তুক একটানা শব্দহীন, খরা-ঝলসিত ঠাঠা হাসি।
আমরা ক’জন শুধু
নিজের সঙ্গেই আজ সারাদিন খেলি কানামাছি
কী জানি কিসের ঘোরে। মাঝে-মধ্যে কেমন অদ্ভুত
মনে হয় নিজেকে নিজেরই কাছে। কী ক’রে যে আছি
ভুল ইতিহাস শুনে, মূঢ়দের প্রগতির দূত
ভেবে নিয়ে; ঐ তো ওরা সর্বক্ষণ পেছনের দিকে
টেনে নিতে চায়, মনে ছড়ায় আঁধার মুঠো মুঠো।
এসব মুখের কোনো বাস্তবতা নেই, ওরা টিকে
আছে মিথ্যা পুঁজি ক’রে কুড়িয়ে ভ্রান্তির খড়কুটো।
কোথায় উদ্ধার ব’লে এমনকি ঘুমের ভেতরে
ভীষণ চিৎকার ক’রে জেগে উঠি, প’রে নিই ঠুলি
দু’চোখে আবার। শুনি কারা প্রকাশ্যে আমারই ঘরে
অস্ত্রে দিচ্ছে শান জোরে; আমার গলায় অত্রগুলি
নির্ঘাত বসাবে কোনোদিন নীল নক্শা অনুসারে,
আমরা ক’জন শুধু গেয়ে চলি তারে নারে নারে।
আমার এ শহরের চোখ
কোথাও ছিল না বৃষ্টিধারা, এ আমার শহরের
অশ্রুপাত; কেঁদে কেঁদে শহরের চোখ দু’টো লাল
আর অতিশয় ফোলা কেন
পারে না বলতে কেউ। কেন তার বুক ঠেলে এত
কান্না ওঠে প্রহরে প্রহতে
এ শহর নিজেও জানে না। আমি শুধু কবিতায়
কিছু অশ্রুকণা জড়ো করি অবেলায় ছোট ঘরে
অরক্ষিত, একা।
কখন জানালা দিয়ে প্রজাপতি ঘরে ঢুকে পড়ে
ফুলের পাপড়ির মতো, বসে
আমার গ্রীবায়, যেন সে অশ্রয়প্রার্থী, অসহায়,
নিজেকে বাঁচাতে চায় নিপীড়ন থেকে। এখন সে
কম্পমান, যেমন চারার পাতা দুরন্ত হাওয়ায়।
আমি কি পারব দিতে ওকে বরাভয়?
লুকিয়ে রাখব তাকে স্বপ্নের ভেতর,
আমার নিমগ্ন কবিতার ক্যামোফ্লোজে?
যা বলি বিশ্বাস করো-ফুরফুরে চড়ুই অথবা
মাছরাঙা, নিভৃত কোকিল,
দ্যুতিময় মাছ, বৃক্ষলতা, ফলমূল, ফুল
এখন কেউই নিরাপদ নয় আর।
যখন বয়স ছিল উনিশ কি বিশ,
তখন থেকেই আমি লিখছি কবিতা
প্রায় ভূতগ্রস্ততায়। কত রাত শব্দের সন্ধানে
প্রত্যুষের কাকের আওয়াজে
চমকে উঠেছি, আধা বোঁজা চোখে স্বপ্নের নগ্নতা
লেপ্টে গেছে কতবার। আমার প্রতিটি
কবিতাকে ওরা সারিবদ্ধ কয়েদীর মতো দাঁড়
করিয়ে ফুলেটবিদ্ধ করে আজ গোধূলিবেলায়
আমার আপন ভালবাসা
সজীব ফলের মতো গহন সবুজ পত্রালিতে
আচ্ছাদিত। কখনও কখনও তার চোখে
চোখ রেখে মনে হয়, এই রূপ কোথাও দেখিনি
কোনো কালে; এমনকি আমি তার চলে যাওয়ার ছায়ার
সঙ্গে প্রেমে ম’জে আছি। ‘এইতো এসেছি
ব’লে সে যখন দাঁড়ায় সম্মুখে, তার দিকে
ঘাতকের হাত প্রসারিত দেখে ভয়ে কেঁপে উঠি।
ক’দিন বা আছি আর? তারপর অনন্তের পথে
ছায়া হ’য়ে হেঁটে যাওয়া, হেঁটে যাওয়া, শুধু হেঁটে যাওয়া।
অথচ এখনই বন্ধ দরজাটা ঠেলে
ভেতরে আসতে চায় হন্তারক নরকের কুকুরের মতো
দাঁত নখ ভেজাতে শোণিতে। আমার এ শহরের
চোখ ভরা রক্তাশ্রুতে রাত্রিদিন; কে দেবে মুছিয়ে
তার চোখ চুমোর জ্যোৎস্নায়, কে সে? বলতে পারি না।
তার পদধ্বনি বাজল কি আজ দিগন্তের বুকে
গুণীর তানের মতো? আমার শঙ্কিত কাঁধে দৃঢ়তা অর্পণ
ক’রে বলে উঠবে কি, এ শহরে মৃত্যুর উৎসব বাঁচবে না?
শহর ঘুমিয়ে ছিল পরিশ্রান্ত শ্রমিকের মতো।
কবি তার সদ্য লেখা কবিতার পঙ্ক্তিমালা জিভে
খেলিয়ে খেলিয়ে বিছানায় গেছে, স্বপ্নের ভেতর
নদীর কিনারে ব’সে গোণে ক’টি সারস নেমেছে
বালুচরে। নতুন কবিতা তাকে দেয় না ঘুমোতে
মাঝে মাঝে, দপ দপ করে চোখে, শিরায় শিরায়।
অকস্মাৎ ২৪টি ঘন্টা বেজে ওঠে দেশ জুড়ে,
কবি শোনে ছন্দোময় ভোরে লেখার টেবিলে ব’সে।
সাহস শব্দটি আজ বিশাল হরফে লেখা হ’ল
সারা দেশে, স্বাধীনতা ২৪টি অনিন্দ্য গোলাপ
হ’য়ে ফোটে জনতার হৃদয়ে এবং খলখল
অন্ধকার কেটে চলে নিরন্তর আলোর তরণী।
ঘন্টাধ্বনি প্রতিবাদী কবিতার মতো জাগরণী
মহামন্ত্র শোনায়, নিমিষে শহরে চোখ থেকে
ঘুম মুছে যায়, চেয়ে দেখে ২৪টি মুখ তাজা
ভোরবেলাকার মতো। নদীতে পা ধুয়ে কবি হেঁটে
যায় কিয়দ্দূরে নিতে আলোকিত প্রকৃত নিশ্বাস,
২৪ সংখ্যাটি যে ইন্দ্রজালে হ’লে ইতিহাস।
আশংকা
তার হাতে কোনো মন্ত্রপূত ডুগডুগি
অথবা জাদুর বাঁশি নেই,
তবু কেন ওর পেছনে পেছনে ছুটে চলেছে এত লোক?
ছোট ছোট হৈ-হৈ ছেলেমেয়েরা ওর পিছু নেবে,
এমন উন্মাদ সে নয়। মাথা উঁচিয়ে
সে হাঁটছে, দৃষ্টি দূর দিগন্তের দিকে।
কোনো রঙিন বিজ্ঞাপনের ফুরফুরে কাগজ
সে উড়িয়ে দিচ্ছে না হাওয়ায়,
তার হাত থেকে ঝরছে না রাজনৈতিক ইস্তাহার।
কাউকে কাছে ডাকার
স্পৃহা লতিয়ে ওঠেনি, তার মনে, বরং সে
নিজের ভেতর ডুবসাঁতার দেয় সারাক্ষণ।
মাঝে-মধ্যে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে
সে ভাবে- এই প্রাচীনকালের মুক্তোর মতো চাঁদ
ঝুঁকে আছে তার উপর, চকচকে কিছু মাছ
তন্দ্রার তটে এসে বুড়বুড়ি কাটে, এরা কি মনে রাখবে
তাকে? আর যারা না চাইতেই ওর পিঠ
লক্ষ ক’রে ছোটে উদ্দাম, একদিন তারা ওকে
পায়ে মাড়িয়ে যাবে না তো? সে কি তখন
মাংসের করুণ দলা হ’য়ে পড়ে থাকবে ধুলোয়?
না কি সে মন্ত্রটন্ত্র ছাড়াই কোনও চৈত্রপূর্ণিমায়
হ’য়ে যাবে মনপবনের দাঁড়!
একজন
সজীব আঠারোতেই রুক্ষ, তামসিক
প্রতিক্রিয়াশীলতার ব্যাকুল খাদেম,
প্রট্রোডলারের
ঝলকানি-লাগা
খালিশ, নিরেট
ভোগবাদী নেতাদের বাক্চমকে আবিষ্ট,
নাৎসী-আনুগত্যে নতজানু সর্বক্ষণ।
তার করোটিতে
বৃষ্টিপাত-পরবর্তী রামধনু নেই,
জ্যোৎস্নাবিহ্বলতা নেই। সুদূর, গুমোট
আইয়ামে জাহেলিয়াতের
অন্ধকার মাথায় ঘা-ভর্তি
গ্রীষ্মের কুকুর যেন, জিভ বের ক’রে
হাঁপায় কেবল।
সূর্যোদায়-রহিত মনের আস্ফালনে
ধুন্ধুমার ফুঁ দিয়ে নেভায়
মঙ্গল প্রদীপগুলি যখন তখন আর প্রগতির ঋদ্ধ গ্রন্থমালা
আগুনের বুকে ছুঁড়ে ফেলে
হাত সেঁকে নেয় ঘটা ক’রে
উঠতে বসতে করে কার্ল মার্কস-এর মুণ্ডপাত।
শহরের ঠেঙাডে প্রহরে গর্দানের রোঁয়া-খাড়া
নেকড়ের মতো ঘোরে রাস্তায় রাস্তায়,
মারণাস্ত্র হাতে মধ্যরাতে দমাদম
লাথি মারে শ্রীমন্ত শুভ-র শান্তিখচিত দরজায়।
এখানে রেখেছি লিখে
আমার স্বপ্নের ঘাটে বৃষ্টি পড়ে, টগবগে
সাদা ঘোড়া পা ঠোকে পিছল
মাটিতে, যদি সে পড়ে যায় মুখ থুবড়ে, পাতাগুলি
সসম্ভ্রমে ঢেকে দেবে তাকে। বজরায়
কে বধূ রয়েছে ব’সে সালংকারা? তার মনোভার
পারে না সরিয়ে দিতে স্তব্ধ নিশীথের জলধারা।
আমার স্বপ্নের ঘাটে ঈশ্বর পুত্রের আংরাখা
বুকে চেপে নারী করে অশ্রুপাত, তার
ওপর নক্ষত্র ঝরে, দেবদূত ওড়ে আর চারণ কবির
কণ্ঠস্বরে সৃষ্টি হয় জ্যোৎস্নাস্নাত মানবিক গাথা।
জগৎ সংসারে প্রতি যুগে মানব সন্তান কত
ক্রুশবিদ্ধ হয়, রক্ত মুছে যায় তাণ্ডবে, আমেন।
২
‘কবিকে পোছে না কেউ,’ ব’লে এক গলির মাস্তান
গুলী ছোঁড়ে মেঘের মুলুকে। কুকুরেরা চিৎকারে বমন
করে ভীতি। কবি কিশোরের পাণ্ডুলিপি
গুণ্ডার পায়ের নিচে কবুতরছানা। এই দৃশ্য দেখে কিছু
দু’চোখে অঞ্জনমাখা ভণ্ড ধর্মাশ্রয়ী হো হো হাসে, উহাদের
হিংস্র দাঁতে
জ্যোৎস্নাও পারে না দিতে সৌন্দর্য প্রলেপ। ছিন্নবেশ
উন্মাদের অট্রহাসি বরং অধিক
রমণীয় মনে হয়। বসিয়া বিজনে কেন একা মনে কবি
বৃষ্টিতে ভেজাও দুঃখ? কেন
বুকের ভেতরে জ্বালা প্রগাঢ় আগুন ছন্নছাড়া প্রার্থনায়?
৩
বয়স ঢলেছে বটে পশ্চিম আকাশে,
তবু শব্দবোধ
সঠিক হ’ল না মঞ্জরিত। দুরাশায়
করেছি মেঘের চাষ দারুণ খরায়। চোখমুখ
হায়, জ্বলে পুড়ে যায় রোদের ছ্যাঁকায়। বৃষ্টিহীন
দীর্ঘ দিবসের ভস্মকণা
দু’চোখে ফোটায় পিন। দুঃস্থ কৃষকের,
মজুরের চালডাল চকিতে নেপোয় দেয় মেরে।
এ শ্রাবণে হায়রে এমন ঘন ঘোর বরিষায়
ফুটোময় টিনের ছাদের
তলায় এভাবে প্রাণাধিক বিবি বাচ্চা নিয়ে বাস করা দায়।
আত্মত্যাগী, রুক্ষ বুদ্ধিজীবী
ঢাউস বইয়ের পাতা চেখে নিজেকে বলেন আজো
বলেন জনসভায় ধারালো ভাষায়,
‘এ সংকটে মার্কসীয় দর্শন ছাড়া মুক্তি নেই কোনো।
কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো সবার মুখস্থ থাকা চাই।
সমাজতন্ত্রের কথা অমৃত সমান,
শ্রেণীচ্যুত কবি ভনে, শোনো পুণ্যবান।
৪
কীভাবে যে বেঁচে আছি পিশাচ নগরে! দিনদুপুরেই দেখি
গুম হ’য়ে যায় লোক, নগররক্ষীরা নিদ্রাতুর,
পাহারা ভরসাছুট, সকলেই নিষ্ক্রিয় দর্শক। পচা মাংসের
দুর্গন্ধ
বেড়ে যায়; যে কোনো মুহূর্তে অন্ধকার ঘাড়ে নিয়ে
ভিক্ষুর মুদ্রায় আমি চলে যেতে পারি,
বহু পথ ঘুরে টলটলে দিঘির কিনারে এসে
শান্তিজল আঁজলায় তুলে নেব, হাওয়ায় উড়বে
বৈকালী চীবর।
৫
এখানে রেখেছি লিখে নিজেকে নানান ছাঁদে, ছোঁও,
ছুঁয়ে দেখো, আমার হৃৎপিণ্ড কীরকম
বেজে ওঠে নিরিবিলি। শব্দগুলি মিলনপ্রয়াসী
রমণীর মতো বুক উন্মোচন ক’রে দেবে। কেউ
গৈরিক বাউল হ’য়ে একতারা হাতে এক পাক ঘুরে এ
গহন
দুপুরে উঠবে গেয়ে গান, কেউ ত্র্যাকর্ডিয়নের
রীডে তার আঙুল নাচাবে। এই লেখা অকস্মাৎ
আর্তস্বরে ব’লে দেবে হৃদয়ের উষ্ণ-অশ্রুজলে-
আমার শৈশব আর আমার কৈশোর
সেই কবে বিক্রি হ’য়ে গেছে কোলাহলে আঁশটে হাটে;
যৌবন যে বাজেয়াপ্ত হ’ল কবে, নিজেই জানি না। খুঁজে
দেখো,
আমার স্পন্দিত বুকে স্তরময় বিষাদের খনি।
এখানে রেখেছি লিখে অন্যমনস্কভাবে, নাকি
গৃঢ় ঘোরে সে গাছের কথা, নিষ্পত্র যে,
যার ডালে ভুলেও বসে না কোনো পাখি,
যে দাঁড়িয়ে থাকে দিনভরা রাতভর বজ্রাহত অভিমানে।
কবিতা লিখতে গিয়ে
কবিতা লিখতে গিয়ে প্রায়শ হোঁচট খাই আজ, ধন্দ লাগে
বার বার, আর অমাবস্যা নামে খাতার পাতায়
যখন তখন, তুমি সাক্ষী। কী ক’রে ফিরিয়ে আনি
পূর্ণিমাকে? জানি না সে মন্ত্র, শুধু ক্ষ্যাপা বাউলের
মতো ঘুরি গেরুয়া রঙের লুপ্ত লিরিকের পথে।
অন্ধত্ব আসন্ন জেনে আলোর ঝর্ণায় স্নান করি অবিরাম।
বাগানের ফুল ছেঁড়া হচ্ছে অবিরত, মাস্তানের
মরশুম চতুর্দিকে। ইদানীং ঘাতকেরা নির্ধারণ করে
আমাদের ভবিষ্যৎ নীল নক্শা টেবিলে ছড়িয়ে।
শতাব্দীর গোধূলিতে মহত্বের ধড় থেকে মুন্ডু ছিঁড়ে নিয়ে
লোফালুফি চিলে চন্ডালের আস্তানায়; এভাবেই
সব কিছু সকলের সহনীয় হ’য়ে যায়, অমাবস্যা বলে
নির্বোধের সমাবেশে। বসন্তের পিঠে
হঠাৎ বসিয়ে ছোরা কে দুর্বৃত্ত ধুলো ছুঁড়ে দিয়েছে চম্পট।
বর্বর পোড়ায় মনীষীর জ্ঞানলিপি হাড়হিম
শীতরাতে উত্তাপের লোভে।
এই শতাব্দীর সেরা গ্রন্থগুলি গণ শৌচাগারে
নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তবু আমি কেন কবিতার জন্য
নিজেকেই করি ক্ষয়, ধুলোয় মেশাই; তুমি বলেছিলে
বটে,
ধৈর্য হারিয়ো না; তাই আজও হাতে
রয়েছি কলম ধ’রে। সর্বক্ষণ ভয়-যদি কেউ এ তাণ্ডবে
আমার কলম কেড়ে নেয়।
কোনো তরুণকে
উজ্জ্বল তরুণ তুমি দিয়ো না সর্বদা নিষ্ঠীবন,
বিদ্রূপের বাছা বাছা তীর ছুঁড়ে তোমার সম্মুখে
কম্পমান কাকতাড়ুয়ার দিকে। তরুণ, একদা
তারও ছিল, যা তোমার আজকাল বন্দনীয় সাজ।
চারটি দশক প্রেমিকার ওষ্ঠ ছিল চুম্বনের প্রতীক্ষায়,
যখন তখন সে-ও আঙুলের ডগায় ফোটাতো
চেষ্টাহীন নক্ষত্রের ফুল, মাটি খুঁড়ে জাগিয়েছে
প্রস্রবণ, অলৌকিক দ্রাক্ষা রসে ভেসে গেছে তার
বুক বার বার আর ফসল তোলার গানে সে-ও
হ’য়ে উঠেছিল ক্রমে কিন্নরের যোগ্য প্রতিযোগী।
দ্রোহে তার হয়েছে চৌচির কত বিগ্রহের মুখ;
তরুণ, সদলবলে যাও যদি যেতে চাও তাকে
ফেলে রেখে বিরানায় ভিন্ন মৃগয়ায়। অতঃপর
ভুলেও কোরো না দাহ তার কোনো কুশপুত্তলিকা।
খনন
কে এক খননপ্রিয় লোক চলেছে নিয়ত খুঁড়ে
অগোচরে, খননের নিঝুম আওয়াজ
কানে আসে; যদি যাও তার কাছে দেখে নিতে কাজ
তার, দেখবে বসে আছে কর্মহীন, যেন কোনো কুঁড়ে
সমাসীন নিরালায়। সরে এলে তুমি
পুনরায়, বিনীত সে শব্দ উঠেবে বেজে
তোমাকে চমকে দিতে। অবারিত মাঠ, তৃণভূমি
শস্যের সম্ভাবনায় সেজে
ওঠে বুঝি সুবর্ণ রেখায়; বহুকাল থেকে সেই
অক্লান্ত খননপ্রিয় লোক
প্ররোচনাহীন আমাকেই
করেছে দখল ঠিক আমার অজ্ঞাতে। খননের তীব্র ঝোঁক
আমার ভেতরকার কাঁচা মাটি থেকে
তুলে আনে অক্ষরের নানা মূর্তি। চাদ্দিক আভায় যায়
ঢেলে।
গোলাপ বাগানে
কত সাধ করে হরফের নীড় সাজিয়ে ছিলাম; তড়পানো
পান্ডুলিপি, বাবুই পাখির বাসা যেন, খর তুফানের তোড়ে
এঁটেল মাটিতে গড়াগড়ি যায়, খড় সমুদয়
কুড়িয়ে আবার জড়ো করি, বিষাদের চোখ জ্বলে
নিরালায়।
এখনই কি উদ্যমের সোনালি প্রন্তর ছেড়ে অসহায় চলে
যাব কালো কুটিরে একাকী, অবনত? মুখ ঢেকে
রাখব হাঁটুতে ক্লান্ত, শস্যহারা কৃষকের মতো? প্রত্যাশার
শব পোড়ে ধোঁয়াটে শ্মশানে, ভয়ে চোখ বন্ধ করব না
আর।
কলকলে জলে ধুয়ে যাবে জেনেও বালক নদীতীরে গড়ে
সাধের বালির ঘর; আমিও কি অনুরূপ খেলা
নিয়ে মেতে আছি নিত্যদিন প্রতারক ভরসায়
শব্দের অতীত শব্দ ছুঁয়ে ছেনে? আমি এই খেলা ছাড়ব না।
আমার ললাটে আজ যৌবনের ভস্মটিকা, রক্তে হিমঝড়
অত্যাসন্ন, কে এক কংকালসার, ভয়ঙ্কর লোক
নিঃশব্দে আমাকে হাত ধ’রে টেনে নিতে চায় হু হু
হাড়ের উদ্যানে, আমি তার সহযাত্রী হ’তে অস্বীকার করি।
পুনরায় সকালবেলার রোদ চিকচিক করে মেরামত-করা
হরফের নীড়ে আর অস্ফুট শব্দের শিশু গলা
বাইরে বাড়িয়ে দেয়। এই আয়োজন সঙ্গে নিয়ে
স্বপ্নঙ্কিত পতাকা উড়িয়ে যাব আকাঙ্ঘিত গোলাপ বাগানে।
জমে দীর্ঘশ্বাস
লোকটা পুরানো এক কবরের কাছে ব’সে থাকে
প্রতিদিন, মাঝে-সাঝে ঘাস টানে, ধুলোর হরফে
কী-যে লেখে হিজিবিজি, ফুঁ দিয়ে ওড়ায়। কেউ তাকে
উত্যক্ত করে না, শুধু বালকেরা কখনো সখনো
কিছু বলাবলি করে, ফন্দি আঁটে ঢিল ছুঁড়ে দেবে
দৌড় মহল্লার দিকে। তার উদাসীনতায় কোনো
চিড় টিড় ধরে না ব’লেই ওরা এলেবেলে ভেবে
চলে যায়, তৃপ্তি খোঁজে চানাচুর, মালাই বরফে।
লোকটা হঠাৎ একদিন কোথায় যে অগোচরে
উদাস প্রস্থান করে। তাকায় না ফিরে, হেঁটে যায়
সহায় সম্বলহীন; কেঁপে ওঠে কবরের ঘাস
বুঝিবা বিচ্ছেদে, আজ কারো কোনো বেহালার ছড়ে
জাগবে না সুর, ছন্দপতনের রেশ কবিতায়
ফোটে আর পথের ধূসর হাতে জমে দীর্ঘশ্বাস।
ডালিমগাছ
তরুণী ডালিমগাছ রৌদ্রশুক্র করছে ধারণ
অসংকোচে, প্রসূনকে নদীজলে ভাসিয়ে দেবে না।
আকণ্ঠ রয়েছি ডুবে নিরাশায়, গাছটির দিকে
তবু চেয়ে থাকি, যেন আমার না-লেখা কবিতার
ফুল ফুটে আছে তার ডালে। বিপদে রয়েছি খুব,
নিজগৃহে ভাত রেঁধে প্রফুল্ল হাওয়ায় খেয়েদেয়ে
শান্তির বালিশে মাথা রাখা দায়। মানুষের মুখ
ক্রমাগত গরিলার মুখ হয়ে যাচ্ছে, চতুর্দিকে
ঘাতকের মজলিশ, তাদের নিশ্বাস বিষ ঢালে
বায়ুস্তরে আর সুন্দরের গলা চেপে ধরে ওরা
বাঘনখ প্রসারিত ক’রে। দেবদূত নর্দমায়
খাবি খায়, চাঁদের কলঙ্ক বেড়ে যায় প্রতিদিন।
পারি না কোথাও যেতে, ভূতলবাসীর মতো দিন
কাটে আতঙ্কিত, রাত্রি দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতায়।
উদ্ধারের পথ রুদ্ধ? শবাহারী পশুর উল্লাস
কানে আসে ক্ষণে ক্ষণে। অকস্মাৎ বরাভয় জাগে
বৃক্ষদের শ্যামল মুদ্রায়, বিজয়ীরা সমাগত-
ডালিমগাছের ডালে ফলগুলি হতেছে ডাগর।
তিনজন
জ্যোৎস্নার আদর খেয়ে চিতাবাঘ শোভার ভেতর
নিভৃতে ঘুমায়। অকস্মাৎ খস্ খস্
শব্দে লাফাবার ভঙ্গি রচিত, দু’চোখ
ফস্সরাসের কণা ছড়ায়, আঁধার শিহরণের নববধূ,
পেশী টান টান, জ্যোৎস্না পান ক’রে তার
সমগ্র সত্তায় মদিরতা জেগে ওঠে, পরিপক্ক নিশীথের
মাংস দাঁতে গেঁথে খুঁজে নেবে
ঝোপের আড়াল, পাবে শব্দ-শিকারীর হরফের
মমতা এবং বাংলা কবিতার বুকে
চোখের আগুন তার রত্ন দশকের পরপারে।
দুর্ধর্ষ শিকারী কালো বন্দুকে উঁচিয়ে ধরে সেই
চলমান ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের দিকে।
কবির কলম বন্দুকের মুখটিকে মূক ক’রে
দিতে চায়; গুলির আওয়াজ ফেটে পড়ে, ঘন ঘন
আর্তনাদ, বিষাদ ভাসতে থাকে রুপালি প্লাবনে;
কলম এবং কবি রক্তস্নাত, শিকারীর পদতলে নিঃস্পন্দ,
নিথর।
তোমারই পদধ্বনি
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার স্বদেশের বুক থেকে,
এই খেলা উঠে এসেছে এ দেশের প্রতিটি নদী থেকে,
যে সব নদী তরঙ্গায়িত হতো তোমার শিরা উপশিরায়,
এই খেলা উঠে এসেছে সেসব ক্ষেত থেকে,
যাদের ফসলের ঢেউ ধারণ করতো তোমার হৃদয়।
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার প্রাণের স্বদেশের
গাছের শেকড়, পাখির বাসা, মাছের চোখ,
কৃষকের চঞ্চল লাঙল, শ্রমিকের শ্রমনিষ্ঠ হাত,
শত শত শহীদের জনক জননীর বিলাপ
বিচ্ছেদকাতর পক্ষিণীর মতো জীবন সঙ্গিনীর দীর্ঘশ্বাস,
আর
সন্তানের আর্তনাদ থেকে।
এই লেখা উঠে এসেছে সেই সিঁড়ি থেকে,
যেখানে পড়েছিলো ঘাতকের গুলিবিদ্ধ তোমার লাশ,
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার বুক জোড়া রক্তাক্ত
গোলাপ থেকে
বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নব পরিণীতার
মেহদি-রাঙা হাত এবং
শিশুর নেকড়ে খোবলানো শরীর থেকে।
তোমার দিকে ওরা ছুঁড়ে দিয়েছিলো মৃত্যু,
কিন্তু ওরা জানতো না,
কোনো কোনো মৃত্যু জীবনের চেয়েও সতেজ মহিমান্বিত,
তোমার মৃত্যুর কাছে কোটি কোটি জীবন আজো নতজানু,
তোমার গুলিবিদ্ধ শরীর এখনো
রাজপথ-উপচে-পড়া মিছিলের সামনে।
যেখানে সমাজ বদলে ফেলার প্রেরণাময় বাঙ্ময় হয়
কোনো তরুণ কণ্ঠ, সেখানে বেজে ওঠে তোমার কণ্ঠস্বর,
যেখানে বুলেটের আঘাতে ঢলে পড়ে কোনো সংগ্রামীর
শরীর,
যেখানে আবার লাফিয়ে পড়ে তোমার দীর্ঘ, ঋজু দেহ,
যেখানে প্রতিবাদে উত্তোলিত হয় বাহুর অরণ্য,
সেখানে সবচেয়ে উঁচু তোমার সূর্যঝলসিত হাত।
এমন কোনো হাই-রাইজ দালান নেই এই শহরে,
যা তোমার উচ্চতাকে খর্ব করতে পারে।
এইতো আমরা দেখছি রৌদ্রময় মাঠে মধ্যবয়সী
কৃষকের সঙ্গে তুমি লাঙল ঠেলছো কড়া-পড়া হাতে,
এইতো তুমি খালি পায়ে এবড়ো খেবড়ো জমিনে হেঁটে
হেঁটে
গুণ টানছো নদীতে, দাঁড় বাইছো মাঝির সঙ্গে,
কারখানার চাকা ঘোরাচ্ছো মজুরের সঙ্গে
কাদায় দেবে-যাওয়া চাকা ঠেলে তুলছো গাড়িয়াল
ভাইয়ের
হাতে হাত লাগিয়ে;
সুন্দর ও কল্যাণের স্বপ্ন দেখছো
ওডেসিউসের মতো বেরিয়ে পড়েছো নব অভিযানে।
আদর্শবাদী তরুণের স্বপ্নে মিশে গিয়ে। এইতো তুমি
কসাইখানাকে ফুলের বাগান বানানো যার সাধনা,
তুমি সেই সাধনার অকম্পিত শিখা।
তোমাকে ওরা অবজ্ঞায়, অপমানে, অবহেলায়
ঠেলে দিয়েছিলো এই বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে
এক কবরে, অথচ আজ চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে
তোমারই পদধ্বনি, আলো-জাগানো ভাস্বর পদধ্বনি।
দাঁড়াও
দাঁড়াও এখনই তাকে সাজানো মঞ্চের মাঝখান
থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। আরো কিছুকাল তার
পার্ট বলে যেতে দাও। খানিক থমকে যাওয়া মানে
বেবাক বিস্মৃতি নয়, যদি তুমি লোভী বেড়ালের
মতো এরকম ঘুর ঘুর করো সারাক্ষণ, তবে
কীভাবে সে সামলে সুমলে নিয়ে আবার বাগানে
যাবে স্মিত ভোরবেলা, চারা গাছটাকে মমতায়
ঈষৎ নাড়িয়ে দেবে? দেখে নেবে রাঙা পাখিটাকে
এক ফাঁকে? এখনো কাপড়ে তার গোলাপ তোলার
কিছু কাজ বাকি, নাতনির সঙ্গে খেলবার
সাধ নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে। দূরে স’রে
দাঁড়াও, ফেলো না তার বুকে মুখে শীতল নিঃশ্বাস।
পুরাণের পাখি
না রাজু, তোমাকে আমরা ঘুমোতে দেব না।
এই যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তোমার শিয়রে
প্রতারিত, লুষ্ঠিত মানুষের মতো,
আমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই যে তোমাকে
ঘুমোতে দেবে।
জেগে থাকতেই ভালবাসতে তুমি
এই নিদ্রাচ্ছন্ন দেশে; অন্ধকারে দু’টি চোখ সর্বক্ষণ
জ্বলত পবিত্র দীপশিখার মতো,
সেই চোখে আজ রাজ্যের ঘুম।
না রাজু, তোমার এই ভঙ্গি আমাদের প্রিয় নয়,
এই মুহূর্তে তোমার সত্তা থেকে
ঝেড়ে ফেলো নিদ্রার ঊর্ণাজাল।
তোমার এই পাথুরে ঘুম আমাদের
ভয়ানক পীড়িত করছে;
রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও
তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই
প্রয়োজন।
দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে।
টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া
তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল
পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে
হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,
মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক
উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,
তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার
মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা
তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,
তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের
সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,
হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে
সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে
গর্ত।
শোনো, এখন যাবতীয় গাছপালা, নদীনালা,
ফসলের ক্ষেত, ভাসমান মেঘমালা, পাখি আর মাছ-
সবাই চিৎকারে চিৎকারে চিড় ধরাচ্ছে চরাচরে, ‘চাই
প্রতিশোধ।‘
নক্ষত্রের অক্ষর শব্দ দু’টি লিখে দিয়েছে আকাশে
আকাশে।
যে-তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্নতায়, সে নও তুমি।
প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু ক’রে আজও নতুন সভ্যতার
আকর্ষণে
হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,
তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে
নিঃশঙ্ক মুদ্রায়,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের
পাখি।
প্রেমের পদাবলী
১
তোমার চোখের মতো আমি দেখিনি কখনো,
তোমার ঠোঁটের মতো ঠোঁটে ওষ্ঠ করিনি স্থাপন
কোনোদিন, তোমার বুকের পাখি একদা ধ্বনিত এ
জীবনে।
তোমার চুলের মতো চুল কোথাও কি এরকম
ছায়া দেয় ক্লান্তির প্রহরে? মুছে ফেলে হিংস্র
দুঃস্বপ্নগুলোকে?
এই যে কবিতা লিখে সত্যের অধিক সত্য রটিয়ে দিলাম
সারা বাংলাদেশে, তার মর্মকথা তুমিই জানো না।
২
বালিকা-বয়সে তুমি কী রকম ছিলে? বাগানের চারাগাছ
জড়িয়ে কোমল বুকে উঠতে কি দুলে ফুল হওয়ার
আশায়?
অনেক বছর আগে-যখন দোয়েল ছিল হৃদয়ে আমার,
যখন আমার চোখ যৌবনের প্রথম স্বপ্নের আচ্ছন্নতা-
তুমি যে বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে হাসিখুশি নীল-শাদা
ফ্রক
পরে, বেণী দুলিয়ে সকালবেলা, আমি ছড়ি হাতে
গোধূলিতে
তার কাছ ঘেঁষে হাঁটি একা মাঝে-মাঝে বৈকালিক ভ্রমণের
অছিলায়, যদি পেয়ে যাই তোমার বালিকা-বয়সের ঘ্রাণ।
৩
একটি সোনালি দিন শুধু দিয়েছিলে উপহার,
কেবল একটি দিন কেটেছিল সান্নিধ্যে তোমার
প্রতিটি মুহূর্ত নেচেছিল, মনে পড়ে, শ্যামা পাখির মতন
নিরিবিলি, একটি সোনালি দিন পথে ঘুরে
লিখেছি কবিতা, প্রিয়তমা, তোমারই উদ্দেশে। যদি
একটি দিনের সঙ্গ কবিতার ইতিহাসে অমরতা পায়,
তা’হলে বলো তো কেন এরকম কার্পণ্য তোমার?
৪
ক’দিন জ্বরের ঘোরে কেটেছে আমার; তুমি এলে
অপরাহ্নে এবং উপেক্ষা করে পরিবেশ আমার উপর ঝুঁকে
ঠোঁটে ঠোঁটে ছোঁয়ালে প্রগাঢ়, স্তনভার
লহমায় দ্রুত করে হৃৎস্পন্দন আমার। কী সহজে
ভুলে গেলে সমাজের বিরূপতা, আমাকে সারিয়ে
তুললে অলৌকিক পথ্যে, তোমার কবোষ্ণ কোলে মাথা
রেখে শুয়ে থাকি আর কখনো তোমাকে, কখনো বা
কবিতাকে দেখে নিই-
ক’দিন জ্বরের পরে এই তো তোমার সঙ্গে স্বপ্নে দেখা
হলো।
৫
এখন ঘুমিয়ে আছো তুমি বৈবাহিক বিছানায়,
মৈথুনের ক্লান্তি কুয়াশার মতো লেগে আছে সারা
শরীরে তোমার, প্রেম জাগে সপ্তর্ষিমন্ডলে আর
আমি দূরে বাংলা কবিতার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি
এক ঠায়, ঘুম নেই। তোমার নিদ্রার রূপ ভেবে
চতুর্দশপদী লিখি, গোপন ঈর্ষায় জ্ব’লে নিই
প্রতিশোধ নিজেরাই উপর। শোনো, একদিন আমিও
ঘুমিয়ে পড়ব, জাগব না আর, তুমি জেগে থেকো।
৬
ঢাকার সুন্দরীদের খ্যাতি প্রজাপতি হয়ে ওড়ে
বহু ঠোঁটে, লাস্যময়ী রমণীরা সৌন্দর্যের উগ্র ঢেউ
তুলে কূটনৈতিক পার্টিতে কিংবা ফ্যাশন শো-এর
ঝলমলে হলঘরে ঘোরে প্রায়শই। তোমাকে যায় না দেখা
সেখানে কখনো, তুমি আছো খুব নিরালায়
এই শহরের এক কোণে আপন সৌন্দর্য নিয়ে। তোমার
মতন
সুন্দর দেখিনি কাউকেই। অবিশ্বাস্য মনে হ’লে
আমার প্রেমের পদাবলী ভাল ক’রে প’ড়ে দেখো।
বরকতের ফটোগ্রাফ
কবেকার ঘাসঢাকা এক টুকরো জমি, ঝোপঝাড়ের
খাসমহল, ঝকমকে আকাশ
অদৃশ্য ঘরের বারান্দা, অন্তরালবর্তিনী
মায়ের তাকিয়ে-থাকা
ইতিহাসের কোনো ইশারা দেখেনি। সকালবেলার হাওয়া
অবিন্যস্ত করেনি তার চুল। তার দৃষ্টি ছিল
সামনের দিকে, ভোরকে সে সোদরপ্রতিম ভেবেছিল?
বলতে পারব না, আমি বলতে পারব না।
তার উপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো গড়িয়ে গেছে
বছরের পর বছর। একটি দোয়েল,
আকাশের সবচেয়ে দূরবর্তী নক্ষত্র, নদী, অমাবস্যা,
জোনাকিপুঞ্জ আর রৌদ্রদগ্ধ রাজপথ
তাকে চিহ্নিত করেছিল ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ হিসেবে,
সে জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি কোনোদিন।
সে কি কখনও রাত জেগে কাউকে লিখেছিল চিঠি
অনুরাগের অক্ষর সাজিয়ে? দিঘির জলে পা ডুবিয়ে
তার বিকেল কি সন্ধ্যায় ঢলে পড়েছে
হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বাড়ানো প্রতীক্ষায়? সে কি রাজনৈতিক
ইস্তাহার পড়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? তার নাম কি
লেখা ছিল পুলিশের স্থুলোদর খাতায়?
জানালার দিকে ঝুঁকে-থাকা
গাছটিকে প্রশ্ন ক’রে ক’রে ক্লান্ত হ’লেও জানতে পারব না।
ভর সন্ধেবেলা বরকতের পুরোনো এক ফটোগ্রাফ
আমার হাতে এসে যাবে, ভাবিনি। তার মায়ের
যত্নের আশ্রয় ছেড়ে সেটি এখন
আমার হাতের উষ্ণতায়। সহজে চোখ ফেরানো
যায় না, যদি বলি, বিস্ময়ের ঘোর নয়,
কোনো চমৎকারিত্ব নয়,
কোনোরকম রোমঞ্চও নয়, শুধু ইতিহাসের একটি অধ্যায়
আমার দৃষ্টি থেকে ছুটে নীলিমায় মিশে গেল,
তবে কি মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেবো আমি?
ঘাস-ঢাকা মাটিতে ফুল ঝরে,
ঘাস-ঢাকা মাটিতে ফুল ঝরে,
ঘাস-ঢাকা মাটিতে ফুল ঝরে।
সুদূরতম এক নক্ষত্র আকাশ থেকে ছুটে এসে
চুমো খেতে চায় ঘাস-ঢাকা, ফুল-মাখা মাটিকে।
চমৎকার একটি গল্প বানানো যায় ফটোগ্রাফের
বরকতকে কেন্দ্রবিন্দু ক’রে
মিডলক্লাশ সেন্টিমেন্টের ভিয়েন দিয়ে।
একুশে ফেব্রুয়ারির শপথ, শপথ এই
ফাল্গুনের গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশের,
আমি সে রকম কিছুই করব না।
সূর্যোদয়ের মতো পবিত্রতাকে মেঘাচ্ছন্ন করার,
অক্ষরের প্রগলভতায় কুয়াশাচ্ছন্ন করার অধিকার
কেউ আমাকে দেয়নি।
‘এই ফটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে
নীরব থাকো, সময় হোক পরিপক্ক ফল, সন্তের ধ্যান’,
বলল আমাকে সন্ধেবেলার মুহূর্তগুলো।
নকশা ঘেরা কাচবন্দী বরকতার পুরোনো ফটোগ্রাফ
সময়ের ছুটন্ত খুর থেকে ঝরে-পড়া ধুলোয় বিবর্ণ,
অথচ আমার মনে হলো, সেই ছবির
ভেতর থেকে জ্যোতিকণাগুলো
চক্রাকারে বেরুতে বেরুতে নিমেষে
ছড়িয়ে পড়ল সব খানে। শপথ বর্ণমালার,
কী ক’রে ভর সন্ধেবেলা আমার চতুর্দিকে
আলোর সমুদ্র, আমি বলতে পারব না।
ব্যবধান
একদা আমাকে তুমি দিয়েছিলে ঠাঁই মমতায়।
আমিও তোমাকে
দিনের সোনালী ছটা রাত্রির মায়াবী কত নিমগ্ন প্রহর
করেছি অর্পণ। আজ আমি তোমার সান্নিধ্য থেকে দূরে
পড়ে আছি অসহায়। তুমি ডাকলেও
পারি না নিকটে যেতে। আমাদের মাঝখানে মরু
শত মরীচিকা আর অজস্র নিশীর্ণ হাড় নিয়ে
ব্যাপ্ত রাত্রিদিন, মাঝে মাঝে
তোমার আভাস পাই অগণিত ওষ্ঠে। বেলা যায়,
বেলা যায়, সময় আমাকে দেয় প্রবীণের সাজ।
যদি কাছে যাই কোনোদিন মনের খেয়ালে, তবে সত্যি
বলো,
সুদূরের সেই
যুবাকে পাবে কি খঁজে এই ভাঙাচোরা মুখচ্ছদে? দেখ
আমি
কী রকম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ভিজছি বৃষ্টিতে ক্রমাগত। শুষে নেয়
মেদমজ্জাজলের দংশন।
মধ্যরাতে ঝুঁকে থাকে
সূর্যাস্তে পাখির ডানা ক্লীর ছবি, দু’চারটে গাছ
অশ্রুপাত করে, কালো মখমলী নিঃসঙ্গ বেড়াল
কুড়ায় আলস্যকণা। নিরালা চায়ের শূন্য কাপ
টেবিলের অত্যন্ত নেতানো তাপ নেয়, এলোমেলো
খাতার পাতায় দীর্ঘশ্বাস; হাওয়া বয়, বল পেন
মৃতের মতোই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, বুকে বোবা
বহুক্ষণ, চক্ষু স্থির, যেন আমি দেখি না কিছুই
কিছুই যায় না শোনা। সন্ধ্যায় বস্তুত আমার
কোথাও যাবার নেই। ব্যথিত দোয়েল ফিরে গেছে,
কালপুরুষের প্রত্যাখ্যান বেজে ওঠে স্তব্ধতায়।
কোথাও যাবার নেই, একটি অচিন পাখি খুব
আসে আর যায়, তার ছায়া যেন ফিসফিসে স্বরে
দেয়ালকে কিছু বলে। তারপর আমার উপর
মধ্যরাতে ঝুঁকে থাকে সমিধলোলুপ নীরবতা।
মরমী পুস্তক
একটি বালক তার রঙিন মার্বেল খুঁজে খুঁজে
প্রায় দিনশেষে
কৈশোরের ঘাটে এসে বসে। জলস্নেহ কাছে ডাকে,
তিনবার দিল ডুব সূর্য ডোবার আগেই।
কিশোরের স্নাত
চিকন শরীরে পলক না পড়তেই
যুবকের সুঠাম শরীর,
জল ছেড়ে ওঠে জ্বলজ্বলে তরবারি।
যুবক নিয়ত হাঁটে একা একা অচিন উদ্যানে,
কে এক অধরা তাকে গহন ভাষায়
দূরে ডেকে নেয়,
হৃদয়ের রত্নরাজি যত্নভরে দেখায় এবং
নিভৃত উদ্যানেশ্বারী সপ্তপদী চালে
বিভ্রম জাগায়। পর্যটনপ্রিয় যুবা
একজন প্রৌঢ়ের ভেতরে যাত্রা করে, বিপরীতগামী এক
উদাস পথিক তাকে হেসে মরমী পুস্তক দেয় উপহার।
একটি গাছের নিচে বিকেলের সুমন্ত আলোয়
মুগ্ধ প্রৌঢ় করে পাঠ মরমী পুস্তক,
ভাবে সে সন্ন্যাস নেবে, চাখবে অশেষ
নির্জনতা, ফলমূল খেয়ে করবে জীবন ধারণ।
নিজেকে বিভক্ত করে কয়েকটি ভাগে অগোচরে-
এ ওকে টানতে থাকে নিজের নিকট;
কেউ লোকালয়ে যায়, কেউ ধায় বিজন ভূমিতে,
দ্রুমতলে দ্রুত তালে নেচে ওঠে মরমী পুস্তক।
মাঝি
ছিলাম তন্দ্রার ঘাটে, চোখ ঢুলু ঢুলু,
অকস্মাৎ বেনো জল। শ্মশানের কাঠ
ভেসে এসে বলে,
‘ধরো’; বুকে নিয়ে ভাসমান। অন্ধ জলে
অবিরল হাবুডুবু খাই।
ওপারে তন্দ্রার ঘাটে ব’সে আছে বেজায় একাকী
খেয়া মাঝি, নৌকো দোলে, ভাঙা দাঁড় হাহাকার বয়,
অসিত চাদরে ঢাকা বিশুষ্ক শরীর, ঘাড়ে তার বিষণ্ন
করোটি।
মাতৃডাক
ছিল না নদী, পাহাড় অথবা প্রান্তর; শস্যের ক্ষেতের
ঢেউ পড়েনি চোখে, বাউলের গান
যায়নি শোনা। এই শহরে শহীদ মিনারে
কতিপয় নারী, যেন শস্যক্ষেত, বিকেলের
নিস্তেজ আলোয়। শহীদ মানিকের মা, একাত্তরের
বীর প্রতীকের মা মাইক্রোফোনের
সামনে দাঁড়ানো এই প্রথমবারের মতো
বক্তার ভূমিকায়। বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা
তাঁর ওষ্ঠে শ্যামা পাখি,
বললেন তিনি মমতার শ্যামল স্বরে-
‘বিশ বছর মা ডাক শুনিনি আমি
তোমরা সবাই আমার সন্তান,
তোমাদের মুখে মা ডাক শুনতে সাধ হয়।
নিমিষেই জনসমাবেশে মাতৃডাকে বাঙ্ময়,
গাছপালা, উদ্যান, পথরেখা, নদী-নালা, ব্রিজ দূরের
আকাশ
‘মা, মা’ বলে ডেকে ওঠে।
মানুষ
লোকটা বিকেলবেলা দু’ভুরুর মাঝখানে সোনালি-হলুদ
আয়োজন নিয়ে হেঁটে যায়, বসে হ্রদের কিনারে
নিরিবিলি; আঁজলায় তুলে
নেয় জল পিপাসার ধূসরতা মুছে
ফেলার তাগিদে। ডালে-বসে-থাকা পাখি
ডেকে ওঠে, যেন বিস্মৃতির
আবরণ কোমল সরিয়ে
শোনাবে কাহিনী কোনো। পথিকের ক্লান্তি ঝ’রে গেলে
অকস্মাৎ কতিপয় ডাকাবুকো লোক
ঘিরে ধরে তাকে। জোরে শোরে শব্দ করে
সব পাখি আর শান্ত গাছদের পাতা। বুঝি ওরা
ভয়ানক ক্ষুব্ধ আর ভীষণ আহত।
‘কী তোমার নাম’ প্রশ্ন ক’রে ওরা খুব কটমট
তাকায় নিশ্রামরত পথিকের দিকে।
‘নগণ্য মানুষ আমি’, ব’লে সে নীরব হ’য়ে থাকে,
প্রসন্নতা-ছাওয়া দৃষ্টি মেলে দেয় হ্রদের গভীরে।
‘তোমার নাম ঠিক ঠিক ব’লে দে এক্ষুণি,
নইলে আজ বেঘোরে হারাবি প্রাণ’ ব’লে একজন
জাঁহাবাজ বুকে তার চকিতে ঠেকায়
বন্দুকের নল।
‘সামান্য মানুষ আমি, এর চেয়ে বড় পরিচয়
নেই কোনো এই অধমের। সদুত্তর নয় ভেবে
গর্জে ওঠে ভয়ঙ্কর রাগী মারণাস্ত্র, গোধূলির
রঙের মতোই রক্তধারা অবিরাম করে উচ্চারণ, ‘মানুষ,
মানুষ।
মুদ্রিত করেছি ভালবাসা
যদি বলি কবিতার দিকে মুখ রেখে কাটিয়েছি
কতকাল, মিথ্যা বলা হবে? যে কোনো ছুতোয় তার
বুকে ঝুঁকে থাকি অপলক, বসি গিয়ে বৃক্ষচূড়ে
কপোত-কপোত যথা-মাথায় থাকুন মাইকেল-
তার প্রতি ভালবাসা মুদ্রিত করেছি সারাবেলা।
কপোতাক্ষ নদীটির তীরে বসে মনে হয়, হায়,
প্রকৃত কবিতা আজও আমার নিকট থেকে দূরে
সরে আছে পর্দানশিনের লাস্যে; আমার ব্যথিত
হৃদয়ের চিতাগ্নিতে এইমাত্র ছিটিয়ে দিয়েছি
কিছু জল; ধোঁয়া ওঠে, কী ভীষণ চোখ জ্বালা করে!
কমিউনিস্ট ইস্তাহার, বলা যায়, নব্য প্রেরণায়
মুখস্ত করেছি; তবু অক্ষরের কেয়ারিতে দেখে
গোলাপের পেলবতা, পক্ষীর কটাক্ষ, ভ্রমরের
আড়িপাতা, কবিতাকে যত্রতত্র করেছি চুম্বন।
যায়নি কোথাও
হঠাৎ গুলির বর্ষা, ধোঁয়াবিষ্ট বাড়ি, আর্তনাদ ছাদ বেয়ে
মেঘে ওঠে, এলোমেলো পদশব্দ, মূক রক্তধ্বানি,
মেঝেতে চামচ, ভাঙা চায়ের পেয়ালা,
চন্দ্রাকৃতি কমলালেবুর কোয়া দেয়ালে প্রবেশ করে ভীত।
তবু কেউ অপরাহ্নে হাঁটুরে ঠেকিয়ে
চিবুক নীরব বসে আছে, তার হাতে প্রেমিকের
স্পর্শ খেলা করে, ভাবে মৃত্যুর মুহূর্তে ভালবাসা
বড় বেশি প্রয়োজন; তার কোলো মাথা
রেখে শোয় তৃষ্ণার্ত পুরুষ।
কবিতার পঙ্ক্তি খোঁজে আনত চোখের কামরূপে
স্মৃতি স্বপ্নাচ্ছন্ন পাখি, মাথার ভেতরে গান গায়,
সুরে কালাকাল বাজে। একটি ফড়িং
বইয়ের ওপর দেয় প্রাণের উত্তাপ, তারপর আলগোছে
তরুণীর স্তনের সুঘ্রাণ নিতে যায়।
পুরুষ আবৃত্তি করে মনে-মনে যেখানে কোকিল
আর গাইবে না গান, ফুটবে না ফুল, বাগানে কি
পথপ্রান্তে, ফসলের সজীবতা মুছে যাবে, প্রেম
চরম নিষিদ্ধ হবে, সেখানে আমার
নিঃশ্বাস নিশ্চিত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে লহমায়
মূঢ়দের খেলাচ্ছলে। পুরুষকে দলে পিষে একপাল
বাইসন ছুটে যেতে থাকে।
স্বপ্নে তার ভ্রমরের ঝাঁক, সে পবিত্র বন্ধ দরজার
সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, ভুল তীর্থযাত্রী, দ্বিধান্বিত,
কারা তাকে সরে যেতে বলে ক্রুদ্ধ স্বরে। প্রতিবাদহীন
একা
হেঁটে যায়, হেঁটে যায়; প্রকৃত সে যায়নি কোথাও।
রক্ত খেকোদের সামনে
চা খেতে-সংবাদপত্র পড়ি।স্থুলাক্ষরের হেডলাইন
সন্ত্রাসীর মতো চোখ রাঙিয়ে
দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে তাড়া করে, আমার দিকে
উঁচিয়ে ধরে স্টেনগান। বিপন্ন উদ্বাস্তুর মতো
ব’সে থাকি খোলা আকাশের নিচে,
ভূমিকম্পে ধসে-পড়া আমার হাত
একটি অস্পষ্টস্মৃত কাহিনীর সূচনা এবং সমাপ্তি।
বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে
একটু জিরিয়ে নেব, স্বপ্নের ডানার নিচে
নিদ্রাশিত দ্বীপের মতো থাকব, তার জো নেই।
আমাকে ক্রমাগত তাড়িয়ে বেড়ায়
এক পাল রক্তলিপ্সু শিকারী কুকুর, যাদের দাঁতে
অসংখ্য প্রাক্তন হত্যাচিহ্ন। পালাব কোথায়?
এই বয়সেও তারুণ্য আমার শিরায় জিপসি-নৃত্য,
পলাতকের ভূমিকা আমার পৌরুষকে ভেংচি কাটে।
এই দেখ, আক্রান্ত গোধূলিতে নিরস্ত্র আমি
রক্ত খেকোদের সামনে কেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছি
হাতে নিয়ে কবিতার খাতা। ঘোর অমাবস্যায়
আমার কবিতা জ্যোৎস্নাস্নাত পাখি এবং
অসত্য আর অন্যায়ের আর বর্বরতার ঋতুতে
জাগর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।
শব্দ
সেই কবে থেকে শব্দ আমাকে স্বস্তি দেয় না,
মস্তিতে রাখে বন্দী, ঘুমোতে দেয় না শান্তিতে, ক্রুদ্ধ
পাখির মতো
একটানা ঠোকরাতে থাকে সকাল সন্ধ্যা, ঘোরায়
অবিরত বনবাদাড়ে, আলো আঁধারে,
তৃষ্ণায় জিভ বেরিয়ে-আসা মাছে, যেখানে
গ্রাম্য বধূর লাশ পশুর লোভের করাতে অপভ্রংশ,
সনাক্ত করণের পরপারে। শব্দ আমাকে হাতছানি দিয়ে
ডেকে নিয়ে নাকানি চুবানি খাওয়ায় খানাখন্দে।
কখনো কখনো প্রতিশোধ আমার মধ্যে
লকলকে আগুন, হঠাৎ
কোনো কোনো শব্দের গাল পুড়িয়ে দিই, কান
মুচড়ে দিই, যেমন কোনো যন্ত্রী সুর বাঁধার সময়
বাদ্যযন্ত্রের কান। আবার কখনো
লাঠির ডগার ঘোরাই বনবন, তপ্ত কড়াইয়ে ভাজি,
করাই সেবন কবিরাজী তেতো বড়ি, নেহাইয়ে ফেলে
বার বার মারি হাতুড়ির বাড়ি, কাস্তে দিয়ে কর্কশ কাটি।
রাত্রির জঠরে দাঁড়ানো শেয়ালের চোখ থেকে,
বরজাশ্রয়ী পানপাতা থেকে, অনূঢ়ার স্তন থেকে, ঈগল
আর সাপের অমীমাংসিত বিবাদ থেকে, ভোরের
স্পর্শ-লাগা
ডিমের কুসুম থেকে, সন্ন্যসীর পিঙ্গল জটা, অমিততেজ
শহীদের বুকের গোলাপ ফুটো, মগরেবে হঠাৎ-দেখা
সিজদারত মানুষের চন্দ্রাকৃতি, সুরাইয়ের ছায়া,
পূর্বপুরুষদের অস্পষ্ট পদধ্বনি আর
বল্লমবিদ্ধ গলার আর্তনাদ থেকে টপকে পড়ে শব্দ।
শব্দ ত্র্যারিয়েলের রেশমপ্রতিম
পাখার আন্দোলনের সত্য।
শব্দ জলাভূমির ধারে গোধূলিতে
ক্যালিবানের আলস্যময় শয়নের সত্য।
অর্ধপশু অর্ধমানবের রোমশ হাতে
নির্জন জল ঝকঝকে আয়নার মতো
টুকরো টুকরো হয় এবং আমি বেলা অবেলায়
জোড়া লাগনোর খেলায় মেতে উঠি।
শ্রোতা
বিকেল বেলা এখানে এসেই লোকটা কেমন
ভ্যাবাচ্যাকা। এত হৈ চৈ, অথচ কেউ কারও কথা
শুনছে ব’লে মনে হচ্ছে না। শব্দগুলো
ইট পাটকেলেত মতো ঠোকাঠুকি করছে অবিরত।
লোকটা শত চেষ্টা ক’রেও কারও দৃষ্টি
ওর দিকে ফেরাতে না পেরে
মুখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে। সারা মুখে ভর
সন্ধেবেলার
অন্ধকার, মাথার ভেতর অন্ধ পাখির ঠোকর।
এখনই অন্ধ বন্ধ কোনো না পাখা,
লোকটা নিজেকে প্রবোধ দেয় চারপাশে
স্তব্ধতার মনোজ জাল ছড়িয়ে। লোকটার মাথা
ক্রমাগত মেঘ স্পর্শ করার বাসনায় স্পর্ধিত হয়।
ওদের কিছু কথা শোনাবার ছিল লোকটার,
কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনার
ব্যগ্রতাকে নাচায়নি চোখের তারায়
পরিণামহীন হৈ-হল্লাই ওদের অধিপতি।
লোকটা আখেরে বলতে-চাওয়া কথাগুলো
বুকের ভেতর গুছিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়াল এক
ভিড়
গাছপালার মধ্যে। ওর মুখে মুক্ত উচ্চারণ; গাছ, পাখি,
নির্জনতা আর বাংলা লিরিকের মতো চাঁদ তার শ্রোতা।
সামান্যই পুঁজি
গর্ব করবার মতো কিছু নয়, সামান্যই পুঁজি।
রোদ আনতে চাঁদিনী ফুরায়; তার চুলে, নাভিমূলে
বৃষ্টি মেখে দিলে প্রাণে বয়ে যায় খরার পবন।
বাড়ির সম্মুখে সন্তর্পণে পদচ্ছাপ রেখে গেলে
কোমল হরিণ কোনো বাজে না গভীর রাতে বাঁশি।
অভ্র দিয়ে শান্তির কুটির বানানোর বাসনায়
কামলার মতো খাটি সারাদিন, তবু অসমাপ্ত
দেয়ালে গজায় বুনো ঘাস। কবে থেকে ব’সে আছি
নতমুখে, মহাজন তাগাদা শোনায়, নিদ্রাছুট
নিশীথে আমাকে ঠোকরাতে থাকে অশান্তির পাখি।
স্বপ্ন গুঁজে দেয়
তোমরা আমাকে বুঝি পোষমানা পশু
বানিয়ে রাখতে চাও খাঁচার ভেতর? এ জীবনে
যা কিছু গৌরবময় তার প্রতি উদাসীন নিত্য
খুঁটব আহার্য আর নিজেরই পুরীষে রাত্রিদিন
দেব গড়াগড়ি, মাছি বসবে শরীরে
যখন তখন, তাড়াবার ইচ্ছাটুকু নির্বাপিত,
জমবে আত্মায় শুধু আলস্যের ক্লেদ-
এই তো তোমরা চাও, হে আমার প্রাণের স্বজন।
আমার স্বপ্নের চারপাশে ছারপোকা ঘোরে, মৃত
নক্ষত্রের ছায়া ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে কথা বলে
কবিতার মেরুন খাতার কানে কানে। সেই কবে
কাঁদতে ভুলেছি বলে ফাঁকা দৃষ্টি মেলে
চেয়ে থাকি সবুজ ডোবায়
নিজের মুখের দিকে। একটি বিষণ্ন পাখি কেঁদে উড়ে
যায়।
আমার বুকের ডান দিক থেকে বারুদের ঝাঁ ঝাঁ
গন্ধ ঝরে যায়,
আমার দু’চোখে রক্তছিটা শব্দহীন কলরব করে আর
করতলে দুঃস্বপ্নের কাকের করোটি
নেচে ওঠে বারে বারে। কোকিলের গানের আশায়
কান পাতি, ঘাতকের পদধ্বনি মেরুদণ্ডে হিম মেখে দেয়।
আত্যস্ত কঠিন আজ প্রকৃত কবির মতো কণ্ঠে
অসত্যের কোলাহল থামিয়ে সত্যের
পূর্ণিমায় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করা। ক্ষিপ্র নেকড়ের কাছে
সিংহের চকিত আত্মসমর্পণ অতি
শোচনীয় দৃশ্য বটে। রক্তে নেই তারাবাতি-দ্যুতি,
তাৎপর্যের আভা ক্রমাগত বহু দূরে সরে যায়।
তোমরা দেখছ যাকে এমন বিপন্ন গোধূলিতে,
সে-তো আমি নয়।
কোথাও সোনালী ঘন্টা বাজে, জাগরণ; খাঁচার ইস্পাতি
শিক
বেঁকে যায় একে একে, খুলে যায় দ্বার,
যেন সূর্যোদয়,
এবং শেকল খসে, ছটে যাই বর্শার মতোই
উদ্দাম, স্বাধীন; পায়ে মেঘ চুমো খায়,
নিরায় শিরায় ভোরবেলাকার রৌদ্র রং ময়ূরের নাচ।
ডানাঅলা কে বার্তাবাহক অগোচরে
আমার মুঠোয় কিছু স্বপ্ন গুঁজে দেয়।
হরিণের হাড়
বেশ কিছুদিন থেকে প্রেরণা ফেরারী; যেন আমি
লুণ্ঠিত কাঙাল, একা-একা
ঘুরি ইতস্তত দিশাহারা। এখন কোথায় গেলে
আবার উঠবো ভ’রে কানায় কানায়?
আখেরে বনের চারু হরিণের নিকট গেলাম
দিনান্তের অস্বচ্ছ আলোয়। তখন সে
পাতা থেকে ঝ’রে-পড়া সপ্নের সবুজ
খাচ্ছিলো চিবিয়ে, চমকিত তাকায় আমার দিকে।
আমি যে নিষাদ নই, অসহায় প্রার্থী একজন,
টের পায়, দোলায় শিঙের কারুকাজ,
ঝরে সৌন্দর্যের কণা চারদিকে। গূঢ় স্বরে বলে,
‘আজ নয়, অন্য কোনোদিন তুমি এসো পূর্ণিমায়।
শান্তি নেই, নিদ্রাহীনতার অন্ধকার
টানেলে আমাকে এক বুড়ো
গেঁথে নেয় তীক্ষ্ণ শিকে, উল্টে আগুনে পোড়ায়
সারা রাত; ব্যর্থ শব্দ লেগে থাকে ঠোঁটে, মরা মাছি।
পূর্ণিমায় বনে যাই, খুঁজি সেই হরিণের সানন্দ ভঙ্গিমা,
আমার পায়ের নিচে পাতা বেজে ওঠে,
হঠাৎ অদূরে দেখি প’ড়ে আছে ঝোপের কিনারে
জ্যোৎস্নার রঙের মতো কতিপয় হাড়। হরিণের?
দ্যুতিময় কী যেন প্রবেশ করে আমার ভেতর
অকস্মাৎ, সৃজনের আলোড়নে হই
ক্রিসমাস গাছ, সব ঠোঁট থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি
মুছে যায়, যখন আমাকে
গাছপালা, পাখি আর জোনাকিরা করে
সম্ভ্রমে কুর্নিশ, মেঘ এসে
আমার চরণ ছোঁয়, আতিথ্য জানায় নক্ষত্রের দরবারে,
অন্তরালে নেচে ওঠে স্বপ্নবৎ হরিণের হাড়।
হৃদয়
সেদিন একালবেলা আয়নার সমুখে দাঁড়াতেই
হাত থেকে টুথব্রাশ খ’সে যায় আর
হঠাৎ বেরিয়ে আসে আমার হৃদয়,
ঠাঁই নেয় জানালার গ্রিলে, যেন পাখি,
উড়ে যাবে ঘন কুয়াশায়। গোধূলির
আকাশ রঙিন কাঁথা, মেঘ সেলাইয়ের
কাজে মগ্ন একজন; আমার হৃদয়
তার বুকে ঝুলে থাকে, যেন নষ্ট চাঁদ।
হৃদয়বিহীন আমি চাঁদ খেয়ে ফেলি ফালি ফালি
ক’রে আর আমার ভক্ষক নাম রটে চরাচরে।