- বইয়ের নামঃ নিরালোকে দিব্যরথ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অধর্মণের গান
সাধের তবিলদারি নিশ্চিত ঠেকেছে তলানিতে,
উপরন্তু দেনায় ডুবেছে মাথা, তবু হু-হু আভিজাত্যে মজে
মাকড়সা, আরশোলাময় অন্ধকার ঘরে বসে
মন উচাটন। ওরে আমি অসময়ে কোথা যাবো?
আমিতো দাসানুদাস, খাস তালুকের প্রজা, জানি
রতন মাণিক্য কতো প’ড়ে আছে সেই জলে, অথচ কখনো
পারিনি তুলতে একরত্তি। বাজারে বাজার করো মন বলে
এ-পাড়া ও-পাড়া করি, আদা কাঁচকলা কিনে থলির দীনতা
সযত্নে লুকোই আর কোনোমতে আধপেটা খেয়ে শতচ্ছিন্ন
কম্বল সম্বল করে শোধনবাদের ছিদ্র খুঁজি, গুলতাপ্পি,
কটুকাটব্যের ঝড় তুলি নিত্য ধারের বুলির ভরসায়।
আর কী মজার কাণ্ড, দু’হাতে রোখেন যারা ক্ষিপ্র আগামীকে,
তারাই সহজে আজ মাথায় বুলিয়ে হাত প্রগতির পথ বাৎলান।
পুরোনো কুকুর-ঘরে গুমনাম স্বপ্ন কতিপয়
রেখেছি গচ্ছিত, তারই প্ররোচনা হৃদয়ের চোরকুঠরিতে
চৈত্ররজনীর স্মৃতি আনে মধ্যে মধ্যে-দেখি, তুমি আছো এই আটত্রিশ
বছরের অভিজ্ঞ পাঁজর ঘেঁষে, উন্মোচিত শরীরের দীপ্ত রাজধানী।
চোখের পাতায় জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্না চুল, স্নিগ্ধ বাহু, মিনার-গ্রীবায়-
জ্যোৎস্নায় বাসনা চরে, যেন রাজহাঁস,
রক্তিম চঞ্চুর আভা ছড়িয়ে হাওয়ায় লীলায়িত।
সোনালি বৃক্ষের ডাল থেকে পাখি নেমে এসে
গান গায় হৃদয়ের উন্মুক্ত খাঁচায়,
বাঁচায় অতনু অতীতকে। অথচ ফেরালে মুখ
চাঁদের ফালিটি দেখি হৃদয়ের ভরা
ক্ষতকে খোঁচায় কৌতুকের বক্রতায়।
প্রচুর আদর খেয়ে প্রকৃতির বসন্তের পেছনে পেছনে
করি ধাওয়া, খুঁজি তাকে দিনমজুরের
খুপরিতে, রেশনের দোকানের দীর্ঘ পাঁচমিশেলী কাতারে,
মুদীর চালায়, কারখানায়,
আর ঢেউ-খেলানো টিনের ছাদে, ডোবার কিনারে।
সেখানে বসন্ত কৈ? বস্তুত অধুনা
বসন্ত প্রতিষ্ঠা খোঁজে তারুণ্যের উদ্দাম মিছিলে,
সংস্কৃতির উচ্চকিত স্বাধিকারে, পর্বত-টলানো হরতালে।
ধরনি ন জাই অনীতি ঘোর নিশাচর জো করহিঁ,
হিংসা পর অতি প্রীতি তিন্হ কে পাপহি করনি মিতি।
বাঢ়ে খল বহু চোর জুআরা।
যে লম্পট পর ধন পর দারা।।
মানহিঁ মাতু পিতা নহি দেবা।
সাধুন্ হ সন কব্রারহিঁ সেবা।।
আমাদের শতকের শোক, জরা, ব্যাধি বড় বেশি
ভাবিত, বিপন্ন করে। দীর্ঘদেহী ইতিহাস অবেলায়
ছায়া ফেলে যায় যুগান্তের করিডরে। প্রত্যুষের শাদা
মোরগের কিরীটের মতো সূর্য আমরা দেখিনি
কতকাল, কতকাল নৈঃসঙ্গ্যের ক্রুশকাঠ বয়ে
ফুটিয়েছি কতো রক্তগোলাপ পাথুরে মৃত্তিকায়
ওরা পা রাখবে বলে। অথচ এখনো স্পষ্ট কোনো
পদধ্বনি এ শহরে আমরা শুনিনি। চাঁদটাকে
কে যেন করবে গ্রাস, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুগুলি
দলে দলে তৃণহীন মাটি ফুঁড়ে অতৃপ্ত ক্ষুধায়
আবার জেগেছে যেন।
ত্রাসের রথের চাকা দ্রুত
দলিত খণ্ডিত করে, আমাদের নগ্ন কাঁধে কোনো
দেবদূত ভুলক্রমে মহিমার হাত রাখলেও
ভাসে না আনাড়ি চোখে স্বর্গোদ্যান আজ।
সেদিন দেখেছি স্বপ্নে আবার এলেন তিনি ম্লান
জটিল পাঁচিল ঘেঁষে-এলেন আমার পিতা, মৃত,
ক্রুদ্ধ, অনুযোগে কম্পমান। তবে কি বেয়াড়া কিছু
ঘটেছে শহরে?
তবে কি আমার কাছে চান কোনো প্রতিকার অশরীরী পিতা?
তেমন যোগ্যতা নেই, বুঝি তাই ভয়ার্ত ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি
চকিতে উঠলো কেঁপে রাত্রির হাওয়ায়,
কেবলি প্রেতের সঙ্গে জমাই আলাপ।
কারাগারে, কখনো-বা চোরকুঠরিতে
ভাঁড় আর ঘাতকের, কপট বন্ধুর কাঁধ ঘেঁষে
লুকিয়ে বুকের ক্ষত হাঁটি একা নিদ্রাতুর এই
শহরের অলিতে-গলিতে। দৃশ্যান্তরে
উন্মাদিনী কাঁদে, ভাসে জলের ভিতরে,
লতাগুল্মে নিদ্রায় নিথর!
শবাকীর্ণ মঞ্চে আমি ভীষণ দোমনা, নিরুপায়।
তবে কি কৃপার পাত্র আমি? পাদপ্রদীপের নিচে
চিরদিন অভ্যর্থনাহীন?
এখানে কোথাও কেউ কারো প্রতি নয় মনোযোগী,
অথচ বচসা করে অবোধ্য ভাষায়, রাতারাতি বাচম্পতি
হতে চায় দায়িত্বের চন্দচর্চিত ললাটের মহিমায়।
আপন-বাঁচার যোগী এখানে সবাই
আজকাল। জীবনের উঁচু উঁচু ডালের অতীব
পুরুষ্ট ফলের গুচ্ছে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে
ক্লান্ত হলে ঘরে ফেরে, করে খুনসুটি
খানিক স্বপ্নের সঙ্গে। অথচ এদিকে
দেনায় ডুবেছে মাথা, ঘরের খুঁটিতে ঘুণ, ভিত টলোমলো।
আমার স্বরের ডালে
আমার স্বরের ডালে কুড়ি ধরার দিনগুলি
এখনো জাগিয়ে তোলে আমাকে সমস্ত আচ্ছন্নতা থেকে আর
মনে পড়ে, সেই কুড়ি প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই
অনেকগুলো নোংরা নখ, কালো তারকাঁটার মতো,
ঘিরে ধরলো আমার স্বরের ডালটাকে।
সেদিন থেকে আমার হৃদয় ঝরনার মতো রক্ত ঝরায়,
সেদিন থেকে আমার কণ্ঠস্বর এক তীব্র আর্তনাদ।
লোর্কার মতো শিল্পের আবেগে বাতাসে গোলাপের পাপড়ি হয়ে,
গিটারে গিটারে গুঞ্জরিত গীতিকবিতা হয়ে,
আন্দালুশীর মাল্লাদের গান হয়ে
কেঁপেছি থরোথরো, অথচ তাঁর মতো অজর কবিতা-যে কবিতা
স্পেনের নিশ্বাস হয়ে বয়ে চলেছে আজো পাহাড়ে, সমুদ্রতটে,
রমণীর পুষ্পিত বুকে, পুরুষের কম্পিত ঠোঁটে-
লিখতে পারবো না কোনদিন।
তপ্ত গোলাপের মতো লোর্কার একেকটি কবিতা
আমাকে অন্ধকার থেকে করেছে উদ্ধার, একেকদিন
শুধু কয়েকটি শব্দ কণ্ঠে ধারণ করে, লালন করে ঝাঁঝালো আদরে
কেটে গেছে প্রহরের পর প্রহর,
সেদিন থেকে মৃত্যুকে ঘেন্না করতে শিখেছি আমি।
লোর্কার উচ্চারণে গোলাপের গভীর নাম ধরে ডেকে ডেকে
সুঘ্রাণ করতে চেয়েছি সত্তা। আমার শয্যার বাগানে
যে-পাখি ব্যাকুল এক গান থেকে আরেক গানের দিকে করে যাত্রা,
তার কণ্ঠে গোলাপ-গজলের সুর ধ্বনিত হোক, চেয়েছিলাম।
অথচ আমার সত্তার ডালপালায়
ঝটিতি বয়ে গেল শুধু কনকনে আর্তনাদ।
চোখের পাতায় কিংবা অক্ষি-গোলকের পরপারে
চিরকাল এক স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে
আমি দয়িতাকে আলোয় গলে যেতে দেখেছি।
যতবার সেই গলে-যাওয়া আলো
আঁজলা ভরে পান করার জন্যে অধীর হয়েছি, ততবার
সূর্য ‘আমার পুচ্ছে’
চাঁদ আমার গলায়
তোর কবর বলে চেঁচিয়ে উঠেছে আর
আমার সমস্ত ভালোবাসা আর্তনাদ হয়ে ঝরে গেছে
খুরে খুরে মাটি খুঁড়ে তোলা এক কালো ঘোড়ার পায়ে।
লোর্কার কণ্ঠ ওরা চিরতরে স্তব্ধ করবে ভেবেছিল
কবির রক্তে রাঙিয়ে শূন্য, হাঁ করা প্রান্তর,
কিন্তু ঐ দ্যাখো তাঁর ক্ষত গোলাপের মতো জ্বলছে,
দুলছে কালকণ্ঠে। শৃন্বন্তু অমৃতস্য পুত্রা
লোর্কার কণ্ঠ সেকালের সব পাহাড়, উপত্যকা, আপেলের বন,
প্রান্তর পেরিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে একালে।
মৃত্যুর কালো আলখাল্লায় মুক্তো হয়ে
ঝলমল করছে লোর্কার একেকটি বালাদ, গোলাপের কাসিদা।
আমি কর্ডোভার ঘোড়সওয়ার নই,
দিনের সোনালি ঝরনায় অবগাহন করে হেঁটে যাই
চেনা অচেনা বহু সোজা, বহু ঘোরানো রাস্তায়,
তবু লোর্কার বালাদ মিশে যায়
আমার স্বরের ডাল থেকে ঝরে-পড়া আর্তনাদে।
না, আমরা কেউ সুখী নই।
ভাড়াটে বাচস্পতির বাছা বাছা বাক্য
আমাদের কানের বিবরে গিরগিটি সেজে সুড়সুড়ি দেয় শুধু।
শিশুরা খেলাঘর ছেড়ে গোরস্থাএ যায় বড় বেশি,
মেয়েরা পৃথিবীতে সন্তান আনতে আনতে ফৌত হয়ে যায়,
যুবকেরা সুদিনের চৌকাঠে কখনো পা না রেখেই
একদিন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে গলির মোড়ে, পার্কের ধারে
আর চশমার পুরু কাচ-ঢাকা চোখ দিয়ে
চাটতে থাকে শৈশব-স্মৃতিকে,
যেমন খড়-ঠাসা বাছুরের গা চাটে ধবলী।
ভদ্রমহোদয়গণ,
এই গাছপালাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,
ঘরের এক কোণে-রাখা ভাঙা হারিকেন,
সেজো-অধ্যুষিত গলির কানা বেড়াল
অথবা মেথরপট্রির নেড়ী কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,
আমরা সুখী নই কেউ।
বিশ্বেস করুন,
এদেশের পোকা-মাকড়, জীবজন্তুগুলোসুদ্ধ ভীষণ অসুখী।
আমি কী করে কাজ পাবো
যেহেতু আদিতে ছিল কর্ম, তাই কর্ম চাই আজো। আপনারা
দয়া করে আমাকেও কাজ দিন। শয়তান দিনরাত মগজে বানাক
যাচ্ছে তাই কারখানা, তা চাই না। আপনারা দেয়ালে দেয়ালে
প্রত্যহ লটকে দেন কর্মক্ষম ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট তালিকা।
নানা কাজে দড় তারা, তাইতো জাজ্জ্বল্যমান তালিকায় ওরা
প্রধান, দ্রষ্টব্য নম। হাতে-হাতে চার্ট ঘোরে, ম্যাপ, দিগদর্শনের কাঁটা,
জরুরি ফাইল কতো-দেখে তাক লাগে। এত কৃতী পুরুষের
ঠেলাঠেলি নিষ্প্রাণ শহরে-গ্রামে, ইতোপূর্বে কখনো জানিনি।
আমার নিষ্প্রভ নাম কখনো পাবে কি ঠাঁই সেই তালিকায়,
ঝুলন্ত প্রাচীরপত্রে? আমি কি আপনাদের কাজে,
যা-হোক তা’- হোক কাজে, পারি না লাগতে?
কী বললেন? মগজের সারবান অংশটুকু বাজে কাগজের
ঝুড়িতে হেলায় ছুঁড়ে হুকুম পেলেই
বড়ো, মেজো, সেজো প্রমুখের নাচের ফ্লোরের মতো ঝকঝকে তৃপ্ত মুখে
পারি কি বাড়িয়ে দিতে হুঁকো?
তৎপর আঙুলগুলো ডুবিয়ে চকিতে বারংবার
জল ঘোলা করা নানা ঘাটে সম্ভব আমাকে দিয়ে?
অভাজন আমি তাই এ-যোগ্যতা করিনি অর্জন।
কখনো ধর্মের কল বাতাসে না নড়লেও দু’দান নিজেই
নাড়িয়ে সরলমতি লোকদের তুখোড় আফিমখোর বানানোর কোনো
তেলেসমাৎ জানি কিনা সঠিক জানতে চান হে ধর্মাবতার?
তেমন সুকৃতি এই অধমের কিছুই জমেনি।
পাড়ায় পাড়ায় দাউ দাউ আগুন লাগিয়ে দিব্যি
প্রফুল্ল মেজাজে নরখাদকের আখড়ায় বখরা বাগানো
কিংবা রক্ত ঠাণ্ডা রেখে শিশুর পাঁজর ভেঙে আর
নারীকে ভাসিয়ে দিয়ে রক্তের প্লাবনে
হো-হো-হেসে উঠবার, পৃথিবীকে নরকের মতো
স্রেফ ঢেলে সাজানোর যোগ্যতার নির্ভুল প্রমাণ
দিতে হবে রাতারাতি?
তাহলে লজ্জার মাথা খেয়ে
বলে ফেলি-কস্মিনকালেও আমি নরমেধে পাকাইনি হাত।
হে ধর্মাবতার যদি একটু অভয় দেন তবে এই দীন অভাজনও
দাখিল করতে পারে ভিন্নতর যোগ্যতার বিনীত দলিল
প্রকৃতির নিদ্রাতুর পাড়ায় হঠাৎ পীত শীতের ডাকাত
পড়লে গাছের প্রাণে কী কী অনুভূতি তোলে সাড়া, তার
শিহরণ চৈতন্যে মেলাতে পারি। ছাদে,
দেয়ালে কার্নিশে আর বারান্দায় বছরের পর
বছর বর্ষায় বৃষ্টি কী-যে ঘোর কাজল অতল গান গায়,
সে গানের ভাষা জানবার সাধ নিয়ে কান পেতে থাকি আর
পাখিরা কী করে মরে ঝাঁক ঝাঁক কোন্ অজানায়,
সে খবরও জানা চাই। ট্রফিকের বাজখাঁই হুল্লোড় স্তিমিত হলে মধ্য-রাত্রির শহর
এই শ্লথনীবী শহর কেমন করে হাই তোলে
কোলে নিয়ে বিশাল বেড়াল, তা দেখার জন্যে আজো সর্বস্ব খোয়াতে রাজি
খুন হলে কেউ, হোস পাইপের জলোচ্ছ্বাসে তার
রক্ত ধুয়ে ফেললেও সেখানে মৃতের কোনো ছায়া
পড়ে থাকে কিনা-তা-ও করে আনাগোনা ভাবনার প্রদেশে আমার।
কোথাও অন্যায় করে যদি কেউ, অপরাধবোধে
ভারাক্রান্ত আমার এ-মাথা নত হয়ে আসে।
কোথাও কারুর কণ্ঠ রোধ করা হলে আমি মূক হয়ে যাই,
কোথাও নির্দোষ কেউ ঘাতকের হাতে
বেঘোরে হারালে প্রাণ অলিতে-গলিতে, জনহীন
প্রান্তরের কর্কশ মাটিতে কিংবা চোরকুঠরিতে,
মৃত্যুর ক্ষুধার্ত মিশমিশে নিস্তব্ধতা আমাকেও করে গ্রাস।
মানুষ উন্মত্ত হলে চক্রান্তে ঘৃণায় দ্বেষে ক্রোধে কারা যেন
আমার শরীর জুড়ে সজোরে ঠুকতে শুরু করে
দজ্জাল পেরেক রাশি রাশি, অন্ধ, কী-ভীষণ কালো!
উঠোনে শিশুর খেলা দেখে দুন্ধুভি বাজাতে পারি
আনন্দের, দূর্দশার ডাকিনীরা চৌকাঠ আগলে
বসে থাকলেও
প্রবল আঁকতে পারি পথরেখা প্রেমের তারায়।
লুণ্ঠিত শস্যের ঝাঁ-ঝাঁ শূন্যতায় দাঁড়িয়ে আবার
নিতে পারি প্রাণ ভরে সুদূর শস্যের ঘ্রাণ কিছু।
মহাপ্লাবনের সেই পুণ্যাতমার পায়রার মতো
একটি সবুজ শীষ এখনো আনতে পারি কিংবা জীবনের
দারুণ খরায় শ্রমে, প্রেমে হতে পারি সন্তাড়িত ভগীরথ।
ঝুলন্ত প্রাচীরপত্রে চোখ রেখে সারাক্ষণ তবু কি ঘুরতে
হবে টো-টো ধূ-ধু বনহংসদের পেছনে পেছনে শুধু ‘কর্ম চাই’ বলে?
আমি হই বর্তমান
আমি হই বর্তমান, আমি হই আদিকাল। যদিও পরি না
বাঘছাল,তুকতাক ফুঁকিনা মন্তর, চাঁপা রঙ
হাওয়াই শার্টের অন্তরালে হৃদয় একান্ত ঝাঁ-ঝাঁ,
দৃষ্টি চাননিমার পর। তোমরা গকুলে আছো আর
আমিতো জলহস্তীর পাকে পড়ে অপটু সাঁতারে
গংগিমার কাছে যেতে চাই। মগজের কোষে কোষে
আউলা ঝাউলা স্মৃতি, মাঝে-মাঝে, রৌদ্রে রৌদ্রে ঝলসিত,
মাথার ওপরে
ওড়ে গিরোবাজ। ভাবি, এ বেলা গহীন গাঙে সূর্যাস্তের আগে
স্বপ্নের মন্থনে কোনো চাচ্রা জেগে উঠলে বলবো,
“নটী তুই পারলিনে কিছুতেই গিলতে আমাকে।“
পৌঁছে যাবো ঠিক
কিছু মুক্তো-ঝলমল শরীরে গকুলে।
গাভীন গাইয়ের
উদরের মতো মেঘ হেলে দুলে যাবে, চিকচিকে
ঘাশুয়া মাটিতে আমি মাথা রেখে অতিল ঘুমাবো।
আছে কি স্বপ্নের ঋতু এখনো কোথাও? আজ বড়ো
প্রয়োজন স্বচ্ছতম স্বপ্নকে আমার। জুগ জুগ্ পায়রার
বুকের কোমল তাপে লুকিয়ে রয়েছে নাকি, নাকি
কারো আঁচলের খুটে এক মুঠো জুঁই হয়ে স্তব্ধ, ম্লান রয়েছে ঘুমিয়ে?
ইচ্ছে হয় এস-ও-এস সর্বত্র পাঠাই।
তোমরা জানো না কেউ, স্বপ্নের মাটিতে নামলাম
খালি পায়ে, চাঁদশাদা প্রান্তরের আনাচে কানাচে
গোলাপী শিখার মধ্যে নেচে নেচে চাইলশ্যা হলো
বালকের চোখ,
গিচসু উঠলো ভরে রঙিন মার্বেলে।
আমাকে দেখেই ঊর্ধ্ববাহু গাছগুলি
সবুজ চীৎকারে আন্দোলিত ঘন ঘন,
দিগন্তের চিবুকের নিচে চাঁদ ডোবে
অন্ধকারে-মনে হলো, জহুরীর নিপুণ আঙুল
কালো মখমল-বাক্সে বন্ধ করে রাখে মুক্তোটিকে।
কখনো নিঃশব্দে হাঁটি অতিকায় গোলাপের গাঢ় বারান্দায়,
কখনো-বা ভাসি
সবচেয়ে প্রবীণ মসজিদের গম্বুজের অনেক ওপরে,
সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার
ছাদের ওপরে, ফ্যাক্টরীর চিম্নি ঘেঁষে।
দূরে
ফোঁটা
ফোঁটা
আলো
যেন
অশ্রু-
মালা আনন্দের।
ব্যাকুল গাছের
ডালপালা ক্ষিপ্র ডানা ঝাপটায় গোধূলিপ্রবণ
মগজে আমার, চেতনায় অগণন সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আসা-যাওয়া,
আমি হই বর্তমান, হই আদিকাল।
কানপট্রি ঘেঁষে গেল; কতিপয় সুনীল কংকাল
হঠাৎ পেরুলো দেখি সুদূরের সাঁকো।
বহুদিন থেকে
মৃত্যু পেয়ে বসেছে আমাকে।
পাওয়াটা বিচিত্র নয়, জীবনের প্রতিটি বছর কম্শম্
মৃত্যুর তুহিন গন্ধে ভরপুর। তাইতো মাংসের অন্তরালে
ব্যক্তিগত হাড় সব কখনো সবুজ হয়, কখনো-বা নীল।
ফ্যালফ্যাল দেখি চেয়ে, মৃত্যুর পাথুরে ধলা স্তন
পান করে করে
কী এক সৌন্দর্য বাড়ে ক্রমাগত নানা বিন্যাসে লোকায়তিক।
‘স্বপ্নের বাজারদর কমেছে সম্প্রতি’-বলে গেল
নব্য খিরকা-পরা বংশধর। খড়িদোর খুলে দেখি
কেউ নেই। পণ্যময় দোকানের পাট খোলা, কোথাও গাহাক্
নেই কোন; অন্যমনে খাউয়া বাউয়া পথে হাঁটি
গোপাট ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে, বুঝি কানাঅলায় পেয়েছে।
মন তুমি কৃষিকাজ জানো না বলেই
করুণ কাহাতে বিদ্ধ কাট্টি মারি উজাড় বস্তিতে, তারপর
খিস্তির মস্তিতে মাতি, কামানি ঘুরিয়ে নিতে চাই
অস্তিত্বের; ডাঁই ডাঁই জমে ওঠে রঙিন গহন ক্যালেন্ডার
সত্তার বেকুব ভিতে। বিবেক ফতুর করে ভাবি যদি আনকোরা শিশু
নতুন বিবেক নিয়ে এসে যায় আমাদের পুরোনো দঙ্গলে…
এমন মানব জমি রইলো পতিত,
অনাবাদে ফলে নাকো সোনা।
হয়তো কোথাও
চাংবাশ মৃন্ময় হলে চাত্রি জ্বলে, মাটির চাপ্পান
পায়ে পায়ে চূর্ণীকৃত; দ্যাখো আমি হই বর্তমান, হই আদিকাল।
এ শহর ঢাকাতেই
মধ্যে মধ্যে ডাক শুনি, দয়াবান তরুণ রোদ্দুর,
বহু বৃষ্টি, বহু দীর্ঘ পথ-পেরুনো গভীর ডাক।
ইচ্ছে হয় এ শহর ছেড়ে চলে যাই,
থাক এই চেনা গলিপথ,
প্রবীণ বসতবাড়ি থাক
অনেক পিছনে পড়ে।
তেতো হয়ে আসা
শস্তা চুরুটটা মুখে চেপে যাই চলে
শব্দের তাড়না থেকে দূরে।
গাঢ় সেই ঢাক শুনে স্বপ্নের গভীর
স্তব্ধতার মতো কোনো নৈঃশব্দ্যের দিকে
যাত্রা করে এ শহুরে রেখাবলী ভুলে যাই যদি,
বলোতো কেমন হয়? কারো কিছু এসে যায় তাতে?
শহরের শেষ প্রান্তে ফ্যাক্টরির চোঙ, ঝিল্লিস্বর,
সমস্ত পিছনে ফেলে পা বাড়ালে দূরে
বুদ্ধের কাঠের মূর্তি, ফ্রেমে-আটা ছবি,
ধবধবে বারান্দাটা, সন্ধ্যা-ছোঁওয়া, চুপ
নানান ফুলের টব, অন্তরঙ্গ টেবিল এবং গ্রন্থমালা
সঙ্গে যায়। আমার শার্টের ভাঁজে ভাঁজে,
কাদা-মাখা জুতোর ওপরে স্মৃতিগুলি সুদিনের
নক্ষত্রের মতো দিব্যি জ্বলজ্বল করে।
এ শহর মাতৃগর্ভ যেন,
আঁধারের রহস্যময় প্রাচীন তারার স্বপ্নে দয়ালু উজ্জ্বল,
নৈকট্যের স্মৃতিতেই উষ্ণ চিরকাল। বুঝি তাই ফিরে আসি
বারবার তেতো-হয়ে আসা চুরুটটা মুখে চেপে।
দীর্ঘ পথ ঘুরে ঘুরে পদযুগলের হাড় ক্রমশঃ নিঃসাড়
হয়ে এলে নিজেকে কেবলি এ শহর ঢাকাতেই
রাত্রির পার্কের
পাথুরে বেঞ্চের মতো ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হয়।
তখন আমার গ্রীবা
শহরের সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার মতো হয়ে যায় আর
চোখ দুটো হাঁস-ভাসা লেক, ক্লান্ত মুখ
জনতা-মথিত এভেনিউ।
একটা চাদর
দেখছি ক’দিন ধরে গৃহিণীর হাতে তৈরি হচ্ছে অনুপম
একটা চাদর।
সততা এবং অনলস যে অধ্যবসায়
শিল্পীকে সফল করে তারই যুগ্মতায়
সে একটা চাদর সেলাই
করলো ক’দিন ধরে। একদিন উদার মাঠে যে-কনক ফসলের নাচ,
চাঁদের বক্রতা ঘেষা বনের যে-শ্যামলিমা আর
সর্ষে ক্ষেতে চঞ্চলা মেয়ের মতো ছোট্র পজাপতির যে-রঙ,
স্বপ্নে দেখা অলৌকিক ফুলের পাপড়ির
যে-নরম-সব কিছু নির্মল তরঙ্গ হয়ে অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল
সমগ্র সত্তায় তার-সেইসব আশ্চর্য বর্ণালী নিয়ে একটা চাদর
ছুঁয়েছে শিল্পের সীমা, দেখলাম, মুগ্ধতায় গাঢ়
রাত্তিরে তন্ময় হয়ে চাদরকে যে দিচ্ছে শিল্পের মুক্তি
আর যেটা ক্রমশ শিল্পিত হচ্ছে, উভয়ে কেমন
নিবিড় একাত্ম, যেন মঞ্চের আলোর নৃত্য আর
নর্তকীর মধ্যে কোন থাকে না তফাৎ। দেখলাম,
সে আর চাদর, উভয়কে সযত্নে বুনছে কেউ সূক্ষ্ম তাঁতে।
চাদরটা উল্টে পাল্টে দেখলো সে, দেখলো নিজের
কারুকাজ, তারপর ঘুমন্ত মেয়ের চার বছরের সেই
একরত্তি শরীরে ছড়িয়ে মৃদু হেসে দাঁড়ালো শয্যার একপাশে।
দেখলাম, সুন্দর চাদর নয়, একটি মায়ের
স্নেহ-জ্যোৎস্না শরতের নিষ্কলুষ দিনের মতোই
নিবিড় জড়িয়ে গেল সন্তানের নিমগ্ন সত্তায়, চুমো হয়ে
চাদরটা রইলো ছুঁয়ে আমাদের সন্তানের সমস্ত শরীর।
সে জানে অশেষ অনুরাগে বোনা এই আবরণ
কন্যাকে করবে রক্ষা অপদেবতার ছায়া থেকে,
দৈত্যের নিশ্বাস থেকে আর সেই চাদর একটা
প্রাচীরের মতো
থাকবে দাঁড়িয়ে শুভ আর অশুভের
মধ্যে প্রতিক্ষণ। দেখি প্রগাঢ় শান্তিতে
ঘুমোচ্ছে মেয়েটা,
তোমরা ঘুমোতে দাও তাকে-
একটি প্রস্থান, তার অনুষঙ্গ
বিশ্বের নানান দৃশ্যে চোখ রেখে, খণ্ড খণ্ড ঘটনাকে নাগর দোলার
লাল নীল ঘোড়া ভেবে কিছুদিন আমার নিজস্ব জগতের
আনাচে কানাচে তুমি উড়িয়ে আঁচল
অকস্মাৎ একদিন হলে অন্তর্হিতা আর আমি
রইলাম পড়ে শূন্য নিশীথের বিজন পার্কের মতো নিঃস্ব।
আমার বিদ্বেষ, ঘৃণা, অভিমান, গনগনে ক্রোধে, এমনকি ভালোবাসা
কিছুই পারে নি ধরে রাখতে তোমাকে।
আমার গণ্ডিতে কোনো লতাপাতা ছিল না কোথাও-বুঝি তাই
গুল্মের ক্রন্দন পথ করেনিকো রোধ।
ছিল না হরিণ তাই আঁচল করে নি আকর্ষণ কেউ, শুধু
দরজা জানালাগুলি হাহাকার হলো আর আসবাবপত্রের বার্ণিশ
কেমন নিষ্প্রভ মনে হয়েছিল তোমার প্রস্থানে।
যেন আমি চোরাবালি, সেখানে পা দিলে
ভীষণ তলিয়ে যাবে ভেবে তুমি
স্থির ভূভাগের দিকে প্রাণপণে পালালে সুদূরে।
যেন আমি মহামারী-বিধ্বস্ত শহর-
হাওয়াকে নিশ্বাসযোগ্য করবার ছলে
পালালে অনেক দূরে, একবারও প্রেতায়িত শহরের দিকে
তাকালে না ফিরে, আমি রইলাম পড়ে। চৌরাস্তায়
অসংখ্য শিশুর মতো কোলাহল করে
আলোমালা উঠলো না দুলে, আমার সত্তাকে ঘিরে
বাজলো না জ্যোৎস্নারাতে সুনীল গিটার।
যেন আমি বদ্ধ কালা, কোনোদিন শুনি নি বেহালা
কিংবা অর্গানের সুর। দেখলাম ডালির ঘড়ির বিগলিত
প্রবাহ গড়িয়ে যায় আমার সতৃষ্ণ অস্তিত্বের নগ্নতায়।
শৌখিন চায়ের সেট নও তুমি, কৌচ নও, নও ফুলদানি,
ছবি নও ফ্রেমে আঁটা, আলমারি-কবলিত কাঠের নর্তকী নও কোনো-
প্রত্যহ বাসায় ফিরে দেখবো রয়েছে সবকিছু যথাস্থানে!
এখনো তোমাকে চাই যেমন ব্যাকুল স্বরে দুর্ভিক্ষের দেশে
আর্ত জনসাধারণ চায় শুধু শস্যের সম্ভার।
কী যেন পাখির মতো গেল উড়ে মাথার ওপর-
আমি ওকে ছেলেবেলা ভেবে অন্তরঙ্গ স্বরে কাছে
ডাকলাম হাত নেড়ে; অজস্র টিয়ের কলরবে
হারালো আমার কণ্ঠস্বর।
সেও তো দিলো না ধরা আমার একান্ত প্রিয় স্মরণ বিলাসে।
আমি বুড়ো ক্লাউনের মতো পরিত্যক্ত, এবং তুষারে ঢাকা।
নিষ্পত্র গাছের মতো গীতার্ত, নিঃসঙ্গ-শুয়ে আছি
শূন্যতায় কোনোমতে ঠেকিয়ে চিবুক অতীতের স্তূপে আর
কেবলি পড়ছে মনে, কিছুতেই তোমাকে আমার করে রাখতে পারি নি।
কিশোররূপে একজন কবির প্রতিকৃতি
ভোরবেলায় পায়ে পায়ে পান্না-ছড়ানো শিউলিতলার কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
ভোর-ছোঁওয়া সেই শিউলিতলায় হঠাৎ একটা সাপ দেখে তুমি চম্কে
উঠেছিলে, দাঁড়িয়েছিলে অনেকক্ষণ। তোমাকে বিপন্ন জেনেও
ফিরে গেল সে তার গর্তে, যেমন কোনো সুন্দরীর
আঙুল অনায়াসে প্রবেশ করে দস্তানায়। ভোরবেলায়
শিউলিতলায় সাপের সম্মোহনে দাঁড়িয়ে-থাকা কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
ঝাঁক ঝাঁক পাখির পাখা ঝলসানির মতো হাসি
ভালোবাসতে তুমি। রঙ-বেরঙের পাখি ভালোবাসতে শিখেছিলে
অনেক আগেই। দেখেছি কতদিন ওদের নানা নাম ধরে
ডেকে ডেকে হারিয়ে গেছ ডাগর জ্যোৎস্নায়।
পাখির ঝাঁকের পেছনে ছুটতে ছুটতে ডাগর জ্যোৎস্নায়
হারিয়ে-যাওয়া কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
গলির মোড়ে হুমড়ি-খাওয়া ঘোড়াটাকে দেখে তোমার বুক
কেঁপে উঠেছিল। তুমি দেখলে, ঘোড়ার পায়ে একটা ক্ষত
ধ্বক্ করে জ্বলে উঠলো বালবের মতো আর সেই মুহূর্তে
ঘোড়ার চোখে অন্য কিছু নয়, শুধু গোধূলি, শুধু অস্তরাগ!
গলির মোড়ে মুমূর্ষ ঘোড়ার শোকে বিহ্বল কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
দ্রুত পথ হাঁটতে গিয়ে কতদিন একটা টক টক গন্ধে উন্মন হয়ে
দেখেছ পথের পাশে হতচ্ছাড়া কোনো দোকানে
তন্দুরের ভেতর বিস্কৃটগুলো একরাশ তারার মতো
জ্বল জ্বল করছে। পথের পাশে বিস্কৃটের টক টক গন্ধে উন্ম কিশোর
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
ঘোর বর্ষায় হাতলে ঝুলতে প্রকাণ্ড প্রত্যাশায়
পাড়ি জমিয়েছিলে কোনো শ্যামল পাড়ায়। মধ্যে-মধ্যে
বনোয়ারী দিনে রাধার হাসির মতো বিদ্যুৎ উঠতো ঝল্সে। বেওয়ারিশ
ভাবনার মালিকানা কারুর একার নয়’ বলে যে লোকটা
বেঠিক স্টপেজে পৌঁছে টলতে টলতে সংক্ষিপ্ত গলির মোড়ে
বাকাট্রা ঘুড়ির মতো লাপাত্তা, তার দিকে দৃষ্টি মেলে-
ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই, ভরা বাসে সামলে থাকুন, নয়তো
পা হড়কে যাবেন পড়ে বলে যে কন্ডাক্টর আউড়ে গেল
কিছু অলৌকিক নাম-তার দিকে চেয়ে তুমি স্বপ্নের স্বত্বের কথা
ভাবছিলে। বাসের হাতলে ঝুলতে ঝুলতে স্বপ্নের স্বত্ব বিষয়ক চিন্তায়
মগ্ন কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
একজন তন্বী বেদেনী বহ্নির মতো কিছু তীব্রতা ছড়িয়ে চলে গেল
চাঁদের তোরণ পেরিয়ে আর তার প্রস্থান
তোমার শিরায় অজস্র জরির চিতাগ্নি জ্বেলে দিয়েছিল, তুমি
একা দাঁড়িয়ে পুড়ে যাচ্ছিলে। সেই প্রাক্তন চিন্তাগ্নিতে
প্রজ্জ্বলন্ত লালচে গালের কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
কেন্নো, কেঁচো নই
কেন্নো কেঁচো নই, গর্ত খুড়ে খুড়ে
মৃত্তিকার নিচে করবো বসবাস।
নই যে পাখি কোনো মেঘের আবডালে।
লুকোবা উড্ডীন ডানার ব্যাকুলতা,
বাদুড় নই শুধু চাইবো কালো রাত।
কাঁকড়া নই যাবো অতল পাতালেই;
মানুষ আমি মেদ মজ্জা মাংসের,
তাইতো তোমাকেই এখনো পাশে চাই।
কোনো সাইকেলচারীর উপাখ্যান
আমার জীবন ভাবো একবার। বস্তুত উড়নচণ্ডী আমি
চিরকেলে, সাইকেলে ঘুরে ঘুরে দিন যায়। অলিতে-গলিতে,
সদর রাস্তায় কিংবা মাংসের বাজার ঘেঁষে বিপণি তল্লাটে
চমৎকার তামাকের, সবুজ ঘ্রাণ শুঁকে দিন যায়।
কখনো রৌদ্রের নিরালায়,
কখনো-বা বৃষ্টি-ভেজা চুপসোনো, ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় ছুটে চলি
বাজিয়ে মধুর ঘণ্টা চারদিকে। কতো কাঁটাবন,
বহুবর্ণ কতো গুল্মচ্ছাদিত পথের ধারে সাইকেলটাকে
মাঝে-মাঝে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিই আপিলা চাপিলা শৈশবের
প্রচণ্ড আহ্বানে।
ক্রিং ক্রিং ধ্বনি শুনে এইতো আমার পকেটস্থ শহরের
হাজার জানালা দেখি ম্যাজিশিয়ানের
রঙিন তাসের মতো ওঠে দুলে। সাইকেল চালাতে চালাতে
দ্বিপ্রহরে কানে আসে বিপন্ন চীৎকার রাস্তা ছেড়ে,
দু’দশটা বাড়ি ছুঁয়ে মেঘে গেল দূরে
মেঘে গেল আর্তস্বর। ধাঁ করে উধাও ট্রাক, বালকের কোমল শরীর
ছিন্নভিন্ন গুল্মলতা, কাকের কর্কশ ডাক থ্যাৎলানো মাংসের
দলাকে করলো বিদ্ধ, আমাকেও। মনে হলো, অবসিত বালককে আমি সাইকেলে
বসিয়ে চলেছি
নিরাপদে পৌঁছে দিতে, এবং শরীর তার রূপালি ঝালর।
এইতো একটু আগে সেখানে এলাম দেখে ঝাঁঝালো দুপুরে
গোরস্থানে ক্রশের ওপর
খুঁটছিল ডানা চিল, যেমন তরুণ
পণ্ডিত খোঁটেন গ্রন্থ নিম আর্টিস্টের
মতো আত্মভোলা। প্যাডেল চঞ্চল পদযুগ, মাঝে-মাঝে দেখি
হুতুম প্যাঁচারা সব সহজিয়া কোটরে নিশ্চুপ
বসে থাকে, আলালের ঘরের দুলাল
মসৃণ মোটরে চেপে প্রগতির মান রাখে আর নব্য ডন যুয়ানেরা
প্রেমের চেয়েও বড়ো পরমার্থ খোঁজে
নানান পাড়ায়; বেশভূষা নাক্ষত্রিক, চলনে বলনে স্মার্ট আগাগোড়া।
আমার জীবন ভাবো একবার। সর্বদা পরণে
পুরোনো কাপড় জামা, গড়াগড়ি দিই সুখে স্বপ্নের বনেদী গালিচায়।
ধূসর পিতার স্মৃতি চোয়ালে, গলায় কিংবা পাকস্থলীতেই
রেখেছি গচ্ছিত আর পাতালে দেখেছি আসবাবপত্র সব
ব্যালে নর্তকীর মতো ভাসমান এবং একটি নারী বাণীহীন তীক্ষ্ম অহংকারে
জলমগ্ন নিয়ে খেলা করে-যেন তার কোনো স্মৃতি নেই
অথবা আগামীকাল নেই।
নিজেকে বুঝিনা ঠিক, তাই
কখনো শহীদ ভাবি জীবনের, কখনো কেবলি সাইকেলচারী এক,
কখনো-বা হাতুড়ে স্বাপ্নিক।
মাথার ভেতরে আজগুবি গোলাপের পাপড়ি পড়ে আছে কতো,
পড়ে আছে অনভ্যস্ত ভঙ্গিমায়, হৃদয়ে দাঁতের মতো চাঁদ
ভীষণ আমূল বিদ্ধ। জ্যোৎস্না রাতে হঠাৎ বাতাসে কালো চেন
উন্মোচিত, সাইকেল ভেসে যায়, গোরস্থান, কাগজের স্টল,
মেয়ে-পুরুষের আর ভুলচুক, করুণা, পাপের পরপারে
মেঘে-মেঘে, নক্ষত্রের বাগানে কেবলি ভেসে যায় দীপ্ত কী এক বোধিতে।
ক্ষয়কাশ
কে যেন উঠলো কেশে কলোনির ফ্ল্যাটে খক্খকিয়ে,
যে মোটর কিছুতে নেয়না স্টার্ট ঠিক তারই মতো
শব্দ করে ঠাণ্ডা রাতে কাশছে লোকটা অবিরত।
গলিপথে অন্য কেউ কেশে ওঠে, প্রাণক্ষয়ী কাশ-
পাশের দালানে কেউ, কেউ বা মাটির ভাঙা ঘরে
বস্তিতে বাজারে আর অভিজাত পাড়ার অন্দরে,
ভয়াবহ শব্দে সেই ছেয়ে গেল সমস্ত আকাশ।
ন্যুনতম নব্বুই হাজার বাসগৃহে নিদ্রাহর
শব্দের ধমকে নড়ে সংখ্যাহীন বুকের পাঁজর
এবং আমার বুক পূর্ব বাংলার মতোই হু হু, তীব্রতর
কাশির দমকে বড্ড দুমড়ে যাই, কুঞ্চিত চাদর
গোধূলি-তরল রক্তে বারংবার ওঠে ঝক্ঝকিয়ে।
কয়েকটি স্বর
“দ্যাখো হে খুলিটা দ্যাখো ভালো করে কেমন সাত্ত্বিক
শূন্যতায় স্থির থাকে, চার ঘণ্টা সাতাশ মিনিটে
সযত্নে তুলেছো খুঁড়ে যাকে”-বলে সে প্রত্নতাত্তিক
তৃতীয় চুরুট জ্বেলে প্রান্তরের বিশুষ্ক গ্রানিটে
রাখেন অভিজ্ঞ হাত। মহাব্যস্ত মেঘের ট্রাফিক
আকাশের মোড়ে মোড়ে, পলায়নপর চুলে হাওয়া
হানা দেয় অবিরত। হঠাৎ মড়ার খুলি ফিক
করে উঠলো কি হেসে? ভৌতিক স্তব্ধতা ছাওয়া
প্রান্তরে অতীত ওঠে জেগে অলৌকিক কোলাহলে?
আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ বর্জইস অক্ষরের মতো
ভিড় করে, রাত্রি বাড়ে, মরা জ্যোৎস্নায় চুরুট জ্বলে।
এসো যাই, তাঁবুর ভিতরে যাই এবং বিগত
শতাব্দীর শোকসভা করে তার নিপুণ বর্ণনা
লিখে রাখি কল্পনা মিশিয়ে কিছু প্রাচীন তুলটে।
ইতিহাস অধিক বাচাল হলে নিত্য আবর্জনা
জড়ো হয় পৃথিবীতে, প্রত্যহ অনেক ফুল ওঠে,
ভীষণ বিষিয়ে ওঠে সময়ের তলপেটে। হায়,
জ্ঞানপাপী অবেলায় আত্মা নিয়ে লোফালুফি খেলে,
অগোচরে জীবনের শুকনো বাতিল বাতাসে ওড়ায়।
প্রত্নতত্ত্বে প্রীত বলে আমিও কি ভীষণ সেকেলে?
“সময়ের চতুরালি জেনেছি আমিও, তবু নিজে
দিয়েছি বাড়িয়ে গলা কুহকের ফাঁদে। চিরকাল
ক্রমাগত ঘুরবো কি অতীতের মায়াবী ট্রাপিজে?
যতদিন যায় তত শূন্যতায় কাটে শুধু কাল।
“দুরূহ পুস্তক পাঠে আনন্দ পেয়েছি, আরো পাবো-
বেহালার ছড় টেনে, ছাই ঝেড়ে ঝেড়ে শুতে যাবো”।
(কোরাস)
বিষাদের গাথা করে অবিরাম
চেতনাকে মন্থন।
অন্ধকারের রিক্ত থাবায়
কাঁপছে চিরন্তন।
কাকতাড়ুয়ার মূর্তি হঠাৎ
ত্রাস করে সঞ্চার।
করোটি মালার শংকা গ্রথিত
নরক সে কোন্ ছার?
অসার রিক্ত, মৃত্যু সদাই
জীবনের বল্লভ।
ঘৃণার আগুনে পুড়েও পোড়ে না
জলপাই পল্লব।
(করোটির স্বগতোক্তি)
আমিও ছিলাম এই পৃথিবীতে, আনুগত্যে প্রিয়
নাচের মুদ্রার মতো ফুটিয়েছিলাম জীবনকে
কতদিন। সৌন্দর্য নশ্বর নয় ভেবে মহিলাকে
করেছি উৎসর্গ প্রেম, নিজেকে ছুঁড়েছি নীলিমায়,
অধীর তৃষ্ণায় পান করেছি সত্তার সারাৎসার।
জনতা-জটিল সেই নগরের মোড়ে দেখি চেয়ে
আমার প্রিয়া মাথা কেটে ফেলে কৃষ্ণ হন্তারক
কুঠারের ক্ষিপ্র ঘায়ে। রক্তে পিতৃপুরুষের ক্রোধ
ফুঁসে ওঠে অকস্মাৎ, কিন্তু তবু স্তম্ভের মতোই
নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকি, অসহায়। এবং তখন
অন্ধকারে ঈশ্বরকে খুঁজি একা দীর্ণ প্রার্থনায়।
যৌবনের উজ্জ্বল চীৎকারে মেতে উঠে রাজহাঁস
বুকে চেপে পৃথিবীর রূপ থেকে একদণ্ড, হায়,
ফেরাতে পারি নি চোখ। পৃথিবীকে ভালোবেসে তবু
আমাকেও যেতে হলো অবশেষে মৃতদের দেশে।
তোমরা তুলবে খুঁড়ে হয়তো মড়ার খুলি আরো,
তাম্রলিপি, মাটির প্রাচীন পাত্র, হাতির দাঁতের
চিরুনি অথবা কোনো নগ্ন দেবতার ভাঙা মূর্তি;
হয়তো তুলবে খুঁড়ে অতীতের খণ্ড খণ্ড শব।
যে যন্ত্রনা জীবনকে দিয়েছিল কর্কশ লবণ
ঘটনার ঘোলাজলে, আমি তার স্বাদে দ্বিধান্বিত
সত্তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেছি বিলুপ্তির দিকে।
আমার উদ্ধার লুপ্ত চিরতরে, শুধু শূন্যতায়
শুদ্ধাচারী স্মৃতি কাঁপে। স্মরণীয় যুগের মহিমা
জেনেও নিশ্চিত আমি চিরকাল স্বরহীন রবো।
(কোরাস)
সুন্দর তারা ছিল বুঝি কোনোদিন,
আজ কুৎসিত কাকতাড়ুয়ার ছবি।
হায়, মালী তোর বাগানের সব ফুল
বিবর্ণ হবে, নষ্ট হবে যে সবি।
অনেক যুগের স্মৃতির জটিল সিঁড়ি
গান গেয়ে ওঠে আলো-আঁধারির সুরে,
ধ্বংসের কীট বস্তুপুঞ্জে বসে
স্বপ্নের ফল খায় শুধু কুরে কুরে।
পিতৃপুরুষ স্বপ্নের নীলমণি
রেখেছিলেন যে সমাহিত সিন্দুকে,
বৈভব তার কিছুটা দিয়েছে মুছে
বিশ্বের যতো বাছা-বাছা নিন্দুকে!
গ্রীষ্মে তার নিজের কথা
ক’দিন থেকে শহর বদরাগী
ড্রাগন যেন, দুপুর হলে চড়া
হাওয়ায় ছোঁড়ে হল্কা আগুনের।
সত্তাময় দারুণ ধু-ধু খরা।
পাখার ব্লেড ঘুরছে অবিরত,
মধ্যদিনে গায় না গান পাখি?
নেইকো ক্ষতি, রোডিয়োগ্রাম খোলা-
ডিভানে শুয়ে ফিল্মী সুর চাখি।
এ গরমের তাল পাকানো রীতি,
দুপুর বেলা বাইরে যাওয়া দায়।
রাস্তাগুলো তপ্ত তাওয়া যেন,
শহর রোদে হাঁপায় অসহায়।
ভাগ্যে ছিল তেজারতির টাকা
পুণ্যবান পিতৃপুরুষের।
খাচ্ছি তাই অনেক ছলেবলে
আদর আজো সুখের বুরুশের!
বেকার নেই, আমারও আছে কাজ,
কালো বাজারে তাল বেতাল আমি।
চাঁইয়ের সাথে নিত্য ওঠা বসা,
ভাগ্য তাই আমার অনুগামী।
এমন দিনে হেঁসেলে বসে তুমি
ছ্যাঁচড়া রাঁধো, কাপড় কাচো ক্ষারে।
স্বপ্ন কিছু গিয়েছে মারা মাঠে,
যৌবন তো পালায় চুপিসারে।
মেঘলা মুখ? বলোতো আজ কেবা
তোমার মান করবে ভঞ্জন?
ঠাণ্ডা ঘরে নীহার বাবু আজো
আমার মন করেন রঞ্জন।
অনেক উঁচু তলায় আমি থাকি,
শুনিনা তাই বামন দিলে হাঁক।
কী করে আজ পশবে কানে বলো
তোমার সেই কান্না-ভেজা ডাক?
টানাপোড়েন
মনে কি পড়ে নিঝুম কুয়োতলা,
গাছগাছালি, রাস্তা জমকালো,
মস্ত মাঠ, দেয়াল, ঘর-বাড়ি,
বকুলতলা শ্লোগানে চমকালো?
সে কবে থেকে বেকার কারিগর;
গ্রাম্যজন শহরে রাখে চোখ।
ভিক্ষা থেকে পালাতে চেয়ে ওরা
ভাগ্যদোষে মড়কে পায় শোক।
সারাটা দিন চাকুরে কেউ কেউ
তুই তোকারি করেন ঘরে বসে,
কালচারের সোনালি গালিচার
সূক্ষ্ম রোঁয়া তোলেন ঘষে ঘসে।
মফস্বলী মোড়ল চায়না তো
মেলুক দল বিশ্ব ঘরে ঘরে।
সমুদ্রের ধারে না কোনো ধার,
মজা নৌকো ভেড়ায় ধু-ধু চরে।
দেখছি তুমি মেঘনা খোঁপা বাঁধো,
গাইছো বসে কতকালের গান।
চিরুনি কোলে স্বপ্নাহত বুঝি-
আকাশে ভাসে চাঁদের শাম্পান।
দাঁড়াও যবে সরু বারান্দায়,
বাহু তোমার দিনকে করে মাৎ।
যুগল টিলা অস্তরাগে লাল,
হঠাৎ চোখে জানায় দাবি রাত।
তোমার ছবি রাত্রি রাখে বুকে,
স্বপ্ন-ঘোড়া মগজ জুড়ে ছোটে।
তোমার ছবি নদীতে মাঠে মেশে,
ফুল্ল চোখ নীল পদ্মে ফোটে।
অন্ধকারে হয়তো ভয় লাগে,
ঝিঁঝির সুর লেপ্টে থাকে মুখে।
দোরগোড়াতে ছায়ার ওঁৎ পাতা,
মূক দেয়াল কপাল দিলো ঠুকে।
রোজ সকালে জাগে শহরতলী,
বাতাসে কাঁপে কচি পিয়াল পাতা।
চোরা গলিতে হাঁটছে একা লোক,
স্বপ্ন তার আগামীকালে গাঁথা।
নব্য যুবা নিত্য বলে শুনি
বোধি দীপ্ত জীবন-ঘন ভাষা।
অবাক হয়ে ভাবেন পিতামহ
পুরোনো ঘরে এ কার যাওয়া-আসা?
মনে কি পড়ে নিঝুম কুয়োতলা,
গাছগাছালি রাস্তা জমকালো,
মস্ত মাঠ, দেয়াল, ঘর বাড়ি,
বকুলতলা শ্লোগানে চমকালো?
টেলেমেকাস
তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়
কখনো তোমার মুখ হবে না নাকি উদ্ভাসিত, পিতা,
পুনর্বার? কেন আজো শুনি নি তোমার পদধ্বনি?
এদিকে প্রাকারে জমে শ্যাওলার মেঘ, আগাছার
দৌরাত্ম্য বাগানে বাড়ে প্রতিদিন। সওয়ারবিহীন
ঘোড়াগুলো আস্তাবলে ভীষণ ঝিমোয়, কুকুরটা
অলিন্দে বেড়ায় শুঁকে কতো কী-যে, বলে না কিছুই।
নয়কো নগণ্য দ্বীপ সুজলা সুফলা শস্যশ্যাম
ইথাকার আমার ধনধান্যে পুষ্পেভরা। পিতা, তুমি
যেদিন স্বদেশ ছেড়ে হলে পরবাসী, ভ্রাম্যমাণ,
সেদিন থেকেই জানি ইথাকা নিষ্পত্র, যেন এক
বিবর্ণ গোলাপ। আমি একা কৈশোরের জ্বলজ্বলে
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কোন্ কাক-তাড়ুয়ার মূর্তি দেখে
ভুলে গেছি হাসি। ‘কেন আপনার ঠোঁটের দিগন্তে
হাসির হরিণ-শিশু পালিয়ে বেড়ায় অবিরত?’-
কখনো করেন প্রশ্ন ধীমান প্রবীণ সভাসদ।
বিদেশীরা রাত্রিদিন করে গোল ইথাকায়; কেউ
সযত্নে পরখ করে বর্শার ফলার ধার, শূন্য
মদের রঙিন পাত্র ছুঁড়ে ফেলে কেউ, লাথি ছোঁড়ে,
কেউ বা উত্যক্ত করে পরিচারিকাকে। মাঝে-মাঝে
কেবলি বাড়ায় হাত প্রোষিতভর্তৃকা জননীর
দিকে, যিনি কী-একটা বুনছেন সুচারু কাপড়ে
দিনে, রাতে খুলছেন সীবনীর শিল্পে। কোলে তাঁর
সুতোর বলের সাথে খেলা করে মোহন অতীত।
লুকিয়ে কাঁদেন তিনি ছড়িয়ে জলজ দৃষ্টি ধু-ধু
সমুদ্রের প্রতি, কালো বেড়ালের মতো নিঃসঙ্গতা
তাঁর শয্যা, অস্থিমজ্জা জুড়ে রয় আজো সর্বক্ষণ।
সবুজ শ্যাওলা-ঢাকা পুকুরেও ছুঁড়ে দিলে ঢিল,
সেখানে চকিতে ওঠে ঢেউ আর বাতাসের ডাকে
এমন কি পত্রহীন গাছও দেয় সাড়া, কিন্তু এই
আমার মুখের রেখা সর্বদাই নির্বিকার, তাই
পালিয়ে বেড়াই ভয়ে, পাছে কেউ জনসমাবেশে
পৌরপথে নানাবিধ প্রশ্নের পেরেক ঠুকে ঠুকে
আমাকে রক্তাক্ত করে। জানি, এ বয়সে প্রাণ খুলে
হাসাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ঘরে শক্র নিয়ে মুখে
হাসির গোলাপ-কুঁড়ি ফোটানো কঠিন। নানা জন
রটায় নানান কথা শুনি, তুমি নাকি মৃত, তুমি
সার্সির সবুজ চুলে বাঁধা পড়ে আছো, বলে কেউ।
কূলে একা বসে থাকি, কোথায় ভরসা? ঘুরে ঘুরে
প্রতিদিন ফিরে আসি অলক্ষ্যে বাড়ির সীমানায়;
দাঁড়াই যেখানে সিঁড়ি শব্দ করে জানায় চকিতে
এখন বয়স কতো বাড়িটার আর আমি নিজে
আনাচে কানাচে ঘুরি, নিরালম্ব, বিদেশীর মতো।
মনে হয়, ক্রমাগত সশব্দে আমাকে দিচ্ছে কারা
কবরে নামিয়ে শুধু; পাগুলো মাটিতে লেগে লেগে
কেমন নির্বোধ হয়ে রয়েছে তাকিয়ে, যেন ওরা
পৃথিবীতে বাস্তবিক হাঁটতে শেখেনি কোনোদিন।
তুমি নেই তাই বর্বরের দল করেছে দখল
বাসগৃহ আমাদের। কেউ পদাঘাত করে, কেউ
নিমেষে হটিয়ে দেয় কনুই-এর গুতোয় আবার
‘দুধ খাও গে হে খুকুমণি’ বলে কেউ তালেবর
দাড়িতে বুলোয় হাত। পিপে পিপে মদ শেষ, কতো
ঝলসানো মেষ আর শুয়োর কাবার, প্রতিদিন
ভাঁড়ারে পড়ছে টান। থমথমে আকামের মতো
সমস্ত ইথাকা, গরগরে জনগণ প্রতিষ্ঠিত
অনাচার, অজাচার ইত্যাদির চায় প্রতিকার।
আমিও বাঁচতে চাই, চাই পড়ো-পড়ো বাড়িটাকে
আবার করাতে দাঁড়। বাগানের আগাছা নিড়ানো
তবে কি আমারই কাজ? বুঝি তাই ঋতুতে ঋতুতে
সাহস সঞ্চয় করি এবং জীবন তুরঙ্গের
বর্ণিল লাগাম ধরে থাকি দৃঢ় দশটি আঙুলে।
কখনো এড়িয়ে দৃষ্টি ছুটে যাই অস্ত্রাগারে, ভাবি
লম্পট জোচ্চোর আর ঘাতকের বীভৎস তাণ্ডব
কবে হবে শেষ? সূর্যগ্রহণের প্রহর কাটবে
কবে? জননীর মতো চোখ রাখি সমুদ্রে সর্বদা।
ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে
দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।
এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার
বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ
আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার?
তাঁর ছায়া
(এ কে ফজলুল হককে নিবেদিত)
বিশাল দেয়াল নয়, বৃক্ষ নয়, নয় সে পাহাড়;
একটি কিশোর শুধু, মেরুদণ্ড দধিচীর হাড়
দিয়ে গড়া; বস্তুত গড়নে দিব্যি বড়োসড়ো,
ঘরে মন টেকা দায়, প্রান্তরে হাঁটায় বেশি দড়।
কখনো ভাদুরে রৌদ্রে উঠোনে, দাওয়ায়
বসলে মা অন্নছত্রে ঘরকন্না, সংসারী হাওয়ায়
সানন্দে উঠলে মেতে আর আঁচলের প্রান্তভাগ
কোমরে জড়িয়ে, হাতে গালে নিয়ে হলুদের দাগ
বটিতে কুটলে মাছ, বাটনা বাটলে কোথা থেকে
সে কিশোর ছুটে এসে নিজের ছায়ায় দেয় ঢেকে
আপাদমস্তক মাকে। মা বলেন তাকে, “লক্ষ্মী, বাছা
মিছে পুড়িসনে রোদে।
কিন্তু তাঁর রোদ্দুরেই বাঁচা।
তাই বছরের পর বছর সে-রৌদ্রের হল্কায়
কাটান প্রহর আর খরবেগে যেখানে ছলকায়
জীবনের দুই পাড়, সেখানে দাঁড়ান অবিচল;
হেলে চাষিদের প্রাণে নামে তাঁর মানবিক ঢল।
দারুণ খরায় পোড়া স্বদেশকে নিত্য দেয় ছায়া,
কী বিপুল ছায়া, এই বাংলাদেশজোড়া তাঁরই কায়া।
তারা ক’টি যুবা
তারা ক’টি যুবা হিংস্র যুদ্ধে
ভাবে না কখনো জিৎ কার, হার কার?
দেয়ালে দেয়াল শুধু সেঁটে দেয়
লাল গোলাপের নতুন ইস্তাহার।
গত শতকের সুড়ঙ্গ থেকে
শক্র শিবিরে আনে স্বপ্নের হাড়-
সে-হাড় দেখিয়ে বলে সবাইকে
‘দ্যাখো এর ছিরি, ক্ষয়িত তীক্ষ্ণ ধার!’
অসম্ভবে ছড়া কেটে তারা
নৌকো ভাসায়, হোক না তা’ বানচাল।
দাঁড় নেই তার, মাল্লা মাতাল;
বস্তুত নেই এমন কি ছেঁড়া পাল।
দুঃখ তাদের কাণ্ডারী তবু
মহাযাত্রায় পড়ে না কখনো ছেদ।
প্রবঞ্চনার চোয়ালে ঘুমিয়ে
রাত্রি কাটায়, তাতেও নেইকো’ খেদ।
ফিরে এসে দ্যাখে হাঁটু মুড়ে বসে
বিশ্বাস কাঁদে, উড়ে গেছে ভিত তার।
কারা যেন সব ফেরি করে রোজ
নর কংকাল-দিকে দিকে চীৎকার।
গোঁড়ামি এখানে উলঙ্গ রাজা;
যুক্তি, বিবেক ইত্যাদি ক্রীতদাস।
সময় বন্দি বদ্ধ জলায়,
মুকুট পরেছে দারুণ সর্বনাশ!
তারা কি’টি যুবা স্বভাবদোষেই
গৃহস্থালির মর্ম বোঝে না আর!
যাত্রার গানে ঊর্মিল পেশী,
বেহালা হলো যে নৌকোর সব দাঁড়।
বয়েসী পিতার অনুনয় ছিঁড়ে
দু’হাতে সরায় নারীর অলক দাম।
যা হবার হবে, ঘর থাক পড়ে-
ভোলায় না মন পুত্রের ডাক নাম।
তারা ক’টি যুবা এখানে জাগায়
আত্মার মহা তৃষ্ণার হাহাকার।
মনের দেয়ালে সেঁটে দেয় ফের
লাল গোলাপের নতুন ইস্তাহার।
তিনি
কতদিন তাঁকে খাটো বারান্দায় ম্লান কেদারায়
নিরিবিলি, একা, বসে থাকতে দেখেছি। হাতে বই,
কফির পেয়ালা শূন্য; কখনো পুরোনো দেয়ালের
বেড়ালের ক্ষিপ্র গায়ে রাখতেন চোখ, কখনো বা
দিতেন গড়িয়ে দৃষ্টি বাগানে এবং বড় বেশি
হতেন কাতর দুষ্ট বালকেরা ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে
আহত করলে কোনো নিঃসঙ্গ পাখিকে খেলাচ্ছলে।
বাগানে দাঁড়ালে ফুলগুলি দিতো ধরা তাঁর হাতে
গভীর আস্থায় আর শালিকের মৃদু শব্দাবলি
কী যেন বলতো তাঁকে। কী হবে বসন্ত যদি আর
কখনো ফিরে না আসে পৃথিবীতে? যদি চিরতরে
গান বন্ধ করে দ্যায় ভুল করে পক্ষীকুল তবে
পাবো কি কখনো আর নিরঞ্জন কাল? ইতোমধ্যে
আমাদের পায়ের ক’বিঘা মাটি ভীষণ অস্থির
দু’তিন দশক থেকে, ঘাস তো সবুজ নেই আর…”
-এসব ভাবনা তাঁকে বিহ্বল করেছে কতদিন।
কখনো ফুলের হয়ে কখনো-বা শামুকের হয়ে
বেঁচেছেন। একদিন কী এক দুর্জ্ঞেয় হাহাকারে
দীর্ণ হয়ে বারান্দায় বাগানের প্রসন্নতা ছেড়ে
প্রতিধ্বনিময় মাথা নেড়ে-নেড়ে, দেখলাম, তিনি
স্তব্ধ ক্রাচে ভর করে চলেছেন হেঁটে নীলিমায়!
দু’ এক দশকের
দু’ এক দশকের রুগ্ন সংবাদ রটলো অবিরত চরাচরে।
বর্বরতা আর হত্যা একালের জীবন প্রবাহের সূত্র,
জীবন যাকে বলি সেওতো সম্প্রতি প্রহত চেতনার অভিমান।
যাচ্ছি ভেসে আজ ভীষণ উদ্বেগে মগ্ন কূল থেকে অকূলে।
সে কবে অতিদূর উধাও শতকের অস্তরাগে কেউ বলেছিলেন
প্রতিটি প্লাবনের জলজ হাহাকারে রয়েছে নিজস্ব পায়রা।
অথচ হা কপাল! কারুর হাতে আজ তেমন শুভবাদী পায়রা নেই!
কেবলি বারবার পাতাল ডেকে নেয়, সেখানে জমে হাড়, মড়ার খুলি।
বর্তমানে আমি ফাটল-ধরা এক দেয়াল যেন একা দাঁড়িয়ে আছি-
আমাকে ঘিরে রয় ঝড়ের মাতলামি এবং অভাবিত ভূকম্পন।
কখন ঢলে পড়ি, এইতো ভয় শুধু কালের চত্বরে হাত-পা ছুঁড়ি,
বিপুল সমারোহে জরিপ করে দেখি বিশ্বে চারভাগই শূন্য!
আমরা অবিরাম ঢুকছি গুটিসুটি যে যার কল্পিত বিবরে,
সেখানে ইচ্ছাকে সাজাই বারবার চতুর নানাবিধ বিন্যাসে।
অথচ বাস্তবে ইচ্ছা নয় জানি প্রকৃত পোষমানা পাখির ঝাঁক,
ডাকলে আসবেই, সহজ অভ্যাসে বসবে জানালায় নীরবে!
এখন যদি লিখি শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রখর কতিপয় পংক্তি
তবে কি বিস্মৃত বাগানে পুনরায় ফুটবে রক্তিম ফুলদল?
তবে কি পৃথিবীতে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ঘটবে অচিরাৎ অবসান?
তবে কি সভ্যতা সত্যি যাবে বেঁচে ছন্দ মিল আর প্রতীকে?
আজকে যারা শুধু হুমড়ি খেয়ে পড়ে শস্তা গ্রন্থের এডিশনে,
কখনো তারা ফের সিদ্ধ বাণী চেয়ে পাবে কী সত্যের পরগনা?
এখন সেই পরগনার আশেপাশে নির্বিচারে ঘোরে চতুষ্পদ-
উড়িয়ে ধুলো খুরে শিল্প থেকে ওরা নিয়ত অ-শিল্পে ধাবমান।
স্নুকার বল হয়ে স্বপ্ন জড়ো হয় সবুজ রাস্তায় মাঝে মাঝে;
কিন্তু পুনরায় হারায় তারা আর খেলার শেষে যেন অবসাদে
টেবিলে মাথা রেখে আমিও কতদিন তীব্র হতাশায় ভেবেছি
জটিল জীবনের অর্থহীনতাকে কী করে করি বলো অর্থময়?
তরল ঘড়ি-স্রোত, সূর্যমুখী আর ফলের থালা হাতে তন্বী
অথবা জ্যামিতিক মাছের স্বপ্নাভা, নর্তকীর নাচ কিংবা
তেরজা রিমা আর প্রগাঢ় পয়ারে অলৌকিক শত ঝংকার
জন্ম দিতে পারে স্বর্গ-মৃগটাকে বাঁচার গণ্ডিতে সুডোল করে?
চূর্ণ হবে থাম, দেয়াল যাবে ধ্বসে, পতনে সম্প্রতি লুব্ধ।
শুকিয়ে যাবে দ্রুত বিশাল হ্রদগুলি, শহর হবে ধু-ধু মরুভূমি।
এসব ভয়াবহ পতন এড়ানোর আশায় প্রাণপণে পালাতে চাই,
অথচ নিশ্চিত সর্বনাশ থেকে জেনেছি কিছুতেই বাঁচোয়া নেই!
দৃশ্যপট, আমি এবং অনেকে
(জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে)
১
শ্যাওলা-শোভিত পাঁচিলের ধার ঘেঁষে
হলদে পাখিটা স্বপ্নে উঠলো ডেকে।
তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম স্নেহে,
দিলো সে আমাকে সুশ্রী পালকে ঢেকে।
পাখিটা চকিতে আমার গলায়, গালে
চঞ্চুর ঘায়ে করলো অনেক ক্ষত-
মনে পড়ে গেল বাল্যসখীর ঠোঁট,
বাগানে ভ্রমণ, তন্বী গোলাপ কতো।
স্বপ্ন মোটেই নয়কো আজ্ঞাবহ,
তাই মাঝ-পথে আচম্কা পড়ে যতি।
স্বপ্ন হারিয়ে শিশুর মতোই আজো
বুকে পুষে রাখি বেলুন-হারানো ক্ষতি।
উঠোনের কিছু বিনীত চারায় দেখি
কলি পেতে চায় ফুলের সার্থকতা।
পাতার শব্দে, ডালের আন্দোলনে
বেজে ওঠে প্রাণে স্বপ্ন-জাগানো কথা।
দেয়ালের হুকে আটকানো পাজামায়,
শার্টের ভাঁজে, পাৎলুনে পড়ে রোদ।
লেখার টেবিলে চড়ুই রটায় ফের
আনন্দ-ঘন নতুন বস্তুবোধ।
সূর্যের লাল মুখের ওপর আজ
অসাধ্য বটে দরজা বন্ধ করা।
পাঁচিলে, উঠোনে দিনারের ঝকমকি,
কানায় কানায় ভরে নিতে হবে ঘড়া!
আজ সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ফুঁকবো কি শুধু শস্তা চুরুটগুলি?
নিজেকে প্রবোধ দেয়ার খেয়ালে মেতে
আঙুলে নাচাবো অলীক মড়ার খুলি?
ভাববো কি ফের তীব্র আর্সেনিকে
কার সে সজীব গোলাপ হয়েছে ছাই?
অথবা শূন্য দেয়ালের দিকে চেয়ে
বলবো কি মরজগতের শেষ চাই?
২
গুমোট রাত্রির পর হতশ্রী কপাট খুলে দেখি
(জয়তু ঘুমের বড়ি, নিদ্রা দিয়েছেন কোল রাতে)
পদ্মার ইলিশ হয়ে সকাল কাঁপছে চতুর্দিকে।
বারান্দায় খয়েরী চেয়ারে বসে পিতা
ভরা অবসরে
ঝিমোচ্ছেন, সকালের কাগজটা হেডলাইনের জমকালো
বর্ণচ্ছটা নিয়ে
পড়ে আছে এক পাশে। চেয়ারে ঠেকানো ঘাড়, প্রায় স্তব্ধ মুখের ভিতর
নকল দাঁতের অবাস্তব শুভ্রতায় চাঁপা-রঙ আলোকণা
হরিণশিশুর মতো শব্দহীন খেলায় মাতাল!
‘দূর দূর’ শব্দ শুনে চম্কে তাকাই, গেল, গেল, বিড়ালটা
কী নিয়ে পালালো দূরে। ট্যুথব্রাশ কই? নিঃশেষিত টিউবকে
অযথা পীড়ণ করি, বস্তুত মাসান্তে কয়লাই ভরসা হে!
জীবন বলোতো তুমি কতো চতুরালি জানো? আলী আকবর
পঁচিশ নিমিট ধরে বাজাচ্ছেন আশাবরী। রান্নাঘর থেকে
মা এলেন বারান্দায়, কপালে ঘামের ফোঁটা, হাতে
চায়ের সামান্য সরঞ্জাম ছেলেমেয়ে ক’টি তা-থৈ হর্ষোল্লাসে
পড়ার ঘরকে দিব্যি বানিয়ে ক্রুশোর দ্বীপ খোঁজে
সোনার হরিণ বনে। আমার টেবিল পড়ে থাকে আধপোড়া
সিগারেট, গমের রুটির টুকরো, শূন্য চা-র বাটি। এইসব দৃশ্যাবলি
প্রচুর দেখেও সুখ, ইচ্ছে হয় উঠোনের গাঁদার চারাটা
ঠিক করে দিই আর পাঁচিলের কাকটার কুশল শুধাই।
এইসব দৃশ্যাবলি চোখ ভরে দেখে দেখে দেখে
শূন্য গলিপথ ছেড়ে পা-দুটো বাড়াই
পৌরপথে, রাজপথে বড়ো ভিড়; মনে হয়, সমস্ত শহর
রঙিন বেলুনের গেছে ছেয়ে।
শার্টের কলার ঠিক করে কেউ হেঁটে যায় দ্রুত, হাসিমুখে
কেউবা সেলুনে ঢোকে, কেউ
পুরোনো জুতোর কাদা ঝেড়ে ঝেড়ে আড়চোখে দ্যাখে
সিনেমার বর্ণাঢ্য পোষ্টার।
কেউবা ছেলের হাত ধরে
দাঁড়ায় রাস্তার মোড়ে,ধাবমান ট্রাকের শক্রতা
থেকে গা বাঁচায় আবশ্যিক ক্ষিপ্রতায়।
দেখি কেউ, বুড়ো সুড়ো একজন, পান
চিবুতে চিবুতে হাল্কা রসিকতা করে
পড়শীর সঙ্গে আর অবহেলে কেউ
অশ্লীল গানের কলি ভেঁজে
লক্কড় গাড়িতে জোতে ডানা-কাটা হাড় জিরজিরে পক্ষীরাজ।
এ শহরে
কেউবা হাপর টানে, অক্লান্ত পেটায় লোহা কেউ;
কেউবা ঘুরিয়ে চাকা গড়ে নানা ছাঁদে
নানান পুতুল, কেউ রঙচটা ষ্টেজে প্রাণপণে
আওড়ায় পার্ট, কেউ কবিতার প্রতিটি অক্ষরে
নক্ষত্রের দীপ্তি চেয়ে ক্লান্ত হয় দুরাশার ভীষণ চত্বরে।
যতই অসহ্য হোক ক্লান্তি আর যতই দুরূহ
হোক পথ, বুড়ো পিকাসোর পরাক্রান্ত
ভীবনতৃষার মতো তৃষ্ণা এই আমাদের স্বতই চালায়
শিল্পের জটিল পথে। নানান রঙের ছবি দেখে
আমরাও হয়ে যাই অভিজ্ঞ সমজদার, মাথা নাড়ি সূক্ষ্ম
ঠারে ঠোরে, দৃষ্টি রাখি রুচি পরিবর্তনের ঋতুতে ঋতুতে,
নিবিষ্ট অধ্যবসায়ে মুক্তো তুলি কখনো-সখনো
মজা খাল সেঁচে আর
সমাজসমস্ত প্রেমে আত্মোদ্ধার খুঁজে
অপ্রেমের বুড়ি ছুঁই, কানামাছি খেলি বারবার!
যৌবনের অপব্যয়ে সম্প্রতি শোকার্ত আমি, নিরুপায়, দেখি
স্বাচ্ছন্দ্যের গোধূলিতে চিরাগত বংশবৃদ্ধি চলে
প্রমত্ত কামের পাঁকে। পঙ্কজের স্বপ্ন ধূলিসাৎ, চতুঃসীমা
কর্কশ কণ্টকাবৃত, আগাছার জয়জয়কার। মাঝে-মাঝে
স্বৈরিণীর আলিঙ্গনে বড়ো দ্রুত গলে যায় মর্যাদা, বিবেক
নামক সুচারু স্তম্ভগুলি। নিয়মিত বাচস্পতি জীবনের
চাটুবাক্য শুনে-শুনে অকূলের ভেলায় বেশতো কাটে কাল!
৩
দান্তের মতো ঘুরি জনপদে একা;
সাঁকো আছে ঠিক, জলও বয়ে যায় নিচে।
এখানে ওখানে ব্যাকুল দৃষ্টি রাখি,
কিন্তু কোথায় আমার বিয়াত্রিচে?
সূর্যের মুখ আকাশের দর্পণে
ভেসে উঠলেই বলি নেপথ্যে, প্রিয়
আর কতোকাল কাটবো গ্লানির ছড়া?
ফ্যাকাশে জীবনে কিছুটা পালিশ দিও।
যৎকিঞ্চিৎ সুখ, তা-ও ক্ষণজীবী।
আমার শিরায় দৈববিধান ক্রমে
পিতৃপুরুষ কী ব্যাধি গেছেন রেখে,
রজ্জু দেখেই পালাই সর্পভ্রমে।
জীবন তো জানি সাবানের বল, জলে
প্রতি মুহূর্তে যাচ্ছে ভীষণ ক্ষয়ে।
পুরোনো বাড়ির ছায়ায় লালিত আমি,
মুখে বংশের বিষাদ বেড়াই বয়ে।
অন্তে তলাবো চিরলুপ্তির খাদে,
ভূত-ভবিষ্য মিলাবে শূন্যতায়।
এসব জেনেও বাঁচার ব্যাকুল তৃষা-
মানব জন্মে এই তো আমার দায়।
নিজস্ব সংবাদদাতা
আমরা ক’জন তীব্র অগ্নিকান্ত এলাম পৃথিবী ঘুরে প্রভু।
আপনি সর্বজ্ঞ জানি, তবু
দেখলাম, শিখলাম যা কিছু সেখানে খুঁটিনাটি,
প্রত্যহ শুনেছি যত অপ্রিয় বচন, কান্নাকাটি,
কলহ, বিদ্বেষ, ক্রোধ, ক্ষোভ
সবকিছু আপনাকে বলবার লোভ
সামলানো দায়।
এ সংবাদ পড়বে না জনগণ ন্যু-ইয়র্ক টাইমস্ কিংবা প্রাভদায়।
দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বেড়ানোর তীব্র সাধ নিয়ে
চালিয়েছিলাম রথ দেশ-দেশান্তরে কিন্তু ইনিয়ে-বিনিয়ে
বলবো না একটানা ভ্রমণ কাহিনী, শুধু যেটুকু বলার
বলবো নির্ভয়ে প্রভু, না-ই থাক কথকী কলার
পরিচয় বিবরণে। যত দেশ আছে সব দেখেই বলছি, লোকমুখে
শুনিনি কিছুই আর গুজবেও দিইনিকো কান, যা মিথ্যুকে
সর্বত্র রটায় তার কানাকড়ি মূল্য নেই জেনে
দেখেছিতো বাস্তবের ভাঁড়ারের প্রভূত মশলা ছুঁয়ে ছেনে।
আপনার নিজস্ব সংবাদদাতা, হে বিশ্বপালক, এই আমরা ক’জন
পৃথিবীতে বহুদিন করেছি ভ্রমণ,
কখনো ভাদ্রের রৌদ্রে, কখনো বা পৌষের ধোঁয়ায় পথ হেঁটে
অনাবিল দেবদূতী পাখাগুলো ছেঁটে।
দেখেছি পেছনে ফিরে গণ্ডগ্রাম হয়েছে উজাড়
চোখের পলকে আর শহরেও মড়কের নৃত্যনাট্য দেখেছি, পূজায়
মণ্ডপ এবং শান্ত মসজিদে জ্যোৎস্না ডেকে যায় হা-হা স্বরে
শূন্যতায়, অথচ কোথাও কোনো লোক নেই ঘরে।
মধ্যরাতে আলোকিত লিফট্-এ বিদেশী প্রতিনিধি উঠে যান
এগারো তলায় হোটেলের। স্যুটকেশ হাতে কেউ কান্তিমান
দ্রুত হেঁটে যায়, যেন আশেপাশে ভালো করে দেখার সময়টুকু নেই,
কখনো ফেরে না আর। এ গল্পের খেই
যদি পাওয়া যেত তবে বলতাম আরো।
কখনো গলির পাশে বিশ্রামের মুহূর্তে শুনেছি কিছু গাঢ়
উচ্চারণ মানবিক উন্মাদের বাজে
বকবকানিতে মাঝে-মাঝে
অনেক গভীর সত্য হয় উচ্চারিত, পথচারী ভড়কায়।
বোঝে না আলাপ তার কেউ, তেল নেই আপাতত কল্পনার চরকায়।
রাস্তার বাঁদিকে বাড়ি, থাকে
একজন; ন্যালাক্ষ্যাপা দিব্যি বলা যায় লোকটাকে।
জেব্রার মতোই কোনো উজ্জ্বল বিকেলে কৈশোরের
রঙধনু ডাকবাক্সে রেখেছিল সে-ও ঢের
পাখির পালক আর ব্যাকুল বকুল।
সম্প্রতি সে অস্তিবাদী, গ্রন্থে ভরপুর, উসকো খুসকো চুল
প্রশস্ত কপালে লোটে। মনের বিজন পার্কে তার শীত নামে
কুয়াশার প্যারাস্যুটে ঘন ঘন, কখনো স্বপ্নের গোল থামে
জাঁহাবাজ চিল নখ আঁচড়ায়। হৃদয়ে লুকিয়ে রাখে বেদনার গ্রাম,
রেডিওর পাশে বসে সর্বদা ঘোরায় নব্ দিগ্ধিদিক-এটুকু বিশ্রাম
লাগে ভালো হয়তোবা। অত্যস্ত ঘরের চেয়ে বাইরের দিকে বেশি টান,
বুঝি তাই জনহীন রেস্তোরাঁর টেবিল প্রবাহে দুলে অমৃতসন্তান
প্রত্যহ কাটায় কাল। কী এক দারুণ ক্ষুধা সমস্ত শরীরে,
সন্তাপের উপাদানে মাথা রেখে দুঃস্বপ্নের তীরে
সে ঘুমায় বেঘোরে জড়িয়ে বুকে নিঃসঙ্গ আয়না। বন্ধ সব
দরজা জানালা, বিলম্বিত সূর্যোদয়-বোঝা ভার সে জীবিত নাকি শব!
আশ্চর্য শহর এক-পথেঘাটে ঈশপের প্রাণীকুল, কতিপয় লোক
নিয়ত গর্জন করে কমিটির বন্ধ ঘরে বর্জনের খোয়ারিতে, বলে লুপ্ত হোক
শিল্পের প্রদেশ। স্পষ্ট বলি, আমরা ধারিনা ধার
নাচের মুদ্রার আর বেহাগের, কাব্যের ফ্রেস্কোর, নিরঞ্জন সূক্ষ্মতার
কালজয়ী বাগানের ঘনিষ্ঠতা ছিঁড়ে খুঁড়ে ওরা পেতে চায় অধিকার
আজীবন ভাগাড়ে থাকার।
অন্য ছবি আছে আরো। রাত্রিদিন চলে বেচাকেনা
গ্রাম-গ্রামান্তের হাটে, দোকানে-দপ্তরে বাসগৃহে; থাকবে না
একরত্তি পণ্য পড়ে কোনোখানে-শহরতলীতে,
অলিতে-গলিতে।
যেখানে বসতি ঘন সেখানেই দলছুট হরিণেরা পড়ে
দালালের প্রশস্ত খপ্পরে।
কিছুটা পার্থিব ছাপ দেখুন এনেছি বয়ে আমাদের অমর শরীরে,
আর কিছুদিন নরবুদ্ধুদের ভিড়ে
ঘুরলেই সুনিশ্চিত অমরত্ব যেত উবে নারকী প্রহরে,
পচতাম পৃথিবীর কোনো জনশূন্য কোণে, অখ্যাত কবরে।
ওরা বড়ো দুঃখ পায়। চৈত্রের হাওয়ায়
গাছের হলুদ পাতা ঝরে গেলে, বিপন্ন দাওয়ায়
অবিরল জল এলে ভেঙ্গে গেলে সাঁকো কিংবা বিমান পতনে
ওরা বড়ো দুঃখ পায়। কথপোকথনে
নিয়েছি এটুকু জেনে কেউ কেউ তারা তামাশাটা বোঝে ভালো,
বোঝে ওপারের রঙ কতটুকু কালো!
তবু ওরা সব, যেন স্বপ্নচারী, হেঁটে যায় গোলক ধাঁধায়,
ঘুমের ভিতরে হু হু কেঁদে ওঠে জাগরণে পরস্পর হাসায় কাঁদায়।
বরং সহজ ক্রুশকাঠে বিদ্ধ হওয়া,
অনেক সহজ বটে রাজ্যত্যাগ, বোধিদ্রুমে সর্বমানবের দুঃখ বওয়া,
সহজ সহস্রগুণে আপনার পদসেবা, এঞ্জেলের ভূমিকা পালন।
পক্ষান্তরে পৃথিবীতে অনেক কঠিন জানি জীবন যাপন!
নিজেকে হিতোপদেশ
আজাড়া কথায় কাজ কি তোমার? এক্ষুণি সরে পড়ো।
নয়তো সবাই চেঁচাবে বড্ড, সভাই পণ্ড হবে।
বরং তুমিও ইক্চি বিক্চি কথা দিয়ে করো মাৎ,
মগজে সবার আহোশা ছাড়াও, বাহবা কুড়াও বেশ।
আমের বাগানে খেজুরের চাষ, কার কী বা এসে যায়।
সকাল-সন্ধ্যে অতীতের ভূত মাথায় দিচ্ছে চাটি?
জীর্ণ যুগের আস্তাবলেই সহিস সেজেছে যারা
তাদের সঙ্গে কানাঘুষো করো, গোপনে পাকাও ঘোঁট।
নিত্য নতুন থিসিসের কালি আকাশের মুখ ঢাকে,
গ্রাম-শহরের জড়োসড়ো লোক সামনে পায় না পথ।
পেছনে হাঁটার হুকুম রটায় বারোয়ারী মেগাফোন,
ভুয়ো বুলবুলি খেয়ে যায় ধান-কেউবা সাফাই গায়।
ভাবছো বৃথাই, কী সে বোকা তুমি, বেখাপ্পা এক লোক।
টিকে থাকবার শিখে নাও চাল, যত্নে ভিজাও চিঁড়ে
নইলে কালের জোয়ার ভাটায় হালে পাবে নাকো পানি,
মুঠোয় শুধুই তাল তাল কাদা উঠবে হরেক দানে।
স্বদেশের মাটি মহাজনদের চক্ষে লাগে না ভালো,
করবে কী তুমি বিদেশী বালির শোভায় জুড়োলে চোখ?
ভালো-মন্দের পুরোনো ফ্যাঁকড়া আগাগোড়া বাদ দাও,
বেলা ফুরোবার আগে মেনে নাও ফড়েদের ইক্তারি।
পাতালে বিশেষ স্বাদ আছে
পাতালে বিশেষ স্বাদ আছে ভেবে আমরা সদলবলে খুব
সবুজ হিল্লোল তুলে চতুর দিয়েছি ডুব। উদ্ভিদ-জড়ানো
শরীর নিজের নয়, মণি অক্ষি-গোলকের আশে পাশে নেই-
এমন অনেক উচাটন অনুভব
হয়তো পাতালে পেয়ে বসে।
বরাবর ছিল সাধ পাতালে নামার। ডুবুরির কাছে কোনো
শিখিনি কৌশল কিংবা ব্যাঙের পায়ের অনুকরণে পাদুকা
ছিল না প্রস্তুত তবু মিহি নীল ভেদ করে পৌঁছেছি পাতালে।
কে জানতো এত কালি, ঝুলের ঝালর
ছিল? ছিলো অতিকায় এমন জলজ মাকড়সা? তাল তাল
জমাট মসৃণ
ব্লিচিং গুঁড়োর মতো হাড়গোড়, অবিরাম জল-ধোয়া বেনামি করোটি
গাছপালা হয়ে সাজিয়েছে
কেমন রোরুদ্যমান অনাদি উদ্যান।
গান নেই কোনো দিকে, অথচ গানের মতো কিছু যায় শোনা
অলৌকিক ফিসফিসানির ঐক্যতান। পাখিগুলি
অনেক আগেই গেছে হু-হু ডাল ছেড়ে।
কতো মাছ ভাসমান চুলের সুনন্দ জালে আসে,
করে খুনসুটি আর মনে হয়, দূর-দূরান্তরে
প্রবাল রঙের কিছু বিকল্প হরিণ চরে, হিসি করে স্বপ্নের খামারে।
কখনো বা তলোয়ার মাছ কিংবা হাঙরের উথা-পাথাল
আলোড়ন পারিনি সামাল দিতে, খেয়েছি দাঁতকপাটি শুধু।
সুহৃদ অনেক ছিল, আপাতত নেই কেউ নিকটে কি দূরে।
পাতাল নির্জন বড়ো, সুনসান বিদেশ-বিভুঁই,
দরজা জানালা নেই, পাতাল অতল ব্যক্তিগত।
এমন নিঃসঙ্গতায় কাঁকড়ার আনন্দ অপার-
সমুদ্রের ধু-ধু ফ্লোরে ঘোরে ইতস্তত, কিঞ্চিৎ বাতিকগ্রস্ত
বায়ুসেবী ভদ্রলোক যেন। ভুলেও ঈর্ষায় ওকে
কখনো করি না বিদ্ধ, তাই মৎস্যশোভন সাঁতারে
ভেসে উঠে ফুসফুসে হাওয়া নিতে চাই।
পাতালে আমাকে রোখে কিছু স্বর করুণ বিলাপে
অনুনয়ে, কখনো বা ঝাঁঝালো ধিক্কারে।
বলে, সব অসুখ সারিয়ে দেবে জলের আদরে।
ভালো অতলতা, ভালো সুনীল ভ্রমণ মাঝে-মাঝে,
ভালো সেই কম্পমান জলের অপেরা,
অসম্ভব সেখানে বানিয়ে তোলা আশ্রয়-গম্বজ।
অবুঝ সঙ্গীরা যদি শূয়োরের মায়াবী খোঁয়াড়ে
পচে তবে পাতকিনী মোহিনীর সুরের কুহক
কী করে পাড়াবে ঘুম? কী করে লুকোবো মুখ বিভ্রম-ঝরানো,
বিবেক-ডোবানো সেই স্পর্ধিত সবুজ স্তনমূলে?
সুশ্রী জলপুরী থাক জলের ভিতরে,
দুহাতে প্রবল ঠেলে ঢেউ-ফণা ফিরবো ডাঙায়।
এখনো ডাঙায় নির্ভরতা? ফুসফুসে চাই হাওয়া?
এখানে থাকবো এই সুঠাম ডাঙায়, আমি পাতালে যাবো না।
পাতাল নির্জন বড়ো, সুনসান বিদেশ-বিভুঁই।
এখানে বসত করে স্বতোজ্জ্বল ভালোবাসা। হৃদয়ের নিভৃত সোনালি
ঝাঁপি খুলে দিলে ভালোবাসা মুখ তোলে কী এক বাঁশির সুরে লীলায়িত
অথচ নেপথ্যে শুনি, “ভালোবাসা তোকে দুধকলা দিয়ে পুষে
দেখেছিতো তুই ছোবলের কথা পারিসনে ভুলতে কখনো।
পিতা-পুত্র
সে, আমার ছেলে, আজো পারে না বলতে কোনো কথা
কিছুতেই; শব্দাবলি পাখির ছানার মতো শুধু
ক্ষীণ ডানা ঝাপটায়। জিভে তার রাজ্যের জড়তা
জুড়ে থাকে সারাক্ষণ, শব্দের জগত করে ধু-ধু
অবিশ্বাস্য শূন্যতায়। কখনো কথায় ঝলমল
মরীচিকা চোখে তার আশার ঝালর বুঝি আনে।
দেখি কিছু ঠোঁট নড়া, নিমেষেই ব্যর্থতায় টল-
টলে চোখে নামে ছায়া। মগজের অরূপ বাগানে
মধ্যে-মধ্যে বুলবুলি গায় গান, অথচ সে-গান
কণ্ঠের ধূসর পথে কেবলই হারায় দিশা। আর
দশজন ছেলেমেয়ে যখন ফোটায় অফুরান
কথার বিচিত্র খই, তখন সে ব্যর্থতায় ভার
বয়ে ক্লান্ত, চেয়ে থাকে তাদের মুখের দিকে কী-যে
ভয়ানক স্তব্ধতায়। এই স্তব্ধতার পরিচয়
কিছু জানি;বহুবার গভীর রাত্তিরে আমি নিজে
হয়েছি ভীষণ বিদ্ধ শব্দহীনতার দাঁতে। ভয়,
তখন আমার বড়ো ভয় করে আর হাতড়ে মরি
ক্ষমাহীণ শূন্যতায় কবিতার কতো নিরুদ্দেশ
শব্দাবলি। ছেলেটাকে বুকে নিবিড় জড়িয়ে ধরি,
বলি তাকে, “তুইতো আমার সেই প্রতিশ্রুত দেশ।“
যখন ঘুমায় খোকা, ডুবে যায় আরো বেশি আরো
শব্দহীনতায়, তখন নিঃশব্দে যাই তার কাছে।
আমার দুচোখ ভেজে, গাঢ় অন্ধকারে যেন কারো
কবরের পাশে আমি শোকাহত। সে ঘুমিয়ে আছে।
পোড়া বাড়ি
(কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত)
আজ তুমি চিনবে না এই পথ, এখন সেখানে
বিপুল পিপুল ছায়া অন্তর্হিত, সুর বাহারের,
সারঙের গৎ নেই, স্বপ্নবাগিচায় প্রতিষ্ঠিত
বুলবুলি নেই কোনো। সুন্দরের স্মৃতিতে মড়ক।
আজ এই ঊনিশশো চৌষট্রিতে গ্লানির বৈঠকে
বসে বসে ক্লান্তি এলে নিজস্ব স্বপ্নের স্বেচ্ছাচারে
মেতে উঠি এবং তোমার কথা ভেবে ভেবে শুধু
শোক হই, অবান্তর জেগে থাকি স্বভাবদোষেই।
তোমাকে দেখি নি তবু গুরুজনদের মুখে-মুখে
গল্পপ্রিয় লোভী বালকের মতো কান পেতে সুখে
থরোথরো শুনেছি তোমার কথা। বস্তুত সর্বদা
খুঁজছি আমার স্বত্ব কবিত্বের বিমূর্ত নগরে।
তোমার মাথাটা বুঝি পোড়ো বাড়ি, যেখানে দেয়ালে
জীর্ণ বন্ধ ঘড়ি আর কয়েকটি বিবর্ণ মুখোশ
হেলায় টানানো। ভাঙা দরজার শব্দ প্রেতায়িত
বাতাসের সহযোগী, শূন্যতাই সেখানে সম্রাট।
চতুর্দিকে বাদুড়ের পাখার ঝাপট দুঃস্বপ্নের
রাত্রিকেই ডেকে আনে সর্বক্ষণ। কবরের সব
বিশীর্ণ বাসিন্দা যেন মাটি ফুঁড়ে ভিড় করে আসে,
মগজে হননে মত্ত নষ্ট কোষে ভয়াল মাকড়সা।
কবিতায় রাগ্মিতার রোদ্দুর মিশিয়ে পোড়া দেশে
এনেছিলে তীব্র দাহ; অত্যাচার অনাচার তুমি
সমূলে ভাসিয়ে নিতে চেয়েছিলে কাব্যের জোয়ারে-
নিশ্চিত জেনেছি আমি, চারণ কবির সততায়।
কে বলে কাব্যের ফুঁকে এ পৃথিবী নিরাময় হয়,
হতে পারে? হয় না তা। নইলে ভগ্নস্বাস্থ্য সময়ের
আর্তনাদে কেন এই মানুষের হাট বারবার
ভেঙে যায়? কেন ওড়ে সর্বত্র পতাকা বিনষ্টির?
পণ্ড করে নিয়মের প্রতিবিম্ব, ছকের বাহার
বণিকের রাজ্যপাট করতে লোপাট সমুদ্যত
ছিলে সর্বদাই, অথচ আমরা আজো পরবাসী
নিজ বাসভূমে। প্রতিবিম্ব ভেংচি কাটে নিজেকেই।
তোমার জীবন যেন অন্ধকারে সুতীব্র চীৎকার,
নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে পুণ্যবানদের। ক্ষণকাল
আড়মোড়া ভেঙে ফের গভীর নিদ্রায় সহজিয়া
তক্তপোশে ঢলে পড়ে অকাতরে বধির সমাজ!
শেকল ছেড়ার গানে রাত্রিদিন সেই ঝোড়ো যুগে
নিজেই হয়েছো অগ্নিবীণা। আমরাও সর্বক্ষণ
সেই গানে মেলাই সত্তার সুর, নির্বাসনে আজো
চৈতন্যের পল্লী জ্বলে, গান গাই শৃঙ্খলিত দাস।
তোমার প্রস্তরমূর্তি রাজপথে পাখির পুরীষে
কলঙ্কিত নয় ভেবে নানা প্রবচনে সমর্থন
সানন্দে জোগায় গৌড়জন, সংস্কৃতির মুখ চেয়ে
সেবকেরা সভাঘরে ঘুর ঘুর করে বিলক্ষণ।
ফুরোলে আতশবাজি যেমন মাটির ঢিবি শুধু
পড়ে থাকে আস্তাকুড়ে, তেমনি তুমি বাঁচো নিরুপায়;
গভীর রাতের শূন্য পার্কের মতোই মানসের
স্তব্ধতায় থাকবে বুঝি, লুণ্ঠিত ভাষার রত্নদ্বীপ।
প্রুফ
বয়োধর্ম অনুসারে ইচ্ছার সি-গাল ভাসা ভাসা
ওড়ে বহু ক্রোশ।
মধ্যবয়সের ভেলা লগি ঠেলে ঠেলে
চমৎকার শান্ত তীরে নিয়ত ভেড়াতে চাই, ছাড়ি আইমুশা,
আর ভাবি যদি এই জীবনের প্রুফ দেখা যেতো, তবে
কয়েক গ্যালির
কিছু দাঁড়ি কমা উল্টে পাল্টে নিলে আক্শি বাক্শি
নিরুপম সংশোধিত হতো।
জীবনের যে-ভাগ মেঘলা তার চারপাশে সযত্নে দিতাম
বুনে বোদ্দুরের পাড় স্রেফ
কম্পিউটারের দক্ষতায়, ডোবার কচুরিপানা
আহ্লাদে আটখানা হতো নীলপদ্ম। রঙ-ফাউন্ডের
গভীর সঙ্কেতে ক্ষুদ্র চাপাতো শরীরে বৃহতের জামেয়ার।
নির্ঘাৎ ডিলিটি করে অপ্রেমের ‘অ’টা
ভাসতাম চোখ বুজে আ’মরি প্রেমের সরোবরে।
কিছু শব্দ কেটে ছেঁটে ভিন্নতর, শব্দাবলি বসালেই, দ্যাখো,
গলির বসতবাটি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি হবে,-
সামনে বাগান, গাড়ি বারান্দায় সর্বদা নিদেনপক্ষে, টয়োটা প্রস্তুত।
অধিকন্তু বেবাক খবর নেবো জাহাজের, অথচ আদার
ব্যাপারির অপবাদ থাকবে না কোনো।
আরো কিছু হেরফের করা যায়, যতটুকু চাই,
‘সি কপি’র মহিমায়; প্রতিভার হর্স পাওয়ারটা
দিব্যি উস্কে দেয়া যায় অন্তত সহস্রগুণ আর
পয়মন্ত ব্যবসায় ঘন ঘন দাঁও মারলেই সর্বক্ষণ
লুটোবে পায়ের কাছে প্রভুভক্ত কুকুরের মতো
নানান পদবী। তৎক্ষণাৎ ঊনপঞ্চাশ ফর্মার
জীবন চরিতে জানি জন্মাবে আমার অধিকার।
কালের সজাগ চৌকিদার
হেঁকে যাক প্রাণপণে, তুলো গুঁজে কানের বিবরে
খানিক স্পেসিং করে নিয়ে
গৃহিণীর মেদ আর বয়স কমিয়ে একালে আমিও হবো
প্রেমার্ত প্রোজ্জ্বল ক্যাসানোভা।
বস্তুত ড্যাশের পুল পেরুলেই সপ্তম স্বর্গের
সিঁড়ি আলোজ্বলা, স্বপ্ন-ধলা।
আপাতত মধ্যবয়সের তোবড়ানো, রস ফতুর এক
ভেলায় চেঁচাই তারস্বরে, মুহুর্মুহু “ওগো প্রভু, দয়াময়
তাড়াতাড়ি অধমের জীবনের এক তাড়া প্রুফ পাঠাবেন?”
প্রেম তুমি এলে
বুনো হংসের পেছনে ছুটেই
কেটেছে সকাল এবং বিকেল।
চোখ মেলে দূর আকাশের নীলে
শূন্য হস্তে ফিরছি যখন,
প্রেম তুমি এলে করুণ পায়ে।
ভেলার স্বপ্নে বদ্ধ জলায়
ভরা আলস্যে সারা দিনমান
আকণ্ঠ ডুবে মজা অতীতের
সাধের জাবর কাটছি যখন,
প্রেম তুমি এলে অধীর পায়ে।
আড্ডা-পিয়াসী ক্লান্ত শরীরে
রিফু-সাপেক্ষ জামাটা চাপিয়ে,
বোদলেয়ারের জীবন-ভাষ্য
মনে মনে ফের ভাঁজছি যখন,
প্রেম তুমি এলে নগ্ন পায়ে।
চায়ের কাপের বিবর্ণ গায়ে
চোখ রেখে সেই দারুণ হলুদ
নব্বুই-এর গোধূলিপ্রবণ
যুগকে স্মরণ করছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ভ্রষ্ট পায়ে।
মুণ্ডবিহীন লোকটাকে দেখে
‘ওরে মাঝি তোর বৈঠা কোথায়?
বজ্রপাতের ভয়ে সচকিত
কণ্ঠে হঠাৎ বলছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ত্রস্ত পায়ে।
দু’বেলা পিতার সরাইখানায়
চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়ের
সরোবরে ভেসে জীব-জগতকে
থোড়াই কেয়ার করছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ক্লান্ত পায়ে।
নিজের চরকা বিকল ভেবেই
মনকে চালাই নানা কৌশলে।
নবযুবতীর দৃষ্টি কুড়িয়ে
বিরাট শহরে ঘুরছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ব্যগ্র পায়ে।
চোত-বোশেখের ঝড় বয়ে গেলে
আ-মরি সারাটা দেশের ওপর,
খড়পাতা নেড়ে অসীম ধৈর্য্যে
নড়বড়ে ঘর বাঁধছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ক্ষিপ্র পায়ে।
রুষ্ট কালের প্রবল দাপটে
অন্ধ গুহায় লুকিয়ে আমিও
আহত পশুর মতো ভয়াবহ
নিজের ক্ষতটা চাটছি যখন,
প্রেম তুমি এলে শান্ত পায়ে।
ঢেকে রেখে মুখ ঘন ঝোপঝাড়ে
এই ইতিহাস-চুল্লীতে শুধু
নিজেকে শুক্নো বড় জোর এক
জ্বালানির কাছ ভাবছি যখন,
প্রেম তুমি এলে দীপ্ত পায়ে।
অনেক লাজুক খর্ব আশাকে
কবরে শুইয়ে, গত শতকের
বহু স্বপ্নের লাশের গন্ধ
কলমে খুঁচিয়ে তুলছি যখন,
প্রেম তুমি এলে নগ্ন পায়ে।
জীবনকে রাজহংস ঠাউরে
তার পশ্চাতে চৌরাস্তায়,
কারখানা আর কলোনীতে, শেডে
উদ্ধাহু, আমি ছুটছি যখন,
প্রেম তুমি এলে সান্ত পায়ে।
সবার সুখের খরদারির
কাজে মেতে বুকে তপ্ত, উদার
পুস্তিকা সব লুকিয়ে, বাঁচিয়ে
ঘরে ঘরে কড়া নাড়ছি যখন,
প্রেম তুমি এলে দৃপ্ত পায়ে।
প্রেমের কবিতা
যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখা
লেকের ধারে সঙ্গোপনে,
বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়
চলছে লড়াই উলুর বনে।
যখন তোমার পায়রা-হাতে হাতটা রেখে
ডুবে থাকি স্বর্গসুখে,
তখন কোনো গোলটেবিলে দাবার ছকে
শ্বেত পায়রাটা মরছে ধুঁকে।
আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,
পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে!
বংশধর
যেদিন আমার পিতামহের কাফন-মোড়া শরীরের ওপর
নশ্বর নক্সার মতো চাংবাঁশটায় পুঞ্জ পুঞ্জ শোক হয়ে কেবলি
ঝরে পড়ছিল কালো মাটির দলা,
তখনও আমি পৃথিবীর কেউ নই।
পিতামহের ডাক নদীর এক তীর থেকে অন্য তীরে
সহজে করতো যাত্রা, শুনেছি।
তাঁর সেই গম্গমে ডাক কবিতার সুরে যেতো মিশে-
এমন কোনো কিংবদন্তীর জন্ম হয়নি আমাদের পরিবারে।
পিতামহীর কথা যখনই ভাবি, শুধু একটি দৃশ্য
ভেসে ওঠে পুরোনো দিনের আরশি ছেড়ে বর্তমানের আয়নায়
ছায়াচ্ছন্ন ঘরে বার্নিশ-চটা পালংকে এগিয়ে-থাকা
বর্ষিয়সী এক মহিলা, চোখ দুটো ভরা দুপুরে
হারিকেনের আলোর মতো নিষ্প্রভ।
তাঁর সেই অনুজ্জ্বল এক-জোড়া চোখ
কোনোদিন কবিতার পংক্তির আভায় জ্বলজ্বলে
হয়েছিল কিনা, জানি না।
আমার মাতামহ সকালের চঞ্চল বেলায় বারংবার
বুক-পকেট থেকে চেন-বন্দি ঘড়িটা দেখতেন
আর দশটার আগেই ছাতা হাতে ছুটতেন
কাচারির দিকে-সেখানে প্রায়-অনুল্লেখ্য কোনো
কাজ করতেন তিনি। একটা টাইপরাইটার ছিল তাঁর;
মাঝে-মাঝে দেখতাম কয়েকটি অভিজ্ঞ আঙুল
ব্যালে নর্তকের মতো নেচে চলেছে কী-বোর্ডে।
যতদূর জানি, মাতামহের সেই অতি-পুরাতন শব্দসমূদয়
কাব্যের পাড়ার কেউ ছিল না।
আমার মাতামহী, সবার অলক্ষ্যে যিনি শাদা অথচ সুদীর্ঘ
চুল আঁচড়াতেন মধ্যদিনে কাঠের চিরুনি দিয়ে আর
সন্ধ্যা হলেই মুরগির বাচ্চাগুলোকে দর্বায় পোরার জন্যে
অস্থির পায়ে করতেন ছুটোছুটি-যত আন্দোলিত হতেন আমার
মাতামহের ডাকে ততটা আর কিছুতেই নয়।
বুঝি তাই কবিতার ডাক তাকে কখনও কাছে টানেনি।
আমার পিতা, সেই অমিতবিক্রম সিংহপুরুষ,
জীবনের দুটো শিং ধরে লড়তে লড়তে নিজেকে যিনি
ক্লান্ত করেছিলেন, যিনি ভালোবাসতেন হেঁটে যেতে
সুঘ্রাণ ভরা শস্য-ক্ষেতের আলের ওপর,
কোনোদিন পা বাড়াননি কাব্যের প্রান্তরে।
না, তাঁরা কেউ পা রাখেননি নিঃসঙ্গতার উথালপাথাল
সমুদ্র-ঘেরা কবিতার দ্বীপপুঞ্জে! কিন্তু ঐ পুণ্যজনের
স্মৃতির অজর শরীরে
কবিতার সোনালি রূপালি জল ছিটোচ্ছে
তাঁদেরই এক ফ্যাকাসে বংশধর
সময়ের হিংস্র আঁচড়ে ক্রমাগত জর্জর হতে হতে।
বুড়িমা
লাল নীল আর হলদে ফ্রকের অপ্সরী
চাঁপা-রঙ রোদে নেচে নেচে হলে টুকটুকে।
বুড়ি ছুতে গিয়ে হেসে ওঠো কেন ফিক করে?
থুত্থুরে ঐ বুড়িমাকে দেখে পায় হাসি?
তোবড়ানো তার গলা দেখে,
শণের মতন চুল দেখে,
ছানি-পড়া দুটো চোখ দেখে,
নড়বড়ে সব দাঁত দেখে,
লোলচর্মের ভাঁজ দেখে
হাসছো তোমরা মুখ টিপে?
জানি তোমাদের কোমল ত্বকের উদ্যানে
মেতে ওঠে পাখি অলীক ফুলের সৌরভে।
চোখ নয় যেন ঝলোমলো সব হ্রদগুলো,
হাতটা সাজানো পাঁচটি হলুদ চম্পকে।
সময়ের পট বড়ো দ্রুত যায় পাল্টিয়ে।
যাকে দেখে হাসো আজ বটে তিনি থুত্থুরে;
এই তো সেদিনও তিনি শোনো নীল লাল পরী
তোমাদের চেয়ে ছিলেন না কম সুন্দরী।
ভালোবাসা তুমি
ভালোবাসা তুমি অনাবৃষ্টিতে
কেমন রুক্ষ্ম, কী দগ্ধ আজকাল।
তারা-পাতা নেই, পাখিরা উধাও;
ভীষণ রিক্ত তোমার সলাজ ডাল।
কতদিন তুমি বৈশাখী রোদে
ভেবেছি শ্যামল ছায়ার আদর দেবে।
কিন্তু পালিয়ে বেড়ালাম শুধু
ছায়াকে তোমার প্রেতায়িত ছলা ভেবে।
চক্ষু কোটরে নিশীথ অশ্ব
রেখে গেছে কত দুঃস্বপ্নের আঁধি।
লিবিড়ো-তাড়িত সুনীল গুহায়
নিজেকে সোনালি সাপের শরীরে বাঁধি।
হৃদয়ের ঢের কাঞ্চন মেঘ
বৈরী হাওয়ায় কোথায় পালালো দূরে।
সংশয় যেন কৃষ্ণ বাদুড়,
ওড়ে অবিরত চিত্ত বলয় জুড়ে।
সমৃদ্ধির মায়ামারীচের
সংজ্ঞা-হরণ দারুণ আকর্ষণে
ধনিক যুগের গোধূলিতে ভাসি
যূথছুট ম্লান, নরমুণ্ডের বনে।
যেসব ভাবনা অবচেতনের
পরাণ-ঋদ্ধ গুহার তিমিরে লোটে,
কখনো হঠাৎ আলোর খোঁচায়
আর্তকণ্ঠে তারাও চেঁচিয়ে ওঠে।
স্বপ্ন এখন ছড়ে যাওয়া-দুধ,
আতঙ্কময় সময়ের জের টানি।
সুবিশ্ব মৃত, পাইনিকো টের
হয়ে গেছি কবে সংশয়-বেধা প্রাণী।
ভালোবাসা তুমি ক্ষয়-চিহ্নিত,
পত্রালিছুট, তোমার কী দোষ বলো?
ব্যাপক খরায় বহুদিন আমি
তোমার শিকড়ে ঢালি নি ঈষৎ জলও!
মাছ
মাছ তুমি প্রতিপলে করতলে হচ্ছো ম্লান। যতদূর জানি,
জল ছেড়ে শালুকের স্পর্শ ছেড়ে হাতের চেটোয়,
রোদের সোনালি কাঁটাতারে
শুয়ে থেকে মাথাটা তোমার
দিলো চাকদানা।
মেঘের গোযোর নেই একটু আকাশে, মাছ তুমি
হচ্ছো ম্লান; নৌকো যাচ্ছে রোদের ভেতর দিয়ে ফুলো
পাল তুলে। চোখ দেখি অপলক, হয়তো সেখানে
এখন জলজ স্মৃতি স্থিরচিত্র। মাছ তুমি সাঁতার জানোনা
হাতের ডাঙায়, তবু সকালবেলার তারা হয়ে
আছো স্বপ্নে, দুঃস্বপ্নে অংশত। জীবনের প্রতিষ্ঠিত
সোনালি কামানি থেকে যাচ্ছো সরে। এখন তোমাকে
অথৈ শূন্যতায়, নীলিমায়
কিছুতেই ওড়ানো যাবে না
ওগো মাছ, হাতের ডাঙায়-পড়া মাছ।
কোথাকার খোয়াইল্যা পাখি
মগজে নোয়ানো
জল-ছোঁয়া তীক্ষ্ম কঞ্চেটায় বসে বুঝি মাছরাঙা হয়ে এলো
তোমার জীবনহর। দেখছো মরীয়া হয়ে, খোলা
চোখে চমকালো চান্নি উয্যালা এবং শরীরের
নক্সী ত্বক ক্রমাগত হারাচ্ছে তীক্ষ্ণতা।
মাছ তুমি ডগা ডগা রোদের ভেতরে আছো, আমি
তোমার ভেতরে যাই, অকাতরে হই
রঙিন ঘুড়ির মতো ত্বক, হই কারুকাজময় শ্বেত কাঁটা
ওগো মাছ, হে বন্ধু আমার।
প্রথম যখন হাতে তুলে নিয়েছিলাম তোমাকে
আলগোছে-প্রতিদিন কত কিছু তুলি বইপত্র, ছেঁড়া মোজা,
জুতোর কালির ডিবে, আলপিন, শার্টের বোতাম, এরকম
অনেক কিছুই তুলি কাজে বা অকাজে-
মনে হয়েছিল যেন তুমিও তেমনি কোনো জিনিশ বস্তুত।
জাপানি সিল্কের মতো চামড়ার আদরে চমকিত
দেখলাম, তস্বী-দানা চোখ নিয়ে চেয়ে আছো রোদের ভিতরে
আমারই চোখের দিকে, আছো হাতের জায়নামাজে, স্থির,
অনবোলা। অকস্মাৎ আমাকে বিঁধলে তুমি মাছ, ওগো মাছ,
হে বন্ধু আমার, অলৌকিক বড়শিতে।
নির্জন কিনারে হাঁটু গেড়ে কাটাল পাখির বুলি শুনি, ভাবি-
তোমাকে ছাড়বো আমি নাকি তুমি আমাকে দয়ালু?
মেঘের নীল ইজিচেয়ারে
মেঘের নীল ইজিচেয়ারে শুয়ে ভাবি
জীবন নয় নেশাখোরের মাতলামি।
অথবা নির্বোধ তর্ক নয় কোনো,
জীবন স্পন্দিত মহৎ রূপাভাসে।
হাতের মুঠো ভরে সূর্যোদয় নিয়ে
মামুলি নক্সায় স্বর্গ পেতে চাই।
অথচ সময়ের সখ্য চেয়ে আজ
কালের কলহের অন্ত নেই দেখি।
সময় উৎকোচ নিয়েছে মানবের,
অন্ধকারে তবু উধাও অমরতা।
জ্ঞানীকে জনরব ব্যঙ্গ করে বলে
জীবনে জটিলতা থাকবে চিরদিন!
ভাবনাগুলি যেন রঙিন কটি বল,
অন্ধকারে যেতে খেলতে ভালোবাসি।
নষ্ট পৃথিবীকে জানিয়ে সাধুবাদ
কখনো নির্জন মনের দ্বীপে যাই।
নিয়তি বিবর্ণ প্রাচীর থেকে বলে
শূন্যতায় ফুল ফোটাতে চেয়ে সব
সুখকে অকাতরে জলাঞ্জলি দিবি?
তবু কি দেখা পাবি অন্তে মিনারের?
ঘটনারণ্যের কালোয় মুখ ঢেকে
আমিও ভৌতিক হরিণ হয়ে যাই।
বর্তমান কাঁপে চূর্ণ দর্পণে,
ব্যাধেরা হননের নেশায় অস্থির।
ময়নামতীর মূর্তিগণ
ময়নামতীর মাটিপ্লুত মূর্তিগণ গোলাপী রঙের রেলগাড়ি চেপে
সটান এলেন রাজধানীতেই সিটি-চমকিত স্টেশনের আস্তানায়।
মাননীয় গার্ড তার হুইসিল বাজাতে বাজাতে নিয়ে যান
বগী ভরে শৈবালিত, মেদুর বছরগুলি সুশীতল শেডে
সকরুণ দিব্যতায়। দুদ্দাড় পড়েন নেমে প্ল্যাটফর্মে ময়নামতীর
স্বপ্নপরায়ণ মূর্তিগণ-
কেউবা পটের বিবি, আকর্ণ বিস্তৃত চোখ, সুন্দর বগল,
উচ্ছল পানের রসে টসটসে ঠোঁট, যেন পাকা জাম; মসৃণ পাম্পসু পায়ে
আহ্লাদিত চতুর নাগর কেউ ফিটফাট, হয়তো কিণ্নর কুলোদ্ভব-
হন্হন্ হেঁটে গিয়ে মূর্তিগণ মেশেন নির্মুখ ভিড়ে। রাস্তায় রাস্তায়
কেমন বিকট চেল্লাচেল্লী, ঠেলাঠেলি, চতুর্দিকে দুঃস্বপ্নের পঙ্গপাল।
শহর এমন তপ্ত পারেনা আলতো হাত রাখতে কোথাও
কেউ, দপ্তরের
পাপোষে জমায় ভিড় দশজন শতজন প্রতিবেশী, দী
উমেদার। মাঝে-মাঝে তিল ধারণের ঠাঁই-নেই শহরকে ভয় পায়
পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই, চায় কোনোমতে
হাতের রৈখিক মাঠে চকিতে আসুক সুশোভন আমলকি। কখনো-বা
চাকারিতে এতল বেতল খেলে অবসাদ এলে
সখেদে দাখিল করে হাকিমের এজলাসে হলুদ দলিল।
কবেকার অব্দে সেই সুখদ বেলায়
বলো ছিল নাকি ভালো গোচরণ? বন দোয়েলের
শিস্ ঠুক্ ঠুক্ নুড়ি ঝুরু ঝুরু, আমের পাতার ঝিরিঝিরি,
এবং ঝাউয়ের আইমুশা
ইত্যাকার শব্দের মস্তকে মৃদু দুদণ্ড ফিরিয়ে হাত
ব্যাকুল আদর করা, লৈতন গাছের ফল কোঁচড়ে কুড়ানো,
অথবা সজল চোখে নৌকোর গলুইয়ে শুয়ে শুয়ে হাট-কারা আকাশের
লাউয়ের জালির মতো চাঁদ দেখা ছিল না কি ভালো?
শহরে নানান লোক, মধ্যবিত্ত প্যাণ্ডার সর্বত্র ঘোরে আর
চুটিয়ে ব্যবসা করে। কেউ কেউ পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে
উৎসবে বিলোচ্ছে হৈ-হৈ জিলিপি বাতাসা। অন্যদিকে
মেঘমৃদু হাত নড়ে জানালায়, অপর্রাবি ফেলছে চটুল দৃষ্টিজাল
রাস্তায় গলিতে পার্কে, সিনেমায়, কাফেতে অতিল্।
‘কী মজা কাফে-র দিবা বর্ণচ্ছটা এবং বানান ভুলে ভর্তি
হে আমার পরম লুকোনো পত্রপাঠ’
পকেটের ছুঁচো হাৎড়ে বলে পথস্থ গেঁজেল, আউগারি যুবা।
ময়নামতীর মাটিপ্লুত মূর্তিগণ অবিরাম ইকর বিকর চলাফেরা
করছেন ফুটপাতে, রুক্ষ চুল, উস্কো-খুস্কো নীলাম্বরী,
পাদুকা ধুলোয় ম্লান। ওড়ের বিগড়া কেউ পা ধোবেন বলে
কোথায় আমার স্থান, কোন আঘাটায়?’- এমন স্বপ্নোজ কিছু
উচ্চারণে যান চলে কামিজের হাতা মুড়ে শহুরে অলীক সরোবরে।
রক্তে তার জলকিণ্নরীর গান, সন্ধ্যালোকে ঘোরেন কেবল
দিগ্ধিদিক, পাতালের বর্ণোচ্ছাসে, জাতিস্মর দোটানার পাকে।
যাদুকাঠি
খাটো সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শহরে হাঁটছি একা,
বুকের ভিতর স্পন্দিত ঢের অলীক কথার ঝাড়।
বড়ো রাস্তায় নেমেছে এখন ভীষণ অন্ধকার,
পার্শ্ববর্তী পথচারীকেও সহজে যায় না দেখা।
চেনা পথ আজ অচেনা ঠেকছে, গা ঘেঁষে দাঁড়ায় ভয়;
চম্কে তাকাই, কে যেন অদূরে সজোরে কড়াটা নাড়ে।
নীল পাহাড়ের অগম চূড়ায় নয়,
নয়কো অনেক হাঁস-ঝলসিত প্রাচীন হৃদের ধারে,
ল্যাম্পোষ্টের চূড়ায় লগ্ন একজন কালো লোক
হাতে নিলো তুলে এলোমেলো কিছু ইলেকট্রিকের তার।
আঁধারে দোকান, রাস্তা, মানুষ, যান, সব একাকার-
যেন কে ডাইনি নাড়ছে পাচন তেপান্তরের পারে!
একটু পরেই বড়ো রাস্তায় পাচন অন্ধকারে
কালো লোকটার যাদুকাঠিতেই ফুটলো আলোর চোখ,
যেমন হঠাৎ বিপুল সাড়ায় কবির অধীর মনে
না-লেখা কবিতা চোখ মেলে চায় নিবিড় উন্মীলনে।
যে-কোনো সকালে
ট্রে হাতে সে এল ঘরে, রাখলো সংক্ষিপ্ত প্রাতরাশ
পাশের টিপয় জুড়ে। টোস্ট আর চায়ের সুরভি
খেলা করে সারাঘরে, না-লেখা শব্দের আঁভালাস
থেকে জেগে তাকে দেখি। রেডিয়োতে ব্যাকুল ভৈরবী।
বসলো গা ঘেঁষে, তার যৌবনের সূর্যাস্ত শরীরে
এনেছে বর্ণাঢ্য ছবি। একটি কি দুটি পাকা চুল
বাতাসে নড়ছে মৃদু, অকস্মাৎ সকালকে চিরে
টিয়ের চীৎকার বেজে ওঠে বারান্দায়; কী নির্ভুল
ঘড়িটা রটায় বেলা। ‘আরেকটা টোস্ট নাও’ বলে
সামনে বাড়ায় থালা, ‘ডিম তো ছুলে না একেবারে।
ফেরাতে পারিনা চোখ, অলীক আগুনে জ্বলে জ্বলে
চেয়ে থাকি তার দিকে, নিমগ্ন স্মৃতির ঘনভারে-
এই কি তরুণী সেই একদা দিতো যে এনে রোজ
গোপন গোলাপ আর সচকিত আনন্দো ভোজ?
রাজা
যেন সব কালো মানুষের এক আলাদা আকাশ,
ওদের রোদের রঙ কালো আর নিত্য যে-বাতাস
চালায় তাদের তপ্ত বুকের হাঁপর যেন কালো
তা-ও; বুঝি তাই মেমফিসে প্রশান্ত চোখের আলো
দপ্ নিভে গেল তাঁর। সুবিশাল প্রেইরীর মতো
বিস্তুত উদার বুক ভাসলো নিমেষে রক্তে। নত
মুখে দ্যাখে আমেরিকা-জবার মতোই তাঁর খুন
ঝরে সেই হোটেলের বারান্দায়। সুনিশ্চিত ঘুণ
ধরে গেছে নিবার্টির পাদপীঠে, নইলে কেন আজ
মার্টিন লুথার কিং লুটোন নিহত? জাঁহাবাজ
ঘাতকের থাবা কেন কম্পমান নিশ্চিত প্রহরে?
কেন অহিংসার মুখ ঢাকা পড়ে অসিত কাপড়ে?
মিশিয়ে মার্কিনী স্বপ্নে আপন সত্তার স্বপ্ন তিনি
দেখালেন বাঁচবার পথ, পর্বতে দাঁড়িয়ে ঋণী
করলেন মানুষকে। ভবিষ্যের দিকে মুখ রেখে
হৃদয়ের খুব কাছে ওদের নিলেন হেসে ডেকে
সোনালি ভূগোলময় ভ্রাতৃত্বের প্রতিশ্রুত দেশে
অচিরে পৌঁছুনো যাবে বলে। লাঞ্ছিতের কাঁধ ঘেঁষে,
ত্যাগে, প্রেমে করেছেন অগণিত হৃদয় শাসন,
যদিও ছিল না রাজদণ্ড, মুকুট কি সিংহাসন।
শঙ্খচূড়
ঝোপেঝাড়ে ঝল্সে ওঠে, কান্তিমান নর্তক যেমন
মুহূর্তে মুহূর্তে তার স্বচ্ছন্দ গতির নক্সা আঁকে
শূন্যতায়; রূপে তার বদ্লে যায় জলা, কাঁটাবন।
প্রকৃতির রঙ্গালয়ে ভ্রাম্যমাণ, কোনো দুর্বিপাকে
সহজে কাতর নয়। এড়িয়ে ব্যাধের ফলা আর
সাঁপুড়ের তীব্র বাঁশি অস্তিত্ব ডুবিয়ে রাখে সে-ও
নিঃসঙ্গতায়। কখনো বা হয়ে যায় ক্রোধের অঙ্গার,
জ্বলন্ত দুর্বাসা যেন। ভয়ার্ত পাখিটা কে ও? কে ও?’
বলে ত্রস্ত উড়ে যায়।
যদিও সে অতি বিচক্ষণ,
তবু এক ক্রূর ভ্রান্তি পরম শক্রতা সাধে তার।
জঠরে চুল্লির দাহ, কাঁদায় বঞ্চনা; কিছুতেই
ব্যস্ততায় ত্রিসীমায় খুঁজে পায় না শিকার।
দ্বিপ্রহর অমাবস্যা-কালো; কেবলি হারায় খেই
ভ্রান্তির সিমুমে ঘুরে, ব্যর্থতার, রুক্ষ্ম যন্ত্রণায়
চেনেনা নিজেরই মুখ। অকস্মাৎ কার মন্ত্রণায়
মেটাতে সুতীক্ষ্ণ ক্ষুধা নিজেকেই করে সে আহার।
শবাহারী কীটের কোরাস
বিশ্বজোড়া অন্ধকারে ধুঁকছে কারা?
কান পাতিনা খবরে।
আলো ছাড়াই দিব্যি জানি দিন চলে যায়,
আমরা থাকি কবরে।
এই যে এখন আমরা যাকে খাচ্ছি কুরে
ছিলেন তিনি সুন্দরী।
মজ্জা মেদের স্বাদের ঘোরে কবর তলায়
অলীক গানের সুর ধরি।
তারই নামে ঊর্ধ্বশ্বাসে লিখেছে কেউ
আধুনিক গীত-গোবিন্দ।
নানা ঢঙের সুবেশ যুবার গুঞ্জরণে
ভরতো মনের অলিন্দ।
বাইরে বটে ঝল্সে ওঠে রোদের জরি,
পাখির গানে গাছ মাতাল।
জীবিতদের বাঁচার ছটায় পাচ্ছে মানে
সপ্ত স্বর্গ, পাঁচ পাতাল।
রোদের জরির ধার ধারি না, পক্ষীকুলের
সুমিষ্ট সুর যাক চুলোয়।
যে রূপসী রোদ পোহাতো, শুনতো যে গান,
এখন সেতো চুপ ধুলোয়।
ভালো তাকে বাসতো যারা, জুটতো যারা
তারই রূপের উৎসবে,
প্রশংসাতেই অষ্টপ্রহর মুখর হতো,
ধরতো তারা খুঁত কবে?
কেউবা তাদের জুয়োয় মাতে, কেউবা এখন
অন্য নারীর শয্যায়।
আশা শুধু তৃপ্তি ভরে মুখ রাখি আজ
এই রূপসীর মজ্জায়।
কবরে তার কেউ নীরবে ফুল রেখে যায়,
মাটি মাতে সৌরভে।
আমরা শুধু বেড়াই নেচে কবর তলায়
শবাহারের গৌরবে।
সকল প্রশংসা তাঁর
সকল প্রশংসা তাঁর কেননা প্রবল জনমতে
আদ্যিকাল হতে
প্রকৃতই তিনি জানি প্রবীণ ওস্তাদ খেলোয়াড়
এবং ইচ্ছায় তাঁর নিমেষেই হতে পারে গ্রাম কিংবা শহর উজাড়।
পথের বান্ধব বৃক্ষ, লতাপাতা, ঘর-বাড়ি, সরল সড়ক
দেশে কি বিদেশে
লুপ্ত হয় চিরদিন তাঁরই অদৃশ্য নির্দেশে।
রাখেন হাতের পাঁচ মধ্যে-মধ্যে-দুর্ভিক্ষ, মড়ক,
যেমন ঐন্দ্রজালিক আস্তিনের আড়ালে কৌশলে রাখে তাস,
রঙিন রুমাল, ফুল খরগোশ; হতবাক দর্শকেরা চকিতে বিশ্বাস
করে সব, অলৌকিকে দিব্যি মজে, কোনো কিছু করে না পরখ।
সকল প্রশংসা তাঁর, কেননা ইংগিতে তাঁর নামে সর্বনাশ
সোনার সংসারে আর রূপসীর শরীর সহসা হয়ে যায় পচা, গলা মাস।
সকল প্রশংসা তাঁর, করুণা অপার-
বুঝি তাই যুগে যুগে সোৎসাহে পাঠান বিশ্বে জনসন আর সালাজার।
সমান্তরাল
পাঠ শুনুন, সেই গল্পে-পড়া বিষণ্ন, অধীর
বুলবুলিটার কথা মনে পড়ে? বসন্ত-মদির
বাগানের খয়েরী ডালের শাদা গোলাপকে লাল
বানানোর অভিলাষে অস্তিত্বের সূক্ষ্ম তন্তুজাল
কাঁপিয়ে অমোঘ ছন্দে সারারাত গেয়েছিল গান
সতৃষ্ণ কাঁটায় ঝোড়ো বুক পেতে। ভোরে সে বাগান
কবরের মতো স্তব্ধ, চতুর্দিকে আশ্চর্য সৌরভ
রইলো জেগে, ফ্যাকাশে গোলাপ পেলো রক্তাক্ত গৌরব।
পাঠক গল্পের সেই
বুলবুলিটাকে মনে পড়ে?
মনে পড়ে রক্তস্নান? সেইমতো আমিও এ ঘরে
জ্বর-তপ্ত, স্বর-মত্ত, বুক রেখে বালিশের মেঘে
আবেগের পালতোলা নৌকোর গলুইয়ে রাত জেগে
কাগজের শুভ্রতায় শব্দের নক্ষত্রপুঞ্জ আনি
শূন্য ছেনে। আপনারা সেসব শব্দের রাজধানী
হয়তোবা দেখবেন সুশীতল ছাপার অক্ষরে
কোনোদিন। পাঠক, তখন পাতা-জোড়া থরে থরে
সাজানো শব্দের গায়ে, বলুনতো, অধীর আমার
হৃৎপিণ্ডের রক্তকণা পড়বে কি চোখে আপনার?
সাক্ষী
এইতো দেখছি দিব্যি টব আলো করে আছো আর
তন্বী ডাল নড়ে চড়ে; অনবোলা পাতার বাহার।
উপরন্তু কী খেয়ালে সুঘ্রাণ বিলাও মাঝে-মাঝে;
যখন দাঁড়াই এসে বারান্দায় কাজে কি অকাজে
অথবা চেয়ার টেনে বসি, দেখি দিয়েছো বাড়িয়ে
চিকন সবুজ বাহু, যেন যাবে এ-টব ছাড়িয়ে
আকাশের নীলে, ভাবি-কী করে সহজে রাখো
বাতাসের তোড় আর এমন নির্জলা মাটিকুনো
হয়েও কী করে বাঁধো রঙিন বিন্দুর সাঁকো এই
হাঁ করা বেবাক শূন্যে? বারংবার দেখি তোমাকেই
তার মধ্যে, যে তোমার পাতায় বুলোয় হাত, যার
আঁচল আটকে গেলে হঠাৎ কাঁটায়, চমৎকার
নুয়ে পড়ো, যেন যেতে দেবেনা কিছুতে তাকে, বুঝি
তাই আকর্ষণে এত নিবিড় আকুতি। সোজাসুজি
বলি, যারা কুটি কুটি ছেঁড়ে পাতা, তারা বটে পশু
কেননা তোমারও আছে প্রাণ, সাক্ষী জগদীশ বসু।
সেই একই দোষ
সেই কবে দাওয়ায় বসে শীতের রোদ্দুরে জ্ঞানবান
ময় মুরুব্বির মুখে শুনতাম মধ্যে-মধ্যে, “শোনো হে বোবার
শক্র নেই। চল্তি পথে লোকজন হাইকোর্ট দেখাতে চাইলে
মুখ বুজে থেকো আর কস্মিনকালেও সাত চড়ে করো না রা,
বোঝোই তো শুধু রোদে চুলদাড়ি হয়নি রূপালি।
কিন্তু কী জানেন, অদৃষ্টের ফেরে নই অনবোলা,
তাই বেলা অবেলায় আত্কা মুখ থেকে ফেটে পড়ে
কথা, মানে কোদালকে কোদাল বলেই
বেজায় নাড়িয়ে দিই তল্পি তল্পা উদ্বেল বাজারে।
মেলার উচ্ছিষ্ট নিয়ে কখনো চলে কি হাট? তদুপরি দিনদুপুরেই
স্পষ্ট দেখি, ডাকাত দোকানপাট করে তছনছ।
কেউ বা সাম্যের গান গেয়ে কারবারে হচ্ছে লাল রাতারাতি,
পক্ষান্তরে দেনায় বিকোয় বাস্তুভিটা কারো কারো।
যেহেতু ছিলনা হাতে সাবধানী হ্যাজাক লণ্ঠন,
পড়েছি হোঁচট খেয়ে খানা খন্দে। অতঃপর ভরাট আঁধারে
বাঁচান নগদ মূল্য সঠিক বুঝিয়ে দিতে চায়
চামচিকে লাথি মেরে। বেগতিক, তবুও তো মুখ খুলি স্বভাবদোষেই।
সেই কবে থেকে
কখনো পিতার চোখে টলটলে জলের বুদ্বুদ
দেখি নি আমরা কেউ। মনে পড়ে, একদা সন্ধ্যায়
বারান্দায় পোষা পাখিটার শূন্য খাঁচার সম্মুখে
দাঁড়িয়ে বিষণ্ন তাঁর তৃতীয় পুত্রকে বললেন
‘ছি কাঁদে না! পুরুষের চোখে কান্না বড্ড বেমানান।
তখন পিতাকে ঠিক নূহের মতোই হয়েছিল
মনে, যেন অতিদূর দিগন্তের বুড়ি ছুঁয়ে ফের
সপ্তম পায়রা তাঁর প্রতীক্ষা-কাতর হাতে এসে
বসবে সবুজ ঠোঁটে, চোখ তাঁর নির্মেঘ দুপুর।
প্রিয়তম পুত্র তাঁর অর্থাৎ কিশোর সুলেমান
মড়কের দাবাগ্নিতে চিরতরে হারালো যেদিন,
সেদিন সে ধীরোদাত্ত পুরুষের পাঁজর-খাঁচায়
কী শূন্যতা করেছিল দাপাদাপি বুঝতে পারি নি।
সেদিনও পিতার চোখ ইতিহাস বইয়ের পাতায়
দেখা কোন মূর্তির চোখের মতো হয়েছিল মনে-
কেমন সুদূর আর শুক্নো বড় বেশি নিষ্পলক।
কখনো পিতার চোখে টলটলে জলের বুদ্বুদ
দেখি নি আমরা কেউ। গতায়ূ পুত্রের কুকুরটা
যেদিন উঠোনে রইলো পড়ে স্তব্ধ, নিঃসাড় কঠিন,
‘সুলেমান’ বলে পিতা আর্তকণ্ঠে এলেন বেরিয়ে
ঘর থেকে বেসামাল। আজো দেখি, সমস্ত শরীরে
পুরোনো ফটোগ্রাফের বিবর্ণতা নিয়ে তিনি কালো
উঠোনের মাঝখানে মুষল বৃষ্টিতে নগ্ন পায়
সেই কবে থেকে ভিজছেন, ভিজছেন, ভিজছেন……
স্বপ্নহীনতায়
বুড়োটা বিরাট এক মাছের কংকাল টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে
জলজ স্মৃতির ভারে স্বপ্ন দেখেছিল
সমুদ্রের তীরে তীরে ঘুরে-বেড়ানো সিংহের।
এমন একটি স্বপ্ন চাই, অভ্রঝরা বিশাল প্রান্তরে যার
তুমিই থাকবে শুধু, তুমি।
অথচ আমার স্বপ্ন হায়রে সে কোন্ চোরা নিয়ে গেছে
সিঁদ কেটে অকস্মাৎ। আমি স্বপ্ন-তাড়ুয়ার পেছনে পেছনে
ঘুরে মরি দিনরাত; তোমাকে দেখার জন্যে ভাদ্রের রৌদ্রেও
ফেঁপে-ওঠা জনসমুদ্রের প্রতিটি তরঙ্গে ভাসি,
স্বপ্নে সমুদ্রের তীরে সোনালি বালিতে
সিংহের পায়ের ছাপ খুঁজি না কখনো।
নিদ্রার বাগানে কোনো হরিদ্রাভ ডাল ধরে তুমি
ইমন কল্যাণে ভরে ওঠো কানায় কানায়, চাই।
আপাতত আমি স্বপ্ন-তাড়ুয়ার হাড্ডিসার হাতে
খাচ্ছি মার বারবার। কখনো-সখনো
ঘুমঘোরে আওড়াই স্বপ্নহীনতায়
কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?
আমি টোটো কোম্পানির একজন, ঘুরি ফুটপাতে,
কুলীন রাস্তায় ব্যাপ্ত চৌমাথায়, কলোনিতে, শেডে;
পকেটের উজাড় বিবর থেকে দুমড়ানো, ম্লান
প্যাকেটটা বের করে বগা ফুঁকে বিরক্তিকে হাওয়ায় ওড়াই,
কখনো আবার
ভিড়ে যাই বাস-ভাড়া-কমানোর দাবির মিছিলে,
কখনোবা খবরের কাগজের অন্তঃস্তল ফুটো করে গোল
চাঁদ দেখি চুপিসারে। মনে পড়ে অতীতের মুখ; দিনগুলি
সাহানা দেবীর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের
গানের মতোই মনে হয়, কেমন সুদূর, হু-হু-
মীড়ে মীড়ে, কখনো গমকে ভরপুর। মনে পড়ে,
ভোরবেলাকার হাসপাতালের করিডরে
নার্সদের আগাগোনা, শাদা হাঁস কজন ব্যস্ততা-ঝলসিত।
কী করে নিজের দেখাশোনা করা চলে
ভালোমতো, তাওতো শিখিনি।
অথচ পাখিও বাসা আজীবন গোছগাছ করে
রাখে আর রৌদ্রের ছটায়
খড়কুটো দিব্যি মুকুটের মতো হয়ে যায়। দ্যাখো আমি শুধু
থপথপে ফুটপাতে ঘুরি, নির্জন পার্কের মতো এই বুক
খবর কাগজে ঢেকে বিবর্ণ চাটাইয়ে শুই আর
মধ্যে মধ্যে ঘুমঘোরে আওড়াই স্বপ্নহীনতায়
কে বাঁচিতে চায় হে বাঁচিতে চায়?
স্বপ্নে ঘুণ ধরে গেছে
স্বপ্নের ঘুণ ধরে গেছে, তবু দেখি সেজানের আঁকা
গাছপালা, ঘর-বাড়ি মেঘ হয়, রঙের সীমানা
পেরিয়ে সুরের রঙ হয়, দেয়ালের ঘড়ি জানা
সময়ের গণ্ডি ছেড়ে অনন্তের মহোৎসশ্বে পাখা
মেলে দেয়, গলে গলে স্রোত হয়। স্বাতী কি বিশাখা
হয়ে যায় অলকায় হর্ম্য আর মনে দেয় হানা
হৃত এক স্বর্গলোক; অপরূপ ঘরের ঠিকানা
পাই বড়ে; গোলাম আলির সুরে, রৌদ্রছায়ামাখা।
প্রত্যহ তোমাকে দেখি কখনো গভীরা চুলের বিনুনির
সহজ পটুত্বে মগ্ন, কখনো গভীর মধ্যদিনে
রাখো মুখ শুভ্র শৈশবের দিকে, অথচ তোমার
মুখে নিত্য একই রূপ খুঁজে পাই। নানান মুনির
নানা মত তোমার ও-মুখ ঘিরে। আমিতো পারিনে
মেনে নিতে রূপান্তর, ভেবো না দুর্ভিক্ষ কল্পনার।
স্মৃতি
অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে খেয়ে
খুঁজছি বাহু, খুঁজছি কালো চোখ।
কাফে-র ভিড়ে টেবিল ঘেঁষে বসে
দৃশ্য দেখি শহুরে এক লোক।
হঠাৎ যদি দৃষ্টিপথে পড়ে
তোমার চোখ, তাইতো চোখ দু’টি
বারংবার সবার চোখে রাখি।
একটু চেনা লাগলে নড়ে উঠি।
রাত্রি বাড়ে, উজাড় করে কাফে
যাচ্ছে ওরা, ঢুলছি আমি একা।
থাকবো আরো থাকবো কিছুকাল,
হঠাৎ যদি তোমার পাই দেখা।
ছিলাম ঝোড়ো যুগের কোলাহলে
গ্রন্থাগারে আমরা সহপাঠী।
পৃষ্ঠগুলো উঠতো গান গেয়ে,
হৃদয় হতো বকুল-ঝরা মাটি!
নিদ্রাতুর দেশের চৌদিকে
সোনার কাঠি জানায় দাবি-দাওয়া।
শহর গ্রামে ক্ষিপ্র হলো স্নায়ু,
লক্ষ প্রাণে বইলো কী যে হাওয়া।
বেরিয়ে এলে তুমিও কলরবে;
পাতার গানে মুগ্ধ দেখি চেয়ে-
বদ্ধ মুঠি, কারখানার কালি;
অন্ধকারে বিশ্ব গেছে ছেয়ে।
সে কবে তুমি হারিয়ে গেলে ভিড়ে,
তখন থেকে তোমাকে খুঁজি শুধু।
নানান জনে রটায় নানা কথা
হৃদয়ে আঁধি, দৃষ্টি হলো ধু-ধু।
ব্যস্ত চোখে বৃথাই ঘুরে মরি
কখনো ভিড়ে, কখনো নির্জনে।
ঝাড়তে চাই মনের কিছু বোঝা,
স্মৃতির ভার কমে না বর্জনে।