কবির মিনতি
থাকেন আপন মনে নিঝুম স্টাডিতে
নিমগ্ন পুস্তকপাঠে, কখনওবা কবিতা লেখায়। কয়েকটি
কবুতর রোজ তার আতিথেয়তায়
তৃপ্ত ওড়ে কাছের আকাশে
প্রফুল্ল ডানায়, ওড়ে রোদ্দুরের ঢেউ হয়ে। কবুতর
অকস্মাৎ রক্তধারা রূপে বয়ে যায় হাওয়ার চাদরে।
এ কেমন ভ্রান্ত কাল এল, ভাবলেন নিতি বই
থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, মনের নানা স্তরে
নানান ভাবনা ভিড় করে। দৃষ্টিপথে
তার ভাসে সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু, লালাসিক্ত জিভ,
রিক্সাচালকের শ্রমনিষ্ঠ শরীরে-ধরানো ক্ষিপ্ত আগুনের
মরণকামড়; চৌরাস্তায়, অলিতে গলিতে আজ
জাঁহাবাজ, উলঙ্গ অস্ত্রের স্বৈরাচার। এ কেমন
ভুল সময়ের বাঁকে দাঁড়ালেন তিনি? বড় প্রশ্নাকুল কবি।
বেদনার্ত, বিচলিত তিনি গোধূলিতে
পুস্তক, কবিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে বড় একা
নামলেন পথে, হেঁটে হেঁটে অস্ত্রের বাজারে এসে
থামলেন। একে একে সকল সফল
অস্ত্র-বিক্রেতার কাছে করজোড়ে অস্ত্রের বেসাতি
বন্ধের মিনতি জানালেন। সমবেত অট্রহাসির তরঙ্গে
কবির কাতর নিবেদন করুণ খড়ের কুটো,
তবু তার কণ্ঠে আজ কবিতার পঙ্ক্তি নয়, প্রার্থনার স্বর।
অস্ত্রের দোকানপাট আরও বেশি জ্বলজ্বলে, মুদ্রাস্ফীতি হয়,
কবির মিনতি শুধু অরণ্যে রোদন। অনন্তর
তাকে মারণাস্ত্রে তৈরি ক্রূসে বিদ্ধ করে
অসংখ্য খঞ্জরে অস্ত্র-বিক্রেতারা মাতে অপূর্ব প্রদর্শনীতে
আলোকসজ্জায়, নৃত্যগীতে মশগুল! ক্রুশবিদ্ধ, অসহায়
কবির বুকের রক্তধারা ঝরে ধূসর ধূলায়, বয়ে যায়
নর্দমায়। কবিতার পঙ্ক্তিমালা শোকগাথা হয়ে ঢাকে
কবির নিষ্পন্দ ক্ষতময় শরীর, দূরের আসমানে ঝোলে
নৈর্ব্যক্তিক চাঁদ, যেন ফাঁসি হয়ে গেছে ওর আর শহরের
গৃহকোণে একা অন্য নব্য কবি লেখে অস্ত্রবিরোধী কবিতা।
১৩.২.৯৯
কাঁটার মুকুট
প্রত্যহ পাথর ছুঁড়ে মারবার লোকের অভাব নেই এই
চৌরাস্তায়্য, অলিতে গলিতে। ডাকলেই বেশ কিছু
লোক জুটে যায়, হৈ-হল্লায়
মেতে ওঠে, করে নিতে চায় হাতের প্রভূত সুখ। কেউ কেউ
বর্জ্য, বিষ্ঠা মেখে দেয় কারও কারও দেহমনে আর
কেউ বা ফাটায় মাথা লাঠির আঘাতে।
নির্যাতনে দড় ওরা, কখনও কখনও
জিহ্বার প্রখর এস্তেমালে ক্লান্তিহীন, তুখোড় মোড়ল
আর তার স্যাঙ্গাতেরা মিথ্যা অপবাদের পেরেক
ঠুকে ঠুকে যাকে ওরা ক্রমে
সেঁটে দেয়, তার রক্তবিন্দুগুলি
তপ্ত ধুলো বালিতে বিলীন নিমেষেই।
লোকটা নিভৃত ঘরে শব্দের আতশবাজি জ্বেলে
অনিন্দ্য শোভার ধ্যানে কাটাতো সময়
আর সঙ্গোপনে গড়ে নিয়েছিল নিজস্ব জগৎ,
দ্যুতি যার পড়তো ছড়িয়ে সবখানে। অথচ সে
বহুরূপী মুখের ঝামটা আর প্রতিবেশীদের তিরস্কার
সয়েছে অনেক, শেষে পরানো হয়েছে তাকে কাঁটার মুকুট!
১২.১২.৯৮
কাল রাতে
কাল রাতে স্বপ্নের ভেতরে
কী-যে দেখেছিলাম, কিছুই স্পষ্ট মনে নেই। তবে
এটুকু দেখেছি বলে মনে হয়, কয়েকটি পাতাহারা বড়
নগ্ন গাছ পথপ্রান্তে বিশীর্ণ দাঁড়ানো ছিল কংকালের মতো।
সেসব গাছের খুব কাছে
দাঁড়িয়ে আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম কারও
জন্যে নাকি বৃক্ষের সবুজ
পরখ করার কোনও জরুরি তাগিদ ছিল? পথ
ভুলে গিয়ে সেখানে হাজির হওয়া ছিল কি আমার
মনের গহন কোনও স্তরের বাসনা? সম্ভবত
এরকম কিছু নয়, বস্তুত চেয়েছি
নিজেরই অজ্ঞাতসারে তৈরি করে নিতে ছায়া ছায়া কিছু কথা।
কাল রাতে স্বপ্নের ভেতরে আরও আলাদা রকম
গূঢ় দৃশ্যাবলী দেখবার সাধ ছিল;
হয়নি তো দেখা, শুধু ঘোর
স্তব্ধ কুয়াশায়
কে যেন যাচ্ছিল হেঁটে, বুকে তার উদ্ভট হরফে
লেখা ছিল ‘মরণ’ এবং
সে দাঁড়াল ঘুরে, হিম কুয়াশায় ভরা দু’টি চোখের কোটর।
৬. ১.৯৯
কুয়াশায়
ভীষণ কুয়াশা চতুর্দিকে, কাছে দূরে সব কুছি
দৃষ্টির বাইরে, আছে শুধু
প্রবল হোঁচট খাওয়া। মনে হয়, ভেজা মাটি ফুঁড়ে
আসছে বেরিয়ে দ্রুত মানুষ সদৃশ প্রাণী, তবে
প্রকৃত মানব নয়। ওরা চন্দ্র, সূর্য, তারা
চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে, শীতার্ত, রোমশ অন্ধকারে ডুবে যাই।
আমার পাশেই ছিল জ্যোতির্ময়ী একজন, মন্ময় যাত্রায়
সমর্পিতা; যতই বাড়াই হাত, তার
হাত দূরে রয়ে যায় স্পর্শাতীত। মাটি কাঁপে, না কি
নিজেই টলছি খুব। গলা ছেড়ে ডেকে
ওঠার বাসনা তীব্র, অথচ হঠাৎ যেন হারিয়ে ফেলেছি
কণ্ঠস্বর; আমার জীবন আজ শব্দহীন ধু ধু আর্তনাদ।
শূন্যতাই চায় সারাক্ষণ
কখনও অস্ত্রের নাচ হয়ে,
কখনওবা অসংখ্য বৃশ্চিকময় খাদ রূপে, হায়,
আমাকে দখল করে নিতে। শূন্যতার দাঁত
আমার সত্তায় তীক্ষ্ণ বসে যায় বেলা অবেলায়। অকস্মাৎ
রোদ ওঠে, একটি কি দু’টি পাখি কাঁটাঝোপে
গান গায়, চোখ পড়ে নিজের জামার দিকে, এ কি!
সমস্ত শরীর জুড়ে কবরের ভেজা মাটি না কি?
কে একজন
হল্দে পাখির নরম বুকের মতো বিকেল বিশ্রামের
আমেজে বুঁদ ছিল। চোখ বুজে এসেছিল প্রায়, হঠাৎ
সে কী ঠোকর কাদাখোঁচা আর বাজপাখির; ঠোকরে
ঠোকরে বিকেলের পেলব হলুদ অমাবস্যা হয়ে যায়।
অমাবস্যায় হাওয়ার গোর মাস্তানি, বিয়ারের ক’টি
খালি ক্যান ক্ষুধার্ত ধুলোয় গড়াতে গড়াতে ডান
থেকে বামে। জিনস্-এর একজন কামার্ত ট্রাউজার
একজন লাজনম্র ভড়কে-যাওয়া শাড়ির দিকে ধায়।
আকাশের কম্পমান নক্ষত্রসমাজ ফ্যালফ্যাল চোখে
তাকিয়ে থাকে; গাছের ডালপালাগুলো বড় বোবা
আর্তনাদে নিথর! একজন ধনকুবের, লাম্পট্যের সেরা
প্রতিকৃতি, হাতের তালেবর দশ আঙুলের দশটি
সুতো নাড়ছে লোভাতুর আন্ধারে। শহর সেই সুতোর জালে
জড়িয়ে গিয়ে ভয়-বিহ্বল হরিণ, বেজায় লুণ্ঠিত এবং ক্রূর
অন্ধকারের থাবা ওকে অন্ধ করে ফেলে। কে একজন,
আহা কী কান্তিমান, হাতে তারাবাতি নিয়ে খেলতে
খেলতে চৌরাস্তায় দাঁড়ায়; দু’চোখে তার স্বপ্নের গোধূলি
এবং চারদিকের ধুলোয় সে গোলাপ আর পদ্ম ফোটায়।
১৯.১২.৯৮