ক্ষয়কাশ
কে যেন উঠলো কেশে কলোনির ফ্ল্যাটে খক্খকিয়ে,
যে মোটর কিছুতে নেয়না স্টার্ট ঠিক তারই মতো
শব্দ করে ঠাণ্ডা রাতে কাশছে লোকটা অবিরত।
গলিপথে অন্য কেউ কেশে ওঠে, প্রাণক্ষয়ী কাশ-
পাশের দালানে কেউ, কেউ বা মাটির ভাঙা ঘরে
বস্তিতে বাজারে আর অভিজাত পাড়ার অন্দরে,
ভয়াবহ শব্দে সেই ছেয়ে গেল সমস্ত আকাশ।
ন্যুনতম নব্বুই হাজার বাসগৃহে নিদ্রাহর
শব্দের ধমকে নড়ে সংখ্যাহীন বুকের পাঁজর
এবং আমার বুক পূর্ব বাংলার মতোই হু হু, তীব্রতর
কাশির দমকে বড্ড দুমড়ে যাই, কুঞ্চিত চাদর
গোধূলি-তরল রক্তে বারংবার ওঠে ঝক্ঝকিয়ে।
কয়েকটি স্বর
“দ্যাখো হে খুলিটা দ্যাখো ভালো করে কেমন সাত্ত্বিক
শূন্যতায় স্থির থাকে, চার ঘণ্টা সাতাশ মিনিটে
সযত্নে তুলেছো খুঁড়ে যাকে”-বলে সে প্রত্নতাত্তিক
তৃতীয় চুরুট জ্বেলে প্রান্তরের বিশুষ্ক গ্রানিটে
রাখেন অভিজ্ঞ হাত। মহাব্যস্ত মেঘের ট্রাফিক
আকাশের মোড়ে মোড়ে, পলায়নপর চুলে হাওয়া
হানা দেয় অবিরত। হঠাৎ মড়ার খুলি ফিক
করে উঠলো কি হেসে? ভৌতিক স্তব্ধতা ছাওয়া
প্রান্তরে অতীত ওঠে জেগে অলৌকিক কোলাহলে?
আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ বর্জইস অক্ষরের মতো
ভিড় করে, রাত্রি বাড়ে, মরা জ্যোৎস্নায় চুরুট জ্বলে।
এসো যাই, তাঁবুর ভিতরে যাই এবং বিগত
শতাব্দীর শোকসভা করে তার নিপুণ বর্ণনা
লিখে রাখি কল্পনা মিশিয়ে কিছু প্রাচীন তুলটে।
ইতিহাস অধিক বাচাল হলে নিত্য আবর্জনা
জড়ো হয় পৃথিবীতে, প্রত্যহ অনেক ফুল ওঠে,
ভীষণ বিষিয়ে ওঠে সময়ের তলপেটে। হায়,
জ্ঞানপাপী অবেলায় আত্মা নিয়ে লোফালুফি খেলে,
অগোচরে জীবনের শুকনো বাতিল বাতাসে ওড়ায়।
প্রত্নতত্ত্বে প্রীত বলে আমিও কি ভীষণ সেকেলে?
“সময়ের চতুরালি জেনেছি আমিও, তবু নিজে
দিয়েছি বাড়িয়ে গলা কুহকের ফাঁদে। চিরকাল
ক্রমাগত ঘুরবো কি অতীতের মায়াবী ট্রাপিজে?
যতদিন যায় তত শূন্যতায় কাটে শুধু কাল।
“দুরূহ পুস্তক পাঠে আনন্দ পেয়েছি, আরো পাবো-
বেহালার ছড় টেনে, ছাই ঝেড়ে ঝেড়ে শুতে যাবো”।
(কোরাস)
বিষাদের গাথা করে অবিরাম
চেতনাকে মন্থন।
অন্ধকারের রিক্ত থাবায়
কাঁপছে চিরন্তন।
কাকতাড়ুয়ার মূর্তি হঠাৎ
ত্রাস করে সঞ্চার।
করোটি মালার শংকা গ্রথিত
নরক সে কোন্ ছার?
অসার রিক্ত, মৃত্যু সদাই
জীবনের বল্লভ।
ঘৃণার আগুনে পুড়েও পোড়ে না
জলপাই পল্লব।
(করোটির স্বগতোক্তি)
আমিও ছিলাম এই পৃথিবীতে, আনুগত্যে প্রিয়
নাচের মুদ্রার মতো ফুটিয়েছিলাম জীবনকে
কতদিন। সৌন্দর্য নশ্বর নয় ভেবে মহিলাকে
করেছি উৎসর্গ প্রেম, নিজেকে ছুঁড়েছি নীলিমায়,
অধীর তৃষ্ণায় পান করেছি সত্তার সারাৎসার।
জনতা-জটিল সেই নগরের মোড়ে দেখি চেয়ে
আমার প্রিয়া মাথা কেটে ফেলে কৃষ্ণ হন্তারক
কুঠারের ক্ষিপ্র ঘায়ে। রক্তে পিতৃপুরুষের ক্রোধ
ফুঁসে ওঠে অকস্মাৎ, কিন্তু তবু স্তম্ভের মতোই
নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকি, অসহায়। এবং তখন
অন্ধকারে ঈশ্বরকে খুঁজি একা দীর্ণ প্রার্থনায়।
যৌবনের উজ্জ্বল চীৎকারে মেতে উঠে রাজহাঁস
বুকে চেপে পৃথিবীর রূপ থেকে একদণ্ড, হায়,
ফেরাতে পারি নি চোখ। পৃথিবীকে ভালোবেসে তবু
আমাকেও যেতে হলো অবশেষে মৃতদের দেশে।
তোমরা তুলবে খুঁড়ে হয়তো মড়ার খুলি আরো,
তাম্রলিপি, মাটির প্রাচীন পাত্র, হাতির দাঁতের
চিরুনি অথবা কোনো নগ্ন দেবতার ভাঙা মূর্তি;
হয়তো তুলবে খুঁড়ে অতীতের খণ্ড খণ্ড শব।
যে যন্ত্রনা জীবনকে দিয়েছিল কর্কশ লবণ
ঘটনার ঘোলাজলে, আমি তার স্বাদে দ্বিধান্বিত
সত্তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেছি বিলুপ্তির দিকে।
আমার উদ্ধার লুপ্ত চিরতরে, শুধু শূন্যতায়
শুদ্ধাচারী স্মৃতি কাঁপে। স্মরণীয় যুগের মহিমা
জেনেও নিশ্চিত আমি চিরকাল স্বরহীন রবো।
(কোরাস)
সুন্দর তারা ছিল বুঝি কোনোদিন,
আজ কুৎসিত কাকতাড়ুয়ার ছবি।
হায়, মালী তোর বাগানের সব ফুল
বিবর্ণ হবে, নষ্ট হবে যে সবি।
অনেক যুগের স্মৃতির জটিল সিঁড়ি
গান গেয়ে ওঠে আলো-আঁধারির সুরে,
ধ্বংসের কীট বস্তুপুঞ্জে বসে
স্বপ্নের ফল খায় শুধু কুরে কুরে।
পিতৃপুরুষ স্বপ্নের নীলমণি
রেখেছিলেন যে সমাহিত সিন্দুকে,
বৈভব তার কিছুটা দিয়েছে মুছে
বিশ্বের যতো বাছা-বাছা নিন্দুকে!
গ্রীষ্মে তার নিজের কথা
ক’দিন থেকে শহর বদরাগী
ড্রাগন যেন, দুপুর হলে চড়া
হাওয়ায় ছোঁড়ে হল্কা আগুনের।
সত্তাময় দারুণ ধু-ধু খরা।
পাখার ব্লেড ঘুরছে অবিরত,
মধ্যদিনে গায় না গান পাখি?
নেইকো ক্ষতি, রোডিয়োগ্রাম খোলা-
ডিভানে শুয়ে ফিল্মী সুর চাখি।
এ গরমের তাল পাকানো রীতি,
দুপুর বেলা বাইরে যাওয়া দায়।
রাস্তাগুলো তপ্ত তাওয়া যেন,
শহর রোদে হাঁপায় অসহায়।
ভাগ্যে ছিল তেজারতির টাকা
পুণ্যবান পিতৃপুরুষের।
খাচ্ছি তাই অনেক ছলেবলে
আদর আজো সুখের বুরুশের!
বেকার নেই, আমারও আছে কাজ,
কালো বাজারে তাল বেতাল আমি।
চাঁইয়ের সাথে নিত্য ওঠা বসা,
ভাগ্য তাই আমার অনুগামী।
এমন দিনে হেঁসেলে বসে তুমি
ছ্যাঁচড়া রাঁধো, কাপড় কাচো ক্ষারে।
স্বপ্ন কিছু গিয়েছে মারা মাঠে,
যৌবন তো পালায় চুপিসারে।
মেঘলা মুখ? বলোতো আজ কেবা
তোমার মান করবে ভঞ্জন?
ঠাণ্ডা ঘরে নীহার বাবু আজো
আমার মন করেন রঞ্জন।
অনেক উঁচু তলায় আমি থাকি,
শুনিনা তাই বামন দিলে হাঁক।
কী করে আজ পশবে কানে বলো
তোমার সেই কান্না-ভেজা ডাক?