কিশোররূপে একজন কবির প্রতিকৃতি
ভোরবেলায় পায়ে পায়ে পান্না-ছড়ানো শিউলিতলার কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
ভোর-ছোঁওয়া সেই শিউলিতলায় হঠাৎ একটা সাপ দেখে তুমি চম্কে
উঠেছিলে, দাঁড়িয়েছিলে অনেকক্ষণ। তোমাকে বিপন্ন জেনেও
ফিরে গেল সে তার গর্তে, যেমন কোনো সুন্দরীর
আঙুল অনায়াসে প্রবেশ করে দস্তানায়। ভোরবেলায়
শিউলিতলায় সাপের সম্মোহনে দাঁড়িয়ে-থাকা কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
ঝাঁক ঝাঁক পাখির পাখা ঝলসানির মতো হাসি
ভালোবাসতে তুমি। রঙ-বেরঙের পাখি ভালোবাসতে শিখেছিলে
অনেক আগেই। দেখেছি কতদিন ওদের নানা নাম ধরে
ডেকে ডেকে হারিয়ে গেছ ডাগর জ্যোৎস্নায়।
পাখির ঝাঁকের পেছনে ছুটতে ছুটতে ডাগর জ্যোৎস্নায়
হারিয়ে-যাওয়া কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
গলির মোড়ে হুমড়ি-খাওয়া ঘোড়াটাকে দেখে তোমার বুক
কেঁপে উঠেছিল। তুমি দেখলে, ঘোড়ার পায়ে একটা ক্ষত
ধ্বক্ করে জ্বলে উঠলো বালবের মতো আর সেই মুহূর্তে
ঘোড়ার চোখে অন্য কিছু নয়, শুধু গোধূলি, শুধু অস্তরাগ!
গলির মোড়ে মুমূর্ষ ঘোড়ার শোকে বিহ্বল কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
দ্রুত পথ হাঁটতে গিয়ে কতদিন একটা টক টক গন্ধে উন্মন হয়ে
দেখেছ পথের পাশে হতচ্ছাড়া কোনো দোকানে
তন্দুরের ভেতর বিস্কৃটগুলো একরাশ তারার মতো
জ্বল জ্বল করছে। পথের পাশে বিস্কৃটের টক টক গন্ধে উন্ম কিশোর
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
ঘোর বর্ষায় হাতলে ঝুলতে প্রকাণ্ড প্রত্যাশায়
পাড়ি জমিয়েছিলে কোনো শ্যামল পাড়ায়। মধ্যে-মধ্যে
বনোয়ারী দিনে রাধার হাসির মতো বিদ্যুৎ উঠতো ঝল্সে। বেওয়ারিশ
ভাবনার মালিকানা কারুর একার নয়’ বলে যে লোকটা
বেঠিক স্টপেজে পৌঁছে টলতে টলতে সংক্ষিপ্ত গলির মোড়ে
বাকাট্রা ঘুড়ির মতো লাপাত্তা, তার দিকে দৃষ্টি মেলে-
ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই, ভরা বাসে সামলে থাকুন, নয়তো
পা হড়কে যাবেন পড়ে বলে যে কন্ডাক্টর আউড়ে গেল
কিছু অলৌকিক নাম-তার দিকে চেয়ে তুমি স্বপ্নের স্বত্বের কথা
ভাবছিলে। বাসের হাতলে ঝুলতে ঝুলতে স্বপ্নের স্বত্ব বিষয়ক চিন্তায়
মগ্ন কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
একজন তন্বী বেদেনী বহ্নির মতো কিছু তীব্রতা ছড়িয়ে চলে গেল
চাঁদের তোরণ পেরিয়ে আর তার প্রস্থান
তোমার শিরায় অজস্র জরির চিতাগ্নি জ্বেলে দিয়েছিল, তুমি
একা দাঁড়িয়ে পুড়ে যাচ্ছিলে। সেই প্রাক্তন চিন্তাগ্নিতে
প্রজ্জ্বলন্ত লালচে গালের কিশোর,
প্রাণপণে তোমাকে ডাকি, তুমি সাড়া দিলে না।
কেন্নো, কেঁচো নই
কেন্নো কেঁচো নই, গর্ত খুড়ে খুড়ে
মৃত্তিকার নিচে করবো বসবাস।
নই যে পাখি কোনো মেঘের আবডালে।
লুকোবা উড্ডীন ডানার ব্যাকুলতা,
বাদুড় নই শুধু চাইবো কালো রাত।
কাঁকড়া নই যাবো অতল পাতালেই;
মানুষ আমি মেদ মজ্জা মাংসের,
তাইতো তোমাকেই এখনো পাশে চাই।
কোনো সাইকেলচারীর উপাখ্যান
আমার জীবন ভাবো একবার। বস্তুত উড়নচণ্ডী আমি
চিরকেলে, সাইকেলে ঘুরে ঘুরে দিন যায়। অলিতে-গলিতে,
সদর রাস্তায় কিংবা মাংসের বাজার ঘেঁষে বিপণি তল্লাটে
চমৎকার তামাকের, সবুজ ঘ্রাণ শুঁকে দিন যায়।
কখনো রৌদ্রের নিরালায়,
কখনো-বা বৃষ্টি-ভেজা চুপসোনো, ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় ছুটে চলি
বাজিয়ে মধুর ঘণ্টা চারদিকে। কতো কাঁটাবন,
বহুবর্ণ কতো গুল্মচ্ছাদিত পথের ধারে সাইকেলটাকে
মাঝে-মাঝে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিই আপিলা চাপিলা শৈশবের
প্রচণ্ড আহ্বানে।
ক্রিং ক্রিং ধ্বনি শুনে এইতো আমার পকেটস্থ শহরের
হাজার জানালা দেখি ম্যাজিশিয়ানের
রঙিন তাসের মতো ওঠে দুলে। সাইকেল চালাতে চালাতে
দ্বিপ্রহরে কানে আসে বিপন্ন চীৎকার রাস্তা ছেড়ে,
দু’দশটা বাড়ি ছুঁয়ে মেঘে গেল দূরে
মেঘে গেল আর্তস্বর। ধাঁ করে উধাও ট্রাক, বালকের কোমল শরীর
ছিন্নভিন্ন গুল্মলতা, কাকের কর্কশ ডাক থ্যাৎলানো মাংসের
দলাকে করলো বিদ্ধ, আমাকেও। মনে হলো, অবসিত বালককে আমি সাইকেলে
বসিয়ে চলেছি
নিরাপদে পৌঁছে দিতে, এবং শরীর তার রূপালি ঝালর।
এইতো একটু আগে সেখানে এলাম দেখে ঝাঁঝালো দুপুরে
গোরস্থানে ক্রশের ওপর
খুঁটছিল ডানা চিল, যেমন তরুণ
পণ্ডিত খোঁটেন গ্রন্থ নিম আর্টিস্টের
মতো আত্মভোলা। প্যাডেল চঞ্চল পদযুগ, মাঝে-মাঝে দেখি
হুতুম প্যাঁচারা সব সহজিয়া কোটরে নিশ্চুপ
বসে থাকে, আলালের ঘরের দুলাল
মসৃণ মোটরে চেপে প্রগতির মান রাখে আর নব্য ডন যুয়ানেরা
প্রেমের চেয়েও বড়ো পরমার্থ খোঁজে
নানান পাড়ায়; বেশভূষা নাক্ষত্রিক, চলনে বলনে স্মার্ট আগাগোড়া।
আমার জীবন ভাবো একবার। সর্বদা পরণে
পুরোনো কাপড় জামা, গড়াগড়ি দিই সুখে স্বপ্নের বনেদী গালিচায়।
ধূসর পিতার স্মৃতি চোয়ালে, গলায় কিংবা পাকস্থলীতেই
রেখেছি গচ্ছিত আর পাতালে দেখেছি আসবাবপত্র সব
ব্যালে নর্তকীর মতো ভাসমান এবং একটি নারী বাণীহীন তীক্ষ্ম অহংকারে
জলমগ্ন নিয়ে খেলা করে-যেন তার কোনো স্মৃতি নেই
অথবা আগামীকাল নেই।
নিজেকে বুঝিনা ঠিক, তাই
কখনো শহীদ ভাবি জীবনের, কখনো কেবলি সাইকেলচারী এক,
কখনো-বা হাতুড়ে স্বাপ্নিক।
মাথার ভেতরে আজগুবি গোলাপের পাপড়ি পড়ে আছে কতো,
পড়ে আছে অনভ্যস্ত ভঙ্গিমায়, হৃদয়ে দাঁতের মতো চাঁদ
ভীষণ আমূল বিদ্ধ। জ্যোৎস্না রাতে হঠাৎ বাতাসে কালো চেন
উন্মোচিত, সাইকেল ভেসে যায়, গোরস্থান, কাগজের স্টল,
মেয়ে-পুরুষের আর ভুলচুক, করুণা, পাপের পরপারে
মেঘে-মেঘে, নক্ষত্রের বাগানে কেবলি ভেসে যায় দীপ্ত কী এক বোধিতে।