তাঁর ছায়া
(এ কে ফজলুল হককে নিবেদিত)
বিশাল দেয়াল নয়, বৃক্ষ নয়, নয় সে পাহাড়;
একটি কিশোর শুধু, মেরুদণ্ড দধিচীর হাড়
দিয়ে গড়া; বস্তুত গড়নে দিব্যি বড়োসড়ো,
ঘরে মন টেকা দায়, প্রান্তরে হাঁটায় বেশি দড়।
কখনো ভাদুরে রৌদ্রে উঠোনে, দাওয়ায়
বসলে মা অন্নছত্রে ঘরকন্না, সংসারী হাওয়ায়
সানন্দে উঠলে মেতে আর আঁচলের প্রান্তভাগ
কোমরে জড়িয়ে, হাতে গালে নিয়ে হলুদের দাগ
বটিতে কুটলে মাছ, বাটনা বাটলে কোথা থেকে
সে কিশোর ছুটে এসে নিজের ছায়ায় দেয় ঢেকে
আপাদমস্তক মাকে। মা বলেন তাকে, “লক্ষ্মী, বাছা
মিছে পুড়িসনে রোদে।
কিন্তু তাঁর রোদ্দুরেই বাঁচা।
তাই বছরের পর বছর সে-রৌদ্রের হল্কায়
কাটান প্রহর আর খরবেগে যেখানে ছলকায়
জীবনের দুই পাড়, সেখানে দাঁড়ান অবিচল;
হেলে চাষিদের প্রাণে নামে তাঁর মানবিক ঢল।
দারুণ খরায় পোড়া স্বদেশকে নিত্য দেয় ছায়া,
কী বিপুল ছায়া, এই বাংলাদেশজোড়া তাঁরই কায়া।
তারা ক’টি যুবা
তারা ক’টি যুবা হিংস্র যুদ্ধে
ভাবে না কখনো জিৎ কার, হার কার?
দেয়ালে দেয়াল শুধু সেঁটে দেয়
লাল গোলাপের নতুন ইস্তাহার।
গত শতকের সুড়ঙ্গ থেকে
শক্র শিবিরে আনে স্বপ্নের হাড়-
সে-হাড় দেখিয়ে বলে সবাইকে
‘দ্যাখো এর ছিরি, ক্ষয়িত তীক্ষ্ণ ধার!’
অসম্ভবে ছড়া কেটে তারা
নৌকো ভাসায়, হোক না তা’ বানচাল।
দাঁড় নেই তার, মাল্লা মাতাল;
বস্তুত নেই এমন কি ছেঁড়া পাল।
দুঃখ তাদের কাণ্ডারী তবু
মহাযাত্রায় পড়ে না কখনো ছেদ।
প্রবঞ্চনার চোয়ালে ঘুমিয়ে
রাত্রি কাটায়, তাতেও নেইকো’ খেদ।
ফিরে এসে দ্যাখে হাঁটু মুড়ে বসে
বিশ্বাস কাঁদে, উড়ে গেছে ভিত তার।
কারা যেন সব ফেরি করে রোজ
নর কংকাল-দিকে দিকে চীৎকার।
গোঁড়ামি এখানে উলঙ্গ রাজা;
যুক্তি, বিবেক ইত্যাদি ক্রীতদাস।
সময় বন্দি বদ্ধ জলায়,
মুকুট পরেছে দারুণ সর্বনাশ!
তারা কি’টি যুবা স্বভাবদোষেই
গৃহস্থালির মর্ম বোঝে না আর!
যাত্রার গানে ঊর্মিল পেশী,
বেহালা হলো যে নৌকোর সব দাঁড়।
বয়েসী পিতার অনুনয় ছিঁড়ে
দু’হাতে সরায় নারীর অলক দাম।
যা হবার হবে, ঘর থাক পড়ে-
ভোলায় না মন পুত্রের ডাক নাম।
তারা ক’টি যুবা এখানে জাগায়
আত্মার মহা তৃষ্ণার হাহাকার।
মনের দেয়ালে সেঁটে দেয় ফের
লাল গোলাপের নতুন ইস্তাহার।
তিনি
কতদিন তাঁকে খাটো বারান্দায় ম্লান কেদারায়
নিরিবিলি, একা, বসে থাকতে দেখেছি। হাতে বই,
কফির পেয়ালা শূন্য; কখনো পুরোনো দেয়ালের
বেড়ালের ক্ষিপ্র গায়ে রাখতেন চোখ, কখনো বা
দিতেন গড়িয়ে দৃষ্টি বাগানে এবং বড় বেশি
হতেন কাতর দুষ্ট বালকেরা ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে
আহত করলে কোনো নিঃসঙ্গ পাখিকে খেলাচ্ছলে।
বাগানে দাঁড়ালে ফুলগুলি দিতো ধরা তাঁর হাতে
গভীর আস্থায় আর শালিকের মৃদু শব্দাবলি
কী যেন বলতো তাঁকে। কী হবে বসন্ত যদি আর
কখনো ফিরে না আসে পৃথিবীতে? যদি চিরতরে
গান বন্ধ করে দ্যায় ভুল করে পক্ষীকুল তবে
পাবো কি কখনো আর নিরঞ্জন কাল? ইতোমধ্যে
আমাদের পায়ের ক’বিঘা মাটি ভীষণ অস্থির
দু’তিন দশক থেকে, ঘাস তো সবুজ নেই আর…”
-এসব ভাবনা তাঁকে বিহ্বল করেছে কতদিন।
কখনো ফুলের হয়ে কখনো-বা শামুকের হয়ে
বেঁচেছেন। একদিন কী এক দুর্জ্ঞেয় হাহাকারে
দীর্ণ হয়ে বারান্দায় বাগানের প্রসন্নতা ছেড়ে
প্রতিধ্বনিময় মাথা নেড়ে-নেড়ে, দেখলাম, তিনি
স্তব্ধ ক্রাচে ভর করে চলেছেন হেঁটে নীলিমায়!
দু’ এক দশকের
দু’ এক দশকের রুগ্ন সংবাদ রটলো অবিরত চরাচরে।
বর্বরতা আর হত্যা একালের জীবন প্রবাহের সূত্র,
জীবন যাকে বলি সেওতো সম্প্রতি প্রহত চেতনার অভিমান।
যাচ্ছি ভেসে আজ ভীষণ উদ্বেগে মগ্ন কূল থেকে অকূলে।
সে কবে অতিদূর উধাও শতকের অস্তরাগে কেউ বলেছিলেন
প্রতিটি প্লাবনের জলজ হাহাকারে রয়েছে নিজস্ব পায়রা।
অথচ হা কপাল! কারুর হাতে আজ তেমন শুভবাদী পায়রা নেই!
কেবলি বারবার পাতাল ডেকে নেয়, সেখানে জমে হাড়, মড়ার খুলি।
বর্তমানে আমি ফাটল-ধরা এক দেয়াল যেন একা দাঁড়িয়ে আছি-
আমাকে ঘিরে রয় ঝড়ের মাতলামি এবং অভাবিত ভূকম্পন।
কখন ঢলে পড়ি, এইতো ভয় শুধু কালের চত্বরে হাত-পা ছুঁড়ি,
বিপুল সমারোহে জরিপ করে দেখি বিশ্বে চারভাগই শূন্য!
আমরা অবিরাম ঢুকছি গুটিসুটি যে যার কল্পিত বিবরে,
সেখানে ইচ্ছাকে সাজাই বারবার চতুর নানাবিধ বিন্যাসে।
অথচ বাস্তবে ইচ্ছা নয় জানি প্রকৃত পোষমানা পাখির ঝাঁক,
ডাকলে আসবেই, সহজ অভ্যাসে বসবে জানালায় নীরবে!
এখন যদি লিখি শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রখর কতিপয় পংক্তি
তবে কি বিস্মৃত বাগানে পুনরায় ফুটবে রক্তিম ফুলদল?
তবে কি পৃথিবীতে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ঘটবে অচিরাৎ অবসান?
তবে কি সভ্যতা সত্যি যাবে বেঁচে ছন্দ মিল আর প্রতীকে?
আজকে যারা শুধু হুমড়ি খেয়ে পড়ে শস্তা গ্রন্থের এডিশনে,
কখনো তারা ফের সিদ্ধ বাণী চেয়ে পাবে কী সত্যের পরগনা?
এখন সেই পরগনার আশেপাশে নির্বিচারে ঘোরে চতুষ্পদ-
উড়িয়ে ধুলো খুরে শিল্প থেকে ওরা নিয়ত অ-শিল্পে ধাবমান।
স্নুকার বল হয়ে স্বপ্ন জড়ো হয় সবুজ রাস্তায় মাঝে মাঝে;
কিন্তু পুনরায় হারায় তারা আর খেলার শেষে যেন অবসাদে
টেবিলে মাথা রেখে আমিও কতদিন তীব্র হতাশায় ভেবেছি
জটিল জীবনের অর্থহীনতাকে কী করে করি বলো অর্থময়?
তরল ঘড়ি-স্রোত, সূর্যমুখী আর ফলের থালা হাতে তন্বী
অথবা জ্যামিতিক মাছের স্বপ্নাভা, নর্তকীর নাচ কিংবা
তেরজা রিমা আর প্রগাঢ় পয়ারে অলৌকিক শত ঝংকার
জন্ম দিতে পারে স্বর্গ-মৃগটাকে বাঁচার গণ্ডিতে সুডোল করে?
চূর্ণ হবে থাম, দেয়াল যাবে ধ্বসে, পতনে সম্প্রতি লুব্ধ।
শুকিয়ে যাবে দ্রুত বিশাল হ্রদগুলি, শহর হবে ধু-ধু মরুভূমি।
এসব ভয়াবহ পতন এড়ানোর আশায় প্রাণপণে পালাতে চাই,
অথচ নিশ্চিত সর্বনাশ থেকে জেনেছি কিছুতেই বাঁচোয়া নেই!