একটি নিবাসে কয়েকটি শতক
বহু রক্তপাত, বহু ধ্বংস আর সৃজনের অন্তরঙ্গ
একটি শতাব্দী অবসিত হলে আরেক শতাব্দী সাবলীল
উদয়ের পথে এসে দাঁড়ায় এবং শুরু হয়
নতুনের জয়ধ্বনি, তবু পুরোনোর কিছু পরাজয় স্মৃতি,
কিছু ঝাঁঝ রয়ে যায়। মানবের দীপ্ত পরিচয়, কীর্তিগাথা
জেগে থাকে; একটি নিবাসে কয়েকটি শতকের বসবাস
আমরা দেখতে যাই কখনও কখনও। গৌরী, তুমি
দ্বিতীয় র্যা মেসিসের অস্থিচর্মসার
প্রাচীন শরীর দেখে মুখ মুহূর্তেই
ফিরিয়ে নিয়েছ জানি সুদূর মিসরে। আর আমি
অন্য কোনওখানে নেফিরেত্তির মূর্তির দিকে বিমুগ্ধ তাকিয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি বহুক্ষণ, কল্পনায়
হয়েছি বিভোর। চেতনায়
রৌদ্রজ্যোৎস্না খেলা করে বারবার মিউজিয়ামের
প্রদর্শনী কক্ষে আর সদর সিঁড়িতে।
গৌরী, তুমি আর আমি কখনও হঠাৎ
জাদুঘরে মিলিত হয়েছি,
যদিও যুগলবন্দি সুরে মেতে পাশাপাশি
দু’জন দেখিনি কোনওদিন কোনও মমি
অথবা সুদূর শতাব্দীর তৈজসপত্তর কিংবা অলঙ্কার।
মিউজিয়ামের অডিটরিয়ামে, সিঁড়িতে পেয়েছি
সান্নিধ্য তোমার কালেভদ্রে, বলেছ নানান কথা
স্বপ্ন জাগানিয়া সুরে। তোমার মনের কথামালা
ঝরেছে মুক্তোর মতো। এইসব মুক্তো, হায়,
আমাদের চিরপ্রস্থানের পরে কখনও সঞ্চিত
থাকবে না কোনও জাদুঘরে।
১২.২.৯৯
একদা এখানে
একদা এখানে এই বাড়িতে করত বসবাস
পরম শান্তিতে কতিপয় নিরিবিলি বাশিন্দা, ছিল না কোনও
চেঁচামেচি বাড়িটিতে, কিংবা কোনও দিন অকস্মাৎ
লাগেনি আগুন, ধসে পড়েনি দেয়াল,
বারান্দা অথবা ছাদ তাসের ঘরের মতো। কখনও কখনও
শোনা যেত নূপুরের ধ্বনি আর মালকোষ, বসন্ত বাহার।
বাড়িটার সমুখে উদ্যান ছিল, ছিল কিছু
রঙবেরঙের ফুল, মাঝে মাঝে পাখিদের গানে
পরিবেশ চিত্তহারী ছন্দে ভোরবেলা
দ্বিপ্রহর অপরাহ্নে হতো নৃত্যপর। কখনওবা
তিন চারজন নারী ও পুরুষ চড়ুইভাতিতে
সুস্নিগ্ধ উঠত মেতে উদ্যানে; শিশুর
হাসির তরঙ্গ মাঝে মাঝে
লুটিয়ে পড়েছে ঘাসে, গাছের পাতায়।
কী যে হ’ল একদিন সেই বাড়ি থেকে মুছে গেল
সব কলরব, কার ফুঁয়ে যেন নিভে গেল বাতি,
দরজা জানালা ভাঙাচোরা, ঘরময়
চামচিকা ও বাদুড় । দেয়ালে সুদীর্ঘ বুনো ঘাস।
মাঝে মাঝে অন্ধকারে বাড়িটার বুকচেরা ঘাস
আর বুনোলতাময় জানালায় জোনাকির ভিড়ে
একটি রহস্যময় মুখ জেগে থাকে
প্রগাঢ় সময়হীনতার। কার মুখ? মেলেনি উত্তর আজও।
১৬.১.৯৯
ওরে নির্বোধ
ওরে নির্বোধ, ওরে হঠকারী পদ্য-লিখিয়ে
কেন তুই শেষে এমন পদ্য লেখার নেশায়
মেতেছিলি এই সূর্য ডোবার একটুকু আগে?
বেশ তো বিকেলে ছিলি হাসিখুশি সুখের ডেরায়,
কেন মিছেমিছি পোড়ালি সে-ডেরা ভরসন্ধ্যায়?
ওরে নির্বোধ, অচল মুদ্রা, কেন রে নিজেকে
ভব্য রাখতে শিখলি না তুই? কেন প্রিয়তমা
নারীর হৃদয় এভাবে ভাঙলি হঠকারিতায়?
ওরে নির্বোধ, ওরে হঠকারী পদ্য-লিখিয়ে
অনেক গুণীর সহবৎ পেলি, তবুও শিক্ষা
হ’ল না তো তোর, মাতালের মতো টলতে টলতে
ঘুরলি বেঠিক পথে আর মুখ থুবড়ে পড়লি
নালা আর খাদে। তোর নামে কত কুৎসা রটলো,
ওরে নির্বোধ, এখনও কি ভুল নিবি না শুধ্রে?
সময় তো হায় বেশি নেই আর, এখন সবার,
বিশেষত তোর দয়িতার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখ।
১৩.৯.৯৮
কবি
নিশীথ আমাকে তার থমথমে অন্ধকারে একটি গাছের
নিচে দাঁড় করিয়ে নিগূঢ় কিছু কথা
মৃদু বলে নেয়, অবয়বহীন তাকে ছুঁতে গিয়ে
স্তব্ধতার রোঁয়াগুলো আঙুলে জমাট বেঁধে যায়। সন্ধ্যারাতে
হুইস্কি করিনি পান, তবু কেন মাথার ভেতর
নানা ফুল ফোটে আর নক্ষত্র-নারীরা নেচে ওঠে
দুলিয়ে সোমথ স্তন? কার ইশারায়
ক্ষণে ক্ষণে ঝোপঝাড়ে জ্বলে আর নেভে ক’টি কবিতা-জোনাকি?
আমি কি কখনও কোনও কোকিলকে গলা টিপে, হায়,
মেরেছি বিভ্রমে? তবে কেন সুর তুলতে গেলেই বারবার
সুর কেটে যায়, যেন আনাড়ি সাধক একজন
জবুথবু, ম্রিয়মাণ। আমি তো নিজের কাছ থেকে
ক্রমান্বয়ে সরে গিয়ে বাঁশপাতা, বাতাসের চুমোয় অস্থির
ঘাসের সবুজ ডগা, পাখির বুকের
নিবিড় স্পন্দিত ছন্দ হতে চাই। নিঃসঙ্গতা হয়ে
আমাকে বিরান মাঠে, হু হু দিঘি নিয়ে যায়।
কখনও চাঁদের ঠোঁটে আঙুল ঝুলিয়ে
স্মরণে ফিরিয়ে আনি ভুলে-যাওয়া পদাবলী আর
পায়ের বিবর্ণ এক পাটি জুতো খুঁজতে খুঁজতে
নিশীথে বিহান করে ফেলি। কখন যে
ভোরবেলাকার রোদ অলক্ষ্যে বদলে দেয় মনের প্রচ্ছদ,
বুঝতে পারি না। অকস্মাৎ
সৃষ্টির মোরগঝুঁটি মুঠোয় নিঃশব্দে ভরে নাচে
কবরের কালো ঘাস। আমাকে কবিতাসুদ্ধ গিলে
খাওয়ার উদ্দেশে কীটপতঙ্গের দল ধেয়ে আসে।
কবিতার বদান্যতা থেকে
কখনও কখনও এমনও তো হয়, কবিতার বদান্যতা থেকে
দূরে পড়ে থাকি ধু ধু নিষ্ফলা জমিনে। রাশি রাশি
রুক্ষ বালি মুখের ভেতর, হাত বিদ্ধ অজস্র কাঁটায়, চোখ দুটো
রক্তে ভিজে ওঠে বারবার, কিছু দেখা যায় কি না যায়,
বলতে পারি না কিছুতেই। আমার এ হাল দেখে
পাথরেরও বুক ফেটে ঝরবে শিশির,
অথচ কবিতা কাছে এসে
বসে না আমার মুখোমুখি, হাতে হাত
রাখে না, দু’চোখে তার বয় না তারার ঝর্নাধারা।
সময় আমাকে নিয়ে খেলা করে, যেমন বেড়াল
এক গাল হেসে
বানায় বিপন্ন ইঁদুরকে ক্রীড়নক। তাহলে কি
সত্যি সত্যি ক্রীড়নক আমি সময়ের ক্রূর হাতে? নিত্যদিন
করব লড়াই সব প্রতিকূলতার
বিরুদ্ধে ট্রাজিক নায়কের মতো। তীব্র খরাতেও
ফসলের আশায় থাকব ফাটা রক্তভেজা ঠোঁটে। সত্য বটে
কবিতা কখনও এসে কড়া নাড়ে, আবার আসে না বহুদিন।
হয়তো একটি পাখি এসে বসেছে রেলিং এ, অকস্মাৎ
এক টুকরো কাগজ পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে,
একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে পথে, এর
যে কোনও একটি চোখে পড়লেই, কিংবা কারও
চোখের রহস্যময় দৃষ্টি জাগলে স্মৃতিতে, ফের পলাতক।
কবিতা আসবে ফিরে অন্তরঙ্গ পুষ্পিত মুহূর্তে।
বুঝি তাই কবিতার বদান্যতা থেকে নির্বাসিত
হয়েও প্রত্যহ চাতকের মতো প্রতীক্ষায় থাকি।
১৫.১.৯৯