- বইয়ের নামঃ প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ দরজা থেকে
আমিতো যুবক নই, মধ্য বয়সের রুক্ষ পথে
নিঃসঙ্গ চলেছি হেঁটে রৌদ্রদগ্ধ আর ঝঞ্ঝাহত
অভিজ্ঞ শরীরে নিয়ে পথনিষ্ঠ শ্রমণের মতো।
বিমুখ সকল দিক, তবু আছি টিকে কোনো মতে।
কেটেছে আমার দিন পথের কিনারে বৃক্ষমূলে
বসে গান শুনে গোত্রহীন কোনো একলা পাখির,
আলোজ্বলা কুটিরের খোঁজে, ভুলি কামড় ক্লান্তির,
যখন আমার দিকে তুমি তাকাও দু’চোখ তুলে।
পিঙ্গল বয়স নিয়ে তোমার নিটোল যৌবনের
নিকটে সর্বদা নতজানু আমি; প্রতিদ্বন্দ্বী যারা
তাদের বৈভব আছে জ্বলজ্বলে, যদিও মনের
ঐশ্বর্যে কাঙাল নই আমিও এখনো। তুমি ছাড়া
কে জানে আমার হৃস্পন্দন কত তেজী, প্রেমময়?
অথচ দরজা থেকে আমাকেই ফিরে যেতে হয়।
ভিমানী বাংলাভাষা
মানুষের অবয়ব থেকে, নিসর্গের চোখ থেকে
এমন কি শাক সব্জি, আসবাব ইত্যাদি থেকেও
স্মৃতি ঝরে অবিরল। রাজপথ এবং পলাশ
যখন চমকে উঠেছিল পদধ্বনি, বন্দুকের
শব্দে ঘন ঘন, স্মৃতি নিজস্ব বুননে অন্তরালে
করেছে রচনা কিছু গল্প-গাথা, সত্যের চেয়েও
বেশি দীপ্র। কান্তিমান মোরগের মতো মাথা তুলে
কখনো একটি দিন দেয় ডাক, পরিপার্শ্ব দোলে,
মানুষ তাকায় চতুর্দিকে, কেউ কৌতূহলে, কেউ
গভীর তাগিদে কোনো, যেন কিছু করবার আছে,
সত্তায় চাঞ্চল্য আসে। করতলে স্বপ্নের নিভৃতে
মনে পড়ে, দিকচিহ্ন, গেরস্থালি, নক্ষত্র দুলিয়ে
অভিমানী বাংলাভাষা সে কবে বিদ্রোহ করেছিল।
আমার প্রেমের মধ্যদিনে
তোমার চুলের রাত্রি, শিখা-জিত আমাকে জড়ায়
গনগনে দ্বিপ্রহরে। তোমার ব্যাকুল বাহুদ্বয়
আমার বন্দর হয়, কী নিঃশব্দ, দীপ্র গীতময়
হয়ে ওঠে নিমেষেই কম্পমান তোমার অধর
আমার তৃষিত ওষ্ঠে আর ছোট ছায়াচ্ছন্ন ঘর
রূপান্তরে ছলোচ্ছল জলপুরী, থর থর তুমি
তরঙ্গিত নদী, কখনো বা গাঢ় বেদনার ভুমি,
তোমার চোখের জল আমার আত্মায় ঝরে যায়।
চুম্বনের পূর্ণতায় সত্তাময় বিষাদের সুর
বুনে দাও নিরুপায়, তুমি হয়ে যাও কী সুদূর।
আমার প্রেমের মধ্যদিনে তোমার চোখের জল
নিবিড় আষাঢ় আনে সত্তায় খরায়, অবিরল
হাওয়া বয় হৃদয়ের ঝোপেঝাড়ে। থামে সব কথা,
তোমার অধর থেকে আমাকেই ছোঁয় অমরতা।
আমি আর করবো কত শোক
আমি আর করবো কত শোক?
অপরাহ্নে পাথরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে
খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে
মাঝে মধ্যে থমকে দাঁড়াই। ভূগর্ভস্থ কোনো স্তব্ধ
সভ্যতার মতো নিস্তব্ধতা চর্তুদিকে।
এদিক ওদিক, সবদিকে
খানিক তাকিয়ে, পাথরের মধ্যে দিয়ে
খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে
দু’পায়ে বাজিয়ে নুড়ি এগোই একাকী।
ছায়াচ্ছন্ন পথ, সাঁকো, উঠোন, ইঁদারা
পুরোনো কালো পাম-সু, বিবর্ণ,
বিবাহমণ্ডপ, নৈশ ভোজ, ঝলমলে গোরস্থান,
নানান বয়সী কত মুখ ভেসে ওঠে বারংবার।
খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে
দু’পায়ে বাজিয়ে নুড়ি এগোই একাকী।
খেলাচ্ছলে চড়ুইয়ের নকশা-প্রায় কংকাল একদা
গিয়েছি ভাসিয়ে জলাশয়ে, মনে পড়ে। নিজস্ব কৌতুক ভুলে
হঠাৎ বালক তার ভেজা হাত দেখে সন্ধ্যেবেলা
অবুঝ কান্নায় ঢেউ হয়েছে সবুজ।
পাখির কংকাল আর নিজের আঙুল
ভীষণ অভিন্ন ভেবে কেটেছিল তার সারা রাত।
হিরন্ময়ী তরুণীর ঈষৎ ঘর্মাক্ত
উরুর মতোন দ্বিপ্রহরে
লাশের শিয়রে নতজানু, একজন
কর্পুর মৃতের কাছে কীরকম ব্যবহারযোগ্য
ভেবে খুব বিহবল হয়েছে কোনোদিন,
মনে পড়ে।
নুড়ি আর খুব উঁচু বুনো ঘাস বুকে চেপে, দূরে
পাখির কংকাল হাতে নিয়ে
প্রাচীন শ্যাওলাময় জলাশয়ে ডুবিয়ে দু’হাত
কতিপয় মুখের পিছনে
পাথরের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে
আমি আর করবো কত শোক নিশিদিন?
ইচ্ছেগুলি থেঁতলে দিয়ে
ইচ্ছেগুলি থেঁতলে দিয়ে করলে এ কি?
চেয়ে চিন্তে কয়েক বিঘে দুঃখ নিলে?
দুঃখ-দুঃখ বেড়াল শুধু তীক্ষ্ম দাঁতে
মাংস ছিঁড়ে হৃদয় ফুঁড়ে ওষ্ঠে চাটে।
তার সে অঙ্গে সঙ্গ চেয়ে মনের ভেতর
মৎস্য হয়ে কেমন তুমি একলা হ’লে।
তীষণ দগ্ধ দূর শতকী পাখির বাসা
স্বপ্নে কেন ভস্ম ছড়ায় বারে বারে?
বহুকালের উজান বেয়ে জ্বলজ্বলে তার
যুগল বাহু জড়ায় কেন স্মৃতির গ্রীবা?
শিরায় শিরায় এখনো কি জ্বলবে প্রদীপ,
উড়বে পায়রা হৃদয় জুড়ে অবিরত?
এই শহরে নগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে
দেখলে হঠাৎ প্রচুর বেলা অস্ত গেল।
রৌদ্র-সেঁকা শিশিরভেজা জামা তুমি
ছেড়ে ছুড়ে বললে এবার ফিরতে হবে।
ফিরতে গেলেই যায় কি ফেরা? পায়ের নিচে
শুকনো পাতা, ব্যর্থ শিল্প কান্না জোড়ে।
ইচ্ছেগুলি থেঁতলে তুমি সামনে গিয়ে
ক্লান্তভাবে খুললে মুঠি বেলাশেষে-
নেই তো কিছুই, কী-যেন সব ছাইয়ের মতো
পড়ছে ঝরে,বিষণ্নতা আসে ব্যেপে।
বিঘে কয়েক দুঃখে তুমি কেমন ফসল
তুলবে বলো? পঙ্গপালের শব্দ জাগে।
ইদানীং সন্ধ্যেবেলা
বকুলের ঘ্রাণময় পথে কিংবা শেফালির নিজস্ব ট্রাফিক আইল্যান্ডে
কার সাথে রফা করে প্রেমের এগারো দফা কর্মসূচি আমি
বাস্তবায়নের পন্থা বেছে নেবো? আমার এ প্রশ্নে সন্ধ্যেবেলা
বকুল বিমর্ষ ঝরে যায়,
শেফালির চোখে
বাষ্প জমে। পথে পাতা, রাশি রাশি, ডালপালা, মৃত পাখি দেখে
এখানে একটা কিছু ঘটে গেছে ভয়ংকর, যে কোনো পথিক
বলে দিতে পারে সহজেই। একটি মানুষ তার একাকীত্ব
নিজের ভেতরে রেখে হেঁটে গেছে কতবার এ রকম
দৃশ্যের ভিতরে।
তার হাতে ছিল স্মিত অমল পতাকা, চোখে দূরত্বের আভা,
তার দীর্ঘ ভ্রমণের স্বীকৃতি রয়েছে কত নিরালা নিশ্বাসে,
ভরপুর সারাবেলা, কেমন অচেনা গানে গুঞ্জরিত
সরাইখানায়।
ভ্রমণ ছাড়া কি পথিকের অন্য কাজ নেই? পথে কত গহন দুপুর
কত অমানিশা তাকে ঢেকে দ্যায় কোমল আদরে?
সবুজ রৌদ্রের কাছে বেগুনি জ্যোৎস্নার কাছে হাত
পেতে সে কি
চেয়ে নেয় কিছু ঝুলি ভরে তোলার আগ্রহে?
এবার প্রশ্নের পর প্রশ্ন বারংবার
চঞ্চু ঠোকে; যেতে যেতে দেখে যাই আমার নিজের আকাঙ্ক্ষাকে
আমি গলা টিপে হত্যা করি; সন্ধ্যেবেলা
গোলাপ-স্পন্দিত পথে নিঝুম গ্রহণ করে কত মৃতদেহ।
হত্যাকারী বড় একা, পরিত্যক্ত; চরাচর আর্তনাদ করে।
বহুদিন থেকে যোগফল নিয়ে ভাবছি, অথচ বারংবার
বিয়োগ করতে হয়, বিয়োগান্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই।
দেখেছি সতেজ সুখ কতদিন বাইসাইকেল
চালাতে চালাতে গায়ে খড়কুটো, শুকনো পাতা
ফুলের পরাগ,
কখনো বা টুকরো টুকরো রঙিন কাগজ
নিয়ে টগবগে গান গেয়ে হাসিমুখে গেছে দিগন্তের দিকে।
হঠাৎ কোত্থেকে দুঃখ চায়ের দোকানে এসে বসে
আমার টেবিলে হাত রেখে;
মুখোমুখি বসে থাকে বহুক্ষণ, বলেনা কিছুই।
কেবল চামচ নাড়ে, বিস্কুটের ভগ্নাংশ খিমচে তুলে নেয়
নখ দিয়ে নিরিবিলি ভীষণ ঔদাস্যে,
যেন কবি-মূর্তি, সামাজিক দাবি ভুলে, সর্বস্ব খুইয়ে
স্বপ্ন পেতে চায়।
সন্ধ্যেবেলা খুব শূন্য হয়ে গেছে ইদানীং। পাখি ডাকে
পাতা ঝরে,
একজন গৌণ ব্যক্তি বসে থাকে খুনীর মতোন একা, তার
মুখ কবরের ঘাসে থুবড়ে পড়ে আছে কাদামাখা,
পোকা মাকড়ের মধ্যে। সুন্দরের পায়ে চুমু খেয়ে
ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ে যায়, আপনার নিশ্বাসের প্রতি
বিরূপ সে ইদানীং, দীর্ঘশ্বাস হয়ে তাকে। নিজেকে কর্কশ
লাগে তার।
ভালোবাসা যদি পুনরায় ফুল্ল মুখ তুলে চায়
ভালোবেসে, তবে আমি বাইসাইকেল চালিয়ে দিগন্তে যাবো
বকুল শেফালি আর জুঁই নীল দীর্ঘ পথে ছড়াতে ছড়াতে।
ঈদকার্ড, ১৯৭৭
হঠাৎ হারিয়ে ফেলি যদি দৃষ্টিশক্তি কোনোদিন,
তবুও তোমাকে আমি দেখবো সর্বদা সবখানে।
যদি পক্ষাঘাতে হই হীনবল, চলৎশক্তিহীন,
তথাপি নিশ্চিত আমি ছুটে যাবো তোমারই বাগানে,
যেখানে থাকবে বসে তুমি সবুজ মেঘের মতো
ঘাসে কিংবা ডাল থেকে অন্যমনে তুলে নেবে ফুল।
যদি কোনো দ্রুত ধাবমান যান কিংবা দৃষ্ট ক্ষত
কেড়ে নেয় আমার দু’হাত, তবু তোমাকে ব্যাকুল
বাঁধবো নিবিড় আলিঙ্গনে। যদি ওষ্ঠ মুছে যায়
নিষ্ঠুর ফুৎকারে কারো, তবু গাঢ় করবো চুম্বন
তোমার মদির তাপময় অস্তিত্বের কিনারায়
বারংবার, যদি স্তদ্ধ হয়ে যায় এই হৃৎস্পন্দন
আমার, তবুও শিরাপুঞ্জে প্রতি রক্তকণিকায়
তোমাকে ধারণ করে একা পড়ে থাকবো শয্যায়।
উল্টো দিকে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন
অন্ধের মতোন আমি অন্ধদের মধ্যে সারাক্ষণ
হাতড়ে বেড়াই কী-যে বুঝি না নিজেই।
পুরোনো চিঠির খাম? চকচকে শূন্য থালা, নাকি
টগর, মল্লিকা ফুটফুটে?
দলছুট কাকাতুয়া? রঙিন টিকিট?
কোথাও না-পাওয়া
কখনো না-দেখা
মানুষের হৃৎপিণ্ডের মতো থর থর কোনো প্রাণী?
মেঘের জঙ্গল থেকে নেমে আসা এবং হাওয়ায়
ভাসা নানারঙা ঘোড়াদের ফুল্ল দানাপানি? শোনো,
যা হোক একটা কিছু হাতে
এলে, ছুঁতে গেলে স্মৃতিময়, স্মৃতিহীন
যে-কোনো জিনিশ,
স্বস্তি পাবো ভেবে ঘুরি সবখানে। কখনো বাড়াই হাত ডানে,
কখনো-বা যাই বাঁয়ে, একটানা খুঁজি।
মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন করি-দোটানায়
এভাবে ফুরোবে তবে জীবনের পুঁজি রুক্ষ পথে, বধিরের
আস্তানার?
বিবর্ণ যুগল চেয়ারের অভ্যন্তর থেকে
ভেসে আসে স্বর
এখানে খুঁজো না কিছু, হবে প্রতিহত।
দেয়ালে সন্তের চোখ, ধারালো, সুদুর-
চোখ ডেকে বলে
এখানে খুঁজো না কিছু, হবে প্রতিহত।
তুমি শত লোক হয়ে খুঁজলেও আহতের ব্যান্ডেজের মতো
সান্তনা পাবে না।
ফিরে যাও, তুমি ফিরে যাও।
ভয়-পাওয়া শিশুর মতোন
ভয় চোখ ঢেকে থাকে পাঁজরের ভেতরে, আমার,
বলে শিউরোনো কণ্ঠস্বরেঃ
এখানে খুঁজো না কিছু অন্ধ নিকেতনে,
ফিরে যাও, তুমি ফিরে যাও।
মানুষের হৃদয়ের ভেতরে চালিয়ে দিয়ে খুব
কম্প্রমান পাঁচটি আঙুল
ভীষণ পাথুরে কিছু করি অনুভব, বাড়ে উপদ্রব।
গোলাপের গল্প শুনে সাত তাড়াতাড়ি
গোলাপ বাগানে যাই, দরজা পেরিয়ে বুঝি, রকের বাশিন্দা
অতিশয় ধাপ্পাবাজ সে কথক। কীটের পাহাড়ে
গৌতম বুদ্ধের পোজে
বাহারী পোশাক পরে বসে আছে সঙ, কোলে তার
কংকালের ভায়োলিন, তার চক্ষুদ্বয়
পাখির পুরীষে ঢাকা, আমি
দ্রুত ফিরে এসে দেখি ক্রমাগত উল্টো দিকে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন।
একদা
সতেজ ঘাসের মতো চকচকে এক ঘোড়া দৌড়ে এসে
একটা জলাশয়ের সামনে দাঁড়ালো।
তখনো তার কেশর থেকে, ক্ষুর থেকে মুছে যায়নি সূর্যাস্তের রঙ।
টলটলে জলের দিকে গ্রীবা বাড়িয়ে
দেখলো সে, আধখানা চাঁদ বন্দিনি রাজকন্যার মতো
চেয়ে আছে তার চোখের প্রতি।
বনের ঘন কালো আকাশের নিষ্পলক চেয়ে থাকা-
সব কিছু অমান্য করে সে
তার মুখ বাড়িয়ে দিলো জলাশয়ে, জলপানের জন্যে নয়,
বন্দিনি রাজকন্যার ওষ্ঠে চুম্বন আঁকার জন্যে।
শীতল পানির স্পর্শ নিয়ে ফিরে এল ওর মুখ
অচুম্বিত, বিচূর্ণিত চাঁদ
প্রত্যাবর্তন করে তার নিজস্ব অবয়বে।
তেজী আর চকচকে ঘোড়াটার কেশর থেকে
ঝরতে থাকে বিন্দু বিন্দু
জলের মতো স্বপ্ন আর
স্বপ্নের মতো জল।
রহস্যময় বনের দিকে তাকিয়ে
হঠাৎ ঘোড়াটার মনে পড়ে গেল
সেই ভুলুণ্ঠিত তেজস্বী সওয়ারের কথা, একদা যে তার পিঠে বসে
ঘুরে বেড়াতো দূর-দূরান্তে,
যার হাতে ছিল ভালোবাসার পতাকা
আর মাথায় সূর্যের মতো উষ্ণীষ।
এখন তোমাকে ছাড়া
আসে না দু’চোখে ঘুম কিছুতেই কোনো কোনো রাতে
তোমাকে প্রবল ভেবে। কত হিজিবিজি, ছায়াবাজী
প্রহরে প্রহরে দেখি, দেখি অস্থিচর্মসার মাঝি
নৌকোর কংকাল নিয়ে বুকে ঝোড়ো জলের আঘাতে
ছিন্নভিন্ন কালো চরে। নয় সবুজ পাতার ভিড়ে,
ভাঙা কবরের পাশে একটি কোকিল করে বাস,
স্মৃতিপোষ্য, আর গানে তার শিহরিত বুনো ঘাস
ঘন ঘন, মহাকায় কৃকলাস ঘোরে নদীতীরে।
নির্ঘুম রাত্তিরে জ্বলি শূন্য ঘরে অত্যন্ত একাকী,
কী বলতে কী বলে ফেলি নিজেকেই। একটি প্রতিমা,
সে তোমারই অবয়ব, জেগে ওঠে বাস্তবের সীমা
ছিঁড়ে খুঁড়ে, পুনরায় স্বপ্নস্মৃতিময় সে বৈভব
সরে যায় দূরে, ভগ্ন কণ্ঠে ডাকি, তোমাকে ডাকি,
এখন তোমাকে ছাড়া সুনিশ্চিত বাঁচা অসম্ভব।
এখনো উদ্বেগে কাঁপি
এখনো কি অন্ধকার কোণে একা ভীষণ নিশ্চুপ
আড়ালে থাকবো বসে? এখনো কি কারো খুব কালো
চুলের ছায়ার কথা ভেবে-ভেবে, গহন দৃষ্টির
অত্যন্ত রাঙ্ময় কোনো ভিতর ভূবন আবিষ্কার
করে দিব্যি সম্মেহিত কাটাবো প্রহর? এখনো কি?
নিজের প্রশ্নের কাছে নিজেকেই বড় অসহায়
মনে হয়। সে আমার দিকে তার সুরভিত
করতল পুনরায় বাড়িয়ে দেবে কি ভেবে আমি
এখনো উদ্বেগে কাঁপি। বৈরী বায়ুস্তরে বিপর্যস্ত
ঈগল আবার যদি না পায় আশ্রয় কোনোখানে,
তবে কার কী বা এসে যায়? তার ছিন্ন ডানা থেকে
একটি অস্পষ্ট ইতিহাস আর্তস্বরে উন্মোচিত
হতে চায়। ঝড়ক্লান্ত ঈগলের রক্তাক্ত ডানায়
আমার অতীত মগ্ন, নিজেরই শোণিত করি পান।
এবং প্রকৃত বিল্পবীর মতো
আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন, হৃদয়ের ক্ষত
শুঁকি, চাটি বারংবার। বোমাধ্বস্ত শহরে যেমন
নিঃসঙ্গ মানুষ ঘোরে, খোঁজে চেনা মুখ কিংবা
স্বজনের মৃতদেহ, প্রত্যহ আমি তেমনি করি
চলাফেরা একা একা। ধ্বংসস্তূপে চোখ পড়লেই
আমার অস্তিত্ব করে আর্তনাদ। কবেকার গাঢ়
বেহালার সুর বাজে পুনরায়, সভ্যতার পোকা-ছাওয়া মাংস
স্পন্দিত সে সুরে।
একটি ভালুক, লাল, বড় স্তব্ধ, বহুদিন থেকে
নিরিবিলি ঘরে
রয়েছে দাঁড়িয়ে ঠায়। যদি প্রাণ পায় চলে যাবে তাড়াতাড়ি
মৌচাকের খোঁজে দূরে বাড়িটিকে ফেলে। বিটোফেনি সুর ঝরে
তার গায়, চক্ষুদ্বয় অত্যন্ত সজীব হতে চায়। নিরুপায়
অন্ধতায় তার বেলা যায়।
একটি চিঠির খাম পড়ে আছে টেবিলের বুকে গোধূলিতে
নিষ্প্রাণ পাখির মতো। পুরোনো চেয়ার অকস্মাৎ
দূর শতাব্দীর
সিংহাসন হ’য়ে মিশে যায় ফ্যাক্টরির কালো পেঁচানো ধোঁয়ায়।
চতুষ্পার্শ্বে সভ্যতার মতো কিছু গড়ে ওঠে, ভেঙ্গে যায় ফের,
কম্পমান অন্ধকারে একরাশ বেহালা চোখের মতো জ্বলে।
কবির মেধার কাছে সভ্যতা কী চেয়ে বিমুখ হয়ে থাকে
বারংবার? মরণের সঙ্গে দাবা খেলে অবসন্ন কবি,
পাণ্ডুলিপি, ফুল মেঘে ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় অবেলায়।
আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। কবি জনস্রোতে,
মোটরের ভিড়ে বুনো ঘোড়ার মতোন থতমত;
আর্তনাদ করে তার পেশী, চক্ষুঃশিরা যেন স্মৃতি
ক্রন্দনের মতো আসে ব্যেপে অস্তিত্বের কন্টকিত তটে!
চতুর্দিকে বাজে ট্রাফিকের কলরব, চোখ বেয়ে
ঝরঝর মুহূর্ত ঝরে, জনতার পাশাপাশি মৃত্যু হাঁটে,
কোথায় সে গোধূমের ক্ষেত পুড়ে যায়, শূন্য ঘরে
টেলিফোন একটানা বেড়ে চলে, শুনেছো তো, হায়,
রেডিয়োর সন্ধ্যার খবরে।
এলভিস প্রেসলির মৃত্যু রটে গেছে চরাচরে। চারখানায়
আড্ডা জমে, পপ সুরে মারফতী গান শুনে মাথা নাড়ে বিগত-যৌবন
ফেরিঅলা। অন্ধকারে তরুণ কবির চোখে পড়ে
অপ্সীরর স্তন,
হিজড়ের সুবজাভ গাল, নর্দমায় ভাসমান সুন্দরীর মৃতদেহ।
দ্যাখো দ্যাখো এ শহরে কী ঘর বানায় ওরা শূন্যের মাঝার।
আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। এখন কোথায় তুমি কোন
সভ্যতার আলো
চোখে নিয়ে আছো শূন্য বারান্দায়? সৌন্দর্য তোমার
সাথে আছে, তোমাতেই মিশে আছে। পাথরের সিঁড়ি
ভেঙ্গে ভেঙ্গে হেঁটে
বহুদূর চলে গেছে বুঝি? একজন কবি তার ব্যাকুলতা,
শব্দপ্রেম রেখেছিলে। তোমার কোমল অঞ্জলিতে-
মনে পড়ে নাকি?
থেমে-যাওয়া ক্যাসেটের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে জানালার
বাইরে কি যেন দেখানোর ছলে আমার আপন
হৃদয়ের অন্তলীন গুহার আঁধার কত সজীব জাগ্রত
দেখে নিতে চেয়েছিলে? অদৃশ্য হরিণ কাঁদে তোমার বাগানে
গভীর রাত্তিরে ঘুরে ঘুরে।
বারান্দায়, ছাদে আর সিঁড়িতে অস্পষ্ট পদধ্বনি, বাড়িটার
দু’চোখে পা ঠোকে ঘোড়া, কার জেল্লাদার পোশাকের
স্পর্শ লাগে তার গালে, বুকে বিদ্ধ কামার্ত নিশান।
বিপ্লবের আগুনের মতো কিছু চক্রাকারে ঘোরে চতুর্দিকে,
কেউ হাত সেঁকে, কেউ পুড়ে ছারখার হয়। হৃদয় কী ঘোরে
সময় আবৃত্তি করে, প্রতীক্ষায় থাকে, জ্বলে আবেগকম্পিত,
স্মৃতিভারাতুর কোনো গজলের মতো।
আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন। কখনো সখনো লোকজন
থাকে বটে আশেপাশে কিংবা
চেনা মহলের চৌহদ্দিতে বসবাস করতেই হয়, কণ্ঠ
মেলাতেই হয় সংসারের ঐকতানে, তবু আমি দৈনন্দিন
কলরবে অকস্মাৎ কেমন রহস্যময় হয়ে উঠি নিজেরই অজ্ঞাতে,
কেমন নিশ্চুপ
এবং প্রকৃত বিপ্লবীর মতো জেগে থাকি নিজস্ব ভূগর্ভে
উদাসীন, একা।
কখনো কখনো স্মৃতি
কখনো কখনো স্মৃতি রাজনীতির মতোন তীব্র
হয়ে ওঠে, ক্রমাগত জিভ তার এগোতেই থাকে।
কোনো কোনো বস্তু কিংবা ব্যক্তি রশ্মির আকারে
স্মৃতির জিহ্বায় নাচে, কখনো বা স্মৃতি অকস্মাৎ
ভীষণ অসামাজিক। কুয়োতলা,সাঁকো, মুখচ্ছবি
ধু-ধু হৃদয়কে করে গোপনে লেহন। বেঁচে থাকা
আপাতত গলি, পার্ক ফুটপাতে সমর্থন পেয়ে
আমার নিজের মধ্যে সুড়ঙ্গ বানায় রাত্রিদিন।
কুয়োজলে স্নান সেরে কেন নদীতীরে চলে যাই?
এখনো মাথার চুল অতিশয় ভেজা, বেলাবেলি
আবার ফিরলে ঘরে দেখবো কি অম্লান বাসন
সাজিয়ে রেখেছে কেউ। হাত-পাখা মাদুরের কাছে
স্বপ্নের হাতের মতো শুয়ে আছে দেখবো কি খর
মধ্যাহ্নে অথবা পাবো শুধু ধবধবে শূন্যতাকে?
কবির ডায়েরী
সকালে ফাউস্ট পড়লাম, কিছুক্ষণ তরতাজা
সংবাদপত্রও বটে, সদ্য-দেখা যুদ্ধার্ত পোলিশ
ফিল্মের নানান শট মনে পড়ে। করি ঘষামাজা
পঙক্তিমালা কবিতায়, জানালায় মেফিস্টোফিলিস
হাসে, পা দোলায় ঘন ঘন, তার উত্তোলিত ভুরু
সর্বক্ষণ জপে মৃত্যু, কখনো বা হঠাৎ দাঁড়িয়ে
আমাকে শোনায় তত্ত্ব রাশি রাশি। ভেনাসের ঊরু
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কিংবা প্ল্যাটো দিলেন বাড়িয়ে
তাঁর হাত মগজের কোষে কোষে। বেহুলা কখন
আসে লখিন্দরময় ভেলা নিয়ে খলখলে জলে,
নিজেই বিস্মিত হই। চিত্রকল্প যখন তখন
নেচে ওঠে চতুষ্পার্শ্বে, দেয়ালের থেকে কত ছলে হঠাৎ বেরিয়ে আসে চিত্রমালা,
শূন্য থেকে আসে,
যেমন মেঘের পরে জমে মেঘ। দুপুরে চৈনিক
রেস্তোরাঁয় তিনজন তীক্ষ্ম সমালোচকের পাশে
বসে আস্তে সুস্থে করলাম মধ্যাহ্ন ভোজন, ঠিক
বুঝতে পারিনি কী যে ওঁরা তিব্বতী মন্ত্রের মতো আউড়ে গেলেন কিছুক্ষণ নিশ্চল
জ্যাকেট হয়ে,
বোঝালেন কী কী বস্তু নিরঞ্জন সাহিত্যসম্মত।
বেরুলে নতুন বই কিছুকাল থাকি ভয়ে ভয়ে।
রিভিউ মুদ্রিত হলে কোথায় নতুন পাণ্ডুলিপি
আপনার বলবে কি প্রকাশক কিংবা সম্পাদক
‘আগামী সংখ্যায় অবশ্যই লেখা চাই’, বলে ছিপি
খোলা সোড়া বোতলের মতো হবেন কি? ধ্বক
করে ওঠে বুক অকস্মাৎ। থাক, আপাতত বেলা
থাক আড্ডা দিয়ে বাদ্য শুনে, স্বপ্নলোকে ছুঁড়ে ঢেলা।
প্রায়শই গাঢ় সন্ধ্যা উপহার দেয় কিছু কথা,
লতাগুল্ময় উৎস থেকে উচ্ছ্বসিত জ্যোৎস্নামাখা।
ঝরণার মতোন হাসি, আধফোটা স্বপ্ন, ব্যাকুলতা।
চোখ বুজলেই দেখি কালো বধ্যভুমির উপরে
একটি রহস্যময় পাখি উড়ে উড়ে গান গায়
সারারাত। কবেকার মিউজিসিয়ান আস্তে করে
প্রবেশ আমার ঘরে, ধুলো ঝাড়ে শরীরের, খায়,
মদ চামড়ার থলে শূন্য করে। তার বেহালার
তারে আদি কান্না, সুপ্রাচীন স্মৃতি বাজে, আমি তাকে
ঘরে রেখে নামি পথে। ফুটপাত, গাছ, অন্ধকার,
বেশ্যার চোখের মতো রেস্তোঁরার আলো শুধু ডাকে
আমাকেই, যে আমি তাদের আপনজন আর
আমার নিবাস এখানেই, এই সত্য হয় গান
অস্তিত্বের মাঠে, পুনরায় মধ্যরাতে ফিরে আসি
ঘরে, কড়া নাড়ি, শুতে যাই, দেখি বিধ্বস্ত বাগান
ঘরময়, পরাভুত নগরীর দেয়াল, মিনার
স্মৃতির অরণ্য চিরে জাগে, শব্দের বুদ্বুদ নাচে
শিরায় শিরায়, হয় পঙক্তিমালা, যেন আদিবাসী
আমি নগ্ন, নতজানু অন্ধকারে রহেস্যর কাছে।
ঘুমঘোরে ভাবি ফের অর্ফিয়ুস বাজাবে কি বাঁশি?
কিছুদিন থেকে
কিছুদিন থেকে আমি অতিশয় মনোকষ্টে আছি
একটি সংসার খুব খাপছাড়া অথচ সুন্দর,
স্বতন্ত্র সাজাবো ভেবে কিছুকাল ছিলাম বিভোর।
এ ব্যাপার কিছুতেই হওয়ার নয় বলে চলে গ্যাছে
পাথরের মতো কেউ, পড়ে আছে এখানে সেখানে
শেকড়-বাকড় আর সম্পর্কের ছিন্ন তন্তুজাল।
মদ্যপ যেমন তার শূন্য বাসি গেলাশের দিকে
তাকায়, আমিও তেমনি চেয়ে থাকি নিজস্ব আয়নায়
মাঝে মাঝে। কোনোদিন মুঠোয় আমার জুঁই কিংবা
চামেলী ছিল কি সত্যি? আজ হস্তময় ঘূণপোকা।
ক্ষ্যাপা, বড় ক্ষ্যাপা এই মন দীর্ঘ সূতো ছেড়ে ছেড়ে
লাটাই করেছে শূন্য। হায়, সুদূর মেঘের ঘুড়ি,
উড্ডীন রঙিন ঘুড়ি ফিরে আসবে না কোনোদিন।
হৃদয়ে অনেক মৃত প্রজপতি, মরাল-কংকাল।
স্বপ্নের ভিতরে ক্ষিপ্র ডালকুত্তা শোঁকে আমার
সর্বক্ষণ ধেয়ে আসে পেছনে পেছনে। রুদ্ধশ্বাস
আমি শুধু খুঁজি বনবাদাড়ে আশ্রয়, কিন্তু, হায়,
জঙ্গলও ভীষণ লোকালয়। স্বপ্নে ভিতরে ঘোরে,
আমার চৌদিকে ঘোরে কী কর্কশ কান ঢাকা ছায়া,
সাপ ওড়ে,আমি নগ্ন, একা ধ্বস্ত কবরখানায়।
কী করে যে বেঁচে ছিল
এখানে নানানভাবে নানাজন কাটায় জীবন।
কেউ রাস্তা খোঁড়ে, কেউ টানে গুণ ধান ক্ষেত ঘেঁষে,
কেউবা আপিশে লেখে নথিপত্র, কেউ কেউ ঘোরে
উদাস প্রান্তরে বনবনান্তরে, কেউ গেরস্থালি
ভালোবেসে নীড়মুখী পাখির মতোন মনোযোগে
সাজায় সংসার, কারো দিন যায় গাছের ছায়ায়
পথপ্রান্তে কী একাকী। কেউ কেউ নিজস্ব বিবরে
স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকে, কেউবা বাঁচার মানে খোঁজে
মিছিলে সভায় আর নেতার ভাষণে। কারো সরু
দড়ির ওপর হেঁটে-যাওয়া, কারো শুধু বসে-থাকা।
হরিদ্রাভ গ্রন্থাগারে কারো বই পড়ে কাটে বেলা,
আর নিরক্ষর কেউ জীবন বিশদ করে পাঠ
মেধাবী ছাত্রের মতো। কারো কারো চোখ এত শাদা,
তাদের দৃষ্টিতে গাছ শুধু গাছ, আকাশ আকাশ,
কেউ কেউ শূন্যতায় অকস্মাৎ দেখে ফেলে কত
সুনীল, সবুজ ঘোড়া, দ্যাখে ওরা নৌকো ফুল হ’য়ে
গহন নদীতে ভাসে। কেউ টিন আর সীসা নিয়ে
সর্বদা ঘামায় মাথা; কেউ গাছ থেকে, গর্ত থেকে
অথবা পাতাল থেকে শব্দ তুলে আনে নিরিবিলি।
এরকম নানা খাতে বয় নানাজনের জীবন।
জীবনে ঔদাস্য কিছু, কিছু গূঢ় অস্পষ্টতা থাকে।
অস্পষ্টতা হেতু বাড়ে আকর্ষণ, আংটির মতোন
পরি কত রহস্যের সোনালির হলুদ সুতো, পড়ি
বেড়ালের চোখে স্মৃতি, মৃত প্রেমিকের সঙ্গে হাঁটি
অস্পষ্ট প্রহরে পারস্পর্যহীন কালের বাগানে।
স্বাপ্নিকের আস্তানায় নৃত্যপর প্রাচীন করোটি,
ওষ্ঠে কর্কশতা আর ধূলোবালি নিয়ে বেঁচে থাকি,
অথচ পাইনি খুঁজে অদ্যাবধি বাঁচার নিয়ম।
পরবর্তীগণ সবিস্ময়ে বলবেন কোনোদিন-
সর্বনাশ গোলযোগে কী করে যে বেঁচেছিল ওরা।
কী ভাবছো তুমি?
কী ভাবছো? কী ভাবছো তুমি অন্তরালে? কাল রাত
নির্ঘুম কেটেছে বুঝি? নানা স্তর থেকে অকস্মাৎ
অসংখ্য বিলুপ্ত প্রাণী, সংহারপ্রবণ, সংহারপ্রবণ, অতি কোলাহলময়
এবং অকুতোভয়,
উঠে এসেছিল দিতে হানা
তোমার এ জরাগ্রস্ত ঘরে? মেলেছিল রুক্ষ ডানা
ভয়ঙ্কর কোনো পাখি ঢেকে দিতে অস্তিত্ব তোমার?
নাকি ভুলে-যাওয়া সব পাখি, অস্পষ্ট ফুলের ঝাড়
মনের ভিতরে
পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দেখছো কর্কশ বালুচরে
পড়ে আছো, যেখানে রঙের খেলা নেই, ফুলঘ্রাণ
নেই একরত্তি, কতকাল কোনো গান
বাজেনি তোমার প্রাণে। কেবলি ক্ষয়ের টানে একা
উদাস চলেছো ভেসে, চতুর্দিকে কম্পমান বনরেখা।
যে-জন বাজায় বেলা দু’হাতে একেলা, তুমি তার
কাছ থেকে বহু দূরে চলে গ্যাছো, যার অন্ধকার
ফুলের স্তবক হয়, জ্যোৎস্নায় সাঁতার কেটে, ডুব
দিয়ে মল্লিকার বনে যে-জন আড়ালে দ্যাখে খুব
মগ্ন হয়ে একটি অস্পষ্ট পরী, দ্যাখে সেই পরী
মগের ভিতরে তার আঙুল ডুবিয়ে রত্ন, ঘড়ি,
এবং পিঙ্গল চোখ তুলে আনে, তার পরগণা
থেকে নির্বাসিত তুমি। তোমার মগজে ধূলিকণা
ওড়ে অবিরত ইদানীং। এ ভীষণ বনবাস
কখন কাটবে বলো? করে পাবে করোটি সুবাস?
স্বপ্নের জটিল লতা-গুল্মময় হৃদয়ের তন্তুগুলি দ্রুত খাচ্ছে উঁই
অগোচরে, বেলা যায়। পরিপার্শ্ব বিদেশ-বিভূঁই
মনে হয়; কোথায় কী আছে
বাসগৃহে, ফুটপাতে, দূরবর্তী গাছে,
যেওনা-পল্লীর কাছে, ভুলে থাকো? কী ভাবছো?
কী ভাবছো তুমি?
ভাবছো কি মানুষের আলুথালু সত্তা দুঃস্বপ্নের জন্মভূমি?
ভাবছো কি কৃষ্ণচূড়া প্রায় ডাকঘর
অতিশয় শূন্য, মুছে যায় স্বপ্নাক্ষর
কালো ফুঁয়ে বারংবার, ঝরণা তলে কেন কুড়োয় না ফুল সুধা,
বুলেটের ঝড়ে আর্তস্বরে ডেকে যান দীর্ণ পাবলো নেরুদা?
কে আসে এমন ধু ধু অবেলায়
কে আসে এমন ধু ধু অবেলায় আমার নিবাসে?
জীর্ণ শীর্ণ আমার নিবাসে
কে আসে তীক্ষ্ণ ক্ষুধার্ত চোখে? করে না তেমন পীড়াপীড়ি কিছু,
চায় না কিছুই, নগ্ন সিঁড়িতে বসে থাকে একা,
বসে থাকে একা,
বসে থাকে একা।
বসে থাকে একা।
উস্কো খুস্কো চুলের ভেতরে স্বপ্ন বুঝিবা হরিণের মতো
করে ছোটছুটি। সরু আঙুলের ডগায় জমেছে স্মৃতির অভ্র।
এখানে আসার কথাই ছিল না। এই লোকালয়,
ফুটপাত, গলি কমলালেবুর স্নেহপরায়ণ
রঙ, শহরের দুঃস্থ বুড়োটে বাজিকর আর খাঁচার ময়না।
ছেড়ে ছুড়ে কবে চলে গিয়েছিল; তবু সে এসেছে
ফিরে উদাসীন। চোখের কিনারে রঙ-বেরঙের
পাখি মরে যায়,
পাখি মরে যায়,
পাখি মরে যায়।
নিজেকে বন্দি রেখেছে বাক্যের জালে।
মুক্তির গান শুনে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইলে দ্যাখে সে
জালের সীমানা বাড়তেই থাকে মোহের বুননে
বাড়তেই থাকে,
বাড়তেই থাকে,
বাড়তেই থাকে।
একদা ছিলাম সতেজ যুবক, একদা আমার দিনের অশ্ব
ছুটেছিল কত খোলা প্রান্তরে বালিয়াড়ি আর
গিরি-সংকটে, ক্ষুরের ঝিলিকে মুগ্ধ সবাই।
এখন এইতো ছেঁড়া খোঁড়া আমি, অবসাদ-ছাওয়া।
মনে বসে আছি, দুঃখের সাথে ভাগাভাগি করে
নিজেকে; দু’বেলা করছি আহার, নিজেরই রক্তে ওজু সেরে ফেলি
তীব্র খরায়, বকুল এখন ফুটলো কোথায় ইত্যাদি কথা
বলে সে হঠাৎ নিশ্চুপ হয়। অলক্ষ্যে তার বুকের ভেতরে
বুক ভেঙে যায়,
বুক ভেঙে যায়,
বুক ভেঙে যায়।
কেউ কি এখন
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
আমার স্মৃতির ঝোপেঝাড়ে
হরিণ কাঁদে অন্ধকারে,
এখন আমার বুকের ভেতর
শুকনো পাতা, বিষের মতো রাত।
দ্বিধান্বিত দাঁড়িয়ে আছি
একটি সাঁকোর কাছাকাছি,
চোখ ফেরাতেই দেখি সাঁকো
এক নিমেষে ভাঙলো অকস্মাৎ।
গৃহে প্রবেশ করবো সুখে?
চৌকাঠে যায় কপাল ঠুকে।
বাইরে থাকি নত মুখে
নেকড়েগুলো দেখায় তীক্ষ দাঁত।
অপরাহ্নে ভালোবাসা
চক্ষে নিয়ে গহন ভাষা
গান শোনালো সর্বনাশা,
এই কি তবে মোহন অপঘাত?
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
কেন তুমি অভিমানে
কেন তুমি অভিমানে এমন বিষণ্ন আলা ছড়াও আমাকে
ম্লান করে যখন তখন?
কেন যে সরিয়ে নাও হাত নানা ছলে,
বুঝি না কিছুই।
এরকম দৃষ্টি দাও যদি, তাহলে আমার সত্তা জমে
নিথর পাথর হ’য়ে যাবে, মগজ বেবাক খড়ে
যাবে ভরে, আমি শুধু দম দেয়া পুতুলের মতো
একাকী ঘুরবো দিগ্ধিদিক।
তোমার চুম্বন থেকে, আলিঙ্গন থেকে বহুদূরে
পড়ে আছি একা শ্বাসকষ্ট হয় রাত্রিদিন, তুমি
অন্যত্র তোমার
সৌন্দর্যের শিখা জ্বেলে আছো
আমার কষ্টের প্রতি উদাসীন।
আমার বিরূদ্ধে আজ একে একে সকলেই গেছে-
আমার বিরূদ্ধে
পাখিরা নিয়েছে নিন্দা প্রস্তাব, নক্ষত্র
প্রতিবাদ মুখর এবং
শহর ব্যানারে তার লিখেছে বিশাল লাল সুস্পষ্ট অক্ষরে,
‘নির্বাসনে যাও’।
আমার নিজেরই ঘর হয়ে যায় জ্বলন্ত কবর,
এমন কি হাওয়া আজ প্রহরে প্রহরে
শক্রতা সাধছে শুধু জাগিয়ে তোমার স্মৃতিমালা,
নিভিয়ে স্বপ্নের দীপাবলী।
আমার নিকট থেকে তুমি সরে গেলে অভিমানে
একটি সভ্যতা অতি দ্রুত ভেঙে যাবে
আমার ভেতরে।
এই যে আমার যাত্রা, কখনো তা’ তোমাকে পেছনে
ফেলে নয়, তুমি চিরসঙ্গিনী আমার
পথে কি বিপথে, যেখানেই পড়ুক আমার পদচ্ছাপ।
তোমার সমুখে নতজানু হয়ে বলি-
আমাকে পেছনে ফেলে তুচ্ছতার ভিড়ে
আমার নিকট থেকে দূরে
যেও না কখনো।
আমিতো তোমার ভেতরেই সারাক্ষণ সুখে-দুঃখে
দাঁড়িয়ে থাকতে চাই, হতে চাই গান স্তব্ধতায়,-
এই ইচ্ছা প্রতিটি ঋতুতে
প্রবল সজীব থাকে। যখন খুলবো চক্ষুদ্বয়,
তখন তোমারই দিকে পড়ে যেন চোখ।
কোথাও সোনালি ঘণ্টা
মাঝে-মধ্যে দূরে যাওয়া ভালো ভেবে মনস্থির করি
একটি ব্রিজের কাছে সাবলীলভাবে চলে যাবো
তুমি আর আমি ধুলিময় পথ হেঁটে একদিন।
মেঘার্ত দুপুরে সেই ব্রিজটির কাছে গিয়ে দেখি-
সমুখেই তৃণভূমি, একটি স্বপ্নিল ঝিল বেঁকে
গেছে দূরে, বুঝি ছুঁতে চায় কোথাও কাউকে আর
তিনটি বাছুর মাঠে দৌড়ায়, লাফায় কখনো বা।
ট্র্যাক্টর মাঠের স্বপ্নে তুলে তীব্র ঢেউ নিদ্রা যায়।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
‘এই দ্যাখো আমাদের আপন দোচালা ঘর
এইতো দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালবিহীন’, বলে তুমি
সেদিকে এগিয়ে গেলে। যেন নিরিবিলি কাচময়
স্বপ্নের ডেরায় পেয়ে গেছি ঠাঁই আমরা দু’জন
শুকনো খড়ে বসে পড়ি। আমাদের আপ্যায়ন করে
গাছপালা, উড়ে-যাওয়া পাখি, দূরবর্তী শান্ত ঝিল।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
হাওয়ায় উড়ছে চুল মাঝে-মাঝে, একটি কি দু’টি
গুচ্ছ নেমে আসে গালে, তোমার দু’চোখ কালজয়ী
প্রাচীন সোন্দর্য যেন। তোমার হাতের সাথে হয়
আমার হাতের দৃষ্টি বিনিময় নিসর্গের ঘরে।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
একজন বুড়ো লাঠি দিয়ে নাড়ে খড় দূরে, যেন
আপন অতীতরাশি নিয়ে মেতেছে খেলায়। তুমি
হঠাৎ দুলিয়ে কালো ব্যাগ প্যাস্টোরাল অপরাহ্নে
বললে, ‘চলো, ফেরা যাক, গোধূলির ঘ্রাণ
আমার শরীরে মেশে, সমাজতো ধৃতরাষ্ট্র নয়।
আমি গোধূলির মতো গলে আবার সংহত হই।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
গভীর হৃদয়জলে হৃদয় চলেছে ভেসে আজ
নিরুদেশে, বিদায়ের বাক্য থাকে প্রতিটি যাত্রায়।
দু’জন দু’দিকে যাই, সামনে পথ, শুধু দীর্ঘ পথ
ফুলপাতা, গাছ করে উচ্চারণ বাল্মীকির শ্লোক।
…কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
কোথায় তুমি?
একটি বনে সন্ধ্যেবেলা ঢুকে পড়েই মুষড়ে পড়ি,
হঠাৎ ভীষণ ক্লান্ত লাগে।
বন্য ঘ্রাণে ধরলো নেশা তড়িঘড়ি।
আগুন-রঙা স্বপ্ন জ্বলে তরুণ বাঘের পায়ের দাগে,
বনের মধ্যে মিশমিশে এক রাত্রি এল ক্রমান্বয়ে।
রাস্তাগুলি কোথায় এখন? চতুর্দিকে বনভূমি।
তোমার খোঁজে বনবাদাড়ে মত্ত হয়ে
ঘুরবো আমি চিরদিনই?
আমার দুঃখ-আলোয় ধৌত কৌমুদিনী
কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? কোথায় তুমি?
বনের মধ্যে হাঁটছি একা, বড় একা, নগ্ন পায়ে
ফুটছে কাঁটা বারে বারে।
হঠাৎ যেন শুঁড়ের মতো কিসের ঘায়ে
ধরলো জ্বালা সত্তা জুড়ে বেবুন, বেবুন অন্ধকারে।
দীর্ঘ ঘাসে জখমি মৃগের রোঁয়া কাঁপে,
দিক-ঠিকানা লুপ্ত সবই; চতুদিকে বনভূমি।
তোমার জন্যে কোন্ পুরনো অভিশাপে
কাঁদবো আমি চিরদিনই?
আমার থেকে সরে যাওয়া কৌমুদিনী
কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? কোথায় তুমি?
কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই
রাগের কারণ থালেও আমি আর রাগান্বিত হইনা এখন।
কারণাবিহীন ক্রোধে ফেটে পড়ে, আকাশের দিকে ছোঁড়ে হাত,
লাথি মারে, হায় আল্লা, আলখাল্লা-মোড়া সমাজের বেবুনসদৃশ
ঘোর বয়স্ক পাছায়,
তেমন ভীষণ রাগী লোক নই আমি, উপরন্তু
এখন আমার কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই।
কেউ কোনো বাঁকা কথা, কটু কথা বললেও মেজাজ
আজকাল হিস হিস করে না কখনো, কারো উপেক্ষা আমাকে
করে না কাতর আর। সন্ধ্যেবেলা মরুভূমি আজ, উষর সন্ধ্যায়
বুকে কত
উটের কংকাল, ভাঙ্গা বেহালা ছড়ানো ইতস্তত,
বালিয়াড়ি রক্ত শুষে নেয়, রক্ত শুষে নেয়, ঠাণ্ডা
পানির বদলে সর্পবিষ ঝরে ডাইনীর মতো বৃক্ষচূড়া থেকে,
তবুও নিজের হাত কামড়ে ধরি না বারংবার। বসে থাকি
গৃহকোণে চুপচাপ, যেন বা উপোসী বৃদ্ধ, ক্ষয়ে সমর্পিত।
সূর্যমুখী হার-পরা গাধা অজস্র পদ্যের পাতা খাচ্ছে বলে
প্রতিদিন যততত্র নতুন সারস মৃত পড়ে থাকে বলে
রাগ নেই, কোনো খেদ নেই
স্বতই জীবনোজ্জ্বল রুবেন্স-রমণী প্রায় কমনীয় ত্বকময়ী দয়িতা
আমাকে
একদিন ত্যাগ করে যাবে ভেবে। বসে থাকি একা বেড়ালের
পশমে ডুবিয়ে হাত, পশম কোমল বলে লিরিকের স্বরে-
বেঁচে আছো তুমি, বেঁচে আছো অলৌকিক মহল্লায়,
দেয়ালের ড্যাম্প-নকশা, কাচের গেলাশ টেবিলের উপত্যকা,
ঘাসফুল গান গায় তোমার সত্তায়, তুমি ওদের প্রগাঢ় মাতৃভাষা জানো।
এখন আমার কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই,
শুধু কবিতার চোখ অনুরাগে আমার দু’চোখ
না ছুঁলে কেমন করে মন আর বুকের ভিতর মৃত কোনো
শহর নিশুত কেঁদে ওঠে।
চন্দ্রোচ্ছ্বাস
এখন আমার আশাবাদ
অন্ধের যষ্টির মতো এদিকে-ওদিকে ঠুকে ঠুকে
করছে পরখ পথঘাট, মাঝে মাঝে কী বিস্বাদ
লাগে সবকিছু, এ জীবন ধুঁকে ধুঁকে
পথ চলে, কখনো বা থমকে দাঁড়ায়
খেলনার জ্বলজ্বলে বাক্সের সমুখে, ফেলে ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস।
কখন যে বাক্সটির ভেতরে হারায়
নিজেকেই, অনন্তর ফিরে আসে। বেবাক বাতিল এলেবেলে
ছিট কাপড়ের টুকরো হ’য়ে স্বপ্নগুলি ওড়ে। আমার জীবনে তুমি এলে
অকস্মাৎ, যেন উপদ্রুত এলাকায় চন্দ্রোচ্ছ্বাস।
চায়ের দোকানে বসে
চায়ের দোকানে বসে মেঘলা সন্ধ্যায় অকস্মাৎ সাধ হয়
রবীন্দ্রনাথের মতো চুলদাড়ি রেখে প্রেমিক সন্ন্যাসী হয়ে
রূপোর মতোন কিছু ভস্ম আলতো বুলিয়ে দিই রুক্ষ জীবনের গালে।
আমারও মুখমণ্ডলে উপনিষদের আভা বেশ
মিশ্চিন্ত করুক খেলা সারাবেলা, সাধ হয়। কয়েকটি
টক বিস্কুটের গুঁড়ো পড়ে থাকে বিবর্ণ পিরিচে।
উড়ছে গেরুয়া আলখাল্লা কালপুরুষের তলোয়ারে গাঁথা,
ধর্মকর্ম কতকাল করি না হে, বাতাসের কিছু কি
প্রবল নড়বে ভাবো কোনোদিন? বলা কওয়া নেই,
যেতে হয়, সবাইকে যেতে হয় শৌচাগারে আর শবাগারে।
চায়ের দোকানে বসে চেনা অচেনা মুখের ভিড়ে
এ রকম ভাবনার পাড়া ঘুরে বেড়াতে লাগে না মন্দ কখনো সখনো।
চায়ের দোকানে বসে মেঘলা সন্ধ্যায় খিস্তি খেউড়ের মাঝে
রবীন্দ্রনাথকে কেন টেনে আনা মিছেমিছি? বিশেষত তার চুলদাড়ি
বিষয়ে নীরব থাকা ভালো। অন্য কিছু ভাবা যাক, আমাদের দীর্ঘশ্বাসে
যাক বয়ে কিছু সিক্ত যুথী গন্ধ, মগজের অন্তর্গত আকাশে উড়ুক
আমাদের পোড়খাওয়া জীবনের বেদনার সাথী। যে বিদায় অকস্মাৎ
এসেছিল নেমে ভরসন্ধ্যার মতোন, তার কথা ভেবে নিজেকে
পোড়াই পুনরায়।
কেন তার কথা মনে পড়ে সারাক্ষণ, কেন? খোলা আকাশের
নিচে তার ওষ্ঠে, মনে পড়ে, খেলা করছিল সোমত্থ বিকেল,
তৃষ্ণার্থ যাত্রীর মতো আমি সেই ওষ্ঠস্থিত অপরাহ্ন চুমুকে চুমুকে
পান করতে গিয়ে প্রতিহত, হঠাৎ সে সরে গিয়ে বলেছিল
‘চুম্বনে আশ্লেষে শোনো, আমাকে খুঁজো না তুমি খুঁজোনা কখনো,
আমার আপন মনোলোকে আছো তুমি, থাকবে সর্বদা’।
ভিজিয়ে চোখের জলে সত্তা সে আমার হাত নম্র ছুঁয়েছিল,
তখন আকাশে ছিল বিদায়কালীন রুমালের মতো পাখি থর থর।
আমি সে ভুবনে আজ, মানে তার মনোলোকে, পড়ে আছি একা
(হৃদয়কে চোখ ঠারি) ছিন্নবেশ রুক্ষকেশ সন্তের মতোন উপবাসে।
আমাকে করছে রান্না সর্বক্ষণ ভীষণ আনাড়ি পাচকের মতো কেউ।
কে সে? কে সে? বলে আমি বিচ্ছেদের বালি মুখে পুরি চায়ের
দোকানে বসে
রবীন্দ্রনাথের মতো চুলদাড়ি রেখে প্রেমিক সন্ন্যাসী হয়ে যেতে চাই
দেশ দেশান্তরে বাদ্য বাজাতে বাজাতে পথপ্রান্তে নদীতীরে, ফুটপাতে, টার্মিনালে
এবং ছড়াতে চাই ভস্ম জীবনের মুখের উপর, মরণের চোখে,
(মরণরে, হে মোর মরণ)
দুনিয়াদারির কোনো তোয়াক্কা না রেখে অলৌকিক জমিদারি
ঔদাস্যে বেড়াই খুঁজে, এক জোড়া রণপা কোত্থেকে এসে যায়।
স্বপ্নের মতোন ভেসে ওঠে পথরেখা, ছিন্ন স্মৃতির মতোন দৃশ্যাবলী,
আমি ফুটপাত, ত্র্যাভিনিউ, মজা খালবিল লঞ্চ টার্মিনাল,
বাস ডিপো আর বনবাদাড়, আঁধার জমিজমা, চকচকে
ফ্ল্যাটে আর কোঠাবাড়ি, গোচারণ ভূমি
পায়ের অনেক নিচে রেখে হেঁটে যাই, হেঁটে যাই, হেঁটে যাই
কেমন চিত্রিত মুখে, মাথার উষ্ণীষ মেঘলগ্ন;
কেবল জ্বলতে থাকে মাথার উপরে ধ্রুবতারার মতোন তার চোখ,
বিপরীত জীবনের লোভ। বেলাশেষে লঘু প্রজাপতিদের
মোহন বিক্ষোভ দেখে লাস্যময় সময়ের কথা ভাবি, ভাবি
কোন পথ কোন দিকে যায়, কতদূর যায়? বিপুল জ্যোৎস্নায়
কাক কেন মাথা কোটে বৃক্ষমূলে পত্রালি অস্থির কেন হয়?
আমার বিরুদ্ধে কেন কথা বলে বারংবার আমারই হৃদয়?
জুনের দুপুর
সেদিন জুনের দুপুর ছিল, একলা ছিলে তুমি।
ঘরের দুপুর বাড়ায় গ্রীবা,
হঠাৎ তোমার পায়ের, নিচে উঠলো কেঁপে ভূমি।
তখন আমি কিসের ঘোরে নিজের ভেতর একা বাঁচছি, মরছি, মরছি, বাঁচছি।
এমনি করেই দ্বন্দ্ব থেকে ফোটে দুঃখরেখা!
ক্লান্ত মনে পড়ছি ধুধু দেয়াল-জোড়া লেখা।
বুকের ভেতর মরুর জ্বালা,
তোমার সঙ্গে ক’যুগ যেন হয়নি আমার দেখা।
ঘরে-বাইরে সঙ্গে আমার নোংরা নরক ঘোরে।
কোথাও কিছু নেইকো পাওয়ার,
বাগান-ফাগান, কোঠাবাড়ি ধুলোর মতো ওড়ে।
তোমার বুকে ওষ্ঠ চেপে ভুলি গেরস্থালি-
শহর কালো বিন্দু হয়ে
শূন্যে মিলায়, সত্তা জুড়ে ঝরে সময়-বালি।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, অবসন্ন হাটুরের মতো বসে আছি
হাঁটু মুড়ে নগর ভেলায়।
এ এক প্রকৃত খেলা, এই ভেসে-যাওয়া তীরবর্তী শোভা দেখে,
জ্যোৎস্নার মাধ্যমে গড়ে তোলা মধুর সম্পর্ক কোনো
মহিলার সাথে।
বাতিল প্রেমিক যদি ফের খুঁজে পায় বেলাবেলি সম্প্রীতির ডেরা,
তাহ’লে সে নীলিমাকে জানিয়ে অভিবাদন, প্রায়
ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে অপরাহ্নে
ঘাসের অম্লান সবুজকে চুমু খেয়ে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, দেয়ালের শ্যাওলায়
মগ্ন হবে গৃহপ্রবেশের সূরে এক লহমায়। কয়েক শতাব্দী তার
আঙুলে উঠবে নেচে, দেশলাই জ্বালালে আঁধারে
প্রাচীন দেয়ালচিত্র অকস্মাৎ হবে উন্মোচিত, বুঝিবা আহত হবে
কাতর হৃদয় তার অতীতের অসামাজিকতা হেতু আর
রাখবে সে চোখ টিকটিকি কিংবা বাতির ওপর।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, ঢাকাও মরাল হতে জানে
পূর্ণিমায়, দেখে নিই। যেন দরদালান সমেত যাচ্ছে উড়ে
দুলিয়ে বিপুল ডানা মগজের জ্যোৎস্নায় আমার।
ওলোট-পালোট কত স্মৃতি গোলাপের মতো ঝরে
এখন আমাকে ঘিরে, ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে পড়ি।
শৈশব কাঠের ঘোড়া চেপে আসে, যৌবনের খর দিনগুলি,
রাত্রিগুলি খুব মেশামেশি করে রক্ত কণিকায়,
চামর দোলায় কোন, অব্যক্ত তরুণী, তবু কিছু স্বেদচিহ্ন
থেকে যায় আমার এ শরীর-পেরুনো অন্য এক অবয়বে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, আমিও ভাসছি ক্রমাগত।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে, ঢাকা ওরা মৃত, ওরা পূর্বগামী পরিজন,
বুঝি ওরা বারংবার মরীচিকার চিৎকার শুনে
ছুটে গেছে, কোথায় যে মরুদ্যান প্রস্রবণ নিয়ে
আমন্ত্রণে উন্মুখর বেলা শেষে, করেনি খেয়াল। ওরা মৃত,
ভ্রান্তির গহ্বরে ওরা হারিয়ে ফেলেছে কণ্ঠস্বর।
দেখি প্লেগ-কবলিত শহরের মতো
ক্রুর অমাবস্যার এলাকা-
ছিন্নভিন্ন জামা, জীর্ণ জুতো পড়ে আছে ইতস্ততঃ
কাঁটাগুল্ম, পাথরের মধ্যে, ফুলের কেয়ারিগুলি ভরে ওঠে
পচা নাড়িভুড়ি আর হাড়গোড়ে। দেখি কতিপয়
ন্যাংটো লোক পথে
করছে বপন মৃত্যু,-আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি তাহ’লে?
আমার অসুখ বলে ঢাকা মন খারাপ করেছে।
ওর চোখে-মুখে বিষণ্নতা জেগে থাকে সারাক্ষণ,
যত বলি ফুল্ল স্বরে, ভেবোনা লক্ষ্মীটি, আমি খুব
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবো, দেখে নিও,
তত সে খারাপ করে মন, চোখে জমে অশ্রুকণা,
আমার শিয়রে বসে থাকে ঠিক নার্সের ধরনে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছো তুমি ঢাকা বেসামাল পূর্ণিমায়।
যাবো না স্বাস্থ্যের লোভে কোনো শৈলাবাসে,
তুমি আছি থেকো তুমি আমার অসুখ সেরে যাবে।
জ্বরদগ্ধ চোখে দেখি জ্যোৎস্না-ধোয়া স্নেহজাত পথ্য
তার হাতে নাচ আর রোজ নিয়ে আসে কিছু ফুল
রোগীর টেবিলে সুখ ফোটানোর অমল উদ্দেশ্যে।
আমার অস্তিত্ব থেকে অসুখের ছায়া সরে যাচ্ছে, দেখে যাও।
টেবিলে জমাট মেঘ
টেবিলে জমাট মেঘ এক খণ্ড যেন স্বপ্নে বুঁদ,
কিংবা অভিশপ্ত গ্রীক দেবীদের কেউ সারাক্ষণ
মুক্তির প্রহর গুণে গুণে ক্লান্ত, ঘুমে অচেতন,
এক্ষুণি উঠবে জেগে এবং সত্তায় তার হবে
মুঞ্জরিত ক্ষণে ক্ষণে বহুবর্ণ গভীর সংগীত।
টেবিল তরঙ্গ হয় বারে বারে মেঘের প্রভাবে।
যখন বুলাই হাত মেঘখণ্ডে, তোমাকে প্রবল
মনে পড়ে। টেবিলের স্বপ্নিল মেঘের অন্তরালে
আলোড়নকারী কোনো কণ্ঠস্বর আছে জেনে প্রতি
মুহূর্ত অপেক্ষা করি, কখন তোমার অস্তিত্বের
সুর হবে গুঞ্জরিত, কখন এ ঘর পুনরায়
ইডেনের লতাগুল্মে যাবে ছেয়ে, দূর সমুদ্রের
সফেন উল্লাসে হবে উচ্ছ্বসিত আর ভেনাসের
পদচ্ছাপ উঠবে জেগে রেণুময় নিঝুম মেঝেতে।
টেবিলে জমাট মেঘ বেজে ওঠে স্বপ্নে, জাগরণে।
সর্বদা কম্পিত হাতে তুলে নিই মেঘ, প্রতিবার
প্রতিহত আমি শব্দহীনতায়, জব্দ হই খুব।
তবে কি ওঠেনি বেজে মেঘপুঞ্জ? তবে কি মিথ্যেই
গভীর নিদ্রার হৃদে পড়ে টোল? শিরায় শিরায়
কেন তবে সূর্যোদয় আগণন, কেন ঝাঁক ঝাঁক
গাংচিল সহসা ওড়ে বুকের ভেতরে বারংবার?
আমার নিজস্ব হাড় কেন বেহালার মতো বাজে?
টেবিলের এক খণ্ড মেঘে আছে তন্দ্রিল সিম্ফনি
অলৌকিক, বুঝি তাই সুরস্নাত এ ঘর আমার।
দেখেছি কখনো টেবিলের মেঘপুঞ্জে দ্রাক্ষালতা
ক্রমবর্ধমান আর রূপোলি ঝালর চমকায়
ঘন ঘন, কখনো বা মেঘখণ্ডে মৃতকে আরেক
মৃতজন ভীষণ জড়িয়ে পড়ে থাকে স্তব্ধতায়
যমজ ভায়ের মতো। কখনো আবার সামুদ্রিক
মাছের কংকালে গড়া উদ্যান সেখানে জেগে ওঠে।
ইদানীং ভয়ে ভয়ে থাকি-যদি এই মেঘখণ্ড
মরাল সংগীত গেয়ে শেষে ডুবে যায় স্তব্ধতায়,
যদি অস্তরাগময় হয়, যদি মৃত শশকের
মতো একা পড়ে থাকে এক কোণে, তাহলে কী হবে?
তবু হয়, এরকমই হয়
তবু হয়, এ রকমই হয়
কখনো চাওনি তুমি এ রকম হোক, তবু সব লতাগুল্ম,
জলজ্যান্ত গাছ
শুকিয়ে বিবর্ণ হলো, বড় শীর্ণ। ফুলদানি শূন্য বহুকাল,
নানারাঙা পাখিরা উধাও-
ওরা কি মেতেছে আত্মহননে কোথাও? ঝাড়লণ্ঠনের শোভা
সহসা গিয়েছে মুছে, ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় কেবলি ঝুলে থাকে
ছাদে, ঘরময়
পশুবিষ্ঠা, বারংবার হাত খুঁজে পাই না কোথাও আজ হাত।
কখনো চাওনি তুমি এ রকম হোক, তবু হয়,
এ রকমই হয়।
এ শহরে আছে এক পথ, কখনো সে স্নিগ্ধ কখনো বা
গরিমায় ঝলমলে, মাঝে-মধ্যে যেন আর্টেমিস-
ছায়ার মতোন তার গায়ের বাকল ছেড়ে ছুড়ে করে স্নান
জোরালো জ্যোৎস্নায়।
তুমি জানবে না কোনোদিন সে পথের জন্যে একজন কবির হৃদয়
কী রকম আর্তনাদ করে রাত্রিদিন। সর্বক্ষণ আমি তার করি ধ্যান
যেমন উদ্ভ্রান্ত পাখি অলভ্য স্বর্গের। এ দারুণ শুশুনিয়া
বুভুক্ষ, তামাটে
জমিনে কর্কশ মুখ রেখে ব্যাধের উদ্যম থেকে পলাতক
প্রাণীর মতোন আজো তোমার জন্যেই বেঁচে আছি
বললে কি তুমি আজ করবে বিশ্বাস? জানবে না কোনোদিন
আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তোমারই নাম গুঞ্জরিত, আমি
শুধু দূর থেকে দেখি পথরেখা, তৃষ্ণা বাড়ে সত্তাময়। যাবো
কি সেখানে?
হাত পেতে নেবো জল রুক্ষ সন্নাসীর মতো? এ রকম হোক,
কখনো চাইনি আমি; তবু হয়, এ রকমই হয়।
একটি আশ্রয় আমি যুগ যুগ পরে পেয়ে গেছি ভেবে খুব
সম্মোহিত হয়ে
ছিলাম অনেকদিন, অলৌকিক খড়কুটো দিয়ে সাজিয়েছি
তাকে, হৃদয়ের ফুল্ল তাপে
রেখেছি সর্বদা উষ্ণ, কখনো চোখের জলে ধুলাবালি
ধুয়ে মুছে নক্ষত্রের মতো।
অকস্মাৎ বজ্রপাত, আমি দগ্ধ আশ্রয়ের কাহিনী শোনাই ঘুরে ফিরে
গাছপালা, নদীনালা, সূর্যাস্তকে নিশীথের প্রেতের মতোন কণ্ঠস্বরে।
তিন যুগ পর
অকস্মাৎ অন্ধকারে একটি পুরনো কোঠাবাড়ি
তাকালো আমার প্রতি চোখ মেলে। বাড়িটার ঘ্রাণ
বাড়ে ক্রমাগত, দেখি বর্ষিয়সী নারী,
পরনে নিঝুম শাড়ি, অত্যন্ত সফেদ, যেন অই আসমান
দিয়েছে মহিমা তার সমগ্র সত্তায়। তাকে চিনি
মনে হয়, তিনি মাতামহী আমার এবং যাকে
আপা বলে ডাকতাম শৈশবে, কৈশোরে। মনে হতো চিরদিনই
থাকবেন তিনি তার কোঠাবাড়ি ভালোবেসে আর আমার ব্যাকুল ডাকে
দেবেন সানন্দ সাড়া যখন তখন। অন্ধকারে
এই তো দেখছি তিনি জ্বেলেছেন হ্যারিকেন ঘরে, আলো যার
কল্যাণের প্রতিবাদ অশুভের বিরুদ্ধে সর্বদা। বারে বারে
আমার মাতুল সেই কবে মদে চুর হয়ে ফিরে এলে হ্যারিকেন তাঁর
নিশ্চুপ বেরিয়ে আসতো আঙিনায় সন্তানের হাত ধরে তিনি
উঠোন পেরিয়ে ঘরে রাত্রিময় যেতেন ঔদাস্যে ভরপুর।
দিতেন শুইয়ে তাকে, নিতেন জুতোর পাটি খুলে, আমি ঋণী
চিরকাল এ দৃশ্যের কাছে। সুন্দরের স্পর্শে বাজে অস্তিত্বের সুর।
রাত্রি বড় ভয়ংকর মনে হয় আজকাল, ভীষণ টলছে মাথা, সারা
গায়ে ভুর ভুর করে গন্ধ প্রায় প্রতিরাত, মধ্যরাতে বুঝি
মেঘে মেঘে হেঁটে যাই, খিস্তি করি নক্ষত্রের সাথে। দিশেহারা,
বেজায় বিহ্বল আমি আর্ত অন্ধকারে। কী-যে খুঁজি
এ বিজনে এলোমেলো ভীষণ একলা আর কেমন অচেনা
লাগে প্রতিবেশ; আপা, তুমি হ্যারিকেন দোলাবে না?
তোমার ঔদাস্য
ইদানীং তুমি বড় বেশি ঔদাস্যের কথা বলো,
বড় বেশি তুমি খেলে যাচ্ছো ধুধু নির্লিপ্তির হাতে-
যেন সূর্যরাজা তার অন্ধকার রাণীকে সপ্রাণ
করে না চুম্বন আর, যেন দূর স্বপ্নের গাংচিল
এখন তোমার চারপাশে ওড়াউড়ি ভুলে গেছে,
কোনো ফুলে ঘ্রাণ নেই, সবচে সুস্বাদু ফলও খুব
স্বাদহীন, এ রকম তোমার ধরন ইদানীং।
যখন তোমার কণ্ঠস্বরে ঔদাস্যের ছায়া পড়ে,
হু হু রুক্ষ প্রান্তরের দৃশ্যহীন দৃশ্যাবলী জাগে,
অকস্মাৎ করোটির ভেতরে আমার চকচকে
রেজরের মতো কিছু ভীষণ ঝিকিয়ে ওঠে আর
স্বপ্নময় তারপুঞ্জ ছিন্নভিন্ন হয়। করোটিতে
শত শত নামহীন কবরের ফলক এবং
রাশি রাশি উন্মুখর ফুল, প্যাগোডার স্বর্ণচূড়ো,
তিনটি বিবর্ণ তাস, পলায়নপর অশ্বপাল,
ব্রোঞ্জস্থিত পরস্পর নানা স্বপ্ন বিনিময়কারী
যমজ বিযার ক্যান প্রতিবেশী। ঔদাস্য তোমার
তোমাকে বসিয়ে রাখে ভুল প্রত্যাশার পথপ্রান্তে,
স্বপ্ন-বিবর্জিত হাহাকারময় বিজন সৈকতে।
তোমার ঔদাস্য-মরু উজিয়ে সকাল দশটায়
অথবা বিকেল পাঁচটায় কিংবা কোনো সন্ধ্যেবেলা
যখনই তোমার কাছে যাবো বলে দর্পণে তাকাই
শার্টের কলার ঠিক করে নিই, আড়চোখে দেখি
শাদাকালো চুল, শিরাপুঞ্জে বেজে ওঠে কনসার্ট,
কোন্ ইন্দ্রজালে এ আমার আটচল্লিশের মুখ
আটাশের মুখ হয়ে যায়? সুদূর সুন্দরবন,
চাটগাঁর কুঁজোপিঠ কাজল পাহাড়, সমুদ্রের
ঢেউমালা সিলেটের টিলাস্থিত কোনো স্মৃতিময়
প্রাচীন দুর্গের মতো বাড়ি, মন্টি-মন্টি প্রতিধ্বনি
পরিপূর্ণ ঝিল, গাছপালা আর ঢাকার আকাশ
ছাপিয়ে তোমারই মুখ উদ্ভাসিত আমার দৃষ্টিতে।
যখন পাইনা দেখা, আমার নিকট থেকে তুমি
যখন অনেক দূরে, তোমাকেই দেখি তন্বী গাছে,
ফুলের আভায়, শস্যক্ষেতে, হরিণের মতো এই
থমকে দাঁড়ানো গলিপথে আর আমার আপন
করতলে, পাঁজরের মরুভূমি, চোখের সৈকতে।
আমার এখনকার প্রতিটি কবিতা তার বুক
উন্মোচন করে বলে,-এই তো এখানে তুমি আছো।
তুমিহীনতায় প্রতিদিন আমার কবিতাবলী
তুমিময় হয়, সেখানেই রোজ খুঁজবো তোমাকে,
দেখবো দু’চোখ ভরে বহুবর্ণ বাক্যের ওপারে।
কি উপমা কি উৎপ্রেক্ষা অথবা প্রতীক ইত্যাদির
পরপারে তুমি আছো হৃদয়ের পরগণা জুড়ে।
যতদিন বেঁচে আছি, থাকবে আমার কাছে তুমি
চিরকাল হৃৎস্পন্দনের মতো, অবিচ্ছিন্ন কোনো
যন্ত্রণার মতো সর্বক্ষণ। আপাতত ঔদাস্যের
বিজন গেরুয়া প্রান্তে দাঁড়িয়ে একাকী ছায়াময়
তোমার ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে এ হৃদয়
কেবলি ডাকতে থাকে আর্ত এক পাখির মতোন।
তোমার চোখ
যখন তোমার চোখ আমার দু’চোখে রাখো তুমি,
মনোলীন অন্ধকারে জ্বলে ঝাড়লণ্ঠনের শোভা,
কখনো জাহাজ আসে উড়িয়ে নিশান, কখনো বা
হরিণের ক্ষুর ডোবে ঝিলে, স্বপ্ন হয় বনভূমি।
তোমার অতল দু’টি চোখ তুলে তাকাও যখন,
মৃত কোনো সভ্যতার প্রাসাদের দীপাধারে রূপ
জেগে ওঠে, মগজের কোষে পোড়ে কী মোহন ধূপ,
রূক্ষ পথ হয় গীতবিতানের পাতার মতোন।
তোমার চোখের নিরালায় স্বর্গপথ ওঠে দুলে,
কাঁপে হ্রদ, বনস্থলী, একজন কবির হৃদয়
প্রায়শ বিছিয়ে দেয় কাতরতা, মৃত্যু গান গায়
রাজপুরুষের বেশে হননের তীব্র স্পৃহা ভুলে।
অমন চোখের জন্যে অপলক চোখে সুনিশ্চয়
শতাব্দী শতাব্দী ধরে ব্যাকুল প্রতীক্ষা করা যায়।
তোমার নিদ্রার দিকে
আমার ভেতর থেকে একজন একাকী মানুষ হেঁটে যায়
তোমার নিদ্রার দিকে, তুমি তার যাত্রা, ব্যাকুলতা,
কাতর দৃষ্টির প্রতি উদাসীন, ঘুমের ভেতরে
মজ্জমান, লতাপাতা জড়ায় তোমাকে,
খরগোশ বুকের নগ্ন মদির উষ্ণতা
শোঁকে কিছুক্ষণ। তার যাত্রায় রোদ্দুর নাচে, বৃষ্টি পড়ে,
কখনো জ্যোৎস্নাও ঝরে। কেমন অচেনা পাখি ডাকে
তার দু’চোখের নিরালায়।
আমার ভেতর থেকে একজন একাকী মানুষ হেঁটে যায়
তোমার জাগরণের প্রতি, তার চুমু ঝরে অবিরল
যে পুষ্পিত জাগরণে। এখন সে তোমার নিদ্রার দিকে হাত
দিয়েছে বাড়িয়ে, নিশীথের ঘ্রাণময় বিছানায়
নিটোল ঘুমাও তুমি, তোমার নিদ্রার রাঙা জল
অত্যন্ত নিথর থেকে যাবে।
ভয় নেই, তোমাকে সে জাগাবে না; বুকে নিয়ে শীতরাত
তোমার রূপের হ্রদে ওজু করে চলে যাবে উড়িয়ে ফানুস
আকাঙ্ক্ষার। চিরকাল হৃদয়ের অভ্যন্তরে তার গভীর বনানী
আবৃত্তি করবে কিছু স্মৃতিময় বাণী।
যখন সবুজ লনে শিশুর মতোন সুখে গড়াবে সকাল,
কার্ডিগান গায়ে তুমি বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়াবে,
তখন তোমার মনে হতে পারে একজন একাকী মানুষ
শীতল সিঁড়ির ধাপে নত মুখে নিঃস্ব বসে আছে কতকাল।
তোর কাছ থেকে দূরে
তোর কাছ থেকে দূরে, সে কোন নিশ্চিন্তিপুরে পালাতে চেয়েছি
প্রতিদিন, বুঝলি মতিন!
হয়তো বা টের পেয়ে অবশেষে নিজেই উধাও হয়ে গেলি
একটি নদীর তীরে, মাঠ-ঘেঁষা, গাছ ঘেরা, জুঁইকি চামেলি
ইত্যাদির ঘ্রাণময় বিজন নিবাসে। আমি তোকে
দীর্ঘ চোদ্দ বছরের সাইকেডেলিক স্মরণের তীব্র ঝোঁকে
ডাকি মধ্যরাত্রির মতো বুক ছিঁড়ে বারংবার,
প্রতিধ্বনি শুধু গূঢ় প্রতিধ্বনি ফিরে আসে মগজে আমার।
কেমন আছিস তুই? এখনো কি ভীষণ অস্থির তুই, ওরে?
এখনো কি অতি দ্রুত হেঁটে যাস দুঃস্বপ্নের ঘোরে
অলীক অলিন্দে কোনো? অবাস্তব বনবাদাড়ে ঘুরিস একা
ছিন্ন বেশ, নগ্নপদ সন্তের মতোন? তোর দেখা,
মানে তোর ঝলমলে প্রকৃত সত্তার দেখা পাবো কি আবার
কোনোদিন? তোকে হারাবার
পর তুই অতিশয় বেগানা আমার বড় বেশি উদাসীন
হয়ে গেলি, রূপান্তরে আমার দুঃখের মতো, বুঝলি মতিন।
যখন এখানে ছিলি, বুকের নিকটে ছিলি, তোর হস্তদ্বয়
আমার স্বপ্নের ঝাড়লণ্ঠন বেবাক অতিশয়
হিংস্রতায় বারংবার দিয়েছে দুলিয়ে। চুরমার
হয়েছে এ-ঘরে নিত্য যা কিছু ভঙ্গুর আর প্রগাঢ় সুমরি
মতো অন্ধকার চোখে নেমে এসেছে আমার ভর দুপুরেই।
এখন এখানে নেই, তুই নেই; আমার বুকের মধ্যে
সবুজ পুকুর!
এই তো সেদিন আমি খাতার পাতায় মগ্ন ছিলাম একাকী
অপরাহ্নে অক্ষরের গানে তরঙ্গিত। ‘সবই ফাঁকি’,
কে যেন চেঁচিয়ে বলে। দেখি খুব থমথমে সমুখে দাঁড়িয়ে
কাল-কিশোরের মতো তুই, যেন দীর্ঘ পথ নিমেষে মাড়িয়ে
এসেছিস বলে দিতে আমার উদ্যাম সব এলোমেলো,
দারুণ বেঠিক।
দিচ্ছিস চক্কর তুই ঘরময়, আমিও ঘুরছি দিগ্ধিদিক
জনাকীর্ণ এ শহরে কে জানে কিসের টানে পরিণামহীন,
বুঝলি মতিন।
যখন এখানে ছিলি, ছিল এক ঝাঁক চিলের ক্রন্দন ঘরে,
ছিল তীক্ষ্ম কলরব সকল সময়, মনে পড়ে।
এখন আমার ঘর অত্যন্ত নীরব, যেন শ্লেট, মূক, ভারী।
কখনো চাইনি আমি এমন নিশ্চুপ ঘরবাড়ি।
দুপুর প্রবেশ করে
দুপুর প্রবেশ করে আমার ভেতরে, কী উদ্দাম
হাওয়া একরাশ বুকে পায় ঠাঁই। সে আছে এখানে
আমার নিকটে বসে, যার কণ্ঠ মৃদু কথা-গানে
পল্লবিত মাঝে মধ্যে এই স্তব্ধতায় ছিমছাম
পরিবেশে, শুধু চেয়ে থাকা কখনো বা, তার নাম
ধূপের মতোন জ্বলে আমার শিরায়। কী যে মানে
অমন দৃষ্টির আজো বুঝতে পারিনি, কিন্তু দানে
দানে ভরিয়েছে সে আমাকে। আগে কী শূন্য ছিলাম।
তবু কি শূন্যতা মুছে যায়? তবে কেন রিক্ত সুর
বেজে ওঠে বারংবার? কেন মনে হয়,আমি শুধু
তার রাজধানী থেকে দূরে চলে যাচ্ছি নির্বাসনে
মুকুট বিহীন একা? দেখি পড়ে আছি খুব ধূ ধূ
পাথুরে জমিনে, কণ্টকিত গুল্মে দীর্ণ চোখ, মনে
প্রেত-নৃত্য। সে-ও যেন বিবাগিনী উদাস দুপুর।
দূরের একটা বাড়ি আমাকে
দূরের একটা বাড়ি আমাকে ভূতগ্রস্ত করে ফেলেছে ইদানীং।
বাড়িটার দেয়াল দরজা জানালা অলিন্দ,
বল্লমের মতো ছাদের চূড়ো-সবকিছু
লগ্ন আমার ভাবনায় সকল সময়। বাড়ি আমাকে দীর্ণ করে
উল্টা-পাল্টা করে ফেলে আমার মগজের কোষ।
বাড়িটাকে আমি অনেক দূরে থেকে দেখি প্রতিদিন,
কখনো তাকে প্রাচীন কোনো দুর্গ বলে ভ্রম হয়,
কখনো গ্রিক পুরাণের একচক্ষূ দানবের মতো লাগে ওকে,
দূর্গ হলেই যেন মানাতো বেশি, এমনি গোমড়ামুখো সে বাড়ি।
সেই দুর্গ, থুড়ি, সেই বাড়ির ভেতরে যাওয়ার ছাড়পত্র
আমার নেই, যদিও এক ধরনের নিরাসক্ত আমন্ত্রণ
থাকে সর্বদাই।
ছাড়পত্র ছাড়াই আমি যাত্রা করি বাড়িটার দিকে;
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হই,
তবু পৌঁছুতে পারি না তার ত্রিসীমানায়।
কখনো পথ আমাকে ঘন অরণ্যের দিকে নিয়ে যায়,
ভয়ংকর কর্দমাক্ত খাদের কিনারে কখনো বা
তখন একদল কংকাল ভারী কাঠের শব্দের মতো
হাসতে থাকে, হাসতে থাকে বিরতিহীন।
বাড়ি, তুমি কেন আমাকে বাইরে রাখো সর্বক্ষণ?
প্রবেশাধিকার চেয়ে আমি বারংবার
টেলিফোন করি হন্তদন্ত হয়ে, ওপার থেকে
পাই না কোনো সাড়াশব্দ;
শুধু এক দঙ্গল বানরের কিচির মিচির ভেসে আসে,
আমি দিনরাত্রি ডায়াল করতেই থাকি ক্রমাগত।
কখনো অবসন্ন চেতনায় নক্ষত্রের আলো
বিকিয়ে উঠবে ভেবে প্রতীক্ষা করি, প্রতীক্ষা করি,
প্রতীক্ষা করি।
বাড়ি, আমার প্রতিটি মুহূর্তকে গোলাপকুঁড়ি বানাই
তোমার জন্যে,
বাড়ি, তোমার কথা ভবে আমার একেকটি দিন
কী দীর্ঘ রক্তাক্ত কাটে।
বাড়ি, আমি তোমার প্রতি আমার সকল স্বপ্নের মাধুর্য
অর্পণ করেছি, তুমি কেন বারংবার দুঃস্বপ্ন দাও?
বাড়ি, তুমি আমার পরমায়ু নিয়ে খেলছো সর্বক্ষণ,
আমার আয়ু ডালকুত্তার মতো খেয়ো না তুমি,
বাড়ি, হে বাড়ি?
বাড়ি, তুমি হাজার হাজার নেকড়ের নখর দিয়ে তৈরী,
তোমার গা-ভরা ড্রাগনের দাঁত দেখিয়ে
আমাকে প্রতিহত করতে চাও,
আমার দরবেশ পদ্য
তোমার তল্লাট থেকে শূন্য-হাতে ফিরে আসবে বারংবার?
প্রাচীন দূর্গের মতো যে বাড়ি তার উদ্দেশ্যে পত্র লিখি প্রত্যহ,
হা নসিব, লেখা হওয়া মাত্রই
প্রত্যেকটি পত্রের সকল ব্যাকুল অক্ষর উবে যায়, রঙিন
ডাকটিকিটগুলি শীতের পাতা হয়ে ঝরে যায়
ধূলায় পাথুরে রাস্তায়।
প্রাচীন দূর্গের মতো একটা বাড়ি অনেক দূর থেকে
দেখে দেখে এখন আমি ভূতগ্রস্ত, ভয়ানক ভুতগ্রস্ত।
দেবার মতোন কিছু নেই
রাজরাজড়াকে হাসানোর ক্ষমতা আমার নেই,
হীরে-জহরত ঝলসিত মহিলার কোলজোড়া জুলজুলে
দৃষ্টি নিয়ে মোলায়েম থাবা নাচানোর, বারংবার
গলার রঙিন ঘুন্টি দোলানোর শিল্প আমি আয়ত্তে আনিনি।
বিশাল প্রাসাদে একা দিনরাত্রি অনেক বছর
কাটায় যে লোক তার মতো হয়ে গেছি, বলা যায়-
খাপছাড়া, অবসাদপ্রস্ত, ছায়াবিলাসে আশিরপদনখ
নিমজ্জিত, বড় বেশি প্রতিধ্বনিময় এ আমার
সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের চুমু-খাওয়া মাথায় কুঠুরি।
অতীতের সাথে খুনসুটি করে কাটে বেলা আর
কেবলি নিজেকে দুঃখ দিতে পারি, নিতে পারি প্রতিশোধ নিজের ওপর।
অপ্রেমের মরুভূমি থেকে হেঁটে আমি তোমার নিকটে
পৌঁছেছি সন্ধ্যায়-
যে সন্ধ্যায়, মনে পড়ে, আমার একান্ত ব্যক্তিগত নিস্তব্ধতা
উঠেছিল বেজে গূঢ় সরোদের মতো, কে অচেতনা পাখি তার
তীক্ষ্ম ঠোঁটে করেছিল পান সুখে হৃদয়ের শোনিত আমার!
কমলালেবুর খোসাভরা ঘরে তুমি
নিউজপ্রিন্টের গন্ধময় ঘরে তুমি
কী স্বপ্নের বীজ দূর থেকে দিয়েছিলে দীপ্র ছড়িয়ে সায়াহ্নে।
অনেক সন্ধ্যার ধ্যানে যুগ যুগ পরে
অমন নিবিড় সন্ধ্যা উঠেছিল ফুটে,
যেন পারিজাত।
পারিজাত সন্ধ্যা আমি পেয়েছি বলেই
শহর শক্রতা সাধে, মধ্যরাত এমন কাঁদায়?
বলেছি অজস্র কথা আমরা দু’জন ভোরবেলা, সন্ধ্যেবেলা,
মধ্যাহ্নে রাত্তিরে,
প্রহরে উপচে রোজ পড়েছে অনেক কথা আর
রঙিন ঘুড়ির মতো উড়েছে সে সব কথা আকাশে আকাশে,
কখনো জ্বলেছে ওরা উৎসবের বাল্বের মতোন ঝোপে-ঝাড়ে।
যখন একলা থাকি, সময় পোহাই শূন্য ঘরে, মনে হয়-
এই কি বলতে চেয়েছিলে তুমি? আমিও কি এই
আবোল তাবোল
আউড়ে তোমাকে হৃদয়ের স্বর শোনাতে চেয়েছি বারংবার?
এখন আমরা মুখোমুখি বসে নেই,
আমার নিকট তুমি নেই,
তবুও প্রখর আমি তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছি সকল সময়।
আমার মুঠোয়
তোমার স্বপ্নিল হাত কোমল প্রাণীর মতো চুমুকে চুমুকে
করছে সময় পান আমার দু’চোখে
তোমার চোখের পূর্ণ দখল এখন।
আঁধারে দুলিয়ে গ্রীবা বলেছিলে, এইতো এসেছি,-
দ্যাখো চেয়ে কী সহজে এসে গেছি তোমার কাছেই।
আমিও বলেছি, মনে পড়ে, স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে,
গভীর প্রত্যয়,
অনেক শতাব্দী ধরে আমি আছি একাকী তোমারই প্রতীক্ষায়।
তোমার দু’চোখে ছিল বিপর্যস্ত সভ্যতার শোক,
তোমার শরীরে ছিল বেদনার প্রগাঢ় চুম্বন,
তোমার যৌবনে ছিল বসন্তের পুষ্পিত বিলাপ,
দুঃখের কবল থেকে ছুটে এসে তুমি
দেখলে আমারও দুঃখ ছাড়া আর দেবার মতোন কিছু নেই
কিছু নেই।
নিজের নিকট থেকে
নিজের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যেতে চাই-
দিনের আড়ালে,
রাত্রির ওপরে ভেসে ভেসে যতদূর যাওয়া যায়
ততদূর চলে যেতে চাই। এ শহরে ঘরে কিংবা
বাইরে কোথাও
বলো না থাকতে কেউ আমাকে, এক্ষুণি
আসবাব, বইপত্র, লেখার টেবিল আর কবিতার খাতা
তছনছ করে চলে যেতে চাই অতিদূরে পথরেখা
ধরে একা একা!
আমি কি অজ্ঞাতবাসে যাবো সবকিছু ফেলে টেলে?
বন্ধুবান্ধবের মুখ, চিরচেনা আপন গলির মোড়, ভাঙ্গা
বাড়ি, স্বরণের অভ্যন্তরে সারি সারি গাছ,
কিছুই আমাকে ধরে রাখতে পারে না,
পারলেও আমি
নিজের নিকট থেকে দূরে চলে যাবো, তাকাবো না
ফিরে, আমি, বলে দিচ্ছি, চলে যাবোই এখন।
বিভ্রম আমাকে কিছুকাল ঘুরিয়েছে পথে পথে,
বুঝতে পারিনি কবে স্বপ্নের মতোন এক মোহন উদ্যান
কাঁটাবন হয়ে গেছে এবং অতিথিবৃন্দ ভোজসভায় হঠাৎ
অজস্র কংকাল হলো, বিকৃত আয়নার
ছবির মতোই
দৃশ্যাবলী চতুর্দিকে। চলে যেতে দাও, এরকম দৃশ্য দেখে
ঝিমোতে ঝিমোতে প্রায় উন্মাদের মতো পারবো না
চেচিয়ে উঠতে কোনোদিন মানুষের মধ্যে, আমি
বরং মাটির নিচে নিজেকে আড়াল করে প্রহর কাটাবো।
প্রত্যহ মেঝেতে দেখি শক্ত, মৃত পাখি পড়ে আছে,-
আমি চলে যাবো।
চেতনায় কৃষ্ণপক্ষ নেমে আসে বারংবার বাদুড়ের মতো,
আমি চলে যাবো।
আমার আনন্দ একজন অকস্মাৎ এক ফুঁয়ে
নিভিয়ে দিয়েছে,-
আমি চলে যাবো।
আমার সুখের নৌকো নিমজ্জিত ঘোর কালো গহন নদীতে,
আমি চলে যাবো।
যে পাখি গাইতো গান নিরিবিলি হৃদয়ে আমার
তার বুক একজন তীক্ষ্ণ নখে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে বেবাক,
আমি চলে যাবো।
নিজের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যাবো দুঃখিত, একাকী।
নিষ্পিষ্ট বেহালা
আমার হৃদয় জুড়ে সারাক্ষণ এ কী জলহাওয়া।
আবহকুক্কুট ঘোরে উল্টোপাল্টা, দিকচিহ্নগুলি
সহসা গিয়েছে উড়ে, দরজা, জানালা ঘুলঘুলি
কম্পমান ক্ষণে ক্ষণে। খুব একা কোনো গানে-পাওয়া
লোকের স্বভাবে ঘুরি দিগ্ধিদিক মানুষের হাটে,
কখনো দারুণ জনশূন্যতায়। রুদ্র ভূকম্পন
মাঝে মাঝে আনে শোক; নৌকো, সেতু ছাড়াই গহন
খর নদী পার হতে হবে, হবে যেতে ফুল্ল ঘাটে।
স্মৃতি ভেতরে স্মৃতি ক্রিয়াশীল পারম্পর্যহীন-
তছনছ ঘরবাড়ি, ক্ষুধার্ত শহর, ডালপালা,
ছিন্নভিন্ন, তরুণীর স্বেদসিক্ত স্তন, একজন
খোঁড়া লোক, চা খানার নির্জন টেবিল, অন্তরীণ
তেজী যুবা ভেসে ওঠে ডুবে যায় এবং যখন
বিপর্যয় অস্ত যায়, বাজে ফের নিষ্পিষ্ট বেহালা।
পাখির ভূমিকা
এখন ডাকার কথা নয় তার এই মধ্যরাতে অকস্মাৎ,
তবুও এমন আর্ত কণ্ঠস্বরে উঠলো ডেকে, যেন
দিয়েছে বসিয়ে দাঁত কেউ তার বুকে হিংস্রতায়।
যেমন নিপুণ দর্জি কাঁচি দিয়ে কাটে মখমল,
তেম্নি তার ডাক নিশীথকে চিরে ঝরে ফুটপাতে,
কলোনীর ফ্ল্যাটে আর বস্তির বিনীত দোচালায়।
প্রহর প্রগাঢ় হয়, মধ্যরাতে পাখির ভূমিকা
মেনে নিয়ে বালিশের গালে খুব জোরে, গাল চেপে
চুপচাপ শূন্য এক কুটিরের কথা, দূর কোনো
বনানীর কথা ভাবি; খড়কুটো উড়ে আসে ঘরে।
এবং পাখির ডাকে ঝিল, কারো স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ,
পদচ্ছাপময় দীর্ঘ পথ, প্রাচীন যে ধাতুশিল্পী
বানায় সোনার পাখি কী তন্ময় অন্ধকার ঘরে,
তাকে, আপনার আবডালে নিজেকেই পেয়ে যাই।
মধ্যরাতে পাখি ডেকে যায়, ডেকে যায় কী একাকী,
এই ডাক শুনে শুনে এ জীবন কেটে যাবে বুঝি!
পার্টির পরে
এখন কোথায় যাবো পথ খুঁজে এই মধ্যরাতে
একা একা? পান্থনিবাসের সব দরোজা জানালা
বন্ধ, পথও লুপ্ত, অস্তিত্বের স্বরে স্তরে বিশ্রী জ্বালা-
হঠাৎ হবে কি দেখা কীর্কেগার্ড, নীটশের সাথে?
এ কেমন শূন্যতায় পা দু’টো দেখাচ্ছে খেল এই
দর্শকবিহীন পথে? নাকি অলৌকিক কিছু চোখ
রয়েছে তাকিয়ে সর্বক্ষণ! স্মৃতি-বিস্মৃতির ঢোক
গিলে বলি নিজেকেই-নেই, কোথাও কিছুই নেই।
ভীষণ বদলে যাচ্ছে দৃশ্যাবলী, হাতের নিকট
হাত এসে কী যে বলে বাউল গানের মতো শুধু।
ব্লিপ, ব্লিপ, হিরোশিমা মন আমার, ব্লিপ, ব্লিপ, রীতি,
নাতি, রাজনীতি, রশোমন, রোসো মন, কে চম্পট
দিলো কানা গলির ভেতর? ব্লিপ, ব্লিপ, রুক্ষ, ধুধু
বয়স আমার, নীল ম্যাপ, ট্যাঙ্ক, ককটেল-স্মৃতি।
পিছুটান
সর্বদাই ছিল পণ, যাই বলুক, সর্বক্ষণ
হাঁটবো সামনের দিকে, চলে যাবো সুউচ্চ চূড়ায়
আখেরে একদিন সূর্যাস্তের রঙ মেখে রুক্ষ গায়।
কস্মিনকালেও তাকাবো না ফিরে, মনের মতোন
পথ না-ই থাক, তবু হেঁটে যাবো, যখন তখন
একটি কি দু’টি ফল ছিঁড়ে নেবো ঝরণাতলায়
অঞ্জলি উঠবে ভরে জলে, শুনেছি রূপকথায়-
তাকালে পিছনপানে মানুষের দীপ্র দেহমন
শিলীভূত হয়, কোথায় যে জন্মস্থান, কোন বাঁকে
নতুন জাহাজ ভিড়েছিল, কার ওষ্ঠে চুমু, খেয়ে
যাত্রারম্ভ-মুছে যায় সবকিছু। তাকাবো না ফিরে,
করেছি শপথ, তবু সিঁড়ি, অনেক মুখের ভিড়ে
স্বতন্ত্র একটি মুখ, দোচালা, বনানী গান গেয়ে
ওঠে; হায়, প্রত্যেকেরই মর্মঘাতী পিছুটান থাকে।
প্রথম দেখা
তোমাকে প্রথম দেখি মধ্যাহ্নের নিঝুম চৈনিক রেস্তোরাঁয়।
অবশ্য এ কথা তুমি করো না স্বীকার। তুমি বলো,
আমাদের দেখা হয়েছিল
অনেক আগেই
কী এক মেলায়।
মেলা? শুনে মনে
কেমন খটকা লাগে। যদি পৃথিবীকে সুবিশাল
কোনো মেলা ভাবো, তবে হয়তো কখনো
কোনোখানে হয়েছিল দেখা,
আজ মনে নেই, কিন্তু এ ও কি সম্ভব
আমরা দু’জন মুখোমুখি
দাঁড়িয়েছিলাম মুখোমুখি ভোরবেলা, দুপুরে কি অপরাহ্নে
অথবা মদির অস্তরাগে-যতই ক্ষণিক হোক সেই ক্ষণ-
ভুলে যাবো? তাই, ভাবি-
হয়তো রহস্যে ভেসে তুমি কোনো নির্বাচিত দিন
মনে রেখে মৃদু হেসে আমাদের কাল্পনিক প্রথম দেখার
গল্প বলো, গল্পে আছে তোমার গভীর অনুরাগ।
তোমাকে প্রথম দেখি মধ্যাহ্নের নিঝুম চৈনিক রেস্তোরাঁয়।
এক কোণে নিরিবিলি বসেছিলে। তোমার সমুখে
(বাইরে ট্রাফিক যেন সুন্দরবনের আর্ত আদিম চিৎকার,
শীত-হাওয়া দুপুরকে চুমু খায়, তামাটে কুকুর
ছুটে যায় ল্যাম্পোস্টের দিকে, গোয়েন্দার মতো কেউ,
না কি দেবদূত জানালার কাচে ঘষে ঠোঁট চোখ)
কোকের বোতল আর বইয়ের পাতায় চোখ আর
তোমার চাদ্দিকে বয়ে যাচ্ছিল প্রফুল্ল বর্তমান,-
ঝোড়ো মনে ঢুকে দেখি এবং নিমেষে হৃদয়ের
(অন্য কোণে কিছু কমনীয়, রুক্ষ অচেনা মুখের
নড়া-চড়া পর্যটন, সিনেমা, স্ক্যান্ডাল বিষয়ক বাক্যালাপ,
মুহূর্তে নিঝুম ঝরে কাঁটা চামচের তক্কে গপ্পে, ন্যাপকিনে,
আমাদের পাশে বসে কীর্কেগার্ড মৃদু খাচ্ছেন রঙিন স্যুপ)
নিভৃত গোলাপবন উঠলো দুলে, যখন তাকালে
চোখ তুলে। এক রাশ হাওয়া গেল খেলে
বুকের ভেতরে-যেন শহর ঢাকার পূনর্জন্ম
ময়ূরের কলাপের মতো!
সেদিন বিকেলে নিসর্গের অন্তঃপুরে তোমার কবোষ্ণ হাত
ধরে হেঁটে যেতে যেতে অকস্মাৎ মনে হলো-
পঁচিশ বছর আগে যে আমার পাশে ছিল
এমনই বিকেলে, তুমি ছিলে তার গভীর আড়ালে
হওয়া না হওয়ার রশ্মিজালে,
আমার শতাব্দীব্যাপী প্রতীক্ষার পারে।
তখনই কি সে সুদূর কালে
তোমাকে প্রথম দেখি না-দেখার মায়াবী উদ্যানে?
বিশদ তদন্তসূত্রে
বিশদ তদন্তসূত্রে জানা গেল ফাল্গুন সন্ধ্যায়-
তোমার হিশেব নাকি, কবি, খুবই পাকা চিরদিন।
বাউল গানের মতো তোমার জীবন উদাসীন,
এই তো জানতো লোকে, তোমাকে অনেকে অসহায়,
বড় জবুথবু বলে করেছে শনাক্ত, তবু, হায়,
সেয়ানা হিশেবীরূপে খ্যাতি রটে তোমার হে কবি।
তোমার হৃদয়ে জ্বলে সর্বদাই যে রক্তকরবী
তাও নাকি হিশেবেরই ফুল? যে কিন্নর গান গায়
তোমার ভিতরে ভেলা অবেলায়, যে-ও বুঝি গণিতের
ক্রীতদাস? যে প্রেমিক তোমার কংকাল জুড়ে আছে,
তার হাতে যোগ-বিয়োগের ফলাফলময় খাতা?
অথচ যদ্দুর জানি করেছে উজাড় জীবনের
সমস্ত তবিল তুমি গোপন জুয়ায়, যারা বাঁচে
নিক্তিতে ওজন করে তুমি নও তাদের উদ্গাতা।
বুগেনভেলিয়া
ঘরের বাইরে নুয়ে আছে নিরিবিলি বারান্দায়
বুগেনভেলিয়া, যেন শূন্য রাঙা মন্দিরে প্রণতা
দেবদাসী একাকিনী। ঘরের ভেতরে আচ্ছন্নতা
গদ্যের পদ্যের, আমাদের দু’জনের চেতনায়
কত যে শতাব্দী বয়ে যায়। আমাদের বাক্যালাপে
খৃষ্টপূর্ব সূর্যোদয়, বিশ শতকের অস্তরাগ,
কত তক্কো গপ্পো মেশে। তোমার কপালে মৃদু দাগ
কবেকার হেসে ওঠে, দূরে বুগেনভেলিয়া কাঁপে!
ঐযে লতাপাতা, ফুল, ওরা মানুষের খুব কাছে
প্রত্যহ আসতে চায়, কখনো হঠাৎ পায় ভয়-
এমন দোটানা মনোভাব ওদের স্বভাবে আছে।
আপাতত দীর্ঘ লাল বারান্দার থেকে, মনে হয়,
আমাদের ভালোবাসা দেখে, নিয়ে অলৌকিক রেশ
বুগেনভেলিয়া ঘরে কী প্রবল করেছে প্রবেশ।
বেহালাবাদকের জন্যে পঙ্ক্তিমালা
আমার ভিতর রাশি রাশি নিউজপ্রিন্টের রোল ঢুকে গেছে
সরাসরি, দ্যাখো আজ কেমন কাগুজে গন্ধ রয়েছে ছড়িয়ে
সত্তাময়; হিজিবিজি লক্ষ লক্ষ অক্ষর বেজায়
চেঁচামেচি করে, প্রায় অশ্লীলতা বলা যায়, আর কি অস্থির
ওরা সর্বক্ষণ, ওরা ভীষণ কলহপরায়ণ। উন্মাতাল,
বেহালাবাদক তুমি সুরে সুরে আমার ভিতর থেকে অই
তাল তাল খসখসে
নিউজপ্রিন্টের মণ্ড তুলে এনে ক্লিন্ন ডাষ্টবিনে ছুঁড়ে দাও।
ওসব ফক্কড় হিবিজিবি
অক্ষর সুনীল শূন্যতায়, নক্ষত্রের পরপারে।
দূষিত রক্তের মতো কালিতে নিমগ্ন আমি সকল সময়
যেন অপদেবতা একাকী।
আমাকে যায় না চেনা আগেকার মতো, অতি দ্রুত
কেমন নির্মুখ আমি হয়ে যাচ্ছি এ খর বেলায়।
বেহালাবাদক তুমি কালির সমুদ্র থেকে আমাকে
নিমেষে তুলে আনো
ধ্বনির মোহন ঝড় তুলে দীপ্রছড় টেনে টেনে।
নিজের রক্তাক্ত বেশভূষা দেখে, ক্ষত দেখে দেখে ঘুরঘুট্রি
অন্ধকারে শ্বাপদের গুহায় আমার কাটে সারাবেলা, তার
নখরে রয়েছে বাঁধা পরমায়ু আমার এবং
নক্ষত্র দেখিনা কতকাল জলাশয়ে
দেখিনি আপন মুখ, যে রূপালি শহরে যাবার কথা ছিল,
পড়েনি সেখানে পদচ্ছাপ।
বেহালাবাদক তুমি বানিয়ে সূরের স্বপ্নময় পথরেখা
আমাকে সেখানে পৌঁছে দাও, পৌঁছে দাও।
আমি এক ঊর্ণাজালে আটকা পড়ে গেছি,
কষ্ট পাচ্ছি, কষ্ট পাচ্ছি অনেক শতক ধরে, বুঝিরা পাঁজর
খসে যাবে বদরাগী হাওয়ার আঁচড়ে।
বেহালাবাদক তুমি আমাকে কর্কশ ঊর্ণাজাল থেকে দ্রুত
মুক্তি দাও, মুক্তি দাও সঙ্গীতের উধাও গৌরবে
কিংবা ঊর্ণাজাল হয়ে যাক ফুলশয্যা অথবা তোমার বাদ্য।
বেহালাবাদক তুমি এতদিন পরেও কি পাওনি আমার
কোনো চিঠি? হায়,
আমিতো চিঠিতে ডাকটিকিটে লাগাতে
ভুলে যাই, বারংবার ভুল হয়ে যায়।
বয়স যতই হোক
বয়স যতই হোক, আজো অমিলের ভিড়ে মিল
খুঁজে ফিরি বন্ধ ঘরে, প্রত্যেকের থেকে অন্তরালে
একটু আলাদাভাবে থাকি কিছুকাল। কী হারালে
বিনিময়ে কী লভ্য সে কথা ভেবে কিছু ঢিল
ছোঁড়া যায় নক্ষত্রের আস্তানায়। অলোকিক ঝিল
আমার ভেতরে উচ্ছ্বসিত, অস্তিত্বের তন্তুজালে
গভীর সরোদ বেজে ওঠে। সে কোন্ সুদূর কালে
ছিলেন আমারই মতো তপোক্লিষ্ট হোমার, ভার্জিল-
এ কথা স্বরণে রেখে নিজেকেই উস্কে দেয়া যায়
মাঝে-মধ্যে; তবে এ ও জানি শূন্য ফাটা কলসের
মতো বেজে ওঠা শুধু আত্মপ্রবঞ্চককে মানায়।
তাই একা, বড় একা কাটাই প্রহর কলমের
স্পর্শে মূলহীন লাল নীল কমলের জাগরণ
দেখে, দেখে মরুবক্ষে হরিণ-কোমল ঘন বন।
ভালো থেকো, সুখে থেকো
ফেলতে চায় না কেউ, তবু ফেলে দিতে হয় অনেক কিছুই,
দিতে হয় অসহায় সূর্যোদয়ে অথবা সূর্যাস্তে। এ বিজনে
এমন কারুর সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়, যার সাথে
সারাদিন সারারাত সময় যাপন করে সুখ পেতে
সাধ হয়, তাকে ছেড়ে মন চায় না কস্মিনকালে, তবু
মৃত্যুর শীতল স্বাদ জিভে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা চলে যেত হয়।
আমার চোখের মধ্যে যে রূপালি নিঝুম শহর আছে এক
তার অলৌকিক অলিগলি আর হৃদয়ের ধুলো ওড়া পথে
জেগে থাকে তার পদচিহ্ন প্রত্যাশার মতো, হয় না নিশ্চিহ্ন
ঝড় জলে। হাঁসময় সন্ধ্যার আকাশে কবিতার পঙক্তি দোলে,
না কি শাড়ি তার ওড়ে নক্ষত্রমালায়। প্রতীক্ষায় কখন যে
সন্ধ্যার আকাশ ফের ভোরের আকাশ হয়ে যায়, রিক্ত লাগে।
কী কী আমি কতদূরে কখন এসেছি ফেলে অবহেলে,
আজ কি পড়বে মনে ঝড়মত্ত এই মধ্য সমুদ্রে হঠাৎ?
অমন ফেলতে হয় কত কিছু, অবিজ্ঞ কাপ্তান জানে, আর্ত
জাহাজ বাঁচাতে হলে। কিন্তু আমি ছেড়ে যাবো
কেন তাকে, যাকে
কী সকালে কী দুপুরে, অপরাহ্নে, অথবা রাত্তিরে এক বেলা
না দেখলে কিছুতেই চলে না আমার? ভালোবাসা,
জানো নাকি
আমিও নিরুপদ্রব বেঁচে যেতে চাই কিছুকাল? কিছুকাল,
যতটুকু পারা যায় মারকুটে পরিবেশে কিল ঘুষি লাথি
মেরে কিংবা খেয়ে রৌদ্রে, খলখলে জ্যোৎস্নার প্রচার আপ্যায়ন
পেয়ে রাজেন্দ্রাণী বলে দরবেশী ধরনে উদ্যানে
করবো প্রবেশ, বসে পড়বো, দোলাবো মাথা বেশ দূরবর্তী
পাখিদের গান শুনে, নামবে গভীর ছায়া ভালোবাসা জুড়ে।
এই আপ্যায়ন পারবে কি করতে রোধ হৃদয়ের অবিরল
শোণিতক্ষরণ? পারবে কি অস্তিত্বের জিভ থেকে মুছে নিতে
কটু স্বাদ? আমাকেই আত্মার অমল অশ্রুধারায় নিয়ত
ধুয়ে দিতে হবে তার হাত, ফেলে যেতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে,
যেমন গিয়েছি আগে অসহায়, ব্যর্থ নিরুপায়। ভালো থেকো,
সুখে থেকো বলে আমি এক ফোঁটা অশ্রু হয়ে থাকবো একলা।
ভায়োলেন্স
শুধু কি ক্ষয়িষ্ণু গ্রামে-গঞ্জে লাঠিসোটা
গজরানো বাবরি (ঝড়মত্ত বৃক্ষচূড়া) ভাটা-চোখ, শক্ত কব্জি,
রামদা সড়কি আফ্রিকার জুলুদের মতো নেচে ওঠে
সংহার নেশায়?
শহুরে গলিতে, চোরাস্তায় আলোকিত ফোয়ারার কাছাকাছি,
তাড়ি-বুঁদ, শূন্য-হাঁড়ি মহল্লায় হৈ-হল্লা, দাঁত-নখ
খিঁচানো প্রহর কটমট
তাকায় চৌদিকে, যেন ডালকুত্তা। ইস্তিকরা কাপড়ের মতো
কলোনীও অকস্মাৎ বন্দুকের নল, তপ্ত ধোঁয়াময় হয়,
রক্তবমি করে সারি সারি ফ্ল্যাটে শহরে শহরে
নানা দেশে ঋতুতে ঋতুতে।
মেঘে মেঘে অন্ধকার পাতালে এবং দূর পবর্ত শিখরে
ধূ ধূ মরুবক্ষে কালান্তক স্বরে অস্ত্র হেঁকে যায়।
জলপাইরঙ কিংবা খাকি ইউনিফর্মের ভিড় গোলাপ বাগানে,
আপেল বাগানে, শস্যক্ষেতে। রাশি রাশি ভারি বুট
পাথরে কাদায় বাজে বনবাদাড়ে এবং সংখ্যাহীন হেলমেটে
মাইল মাইল-ব্যাপী সূর্যমুখী ঘন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যায়।
মনের ভেতরে খণ্ড প্রলয়ের উন্মত্ত ঝাপটায়
মধ্যবিত্ত প্রেমিকের চোখে ওথেলোর ভীষণ সবুজ চোখ
নিমেষে প্রবেশ করে, অতিশয় কর্কশ রাত্রির কিনারায় বিচুর্ণ স্বপ্নের মতো,
একরাশ বিমর্দিত জুঁইয়ের মতোন
প্রেমিকা নিঃসাড় পড়ে থাকে।
নানা রাষ্ট্র, বিশেষত উন্নতি-ঊর্মিল,
আদিবাসীদের মতো মদির উল্লাসে ধূপ-ধুনো
অথবা আগরবাতি জ্বেলে
নিয়ত বন্দনা করে নানাধর্মী বোমাকেই।
সুদুর দিগন্ত, লোকালয়, দ্বীপপুঞ্জ মুছে-ফেলা।
ঝড়ের পরেও কোনোদিন কূল পাবো কি পাবো না।
না জেনেই সঙ্গীহীন, পানির দংশনে জর্জরিত একা,
প্রায় ক্ষয়ে-যাওয়া
মান্দাস আকঁড়ে ধরে ভেসে চলি ক্ষুধার্ত সমুদ্রের
ভেসে চলি।
ভ্রান্তিবিলাসে
একদা আমারও ছিল একটি আকাশ সীমাহীন
এবং সেখানে কত উড়ন্ত উৎসব প্রতিদিন,
অজস্র রুমাল যেন হাওয়ায় ঊর্মিল। আজ বড়
খণ্ডিত সংকীর্ণ সে আকাশ, মেঘদল কী মলিন।
আমি নিজে বহু নিচে মহিমাবঞ্চিত, জড়োসড়ো
ডানা নিয়ে ভুলুণ্ঠিত সারাক্ষণ। যদিও কখনো
সখনো কিঞ্চিৎ ডানা জোড়া পেতে চায় নীলিমার
স্পর্শ, তবু উঁচু আরো উঁচুতে সহজে আমি আর
পারিনা মেলতে পাখা। বুঝি আজ মেঘাশ্রয়ী মনও
হারিয়ে ফেলেছি আর বায়ুস্তরে কাক শালিকের
নিয়ত সংস্রবে ভুলে গেছি রাজসিক পাখিদের
পরিচয়। অতীতের সৌন্দর্যের মতো কী সূদূর
ওরা ইদানীং ক্ষুব্ধ ডানায় এখনো জাগে সুর,
মাঝে-মাঝে ভ্রান্তিবিলাসে ভাবি আমিও স্বাধীন।
মাঝে মাঝে তাকে
দূর থেকে দেখে ঈর্ষার তাপ লাগে সত্তায়।
তার এলোমেলো রুক্ষ চুলের ঘন অরণ্যে
হরিণের খেলা,
সোনালি সাপের এঁকে বেঁকে চলা, অথবা কখনো
কাঠুরের চোখ, শাণিত কুঠার দেখেছি সহসা।
জ্বলজ্বলে গালে
কর্কশ দাড়ি, ছিপছিপে গায়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবী, পায়ে চম্পল
বিবর্ণ আর মুমূর্ষু খুব। রাস্তার ভিড় গহন দুপুরে
চিরে যায় সেই
সতেজ একলা যুবক, যেমন সাগর-জলের বুক কেটে দ্রুত
এগোয় জাহাজ, কেমন অচিন। নিজের ভেতর
জ্বলি অনিবার।
ঔদাস্যের
পাল তুলে চলে হাওয়া থেকে কী যে যখন তখন
মোহন মাগনা কুড়িয়ে সে নয়, আবার ফিরিয়ে
দ্যায় সহজেই
শূন্যের হাতে রূপান্তরের ভিন্ন খেলায়, যেন যাদুকর।
আমাকে দ্যাখেনা। আমি তাকে দেখি, যেমন দুপুর।
রোদ্দুর দ্যাখে।
তার জ্বলন্ত
মহানিশাময় ক্ষুধার্ত চোখ কোথায় কখন
হয় নিবদ্ধ, কেউ তো জানে না। বুঝি তার চোখে
কিলবিলে কীট, পদ্ম-কোরক! পদযুগল তার অবশ্য এই
শক্ত মাটিতে সচল, অথচ প্রায়শই মাথা মেঘমালা ছোঁয়।
কখনো সখনো
থাকতে দ্যায় না আমাকে আমার মধ্যে সে তেজী,
আমাকে আমার গহন ভেতর থেকে টেনে আনে!
বাইরে দাঁড়িয়ে
বড় অসহায়, ভীষণ নগ্ন, আড়ষ্ট লাগে।কিন্তু সে রোজ
ত্রিলোক-বিহারী। দূর থেকে দেখে আমি কি শুধুই
জ্বলতে থাকবো?
মানবের ব্যাখ্যা
মানবের ব্যাখ্যা নিয়ে ঘামাই না মাথা আজকাল।
মানুষ বিষয়ে কী বলেছে রেনেসাঁস, কাকে বলে
মানবতা, শুভাশুভ, দুর্জনের অনাচার, সাধু
সন্তের উদার ঐশী পর্যটন, ইত্যাদি কিছুই
এখন ভাবিনা আর। সংসারে ক’জন নিরিবিলি
অন্ন ভাগ করে খাই, কখনো পান্থনিবাসে ঠাঁই
খুঁজি, ঘুর একা একা ভেঙ্গে যাওয়া মেলায় কখনো,
নিজের শরীর থেকে পশুগন্ধ মুছে ফেলি কিছু।
মানুষ বলেই গোলাপের প্রতি যাই অনুরাগে,
সযত্নে পালিশ করি জুতো, মোজা দিই রোদে আর
হঠাৎ ভীষণ রেগে যাই, মাঝে মাঝে অভিমান
মেঘের মতোন গাঢ় ছেয়ে যায় সমগ্র সত্তায়।
মানুষ বলেই মানবীর দিকে তাকাই গহন,
স্তব্ধ রাতে হেসে উঠি কখনো খারাপ হয় মন।
মুর্গী ও গাজর
এখন আমার সত্তাময় কত ভীষণ আঁচড়।
কত পৌরাণিক পশু আমার সমগ্রে দাঁত-নখ
বসিয়েছে বারংবার ধুমায়িত ক্রোধে। কী প্রখর
চঞ্চু দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক কালো পাখি আমার
ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছে বেবাক, কোনোদিন দেখবে না
তুমি, খেদহীন আমি তোমার ধারণা, বিবেচনা
ইত্যাদির পরপারে আস্তে সুস্থে হেঁটে যাবো, চেনা-
শোনা ছিল কোনোদিন আমাদের, এই তো সান্ত্বনা।
বিদায়ের ঘণ্টা বাজে হৃদয়ের দিগন্তে এখন।
চড়ায় ঠেকেছে শূন্য রূপসী ময়ূরপঙ্খী নাও,
বৈরী হাওয়া সহসা কাঁপিয়ে দেয় আমার পাঁজর।
দুঃখ নাম্নী যে নিঝুম পল্লী আছে, সেখানে আপন
ডেরা আজো, সংসার পাতো গে তুমি, যাও মেয়ে যাও,
বস্তুত তোমার পথ চেয়ে আছে মুর্গী ও গাজর!
মৃতের মুখের কাছে
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলে ভাবনার
স্বরূপ বদলে যায়? চোখে সম্মুখে বনভূমি,
কাঁটাবন, শীর্ণ নদী, সন্তের ঔদাস্যময় ছিন্ন
আলখাল্লা, এক পাটি জীর্ণ জুতো, দূরবর্তী লাল
টিলা বেয়ে নেমে আসা কেউটে, গহ্বর ভয়ংকর,
অবেলায় ঘরে ফেরা জেগে ওঠে। চৌদিকে বিপুল
বৃষ্টিধারা, ভেসে যায় শিকড় নিরুদ্দেশে,
কে যেন একাকী দাঁড় টেনে চলে গহন নদীতে।
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু গূঢ় কথা
জিগ্যেস করতে সাধ হয়, কিন্তু ভুলে যাই সব।
কেমনে অমন পড়ে থাকে একা এমন অচিন,
শূন্য খাঁচা স্তব্ধতায় কম্পমান, হায়, গানহীন।
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে দুঃখের ভিতরে
বসে থাকি কিছুক্ষণ খুব একা, মেঘ হয়ে যাই।
মেধার কিরণে স্নান করে
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী ফিরে আসে
আপন নিরালা ঘাটে, কখনো বিস্তর মেঠো পথ
এবং সুদূর সাঁকো পেরিয়ে, ঔদাস্যে
ফুটপাতে গায় গান, কখনো বা দরদালানের
দেয়াল, রেস্তোরাঁ, পুলিশের পিঠ বেয়ে উঠে পড়ে
কাঠবিড়ালীর মতো নিঝুম ভঙ্গিতে।
মধ্যরাতে জ্যোৎস্না-ধোয়া চা-খানায় ফোকটে চা খেয়ে
গলিতে আড়াল খোঁজে ওরা, প্রত্যুষে সংবাদপত্রে
শিস দেয় অকস্মাৎ মেধার সম্ভ্রম ভুলে দিয়ে।
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী
উঠোনে বেড়ায় নেচে, ঘরে
প্রহরে প্রহরে শুয়ে-বসে, হামাগুড়ি দিয়ে আর
মেঝেতে গড়িয়ে
কাটায় সময়। কখনো বা
স্বপ্নের ঝরণায় মুখ রেখে দূর ঝুলন্ত উদ্যানে
বাড়ায় স্বপ্নার্দ্র হাত, অন্তরালে অজস্র বেহালা
বেজে ওঠে।
শব্দের ভেতরে শব্দ অবলুপ্ত সভ্যতায় স্মৃতির মতোন
জেগে থাকে, উড়ে যায় মেঘে, যেন হাওয়ায় হরিণ ওড়ে
এক পাল। সভ্যতার দ্বিপ্রহর কখনো প্রোজ্জ্বল মরীচিকা,
কখনো বা ঐন্দ্রজালিকের ভুল খেলা
বিশ্বব্যাপী জনসমাবেশে। যখন সিংহের পায়ে
মরুসীমা শিহরিত হয়, স্ফীত কেশরে কেশরে
সমাহিত সাম্রাজ্যের দিকগুলি সুনীল শোভায়
প্রস্ফুটিত বারংবার, জগৎ-সংসার
নানা গুঞ্জরণে
দৃশ্যে দৃশ্যে অর্থ আর অর্থহীনতায় ক্রমাগত
অত্যন্ত দোদুল্যমান। শব্দাবলী সভ্যতার স্তর,
শোকগাথা আর্তরব কত
বিপুল ধ্বংসের।
রেস্কিউ পার্টির উদ্ধারের অতীত সে ধ্বংসলীলা, মনে রেখো।
তরুণ কবির থর থর হৃদয়ের মতো কিছু
অদৃশ্য পলাশ জ্বলে দ্বিপ্রহরে। ফাল্গুনের পথে
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, মুখচ্ছবি বহু গান। দুপুরেই
অকস্মাৎ চুতর্দিকে কেমন আঁধার হয়ে আসে।
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী অন্ধকারে
কাকে ডাকে? উন্মুথিত নগর, বনানী উপত্যকা
এবং পাহাড়ি পথ স্বপ্নে কথা বলার মতোন
সাড়া দেয়, শব্দাবলী অভ্যাসের সীমা ছিঁড়ে যায়।
যখন শুধাও তুমি
যখন শুধাও তুমি, ‘হে বন্ধু কেমন আছো’, আমি
কী দেবো উত্তর ভেবে পাই না কিছুই। প্রশ্ন খুব
শাদাসিধে, তবু থাকি নিরুত্তর; যিনি অত্নর্যামী
তিনিই জানেন শুধু কী রকম আছে এ বেকুর
দুঃখজাগানিয়া জনশূন্য ধুধু চরে। এ কেমন
দীর্ঘ স্থায়ী পরবাস নিজেরই ভেতর? দীর্ঘ বেলা
কাটে জন্মান্ধের মতো। সমাধি ফলক, ঝাউবন,
উন্মাদ আশ্রয়, শূন্য ঘর চেতনায় করে খেলা
এসব কিছুই আমি বলি না তোমাকে। প্রায়শই
তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকি চুপচাপ, কথা
সামান্যই বলি, বলি, ‘ভালো আছি’। গূঢ় চঞ্চলতা
গোপন শিরায় জাগে, মনোকষ্ট ব্যাকুল লুকোই।
মৃতের রহস্যময় চোখ আমার নিকটে আসে
লাফাতে লাফাতে, অশ্রুকণা পড়ে থাকে বুনো ঘাসে।
যখন সে লেখে
যখন সে লেখে তার ধমনীতে নেচে নেচে মেশে
গোলাপের পাপড়ি একরাশ, টেবিলের গ্রীবা ঘেঁষে
জেগে ওঠে বহুবর্ণ অশ্বপাল কেশর দুলিয়ে,
দেবদুত মাঝে সাজে দ্যায় তার মাথাটা বুলিয়ে।
যখন সে লেখে, দ্যাখে তার শৈশবের খড়স্তূপে
খরগোশ নাকের ডগা থেকে ঝাড়ে খড়কুটো চুপে
এবং আলেখ্যবৎ আস্তাবলে সহিস ঘুমায়।
যখন সে লেখে, দ্যাখে তার পদাবলী উড়ে যায়,
একজন তরুণীর কোলে কোমল লুটিয়ে পড়ে,
চুমু খায় ওষ্ঠে তার; যখন সে লেখে, সারা ঘরে
জীবনের ঠোঁট নড়ে মৃত্যুর নিতম্ব দোলে শাদা।
যখন সে লেখে, লাশময় বিধ্বস্ত ট্রেঞ্চের কাদা
উঠে আসে চতুপার্শ্বে আর তারই দিকে অবিরত
নিঃশব্দে বাড়ায় গ্রীবা বাংলাদেশ হরিণের মতো।
রেনেসাঁস
চকচকে তেজী এক ঘোড়ার মতোন রেনেসাঁস
প্রবল ঝলসে ওঠে চেতনায়। ক্ষিপ্ত তরবারি,
রৌদ্রস্নাত রণতরী, তরঙ্গে তরঙ্গে নৃত্যপর,
জ্বলন্ত গমের ক্ষেত, আদিগন্ত কালো মহামারী,
অলিন্দে রহস্যময়ী কেউ, দিকে দিকে প্রতিদিন
ভ্রাম্যমাণ অশ্বরোহী, মাঝিমাল্লা স্মৃতিতে ভাস্বর।
জেল্লাদার ট্রফি, অসিচালনা অথবা বল্লমের
খেলা-কোনো কিছু নয়, সেকালে মেধার উল্লাস
এখনো আমাকে টানে। তোমার উদ্দেশে কতিপয়
চতুর্দশপদী লিখে, নিশীথের শেষ প্রহরের
ক্ষয়িষ্ণু বাতির দিকে চোখ রেখে শুভ্র সূর্যোদয়
আকণ্ঠ করবো পান, মড়কের প্রতি উদাসীন
অশ্বারূঢ় নাইটের মতো যাবো। সভ্যতার বিভা
উঠবে চমকে জ্যোৎস্নালোকে, জ্বলবে ঘোড়ার গ্রীবা।
রৌদ্রলোকে, নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে
আমাদের দু’জনের মধ্যে যেন কবরের মতো কিছু আছে,
বুঝি তাই অন্তহীন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে
দু’জন দু’দিকে থাকি। শুকনো ওষ্ঠে পানি ঝরবার
অনেক আগেই বেলা যায়, বেলা যায়।
তবুও তোমার প্রতি যাই বেলাশেষে,
যেমন নিঃসঙ্গ বেদুইন
ব্যাকুল প্রবেশ করে মরুদ্যানে। আমি বালির ভেতর থেকে
ঝরণার বদলে
বেনামি কংকাল তুলে আমি আর প্রিয় কোনো গান
হঠাৎ গাইতে গিয়ে বোবার মতোন কিছু শব্দ করে ফেলি।
কবরখানার পাশে দ্বিপ্রহর, সোনালি নর্তকী,
প্রতিটি মুদ্রায় তার
কেমন ঔদাস্য ছিল, কবরের ফুলের মতোন
দৃষ্টি নিয়ে কী তন্ময় তাকিয়েছিলাম একজন
প্রতিমার প্রতি,
তুমি তাকালে না;
অথচ আমার ভেতরের দৃশ্যাবলী দুলে উঠেছিল খুব।
কবরখানার পাশে দাঁড়ালেই কেবলি আমার
সাবানের ঘ্রাণ, যেশাশের অন্তিম ভোজন, শূন্য পানপাত্র,
জংধরা হেলমেট চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া জল মনে পড়ে,
মনে পড়ে কুয়াশায় ভীষণ একলা কারো যাওয়া।
তোমার নিকট থেকে চলে যেতে ভারি ভয় পাই,
যেমন ধার্মিক ধর্ম থেকে,
সর্বক্ষণ বুক জুড়ে থাকে তোমাকেই
পাওয়ার প্লাবন, কাতরতা।
ধ্বংসস্তূপে বসে আমি তোমার অধরে ওষ্ঠ রেখে
অমরতা চেয়ে নিতে পারি,
তোমাকে বাঁধতে পারি আলিঙ্গনে কবরের পাশে,
কবিতাও লেখা যায় লাশময় প্রান্তরে একাকী
ট্রেঞ্চে জ্যোৎস্না ব্যেপে এলে মুশকিল নয়
দিনপঞ্জী কিংবা চিঠি লেখা।
যখন একলা থাকি ঘরে, পোশাক বদলে ফেলি যথারীতি,
সিগারেট খাই, ভয় পাই, এ ভয়ের কোনো ব্যাখ্যা
চলে না কখনো।
কখন যে কবেকার শীতল মোমের গন্ধে ভরে যায় ঘর,
অনেকেই ফিস ফিস কথা বলে, মনে হয়, আমি
কারো কথা শুনি না স্পষ্টত।
বুঝি বা দেয়াল বলে, ‘আত্মসমর্পণ করো’, কিন্তু তার প্রতি?
পাই না উত্তর।
অনিদ্রার ঘোরে শুধু নিদ্রাকেই ডাকি, পাছে আমি
আত্মহত্যা করে ফেলি জাগরণে ক্রুর নিঃসঙ্গতাবোধে।
প্রতিদিন দেখি আমি মনশ্চক্ষে একটি বিজন পথরেখা-
সে পথে আমরা, তুমি আর আমি, হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে
জেনে নিতে চাই প্রকৃতই কতদূর যাওয়া,
সে পথে তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নিরিবিলি
কখনো ফিরিয়ে আনতে চাই মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া
দগ্ধ চিৎকারের মতো আমার আহত, অভিমানী
কবিতাগুলিকে।
এভাবে অনন্তকাল তোমার সঙ্গেই হেঁটে যাওয়া যেতো যদি
দয়ার্দ্রে রোদ্দুরে
প্রজাপতিদের মধ্যে, তবে আমি বিশ্রামের কথা
ভুলে থাকতাম।
প্রতিদিন ধু ধু পথে স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলি, যেন মরুদ্যান।
বারবার আমাদের দু’জনের মধ্যে কবরের মতো কিছু,
বস্তুত কবরই এসে যায়।
‘এ কবর কার? বলে আমরা দু’জন পরস্পর চেয়ে থাকি
কিছুক্ষণ দেখি প্রজাপতি ঘাস ছুঁয়ে
ঝরণার নিকটের উড়ে যায়।
কবরের দীর্ঘ ঘাস আমাকে জড়াতে চায় যত,
তত বেশি ভালো লাগে জীবনের সঙ্গে উন্মুখর গলাগলি
রৌদ্রালোকে নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে।
লোকটা বুড়োই বটে
লোকটা বুড়োই বটে, অতিশয় স্মৃতিভারাতুর।
স্মৃতিমোহে সে একাকী সন্ধ্যায় কবরে দীপ জ্বালে
কোনো কোনো দিন খামখেয়ালের আঁকাবাঁকা খালে
প্রায়শ ভ্রমণ করে কাটে তার বেলা। মদে চুর
(খাঁটি দেশী) প্রতিরাতে, ক্লান্ত মনে তার দেয় হানা
বোমারু বিমান ঝাঁক ঝাঁক, দ্যাখে গ্রামে কি শহরে
লোক মরে লক্ষ লক্ষ, ইউরোপ আর্তনাদ করে
চকচকে হিটলারী বটের তলায়। লাশটানা
গাড়ি খুব এঁটেল কাঁদায় ডুবে যায়। কানে আসে
বন্ধ গ্যাস ঘরে দগ্ধ মানুষের বিকট চিৎকার।
শোনে সে এখনো মরু শেয়ালের হাঁক, পোড়া ঘাসে
বুট ঘষে জেনারেল। ট্যাঙ্ক চলে, ক্ষেত ছারখার।
লোকটা বুড়োই বটে, তবু আজ স্বপ্ন দ্যাখে, সুখে
সে ঘুমায় একা জলপাই বনে তরুণীর বুকে।
লোকটার কাহিনী
একজন লোক, যার চালচুলো নেই, ঝরে গ্যাছে
ফুটো পকেটের বিবর্ণ মানি ব্যাগের মতো যার সংসার
যে স্বপ্নের ভগ্নাংশ কুড়োতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় বারংবার, ট্রাফিক-অরণ্যে পরীর আর্তনাদ
শুনতে শুনতে, পালাতে পালাতে
অবসন্ন সন্ধ্যার ঠোঁটে ওষ্ঠে চেপে কোথাও এক কোণে
ঘুমোতে চায় কিছুক্ষণ।
তার শুকনো মুখে ঝরে স্মৃতির মতো একরাশ পাতা,
হাওয়া এলোমেলো করে দেয় রুক্ষ চুল, কয়েকটি পাখি
ভীষণ হল্লা করে বিকেলকে কাঁপিয়ে ওড়ে দিগ্ধিদিক।
সে হয় অবসাদগ্রস্ত, তার মুখ নিদ্রার স্তনে গচ্ছিত,-
যেন কোনো প্রৌঢ় মণিরত্নের ঠিকরোনো আলোর মতো
ব্যাকুলতায় মুখ ঘষে তন্বী-সত্তায়
এবং তার নিজেকে মনে হয় ভাঙা বাবুই পাখির বাসার মতো।
লোকটা সন্ধ্যাকে সমুদ্র ভেবে ভাসায় নিজস্ব জলযান,
গাভিন গাভির মতো পালে লাগে দিগন্তের ঘ্রাণ, অকস্মাৎ
সে দ্যাখে, গলুইয়ে এক তরুণী, জল-ছুঁই-ছুঁই তার চুল,
মসৃণ, ছন্দিত হাত, চোখে পৌরাণিক সৌন্দর্যের বিস্ময়, দৃষ্টি
তারই দিকে নিবদ্ধ, সে সোনালি বর্শিতে বিদ্ধ।
লোকটা রত্নদ্বীপের জাগরণ অনুভব করে নিজের ভেতরে
আর তন্বীর সামনে নতজান, হয়ে সে বলে-
আমাকে দিয়েছো তুমি নতুনের সাহস, যৌবনের অহংকার।
লোকটার কাহিনী, যদি কাহিনী বলা যায় একে,
এখানে শেষ হলেই ছিল ভালো, মোটামুটি তৃপ্তিকর।
কিন্তু তা হওয়ার নয় কস্মিনকালেও। অন্য পরিণাম
ওঁৎ পেতে আছে তার জন্যে, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে
যে কোনো সময়-
যেমন তার নৌকো হঠাৎ ফুটো হয়ে যাবে
কিংবা সে নিজেই পুড়িয়ে ফেলবে নিজস্ব চন্দ্রোপণ জলযান
অথবা দু’দিকে বিস্মৃত যুগল পথের কোনটিকে
ঠিক পথ ভেবে এগোবে, মনস্থির করতে না পেরে
কেবলি পথের ধারে যাবে আর ফিরে আসবে বারে বারে।
হয়তো সে সারাক্ষণ পার্কের বেঞ্চিতে বসে
আরাধনা করবে নীরবতার
আর সন্ধ্যামালতীর সান্নিধ্যের স্বপ্ন দেখবে ঝিমুতে ঝিমুতে
অথবা বিস্কুট চিবুতে চিবুতে, হয়তো বা মন দেবে
মূলো আর গাজর ফলানোয়, গো-পালনে,
হেঁটে যাবে সর্ষে ক্ষেত্রের ভেতরে, জোনাকিতে ছেয়ে যাবে
সমস্ত শরীর
কোনো কোনো রাতে
কিংবা পতঙ্গরূপে সকাল-সন্ধ্যা উড়ে বেড়াবে ছমছমে
পোড়োবাড়ি আর গোরস্তানে।
কাহিনীর সমাপ্তির তাগিদে।
লোকটার সম্ভাব্য পরিণামের যে কোনো একটি, যার যেমন ইচ্ছে,
বেছে নিতে পারে।
আপত্তি জানানোর জন্যে সে একটা আঙুলও নাড়বে না।
শব্দের সংস্রবে কতকাল
শব্দের সংস্রবে কতকাল কেটে গেছে, মেলামেশা
ভালোবাসাবাসি
হয়েছে শব্দের সঙ্গে বারে বারে। দূর থেকে ওরা কেউ কেউ
বহুক্ষণ আড়চোখে তাকিয়ে থেকেছে, কতদিন কানামাছি
খেলার প্রস্তাব রেখে দিয়েছে সম্পট অকস্মাৎ
আমাকে কিছু না বলে। ধুলো কিংবা মেঘের আড়ালে
দূর দিগন্তের দিকে পলায়নপর
কাউকে কাউকে আমি উপড়ে এনেছি, বলা যায়,
মায়াবী উদ্যান থেকে। কেউ কেউ এমনই নাছোড়,
মধ্যপথে তর্ক জোড়ে, কে কোন পরিধি ভালোবাসে
বিশদ বুঝিয়ে দ্যায় যুক্তি বিশ্লেষণে। আজকাল, হা কপাল,
কোকিলও উকিল হয়ে যায়।
বাঁচাই ভাষার ঝরণাধারা। শত নুড়ি, লতাগুল্ম-রঙধনু,
কখনো বা খরবেগ চোরা টান থাকে, মাধুর্যের উন্মীলন,
বাঘের হুংকার,
নবজাতকের স্পন্দমান বুক অথবা লাশের পাশে প্রহর যাপন,
পুরোনো বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পাওয়া,
মর্চেপড়া চাঁদ,
স্বাস্থ্যেজ্জ্বল শবাগার থাকে ভাষার চঞ্চল ওষ্ঠে।
শব্দের ওপারে গোরখোদক পরখ করে মাটি সন্ধ্যেবেলা,
কুকুর প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে জ্বলজ্বেল চোখে,
একাকী কর্কশ খুনী হাত ধোয় ঝরণাতলে, জননী কন্যায় চুল বাঁধে,
বালক ওড়ায় দ্বিপ্রহরে কত সাবানের রঙিন বুদ্ধুদ,
পড়ার টেবিলে কেউ এলোকেশী মাথা রেখে স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে
শাদা ঘোড়া ছুটে যায় অভ্রের প্রান্তরে,
পায়ে তার সোনার মুকুট,
জলোচ্ছ্বাস,প্রেমিকের মুঠো থেকে প্রেমিকার হাত ছিঁড়ে যায়।
ভোরে অপরাহ্নে, চন্দ্রালোকে
স্মিত ডানা-অলা ডাকপিয়ন দোলনচাঁপা চিঠি তাড়া তাড়া
রেখে আসে লাল বাক্সে, উড়ে উড়ে ফেরে মেঘলোকে,
ভীষণ শুকিয়ে-যাওয়া ইঁদারার মতো কিছু মাঝে মধ্যে হাহাকার করে
আমার ভেতরে।
যদি উচ্চারিত হলে সর্বদা আমার দৃষ্টিপথে
একটি খয়েরী বাড়ি উদ্ভাসিত হয়, গেটে যার যুগল রূপালি ছুরি
ঝোলে সারাক্ষণ।
যখন অথবা বলে কেউ, একটি সুদীর্ঘ পথ, আজোজ্বলা,
মনে পড়ে যায়।
কাগজে আনলে তুলে অন্যমনে ভ্রমণ নামক শব্দটিকে,
আরক্ত কোমল গালে ঝুলে-থাকা কালো চুল, ভেজা চোখ, পুরনো পুকুর,
অশ্চিমে সূর্যের হারাকিরি,
ফসলবিহীন মাঠ ঘেঁষে রেল লাইনের ধারে বহুদূরে
পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, রাজসিক গাছের গুঁড়িয়ে বসে থাকা,
খঞ্জের মোহন যানে চেপে কয়েক মাইল সাবলীল চলে যাওয়া,
হঠাৎ পাখির সম্ভাষণ, মাধুর্যের স্পর্শ-লাগা,
স্মৃতিতে চাঞ্চল্য আনে।
অধিকন্তু মানে রৌদ্রঝলসিত বাবুই পাখির বাসা,
সূর্যের ভেতর পিকাসোর হাত, মেঘদল নেরুদার সঙ্গীতমুখর
পাণ্ডুলিপি, আদিগন্ত চাইকোভস্কির হংসমালা,
পাথুরে বেঞ্চিতে
সেজানের জাগরণ, জ্যোৎস্নালোকে ধাবমান বুনো অশ্বপাল।
হায় মধ্যরাতে ঘুমহীন মুহূর্তের ঝরে-পড়া, বুক-চেরা দীর্ঘশ্বাস,
এমন একটি ঘর যেখানে জ্বলে না আলো অনেক বছর,
তাকে ছেড়ে এসে পুনরায় বড় একা ঘরহীন ঘরে ফেরা।
শহুরে জ্যোৎস্নায়
সেদিন এক ফালি জ্যোৎস্না দেখে চমকে উঠেছিলাম,
যেমন সাপের চকচকে চোখ দেখে পথচারী।
জ্যোৎস্না যে-কোনো স্থানে তন্বীর সুরের মতো গুঞ্জরিত হতে
পারে-
নৈসর্গিক যে কোনো বস্তুতে, যে-কোনো প্রতিষ্ঠানে।
ডিমভরা পাখির বাসায় টলটলে জ্যোৎস্নাঃ শৈশব।
হরিণের পিঠে কিংবা চিতাবাঘের জ্বলজ্বলে চোখে জ্যোৎস্নাঃ
যৌবন।
বারান্দায় হেলান-দিয়ে-থাকা লাঠি আর
পার্কের বিবর্ণ বেঞ্চিতে জ্যোৎস্নাঃ বার্ধক্য।
সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃত্ত এঁকে প্রায়শই জ্যোৎস্নার কথা ভাবি-
কিছু জ্যোৎস্না আমার সঙ্গে পারফিউমের মতো থাকে সর্বক্ষণ
আর এমনও তো হয়, এক টুকরো বখাটে কাগজ
কোত্থেকে উড়ে আসে, কবিতা হয়, জ্যোৎস্না হয়।
আততায়ীর কানপট্রিতে-জ্যোৎস্না ফিক করে হেসে ওঠে।
কখনো রাষ্ট্রদূতের ট্রিম-করা গোঁফে, কখনোবা
বন্দুকের নলে, উদাস প্রান্তরে মৃত সৈনিকের নীল ওষ্ঠে,
শাদা প্রজাপতির মতো বসে থাকে জ্যোৎস্না।
বুনো জ্যোৎস্নায় আমি তাকে কখনো দেখিনি
হয়তো দেখবো না কোনোদিন তার চোখ চন্দ্রালোকে
কীরকম হয়, কীভাবে সে হাঁটে জ্যোৎস্নার ভেতরে
স্বপ্ন-গাঁথা শাড়ি পরে, জানবো না কখনো।
আঁজলাভরা জ্যোৎস্না দিয়ে ওজু করে আমি তাকে আবৃত্তি করি
মধ্যরাতে, সহসা এক পাল ঘোড়া, শহুরে জ্যোৎস্নায়
নাচতে নাচতে
আমার সস্মুখে শুয়ে পড়ে, যেন কিছু গল্প আছে ওদের,
এভাবে তাকায়।
মুহূর্তে লুপ্ত ঘোড়া আর ফুলের তোড়ার ব্যবধান।
চন্দ্রালোকে কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো কখনো পড়িনি,
পড়লো আরো বেশি ভালো লাগতো কী?
গোইয়ার মগজে খুব রাঙা বিপ্লবী পূর্ণিমা ছিল বুঝি!
জ্যোৎস্নায় বিয়াত্রিচে আর সে একই স্বপ্নের একাকার।
শিরোনামহীন
কিছুই পারো না ধরে রাখতে কখনো, ঝরে যায়-
হাত থেকে গোলাপ টগর, চিঠি, ঝুঁটি কাকাতুয়া,
কবিতা লেখার নীল পোয়াতী প্রহর
নিরিবিলি ঝরে যায় শুধু।
এক ডিসেম্বরে পাওয়া নামঙ্কিত আলৌকিক একটি রুমাল
হারিয়ে ফেলেছো তুমি অন্য ডিসেম্বরে।
এমন শিথিল মুঠি যদি, তবে ঘোর অবেলায়
কী করে ধরবে বলো সারবন্দি ঝড়ক্ষুব্ধ খুঁটি?
প্রতিবাদ করবো কি? স্বীকার করাই ভালো, আমি
ব্যর্থতার আতিথ্য গ্রহণ করে অম্ল
ঢেকুর তুলছি ক্রমাগত,
তবু কলমের নিবটিকে সোনারুর মতো খুব ঘঁষে ঘঁষে
একটি নিজস্ব অলংকার বানিয়েছি চমৎকার। বারংবার
হৃদয় কুপিয়ে তুলে আনি গোপন উদ্ভিদ কিছু,
অথচ খরখরে কাগজের কাছে কতবার পরাস্ত এ হাত।
কী এক সময় এল বিশ্বাময়, নির্ভরযোগ্যতা নেই কোথাও কিছুর।
ব্যানারে ফেস্টুনে মিথ্যা চেঁচাচ্ছে মাতাল
আদিবাসীদের মতো। মুদ্রাক্ষর, নাম ধাম লোকালয়, কবির হৃদয়
সবকিছু মিথ্যা, ভয়ানক মিথ্যা মনে হয় আর
অতিশয় ঘৃণ্য ঠেকে বসবাস পৃথিবীতে আজ।
অন্যদের কাছ থেকে, এমনকি নিজের নিকট
থেকেও পালাতে চায় দিগ্ধিদিক দেশে দেশে বিপন্ন মানুষ।
বসে থাকি অস্তরাগে ভীষণ একাকী, চক্ষুদ্বয় নিবু নিবু,
কেমন নিঃস্পন্দ শিরোপুঞ্জ মাঝে-সাঝে অলৌকিক গুঞ্জরণে
নড়ে চড়ে উঠি আর ক্ষণিকের জন্যে তড়াক লাফিয়ে ওঠে
হরিণ শিশুর মতো খুশি।
কখনো আবার বড় লোনা,
খর ঢেউ ভেঙে পড়ে আমার শরীরে
এবং পায়ের নিচে পড়ে থাকে অনেক গাংচিল, ভেজা, মৃত;
ভারি জব্দ করে ক্রুর হিসহিস জলে চাবুক।
ভালোমন্দ কিছু অভিজ্ঞতা আছে আমারও অকূল সমুদ্রের,
আমিও দুলেছি ঢেউশীর্ষে বহুকাল,
দেখেছি দু’চোখ ভরে উথাল পাথাল কত মাছ,
এবং ডাগর চন্দ্রোদয়।
আহারের মতো ছুটে চলেছি সফেদ
প্রাণীটির প্রতি আজো বিরতিহীন।
পরে কোনোদিন তীরে পৌঁছে সঙ্গীহীন ইশমায়েল বলবে
অবসন্ন, সিক্ত স্বরে ট্র্যাজিক কাহিনী আমাদের।
শিল্পের অপচয়
মনে হয়, কতকাল বাইরে যাইনি কতকাল,
যেন হিমযুগে রয়ে গেছি, অন্ধকার বাস করে
দীর্ঘকাল বাস করে, হৃদয় কেমন কৃষ্ণকায়
তুষারের মতো হয়ে গেছে। লতাগুল্ম কিছু নেই
চুতুষ্পার্শ্বে, বুজে থাকা চোখ বড় বেশি ঢাকা রুক্ষ
পাথুরের কণায়, ঘোড়া কোথায় যে উধাও, একটি
শীতল গুহায় আমি ভীষণ আটকা পড়ে গেছি।
আমাকে পাবে কি খুঁজে কখনো উদ্ধারকারী দল?
এখন পাতিনা আর কান কোনো শব্দের উদ্দেশে,
পাছে প্রতারিত হই। হাতে হাত ঘষি বারংবার
জ্বালানিবিহীন, ক্রমাগত নীল-হয়ে-আসা ওষ্ঠে
নাচে স্বপ্ন, নাচে স্মৃতি; জন্ম-জন্মান্তর কম্পমান
দৃষ্টিপথে। যদি কেউ আসে এখানে, দেখবে একা
বিশীর্ণ কংকাল আর দেয়ালে শিল্পের অপচয়।
শুভেচ্ছান্তে
তোমার বয়স কত হলো ঠিক? ঝড়ে-জলে আজ
তেষট্রি পেরুলে বুঝি। আমিও তোমাকে সুপ্রাচীন
ধুমল কাগুজে স্তূপে অতিশয় পরিণামহীন
বিবর্ণ দলিল ভেবে বস্তুত ছিলাম ভুলে। বাজ
পাখি বলে রটেনি তোমার নাম কিংবা অধিরাজ
ছিলে না কখনো কোনো কবিসংঘে। বড় বেশি ক্ষীণ
স্বাস্থ্য আজ; হাঁপানি এবং বাতে কাটে নিশিদিন।
ছিল না তোমার পদ্যে বিশ্ববীক্ষা, সূক্ষ্ম কারুকাজ।
বেঠিক মাটিতে তুমি ছড়িয়েছো বীজ ক্রমাগত
বছর বছর? কিন্তু জানি, কখনো সখনো ভুল
মাটিতেও ফলে কত আশ্চর্য ফসল অবিরত!
যদিও তোমার গোলা শূন্য, তবু রক্তপায়ী মাঠে
স্বেদক্ষরণের কথা ভেবে যেন তোমারই চৌকাঠে
করুন প্রত্যহ পুষ্পবৃষ্টি দয়ালু ফেরেশতাকুল।
শোনো হে
শোনো হে তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল।
এখনো সুস্থির হ’য়ে গুছিয়ে-গাছিয়ে সব সময়মাফিক
কিছুতেই বসতে পারলে না। এখনো হঠাৎ ঢিল
ছুঁড়ে দাও মগডাল, পুকুরের সবুজাভ জল লক্ষ্য করে
কিংবা দাও শিস পথে হেঁটে যেতে ঠিক
চঞ্চল যুবার মতো। এখনো তোমার মৌন রক্তের ভিতরে
এক ঝাঁক পাখি গান গেয়ে ওঠে যখন তখন,
প্রেমিকার খুব কাছে থাকবার জন্যে, কী-যে হয়,
আজো ছোঁক ছোঁক করে মন
এবং তোমার সত্তা জুড়ে নামহীন এক ব্যাকুলতা রয়।
শোনো হে তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল।
একদিন চিঠি বিলি না করলে ডাকপিয়ন, তোমার মধ্যে
জেগে ওঠে ছটফট একটি মানুষ আর এখনো দুয়ারে এঁটে খিল
ঘরময় করো ক্ষিপ্র পায়চারি, শূন্য পাতা পদ্যে
ভরে না উঠলে সুখ সর্বদা তোমার সাথে দেয় আড়ি, তুমি
নিষ্ফল ক্ষেতের মতো পড়ে থাকে একা শুকনো ডাল,
খড়কুটো, মরা শালিখের স্মৃতি নিয়ে। কেমন রহস্যময় জলাভূমি
তোমাকে কেবলি ডাকে, তুমি ফের হয়ে যাও অস্থির, মাতাল।
সন্দেহপ্রবণ নই
এখন নতুন নয় আর আমাদের পরিচয়।
বেশ কিছুদিন, বলা যায়, কী মধুর এক সাথে
কাটিয়েছি আমরা দু’জন কথা বলে কত, হাতে
হাত রেখে, পথ চলে শস্যক্ষেত, সাঁকো, জলাশয়
বনানীর ধার ঘেঁসে। তোমার সান্নিধ্যে প্রতিবার
গিয়েছি, যেমন ছুটে যায় দ্রুতপায়ে একা একা
পুণ্যার্থী তীর্থের দিকে আর যখনই হয়েছে দেখা
তোমার দৃষ্টিতে শূচি হয়েছে তো সমগ্র আমার।
যতই প্রগাঢ় আর দীর্ঘ হোক পরিচয় আমাদের,
যতই বলো না কেন ভালোবাসি তোমাকেই আমি,
তবু এক অস্থিরতা বারে বারে ক্রুর বৃশ্চিকের
মতোন দংশন করে আমাকে এবং অন্তর্যামী
সাক্ষী আমি স্বভাবত সন্দেহপ্রবণ নই মোটে;
তবুও সন্দেহ-কীট তোমার সত্তায় মাথা কোটে।
সময়ের লালা
অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়।
অনেক শতাব্দী অস্তিত্বের শৈলাবাসে ফুলপাতা,
উদাস সুরভি, কিছু ওষুধের চাপা ঘ্রাণ নিয়ে,
পায়ে নিয়ে কম্বলের তাপ,
অনেক শতাব্দী মিশরের সুপ্রাচীন
প্রকোষ্ঠের মতো
মগজের ভেতরে কখনো
অমাবস্যা, কখনো ডাগর
পূণিমা, অদ্ভুত ফ্রেস্কো নিয়ে বসে আছি, মনে হয়।
স্পন্দন আছে কি নেই, বোঝা মুশকিল। অকস্মাৎ
কেমন খটকা লাগে, চোখের পাতা কি জমে যাবে
উত্তুরে হাওয়ায়?
চতুষ্পার্শ্বে কত কিছু খর জলধারার মতোন বয়ে গেছে,
ফেলে গেছে কোনো কোনো চিহ্ন-প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন, আড়ে
সেদিকে তাকিয়ে দেখি সময়ের লালা ঝরে হাসপাতালের
বারান্দায়, করিডোর, ব্যাঙ্ক কাউন্টারে, ভিখিরির
খুব সংকুচিত নগ্ন মধ্যাহ্ন ভোজনে,
মিশকালো আইবুড়ো মেয়েটির শুভ্র প্রার্থনায়,
সময়ের লালা ঝরে বেদেনীর নিতম্বে নিয়ত।
তিনখণ্ড গীতবিতানের ভালোবাসা খরাগ্রস্ত
সত্তাকে লালন করে নিশিদিন। ডাকঘর ডাকে
বেহালার সুরে আমি ছুটে যাই একা, পত্রগুচ্ছ
এখন আমার নামে এসেছে কি আসে নি, ভাবিনা এতটুকু।
তাহলে এ-ও সত্য কবিতা লাফিয়ে উঠে ব্যাপক আঁধারে
চুমু খায় পুলিশের শাদা দস্তানায়
অথবা লেহন করে গণিকার পাইকারী ঊরু?
কবিতা কি তপোজ্জ্বল ওষ্ঠ রাখে মৃতের অধরে?
নাকি বৈদেশিক দূতাবাসে এর ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে
গোলাপের মতো ঝরে যায়
পুরু গালিচায়?
কবিতা কখনো চুপিসাকে ক’ফোঁটা চোখের জল, কিছু ফুল
রেখে আসে মর্গে, পথে পথে ঘোরে, মিশে যায়
শহীদ বেদীর অর্ঘ্যে, মিশে যায় ফেরারীর পায়ের আওয়াজে।
কবিতা কখনো জিরাফের গলা বেয়ে ওঠে, কখনো সুদূর
নীলিমানিমগ্ন তীক্ষ্ম চিলের চোখের
ভেতরে প্রবেশ করে, কখনো বা জাহাজডুবির পরে দ্বীপে
শুয়ে-শুয়ে দ্যাখে শুধু চকচকে মাছের মতোন
জলধোয়া নিজের শরীর,
কখনো বা পিছুটান তার কাছ থেকে টেনে নেয়
কিছু দীর্ঘশ্বাস।
অনেক শতাব্দী ভারি মনোকষ্টে আছি, মনে হয়।
যখন সূর্যাস্ত রাঙা চেলীর মতোন
কোমল ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, আড়াল ছিঁড়ে খুঁড়ে।
জ্বলজ্বলে
একটি মোরগ চায় তার প্রতি আমার কাছে, যেন
জেনে নিতে চায় তার প্রতি আমার প্রকৃত মনোভাব আর
অনেক শতাব্দী কাঁপে ঈষদুষ্ণ মোহন কিরীটে, মনোভূমে
ফিরে আসে হাঁস স্বপ্নছায়া নিয়ে মেঘার্দ্র ডানায়।
পারস্পর্যহীন সব বলে আমি দিনরাত্রি মনোকষ্টে থাকি।
অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়।
আমার ওপর অবিরল সময়ের লালা।
হঠাৎ কবিতা এসে বসে খুব কাছে, হাত ধরে বলে-চলো,
খানিক বেড়িয়ে আসি, যেখানে তোমার খুশি, ওঠো,
খামোকা কোরো না দেরী, খুঁজো না টিফিন ক্যারিয়ার
কিংবা ক্লাস্ক, স্যুটকেশ হোল্ডল ইত্যাদি থাক, বাস ছেড়ে দেবে।
সে একলা হাঁটে
সে একলা হাঁটে, হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে যোজন যোজন দূরে।
ফুটপাত, আইল্যান্ড, দালানের ভিড়, ফ্ল্যাটরাজি,
অজস্র দোকানপাটি ছেড়ে সে একলা হাঁটে, যায়
প্রান্তরের কাছে,
নদীর কিনারে।
পানির গভীরে চোখে মেলে কী-যে খোঁজে সূর্যাস্তের
রঙের আড়ালে, কম্পমান নৌকোগুলি বুঝি তার
স্মৃতির নিঝুম খাল বেয়ে সদ্য এসেছে এখানে।
তার হাতে বাদ্যযন্ত্র নেই কোনো, তবু তার কাছ থেকে সুর
ভেসে আসে, বুঝি রিস্টওয়াচের থেকে বংশীধ্বনি সৃষ্টি হয়,
না কি তার তন্দুরের মতো লাল চোখ থেকে, হৃৎপিণ্ডের থেকে?
যখন সে পেয়ালায় ওষ্ঠ রাখে, পেয়ালা উপচে পড়ে সুর,
আবার কখনো বুক জমে যায় পাথরের মতো, উদাসীন
প্রাণের সকল তন্ত্রী, সংগীত ও ভীষণ ক্রূর মূক হতে পারে।
মাঝে-মাঝে তাকে
সরাইখানার আলো, ম্যান্ডোলিন পারে না থামাতে, সবকিছু
ছেড়ে ছুড়ে সে একলা হাঁটে। দ্যাখে স্বপ্নের রঙের মতো গাভি
ওড়ে পূর্ণিমায় আর কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে
পথপ্রান্তের, কেউ কেউ দোলনায় দুলে দুলে করছে বিলাপ।
মেঘে মেঘে মেহগনি কফিনের মিছিল এবং
সিংহের খণ্ডিতে মাথা, এক গুচ্ছ সোনালি চাবির ঐকতান,
এনামেল-রঙ দেবদূত।
মাথার ভেতরে তার বাবুই পাখির তছনছ বাসা, কালো
পেন্সিলের আঁকাবাঁকা রেখার মতোন পিঁপড়ে-সারি,
ছিন্নভিন্ন একরাশ ভ্রমণ কোমল, কিছু দুর্গের প্রাকার-
দু’তিন শতাব্দী তার মাথার ভেতরে খেলে যায়।
সন্দেহপ্রবণ তার প্রতি অনেকেই এমন কি কৃষ্ণচূড়া
কোকিল, পাহাড়ি ঝরণা তাকে কতিশয় ঘাঘু এক
গোয়েন্দা ঠাউরে নেয়। সে একলা হাঁটে, কখনো বা
দুপুর সাঁতরে এসে বিকেলের ঘাটে বসে চুপে
ঘাসের ওপরে ঝুঁকে গোপন রিপোর্ট লেখে কিছু
খরগোশ, কোকিল আর রজনীগন্ধার, কেউ কেউ
দু’পাশে মার্জিনে পায় ঠাই।
অকস্মাৎ ফিরে আসে মানুষের ভিড়ে একা-একা।
যদি কেউ কোনো প্রশ্ন করে তাকে, তবে সে নীরবই
থাকে বেশি, মাথা নাড়ে মাঝে-মধ্যে, আবার কখনো
ইচ্ছে হ’লে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলে উত্তরের দায় সারে।
যখন সবাই থাকে চুপচাপ, তখন হঠাৎ তারস্বরে
আকাশ ফাটিয়ে
একাকী সে লোক সহস্র জনের মতো-আজ
আমরা সর্বস্ব দিয়ে কিনেছি এ কোন
সোনালি সাপের মতো পণ্য ভয়ংকর?
সে একলা হাঁটে। ফিরে গেলে গৃহকোণে, প্রভুভক্ত
বয়েসী কুকুর তাকে শুঁকবে কি পুরোনো স্মৃতির মতো আজ
এতকাল পরে?
কোনো সঙ্গী নেই পাশে। কেউ চোরাবালি, কেউ ধুধু
প্রান্তরে অথবা দৈত্যকবলিত গুহায়, কেউ বা সমুদ্রে চিরলীন।
সে একলা হাঁটে। হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে, বুঝি কেউ তার
প্রতীক্ষায় আছে চুল খুলে আর ওঁৎ পেতে আছে প্রতিদ্বন্দ্বী
থামের আড়ালে বহুজন।
সেই কবেকার ঋণ
এখন একটি নয়, দু’টি নয়, তিনটিও নয়, একপাল
চিত্রল হরিণ আসে শহরের অখ্যাত গলিতে,
আসে সাবলীলভাবে। বনবাসকালীন বন্যতা
এখনো যায়নি মুছে, ইট পাথরের কাছে যেন
ভয় করবার কিছু নেই, যেন ওদের আহত করবে না
কোনো অস্ত্র, পড়বে না মোটরকারের নিচে কিংবা
বাজারে দেবে না বেচে কেউ শস্তা দামে। আস্তে সুস্থে
ওর এই ছায়াচ্ছন্ন গলিতে প্রবেশ করে আর
আমার বাড়িকে ঝিল ভেবে বিশ্রামের প্রত্যাশায়
উঠোনে ঘাসের মতো স্বপ্ন ডোবে। এইসব প্রাণী
কী করে এখানে এল, এই প্রশ্ন আমাকে কেবলি
ঠোকরাতে থাকে, অকস্মাৎ স্তব্ধ তার মধ্য থেকে
ছন্দিত গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আসে একটি হরিণ-
বলে, ‘শুধে দিতে চাই আজ সেই কবেকার ঋণ।
সোনালি পাখি, নীলিমা এবং একজন
এখনো সে নীলিমায়, একটি সোনালি পাখি খুব
উঁচুতে এখনো
গড়ছে নানান বৃত্ত, কান্তি তার অম্লান, অথচ
মোহন ডানায় তার কিছু ক্লান্তি তুষারের মতো
জমছে নিয়ত, মৃত্যুভয় অমাবস্যা হয়ে তাকে
তুমুল ফেলবে ঢেকে, মনে হয়। কখন সে মুখ
থুবড়ে পড়বে রুক্ষ ধূলায়, নিঃস্পন্দ হবে, তারই
প্রতীক্ষায় আছে অনেকেই
সেই কবে থেকে।
‘হবে না উড়তে আর নীলিমায়’, বলে কেউ কেউ,
কেউ ফের দোকানের দড়ির আগুন থেকে শস্তা
সিগারেট ধরাতে ধরাতে
স্বগতে ভাষণে মাতে-উজ্জ্বল ডানায় ওর মৃত্যু
চুমু খাচ্ছে ক্রমাগত; খাক, পড়ুক সে রাজপথে
অথবা গলির মোড়ে, কাকপক্ষী ওকে ঠুকরে ঠুকরে
করুক নাকাল।
প্রায় সকলেই
উড়ন্ত সোনালি পাখিটাকে দূরে নীলিমার থেকে
তাড়াতাড়ি পেড়ে ফেলে মোচ্ছবে ভাসতে চায় গহন দুপুরে।
আহত সোনালি পাখি মাটির ঢেলার মতো দ্রুত
পড়ে না ধূলায়। উড়ে যায় বহুদূরে মেঘের ভেতরে একা
কী তেজস্বী ভঙ্গিমায়, যেন অভিষেক হবে তার
অনেক উঁচুতে ঐ নীলিমার রাজ্যে।
কৌতুহলী লোকদল মুখ
অন্ধকার করে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে হতাশায়।
শুধু একজন পোড়খাওয়া অপমানিত মানুষ
সোনালি পাখিকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সটান
হেঁটে যায়, মনে হয় তার
নিজের বেঢপ মাথা পৌঁছে, গেছে নীলিমায়।
হৃদয়ের চোখে জলধারা দেখে
আমি কি থাকবো পড়ে লোকালয় থেকে দূরে এমন একাকী?
বহুদিন তুমি চোখ তুলে দ্যাখোনি আমাকে, বহুদিন
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি আঙুলের ডগায় নাচিয়ে
দিয়েছো হেলায় ছুঁড়ে। আমি অভিমানে
নিশ্চুপ গিয়েছি চলে নিজের নৈঃসঙ্গ্যে পুনর্বার,
তোমার সান্নিধ্য থেকে দূরে যেতে শ্বাসকষ্ট হয়
জেনেও নিভিয়ে আলো হৃদয়ের অন্ধকার দীপের মতোই
ভেসে গেছি খরস্রোতে, ঝড়বাদলের প্রতি বড় উদাসীন।
এখানে একাকী পড়ে আছি কতকাল
আমার শরীরের লতাগুল্ম
গজিয়েছে ক্রমান্বয়ে, পোকামাকড়ের আনাগোনা
চতুর্দিকে, মনে হয় উঠে আর দাঁড়াবো না পায়ের ওপরে
কোনোদিন, তুমি
এসে দেখে যাও একজন মানুষের
ভীষণ অনুপস্থিতি অন্যজন নিজের সত্তায় কী রকম
বোধ করে, কী রকম মনে হয় জীবনযাপন।
একটি চুম্বন আমি তোমার নিকট বারংবার
প্রার্থনা করতে গিয়ে দেখেছি আমাকে দুঃখ তীব্র
চুমু খায় প্রতিবার আর
যখনই তোমাকে বুকে নিয়ে স্বর্গসুখ
নিরিবিলি পেতে চাই, তখনই শূন্যতা নরখাদকের মতো
আমাকে কেবলি গিলে খায় এবং আমাকে ঘেঁষে
হাঁটে দূর শতাব্দীর কতিপয় বেনামি কংকাল প্রেমিকের।
তোমার চুম্বন জানি ঝরে যাবে ভিন্ন ওষ্ঠে সকল ঋতুতে;
হয়তো সে বীতপ্রেম চুম্বনকালীন দৃশ্যে একটি রঙিন
পায়ের আঙুলে
কিংবা উন্মোচিত স্তনে, তাকে তুমি দিওনা উড়িয়ে
কখনো বিরক্তি ভরে-সে আমার আরম্ভ বাসনা।
নিজের ভেতরে আমি বাজি, যেন করুণ বেহালা,
কী এক ক্ষুধায় নিজেকেই প্রতিদিন
করছি আহার
গাছের প্রতিটি পাতা ছিঁড়ে এনে পত্র লিখি, হটাৎ আবার
কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলি সব। মাঝ-মধ্যে মনে হয়
তুমিহীনতায় ভয়ানক সেলে আছি, যাচ্ছি ক্ষয়ে ক্রমাগত।
যদি তুমি দূর থেকে বলো,
‘এখনো লোকটা এত দুঃখে ডুবে আছে?’-
তাহলে আমার অহংকার
প্রবল জাগিয়ে
আমি নিরুত্তর সেলে মাথা রেখে
দুঃখের অধরে চুমু খেয়ে, হৃদয়ের চোখের জলধারা দেখে
খর বিবেকের শরশয্যায় থাকবো শুয়ে একা।