- বইয়ের নামঃ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতি পুরাতন বৃষ্টি
মেঘে-ঢাকা রাত্রি নয়, ভরা-দুপুরেই
যখন পরীর মতো গান গেয়ে ওরা আসে এই
বাংলার আকাশ থেকে নিচে
দিগন্তের ঘাসে দক্ষিণের শান্ত বিলে শহরের পিচে
আমারও প্রাণের ভাষা সুর হয়ে ঝরে
এ মাহ ভাদরে।
আবার তোমাকে পাই হৃদয়ের সৃজনী-উত্তাপে
সমস্ত শরীর হয় দীপ্ত শিখা, অন্ধকারে কাঁপে।
মেঘে-ঢাকা এই ভরা-দুপুরের কাছে
হয়তো তোমার কিছু রহস্য-নিবিড় কথা আছে
শুধুবার, তাই চোখে অপার বিস্ময়
তরঙ্গের তরণীর মতো কাঁপে, মনের নিঃশব্দ লোকালয়
দূরগামী উত্তরমেঘের
নিত্যপথে ভাষা পায় বেদনার ব্যাপ্ত আনন্দের।
যে-পথে হাঁটিনি আমি কোনো দিন, সেখানে এখন
স্তব্ধতার সুরে সুরে নেমেছে বর্ষণ
শ্রাবণের। পথের যে-কোনো গাছ, পশু, একা পাখি, সারি সারি বাড়ি
মহাশ্চর্য মেঘ হয়ে যায়
বৃষ্টির ধোঁয়ায়।
কখনো যাবে না চেনা কে ছিল ঘুমিয়ে
না-দেখা পল্লীর
মাটির দেয়াল-ঘেরা দূর ঘরে স্বপ্ন মুড়ি দিয়ে
এমন বৃষ্টির
আচ্ছন্ন দুপুরে মিশে। পাশে তার কেউ
ছিল না কি জেগে একা রমণীর ঘুমের সৌরভে?
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু’দিনের ঘরে।
অপাঙ্ক্তেয়
যেহেতু লৌকিকতার দড়িদড়া ছিঁড়ে বেপরোয়া
উঁচিয়ে মাস্তুল সুন্দরের ভাস্বর সে নীলিমায়
ভ্রমণবিলাসী তাই সম্মিলিত মুখর প্রস্তাবে
দিয়েছ উন্মাদ আখ্যা, উপরন্তু চিরশক্র ভেবে
আমাকে করেছ বন্দি সন্দেহের অন্ধ ঊর্ণাজালে।
অথচ নারীর গর্ভে তমসায় নক্ষত্র-খচিত
আয়ুর অবোধ স্বপ্নে জন্মেছি আমিও, দন্তহীন
বাসনায় নিয়েছি অধীর মুখে স্তনাগ্র কোমল,
আর জুয়াড়ির মতো আপনাকে করেছি উজাড়
তীব্রতায় ধাতুর উজ্জ্বল মদে, ধুতুরার ঘ্রাণে।
মিথ্যাকে কখনো ভুলে সুন্দর ফুলের রমণীয়
স্তবকের মতো আমি পারিনি সাজাতে বঞ্চনায়,
বরং করিনি দ্বিধা কণ্ঠে তুলে নিতে আজীবন
সত্যের গরল। ফলত সে উন্নদ্র তৃতীয় চোখ
অন্ধের বিমূঢ় রাজ্যে বাদ সাধে বলে ক্রোধ জ্বলে
বারবার আত্মতৃপ্ত এই অন্ধ কূপের গভীরে।
নেকড়ের মতো সব মানুষের দঙ্গল এড়িয়ে,
মাংসের মূঢ়তা ছেড়ে নৈঃসঙ্গে সম্পন্ন হয়ে চলি;
উত্তপ্ত তোমার মতো শরীরের পৌত্তলিক যেন
অর্পিত, গ্রথিত প্রাণ ভীষণের আগ্নেয় মালায়।
জীবনকে সহজ নিয়মে নেয়া যেত প্রথামতো,
কিন্তু তবু জ্যামিতির নেপথ্যে মায়াবী গুঞ্জরণে
মজেছি স্বতই দুঃখে অর্থ থেকে অর্থহীনতায়।
কুৎসার ধারিনি ধার, বরং নিজেরই আচরণে
বিপন্ন হয়েও শুধু সারাক্ষণ অস্তিত্বের ধার
রেখেছি প্রখর তীক্ষ্ণ আর ব্যালে নর্তকের মতো
চেয়েছি গতির ধ্যানে অনন্তের একটি মাধবী
উন্মোচিত আবর্তিত হৃদয়ের হলুদ আকাশে।
অথচ নিশ্চিত জানি জীবনের সুকান্ত আপেল
অলক্ষিতে রক্তিম চাঁদের মতো ঝরে সুনিপুণ
কীটের সুখাদ্য হবে যথারীতি। মাঝে-মাঝে তবু
নিজের ঘরের ছিদ্রে চোখ রেখে দেখি পৃথিবীকে,
যেমন বিকারী দেখে যুগলের মদির নগ্নতা,
কামকলা, অবসাদ, নিদ্রায় মধুর শিউরনো।
তোমরা সজ্জন সহৃদয়, বলি হৃদয়ের স্বরে
আমাকে গ্রহণ করো তোমাদের নিকানো উঠোনে
নারীর আর শিশুর ছায়ায় আঁকা, রক্তকরবীতে।
আমার জীবনে নেই তৃপ্তির গৌরব, আর আমি
অর্থ খুঁজি চক্রে চক্রে, সমর্পিত মহাশূন্যতায়।
কী অর্থ নিহিত তবে নিপতিত গাছের পাতায়?
অ্যাপোলোর জন্যে
অ্যাপোলো তোমার মেধাবী হাসির সোনালি ঝরনা
শিশু পৃথিবীর ধূসর পাহাড়ে এখনও কি রবে লুপ্ত?
আমরা এখানে পাইনি কখনো বন্ধু তোমার
সোনালি রুপালি গানের গভীর ঝঙ্কার,
শাণিত নদীর নিবিড় বাতাস মানবীর মতো ডাকে চেতনার রাত্রে,
তবুও এখানে আমরা সবাই বিবর্ণ রোগী পৃথিবীর পথে,
হৃদয়ের রং মনের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা ফেলেছি হারিয়ে।
ত্র্যাপোলো তোমার মেধাবী হাসির সোনালি ঝরনা
শিশু পৃথিবীর ধূসর পাহাড়ে এখনও কি রবে লুপ্ত?
রাত্রি। রাত্রি। অথই রাত্রি। নীল সমুদ্র মনের কিনারে ফুলছে।
অতিদূর ধু-ধু সময়হীনতা সময়ের কোনো তন্দ্রাকে মুছে
নির্জন সেই আকাশপ্রদীপে, শিশিরে জলে কাঁপছে।
দেয়ালে টাঙানো হরিণের ছালে অরণ্যমতী জীবনের গাঢ় কান্না,
অরণ্য তুমি ক্ষমা করো শুধু-চেতনা প্রসারী।
মহতী গানের ধ্বনি বুকে পুষে তোমাকে ভুলেছি আমরা।
অতিদূর ধু-ধু সময়হীনতা সময়ের কোনো তন্দ্রাকে মুছে
নির্জন সেই আকাশপ্রদীপে, শিশিরের জলে কাঁপছে!
সান্ধ্যভাষার দীপ্তি জড়িয়ে কার যেন এক অপরূপ মুখ ক্ষুব্ধ
ক্ষুব্ধ আমার মনের ক্লান্ত গোধূলি-শিখায়, জানালার প্রীত আকাশে।
চোখের গভীরে সুদূর-অতল কাস্পিয়ানের টলটলে নীল কেঁদেছে,
অত্যাচারের হিংস্র ব্যথায় নিজের হাতেই ছিঁড়েছে বুকের
সোনালি হরিণ দীর্ণ সে-নারী ফাল্গুনি মন হারাল?
তবুও একটি গভীর-রুপালি পূর্ণিমা জ্বলে মানবীর ছেঁড়া হৃদয়ে।
ক্লীব সমাজের প্রবীণ ক্ষমতা কেড়েছে অনেক
প্রণয়ী মনের উজ্জ্বল আর নরম রজনীগন্ধা।
রাত্রি। রাত্রি। অথই রাত্রি। নীল সমুদ্র মনের কিনারে ফুলছে!
অ্যাপোলো শুনছ? নামল এখানে যাদের ধূসর সন্ধ্যা,
পৌষ এসে ডাক দিয়েছে তাদের শূন্য ভাঁড়ারে
ঠোঁটে তুলে নিতে ইঁদুরের মতো মৃত্যু!
ধু-ধু প্রান্তরে আনাগোনা করে ‘প্রাচী’র প্রাচীন ছায়ারা,
ম্লান ঘোড়াদের আর্ত চোখের বিষণ্ন রোদে
খুঁজব কি বলো মধ্যযুগের ক্লান্তি?
নেমেসিস-হাসি কেঁপেছে আবার প্রাণ ঝরে ফের জীবনের মানচিত্রে,
অ্যাপোলো! অ্যাপোলো! প্রবাল ঠোঁটের, চেতনা-প্রসূত-
সোনালি রুপালি মেয়েরা এখানে আসবে?
আত্মজীবনীর খসড়া
গলায় রক্ত তুলেও তোমার মুক্তি নেই
হঠাৎ-আলোয় শিরায় যাদের আবির্ভাব,
আসবেই ওরা ঝড়ের পরের পাখির ঢেউ।
তাদের সুদূরে ফিরিয়ে দেবার মন্ত্র যদি
জানতে, তবে কি প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থতার
কাদাবালি মেখে সত্তা তারায় আত্মজ্যোতি
কখনো হারায়, লোকনিন্দার তীক্ষ্ম হুলে
অচিরে বিদ্ধ অকালবৃদ্ধ সহজে ব’নে
কেটে যেত কাল আকাশকুসুম জল্পনায়?
তারা যাকে বলে সফলতা তার চিহ্ন তুমি
সারা পথ হেঁটে এখনও কিছুই পাওনি খুঁজে
সহজ তো নয় স্বর্গসিঁড়ির আশায় বাঁচা।
যার দেখা পেয়ে চলতি পথের সূর্যোদয়ে
মুগ্ধ তরুণ অমরত্বের মন্ত্র পেল,
অচেনা মাঠের বিহ্বল থামে দাঁড়িয়ে একা
পেতে চাও ঐ নদীর নিবিড় শ্রাবণে যাকে,
ইচ্ছে-জোয়ারে ভেসে-ভেসে তুমি ট্রেনের পথে
নেমে যাও সুখে হঠাৎ বেঠিক ইস্টিশনে
খেয়ালি আশায় সন্ধানে যার দিনের শেষে
গ্রামান্তে কোনো, তাকেই তো বলো সুন্দর, না?
গোলকধাঁধায় তাকে খোঁজা ভার সত্য জেনো,
তার জন্যেই জপেছ গানের কত-না কলি,
পথ চেয়ে আছ সকল সময় প্রতীক্ষায়
কে জানে কখন আসবে সে তার শ্রান্ত পায়ে-
আসবে যেদিন কী দিয়ে বরণ করবে তাকে?
তোমাকে দীর্ণ করে যারা আসে, প্রস্ফুটিত
পদ্মের মতো সৃজনী আভায় কামসুরভি
ছড়ায় হৃদয়ে, কোটি জ্যোতিকণা বিলায় মনে,
সমস্ত রাত একা-একা ঘরে চার-দেয়ালে
মাথা খুঁড়ে তুমি মরছ যাদের প্রতীক্ষায়
চিনেছ তাদের বহুবার তবু কেন যে এই
লগ্নে রক্তে কুমারীর ভীরু চঞ্চলতা,
আসবেই ওরা-পারবে না তুমি ফেরাতে আর।
ভেবেছ কখনো সুরের সভায় আসন পাওয়া
সম্ভব হবে? এই যে ছড়ানো কথার কালো
দুরাশায় আজও জোনাকি-জীবন, কখনো তারা
দূরের শরতে স্মৃতিগন্ধার পাবে কি আলো?
এ-কথা কখনো জানবে না তবু মৃত্যু হবে।
শহর জেগেছে, দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি,
রোগীর শরীরে নামল নিদ্রা হাসপাতালে,
যারা কোনো দিন ভুলেও পেল না আপন জন
ছেঁড়াখোঁড়া সেই কজন রাতের জুয়োশেষের
ক্লান্তিতে ফের ভিড়ল ধোঁয়াটে রেস্তোরাঁয়।
আস্তাবলের সহিস ঘোড়ার পিঠ বুলোয়,
শীতের শুকনো ডালের মতোই ভিস্তি বুড়ো
কেঁপে-কেঁপে তার জল-মসৃণ মশক বয়;
পথের কুকুর হাই তুলে চায় ধুলোয়, কেউ
জানল না ভোর ফুটল তরুণ ফুলের মতো,
খণ্ডিতা নারী এখনও আলোর আলিঙ্গনে।
আজও আছে চিরকস্তুরীটুকু লুকোনো মনে
সেই সৌরভে উন্মন তুমি, তখন জানি
দেয়ালে তোমার কাঠকয়লার আঁচড় পড়ে।
একান্ত গোলাপ
আমার হৃদয়ে নেই লোকাতীত একান্ত গোলাপ
সৌরভের উন্মোচনে যার রূপসী মহিলা তুমি,
তুমি হবে প্রমোদের রাণী নেপথ্যে বসন্ত দিনে।
বরং হৃদয় আজ ভয়াবহ তীব্র তিক্ত গন্ধের অধীন। ভ্রমে যদি
নিষ্ঠুর দুর্গন্ধে ভরা এই হৃদয়ের মনে করো
অলীক অম্লান ফুল, সে কার চক্রান্ত তবে, কার?
আমার হৃদয় যেন অতীতের বিধ্বস্ত নগর,
যেখানে প্রেতের মতো ভাঙা থামে নিশান্তের হাওয়া
মাথা কোটে অবিরাম, শূন্যতায় তারার বৈভব।
মানি না আত্মার আয়ু যতিহীন, স্বর্গ-নরকের
প্রাক্তন কাহিনী শুনে বিচলিত হইনি কখনো।
দেহের বিনাশ চলে পরপারে পুনর্মিলনের
উৎসব উজ্জ্বল হবে’-করব না সে-কথা স্বীকার।
বিশ্বাসের ঝুলি ঝেড়ে অদ্যাবধি পাইনি তবুও
অন্তত একটি কণা সান্ত্বনার। তাই বলি, তুমি
আমার কামের ফুলে মঞ্জরিত হও দ্বিধাহীন,
তোমার অধর দাও দাও তুমি মধুর আলস্যে ভরা কেশের মিনার,
এবং বিশ্বাস করো তোমাকে যে ভালোবাসি, তার
চিহ্ন তুমি কখনো পাবে না খুঁজে প্রথাসিদ্ধ পথে।
ওই মৌন আকাশের
ওই মৌন আকাশের শবাধারে মৃতা সুন্দরীর
নিদ্রিত মুখের মত পাণ্ডু চাঁদ! কয়টি জোচ্চোর
নৈশ আস্তানায় জোটে, যেন খিন্ন মাছি ঊর্ণাজালে।
শিহরিত আমার শহর কত স্খলিত চরণে।
স্বপ্নে দেখি সিমেরীর রাজ্যে আমি যুবরাজ আর
বাহুলগ্না শাহজাদি আমার সপ্রাণ, দীপ্ত কামে
মঞ্জরিত। অথচ আবার ঘুঁটে-কুড়ানির হাত
সযত্নে সেলাই করে আমার মলিন পরিচ্ছদ।
কুকুরের দাঁতে বিদ্ধ হৃদয় আমার, উন্মোচিত
সবার চোখের নিচে, ছিন্নভিন্ন, নগ্ন, অসহায়।
চৌদিকে প্রেতেরা মত্ত ছায়ানাট্যে অফুরান, তবু
বাসনার নৌকো দোলে দুর্নিবার তরঙ্গ-শিখরে।
নাগরিক রাত্রি এই রজনীগন্ধার মতো ঘ্রাণে
উন্মীলিত অনন্তের বিশাল অরণ্যে। অন্ধকারে
প্রৌঢ় কবি হাতড়িয়ে ফেরে লোকালয়ে অবিরাম
নর্দমায় নোংরা জলে প্রজ্বলিত দুর্লভ মানিক।
শোণিতে তারার স্রোত খরশান, মাল্লাদের গানে
মাঝে-মাঝে সচকিত চৈতন্যের ভাস্বর নীলিমা।
মাস্তুলে গ্রথিত দেখি রক্তাক্ত শুশুক, ছেঁড়াখোঁড়া;
রঞ্জিত পাঁকের মাঝে উচ্চকিত কোকিলের স্বর!
আসার, শটিত ক্লেদে কলঙ্কিত অস্তিত্বের পট,
আর আমি প্রমত্ত দঙ্গলে এই চিহ্নিত, ধিক্কৃত
শিল্পের শহীদ। শাশ্বতীরে খুঁজে ফিরি, আর দেখি
নিয়ত রাত্রির চোখ সুশোভিত পাপের কাজলে।
কথার জন্যে
তা চলে কী করি?
একটি কথার জন্যে ভেবে মরি সারাক্ষণ, অথচ কথার
অন্ত নেই বিশাল ত্রিলোকে, প্রাণবন্ত শত কথা
-ব্যথার কান্নার জলে ভেজা,
অব্যক্ত আনন্দে আভাময়-
শুধু কথা ফোটে চিরকাল। এই মাটির সংসারে
নিতান্ত যে আটপৌরে লোক,
তারও চোখ দীপ্ত হয় কথার অনলে।
পথে-ঘাটে গঞ্জে কি বাজারে
হাজারে হাজারে তারা ধ্বনিময়। শ্রুতির জানালা খুলে রাখি।
কথা,
গাছের পাতার মতো সহজ-সবুজ;
কথা,
রহস্যের মেঘে-ঢাকা
কথা,
তত্ত্বের ঘোরালো
আবর্তের মতো
নিষ্ঠুর-কুটিল;
কুমারীর কণ্ঠে-জাগা কুহকিনী কথা আছে,
আছে অফুরন্ত অর্ধস্ফুট কথা; আর আছে কথা
কবির চৈতন্যলোকে সুপ্ত, স্তব্ধ প্রতীক্ষায়।
শুধু তাকে বলা যায়-এমন কথার সাড়া নেই
অসংখ্য কথার ভিড়ে, হাটে-মাঠে। যেখানেই থাক
আসে না সহজে তারা এই অন্তর্লোকে।
কবর-খোঁড়ার গান
মদের নেশা খাঁটি সারা জাহানে,
বাকি যা থাকে তার বেবাক ঝুট।
বাঘিনী যেন সেই মেয়েমানুষ,
যার আঁধারে কাল কেটেছে রাত।
যার আঁধারে কাল কেটেছে রাত
নেশার মতো তার স্মৃতির জ্বালা।
আলিঙ্গনে তার দুনিয়াদারি
নিমেষে ভুলে যাই অতল মোহে।
নিমেষে ভুলি সাধ অতল মোহে।
মোহিনী ও-মুখের মিথ্যা বুলি
সত্য সার ভাবি, এবং আমি
ধারি না ধার কোনো মহোদয়ের।
ধারি না ধার কোনো মহোদয়ের
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
নিপুণ বিদ্রূপে অন্তহীন
দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।
দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।
কোদালে অবহেলে উপড়ে আনি
মাটির ঢেলা আর মড়ার খুলি।
শরিফ কেউকেটা কী করে চিনি?
শরিফ কেউকেটা কী করে চিনি?
মাটির নিচে পচে অন্ধ গোরে
হয়তো সুন্দরী কুরূপা কেউ।
কোরো না বেয়াদাবি বান্দা তুমি।
কোরো না বেয়াদবি বান্দা তুমি।
বাদশা নেই কেউ, গোলাম সব,
বেগম চায় পেতে বাঁদীর সুখ
আউড়ে গেছে কত সত্যপীর।
আউড়ে গেছে কত সত্যপীর
সমরকন্দ্ আর বোখারা তার
রূপসী মাশুকের যোগ্য নয়।
সেসব ছেঁদো কথা, মস্ত ফাঁকি।
সেসব ছেঁদো কথা, মস্ত ফাঁকি।
বিবেক বিলকুল লক্ষ্মীছাড়া,
মনের পশুটাও চশমখোর।
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
হয়তো রুটি আর গোলাপ-কুঁড়ি
যুগ্মতায় জ্বলে চাওয়া-পাওয়ায়,
নেশার মতো খাঁটি নেই কিছুই।
নেশার মতো খাঁটি নেই কিছুই,
সাচ্চা শুধু এই দেহের দাবি।
মানতে নয় রাজি বেয়াড়া মন
দীন ও দুনিয়ার ধাপ্পাবাজি।
কাব্যতত্ত্ব
গনগনে চুল্লির আলোর খইয়ের মতো কথা ফোটে
অন্তর্লোকে, রাশি রাশি। আর আমি
তাদের ছড়িয়ে দিই ঢেউয়ের ফেনায়, সপ্তর্ষিমণ্ডলে,
পাহাড়ের চূড়ায়, উইয়ের ঢিবিতে, যেখানে খুশি।
গাছের সতেজ পাতায়, রৌদ্র-লাগা, বৃষ্টি-মোছা দেয়ালে,
ঘরের উন্মুক্ত কপাটে, রুটির বাদামি গড়নে,
শুকনো ফলে, অলিন্দে চড়ুইয়ের বুকে গাঁথা সেসব কথা
নক্ষত্রের অভিযাত্রার মতো বিন্দুতে বিন্দুতে
কম্পমান, মুহূর্তের অধীশ্বর। সেই মুহূর্তে
মাতাল ছাড়া কী-ই আর হতে পারি আমি?
রাত্রির পীড়নে উন্মথিত আমি নক্ষত্রের ঝড়ের মতো
শব্দপুঞ্জ থেকে ছিঁড়ে আনি কবিতার অবিশ্বাস্য শরীর
-সৌন্দর্যের মতো রহস্য-ঢাকা, নগ্ন আর উন্মীলিত।
আমার সেই নির্মাণে মাননীয়, পক্বকেশ পণ্ডিত
হন্তদন্ত হয়ে খোঁজেন গ্রিক পুরাণের উল্লেখ,
দেশী কিংবা বিদেশী কবির প্রভাব শুঁকে বেড়ান তাঁরা
নিপুণ গোয়েন্দার মতো, আর না-চাইতে বিলিয়ে দেন
ঝুড়ি ঝুড়ি মূল্যবান কথা,
হায় রে মূল্যবান কথা!
বলতেই হয় তাঁরা বুদ্ধিমান, মগজওয়ালা দামি মানুষ,
তাঁদের ভয়ানক বিদ্যের স্কেল দিয়ে মেপে দেখেন
সৌন্দর্য, কিন্তু কী মূঢ় তাঁদের বিবেক!
জানি সেই বুদ্ধির চত্বরে কোনো দিন ছিটিয়ে পড়বে না
প্রেমের মতো সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, জন্ম নেবে না
আগুনের শিকার মতো
রাশি রাশি অফুরন্ত সবুজ ঘাস, ভুলেও কোনো দিন
তাদের চোখে, মনে উড়বে না তারার ঝড়ের ধূলি,
এতই সাবধানি তাঁরা, এতই বিবেকী!
লোকে বলে বিজ্ঞজন সহস্রচক্ষু, অথচ প্রিয়তমা,
কী আশ্চর্য, কিছুতেই তাঁরা দেখতে পান না
আমার কবিতায় অর্পিত তোমার চুলের ছায়া,
নিঃশ্বাসের সুগন্ধি তাপ, আর আমার হৃৎস্পন্দন।
কোনো একজনের জন্যে
এতকাল ছিলাম একা আর ব্যথিত,
আহত পশুর অনুভবে ছেঁড়াখোঁড়া।
দুর্গন্ধ-ভরা গুহায়িত রাত নিষ্ফল ক্রোধে দীর্ণ,
শীর্ণ হাহাকার ছাড়া গান ছিল না মনে,
জানি প্রাণে ছিল না সতেজ পাতার কানাকানি
-এমনকি মরুভূমির তীব্রতাও ছিল না ধমনিতে,
স্বপ্ন ছিল না,
ছিল না স্বপ্নের মতো হৃদয়।
এই উন্মথিত সময়ের আকাশ চিরে যাব
-এমন সাহসী ডানা ছিল না আমার।
রাত্রিময় আকাঙ্ক্ষাগুলো বেড়ে ওঠেনি সজীব গাছের ছন্দে,
দমকা বাতাসের আনন্দে নেচে ওঠেনি বুকের তারা।
শুধু রূঢ় অনিশ্চয়তার পাথরে
এতকাল ধরে ক্ষয়ে গেছে দিনগুলি, রাতগুলি।
মৃত্যুপ্রতিম স্মৃতির সরীসৃপ নিয়ে
আমি বিব্রত, বিপজ্জনক।
বিশ্বাসের কোনো ঐন্দ্রজালিক তারা
আলো বিলোয়নি সত্তায়, তবু
উদ্ধারের বাসনায় গ’লে প্রার্থনা হয়েছি কতদিন।
অনিদ্রার বিভীষিকায় তুমি এলে
-অনন্তের একবিন্দু আলো-
বাহুতে উজ্জীবনের শিখা,উদ্ধারের মুদ্রা উন্মীলিত।
দমকা বাতাসের আনন্দে কেঁপে উঠল বুকের তারা;
শশকের উৎকণ্ঠা নিয়ে তোমাকে দেখলাম,
রুপালি ঊর্ণাজালের শক্রতা সাধল
দুরন্ত উদ্দাম একরাশ চুল।
কে জানত এই খেয়ালি পতঙ্গ, শীতের ভোর,
হাওয়ায় মর্মরিত গাছ,
ঘাসে-ঢাকা জমি, ছায়া-মাখা শালিক
প্রিয় গানের কলি হয়ে গুঞ্জরিত হবে
ধমনিতে, পেখম মেলবে নানা রঙের মুহূর্ত।
কে জানত লেখার টেবিলে রাখা বাসি রুটি
আর ফলের শুকনো খোসাগুলো
তাকাবে আমার দিকে অপলক
আত্মীয়ের মতো?
কোনো পরিচিতাকে
জানতাম একদা তোমার চোখে জারুলের বন
ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ
রৌদ্রের জোয়ার কত। সবুজ পাতায় মেশা টিয়ে
তোমার ইচ্ছার ফল লাল ঠোঁটে বিঁধে নিয়ে দূরে
চরাচরে আত্মলোপী অলীক নির্দেশে। শাশ্বত সে
বৃক্ষের গৌরবে তুমি দিয়েছ স্বামীকে দীপ্ত কামের মাধবী
শিশুকে সুপুষ্ট স্তন। দাম্পত্য প্রণয়ে সোহাগিনী
প্রেমিকার মতো হৃদয়ের অন্তহীন জলে, ঢেউয়ে
খর বাসনাকে ধুয়ে দান্ত সাধকের ধ্যানে তবু
গড়েছ সংসার। প্রত্যহের দীপে তুমি তুলে ধরো
আত্মার গহন নিঃসঙ্গতা, নকশি-কাঁথা-বোনা রাতে
স্বপ্নের প্রভায় জ্বলো। তোমার সত্তায় কী উজ্জ্বল
নিঃশঙ্ক অপ্রতিরোধ্য ফল জ্বলে, স্বর্গের সম্ভার।
এবং এখন জানি করুণ কাঠিন্য ভরা হাতে
আত্মায় নিয়েছ তুলে নগরের ফেনিল মদিরা,
আবর্তে আবর্তে মত্ত কাম, প্রাণে স্থির অন্ধ গলি।
হে বহুবল্লভা তুমি আজ কড়ায় ক্রান্তিতে শুধু
গুনে নাও নিষ্কাশিত যৌবনের অকুণ্ঠ মজুরি।
রূপের মলম মেখে সুচতুর মোমের ঊরুর
মদির আগুনে জ্বেলে পুরুষের কবন্ধ বিনোদ
কখনো জানিনি আগে এত ক্লান্ত, এত ক্লান্ত তুমি।
ক্ষত এবং ধনুক
বহুদূরে লোকালয় উন্মীলিত মাধবীর মতো।
অস্পষ্ট আঘ্রাণ তার স্মৃতিকে জোগারে আমরণ
নিভৃতে উচ্ছিষ্ট মধু আর আমি দ্বৈপায়ন, রণ-
ছুট আজ, স্বেচ্ছাবন্দি; লোনা জলোচ্ছ্বাসে অবিরত
মেলাই বিষাদ-গাথা। চেয়ে দেখি সহযাত্রী কত
ভাসিয়েছে সহস্র উজ্জ্বল তরী; আমার চরণ
কৃমি-প্রসূ কাদায় প্রোথিত বলে নিয়েছি শরণ
পশুর দঙ্গলে আর জ্বলে শটিত আমার ক্ষত।
ক্ষতের দুর্গন্ধে ভীত পশু, দূরে মরালের বুক
স্বচ্ছ নীলিমায় খোঁজে স্বর্গসুখ; আর আমি এই
দুর্গম কণ্টকাবৃত বনে মাল্লার গানের প্রতীক্ষায়
জ্বলি শুধু হাতে নিয়ে যৌবনের মতন ধনুক।
জানি ঘৃণ্য প্রোজ্বল আমার ক্ষত, তবু নিমিষেই
অক্ষয় ধনু জ্বলে সবার উদ্বাহু আকাঙ্ক্ষায়।
খাদ
সেখানে গভীর খাদ আছে এক কুটিল, ভয়াল
অতিকায় সিংহের হাঁয়ের মতো অদ্ভুত শূন্যতা
চতুর্দিকে ব্যাপ্ত তার, আদিগন্ত বিভ্রমে বিহ্বল।
অতল গহ্বরে সেই আছে শুধু পাঁক, পুঞ্জীভূত
আবর্তিত ক্রুদ্ধ ক্রূর অন্ধ পাঁক, শুধু পাঁক।
আকাঙ্ক্ষিত ফুলদল, লতাগুল্ম, পদ্মের মৃণাল
অথবা চিকন মৃগ কিছুই হয় না প্রত্যাখ্যাত
গলিত শবের কীট, কৃমিপুঞ্জ-ঘৃণিত জটিল-
কিছুই জন্মে না তাতে, মৃত্যু ছাড়া জন্মে না কিছুই।
অপটু ডানার শীর্ণ পাখির শাবক, বুড়ো কাক,
মাঠের নিরীহ গোরু, দিনান্তের তৃষিত মহিষ
অথবা চিকন মৃগ কিছুই হয় না প্রত্যাখ্যাত
অতল গহ্বরে সেই। অতর্কিতে হয়তো কখনো
বিভ্রান্ত পথিক কোনো রাত্রির মোহিনী অন্ধকারে
পাঁকের আবর্তে ডোবে নিরুপায়, ব্যর্থ আর্তনাদ,
তিলে তিলে নিমজ্জন, যথারীতি অন্তিমে বিলোপ।
এবং আমিও আজ নিমজ্জিত অন্তহীন খাদে।
দুর্গন্ধের সুতীব্র পীড়নে রাত্রিদিন বিভীষিকা
সমপরিমাণে; ক্রমাগত কেবলি জড়াই পাঁকে।
নিঃশ্বাসে নরক ফোঁসে, আমার অধীর আত্মা সে-ও
গরলের বিন্দু হয়ে ঝরে সারাক্ষণ, আর দেখি
আকাশে নক্ষত্র-গুচ্ছ, আমি শুধু মরালের মতো
অন্তিম গানের ধ্যানে প্রজ্বলিত, গুঞ্জলিত খাদ।
গোষ্পদ এবং মন
এখানে সমুদ্র নেই, আছে শুধু অন্ধ এঁদো ডোবা,
উইঢিপি সগৌরবে জুড়ে রয় পর্বতের স্থান,
আর ক্ষিপ্ত বায়সের গণ্ডগোলে কোকিলের গান
ডোবে অকস্মাৎ, দূরে ভাঙা চাঁদ একমাত্র শোভা।
এবং জ্ঞানীর পার্টে মূর্খ ভাঁড় কুড়োয় বাহবা
প্রতিদিন দ্বিধাহীন; নিমেষেই সাধের বাগান
ভরে ওঠে সকণ্টক ফণিমনসায়, অফুরান
দুঃস্বপ্নের প্রেত করে আনাগোনা; চেয়ে থাকি, বোবা।
অর্থাৎ কিছুই নেই, র’য়ে গেছে একখানি মন-
যেখানে গহ্বর অতল সমুদ্র জেগে রয়
পাশাপাশি, হাঙরে প্রবালে দ্বন্দ্বময়। কী ফসল
ফলবে সেখানে কল্পনার মন্বন্তরে? সারাক্ষণ
জপেছি প্রথম পাঠ জীর্ণ টোলে-জেনো সুনিশ্চয়,
আশার মৃণালে জ্বলে জ্বীনের সুবর্ণ কমল।
ছিল সে-ও
ছিল সে-ও ধুলোর নিঃসঙ্গ পথে, ছিল কোলাহলে
সমর্পিত চিরদিন। দিঘি তাকে চেয়েছিল বলে
সোনার শরীর নিয়ে ব্যর্থ হল নারী।
ডুবিয়ে পায়ের পাতা, সহচরী শাড়ি
ডুবিয়ে নিঃসঙ্গ জলে নামল যখন-
ঝাপসা চোখ, মেঘ হল মন।
অত শান্ত জলের কুহকে তার সমাজ সংসার হবে লীন
কেই তাকে বলেনি সেদিন।
মাচায় অর্পিতা লতা জানে যার প্রীত পরিচয়,
ভুলব কি তার নাম? দূরে কাছে একই হাওয়া বয়?
প্রসারিত ধুলোয় নিঃসঙ্গ পথ-রেখা;
কাকে দেখে ঘুরে ঘুরে উঠানে কুকুর কাঁদে একা?
খাঁচার পাহাড়ি পাখি সে-ও যেতে চায়
অজানা কোথায়-
গাছে-গাছে মূর্ত ভাষা, পৃথিবীর সমস্ত আকাশে
বেলা প’ড়ে আসে।
জর্নাল, শ্রাবণ
১
তুমি আসবে না
নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ এই চেনা
বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল দুপুরে বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে
এসে শিশিরের মতো স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে, হাওয়ায়
প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়;
গানের গুঞ্জনে আর উঠবে না ভরে
দক্ষিণের শূন্য ঘর প্রহরে প্রহরে।
যে-চোখে ফুলের ঝাড়, ফলের গুচ্ছের ভার দেখি
সেই চোখ চোখই থাকে অনাদি,, সাবেকি;
যখন তোমার দিকে চাই, চোখ আর চোখ নয়,
থরথর কম্পিত হৃদয়।
দুপুরের ছায়া মনে হালকা পর্দা তুলে
তুমি এসে দাঁড়ালে কি পিঠ-ছাওয়া চুলে?
শুধু ভুল ভেঙে দিতে ঘরময় বয়ে গেল বেনামি নিঃশ্বাস।
বাতাসের ঘূর্ণি নাচে বাগানের শুকনো পাতা ওড়ে পথে, পিচে-
তরতর সিঁড়ি বেয়ে সূর্য নামে পশ্চিমের, দোতলার নিচে
মশকের ভারে কুঁজো ভিস্তি, জলোচ্ছ্বাস। ভেজা ঘাস।
যাকে ভুলি, যোজন-যোজন দূরে যে যায় হারিয়ে
তাকে হাতড়িয়ে
আনা ফের স্মৃতির রোদ্দুরে-
অবিকল যেন ফুল হয়ে যাওয়া ভ্রমরের সুরে।
দূরত্বের তটরেখা ব্যাপ্ত জাগরণে
এই চরাচরে- সব ব্যবধান ঘুচে যায় মনে,
জানি ঘুচে যায়
অরণ্য মর্মরে দূরে স্বপ্নের ছায়ায়
একই স্রোতে গ’লে গিয়ে, একই কামনার সুরে ভেসে
দু’দিকের অভিসারী দুই নদী মেশে।
পাখির মতন কেউ বলে-
‘অজস্র তারার ধূলি যাবে শিশিরের জলে
ঘুমহারা জানালার রাত শেষ চলে।
সন্ধ্যার হাটের মেলা ভেঙে গেলে যার
ভয় থাকে কিছু হারাবার
সে-ও অনুরাগে হাত ছোঁয় কত চেনা ও অচেনা
পথিকের-ভোরের স্বপ্নের ডালে।
তুমি আসবে না।
২
পৃথিবী শেখায় বহু তত্ত্বকথা, সব টুকিটাকি
আশ্চর্য খবর জানা যায় গ্রন্থকীট সেজে ব’সে;
যেখানেই থাকি
কোথাও আকাশ থেকে দূরে তারা খ’সে
গেলে টের পাই;
সাংহাই জ্বলেছে কবে, কার চোখে ট্রয় জ্ব’লে পুড়ে হল ছাই,
রুশের বিপ্লবে কারা করতালি পেয়েছে প্রচুর,
জীবনের নানা ছলাকলা আর দূর
আকাশের পরপারে যা রয়েছে লেখা
একদিন সবি যায় শেখা
শিল্পের জটিল সূত্র উন্মীলিত হয়,
রবীন্দ্রনাথের গান সময় সময়
হাওয়া দেয়, হাওয়া দেয় সত্তার গভীরে,
তবু জানি, মেয়ে, এত আলো মেখে মনের তিমিরে
কী আশ্চর্য আজও মনে হয়-
তোমার হাতের স্পর্শ, কপালের টিপ,
তোমার কণ্ঠের মৃদু গুনগুন ধ্বনি, হাসি, কালো
চুল আর অতল চোখের দুটি শিখা দিতে পারে যত আলো
তত আর দেয় নাকো অন্য কোনো জ্ঞানের প্রদীপ।
৩
জানি না রাত্রির কানে কার নাম প্রার্থনার মতো
বলো তুমি ঘন-ঘন অন্ধকার নিঃশ্বাসের স্বরে,
পুবের জানালা খুলে গুনগুন গান গেয়ে শেষে
যখন শয্যায় জ্বলে দেহ, কার মুখ ভেবে-ভেবে
তোমার চোখের হ্রদে নামে সব ঘুমের অপ্সরী,
কার স্বপ্ন দেখে, কার তীব্র চুম্বনের প্রতীক্ষায়
তোমার যুগল স্তন স্বর্গ হয় রাত্রির নরকে;
জানব না কার কোলে মাথা রেখে অন্তিম বিদায়,
শেষ ক্ষমা চেয়ে নেবে পরিচিত পৃথিবীর কাছে
কোন ক্ষণে জানব না কোনো দিন, কোনো দিন তবু।
তার শয্যার পাশে
শুয়ে আছে একজন নিরিবিলি ভোরের শয্যায়
শীত-গোধূলির শীর্ণ শব্দহীন নদীর মতন
শিথিল শরীর তার লেগে আছে ফ্যাকাশে চাদরে,
দেয়ালে আলোর পরী। খোলা দরজা। ঘরে ঠাণ্ডা হাওয়া
খেলা করে, ঝরনা-হাওয়া ঝরে,
ঝরে একমাথা চুলে, ঝরে
করুণ ক্লান্তির ভারে বুজে-থাকা চোখের ওপর।
পাখা নেড়ে, শিস দিয়ে হলদে পাখি উড়ে গেল মেঘে
নির্জন বারান্দা থেকে। সারা ঘরে শান্তি স্তব্ধতার,
কখনো হঠাৎ তার নিমীলিত শুকনো গলা শুনি
ছায়া-ছায়া-আলো-স্বর-হয়তো ডেকেছে জল দিতে।
শিরশিরে হাওয়ায় কাঁপে শরীরের মেরুন র্যাপার।
চৈতন্যের আলো পড়ে ঘুম-পাওয়া সত্তার পাপড়িতে,
সূর্যের চুমোয় লাল পাণ্ডু গাল। টেবিলের দুটি
তরুণ কমলালেবু চেয়ে আছে দূরের আকাশে,
চিকন সোনালি রুলি ম্রিয়মাণ শঙ্খশাদা হাতে
যেন বেদনায় স্থির-মনে হল-সেই দুটি হাত
মায়াবী নদীর ভেজা সোনালি বালিতে আছে প’ড়ে!
ফ্লাস্কে দুধ। শিশি। ওডি-কলোনের ঘ্রাণ উন্মীলিত
সারা ঘরে। পেশোয়ারি বেদানার ফিকে-লাল রস
কাচের গেলাশে ভরা- গোধূলি-মদির।
কাল সারারাত ছায়া-অন্ধকারে প্রতি পলে পলে
মোমের শিখার মতো ইচ্ছা তার জ্বলেছিল এই
ভোরকে পাওয়ার। চোখে ছিল
গাঢ় প্রার্থনার ভাষা, বুকে
উজ্জ্বল আকাঙ্ক্ষা প্রীত জীবনের, সৌন্দর্যের সাধ।
কে যেন তারার মতো কাল রাতে ডেকেছিল তাকে
মূক ইশারায় দূরে তবু সেই একজন জানি
ভোরকেই চেয়েছিল উন্মথিত রক্তের ভিতর
যেমন সে পেতে চায় প্রেমিকের চুমোর আদর
রাত্রির জঠরলগ্না। ছায়াচ্ছন অপদেবতার
অমর্ত্য চোখের নিচে রাত তার কাটে হরিণের
করোটির ছবি নিয়ে, সারাক্ষণ জেগে থেকে কাল
শুনেছে ধূসর ধ্বনি অবচেতনার অন্ধকারে।
এখন সে শুয়ে আছে ক্লান্তপ্রাণ সম্রাজ্ঞীর মতো
ভোরের আলোয় নেয়ে, ডুবে আছে মসৃণ আরামে।
জেগে উঠে হাত নেড়ে, সোনালি রুলির শব্দ করে
গোধূলি-মদির শান্ত বেদানার রস নিল চেয়ে,
হাসির আশ্চর্য জ্যোৎস্না তার
ঠোঁট চুয়ে ঝরে গেল (হায়,
অপদেবতার ক্রোধ) ঝরে গেল ভোরের শয্যায়।
অতল হৃদয় বেয়ে উঠল গান, শান্ত শব্দহীন,
চোখে তার উপচে-পড়া অপরূপ জয়ের উল্লাস।
ভোরকেই চেয়েছিল উন্মথিত রক্তের ভিতর।
সেই একজন।
তিনশো টাকার আমি
আখেরে হলাম এই? আর দশজনের মতন
দৈনিক আপিস করা, ইস্ত্রিকরা কামিজের তলে
তিনশো টাকার এই পোষমানা আমিকে কৌশলে
বারোমাস ঝড়ে জলে বয়ে চলা যখন-তখন?
এই আমি? এবং প্রভুর রক্তনেত্র সারাক্ষণ
জেগে রয় ঘানিটানা জীবনের চৌহদ্দিতে; ফলে
ঠাণ্ডা চোখে ঠুলি এঁটে দশটা-পাঁচটার জাঁতাকলে
অস্তিত্বকে চেয়ে দেখি নিখুঁত গোলাম, নিশ্চেতন।
আমিও নিজেকে দেখি করেছি ঢালাই মাঝারির
স্পষ্ট ছাঁচে। যদি না অকালে ফস্কে যায় কিস্তি বিনে,
জীবনবীমাই জানি হে পান্থপাদপ মরুপথে।
তা চলে আমিও টেড়িকাটা ছা-পোষা বিজয়ী বীর?
হরলিক্স মিল্ক আর হাক্সলির নয়া বই কিনে
সাধের মানবজন্ম ধন্য করি তবু কোনোমতে।
তোমাকেই বলি
ছায়া-করে-আসা দূরের পথের
সাঁকো পেরোবার ধীর-মুহূর্তে
পাশাপাশি শুধু হেঁটেছি দু’জন;
স্তব্ধ ছিলাম সারাবেলা তবু
দ্বিরুক্তি তুমি করনি কিছুই।
মনের কথাটি বলতে যাবার
লগ্নে আমার হৃদয়ে আজও তো
শত-পাখি-স্বর ফোটে নির্জনে,
সেই কাকলির তাড়ায় মধুর
আপন কথাটি কোথায় হারায়।
হয়তো ভেবেছ কোনো দিন কেউ
সেই ঢেউ মেখে হয়নি উতল
যার উতরোল ফেলার শীর্ষে
জ্বলছে আমার ভাষার মুক্তো।
দিনরাত্তির ভাবনার জাল
ফেলে শেষে তুমি কতটুকু পাবে
হৃদয়ের সেই অতল আমায়?
নতুন কথার অপরূপ মণি
তোমাকে যে দেব কৌটোয় তুলে
এমন আশায় কখনো জ্বলিনি।
প্রাকৃতিক মহাদানের মতোই
তোমার গানের শান্ত-মধুর
পুরানো কলিটি নতুন যেমন
-প্রতিবার বলি হৃদয়ের কাছে-
মনের কথাটি তেমনি আমার
তোমাকেই চাই, তোমাকেই চাই।
নক্ষত্র-বিন্দুর জন্যে
কেন আমি নিমেষেই সর্পমুগ্ধ শশকের মতো
হয়ে যাই আবির্ভাবে তার? কেন শুধু উন্মুখর
একটি অনুরণনে প্রতি রক্তকণা হয় নক্ষত্র-চেতন?
শব্দের মোহন সুরে ঘর ছেড়ে নির্দয় সূর্যের
তৃণহীন প্রান্তরে হারাই পথ, চোরাবালিতেও
পা ঠেকে কখনো আর অরণ্যের জটিল বিভ্রমে
চুল ছিঁড়ি, মুহূর্তে মুহূর্তে মজি মৃগতৃষ্ণিকায়।
যখন মজুর মিস্ত্রি সান্ত্রী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই
ক্লান্তিহর আদিম নিদ্রায় মগ্ন অকাতরে, আমি কেন শুধু
শয়তানের মতো একা বন্ধ ঘরে করি পায়চারি?
অশান্ত জ্বলন্ত গুপ্ত, নিষ্করুণ জ্বরের মূর্ছায়
নিজেকে খনির মতো কেন খুঁড়ে আনি আজও শব্দের সম্ভার?
এমনকি নিদ্রার ঘোরেও করি কত দেবদুর্লভ প্রগাঢ়
উচ্চারণ, অথচ স্বগৃহে বহু বিবেকী মানুষ
সুখ-পরিমল পান করে কাটায় প্রহর কত
উজ্জ্বল রেশম যব আর তিসির হিসেবে।
তবে কেন, কেন আমি
এমন উত্তাল হই, এমন অধীর
ভূতে-পাওয়া মানুষের মতোই সুদূর আর প্রতিধ্বনিময়
আশৈশব সামান্য মিলের আর ছন্দের সংরাগে?
মাঝে-মাঝে নিরাপদ স্বর্গের মসৃণ অধিবাসী
আমাকেও বিদ্ধ করে দ্বিধাহীন ঘৃণার ত্রিশূলে,
যেমন সদলবলে তারা খাঁচার পশুকে তার
স্বপ্ন থেকে কৌতুকে খুঁচিয়ে তোলে অবলীলাক্রমে
প্রচ্ছন্ন হিংসায় মেতে গরাদের নিশ্চিন্ত আড়ালে?
দান্তে কি উন্মাদ তবে, বোদলেয়ার মাতাল শুধুই?
জেনেছি আমার পথ নয় কিছু নির্বিঘ্ন, সরল;
উপরন্তু সর্বনাশা ঘুঁটির নিহিত পরিণামে
বুকের নক্ষত্র ছিঁড়ে নিয়ে গেছে দুর্জয় শয়তান।
নির্জন দুর্গের গাথা
মানিনি জীবন সমুদ্র সন্ধানে
চোরাবালিতেই পরম শরণ নেবে।
আশার পণ্যে পূর্ণ জাহাজ সে-ও
ডোবা পাহাড়ের হঠকারিতায় ঠেকে
হবে অপহৃত-ভাবিনি কখনো আগে।
দিনের সারথি বল্গা গুটিয়ে নিলে,
যখন রাত্রি কৃষ্ণ কবরী নেড়ে
আনে একরাশ তারা-ফুল থরথর
দু’হাতে সরিয়ে শ্যাওলার গাঢ় জাল
চম্কে তাকাই আমিও মজ্জমান।
ভবিষ্যতের ঝাঁপিয়ে অন্ধকারে
যা-কিছু রয়েছে আমার জন্য শেষে
সবি নিতে হবে দৈবের দয়া মেনে?
ব্যঙ্গ-দৃষ্টি আড়ালেই ঝলসায়।
নির্জনতার কারাগারে সঁপে প্রাণ
আত্মদানের মহৎ দুর্গ গড়ি।
যদি সে প্রাকার-বিরোধী অশ্বখুরে
অচিরাৎ তার দৃঢ় নির্ভর ভোলে,
যদি দর্পের দর্পণ হয় গুঁড়ো,
ঝড়ের সামনে ভাগ্যের শাখা মেলে
কাকে পর ভেবে কাকে-বা আপন জেনে
সাধের শ্রমের দিব যে জলাঞ্জলি।
যদি হ’ত ঐ তারাদের মতো চোখ
তারার মতন নিবিড় লক্ষ কোটি
দু’দিনের ঘরে হয়তো পেতাম তবে
বেলা না ফুরাতে তাকে এই চরাচরে
চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখার সুখ।
অবুঝ আমার আশা উদ্বাহু তবু।
বিরূপ লতার গুচ্ছে জড়িয়ে শিং
কালো রাত্তিরে তৃতীয় প্রহরে একা
কাঁদে প্রত্যহ হরিণ-হৃদয় যায়
তাকে নেব চিনে প্রাণের দোসর সে-যে।
সম্মুখে কাঁপে অমোঘ সর্বনাশ।
দিনের ভস্ম পশ্চিমে হয় জড়ো,
অনেক দূরের আকাশের গাঢ় চোখে
রাত্রি পরায় অতল কাজল তার।
এমন নিবিড় স্মৃতি-নির্ভর ক্ষণে
বলি কারো নাম, হৃদয়ের স্বরে বলি।
জ্বলি অনিবার নিজেরই অন্ধকারে।
এতকাল ধরে আমার আজ্ঞাবহ
ঘাতক রেখেছে তীক্ষ্ণ কুঠার খাড়া,
সেই যূপকাঠে নিজেই বলির পশু।
উঁচু মিনারের নির্জনতায় মজে
ভেবেছি সহজে বিশ্বের মহাগান
আমার প্রভাতে সন্ধ্যায় আর রাতে
ঝরনা-ধারায় আনবেই বরাভয়।
সেই বাসনার প্রভুত জাবর কেটে
শূন্যে ছুড়েছি দুরাশার শত ঢিল।
প্রতিপক্ষের কূটচক্রের তান
পশেনি কর্ণে, ওদের বর্ণবোধে,
সান্ধ্য ভাষায় করিনিকো দৃক্পাত।
কবন্ধ যারা নিত্য জন্মাবধি
অন্ধের মতো তাদের যষ্টি ধরে
দ্বন্দ্বের ঘোরে ছুঁইনি গতির বুড়ি।
পিতা
প্রাণে গেঁথে সূর্যমুখী-উন্মখতা খুঁজি আজও তাঁকে
সর্বত্র অক্লান্ত শ্রমে। স্বপ্নের মৃণালে মুখ তাঁর
জ্যোতির্ময় কল্যাণের মতো ফুটে অভ্র-শুভ্রতার
অতল সমুদ্রে ডোবে-খুঁজি আজও বিদ্রোহী পিতাকে।
অজ্ঞাত, বিরূপ এই রুক্ষ দেশে মৌন বাসনাকে
নক্ষত্রের মতো জ্বেলে চাই তাঁকে দুর্নিবার
আতঙ্কের মুখোমুখি, যেমন সে মৃগতৃষ্ণিকার
নিঃসঙ্গ পথিক চায় পান্থপাদপের মমতাকে।
তিনি নন জন্মদাতা, অথচ তাঁকেই পিতা বলে
জেনেছি আজন্ম তাই মুমুক্ষু কালের অস্তরাগে
সমর্পিত তাঁরই কাছে। জীবনের সব মধুরিমা
করেছি নিঃশেষ শুধু অশেষ সন্ধানে জ্ব’লে জ্বলে।
তিনি নন বিধাতা অথচ ব্যাপ্ত সত্তার পরাগে-
তবে কি উপমা তাঁর চৈতন্যের ভাস্বর নীলিমা?
পুরোনো তৈলচিত্র
পৃথিবী ঘুরছে নিত্য, ডিঙিয়ে শীতের বেড়া বসন্তের শিশু
প্রথামতো হানা দেয় উড়িয়ে নিশান।
ফিরতি-পথে ফুল কিনে সন্ধ্যার পথিক
কড়া নেড়ে দরজায় যাকে পায় তার
আঁচলে প্রদীপ কাঁপে, প্রাণের হাওয়ায়
জানা কবিতার
উন্মীলিত ধ্বনি,
সামান্যের জিত
দু’দণ্ড পুণ্যের জলে ডুবোও হৃদয়,
ধুয়ে নাও নরকের কালি।
তুমি আর পারবে না দাঁড়াতে সেখানে
জীনের মুখর সারিতে
স্থানাভাবে,
দেয়ালেই আপন পৃথিবী।
বুক-ডোবা শান্ত জলে পাখি মেরে সূর্যাস্তের পরে
নিত্যসঙ্গী কুকুরের গলার শিকল শ্রান্ত হাতে
সুন্দরবনের রাতে ধোঁয়া-ওঠা তাঁবুর আরামে ফিরে আসা,
রহস্যসিরিজে ডুবে কাঁটা আর চামচের বিতর্কে উৎসুক
প্রহর কেটেছে যার জায়াপুত্রকন্যার সংসারে
অথবা চিল্কায় ছুটি সিমলায় ফগে আর পাহাড়ি হাওয়ায়
পত্নীর অভ্যস্ত প্রেমে তৃপ্ত মন (আপাতদর্শনে)
ব্যাঙ্কের অঙ্কের স্ফীতি ছিল যার স্বর্গ-সিঁড়ি, তার
প্রস্থানের নেপথ্য নাটকে
সে কি তবু জেনে গেছে পৃথিবীর শেষ কোনো শ্লোক,
স্বপ্নে তাকে করেছে কি তাড়া চন্দ্রবোড়া, অন্তরালে
কে জানে হৃদয়ে তার ছিল কি না কীটের উৎসব।
পূর্বরাগ
জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা;
কাঁপি না ভয়ে আর দ্বিধার নেই দোলা-
এবার তবে রাতে হাজার দীপ জ্বেলে
সাজাব তার পথ, যদি সে হেঁটে আসে।
যদি সে হেঁটে আসে, প্রাণের ছায়াপথ
ফুলের মতো ফুটে তারার মতো ফুটে
জ্বলবে সারারাত, ঝরবে সারারাত।
জেনেছি কাকে চাই, বলি না তার নাম
ভিড়ের ত্রিসীমায়; স্বপ্ন-ধ্বনি শুধু
হৃদয়ে বলে নাম, একটি মৃদু নাম।
প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
(পূর্বলেখ)
এই সেই পৃথিবী অপার মাটি যার এতকাল
সুপুষ্ট স্তনের মতো ফল আর ফাল্গুনের ফুল
করেছে উৎসর্গ নিত্য সন্তানের শ্রম প্রজ্ঞা প্রেমে
পূর্ণ হয়ে দীর্ণ হয়ে? এই সেই পৃথিবী সাবেকি?
দেখেছি সমুদ্রতীরে অস্তরাগে একদা হাওয়ায়
নর্তকী-শিখার মতো সফেদ তরুণ ঘোড়া এক
মেতেছে খেলায়-মনে পড়ে পিছনে এসেছি ফেলে
উজ্জ্বল হরিণ-দিন, উন্মুখতা সজীব গাছের।
এতদা যে-নদী নীলিমাকে ভালোবেসে চেতনায়
নিপুণ শিল্পীর মতো গড়েছে নিবিড় দুই তীর,
তাকে আর পাব নাকো দৃষ্টির রেখায় দীপ্ত, প্রাণে
হবে না মুখর ঝরনা বসন্তের বিফল সম্ভাষে।
যে-চেতনা এল ফিরে দুঃস্বপ্নের কুয়াশাকে চিরে
জীবনে আবার অন্ধ নিয়তির মতো দুর্নিবার
চাইনি এমন আলো অভিসন্ধি যার নিমেষেই
নরকবিলাসী শুধু লুব্ধ এক তৃষিত কোরাসে।
এখন যে-অগ্নিকুণ্ড দাহ আনে কে তাকে নেভাবে
প্রসন্ন রুপালি জলে? সূর্যহীন হয়েছে এখন
যে-হৃদয় অনেক অজ্ঞাতবাসে, অন্ধকারে তার
শুধুই প্রেতের গান-নেই কোনো সমুজ্জ্বল মুখ।
অন্ধকার ভয় ব্যাপ্ত রক্তের ভিতর, সাড়া নেই
লোকালয়ে, এমনকি পাখির চিৎকারে অতর্কিতে
কাঁপে না হাওয়ার ঢেউ, ভয়াবহ স্তব্ধতা পথের।
‘দাঁড়িও সেখানে তুমি’-বলেছিল কেউ-মনে পড়ে,
নিঃশব্দে যেখানে শত হৃতদীপ্তি আত্মার মিছিল
রক্ত আর হলুদ পুঁজের ভাণ্ড তুলে ধরে মুখে।
দারুণ দুঃস্বপ্ন-বিদ্ধ বিকারের ঘোরে তমসায়।
ভুলতে-না-পারা অগণিত স্মৃতির করাল চিহ্নে
কণ্টকিত তাদের বিশীর্ণ সত্তা; দাঁড়িও সেখানে-
তারপর চলে যেও একা তুমি, কোরো না যাচাই।
এ-দৃশ্যের বোধ যাকে পায় সে কি মৃত্যু নয় তবে,
মৃত্যু নয়, মৃত্যু নয়, মরণের অন্য মানে আছে?
মনে হয় আমি যেন সেই লোকশ্রুত ল্যাজারস,
তিনদিন ছিলাম কবরে, মৃত-পুনর্জীবনের
মায়াস্পর্শে আবার এসেছি ফিরে পৃথিবীর রোদে।
পোশাকের জেল্লা তবু পারে না লুকাতে কোনোমতে।
বিকৃত দেহের ক্ষত, লোবানের ঘ্রাণ সহজেই
ডুবে যায় প্রাক্তন শবের গন্ধে; নীল আঙুলের
প্রান্তে বিদ্ধ তিনটি দিনের ক্ষমাহীন অন্ধকার।
ভাস্করের অসম্পূর্ণ মূর্তির মতন ঘুরে ফিরি।
উল্লোল নগরে কত বিলোল উৎসবে; কিন্তু তবু
পারি না মেলাতে আপনাকে প্রমোদের মোহময়
বিচিত্র বিকট স্বর্গে। বিষাক্ত ফুলের মতো কত
তন্ময় রহস্য জ্ব’লে ওঠে আজও দু’চোখে আমার।
সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ।
সেহেতু সে-বিষাদের বৃন্তে ফোটে আতঙ্কের ফুল,
আমার সান্নিধ্যে কেউ ঘেঁষে না সহজে, ভয়, পাছে
তাদের শিরায় নামে লিথির বিষণ্ন জলধারা।
স্বর্গদীপ্ত প্রাণ নিয়ে এসে এ কোথায় কোন দেশে
হারিয়ে ফেলেছি রূপ পশুর রোমশ অন্ধকারে?
এখানে মরার খুলি ধুলোয় গড়ায় চারদিকে,
খেলার ঘুঁটির মতো অসহায়, ভবিষ্যৎহীন।
মাঝে-মাঝে কৃষ্ণকায় বিকট পাখির লৌহচঞ্চু
মাংস ছিঁড়ে নিতে আসে-আমি তাকে পারি না ফেরাতে।
আর চেয়ে দেখি মৃত্তিকায় করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলে
বিষণ্ন স্মৃতির মতো, দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভাসে।
বিরস গান
ইচ্ছা আর অনিচ্ছায় জীবনভোর কলম ঠেলে
হায়রে তুমি কী-ইবা পেলে?
দিনরাত্রি পুঁথির শত পাহাড় খুঁড়ে দেখলে শেষে
পোড়া কপাল! মূষিক মেলে।
কালের মেঘে অকাল সাঁঝ নিমেষে এল হঠাৎ ভেসে
দেখলে শেষে যৌবনের পরম গতি নিরুদ্দেশে।
প্রেতের মতো একাকিত্বে সব পন্থা খুইয়ে এসে
কন্থা গায়ে বলবে কাকে মহান প্রভু?
যাকেই বলো হারানো গান পাবে না তবু।
কঠিন পথে আশার রথ তাড়িয়ে দ্রুত কোথায় এলে?
কার সে হাতে আত্মা সঁ’পে,
জীবনভোর ভীষণ সেই নামটি জ’পে
মনের যত হঠকারিতা গুঁড়িয়ে ফেলে
হায়রে তুমি কী-ইবা পেলে?
ব্যবধান
আজও কি সেখানে যাও, যেখানে মায়াবী একদার
স্বর্ণমৃণ দেখা না-দেখায় মেশা? হয় কি সময়?
হয়তো সেখানে আজ নন্দিত, প্রোজ্বল ফুল নয়,
বল্মীক ও রুক্ষ আগাছায় ছেয়ে গেছে চারধার।
তোমার সত্তার দীপে আজ আর আমার আঁধার
হয় নাকো দীপান্বিতা; শুধু মনে রাখার বিস্ময়
নিয়ে বেঁচে থাকি আজ। ইতিমধ্যে হয়ে গেছে ক্ষয়
রৌদ্র-ঝড়-জলে কত লঘুপক্ষ বছরের ধার।
পুনর্মিলনের সূর্য যেন না-ই জ্বলে দু’জনের
গোধূলি আকাশে আর; তুষারের তীক্ষ্ণ শুভ্রতায়
বাসনার শতদল যাক ছিঁড়ে-বিষাদের দান
সন্তপ্ত হৃদয়ে গেঁথে গাব গান নির্মোহ প্রাণের।
এই ভালো-তুমি আর আসো না যে চারু, মৃদু পায়,
কেননা দুর্লঙ্ঘ্য এই নির্দয় কালের ব্যবধান।
মনে মনে
জানি না কী করে কার মমতার মতো
শান্ত-শুভ্র ভোর এসে ঝরে
জানি না কী করে এত নীল হয় রোজ
ধ্রুপদী আকাশ। ঘাসে এত রং, রোদে
জীবনের সাড়া, বিকেল হাওয়ায় এত নির্জন ভাষা
(জানল না কেউ) তবু কী করে যে বেঁচে আছে তারা!
ভালোলাগা রং নিয়ে
সাধারণ-অপরূপ
কত ছবি আঁকলাম
নগরে ও বন্দরে
হিতকথা বুদ্ধের
শিখলাম, যত পাখি
সন্ধ্যার-জানলাম।
আমার কি সব তবু ঠিক জানা হল?
শিশুর চোখের বিস্ময়-আঁকা মায়াবী দৃষ্টি যার
প্রসারিত এই জীবনের গাঢ় মানচিত্রের রঙে,
সুদূর গাঁয়ের কুয়োতলা আর শহরের কোনো পার্কের মৃদু ঘাস,
পৃথিবীর কত রহস্যময় সোনালি রুপালি দ্বীপ
আবরণ খুলে জীবনের মানে এখনও জানায় যাকে
সে কি তবে তার মুখের ওপর বন্ধ দরজা দেখে
ফিরে যাবে একা, ভুলে যাবে গান, বলো?
হারিয়েছি কত বিকেলের মতো নারী,
বহুবার আমি হারিয়ে ফেলেছি
পাখির দেহের রঙে ঝিলমিল, স্নেহে-ছাওয়া ঘর;
হারাইনি তবু সুরের নূপুর, ভুলিনি আমার গান।
এখনও তো লুট করে আনে মন দিনের প্রবাল,
রাতের হীরের হার,
এখনও হাজার সহজ খুশির
নিবিড় ঝরনা-আলো,
এতটুকু ভালোলাগা
কুড়িয়ে ছড়িয়ে সহস্র ভিড়ে ডুবে যাই, ভেসে উঠি।
ফুলের মতন তারারা যখন অন্ধকারের স্রোতে
ভাসে, কাঁপে, জ্বলে-মনে পড়ে তার মুখ,
মনে পড়ে তার মুখ।
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যায়।
যে আছে দাঁড়িয়ে অতিদূর পাড়াগাঁয়ে
দীপ হাতে সেই অভাবের সংসারে
সত্যিমিথ্যে যদি ফিরে যাই হঠাৎ সেখানে তার
বিবর্ণ খেলাঘরে
সে কি আর ভাঙা পুতুল কুড়োবে
কাক-ডাকা রাতে একা?
দু’জনের কত গহন দুপুর
চলে গেছে সেই যোজন-যোজন দূরে।
যদি ফিরে যাই জামতলা আর পারুলডাঙার মাঠে,
যে যাবে সঙ্গে তার কথা কিছু জানি!
মর্মর প্রাসাদ শুধু
মর্মর প্রাসাদ শুধু ধসে যায়, সারি সারি থাম
মোমের মতন যায় গ’লে আর অজস্র জন্তুর
বিক্ষুব্ধ গর্জনে ব্যাপ্ত নৃত্যনাট্য সমূহ ধ্বংসের;
পথে পথে ঘোরে নিত্য লক্ষ্যহীন কবন্ধের দল।
আমিও নগরেও এই মত্ত কোলাহলে
ক্রুশবিদ্ধ চেতনায় নিজেকে মেলাতে চাই
স্মৃতির পরম অধীশ্বরে।
এবং পাপড়ির মতো মুখ মনে পড়ে
সময়ের আঁধার অলিন্দে, যতবার সর্বনাশা
গোলকধাঁধায় ঘুরি অবিরাম ভবিষ্যৎহীন।
মৃত্যুকে লালন করে গহন সত্তায় রাত্রিদিন
দুঃস্বপ্নের নারকী বলয়ে ভ্রাম্যমাণ পথিকের
আজও তো তোমাকে
স্মরণ করার মতো মন বেঁচে আছে।
এবং কী দীর্ঘ এই প্রতীক্ষা আমার।
কতদিন স্নান জনস্রোতে রেখেছি অধীর চোখ
তোমার সন্ধানে, তবু দেখিনি তোমাকে আর সেই
লোকশ্রুত অনন্য সাঁকোর ধারে। অথচ তুমিই
আমার ধ্যানের
সুনীল আকাশে কত পারিজাত হয়ে
জ্বলো সর্বদাই।
এ-নগরে কোলাহলে চেয়েছি একটি স্বর শুধু
ঝরুক ঝরনার মতো-সে পুণ্য ধারায়
নিশ্চল পাথর হোক প্রাণ, হে নায়িকা,
আমি চাই তোমার উজ্জ্বল আবির্ভাব।
একদা তোমার আবির্ভাব জানি ক্ষণিকের অপরাহ্নে সেই
চকিতে দিয়েছে জ্বেলে অলৌকিক প্রভা।
সত্তার নিহিত
কস্তুরীর ঘ্রাণ
তোমাকে উন্মন করে শরীরে তোমার
অলক্ষ্যে করেছে সৃষ্টি স্বপ্নচিত্র শাশ্বতীর।
ভাবিনি কখনো আগে
অন্ধ নিয়তির মতো নিশ্চিত, অপ্রতিরোধ্য, দ্রুত
পতন নির্মম, আর আমি তো চেয়েছি
মোহন মোমের ডানা মেলে নীল, বিশাল আকাশে
গর্বিত পাখির মতো অন্ধ করে দিতে
সূর্যের অনল-চোখ, কিন্তু সেই ডানা
তরল জ্যোৎস্নার মতো গেল শুধু গ’লে
অগ্রজের বিস্মিত দৃষ্টির নিচে শেচনীয় সৌন্দর্যের মতো।
দিনগত পাপক্ষয়ে কাটে
দারুণ দুঃস্বপ্ন-গাঁথা প্রহর আমার,
তারপর হয়তো কখনো
স্বপ্নে-দেখা অপ্সরীর মতো নেমে আসে
মোহিনী সৌজন্যময়ী রাত্রি, আর
তখনও তোমার শেষ দৃষ্টি
হীরের মতন জ্বলে মনের খনিজ অন্ধকারে।
মৃন্ময়
অনেক কিছুই জানা নেই আপন এ পৃথিবীর।
বিতরিত হতে পারে হাটে-মাঠে-এমন নিবিড়
আলো নেই আমার তামস করতলে,
অথচ নিত্যই দেখি নির্বিকার জোনাকিরা জ্বলে
ছায়ার প্রহরে আর মসৃণ স্তনের মতো ফলে
স্তব্ধ গাছ, শব্দ শুনি মৌমাছির অধীর ডানার।
কখনো খড়ের বিছানার
উষ্ণতায় মজে দেখি যায় বেলা যায়
গোলাপি আকাশ ক্রমে হয় ফিকে, কাঁপি প্রত্যাশায়।
কারো শুভ্র মালা ছিঁড়ে করি না বড়াই
কোনো দিন আর রাজরাজড়ার লড়াই
বাঁধলে ঘেঁষি না তার ত্রিসীমায়, জানি না কোথায়
বাঘ-মোষ এক ঘাটে জল খায় কিংবা ইতিহাসের পাতায়
কারা কুশীলব,
তাদের বৈভব
আনে না বিভ্রান্তি মনে। শুধু জ্বেলে রাখি
ইচ্ছা-ব্যাকুলতা যেন তাকে নিয়ে থাকি
দুর্জ্ঞেয় কান্নার পাকে, অভিন্ন হাওয়ার ধ্যানীক্ষণে
দু’জনের আপন ধুলোয় এই শান্তিনিকেতনে।
যুদ্ধ
বারোমাস তুমি ক্ষ’য়ে গ’লে ঝরে
যা-কিছু পেয়েছ বর্ষার মেঘে বাতাসের স্বরে
দিগন্ত-কাঁপা রোদের সাড়ায়
শত বছরের কবির চোখের, প্রাণের তারায়
-নিত্য নিজেকে বলি বারবার-
বিনিময়ে তার
দু’দিনের যত সাধারণ সুখ
ছাড়ো হেসে-খেলে, শুধু এক-বুক
বেদনার রেণু ছড়িয়ে তোমার গানের ভাষায়
প্রগাঢ় অনেক অজানা আশায়
ভুলে গিয়ে ছেঁড়া হৃদয়ের ক্ষত
যেই ঝড় আজও না চাইতে আসে
মুছে ফেলে তাকে মেনে নাও এই বন্ধ্যা আকাশে
তারা ফোটানোর ব্রত।
কিছু নেই যার বিত্তের কণা
বাজিয়ে সে তার চিত্তের তারে আনে মূর্ছনা,
কত নেভা প্রাণে বাতি দেয় জ্বেলে
আবেগের নীল শিখা-শিহরণে, দ্যাখে চোখ মেলে
গ্রীষ্মকঠিন বর্ষাকোমল শহরের মুখ
প্রেমিকের মতো গাঢ় উৎসুক।
আমি যা-কিছুই করি আহরণ দিন-রাত্তির
উজ্জ্বল বহু গ্রন্থ অথবা দেশ-কাল আর ভোরের শিশির
পাখির বৃত্ত, কৃষ্ণচূড়ার রোদ্দুর থেকে
স্বচ্ছ মধুর মতো চেখে-চেখে-
ব্যর্থ হবে কি তা-ও একদিন?
পাতা ঝরে যাক, ব্যথা মর্মরে প্রাণ হোক লীন;
বিদ্যুৎজ্বলা সৃষ্টি-আগুনে ঝরুক ঝরুক ঘন অবিরল
হৃদয়ের মেঘ-জল।
বাঁকাচোরা পথ দু’পায়ে মাড়িয়ে দেখি উদ্ধত
কৃপাণের মতো
জ্বলছে প্রাণের রৌদ্রের শিখা রাত্রির খাপে;
যাকে ভালোবাসি তার ঠোঁটে কাঁপে
সূর্য-হাসির, সোনালি-চিকন বালি-ঝরা আভা-
তার জন্যেই কখনো বাঁচার আনন্দ বাড়ে।
জলের কুমির ডাঙার বাঘের দুরন্ত থাবা।
ক্রূর উদ্যত, হই না ছিন্ন পৃথিবীর দাঁত-নখের প্রহারে,
তবু জানি এত বিস্ময়-লাগা সভ্যতা আছে
জীবনের কাছে;
বিনিময়ে তার
তুচ্ছ মেনেছি খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের হার।
অস্ত্র আমার নেই কিছু শুধু গান নিয়ে আমি
সংসার রুখে দাঁড়ালে কঠিন প্রান্তরে নামি;
যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি তবুও মরিনি থাবার
প্রহারে এখনও; সোনালি-চিকন সূর্য-হাসির, গ্রন্থ-আভার
পৃথিবীতে রোজ নতুন বোধের গাঢ় রূপাভাস,
বাঁচবার উল্লাস।
যে ছায়া আয়নায়
যে-ছায়া আয়নায় দ্যাখো সকাল-সন্ধ্যার অবসরে
তাকে কেউ কোনোদিন বলে কি রূপসী অনুপমা?
ভুলেও বলে না জানি কেউ তাকে রূপের আধার।
তোমার গালের কালো একটি তিলের বিনিময়ে
দেবে না বিলিয়ে কেউ অকাতরে সাম্রাজ্য বিশাল;
অথবা তোমার জন্য ভাসবে না শত রণতরী
তোমার শিখায় জ্ব’লে পুড়ে ছাই হবে না কখনো
প্রাচীন নগর কোনো-কোনো দিন হবে না কিছুই।
আক্ষেপ প্রচ্ছন্ন থাক, ক্ষমা করো এ সত্যভাষণ।
জেনেছি স্তুতির জাদু, কী দরকার মিথ্যাচারে মজে?
যা-কিছু অর্পিত এই কবিতার সামান্য আধারে,
নিশ্চিত এ নয় জানি প্রেমিকের উচ্ছ্বাস প্রপাত,
অথচ তোমার মনে নিত্য যে-অনল উন্মীলিত,
তাকে চাই দ্বিধাহীন প্রাণের সংসারে প্রতিদিন।
অলোকসামান্য নয় লেখনী আমার, তুমি তাই
পারবে না কখনো এড়িয়ে যেতে কালের তিমির।
তাকে কী? অন্তত ছিলে আমার নিভৃত অন্তর্লোকে
গানের মতোই ব্যাপ্ত চিরদিন সে-ও তুচ্ছ নয়।
রজনীগন্ধার ঘ্রাণ
আজও দেখি আমাদের মর্ত্যলোকে রাত্রির আকাশে
খণ্ডিত রুলির মতো চাঁদ জেগে ওঠে দ্বিধাহীন,
এবং রজনীগন্ধা ফোটে কোনোখানে। বহুদিন
আসেনি এমন রাত ভর করে মধুর বাতাসে,
হয়তো এমন রাতে কবিতার লগ্ন ফিরে আসে
বৃত্তাবদ্ধ এ-জীবনে। বস্তু-গাঁথা দেউলে, কঠিন
জীবন ক্ষণিক স্বপ্নে হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ, অমলিন;
উন্মুখ সত্তায় শুধু রজনীগন্ধার ঘ্রাণ ভাসে।
আজ রাতে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ করেছে উন্মন,
অধীর আমাকে আর মদির সৌরভে মনে পড়ে
একদা তোমার মায়া-স্পর্শে আমার প্রাক্তন মন
পাপড়ি মেলেছিল দু’দিনের জ্যোৎস্নার দুরন্ত ঝড়ে
অলীক পদ্মের মতো। আজ শুধু স্মৃতি-রোমন্থন
সম্বল আমার এই তুমিহীন ব্যথাদীর্ণ ঘরে।
রুপালি স্নান
শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ
অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা-ভরানো পানীয়ের খোঁজ
শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের কাছে এসে রোজ
চাইনি তো আমি। দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধুই
শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল। এখনও যে শুই
ভীরু-খরগোশ-ব্যবহৃত ঘাসে, বিকেলবেলায় কাঠবিড়ালীকে
দেখি ছায়া নিয়ে শরীরে ছড়ায়,-সন্ধ্যা-নদীর আঁকাবাঁকা জলে
মেঠো চাঁদ লিখে
রেখে যায় কোনো গভীর পাঁচালি-দেখি চোখ ভরে;
ঝিঁঝির কোরাসে স্তব্ধ, বিগত রাত মনে করে
উন্মন-মনে হরিণের মতো দাঁতে ছিঁড়ি ঘাস
হাজার যুগের তারার উৎস ঐ যে আকাশ
তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে, সোনালি অলস মৌমাছিদের
পাখা-গুঞ্জনে জ্বলে ওঠে মন, হাজার-হাজার বছরের ঢের
পুরোনো প্রেমের কবিতার রোদে পিঠ দিয়ে বসি, প্রগাঢ় মদের
চঞ্চলা সেই রসে-টুপটুপ নর্তকী তার নাচের নূপুর
বাজায় হৃদয়ে মদির শব্দে, ভরে ওঠে সুরে শূন্য দুপুর
এখনও যে এই আমার রাজ্যে-এইটুকু ছিল গাঢ় প্রার্থনা-
ঈশ্বর! যদি নেকড়ের পাল দরজার কোণে ভিড় করে আসে,-
এইটুকু ছিল গাঢ় প্রার্থনা-তবুও কখনো ভুলব না, ভুলব না।
ভাবিনি শুধুই পৃথিবীর বহু জলে রেখা এঁকে
চোখের অতল হ্রদের আভায় ধূপছায়া মেখে
গোধূলির রঙে একদিন শেষে খুঁজে নিতে হবে ঘাসের শয্যা।
ছন্দে ও মিলে কথা বানানোর আরও কত তীক্ষ্ণ লজ্জা
দৃষ্টিতে পুষে হাঁটি মানুষের ধূসর মেলায়!
চোখ ঠেরে কেউ চলে যায় দূরে, কেউ সুনিপুণ গভীর হেলায়
মোমের মতন চকচকে সুখী মুখ তুলে বলে এঁকেবেঁকে ‘ইশ,
দিনরাত্তির মধুভুক সেজে পদ্য বানায়, ওহো, কী রাবিশ!’
আকাশের নিচে তুড়ি দিয়ে ওরা মারে কত রাজা, অলীক উজির
হেসে-খেলে রোজ। তবু সান্ত্বনা আকাশ পাঠায় স্বর্গ-শিশির,
জোনাকি-মেয়েরা বিন্দু-বিন্দু আলোর নূপুরে ভরে দেয় মাঠ
গাঢ় রাত্তিরে বিষণ্ন সুরে তোমার রাজ্যে একা-একা হাঁটি
আমি সম্রাট!
শিশিরের জলে স্নান করে মন তুমি কি জানতে
বিবর্ণ বহু দুপুরের রেখা মুছে ফেলে দিয়ে
চলে যাবে এই পৃথিবীর কোনো রুপালি প্রান্তে?
নোনাধরা মৃত ফ্যাকাশে দেয়ালে প্রেতছায়া দেখে, আসন্ন ভোরে
দু’টুকরো রুটি
না-পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক-গা ঘুমেই বিবর্ণ হই,
কোনো-একদিন গাঢ় উল্লাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি
হয়তো হিংস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজায় খিল
সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল।
হয়তো কখনো আমার ঠাণ্ডা মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ
শহরের কোনো নর্দমাতেই,-সেখানে নোংরা পিছল জলের
অগুনতি ঢেউ
খাব কিছুকাল। যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি
প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবু শান্ত রুপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।
শিখা
জানলাম
পোড়ায় সে নগর ও গ্রাম,
শক্রর শিবির আর মিত্রের পাড়ায়
সমান প্রতাপ তার। অলক্ষ্যে কখন কী হারায়
পৃথিবী, কে জানে-
হাওয়ায় ঘোরান ক’টি শুকনো পাতা, অথবা সভ্যতা, তার মানে
নিয়েছি নিজের মনে খুঁজে;
দেখি চোখ বুজে
সে যায় অনেক দূরে বনের হাওয়ায়
এবং মোমের মৃদু শিখা হয়ে কাঁপে তার খোলা জানালায়।
সুন্দরের গাথা
যেখানে সূর্যের তলে আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরের গাথা
নিসর্গে মধুর মতো, ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে
অথবা যেখানে গাঢ় চন্দ্রবোড়া সঙ্গিনীর শাখায় আকুল,
ঋতুর মধুর রণে পরাক্রান্ত, সেখানে আমার অভিলাষ
অভিসারী। পিছনে থাকুক পড়ে অনেক দূরের
অনচ্ছ তারার মতো লোকালয়, তাকাব না ফিরে।
যে-চেতনা ভ্রমরকে মেখে দেয় ফুলের যৌবনে,
বসন্তের তরুণ গাছকে
দেয় মেলে অনাঘ্রাত নীলের আকাশে,
সমুদ্রের ঢেউয়ে আনে পাখিদের উদ্বেলিত বুক,
নিঃসঙ্গ কবিকে দেয় জীবনের গাঢ় মদ-শব্দের প্রাসাদ,
যে-চেতনা তৃষ্ণার্ত যাত্রীকে আনে ফের
স্মৃতির সৌগন্ধে ভরা শীতল ঝরনায়,
তারই প্রজ্বলনে
সমস্ত দুপুর ভরে জলের আলোর নিচে দেখলাম তাকে
সঞ্চারিণী জলজ উদ্ভিদ যেন। এবং স্ফুরিত
অধরে রক্তিম মাছ, ফলের পূর্ণতা তার সমস্ত শরীরে।
সহসা উঠল ভেসে গভীর জলের সেই নারী
এবং সহজে তার করতলগত
নন্দিত ফুলের ঝাড় দিল সে বাড়িয়ে
আমার চোখের নিচে। দুর্লভ মণির মতো স্তন
ঘন হল বাসনার তাপে, যেমন গ্রীষ্মের ফল
গাঢ় হয় সূর্যের চুম্বনে। দেখলাম জনহীন তীরে সব
উৎকণ্ঠা উজিয়ে এসে প্রবীণ কচ্ছপ অকাতরে
তাপ নিল খুঁজে তার রৌদ্রের মসৃণ বালাপোশে।
সূর্যের জাহাজডুবি হলে সে-নারীকে বললাম,
‘আমার জীবনে তুমি খেয়াল-খুশির প্রস্রবণে
প্রতিদিন যে-কুসুম দিয়েছ ছড়িয়ে,
সুতীব্র আনন্দে তার গড়েছি বাগান লোকোত্তর।
আমার ত্বকের নিচে অলৌকিক যে-কীট খেলায়
সারাক্ষণ মগ্ন তাকে ভুলে গিয়ে চেয়েছি তোমাকে,
যেমন মৃত্তিকা চায় সজীব গাছের ফল, সুপক্ব-সোনালি।
ভেবেছি বিঁধর তাকে সহসা কৌশলে, অথচ সে
নিরুত্তর অধরে রক্তিম মাছ নিয়ে
স্বপ্নের চেয়েও আরও অধিক অতলে
গেল ডুবে নবতর কেলির তৃষ্ণায়।
তখন রাত্রির পূর্ণ আকাশে হঠাৎ এল চাঁদ-
অমূল্য, অপ্রাপনীয় মুক্তো। আর একটি শুয়োর
ইতস্তত পথ শুঁকে এসে গেল জ্যোৎস্নায়, যেখানে
তারার বুদ্বুদে ফোটে আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরের গাথা।
মুছে গেল দৃশ্যাবলি চারদিকে, অনন্তর একা
আমি আর অকূল শূন্যতা।
সে
প্রেম তাকে করে না আকুল। উদয়াস্ত তার প্রাণে
একটি মরুর জ্বালা উন্মোচিত-যেন সে দুর্জ্ঞেয় কোনো যন্ত্রণার গানে
ধুলোর বিজনে যাত্রী মোহাবিষ্ট আর হলদে পাতার বালিশে
মাথা রেখে অভীষ্ট সহজ গাঢ় ঘুমে যায় মিশে
ক্লান্তির মন্থর শ্লোকে,
অভিভূত হঠাৎ কখনো
ফুলের পাপড়ির মতো আকাশকে বলে, ‘ঐ শোনো
কার যেন বাঁশি বাজে, স্পন্দিত পৃথিবী!’-শুধু তার মনে হয়
কোথাও অলক্ষ্যে কোনো নিঃসঙ্গ ফলের মতো একটি হৃদয়
গড়ে ওঠে। সারাক্ষণ ভাবনার কত ছায়া ঝরে,
সে কার স্পর্ধিত মাথা লোটে আজ ব্যথার পাথরে?
সোনার শিকল পায়ে পারেনি পরাতে কেউ তার
ত্রিলোকের ত্রিসীমায়। একটি অরূপ নদী প্রাণে বয় যার,
সে যায় চলার ধ্যানে, জনহীন বনে সে-ও পথভ্রষ্ট, জানে সব দিক
নির্দয় কালোয় মাখা, তবু এক তৃষ্ণা তাকে করেছে পথিক।
এবং অভ্যাসবশে
উদাসীন সে-ই আসে ফিরে
সাতপুরুষের জীর্ণ ভিটের তিমিরে
মাঝে-মাঝে, আলোর দাক্ষিণ্য নেই, তবু কিছু তুলে নিতে বাসনার ফুল
পুরোনো পিদিম জ্বালে। মনে পড়ে ছিল কার কালো চুল সুগন্ধে আকুল।
সে জানে নিজের কিছু পরিচয়, জানে তার বয়সী কপালে
ক্রটির তিলক কাটা, একা-একা তাই শুধু জ্বালে
ব্যথার আগুন মনে। কোনো দিন অপরের দীপ্ত গুণে, জয়ে
হয়নি অসূয়া-দীর্ণ, তারও চোখ রূপ খোঁজে, অথচ আপন মুখ ভয়ে
কখনো দেখে না ভুলে। তাকে আর কে দেবে অভয়?
একটি অরূপ নদী (জানে সে-ও) প্রাণে তার বয়।
সেই ঘোড়াটা
আস্তাবলে ফিকে অন্ধকার, ঝুলছে নিষ্কম্প স্তব্ধতা,
আর সেই বেতো ঘোড়াটা অনেকক্ষণ থেকে ঝিমোচ্ছে
নিঃশব্দে কোনো আফিমখোরের মতো, মাঝে-মাঝে শুধু
ফোলা-পা নাড়ছে ঘাড় ঝাঁকিয়ে।
আস্তাবলে ধারে নোংরা নর্দমা, তার পিছল জলে
একটা থ্যাঁতলানো ইঁদুর ক্রমাগত ধুয়ে-ধুয়ে
রূপান্তরিত বিলীয়মান সমাতন স্বপ্ন-স্মৃতি যেন
মঞ্জরিত ওর বিকল্প অস্তিত্বে।
বিশাল আকাশে ফুটেছে পারিজাতের মতো চাঁদ,
হলদে খড়ের শয্যায় বুড়ো সহিস ঘুমিয়ে আছে সেখানে
ক্লান্ত দেহে, নিঃসন্তান, বিপত্নীক-নিদ্রিত
কাঠের নকশা যেন অবিকল।
ঘোড়াটাও ঝিমোচ্ছে, কিন্তু তার ক্ষত-নিঃসৃত মদিরা
মাতালের মতো অধীর আগ্রহে বুঁদ হয়ে পান করছে তিনজন মাছি;
এক কোণে নিস্তেজ কুপিটা কোনো প্রেমিকের বিলুপ্ত প্রেমের মতো
জ্বলছে এক বিষণ্ন আচ্ছন্নতায়।
এই তো এখানে নর্দমার ধারে কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন প্রৌঢ়
মাটির ভাঁড়ে ঢক্ ঢক্ শব্দ করে গিলেছে তাড়ি,
সব অনুতাপ হাওয়ায় উড়িয়ে, জ্যোৎস্নায় ভেজা ঠোঁটে
পান করেছে পূর্বপুরুষের স্মৃতি-বিষ!
আর রাত্রির তারাময় আঁধারে তারা হাতের মুঠোয়
কামনা করেছে অপ্সরীর স্তন, তারপর বিষাক্ত কোনো বাষ্পে
স্ফীত হয়ে ট’লে-ট’লে চলে গেছে যে যার গণিকার ঘরে।
এখন এখানে শূন্যতার ভার।
আস্তাবলে সেই বেতো ঘোড়াটা নিমেষে
তন্দ্রার ঘোর কাটিয়ে উঠল, আশ্চর্য এক ফুল হয়ে
জন্ম নিল তার ইচ্ছা, শিরায় শিরায়
সঞ্চারিত হল সে ফুলের সৌরভ।
চকিতে নোংরা নর্দমা হয়ে ওঠে অপরূপ সরোবর,
খড়কুটো, ছেঁড়া ন্যাকড়া থ্যাঁতলানো ইঁদুর, ফুলের তোড়া মণিরত্ন হয়ে
ঝলসে ওঠে ওর চোখে, আর সে নিজে উড়ে গেল
মেঘপুঞ্জে, নক্ষত্রগুচ্ছে, শূন্যের নীলিমায়।
মুহূর্তে মুছে গেল সময়ের সব ব্যবধান,
মেঘের বৈভবে সে ফিরে পেল তার অবলুপ্ত কান্তি,
আর ভেসে চলল আকাশ থেকে আকাশে অকান্ত গতিতে
কবির মতো নিঃশঙ্ক, সহজ একা।
১৩৫৭-র একটি দিন
দৈনন্দিন নগরে ও বন্দরের ভিড়ে যত মুখ
দেখি, ছুঁই যত হাত, রংছুট জীবনের যত
টুকরো ছবি তুলে নিয়ে মনে রোজ ফিরে আসি ঘরে,
বু্দ্বুদের মতো সবি একদিন হারায় সুদূরে,
মিলায় কৌতুকী ধূপে। সবি মুছে যায়? তবু কিছু
সুবর্ণ ঘটনা
জমা থাকে জাদুকর সময়ের আশ্চর্য থলিতে।
বিস্ময়ের স্তব্ধ তটে দাঁড়িয়ে দু’জনে
মুখোমুখি পদ্মার স্টিমারে,
উন্মীলিত চোখের আকাশে
বিদ্যুতের মতো উঠল জ্বলে প্রিয়-সম্ভাষের শিখা।
ডেকের রেলিং ধরে সে-ও পদ্মাপারের সুদূরে
এক ফোঁটা কাজল গাঁয়ের দিকে, ধু-ধু শূন্য চরে
চেয়ে ছিল অপলক চোখে;
জেলেদের সরু ডিঙি চলে গেল ঢেউয়ের আড়ালে।
পদ্মায় সন্ধ্যার ছায়া। দূরযাত্রী পাখিকণ্ঠে সাড়া
দিগন্তের অদৃশ্য নূপুরে,
এখানের একদিন ছিল নাকি রৌদ্র-ছায়া-আঁকা
কোনো গ্রাম,-কোমন শিশিরে আর ঘাসে পরিপাটি,
হয়তো মুখর হ’ত মানুষের উজ্জ্বল উৎসবে সেই গ্রাম
এখন যেখানে শুধু জলের ধূসর মরুভূমি।
মদির চুলের গাঢ় তিমির-সৌরভে
সহস্র রজনীগন্ধা হৃদয়ের উষ্ণ অন্ধকারে
উঠল ফুটি থরে-থরে, তখন হঠাৎ যদি নিতাম মুঠোয়
তুলে তার দুটি হাত, স্নিগ্ধ গালে উঠত জেগে লজ্জার আশ্চর্য রামধনু
আর যা হ’ত (বলা নয়) ভাবা যায় শুধু।
দূরন্ত পদ্মার
অজানা যাত্রীর সাথে সে-ও নেমে গেল
একফোঁটা গাঁয়ের স্টেশনে,
জলে তার পূর্ণ ছায়া, বাতাসে রুমাল, মেঘে-মেঘে ঝাপসা চোখ,
প্রৌঢ় পিতা বিব্রত শরীরে
জড়িয়ে পুরোনো শাল নামলেন ধূসর ডাঙায়
পিছনে আড়ষ্ট গিন্নি, শিশুপুত্র। কন্যা অষ্টাদশী।
সারেঙের তীব্র বাঁশি, নিচে ফের চাকার তলায়
উচ্ছল, ফেনিল জল-দূরে নীল কুয়াশায় সুখী পরিবার।
পেরিয়ে বাঁশের সাঁকো, মাঠ। মধ্যযুগী
অশ্বত্থের নিচে হেঁটে যেতে
হয়তো পড়বে চোখে পথের কিনারে
পাড়াগাঁর কোনো
দুরন্ত ছেলের কিছু ফেলে-যাওয়া ম্লান বুনো ফল,
কড়ি আর রাঙা নুড়ি ছেঁড়াখোঁড়া খেলার সংসার।
কার কথা ভেবে-ভেবে সেই মেয়ে পৌঁছে যাবে শেষে
তার সাতপুরুষের দেশের ভিটায়? কত সুবর্ণ ঘটনা
জমা থাকে জাদুকর সময়ের আশ্চর্য থলিতে।
সগর-শিয়রে রোজ সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের ছবি
রং ঢালে, প্রজ্বলিত হয় দিনলিপি।
কে যেন ফুঁ দিয়ে
বারবার খুলে দেয় রহস্যের থলি;
ঝরায় বর্ষার জল প্রথামতো আষাঢ়, শ্রাবণে,
পথ চলি আশার উল্লাসে!
সব কলরব, সব গুঞ্জন ছাপিয়ে
মাঝে-মাঝে তাকে মনে পড়ার মতন
সমুজ্জ্বল বেদনায় হৃদয়কে ছিঁড়ে
জেগে ওঠে দূরন্ত পদ্মার সেই সফেন কল্লোল।