- বইয়ের নামঃ নায়কের ছায়া
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অচেনা শহরে
স্বপ্নে দেখি পর্যটন বিভাগ অথবা
অন্য কারো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ভিনদেশী কী এক অচেনা
শহরে প্রবেশ করি আমি বেলাবেলি
অবলীলাক্রমে, দেখি সেখানেও ফোটে রক্তজবা,
জুঁই ও চামেলি।
সেখান করে দেনা লোকজন? দোকানপাটের জ্বলজ্বলে শোভা আর
অত্যন্ত বনেদী ক্লাব, শিশু পার্ক, স্টেডিয়াম, পৌরসভা আছে
সেখানেও, আছে ব্যাংক আর সিনেমার কাউণ্টার।
আমাকে চেনে না কেউ অচেনা শহরে। কারো কাছে
গিয়ে আমি দাঁড়ালেও, হাত
বাড়ালেও কোনো সাড়া পাই না। যদিও সকলেই
স্বাভাবিক চোখ মুখ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী। অকস্মাৎ
মনে হয়, বুঝি বা ওদের কোনো সাধ আহলাদ নেই।
বেজায় অটোমেটিক ওরা ঘোরে, হাঁটে
ভাবলেশহীন,
রা’ কাড়ে না কেউ, কিংবা চকিত পাখির পাখসাটে
পলক পড়ে না কারো চোখে। রাত্রিদিন
একাকার, কেউ কারো সঙ্গে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা
বলে কিংবা কুশল জিজ্ঞেশ করে হেসে,
পাইনি প্রমাণ তার। কোনো ব্যাকুলতা
নেই কারো বুকের ভেতর। ভালোবেসে
পরস্পর কেউ এক লহমাও তাকায় না কারো
দিকে, ওরা ঘোরে শুধু ঘোরে
চক্রাকারে গাঢ়
অন্ধকারে আর কখনো পথের মোড়ে
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, যেমন পুতুল
থেমে যায় হঠাৎ চাবির দম ফুরোলে। নিকটে
গিয়ে ছু’য়ে দেখি, কারো মধ্যে নেই প্রাণের স্পন্দন। নাকি ভুল
করে ভাবি মৃত ওরা। সেখানে যা ঘটে,
কেমন অলীক সবই। সেখানে কবির খাতা থেকে
বেবাক অক্ষর
মুছে যায় প্রবল অদৃশ্য ফুঁয়ে, দবিজ ধুলোয় যায় ঢেকে
অসহায় গায়কের ফুল্ল কণ্ঠস্বর।
স্বপ্নের ভেতরে আমি নিজেকে চিমটি কেটে দেখি
সত্যি নিজে বেঁচে আছি কিনা, এ কেমন মরশুম
অচেনা শহরে দেখি। ভীষণ শীতল সব, এ কি
সেখানে আমিও মরহুম!
অন্যরকম যুদ্ধ
তবে কি আখেরে আমি মাথা নত করে চলে যাবো
এমন জাজ্বল্যমান দ্বিপ্রহরে নামিয়ে উষ্ণীষ? যদি যাই,
গাছপালা, নদীনালা, উদাস প্রান্তর, আর ধূসর পাথর
নীল আসমান, রোদ্দুরের
চমকিলা বদ্বুদ পায়রা, বাজপাখি , এমন কি
মালিক, চড়ুই আর শেয়াল-কুকুর
কাপুরুষ বলে দেবে তুমুল ধিক্কার।
প্রতিপক্ষ ডান দিক থেকে ঘনঘন বুক ঠুকে
দিচ্ছে ডাক, ছাড়ছে হুঙ্কার,
বাজে রণঢাক, শুনি অবিরত তুলছে ধনুকে
প্রবল টঙ্কার। অশ্বক্ষুরে
পায়ের নিচের মাটি কম্পমান, মত্ত কেশরের
ঢেউ নাচে দিগ্ধিদিক, জান্তব নিশ্বাস আগুনের
হল্কার মতন এসে লাগে
চোখে-মুখে। পিপাসার্ত মাটি
আমার গরম রক্ত শুষে নেবে বলে সর্বক্ষণ
চাটে শুক্নো ঠোঁট।
অথচ এখনো আমি রয়েছি দাঁড়িয়ে
প্রবল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি, মানে বামদিকে
অবিচল। চারদিক থেকে
আসুক তীরের ঝড়, নামুক বিরোধী ঢল, তবু,
মাথা নত করে আমি হবো না উধাও
রণে ভঙ্গ দিয়ে, পরাজিত
মানুষের মতো ঘষবো না মুখ ধুলায় অথবা
বিপর্যস্ত ঘাসে। জানি, সপ্তরথী ক্রুর অবেলায়
আমাকে ফেলেছে ঘিরে, দিচ্ছে হাঁক; অসি,
বল্লম ঝলসে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, কিন্তু আমি অভিমন্যু নই;
ভয়ংকর ব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসার
গূঢ় মন্ত্র এখনো ভুলিনি। উপরন্তু কী অটল
রয়েছে আমার হাতে জ্বলজ্বলে মৌলিক ধনুক।
আমার নিজস্ব তূণ থেকে সহজে আনবো আমি
হিংসার বদলে ভালোবাসা,
আমার রথের চাকা ধ্বংসের প্রান্তরে
করবে কর্ষণ মৈত্রী বৈরিতার কালে,
স্বপ্নের কেয়ারি হবে তৈরি দিকে দিকে। নিত্য ফুল
ফোটাবো ব্যাপক শূন্যে, সে পুষ্পশোভায়
অন্ধ হবে রক্তজবা-চোখে এবং বাঁচার গানে
স্তব্ধ করে দেবো প্রতিপক্ষের হুঙ্কার।
আবার কখন তুমি
তুমি টেলিফোন রেখে দেবার পরেই আচমকা
নিজেকে রবিনসন ক্রুশো মনে হলো।
আমার বুকের
ভেতরটা খুব ক্ষত বিক্ষত এখন এই সকাল বেলায়
ঝাঁক ঝাঁক কাক আর খুব রাগী বকের নখের হামলায়।
‘নির্বাসন, নির্বাসন’ বলে হয় অতিশয় বিদ্রূপপ্রবণ
ঘরের চৌকাঠ, জানালার পর্দা, একাকী চেয়ার,
যাবতীয় পুরোনো দলিল দস্তাবেজ,
আর জুতোজোড়া, যারা সময়ের চুমোয় চুমোয়
বয়স্ক হয়েছে খুব, যাদের বেকুব মুখ একবিংশ শতাব্দীর দিকে
সারাক্ষণ,
রবীন্দ্ররচনাবলী, ডাস ক্যাপিটাল,
এবং অস্তিত্ববাদী দর্শনের বই।
পূর্ণিমার কাছ থেকে পেয়েছি আত্মার রঙ আর
যে-গোলাপ স্বপ্নে দেখি রবীন্দ্রনাথের
করতলে, তাকে জানি প্রেম বলে, প্রেম
প্রেমই, তার বেশি কিংবা কম কিছু নয়।
আমি তো প্রেমের গূঢ় পাঠ নিই হরিণের কাছে,
কখনো বা জ্যোৎস্নাস্নাত নেকড়ের কাছে
এবং শিখেছি ঘৃণা মানুষের ব্যাপক সৌজন্যে বহুদিন।
তুমি টেলিফোন রেখে দেবার পরেই
মমতাবিহীন দীর্ঘ দিপান্তরে আছি।
তুমি কি জানোনা
নানা দিকে উল্টোপাল্টা ছুটতে ছুটতে
বহু কাঁটাবন
বহু বালিয়াড়ি আর দুঃস্বপ্ন-বিমূঢ় অলিগলি
পেরিয়ে এসেছি
তোমার দিকেই আমি এসেছি আখেরে?
তুমি কি জানোনা
আমার গলার
ঈষৎ-কুচকে যাওয়া চামড়া পুনরায়
আশ্চর্য মসৃণ হয় তোমার চুম্বনে?
তুমি কি জানোনা
তোমার সান্নিধ্য পেলে কেমন আপ্লুত, এলোমেলো
হয়ে যায় আমার এ মোতাজিলা মন?
তোমার চোখের মতো এমন গভীর চোখ দেখিনি কখনো,
তোমার সুরেলা কষ্ঠস্বরে যে-মাধুর্য সঞ্চরণশীল, তার
উপমা দুর্লভ আর অনুপম শরীরের আশ্বিন তোমার
এবং তোমার মতো এমন সংস্কার ছিঁড়ে ভালোবেসেছে কি
কখনো আমাকে কেউ?
তবে কেন জেনেশুনে এত ধুধু যোগাযোগহীন
করো বসবাস এই কোলাহল-বিহ্বল শহরে
এমন নিঃসাড়।
আবার কখন হাওয়া, মেঘমালা হবে ভালোবাসা,
প্রতীক্ষায় আছি
প্রতীক্ষায় আছি
প্রতীক্ষায় আছি।