টানাপোড়েন
মনে কি পড়ে নিঝুম কুয়োতলা,
গাছগাছালি, রাস্তা জমকালো,
মস্ত মাঠ, দেয়াল, ঘর-বাড়ি,
বকুলতলা শ্লোগানে চমকালো?
সে কবে থেকে বেকার কারিগর;
গ্রাম্যজন শহরে রাখে চোখ।
ভিক্ষা থেকে পালাতে চেয়ে ওরা
ভাগ্যদোষে মড়কে পায় শোক।
সারাটা দিন চাকুরে কেউ কেউ
তুই তোকারি করেন ঘরে বসে,
কালচারের সোনালি গালিচার
সূক্ষ্ম রোঁয়া তোলেন ঘষে ঘসে।
মফস্বলী মোড়ল চায়না তো
মেলুক দল বিশ্ব ঘরে ঘরে।
সমুদ্রের ধারে না কোনো ধার,
মজা নৌকো ভেড়ায় ধু-ধু চরে।
দেখছি তুমি মেঘনা খোঁপা বাঁধো,
গাইছো বসে কতকালের গান।
চিরুনি কোলে স্বপ্নাহত বুঝি-
আকাশে ভাসে চাঁদের শাম্পান।
দাঁড়াও যবে সরু বারান্দায়,
বাহু তোমার দিনকে করে মাৎ।
যুগল টিলা অস্তরাগে লাল,
হঠাৎ চোখে জানায় দাবি রাত।
তোমার ছবি রাত্রি রাখে বুকে,
স্বপ্ন-ঘোড়া মগজ জুড়ে ছোটে।
তোমার ছবি নদীতে মাঠে মেশে,
ফুল্ল চোখ নীল পদ্মে ফোটে।
অন্ধকারে হয়তো ভয় লাগে,
ঝিঁঝির সুর লেপ্টে থাকে মুখে।
দোরগোড়াতে ছায়ার ওঁৎ পাতা,
মূক দেয়াল কপাল দিলো ঠুকে।
রোজ সকালে জাগে শহরতলী,
বাতাসে কাঁপে কচি পিয়াল পাতা।
চোরা গলিতে হাঁটছে একা লোক,
স্বপ্ন তার আগামীকালে গাঁথা।
নব্য যুবা নিত্য বলে শুনি
বোধি দীপ্ত জীবন-ঘন ভাষা।
অবাক হয়ে ভাবেন পিতামহ
পুরোনো ঘরে এ কার যাওয়া-আসা?
মনে কি পড়ে নিঝুম কুয়োতলা,
গাছগাছালি রাস্তা জমকালো,
মস্ত মাঠ, দেয়াল, ঘর বাড়ি,
বকুলতলা শ্লোগানে চমকালো?
টেলেমেকাস
তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়
কখনো তোমার মুখ হবে না নাকি উদ্ভাসিত, পিতা,
পুনর্বার? কেন আজো শুনি নি তোমার পদধ্বনি?
এদিকে প্রাকারে জমে শ্যাওলার মেঘ, আগাছার
দৌরাত্ম্য বাগানে বাড়ে প্রতিদিন। সওয়ারবিহীন
ঘোড়াগুলো আস্তাবলে ভীষণ ঝিমোয়, কুকুরটা
অলিন্দে বেড়ায় শুঁকে কতো কী-যে, বলে না কিছুই।
নয়কো নগণ্য দ্বীপ সুজলা সুফলা শস্যশ্যাম
ইথাকার আমার ধনধান্যে পুষ্পেভরা। পিতা, তুমি
যেদিন স্বদেশ ছেড়ে হলে পরবাসী, ভ্রাম্যমাণ,
সেদিন থেকেই জানি ইথাকা নিষ্পত্র, যেন এক
বিবর্ণ গোলাপ। আমি একা কৈশোরের জ্বলজ্বলে
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কোন্ কাক-তাড়ুয়ার মূর্তি দেখে
ভুলে গেছি হাসি। ‘কেন আপনার ঠোঁটের দিগন্তে
হাসির হরিণ-শিশু পালিয়ে বেড়ায় অবিরত?’-
কখনো করেন প্রশ্ন ধীমান প্রবীণ সভাসদ।
বিদেশীরা রাত্রিদিন করে গোল ইথাকায়; কেউ
সযত্নে পরখ করে বর্শার ফলার ধার, শূন্য
মদের রঙিন পাত্র ছুঁড়ে ফেলে কেউ, লাথি ছোঁড়ে,
কেউ বা উত্যক্ত করে পরিচারিকাকে। মাঝে-মাঝে
কেবলি বাড়ায় হাত প্রোষিতভর্তৃকা জননীর
দিকে, যিনি কী-একটা বুনছেন সুচারু কাপড়ে
দিনে, রাতে খুলছেন সীবনীর শিল্পে। কোলে তাঁর
সুতোর বলের সাথে খেলা করে মোহন অতীত।
লুকিয়ে কাঁদেন তিনি ছড়িয়ে জলজ দৃষ্টি ধু-ধু
সমুদ্রের প্রতি, কালো বেড়ালের মতো নিঃসঙ্গতা
তাঁর শয্যা, অস্থিমজ্জা জুড়ে রয় আজো সর্বক্ষণ।
সবুজ শ্যাওলা-ঢাকা পুকুরেও ছুঁড়ে দিলে ঢিল,
সেখানে চকিতে ওঠে ঢেউ আর বাতাসের ডাকে
এমন কি পত্রহীন গাছও দেয় সাড়া, কিন্তু এই
আমার মুখের রেখা সর্বদাই নির্বিকার, তাই
পালিয়ে বেড়াই ভয়ে, পাছে কেউ জনসমাবেশে
পৌরপথে নানাবিধ প্রশ্নের পেরেক ঠুকে ঠুকে
আমাকে রক্তাক্ত করে। জানি, এ বয়সে প্রাণ খুলে
হাসাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ঘরে শক্র নিয়ে মুখে
হাসির গোলাপ-কুঁড়ি ফোটানো কঠিন। নানা জন
রটায় নানান কথা শুনি, তুমি নাকি মৃত, তুমি
সার্সির সবুজ চুলে বাঁধা পড়ে আছো, বলে কেউ।
কূলে একা বসে থাকি, কোথায় ভরসা? ঘুরে ঘুরে
প্রতিদিন ফিরে আসি অলক্ষ্যে বাড়ির সীমানায়;
দাঁড়াই যেখানে সিঁড়ি শব্দ করে জানায় চকিতে
এখন বয়স কতো বাড়িটার আর আমি নিজে
আনাচে কানাচে ঘুরি, নিরালম্ব, বিদেশীর মতো।
মনে হয়, ক্রমাগত সশব্দে আমাকে দিচ্ছে কারা
কবরে নামিয়ে শুধু; পাগুলো মাটিতে লেগে লেগে
কেমন নির্বোধ হয়ে রয়েছে তাকিয়ে, যেন ওরা
পৃথিবীতে বাস্তবিক হাঁটতে শেখেনি কোনোদিন।
তুমি নেই তাই বর্বরের দল করেছে দখল
বাসগৃহ আমাদের। কেউ পদাঘাত করে, কেউ
নিমেষে হটিয়ে দেয় কনুই-এর গুতোয় আবার
‘দুধ খাও গে হে খুকুমণি’ বলে কেউ তালেবর
দাড়িতে বুলোয় হাত। পিপে পিপে মদ শেষ, কতো
ঝলসানো মেষ আর শুয়োর কাবার, প্রতিদিন
ভাঁড়ারে পড়ছে টান। থমথমে আকামের মতো
সমস্ত ইথাকা, গরগরে জনগণ প্রতিষ্ঠিত
অনাচার, অজাচার ইত্যাদির চায় প্রতিকার।
আমিও বাঁচতে চাই, চাই পড়ো-পড়ো বাড়িটাকে
আবার করাতে দাঁড়। বাগানের আগাছা নিড়ানো
তবে কি আমারই কাজ? বুঝি তাই ঋতুতে ঋতুতে
সাহস সঞ্চয় করি এবং জীবন তুরঙ্গের
বর্ণিল লাগাম ধরে থাকি দৃঢ় দশটি আঙুলে।
কখনো এড়িয়ে দৃষ্টি ছুটে যাই অস্ত্রাগারে, ভাবি
লম্পট জোচ্চোর আর ঘাতকের বীভৎস তাণ্ডব
কবে হবে শেষ? সূর্যগ্রহণের প্রহর কাটবে
কবে? জননীর মতো চোখ রাখি সমুদ্রে সর্বদা।
ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে
দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।
এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার
বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ
আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার?