- বইয়ের নামঃ স্বপ্নেরা ডুকরে উঠে বারবার
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আছে একজন
বহুদিন পর অকস্মাৎ অপরাহ্নে চা-খানায়
বন্ধুরা আমাকে দেখে চমকে ওঠেন, যেন কোনো
প্রাচীন যুগের প্রেত দিলো হানা তাদের ডেরায়। প্রত্যেকের
মুখে উদ্বেগের কাঁটা, তিন জোড়া চোখ
শুধু প্রশ্ন হয়ে
সেঁটে থাকে আমার শরীরে। বন্ধুদের কৌতূহল
মেটাবার জন্যে বলি, ‘আছে
একজন, যার সৌন্দর্যের অপরূপ
দেয়ালি আমাকে খুব ঝলসে দিয়েছে
তন্দুরী রুটির মতো। ইদানীং আমি
সত্তায় বেড়াচ্ছি বয়ে কামনার অজস্র নাছোড় মৌমাছির
কামড়ের দাগ,
যে মৌমাছি ঝাঁক বেঁধে ওড়ে সারাক্ষণ
তার ওষ্ঠে, বুকের উদ্যানে আর নাভির মদির সরোবরে।
আজও তিনি
ছিল না বিষয়বুদ্ধি এতটুকু; তাই ঘর ঠিক
না করেই একপ্রস্থ আলখাল্লা পরে অর্ধাহারে,
অনাহারে বনের স্বর্গীয় মোষ গেলেন তাড়াতে।
ছিল না বিষয়জ্ঞান, তবু জ্ঞানকেই সাজালেন
প্রেমের আভায়। ডেরাছুট ঘুরেছেন পথে পথে
সহায় সম্বলহীন চরাচরে ঈশ্বরের ঘর
বানাবার কী তীব্র মোহন আকর্ষণে। জানি তিনি
রাজার অধিক রাজা, কিন্তু জোটে কাঁটার মূকুট।
যখন অনাথ শিশু শূন্য এনামেলের পাত্তর
মেলে ধরে পথচারীদের দিকে, তখন তাঁকেই
দেখি সেই শিশুর ভিতরে; কোনো শিল্পী নিঃসঙ্গতা
আর যন্ত্রণায় কান্না বয়ে বেড়ায় যখন, দেখি
তিনি ক্রূশকাঠ পিঠে নিয়ে চলেছেন হেঁটে একা।
ধর্ষিতা নারীর চোখে তাঁর চোখ, নিষ্ঠুর, গোঁয়ার
চাবুকের অন্ধ দাগ যে দাসের পিঠে জেগে থাকে,
তিনি সেই দাস হয়ে অত্যন্ত একাকী কষ্ট পান।
ছিল না বিষয়বুদ্ধি এতটুকু, বস্তুত বোকাই
বলা যায়। আত্মরক্ষা জরুরি জেনেও কোনোকালে
গড়েননি সশস্ত্র বাহিনী, মেষপালকের মতো
শুধু কতিপয় মেষ নিয়ে গাধায় সওয়ার হয়ে
কখনো, কখনো নগ্ন পদে যোজন যোজন পথ
হেঁটেছেন; একরত্তি সোনারূপ নয়, শুধু বাণী
ব্যাকুল ছড়িয়ে দিয়েছেন মরুভূমিতে, প্রান্তরে,
নদীতীরে বিনিময়ে দাগি চোর আর খুনেদের
সঙ্গে শতাব্দির কলঙ্কের মতো পেরেকে পেরেকে
হয়েছেন বিদ্ধ আর আজও এশিয়ার বুভুক্ষায়
জীবন্ত কংকাল হন, স্বৈরাচারী বুটের তলায়
হাতীর কিমতি দাঁতে তৈরি শিল্প সামগ্রীর মতো
পাঁজরের হাড় তার গুঁড়ো হয় দিকে দিকে, আর
বেদনার্ত আফ্রিকায় বেকসুর ঝোলেন ফাঁসিতে।
আমার দুচোখে বেঁধে
আমার দু’চোখে বেঁধে রেখেছি প্রতিমা। তার রূপ
কেমন নিশ্চুপ
কানায় কানায় ভরা সরোবর। আমার হৃদয়ে ঢেউ ওঠে,
যখন অধরে তার ফোটে
পারস্য গোলাপ-কুঁড়ি। প্রায়শ কুড়াই অসামান্য স্মৃতিকণা
নীরব সাধনে, ভুলব না
তাকে ভুলব না কোনো দিন।
আছে তো চোখেই বাঁধা, তবু কেন হয়ে যাই আর্ত ভায়োলিন?
উৎসব-রাতে হঠাৎ
উৎসব রাতে গিজগিজে ভিড়ে মনে হলো আমি
বড় অসহায়, একা।
মনের ভেতর হঠাৎ ভ্রমর সুর তুলে বলে-
কতকাল পরে দেখা।
শরীরে তোমার জড়িয়ে নিবিড় সুনীল আকাশ
অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলে,
এবং বিউটি পার্লারে রচা খোঁপা বেলফুলে
ঈষৎ সাজিয়ে নিলে।
মোমের মতোই গলে যায় খুব দেহমন জানি
নীল আগুনের আঁচে,
সেই ভয়ে আমি আড়ালে ছিলাম রাত্রিছায়ায়,
যাইনি তোমার কাছে।
তোমাকে নিত্য মনে রাখি কিনা, প্রশ্নটা শুনে
ছিলাম নিরুত্তর;
কী করে জানাই, তুমি নেই তাই হৃদয় আমার
শোকাগ্নিময় থর।
ঘরে ফিরে গিয়ে যখন শরীর থেকে নীলাকাশ
চুপে নিয়েছিলে খুলে,
তখন হঠাৎ একাকী প্রহরে পড়েছিল টান
তোমার মর্মমূলে?
বারান্দাটায় একা বসে ভাবি, কেঁপেছিল কোন্
সে-ভাষা তোমার ঠোঁটে?
হৃদয়ে আমার দূর অতীতের গোলাপ-পাগল
বুলবুলি গেয়ে ওঠে।
দেখলাম তুমি ভাড়াটে এ ফ্ল্যাটে দাঁড়ালে আমার
সামনে ছড়িয়ে হাসি।
এ কেমন দাহ শিরায় শিরায়, আমি নই আজও
মঠবাসী সন্ন্যাসী।
তোমাকে অধীর ছুঁতে গিয়ে দেখি তোমার বদলে
শূন্যতা আছে ফুটে।
শ্বাসকষ্টের ধকল সইবো, কাটবে জীবন
অতীতের কণা খুঁটে।
নেপথ্যে কার রটনা তোমার প্রাক্তন রূপ
হয়েছে খানিক ফিকে,
সত্যি বলতে, আমিও চলেছি অতিশয় দ্রুত
অস্তাচলের দিকে।
উৎসব-রাতে মনে হয়েছিল তোমাকে দখল
করেছে বিষণ্নতা
এবং আমার মনে সেঁটে থাকে এঁটোময় পাতে
মাছির মতন কথা!
অনিশ্চয়ের প্যাঁচা প্রগল্ভ তৃতীয় প্রহরে,
কাঁপে সত্তার ভিত।
আমার ভেতর উঠল কি জেগে বীতংসঘেরা
মরালের সঙ্গীত?
একদা এক কবিতা
একদা এক কবিতা, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতে
পাখাঅলা ঘোড়ার লাগাম,
বেরিয়েছিল একটি ডালিমের খোঁজে,
যা সারিয়ে তুলবে অসুস্থ রাজাকে। একদা এক কবিতা
মায়াবিনীদের স্মৃতি-ভোলানো গান উপেক্ষা করে
ভুরু থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল মতিচ্ছন্নতার ছায়া।
প্রান্তরের পর প্রান্তর পেরিয়ে, ডিঙিয়ে
পাহাড়ের পর পাহাড়
সন্ধ্যেবেলা সে পাখাঅলা ঘোড়াটাকে থামায়
গাছতলায়, জিন থেকে নেমে ডালে ঘোড়ার
লাগাম বেঁধে সে ঘুমায়। ছায়া গ’লে গ’লে
পড়ে ওর চোখে-মুখে স্তব্ধতার সর-পড়া ঠোঁটে, ঘোড়ার লেজে
কুণ্ডলি পাকিয়ে-থাকা জগমোতির হারে। তার পাশ দিয়ে
বয়ে যায় ঝরণা, ঝরণাধারায় ভাসে অসংখ্য গোলাপ।
যখন ওর ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলা
দূর উদ্যানের স্মৃতি বয়ে-আনা পাখির গানে,
সে তার ব্যর্থ অভিযানের কাহিনীগুলো আবৃত্তি করে
মনে-মনে, তারপর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে, কখনো
ঝরণার নুড়ির ওপর দিয়ে দুলকি চালে
যাত্রা শুরু করে, কখনো টগবগিয়ে চলে সবুজ উপত্যকায়,
কখনোবা রঙিন মেঘের পেলবতায়
ঢেউ তোলে পাখাঅলা ঘোড়ার ক্ষুর। কখনো
ওর চোখে এসে লাগে সুদূর ডুমুর পাতার
ঝলক, নাকে দরিদ্রের খড়-ছাওয়া ঘরের বলক-আসা ভাতের ঘ্রাণ।
সেই কবিতা, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতের মুঠোয়
রাশি রাশি নক্ষত্র, লক্ষ্য করে
দূরের মেঘে কিসের কুণ্ডলি, ঘোড়াটা ভড়কে যায়
বেধড়ক, পালাতে চায় উল্টো দিকে।
সে লাগাম টেনে ধরে জোরে, কলকারখানার ধোঁয়া
ওর চারদিকে, চোখে কাঁদানো গ্যাসের দুঃসহ জ্বালা।
কারা যেন তাকে পরিয়ে দেয় কোমরবন্ধ,
আর সেখানে সে দেখতে পায়
খাপে-ঢাকা তরবারি। যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ,
হাতের মুঠোয় রাশি রাশি নক্ষত্র, সে কিছুতেই ভেবে পায় না
এই অস্ত্র তার কী কাজেই বা লাগবে?
পাখাঅলা ঘোড়াটা ঘুরতে থাকে দিগ্ধিদিক।
ঘন অরণ্যের দিকে এগোতে এগোতে সে ডান দিকে
ফেলে দেয় কোষবদ্ধ অসি আর বাঁ দিকে
শপথের মতো দৃঢ় কোমরবন্ধ। আবার ছুটে চলে রোগহর
ডালিমের উদ্দেশে, যার প্রতীক্ষায় আছে রাজ্যের সবাই।
দিন যায়, রাত কাটে, এভাবে চলতে চলতে
একদিন সে অভীষ্ট উদ্যানের
প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, ওর কানে ভেসে আসে
অমর্ত্য গান, সে-গান কোনো পাখির
না নারীর, শনাক্ত করা মুশকিল। অথচ সেখানেই
দশদিক থেকে টর্নেডোর মতো তেড়ে আসে হা রে রে রে
দস্যুদল বল্লম আর অসি উঁচিয়ে
ওর দিকে, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতে পাখাঅলা ঘোড়ার লাগাম।
এই আচমকা আগ্রাসনে দিশেহারা সে
কোমরে হাত রাখে, কিন্তু সে মুহূর্তে ওর মনে ছিল না
সেখানে না আছে কোমরবন্ধ, না কোনো
তীক্ষ্ণ তরবারি। তার কাঁধের পূর্ণিমার চাঁদ আর
হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে ছুটে আসে ঝাঁক ঝাঁক তীর,
বল্লম, আর ওর অস্তিত্বের
ক্ষতগুলো থেকে ঝরতে থাকে অবিরত
বর্বরদের চম্কে দেয়া গোলাপ, সাদা, লাল, হলদে, সবুজ।
এমন ঠেলতে ঠেলতে
আজ
তুমি আমাকে
এমন ঠেলতে ঠেলতে
এ কোথায় নিয়ে এসেছ ঢাকা,
হে শহর আমার?
তোমার কনুই আমাকে
পৌঁছে দিয়েছে, বলা যায়,
প্রায় উপকণ্ঠে।
তোমার পুরানো সৌন্দর্যে
অভিভূত আমি
ভালোই ছিলাম, একথা
অস্বীকার করব কী করে?
নানা ফাটল-খচিত এক বাসায়,
ইঁদুর, ছুঁচো, চামচিকা আর মাঝে-মধ্যে
আরশোলার ওড়াউড়ি
হয়ে গিয়েছিল গা-সওয়া।
হেমন্তে চড়ুই দম্পতি
বাসা বাঁধত ঘরের ভেতরে।
খড়কুটোয় নোংরা হতো মেঝে,
কখনো-সখনো পাখির সংসারের
কণা এসে পড়ত মাথায়,
মাথা নেড়ে মেনে নিতাম
সেই উপঢৌকন। কোনো কোনো
অতিথি বলতেন, ‘বেশ আছেন কবি।
আমি কাঠের বর্গার
ফাঁক-ফোকরের দিকে
দৃষ্টি মেলে দিয়ে একটু হেসে
সায় দিতাম তাঁদের উক্তিতে।
হ্যাঁ, বেশ ছিলাম, ঢাকা, শহর আমার,
কলতলার জটলা, নড়বড়ে চা-খানা
আর মাতালের চিৎকারে শিউরে ওঠা
রাতের গলিতে, ফিল্মি গানের ভেসে-আসা কলিতে
মৌজে-থাকা মাস্তানদের
আড্ডার হৈ-হল্লা
আর তেহারির ঘ্রাণে, ডাস্টবিনের
আশপাশে কুকুর, বেড়ালের
সম্মেলনে, দিব্যি ছিলাম।
কিন্তু তুমি আমাকে
হঠাৎ পাঠিয়ে দিয়েছ
তোমার হৃদয় থেকে অনেক দূরে।
নির্বাসিত কবির মতো
আমি দিন কাটাই,
রাত্রি যাপন করি,
অথচ আমার মন পড়ে থাকে তোমার
পুরানো রূপের গভীরে।
আজ রাত্তিরে কিছুতেই
আমার ঘুম আসছে না। নিঝুম
পাড়া, হয়তো কোথাও কোনো
ছিঁচকে চোর ওৎ পেতে আছে,
আমার জানলার পাশে নারকেল
গাছে দেবদূতের দোলা। কেন জানি না
নিজের গোটা জীবন
উঠল দুলে
আমার দৃষ্টিপথে। কত চড়াই-উৎরাই,
পুকুরে মাছের ঘাই, সকালবেলা
মোরগের ডাক, পাখির শিস,
নীল প্যাডে চিঠি, দুপুরে
ভাঙা মন্দিরের ছায়া,
ঘোড়ার গাড়িতে নগর ভ্রমণ,
মধ্যরাতে টেলিপ্রিন্টারের শব্দ,
কবিতার কচ্ছপ কামড়, প্রেমের রাজ্যে
জব্দ, অর্ধচন্দ্র খেয়ে বিদায়, অকস্মাৎ ধুমধাড়াক্কার
ফুলশয্যা, অনিয়ন্ত্রিত জন্ম;
মার্কস আর ফ্রয়েডের সহাবস্থানে আস্থা,
সামরিক শাসনে কারো আস্থা কারো বা অনাস্থা, রেড বুকের
সূত্র আওড়ানো, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার
হুইল চেয়ারে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা।
খানাখন্দে মানবতার হুমড়ি খেয়ে পড়া,
শিকারির গুলিতে পালকখসা গণতন্ত্রের পতন,
শিরাস্ত্রাণের উত্থান!
ঢাকা, হে শহর আমার,
ঠেলতে ঠেলতে আমাকে
এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি?
তোমার চতুঃসীমা থেকে,
একেবারে বাইরে ফেলে দেবে না তো?
পড়বে না জেনে বুক শেল্ফ
হাতড়ে বেড়াই, তাকে তুলে-রাখা
গুরুমুখী লাল বইয়ে
ধুলোর আস্তরণ, মগজে ভ্রমণের গুঞ্জন, অন্ধকারে
দৃষ্টি ছড়িয়ে ভাবি,-
আমার প্রতিবেশে
থরেথরে শত ফুল ফুটবে কবে?
এমন দিনে
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ যথারীতি;
এ মাহ ভাদরে
ভরা এ শহরে
সারাদিনমান বৃষ্টি শুধু বৃষ্টি একটানা আর আসমানে
মেঘের কুচকাওয়াজ, তেড়ে-আসা কসাক সওয়ার
যেন ঝোড়ো হাওয়া,
হাজিরা খাতায় সই করেননি সূর্যদেব আজ। এ ভবের
হাটে কাকে সত্য বলে মানি? গলিতে জোয়ার এলো,
ভিজে জাব ক্ষয়রুগী রিক্শা-অলা চড়া ভাড়া হাঁকে,
বস্তি ডোবেঁ অকাল বন্যায়, ব্যাঙ ডাকে মাঝে-মাঝে,
ভরা সাঁঝে শিশুর কান্নার রোলে মুখ-গোমরা আকাশ আরও
বেশি মুখ কালো করে।
টিপয়ে চায়ের কাপ, ধোঁয়া;
দিন কাটে ছায়া নিয়ে। বৃষ্টির ধোঁয়ায় আমি স্মৃতিভারাতুর
আর মধ্যবিত্ত মনে চুপিসারে হামাগুড়ি দেয় ছদ্মবেশী
বুর্জোয়া-বিলাস। একরোখা বৃষ্টি পড়ে
চতুর্দিকে, রবীন্দ্রনাথের গান অবিরাম হানা দেয় মনের কোটরে-
পাগল আমার মন জেগে ওঠে। টেলিফোনে শুনি
ক্লান্ত কণ্ঠস্বর
তোমার, রাত্রির দুঃস্বপ্নের ভাষা করে
ভর স্বরে, বললে, ‘ভুলে যেতে চাই, তবু
বৃষ্টির সুরের মতো স্মৃতি আমাকে রয়েছে ঘিরে
রাত্রিদিন। আসমান কয়লার খনি,
ময়লা গলিতে ভেজে উন্মাদিনী, বাতাস হাজার
নেকড়ের আর্তস্বর, সে মুহূর্তে নিজেকে কেমন
অবান্তর মনে হলো উৎসব রাত্রির ক্লিন্ন উচ্ছিষ্টের মতো।
তোমার গলায় বাজে অতীতের স্খলিত নূপুর, দুলে ওঠে
নিবু নিবু ঝাড়লণ্ঠনের শোভা। মনে মনে বলি,
হে মেয়ে কী খোঁজো তুমি পলায়নবিলাসী ছায়ার
সঙ্গে নিত্য সহবাসে? এ বৃষ্টির দিনে
রভসে গোঙাও কেন বিগত যুগের ভস্মরাশি বুকে নিয়ে?
বরং ক্যাসেট প্লেয়ারে আমির খাঁর মেঘ রাগে যাক
ভেসে যাক হৃদয়ের একূল-ওকূল।
টেলিফোন ভরা বর্ষাখচিত গলায়
শোনাল আমাকে,-
‘কেন তুমি শিরায় স্পর্শের
অস্থির উৎসব জ্বেলে দিতে চাও বারবার? কেন
আমাকে বসাতে চাও মদন মণ্ডপে? আমার তো
ভিন্ন অধিষ্ঠান।
তক্ষুণি আমার চোখে
এক জোড়া সুতীব্র সবুজ চোখ জ্বলে ওঠে আর
নাকে লাগে বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে ভেসে আসা দূর
লাশকাটা ঘরের উৎকট গন্ধ, বিবমিষা জাগে!
এসেছি দাফন করে
কেউ কি শুনতে পাচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসা
বনপোড়া হরিণীর
আর্তনাদ? সর্ষেক্ষেত, আসশ্যাওড়ার
ঝোপ, মাছরাঙা
আর পানকৌড়িময় বিল,
প্রান্তর পেরিয়ে-আসা ধ্বনি ক্রমাগত
আছড়ে পড়ছে এ শহরে
রাজপথে, গেরস্ত পাড়ায়, কলোনিতে
দেয়ালে দেয়ালে, কারাগারে,
অত্যন্ত সতর্ক
প্রহরী বেষ্টিত ছাউনিতে, পরিখায়
কেউ কি শুনতে পাচ্ছে? নাকি এ আমার
মনেরই খেয়াল? অতিশয় ন্যালাক্ষ্যাপা
কবিত্বের ব্যাপার স্যাপার?
এই তো শুনছি স্পষ্ট এবং নির্ভুল-
কে যেন কুয়াশাময় কণ্ঠে ‘সত্য, সত্য’ বলে যাচ্ছে ডেকে
একটানা, অথচ সাধের
সত্য অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে
সে কবে হয়েছে দেশান্তরী। সে আবার আসবে কি
ফিরে কোনো দিন
ভীষণ উড়নচণ্ডে, ভ্রষ্ট, গৃহত্যাগী
পুত্রের মতন?
‘সুন্দর, সুন্দর, ওরে সুন্দর কোথায় গেলি’ বলে
নেকড়ের গায়ের রঙের
মতো অন্ধকারে কেউ বুকফাটা আওয়াজে ডাকছে
যেরকম মৃণাল সেনের
ফিল্মে ছেলে-হারানো মা উজাড় ভিটায়
ফসলবিহীন
ক্ষেতে ও প্রান্তরে সন্তানের নাম ধরে
ডাকে, ডাকে, ডাকে; সে কোথায়
সুন্দর রয়েছে পড়ে; তার শব নিয়ে কী ভীষণ টানাটানি,
খাবলাখাবলি
করছে শেয়াল আর কুকুরের পাল,
যেমন আকালে করে ওরা আদমসন্তান নিয়ে।
‘কায়ক্লেশে যাচ্ছিলাম ভদ্রাসনে। উল্টো দিক থেকে
ক’জন নধর ভদ্রলোক-
কেউ পান চিবুতে চিবুতে, কেউ কেউ সিগারেট
ফুঁকুতে ফুঁকুতে,
কেউবা মাটিতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে-
আমাকে জিগ্যের করলেন,
‘কোত্থেকে এলেন? আমি সূর্যাস্তের দিকে
দৃষ্টি মেলে বলি,
সাত হাত জমিনের নিচে
এসেছি দাফন করে বিবেকের মৃতদেহটিকে।
কক্ষণো ছাড়ব না
মানুষের হাটে হেঁটে যেতে যেতে
কবি বললেন, আমাকে বাৎলে দিন-
কবন্ধ এই কপট সমাজে
শিল্পের কাছে কার কতটুকু ঋণ?
কথামালা তার ঢেউয়ের মতোই
পাথুর দেয়ালে ভীষণ আছড়ে পড়ে।
বেলা-অবেলায় খঞ্জের মতো
মাথা নিচু করে কবি ফিরে যান ঘরে।
কিন্তু কোথায় এমন আঁধারে
নান্দনিক সে কবির বাড়ির পথ?
থিকথিকে পচা কাদা সবখানে,
ডুবে গেছে তার বিদ্যুৎপ্রভ রথ।
মেধা ও মনন গ্যাছে বনবাসে,
প্রকৃত মানুষ সবখানে আজ মৃত।
আদর্শ পচে আগাড়ে-ভাগাড়ে,
সে কটু গন্ধে শ্মশান-শেয়াল প্রীত।
সমাজবাদের পাট তুলে দিয়ে
কত বিপ্লবী ছড়ায় ব্যাপক বিষ।
ক্রান্তিলগ্নে বড় দোটানায়
খঞ্জনা নাচে, শ্যামা পাখি দেয় শিস।
এই নাচ আমি দেখব এবং
কুড়াব নীরবে শ্যামার সুরের কণা।
বর্ণমালায় রঙধনু মেখে
আঙ্গিক গড়া কক্ষণো ছাড়বো না।
কালবেলায় ক্রুশকাঠে
তোমাদের ডাক শুনেই ঘর থেকে
বাইরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। অথচ
চৌকাঠে মাথা ঠুকে গেল,
কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে, রক্ত মুছে
আবার পা বাড়ালাম। তখন কে এক পাখি কোত্থেকে
ডেকে উঠল নিষেধের সুর ঝরিয়ে।
আমি সেই নিষেধের ঢেউ উজিয়ে
অনুসরণ করলাম তোমাদের মিলিত কণ্ঠস্বরকে,
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিহত হয়ে ফিরে আসতে হলো
আমাকে, যেমন আসে তট থেকে তরঙ্গ। আমার কপালের ফোঁটা ফোঁটা
রক্ত দেখেও তোমরা
বিশ্বাস করতে পারলে না তোমাদের গন্তব্যই
আমার গন্তব্য। তোমাদের ভেতর থেকে
কেউ আমার দিকে আড়চোখে তাকাল,
কেউ কেউ ছুড়ে দিলো বিদ্রূপের পাথর, কেউবা
ঠোঁটে অনুচ্চারিত
জুড়াস শব্দটিকে নাচাল কিছুক্ষণ। তোমরা তাচ্ছিল্য আর
উপেক্ষায় আমাকে, বলা যায়,
বিতাড়িত করলে, স্পষ্টতই জানিয়ে দিলে
তোমাদের পথে আমার পদচিহ্নের
কোনো ঠাঁই হবে না।
এই কি আমার অপরাধ যে আমি
তোমাদের গলায় গলা মিলিয়ে ডুমুরপাতা
আর আকন্দ গাছে শিহরণ জাগিয়ে
দিইনি ডাক? দোর এঁটে কখনো অক্ষরবৃত্তের
কখনো মাত্রাব্ত্তের পর্বে পর্বে ছায়া আর জ্যোৎস্না
পুরে, নর্দমার গাদ ঘেঁটে হীরে
বের ক’রে সময় কাটিয়ে তোমাদের তীর্থরেণু
গায়ে মাখিনি বলেই কি
আমাকে ফিরে যেতে হলো মুখ অন্ধকার করে?
তোমরা কি আমাকে ডাকবে না আর,
যে ডাক শুনে আমার
হাড় থেকে ত্বক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে শৈবের রোদ,
যে ডাক শুনে আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে
দিগন্তের দিকে ছুটে যাবে যৌবনের উল্লাস?
তোমাদের পথে পদচিহ্ন
আঁকার জন্যে আমাকে কি নাজেরাথের সেই
অমৃত পুরুষের মতো ঝুলতেই হবে কালবেলায় ক্রূশকাঠে?
কেউ তা জানে না
কোনো কোনো দিন খুব ঝোঁক চাপে লোকটার মাথায় হঠাৎ
এঁদো গলি ছেড়েছুড়ে দূর দূর করে
কাক আর কুকুর তাড়িয়ে আঁস্তাকুড়,
ধোঁয়াটে চা-খানা, বোবা রেশনের তালাবন্ধ দোকান এবং
অন্ধ ডোবা অনেক পেছনে
ফেলে চলে যাবে
বহুদূরে যেখানে দাঁড়ালে দেখা যায়
মহাপুরুষের হৃদয়ের মতো দরাজ আকাশ, বুক ভরে
নেয় যায় শরীর চেতিয়ে-তোলা সতেজ বাতাস। মাঝে-মাঝে
লোকটার ভারি ইচ্ছে হয়
সেখানে একলা বসে চুষে চুষে খাবে পাকা আম।
গুমোট রাত্রির পর ভোর হ’লে লোকটা ঝুপড়ির
দোর খুলে পা বাড়ায় পথে।
পাড়াটা বেজায় চোখ পাকানো বাঁকানো শিঙ ষাঁড়ের মতন
মনে হয়। ক’কদম আগে বাড়তেই
ডালপুরি আর তেহারির তেলতেলে গন্ধ লাগে
নাকে, তাকে কেউ কি পেছন থেকে ডাকে?
পেরিয়ে মেথরপট্রি অন্য এক গলির ভেতর
ঢুকে ফের বেরিয়ে কী ভেবে
তাড়াতাড়ি পথ হাঁটে, জানালার ধারে
দাঁড়ানো, তরুণী, বারান্দায় ঝোলে জাফরানি শাড়ি। রাতে তাড়ি
গিলেছিল খুব, দিল বাগ বাগ ছিল,
মনে পড়ে। বেলা বাড়ে, সূর্য জ্বালা ধরায় চামড়ায়।
এ সময়, হাঁটতে হাঁটতে
একাকী লোকটা ভাবে ঠাণ্ডা কামরায় জিরোনো
ছিল ভালো। হাতের চেটোয় কপালের
ঘাম মুছে খোঁজে ছায়া, যেমন ফিল্মের
পোড়া-খাওয়া, ধনীর সুন্দরী দুলালীর ছ্যাঁক-খাওয়া
পথশ্রান্ত বেকার নায়ক।
ঝাঁ ঝাঁ ভাদুরে দুপুরে
লোকটার চোখে তাজা খোওয়াবের ফুলঝুরি ছড়িয়ে চকিতে
মেঘের আড়ালে চলে গেল
একজন জলপরী; সেও হলো অনুগামী
যে পাখাহীন পাখি, অথবা আস্তাবলের বেতো
ঘোড়া পক্ষীরাজ রূপান্তরে। মেঘ আর
মানুষের সখ্য এ রকম, ভাবেনি সে কোনও দিন
এর আগে। রঙিন বুদ্বুদ কত মুখ, চালচুলো, খড়কুটো,
সোনালি-রুপালি মাছ লাফায় চৌদিকে, কে কোথায়
চুমু খায় নিবিড় আশ্লেষে, বোঝা দায়।
কতকাল, কত হরতাল, কত পার্বণ ফুরাল,
ফেরেনি সে কখনো এখানে আর ভাড়াটে ঝুপড়িতে
এঁদো গলিটায় লাঠি ছোরা, স্টেনগান আর বোমার শহরে।
গৃহিণী পাথর তার, ভাগ্য খেলে কানামাছি। লোকটা কোথায়
আছে কোন হালে
মেঘে মেঘে, নির্জন গৃহায় নাকি মায়াবী গাছের ডালে ঝুলে
বাবুই পাখির মতো বাসা বেঁধে একা
কেউ তা জানে না।
ক’দিন পরেই
ক’দিন পরেই
আমার জীবন হবে গোধূলিতে শস্যহীন ক্ষেত, কুয়াশায়
হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া ঘণ্টাধ্বনি। কিছু
পোড়া কাঠ, শূন্য কৌটো, একটি কি দু’টি
প্লাস্টিকের ক্লিপ, আপেলের টুকরে ইতস্তত
থাকবে ছড়ানো আশেপাশে। সেদিন দুপুরবেলা
তোমার শয্যায় পাশে বসে স্বপ্নের জগৎ থেকে
ভেসে-ওঠা অমন রহস্যের চোখ রেখে
চকিতে পড়ল মনে ক’দিন পরেই
তুমি চলে যাবে দূরে, কুড়িয়ে স্মৃতির ধানশীষ
পরিযায়ী পাখির মতন
এবং আমাকে ঘিরে ঘুরবে তখন হানাকার।
সেদিন দুপুরে
বলেছিলে, ‘আমার যে-হাত সাবলীল স্পর্শ করে
তোমাকে কখনো, জেনো সে-হাত এঁকেছে চুম্বন,
সে ঠোঁটও আমার নয়। তবে কার?’ আমি কি তোমার
ছায়ার পুতুলটিকে দিঘিতে ভাসিয়ে তৃপ্ত হবো?
কয়েকটি দিন,
যেন অনাস্বাদিত চুম্বন, কাটে বড় এলোমেলো,
আমার হৃদয় ঝড়বিক্ষুব্ধ সারস;
আমার কবিতাগুলি তোমার নিভৃত শুয়ে-থাকা,
বসে থাকা, বই-পড়া, হাত নড়া দ্যাখে
উপনিষদের
দ্বিতীয় পাখির মতো এবং তোমার বিরূপতা
চাবুকের কালসিটে দাগ হয়ে সেঁটে থাকে আমার সত্তায়।
আমি সেই বেদনার্ত স্থানটিতে পানি ঢেলে ঢেলে
করবো শুশ্রূষা
মধ্যরাতে, যেমন বালক করে আহত পাখিকে,
মাঝে-মধ্যে চুমো খাব। ক’দিন পরেই
স্বর্গচ্যুত আদমের মতো শূন্য প্রহরে প্রহরে
গোঙাবো কেবলি।
ঘুমোতে যারার আগে
হন্তারক গুলিবিদ্ধ হিস্পানি প্রান্তরে পড়ে-থাকা
লোর্কা, তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিমালা স্তব্ধ মধ্যরাতে
মাথার ভেতরে ডালিমের দানার মতন লাল,
হল্দে চকোলেট,
ফিরোজা, বেগুনি গুঞ্জরণ; যেন কেউ কী বিভোর
বাজিয়ে চলেছে এক চন্দ্রিল সিস্ফনি
সত্তা জুড়ে; জানালার কাছে যাই, একটি ব্যাকুল গাছ হাত
বাড়ায় আমার দিকে, বুঝি সখ্য দিতে চায় এই
প্রীতির কাঙালটিকে। মশারির ভেতরে গৃহিণী
ঘুমে কাদা, তার মৃদু নিঃশ্বাস পতনে অতীতের
তরুণীর শরীরের দিলরুবা আর মরূদ্যানের হাওয়ার
ধ্বনি, ঠোঁটে কিছু
স্বপ্নকণা ঝরে, ব্লাউজের বেড়া টপকিয়ে বের
হয়ে আসে স্বপ্নভ্রষ্টতায়
যমজ চাঁদের মতো স্তন, ওর খোলা চুল নিয়ে
খেলা করি, সৌন্দর্য এসেছে যেন ফিরে বেখবর অবয়বে।
রক্তভেজা হিস্পানি প্রান্তর থেকে উঠে
তিনি, লোর্কা, চলেছেন হেঁটে একা দেশদেশান্তরে
দুয়েন্দোর ঘূর্ণিনাচে। মুখের ভেতর থেকে তাঁর
কেবলি বেরিয়ে আসে রঙিন বুদ্বুদ
অবিরত, যায়
দিগন্তের দিকে বাধাবন্ধহীন। ফুটন্তে জিপসি
রমণীর নৃত্যপর ঘাগরা এবং অগ্নি গোলকের মতো
ষাঁড়, বুকে গোলাপ-প্রোথিত মাতাদোর, বৃষ্টিপায়ী
স্তব্ধ ঠোঁটে মৃত্যুর প্রসূন, কাসিদার
স্মৃতি নিয়ে চলেছেন হেঁটে বড় একা।
আজও কি হবে না ঘুম? বাথরুমে বালতিতে পড়ে
পানি, ট্যাপ বন্ধ করা হয়নি নিশ্চয়
ভুলক্রমে। দাঁত মেজে রিলাক্সেন খেয়ে শুয়ে যাই।
ফ্ল্যাট বাড়িটার
কোমরে জড়ানো জ্যোৎস্নালতা; স্তব্ধতাকে
চিরে, যেন জামদানি শাড়ি তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে কাটে
কেউ ফালি ফালি করে, চাঁদের উদ্দেশে অকস্মাৎ
পথের কুকুর গেয়ে ওঠে সেরেনাদ।
গোধূলিতে গরুর গলার
ঘণ্টার রুপালি ধ্বনি যেমন মধুর ভেসে আসে
তেমনি কোনো আওয়াজের ঢেউ
হৃদয়ের তটে এসে ফেটে যায়, সহর্ষ চমকে ওঠে ত্বক। ঘুম নেই,
শয্যায়, দেয়ালে, বারান্দায়
চেয়ারে গাছের পত্রালিতে ঘুম নেই। শত শত
ঘোড়া, মুখের রক্ত জমা, শ্বেতপদ্ম নিয়ে ছুটে আসে
আমার চৌদিকে; হাত
চলে যায় মাথার পেছনে, কতকাল চুল ছাঁটা
হয়নি, হঠাৎ মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় সেই কবে এক
আহত পাখিকে বুকে জড়িয়ে বালক
অশ্রুময় চোখে হেঁটে গিয়েছিল বৃষ্টি ভেজা পথে
সন্ধ্যেবেলা; কে যেন আমার হাত থেকে
এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে কাফকার উপন্যাস
হেসে উঠেছিল বিকেলকে
চমকিয়ে সূর্যাস্তের রঙে তাকে আপাদমস্তক স্নাত
রূপসী কাতিল মনে হয়েছিল! আমি
তার স্বেচ্ছাবলি ভেবে
হৃদয়কে কণ্ঠস্বর ক’রে পৌঁছে দিয়েছি আকাশে,
যেখানে মেঘের ফাঁকে অজস্র গোলাপ ফুটে ওঠে।
ভোরবেলা এখনো গা ঢাকা দিয়ে আছে দূরে কোনো
বিপ্লবীর মতো
দুর্নিবার প্রত্যাশায় শয্যা ছেড়ে কাঠের চেয়ারে
বসে থাকি; যেন আমি অন্য কোনো কাল
থেকে এসে এখানে বিশ্রাম নিচ্ছি, অথবা আমি কি
ভবিষ্যের কেউ এই জানালার পর্দা
সরিয়ে দেখছি ফাঁকা রাস্তা মধ্যরাতে কোনো দূর
শতাব্দীর?
কে যায় একাকী চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত পোজে
খাবি খায় নর্দমায়, মণিরত্ন খোঁজে?
আমিও তো মাঝে-মাঝে
উড়িয়ে মেঘের তুলো ঠুকরে ঠুকরে পথ চলি
জলাঞ্জলি দিয়ে ভব্যতার নীল ভোকাট্রা নিশান।
ত্বরিত বলক-আসা দুধের মতন
কবিতা ফুটছে হাড়ে, মজ্জায়, চাঁদিতে
হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, প্রতি রোমকূপে, নখে।
খাতা টেনে বসি, দেখি রহস্যময়তা কবুতরের ধরনে
নিরিবিলি ডিম পেড়ে যায়
খাতায় পাতায়। ক্লান্ত লাগে, মনে হয়
আমার ভেতরে কোনো যুদ্ধশ্রান্ত সেনা
করেছে প্রবেশ, ঘুমকাতরতা তাকে ক্রমশ করছে গ্রাস,
এবং সিঁড়ির ধাপগুলো
অজানা সমুদ্রতীরে চলে, জলে মিশে যায়।
যদি কাল ভোরবেলা আমার চোখের পাতা দুটো
পাখির গুটিয়ে-রাখা ডানার মতন
হয়ে যায়, যদি মৃত্যু আমার সত্তার তন্তুজালে
সকালে ফলিয়ে যায় নিরুত্তর হিম, তবে আমি
রোদ্দুরের রেণুমাখা ডুমুর গাছের পাতা, ডালে দোল-খাওয়া
পাখি দেখব না আর; এবং যেসব
কবিতার, দর্শনের বই কিনে সাজিয়ে রেখেছি
থরে থরে বুক-শেলফে, সেগুলো হবে না পড়া আর
কোনো দিন, যার মুখ বার বার দেখেও মেটে না
দৃষ্টি-তৃষ্ণা, তার
মুখশ্রী অদৃশ্য হবে আবছায়া হয়ে চিরদিনকার মতো।
রাত আড়াইটা বাজে, চৌকিদার হেঁকে যায় কখনো-সখনো,
ঘুম কি আসবে আজ? আমার চিন্তার
গা বেয়ে ক্রমশ নামে মাকড়সা, অষ্টবক্র মুণি,
তীরবিদ্ধ দুলদুল, কবরের মাটি-চেরা হাত, বৃষ্টিধারা,
আমার চিন্তার মোহনায় সদ্যমৃতা
সিমোন দ্য বোভোয়া দাঁড়ান, অস্তরাগে মুখ তাঁর
জরাকে তাচ্ছিল্য করে অপরূপ দীপান্বিতা, যেন
তাঁকে কোনো শহরতলিতে
দেখেছি কখনো হেঁটে যেতে চুপিসারে, টুপি-পরা
ক্ষেতে জংধরা কিছু রাইফেল পড়ে আছে কংকালের মতো,
দীর্ঘ ঘাসে ঢাকা হরিণেরা সবুজ রঙের ত্বক পেয়ে যায়,
ডান দিকে কবর খুঁড়ছে কারা ক্রমাগত এবং বাঁদিকে
কণ্ঠে এনে সমুদ্র কল্লোল কী প্রবল
গান গেয়ে হেঁটে যান পল রবসন।
চারু ভিক্ষা
জানলার প্রতি সম্ভ্রমে আমি
চারু ভিক্ষায় বাড়িয়ে দিলাম হাত।
কেউ কি সেখানে ছিলেন একাকী?
করতলে এল কমলা অকস্মাৎ।
ভাগ করে খাই মরশুমছুট
কমলার কোয়া, জিভে লেগে থাকে স্বাদ।
কার মাধ্যমে এল সওগাত,
হুটোপুটি খায় সে-কথা জানার সাধ।
বিস্ময় তার জাল ছুড়ে দ্যায়,
স্বরহীন ঘর বলে, কেন ভয় পাস?
কিসের সোহানা গন্ধ মেতেছে,
কোন কাননের পুষ্পের নির্যাস?
তত্ত্বে তথ্যে ভরপুর মন,
মনোসীমান্তে যুক্তি পাহারাদার,
প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে কী-যে
ঘটে গেল দ্রুত, খুলল গুপ্ত দ্বার।
রাত্রি কি ঘোর কুহক ছড়ায়?
কাঁপে বারবার রহস্যময় চিক।
চৌদিকে কিছু ভস্ম উড়িয়ে
গেয়ে ওঠে গান পক্ষী অলৌকিক।
রুটির মতোই মুখে পুরে তাকে
চিবুই সহজে, সূক্ষ্ম শিল্প-কাজ;
হাতের চেটোয় বিস্মৃত পথ,
আঙুলে লগ্ন অভীষ্ট দুধরাজ।
আমার ভিক্ষা ফেলেছে ধন্দে,
সোফায়, শেল্ফে জাগে সমুদ্র-ঢেউ
দীক্ষা ব্যতীত কী করে আমিও
ভাসি নীল জলে, সেকথা জানে না কেউ।
চিরিত্রলিপি
অধ্যাপক ক্লাসরুমে রবি ঠাকুরের জীবনদেবতা নিয়ে
ইনিয়ে বিনিয়ে
বরাদ্দ বক্তৃতা করছেন,
যেন রঙবেরঙের তালি দেয়া জামা,
কেউ কেউ শাঁসালো মক্কেল, কেউ ধামা
ধরেছেন বড় সাহেবের। শুক্রবার
মসজিদে একনিষ্ঠ ইমাম খোৎবা পড়ছেন,
শুনতে ইমানদার ভক্তিভরে সফেদ টুপিতে মাথা ঢেকে;
অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ় ভোরবেলা থেকে
সন্ধ্যে অব্দি চার ফেলে প্রায়শই রুই আর কাতলা শিকার
করছেন। বছর না ঘুরতেই তিন লাফ
দিয়ে ঠিক তিনবার বাড়ল সোনার দাম, তবুও সোনারু
নিত্য গড়ে কিমতি গয়না রাশি রাশি, দিচ্ছে ঝাড়
প্রথামতো ঝাড়ুদার, রাস্তা হচ্ছে সাফ
প্রতিদিন। ফিল্মের নায়ক পরচুলা পরছেন,
বাঁকা তলোয়ার নিয়ে জোর লড়ছেন
পাহাড়ি টিলায় কিংবা কক্সবাজারের দীর্ঘ বিচে,
কখনো এলাহি লম্ফ দিয়ে সাত মহলের নিচে
পড়ছেন নিখুঁত অক্ষত। কতিপয়
বক্তৃতাবাগীশ নড়ছেন চড়ছেন অদৃশ্য সুতোর টানে,
মনে হয়
দেখছে সবাই চমৎকার পাপেট শো সবখানে।
অথচ এখনো আমি সুড়ঙ্গের ভেতরে একাকী
আমার নিজের মুখোমুখি বসে থাকি
অন্ধকারে। কিছু ধড়িবাজ, যেন জন্মান্ধ বাদুড়, অট্রহাসি
হেসে বলে, ‘বাজাও হে বাঁশি
নটবর যত খুশি প্রহরে প্রহরে’,
এবং আমার ওষ্ঠে বিষপাত্র ক্ষিপ্র চেপে ধরে।
ডাক
পলাশতলীর বাঁকে কর্মিষ্ঠ মুনিষ
মহিষ তাড়িয়ে নিয়ে যায়
মাঠে, শোনে দ্বিপ্রহরে কখনোবা দোয়েলের শিস
গাছে ঠেস দিয়ে, সানকিতে আঙুলের নকশায়
ছবি দেখে, দিঘিতে আঁচিয়ে হাত মুখ
ক্ষেতে ফের নিড়ানির কাজ করে, যদিও অসুখ
বহুদিন থেকে। দিনশেষে ঘরে ফিরে হুঁকো টানে।
বউ, যার শরীরে আমন
ধানের সুবাস, যাকে মাঝে মধ্যে প্রবল ফাল্গুন
দোল দিয়ে যায়, জ্বালে সাঁঝবাতি, মন
হয় উচাটন বাঁশঝাড় দেখে। বাউলের গানে
ধুলায় এসেছে নেমে আরশি নগর।
মুনিষকে সালংকরা গণিকার মতো
অবিরত
ডাকে সেই দূরের শহর।
তোমার চলে যাবার পর
তোমার চলে যাবার পর
থরথর হৃদয়ে রঙ্গন ফুলের গাছে আমি
গচ্ছিত রেখেছি আমার কিছু
অনুভব। রৌদ্রে পুড়বে না, হাওয়ায়
উড়ে যাবে না কিংবা শ্রাবণের বৃষ্টির পেরেকে
হবে না বিদ্ধ। অথচ রঙ্গন আর আমার অনুভূতি
কেমন একাত্ম
তোমার চলে যাবার পর।
একটি গাছের সঙ্গে আমার এই সংযোগ
কী গভীর, কেউ তা জানে না। একটি স্বপ্নের মতো
তাকে লালন করে চলেছি
দিনের পর দিন। যদি কখনো
আবার ফিরে আসো এ শহরে, এই ফ্ল্যাট বাড়িতে
যদি আনো কোনো বিকেলে, কবে
আলগোছে ছুঁয়ে দেখো, তুলে নিও আমার
অনুভবের কয়েকটি গরাগ উঠোনের
রঙ্গনগুচ্ছ থেকে।
কথা দিচ্ছি, আমার হৃদয় টুঁ শব্দটি করবে না!
দূর থেকে তোমার নিকট
পথঘাট ভিজে জাব, ট্যাক্সির ওয়াইপার মাথা
নাড়ে মাতালের মতো। দূর থেকে তোমার নিকট
পুনরায় এসে গেছি, যেমন নাগর
জড়িয়ে ফুলের মালা হাতে
সেজে-গুঁজে আসে রূপজীবীর কোঠায়,
যদিও তোমার সঙ্গে হয়নি দীঘল সোহবত।
সেবার তো নিঃস্ব হয়ে, বলা যায়, প্রত্যাবর্তনের
সুর গুনগুনিয়ে করেছিলাম প্রস্থান
উল্টে-যাওয়া কলসের উদাসীনতায় ভরপুর,
বিদ্যুল্লতা স্মরণ করিয়ে
দেয় বার বার, স্মৃতি বৃষ্টির ছাঁটের মতো লাগে
চোখে-মুখে, ক্ষয়ে যায় বয়সের ভার।
কলকাতা হঠাৎ তুমি রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে
গড়িয়াহাটের ব্রিজে বল্লে কানে কানে,
‘এতদিন পর কেন এলে?
আমি তো কবেই মুছে ফেলেছি তোমার
চুম্বনের বাসী দাগ আর
আলিঙ্গন ছায়া বৈ তো নয়।
দ্যাখো, দ্যাখো, আমার চোখের নিচে কী গভীর কালি।
মাইরি, এ মধ্য বয়সের গোধূলিতে
কী পেলে গঙ্গার ধারে, বিকেলের চৌরঙ্গীর ভিড়ে?
তোমার হৃদয়ে যারা পা ঝুলিয়ে বসে আছে তারা-
অনেকেই কবিতার গ্রীবায়, ঊরুতে নাভিমূলে
স্বাক্ষর রাখার লোভে রঙচটা কাঠের টেবিলে
হাতের সকল তাস ফেলে খেলে যাচ্ছে ক্রমাগত,
তোমাকে প্রকৃত কতটুকু মনে রাখে?
পরিচয় গাঢ় কিন্তু চিনতে পারি না। শুনে ফেলি
মধ্যরাতে স্বপ্নের ঈষৎ উল্কি-আঁকা
কলকাতার কণ্ঠে মদির ছেনালি,
যেন তার গলার ভেতর
থেকে এক কামবিদ্ধা বিড়ালিনী কিছু ধ্বনি
মসৃণ উগরে দিচ্ছে। বুঝি
আমার সত্তার গহনতা
থেকে উঠে-আসা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা
এবং মেঘনার তীব্র ঘ্রাণ,
বনদোয়েলের শিস, কলাপাতা শাপলার হুটোপুটি তার
ক্ষয়াটে বর্তুল ফোমে-গড়া স্তনে ভিন্ন শিহরণ
জাগাল আবার।
কলকাতার বুকের ভেতর কলকল,
কলকাতার বিষণ্ন ধূসরতায় নীলপদ্ম ফোটে, দিনভর রাতভর।
ক’দিনইবা আছি? এখন তো পা রাখার জায়গা নেই
তোমার হৃদয়ে;
জানি আমি প্রেমিকের স্বীকৃতি পাব না কোনো দিন।
এবার চুম্বন কিংবা আলিঙ্গন নয়
তোমার মুখের লালা ভেজা সপ্সপে
গহ্বর আমাকে গিলে ফেলার আগেই
স্বৈরিণী জেনেও
তোমার কপালে আমি পরিয়ে সোহাগে
স্খলিত প্রহরে শ্বেত চন্দনের টিপ
সফেদ রুমাল নেড়ে নেড়ে
চলে যাব চুপচাপ ঘরমুখো বেগানা পুরুষ।
পাঁঠা সংকীর্তন
সেদিন হঠাৎ তাকে দেখে, সত্যি বলতে কী, গাটা
গুলিয়ে উঠল খুব, এমন প্রচণ্ড বিবমিষা
কখনো হয়নি আগে। অতি মনোহর রাম পাঁঠা
তাকে বলা যায় সহজেই। পালাতে চাইলে দিশা
মেলা ভার, বেড়ে কান্তিমান শিঙ দুটো নেড়ে নেড়ে,
ঘাড় থেকে ঝুলে-পড়া সোনালি আঁশের মতো লোম
প্রদর্শন করে সকলের নেক দৃষ্টি নেয় কেড়ে
অচিরাৎ, ক্রমশ ছাগল হয়ে ওঠা কিছু ডোম
তার নিত্য সহচর। প্রকৃত প্রস্তাবে বড় খাসা
এই জীব, বলে লোকে। পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি
উঁচু এই রাম পাঁঠাটার থমথমে মাথা ঠাসা
লোকগাথা আর শত কল্প-কাহিনীতে। যে-বিরিঞ্চি
বাবা ওকে দীক্ষা দিয়ে ভবনদী দিয়েছেন পাড়ি,
অনুমান করে অনেকেই, ওরই থুথু ছিটানোর
ভঙ্গিতে অতিষ্ঠ হয়ে বিশ্ব ছেড়ে সাততাড়াতাড়ি
আছেন পরম সুখে স্বর্গলোকে বন্ধ করে দোর,
পাছে সেই ঢুঁ মেরে বেড়ানো এঁড়ে জীব দেয় হানা
সেখানেও। বংশ গৌরবের ঘোরে খুর-অলা পাটা
পায়শই ঠোকে ঘাসে এবং মাটিতে একটানা
পঁচিশ মিনিট মুগ্ধাবেশে সেয়ানা সে রামপাঁঠা।
পুতুল পূরাণ
পুতুলটি সে, হাল আমলের যুবক, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে
নিছক খেয়ালবশে আনল কিনে। সে বিবাহিত
নয়, ওর ঘর হয় না মুখর কোনো শিশুর
হাসির ঝরণাধারায়। পুতুলটি ওর, যুবকের, হারানো
শৈশবকে আকর্ষণ করে
মধ্যদুপুরে অথবা বিকেল-জেলের জমকালো আলোর জাল
গুটিয়ে নেয়ার মুহূর্তে। পুকুরে মেঘের ছায়া,
জানালা থেকে দেখা
কিছু গাছগাছালি আর গলির মোড়ে আস্তাবলে
ঘোড়ার ঘাসবিচালি,
ভেজা ছোলা খাওয়া, কোচোয়ানের চোখে ঘোড়দৌড়ের
ছবি, জখমি ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘ চুল খেলিয়ে
এলিয়ে থাকা হুরীর
থই থই জওয়ানী, নড়বড়ে টুলে বসে
দো-আনির চা খাওয়া, গলির ভেতরে জুয়াড়ির
আসা-যাওয়া-যুবককে
দাঁড় করিয়ে দেয় বাল্যকালের মুখোমুখি। আপাতত
সুখী নয় সে, মাথা রাখে বিষাদের ডালে।
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিনে আনা পুতুল, মানে
একটা মেশিন, ভোরবেলা হঠাৎ
নড়ে ওঠে চমৎকার ভঙ্গিতে, যুবকের ভালো লাগে এই সঙ্গীকে।
মনে হয়, রঙধনু ছড়িয়ে পড়ে
ঘরে, যখন সেই মেশিন ঘুরে বেড়ায় আশেপাশে
দম দেয়া ছাড়াই। ছোট আর রঙিন খেলনার মতো
মেশিনের সঙ্গে তার খেলা, বলা যেতে পারে,
সারাবেলা। মেশিনটাকে বারবার দেখা নানা
কোণ থেকে, একটু স্পর্শ করা
আদর-ঝরানো আঙুলে শিশুর মতো দুলিয়ে দুলিয়ে
ঘুম-পাড়ানো, ছড়া কাটা,
পুতুলকে ঘিরে সাইকেডেলিক ছবি দেখা
হয়ে ওঠে যুবকের নাছোড় নেশা। বস্তুত বিবাহিত
সে এই মেশিনময় প্রহরের সঙ্গে।
খেলাচ্ছলে মেশিনটাকে ফিডিং-বটল দিয়ে সে
দুধ খাওয়ানোর ভান করে
কখনো কখনো, আবার ওষুধও খাইয়ে দেয় ঘনঘোর
বর্ষার দিনে, যেন সর্দিতে
ভুগছে তার পুতুল। মাঝে মধ্যে নৃতত্ত্ব অথবা দর্শনে বই
তুলে দেয় মেশিনের হাতে, জপাতে চেষ্টা করে
মার্কস আর এঙ্গেলস-এর
নাম, পুতুলের মনোরঞ্জনের জন্যে ক্যাসেট প্লেয়ারে
বাজায় পপ গান, বোঝায় পাখি-পড়ার মতো
কেউ টেড হিউজ কে-ইবা টম গান। তারপর নিজেই হেসে ওঠে
ঘর কাঁপিয়ে, বেরিয়ে পড়ে কালো মখমলের জ্যাকেট
চাপিয়ে গায়ে, মধ্যরাতে ফিরে আসে স্খলিত পায়ে।
যুবকের আদর আপ্যায়নে
মেশিন, তার রঙিন খেলনা, পুতুল , বাড়তে থাকে
দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দিনের পর দিন
রাতের পর রাত; প্রথমে একটু একটু করে,
পরে লাফিয়ে লাফিয়ে। মেশিনের আকারের
তুলনায় ঘর যেন দেশলাইয়ের বাক্স। অকস্মাৎ ছাদ ফুঁড়ে
বেরিয়ে পড়ে মেশিনের মাথা; হাত
দেয়াল ভেদ করে অশত্থের শাখার মতো
প্রসারিত হয় পৌরপথে। স্তম্ভিত যুবক টিপ করে
মাথা ঠেকায় মাটিতে মেশিন-পুতুলের
উদ্দেশ্যে, যেমন গুহামানব
মাথা নত করত, হতো নতজানু বিশাল কোনো
বৃক্ষ কিংবা পাহাড়ের সামনে। যুবক
তার এই ভয়ংকর পুতুল নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না।
এখন মেশিন ওর দিকে তাকায়
একনায়কের দৃষ্টিতে, ভীষণ ধাতব হাতে তুলে নেয়
যুবকটিকে, তারপর শুরু করে অবিরাম লোফালুফি
যেন দক্ষ অ্যাক্রোবেটের
করতলে একটা চাকতি কিংবা বল। একদিন
অমাবস্যা রাতে মেশিন
মুখে পুরে নেয় প্রভু যুবককে, খেলাচ্ছলে
গিলতে থাকে এবং সেই যুবক
মর্মমূল-ছেঁড়া চিৎকার করতে গিয়েও
পারে না, দ্রুত বিলীন হতে থাকে নিঃসীম একাকিত্বে।
প্রতিবাদী কবিতার সংকলন
দীর্ঘকাল পর, মনে হলো, শুনতে পেলাম দেয়ালের শিস
শহরের অন্ত্যজ পাড়ায়। আবর্জনা,
ড্রেনের উগরে-দেয়া কুট গন্ধ সত্ত্বেও মেজাজে
রুক্ষতার রোঁয়া তীব্র গজিয়ে ওঠেনি। আসমানে কবুতর।
বিকেলে চায়ের স্বাদ নিতে চেয়ারে হেলান
দিয়ে পড়ছিলাম নিভৃতে
প্রতিবাদী কবিতার সংকলন। রক্তে জ্বালা ধরে
মানবতা আর সভ্যতার লাশঘেরা হাহাকার শুনে। কিছু
চিত্রকল্প বিপ্লবীর মতো
আমাকে ঝাঁকুনি দেয় শক্ত হাতে, আমার সত্তার
দিকে চেয়ে থাকে স্বপ্নময় চোখ মেলে। ভেসে ওঠে
দৃষ্টিপথে চাবুকের দাগময় হাজার হাজার
নগ্ন পিঠ, চকচকে বিশুদ্ধ বুটের লাথি-খাওয়া
সম্ভ্রমের মুখ-থুবড়ে-পড়া থাকা দেশ-দেশান্তরে।
পঙ্ক্তিমালা ঈগলের মতো উড়ে ঠুকরে ঠুকরে
খাচ্ছিল আমার হৃৎপিণ্ড, করোটির
ভেতরের স্নায়ুপুঞ্জ। অকস্মাৎ পাড়া-কাঁপানো কান্নায় ফিরে
প্রতিবাদী কবিতার সংকলন
থেকে চেনা প্রতিবেশে। কান্না শুনে বুকের ভেতর
আদিম যুগের সন্ধ্যা নামে,
জেগে ওঠে বলি-দিতে-নিয়ে-যাওয়া কুমারীর বন বনান্তরে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়া করুণ চিৎকার। কিছুক্ষণ
চুপ থেকে, পায়রার ওড়াউড়ি দেখে
আবার বুলোই চোখ বৈশাখী ঝড়ের মতো পঙ্ক্তিময় বইয়ে।
পুনরায় কান্না ভেসে আসে, খুব কাছ থেকে
নারীসত্তা দীর্ণ করা কান্না, যেন বা ঢেউয়ের ভেঙে
পড়া শিলাতটে; পুরুষের তর্জন গর্জন শুনে মনে হয়
দানবের বসবাস নয় শুধু পুরাণের প্রাচীন পাতায়,
ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে খুঁজি সে কান্নার উৎস,
জানাই সরোষ প্রতিবাদ,
কিন্তু আমি ফ্ল্যাটে ক্ষুব্ধ, ভব্যতার খাঁচায় কয়েদ হয়ে থাকি,
হাতে প্রতিবাদী কবিতার সংকলন।
প্রতীকী চিত্রের মতো
ভোরে চোখ মেলে দেখি ঘরের দেয়ালে
রোদ্দুরের নক্শা ঝুলে আছে
প্রতীকী চিত্রের মতো আর
নারকেল গাছের ডালটা,
আলোর লেবাস-পরা, জানলার গ্রিলে
সবুজ চুম্বন আঁকে। হাওয়া দিচ্ছে; ডালটার সঙ্গে, ইচ্ছে হলো,
হ্যান্ডশেক করি, যে-ইচ্ছের গ্রীবাটিকে খুব
সন্তর্পণে খর্ব করে রাখি
কতিপয় লোকের বেলায়।
গর্বের ব্যাপার নয়, তবু
এ রকম অন্তত নিজের কাছে ফিসফিস করে
বলতেই হয়,
যেমন পুরাণে আছে গর্তে মুখ রেখে একজন
অন্তরালে বলেছিল কথা।
হঠাৎ বিছানা ছেড়ে দাঁড়াই ঘরের মাঝখানে;
কোনো পাখি কিংবা কোনো ফুল
কবিতার পক্ষে বেশি সহায়ক ভাবতেই শুনি
বুকের ভেতর
দোয়েল কোকিল ডেকে ওঠে, ফোটে গোলাপ, অর্কিড।
অথচ এখন আমি নতুন পাখির খোঁজে আর
অভিনব ফুলের সন্ধানে
ঘরের নিভৃত কোণে কাটাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ঘুরে আসি
শহরের চেনা,
অচেনা অনেক রাস্তা থেকে, দূর গ্রাম,
গ্রহ-গ্রহান্তর থেকে, আখেরে দেয়ালে
দৃষ্টি রেখে বসে থাকি, যদি
ইট আর সিমেন্টের ত্বক ফুঁড়ে কোনো
সম্পূর্ণ অঞ্জাত ফুল অথবা অচেনা
পাখি বের হ’য়ে আসে, যদি
কারো অঞ্জলিতে পেয়ে যাই
দেবদূতদেরকেও ঈর্ষাতুর করে তোলা কোনো
নব্য সওগাত।
একটি পুরোনো চিঠি পড়ার সময়
দেখি খোলা দরজায় জলকন্যার ধরনে শুয়ে
আছে কবিতার পঙ্ক্তি, লেজের সোনালি
আঁশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে স্বপ্নমুক্তো, আর
আমার অনেক আগেকার
যূথচারী পুর্বপুরুষের স্মৃতি। ভাবি
অপসৃত হবার আগেই
প্যাডে তুলে রাখা ভালো। কী যেন বলতে
চাইল সে, কবিতার পঙ্ক্তি, অথচ ওষ্ঠের কাছে
শত পাথরের নুড়ি এসে
করে ভিড়; কিছুই না বলে
জলকন্যা দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে
আমার ভেতরে এক পবিত্র আগুন
ধরিয়ে নিমেষে চলে গেল। সারা ঘরে হাহাকার
বেহালার করুণ সুরের মতো ঝরে,
এবং টিবিলে ঝুঁকে কয়েক দিনের
পাতাজোড়া কাটাকুটি থেকে
একটি নিঃসঙ্গ হরিণকে মৃগনাভিসুদ্ধ বের
করে নিয়ে আসি, দেখি তার টলটলে
চোখে কাঁপে জন্ম-জন্মান্তর।
প্রবাদকে মিথ্যে করে দিয়ে
লোকটাকে বহুক্ষণ ধরে ওরা ভীষণ পীড়ন
করছিল; ওর ত্রস্ত চক্ষুদ্বয় সূর্যের কিরণ
দেখতে পারবে কিনা পুনরায়, এমন সন্দেহ মনে উঁকি
দিচ্ছিল আমার, তাই ঝুঁকি
নিয়ে কাছে গিয়ে বলি, আসলে সে নয়
দোষী, মানে ধৃত অর্ধমৃত এই লোকটার ভুল পরিচয়
ফেলেছে বিপদে তাকে। সে-যে নয় আমি, এ-কথা কসম খেয়ে
নিশ্চিত জানাতে পারি। যুক্তি-তর্কের দাঁড় বেয়ে
বেয়ে ক্লান্ত হয়েও ওদের কে প্রকৃত অপরাধী
আমি না সে লোকটা, বোঝাতে ব্যর্থ হই। ফরিয়াদি
সেজে আমি যত বলি সে-তো জন্ম বোবা-
তত ওরা ‘আরে তোবা তোবা’
বলে তার কোমরে পেঁচিয়ে দড়ি সগৌরবে নিয়ে
যায় ঠেলে ঠুলে জেলে প্রবাদকে মিথ্যে করে দিয়ে।
প্রামাণ্য চিত্রের অংশ
ভাদ্রের দুপুর চিল্লাচ্ছে পুরানো ঢাকার
কলতলার
ঝগড়াটে যুবতীর মতো। একটার পর একটা বাস
ক্রমাগত ছুটে যাচ্ছে, বাস-এ চড়তে গিয়ে যাত্রীদের নাভিশ্বাস
উঠছে ভীষণ। দূর থেকে দেখলাম
লোকের ভিড়ে তাঁকে। তিনি রীতিমতো
গলদঘর্ম, ভ্যাবাচ্যাকা, যেন আহত
চিল। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও সময়কে চড় কষিয়ে-যাওয়া বাসে ঠাঁই
পাচ্ছেন না। ‘ও ভাই
কন্ডাক্টারের নেই। মনে হয়,
হয়তো এবার ভিড় ঠেলে
কনুই চালিয়ে উঠে পড়বেন, অথচ এই বাসটাও
উধাও তাঁকে ফেলে।
বাসের পর বাস আসে, যায়,
হাত নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক ঠায়।
তিনি, আবদুস শহীদ, খাপরা ওয়ার্ডের বিপ্লবী,
আজ এ কেমন ছবি
তাঁর! শোণিতে শর্করার কোলাহল, দ্রুত তন্তুক্ষয়,
একদা স্বপ্নের বীজময়
উর্বর চোখের নিচে দুঃসময়ের কালি নিয়ে রাস্তার ধারে
ভাদ্রের দুপুরে বন্দি, পরিত্যক্ত। বারের বারে
তাকাচ্ছেন পথের দিকে,
হয়তো অনেক দূরের কিছু ফিকে
স্মৃতি রক্তচক্ষু কোকিলের মতো গান গেয়ে
উঠছে নাছোড়ে, তিনি চলেছেন খেয়া বেয়ে
ভাটির টানে। বৈঠায় শ্যাওলা জমে,
আজও কালবেলায় অমোঘ জাল ফেলে কেন তাঁকে টেনে
নেয় না যমে?
বাসের পর বাস আসে যায়,
ধূসর বিপ্লবী এখনো আছেন দাঁড়িয়ে পথে অসহায়।
তাঁর প্রতি বস্তুত ভ্রূক্ষেপ নেই কারো। ধারালো অস্ত্রে
জং ধরলে, রঙচঙে মখমলের বস্ত্রে
তাকে রাখলেও বাড়ে না গৌরব তার,
একথা ভালোই জানেন তিনি, আবদুস শহীদ। যতক্ষণ থাকে ধার
ততক্ষণই অস্ত্রের প্রতি অটুট সতর্ক মনোযোগ,
হোক সে শেয়াল, নেকড়ে বাঘ কিংবা ঘোগ।
ভাবি নিশ্চয় এবার তিনি, খাপরা ওয়ার্ডের বিপ্লবী, রাস্তার
মাঝখানে সটান দাঁড়িয়ে ছুটন্ত বাসটার
ঘাড় ধরে গলায় ঠাটা বাজিয়ে বলে উঠবেন, ‘হেই,
আমাকে এভাবে ফেলে যাবার অধিকার কারো নেই।
প্রেতের নিকট থেকে
রাত এক্কেবারে চুপ মেরে গেছে। ধরে নিচ্ছি,
এ মুহূর্তে তুমি গা এলিয়ে
দিয়েছ শয্যায়,
বালিশে ছড়ানো চুল, যে বইটা পড়ছিলে তার শব্দশোভা
স্মৃতিতে প্যাস্টেল চিত্র। তুমুল ঘুরছে চকচকে
পাখার তিনটি ব্লেড। বাম পাশে ঘুরে তুলে নিলে
হাতঘড়ি, জ্বলে রাত বারোটা, আয়ত
চোখে জ্বালা, ঘুম বিছানার চারদিকে থই থই, ধু-ধু চোখে নেই,
বারবার শুধু মনে পড়েছে তাকে, যে তোমার প্রিয়
স্বপ্ন চেটেপুটে
দিয়েছে গা ঢাকা লুটেরার মতো। তুমি
অতীতের মঞ্জরী ফুটিয়ে চিদাকাশে
তার অবয়বহীন মাথা বুকে টেনে নিয়ে পোড়াচ্ছ নিজেকে।
একটি প্রেতের কাছে তোমার হৃদয়
এখনো গচ্ছিত রেখে অস্তিত্বে লালন করো ধোঁয়াটে শ্মশান।
রাত্রির ভেতরে রাত্রি গড়ায় কেবলি, যেন কালো উন্মাতাল
ঢেউয়ের ভেতরে ঢেউ; জেঁকে আসে ঘুম
তোমার শরীরে রাত দেড়টায়। ঝিঁ ঝিঁ পোকা শূন্যতার গায়ে
লেপ্টে থেকে ক্রমাগত ডেকে যায় আর
তখন তোমার দরজার কিয়দ্দূরে একজন
দীর্ণ কবি, তোমাকে যে তার প্রিয় প্রেমের কবিতা
ব্যাকুল শোনাতে দীর্ঘ সময় নিয়েছে,
রয়েছে দাঁড়িয়ে ঠায় সেই কবে থেকে। তুমি তাকে
তোমার অধর, স্তন শ্রোণীর লুণ্ঠনকারী পুরুষের মোহে
দেখতে পাওনি। হোশ-হাওয়াসবিহীন
বেখাপ্পা কবির দিকে চটুল তাকিয়ে
অকস্মাৎ রাত্রি হো হো হেসে ওঠে বেশরম গণিকার মতো।
বন্ধ দরজার ঔদাস্যের গূঢ় নিস্তব্ধতা থেকে
কুড়িয়ে স্বপ্নের ছাই জবুথবু কবি
হেঁটে যায় বড় একা রাত্রির হাওয়ায়। জপছেন
কানে কানে তার একজন
মরমী সাধক-বারবার
কী ঘর বানাও তুমি শূন্যের মাঝার? মগজের
ভেতরে গুঞ্জন তার। ফিরে গিয়ে নিজস্ব ডেরায়
রাত জেগে খাতার পাতায়
সারি সারি অক্ষরের গায়ে ভোরের আবীর নিয়ে
প্রেতের নিকট থেকে কেড়ে নিতে চায় ছায়াময় জয়োল্লাস।
ভূপ্রদক্ষিণ
জর্নাল নিখোঁজ ঝড়ে, দিনক্ষণ মনে নেই; ছুট
কাটাতে প্রবাসে ছিঁড়েছিলাম বাদামি, সাদা রুটি
ক্যাফেটারিয়ায়, কফি খেয়ে গাইডের সঙ্গে গিয়ে
উঠেছিল নেচে প্রাণ অঞ্জলিতে ঝরনাজল নিয়ে।
দুপুরে ঢাকায় ফ্ল্যাটে শুয়ে অকস্মাৎ মনে পড়ে-
শুল্ক বিভাগের বেড়া ডিঙিয়ে প্রাচীন সে নগরে
তোমার স্তনের ডৌল দেখে নিয়ে সতেজ আপেলে
পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি দেখি সিস্টিন চ্যাপেলে।
মানুষকে নিয়ে
আকাশকে আকাশ বলেই চেনা যায়। পাহাড়কে
পাহাড় না বলে অন্য কিছু
বলবার কোনো মানে আমি খুঁজে পাই না, যদিও
নদীকে উপমা দিয়ে সাজানো তেমন
কঠিন ব্যাপার নয় কস্মিনকালেও তবু নদী
অবিকল নদী থেকে যায়।
কখনো-সখনো কোনো কোনো
মানুষকে ডুমুরের ফুল বলা হয়,
কিন্তু তাতে ডুমুর গাছের অভিধার
হেরফের হয় না কিছুই।
সিম্পাঞ্জিকে শিম্পাঞ্জি অথবা
বাঁদরকে বাঁদর হিসেবে যদি শনাক্ত করেন
কেউ তবে যথার্থই হবে। অরণ্যের ডোরাকাটা
বাঘ গর্জনা না করলেও
তাকে বাঘ বলা যাবে দ্বিধাহীন। মেনী বেড়ালকে
বনের বাঘের মাসি বলে জানি, অথচ বেড়াল
বেড়ালই সঠিক।
কিন্তু যত ফ্যাসাদ, ঝামেলা অদ্যাবধি
মানুষকে নিয়ে। সত্যি বলতে কি, মানুষ বিষয়ে
কোনো স্থির সিদ্ধান্তের ঘাটে
বিশ্রাম নেয়ার পথ জানা নেই। আজ যাকে তুমি
ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে
জানে না এমন কেউ বলে জানো, কাল
সে ভীষণ ধড়িবাজ হয়ে দেখা দেবে অকস্মাৎ। রবিবার
যার হাত খুব সাদা প্রতিভাত হবে,
সোমবার তার হাতে মানুষের শোণিতের ছোপ
দেখে তুমি শিউরে উঠবে। আর বন্ধু যে কখন
শক্রর নিখুঁত ভূমিকায় নেমে যাবে
তার সঙ্গে তুমি অষ্টপ্রহর থেকেও ঘুণাক্ষরে
কখনো পাবে না টের। অন্যদের চায়ের আসরে
যে তোমাকে পাঠাবে হাবিয়া
দোজখে হাজারবার, সেই একই লোক তোমার টেবিলে
এসে বেদনার ভারে কেঁদে বেদানার
দানার মতোই লাল করে ফেলবে দু’চোখ তার। এরকম
জন্ম-অভিনেতা
খুঁজে মেলা ভার। কোনো কোনো
লোককে মানুষ নাকি হায়েনা বলবে, এ বিষয়ে
তোমাকে বেজায় ধন্দে থেকে যেতে হবে চিরকাল।
মায়াবিনী মূলে
রোজকার মতো আজও ভোরবেলা তোমাকে ছাড়াই
জেগে উঠি এই বাসী শয্যায়। তুমি নেই তবু
মিছে হাতড়াই, বাঁদিকে আমার শূন্যতা থেকে
ছায়ার মতোই কী যেন জন্ম নিল মনে হয়-
জায়মান সেই বস্তুর প্রতি তাকাতেই দেখি
ছায়ার চেয়েও অধিক ছায়াটি চকিতে মিলায়।
টুথব্রাশ মুখে জানালার ধারে একলা দাঁড়াই,
নিজেকে কেমন ন্যালাক্ষ্যাপা আর ভারি জবুথবু
লাগে, যেন আমি একতাল ঘুম। হাওয়া যায় ডেকে
ফিসফিসে স্বরে বারান্দাটায়, একি বিস্ময়,
কারো চেনা নাম। যা ছিল আমার চারপাশে মেকি
এবং ঠুনকো সাদা গোলাপের গাথা হয়ে যায়।
আমার ভুরুতে স্বপ্নের ছায়া। দরজায় এসে
দাঁড়ালে কি তুমি? সামনের দিকে এগোতেই চোখে
থান কাপড়ের মতো শুভ্রতা হয় মরীচিকা।
এখানে তোমার না-থাকার বুনো আন্ধার দিয়ে
করি আচমন। এই তো হঠাৎ ভেসে আসে সুর
বাথরুম থেকে, তুমি কি গাইছ শাওয়ারটা খুলে?
তোমার শরীর নিমেষে রচিত সে সুরের রেশে।
আমি তাকে বাঁধি বাহুতে নিবিড় অতীতের ঝোঁকে,
কিন্তু আমার আশ্লেষে এ কি শরীরের শিখা
ছায়া হয়ে গলে, জল হয়ে ঝরে। দৃষ্টি সরিয়ে
দেখি ডুমুরের পাতা উড়ে যায়, ঝরে অতিদূর
ডোবায় এবং তুমিহীনতার মায়াবিনী মূলে।
যখন অনেকে সগৌরবে
যখন অনেকে সগৌরবে বাণিজ্যেতে ছুটে যায়
অথবা সাধের চাকরির অলৌকিক
গুহায় প্রবেশ করে প্রত্যহ, তখন
আমি এক রূপসীর নিরিবিলি গুলবাগে যাই।
যখন অনেকে করজোড়ে গদগদ কণ্ঠস্বরে জাঁরেল
আমলা তোষণে মেতে ওঠে কিংবা নতজানু হয়
দীপ্র শিরস্ত্রাণের সমুখে, তখন
আমি সেই সুন্দরীর রূপবর্ণনায় মগ্ন হই।
যুদ্ধের মাহাত্ম্য আমি কস্মিনকালেও
করি না প্রচার, পরাক্রান্ত বীরদের গাথা লিখে নাম কিনে
ধন্য হতে চাইনি কখনো, আমি শুধু
গৃহকোণে বসে একা অক্ষর সাজাই এক নারীর উদ্দেশে।
যখন অনেকে দিনরাত্রি ম্যামনের স্তব করে
প্রাণপণে, ম্যামনের স্বর
তাদের অতৃপ্ত কণ্ঠে করে ভর, তখন আমার
কণ্ঠস্বর সবার অলক্ষ্যে কন্দর্পের কণ্ঠস্বর হয়ে যায়।
যখন অনেকে জয়োল্লাসে অতিশয় মত্ত হয়ে,
যেন যদুবংশ, কুচকাওয়াজের দৃপ্ত ভঙ্গিমায়
সমস্ত শহর করে প্রদক্ষিণ, তখন একাকী আমি গূঢ়
বেদনার পথে হেঁটে প্রিয়তমার উদ্দেশে করি অশ্রুপাত।
যখন অনেকে খুব ঝুঁকে স্থুলকায়
জাবেদা খাতার রঙবেরঙের হিশেব-নিকেশ
করে নিত্য, তখন নেহাৎ বেহিসেবী আমি, হায়,
অগোচরে কাগজে শিশিরবিন্দু, ঘাস, মেঘ, চুমো জড়ো করি।
যখন অনেকে ক্রূরতার মদিরায় বুঁদ হয়ে রয়,
তখন সবুজ গ্লাসে সুন্দরীতমার
ঢেলে-দেয়া পানিতে চুমুক
দিয়ে আমি আকুল তৃষ্ণায় আবেহায়াতের স্বাদ পেতে থাকি।
পুণ্যবানদের মতো আমার কপালে, হা কপাল,
একনিষ্ঠ নামাজ পাঠের দাগ নেই,
অথচ আমার
হৃদয়ে বেড়াই বয়ে কত দহনের চিহ্ন সারাদিনমান।
শহুরে বাগানে
শহুরে বাগানে রাঙা প্রত্যুষে
রূপসী কুড়ায় শিউলী ফুল।
নুয়ে-পড়া তাকে দেখেছি তো ঠিক?
নাকি এ আমার চোখের ভুল?
গত রাত্রির স্বপ্নের ঢেউ
অবয়বে তার এখনো বয়।
তন্বী বুকের যুগল চূড়ায়
গোলাপ-জাগানো সূর্যোদয়।
এত ভোরে এই নির্জনে তার
চুপিসারে আসা হয়নি ঠিক;
মনে মনে বলি, তাকে ঘিরে থাক
সকল সময় মাঙ্গলিক।
গ্রীবা জুড়ে তার অতিশয় সাদা
কুয়াশার মতো রয়েছে কী-যে।
নাভিমূলে লাগে শিশিরের ছোঁয়া
পায়ের পাতাও উঠেছে ভিজে।
চুলে ভিড় করে শত প্রজাপতি,
কিটদেশে দোলে হাওয়ার মালা।
গোলাপি শিখার মতো যৌবন
হৃদয়ে ছড়ায় চৈত্রজ্বালা।
হঠাৎ একটি কালো ঘোড়া এসে
পিঠে নিয়ে ওকে মিলায় মেঘে।
ক্ষুরের শব্দ প্রতিধ্বনির
মতো চেতনায় রইল জেগে।
খোঁপা খসে যায় বেগানা রাতের
নিঝুম তৃতীয় প্রহর শেষে,
স্তন থেকে তার ডাগর গোলাপ
উড়ে যায় কোন্ নিরুদ্দেশে।
দূর থেকে দেখি রাঙা প্রত্যুষে
শিউলি গাছের অশ্রুপাত।
হাওয়ার দুয়ারে এক যেন নিয়ত
অদৃশ্য হাতে করে আঘাত।
ধু-ধু শূন্যতা গোঙায় কেবলি,
চারদিকে নেই কোথাও কায়া।
শিউলী তলায় ছায়ার মতন
হাতে কেউ শুধু কুড়ায় ছায়া।
সকাল-সন্ধ্যা আবার ব্যাকুল
চোখ খোঁজে তাকে দিগ্ধিদিক।
মনে মনে বলি, তার সত্তায়
নিয়ত ফুটুক মাঙ্গলিক।
স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার
এবারও সে, ফয়সল, আসেনি, অথচ কথা ছিল
আসবে, বসবে নকশাময়, রঙচটা
খাটে আর
ধরবে সস্নেহে হাত বর্ষীয়ান মহিলার, সতৃষ্ণ তাকাবে
আড়চোখে গৃহকোণে দাঁড়ানো সুন্দরী
তরুণীর দিকে, চশমার কাচ মুছবে খানিক
সফেদ রুমালে,
পানি খেতে চেয়ে গ্লাস ধরবার ছলে
এক ফাঁকে ছুঁয়ে নেবে তার কম্পিত আঙুল যার
ঈষৎ সবুজ
শালের আড়ালে মূক হয়ে আছে প্রগলভ যৌবন, খোলা ছাদে
বলবে অনেক কথা তরুণীর কানে কানে, চুমো
খাবে তাকে খইয়ের যতন
নক্ষত্র ছিটানো আকাশের নিচে স্পন্দিত শরীরে।
না, এসব কিছুই ঘটেনি এই শীতে। ফয়সল কথা দিয়ে
আসেনি নিষ্প্রভ ঘরে। অসুখের খর
জিভ চেটেপুটে
খেয়েছে বেবাক পলস্তারা, দেয়ালের কুলুঙ্গিতে
ব্যর্থতা নিয়েছে ঠাঁই, হতাশা মৌরসীপাট্রা পায়
বিবর্ণ খিলানে। সাধাহ্লাদে ভরপুর
স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার তৃতীয় প্রহরে
রবীন্দ্রনাথের
ক্ষুধিত পাষাণে অতীতের রূপসীরা যে-রকম। কৃষ্ণসার
হরিণেরা তন্বীর হাতের তেলো থেকে
আকাঙ্ক্ষার তৃণ মুখে নিয়ে
পলাতক বহুদূরে। সিংহভুক্ত হরিণের ভগ্নাংশের মতো
জায়গায় সে বসে থাকে বড় একাকিনী।
নিঃশব্দে সকাল-সন্ধ্যা প্রতীক্ষায় কাটায় সময়
ঝিঁ ঝি-ডাকা রাতে
হ্যারিকেন হাতে ঠায় সে দাঁড়িয়ে থাকে,
পাছে ফয়সল ফিরে আসে
প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদে ডাকিনীর
ছড়ানো চুলের মতো অন্ধকারে। নির্বিকার পথ অকস্মাৎ
কেমন নির্দয় আর ব্যঙ্গপরায়ণ হয়ে ওঠে,
তবু সে তরুণী সরায় না
চোখ পথ থেকে, রূপ তার অন্ধকারকে পরায়
অপরূপ সৌন্দর্যের সাজ।
ফয়সল কিংবা তার মতো অন্য কেউ
তারা কি কখনো কথা দিয়ে ফিরে আসে কোনও দিন?