এ শহর ঢাকাতেই
মধ্যে মধ্যে ডাক শুনি, দয়াবান তরুণ রোদ্দুর,
বহু বৃষ্টি, বহু দীর্ঘ পথ-পেরুনো গভীর ডাক।
ইচ্ছে হয় এ শহর ছেড়ে চলে যাই,
থাক এই চেনা গলিপথ,
প্রবীণ বসতবাড়ি থাক
অনেক পিছনে পড়ে।
তেতো হয়ে আসা
শস্তা চুরুটটা মুখে চেপে যাই চলে
শব্দের তাড়না থেকে দূরে।
গাঢ় সেই ঢাক শুনে স্বপ্নের গভীর
স্তব্ধতার মতো কোনো নৈঃশব্দ্যের দিকে
যাত্রা করে এ শহুরে রেখাবলী ভুলে যাই যদি,
বলোতো কেমন হয়? কারো কিছু এসে যায় তাতে?
শহরের শেষ প্রান্তে ফ্যাক্টরির চোঙ, ঝিল্লিস্বর,
সমস্ত পিছনে ফেলে পা বাড়ালে দূরে
বুদ্ধের কাঠের মূর্তি, ফ্রেমে-আটা ছবি,
ধবধবে বারান্দাটা, সন্ধ্যা-ছোঁওয়া, চুপ
নানান ফুলের টব, অন্তরঙ্গ টেবিল এবং গ্রন্থমালা
সঙ্গে যায়। আমার শার্টের ভাঁজে ভাঁজে,
কাদা-মাখা জুতোর ওপরে স্মৃতিগুলি সুদিনের
নক্ষত্রের মতো দিব্যি জ্বলজ্বল করে।
এ শহর মাতৃগর্ভ যেন,
আঁধারের রহস্যময় প্রাচীন তারার স্বপ্নে দয়ালু উজ্জ্বল,
নৈকট্যের স্মৃতিতেই উষ্ণ চিরকাল। বুঝি তাই ফিরে আসি
বারবার তেতো-হয়ে আসা চুরুটটা মুখে চেপে।
দীর্ঘ পথ ঘুরে ঘুরে পদযুগলের হাড় ক্রমশঃ নিঃসাড়
হয়ে এলে নিজেকে কেবলি এ শহর ঢাকাতেই
রাত্রির পার্কের
পাথুরে বেঞ্চের মতো ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হয়।
তখন আমার গ্রীবা
শহরের সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার মতো হয়ে যায় আর
চোখ দুটো হাঁস-ভাসা লেক, ক্লান্ত মুখ
জনতা-মথিত এভেনিউ।
একটা চাদর
দেখছি ক’দিন ধরে গৃহিণীর হাতে তৈরি হচ্ছে অনুপম
একটা চাদর।
সততা এবং অনলস যে অধ্যবসায়
শিল্পীকে সফল করে তারই যুগ্মতায়
সে একটা চাদর সেলাই
করলো ক’দিন ধরে। একদিন উদার মাঠে যে-কনক ফসলের নাচ,
চাঁদের বক্রতা ঘেষা বনের যে-শ্যামলিমা আর
সর্ষে ক্ষেতে চঞ্চলা মেয়ের মতো ছোট্র পজাপতির যে-রঙ,
স্বপ্নে দেখা অলৌকিক ফুলের পাপড়ির
যে-নরম-সব কিছু নির্মল তরঙ্গ হয়ে অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল
সমগ্র সত্তায় তার-সেইসব আশ্চর্য বর্ণালী নিয়ে একটা চাদর
ছুঁয়েছে শিল্পের সীমা, দেখলাম, মুগ্ধতায় গাঢ়
রাত্তিরে তন্ময় হয়ে চাদরকে যে দিচ্ছে শিল্পের মুক্তি
আর যেটা ক্রমশ শিল্পিত হচ্ছে, উভয়ে কেমন
নিবিড় একাত্ম, যেন মঞ্চের আলোর নৃত্য আর
নর্তকীর মধ্যে কোন থাকে না তফাৎ। দেখলাম,
সে আর চাদর, উভয়কে সযত্নে বুনছে কেউ সূক্ষ্ম তাঁতে।
চাদরটা উল্টে পাল্টে দেখলো সে, দেখলো নিজের
কারুকাজ, তারপর ঘুমন্ত মেয়ের চার বছরের সেই
একরত্তি শরীরে ছড়িয়ে মৃদু হেসে দাঁড়ালো শয্যার একপাশে।
দেখলাম, সুন্দর চাদর নয়, একটি মায়ের
স্নেহ-জ্যোৎস্না শরতের নিষ্কলুষ দিনের মতোই
নিবিড় জড়িয়ে গেল সন্তানের নিমগ্ন সত্তায়, চুমো হয়ে
চাদরটা রইলো ছুঁয়ে আমাদের সন্তানের সমস্ত শরীর।
সে জানে অশেষ অনুরাগে বোনা এই আবরণ
কন্যাকে করবে রক্ষা অপদেবতার ছায়া থেকে,
দৈত্যের নিশ্বাস থেকে আর সেই চাদর একটা
প্রাচীরের মতো
থাকবে দাঁড়িয়ে শুভ আর অশুভের
মধ্যে প্রতিক্ষণ। দেখি প্রগাঢ় শান্তিতে
ঘুমোচ্ছে মেয়েটা,
তোমরা ঘুমোতে দাও তাকে-
একটি প্রস্থান, তার অনুষঙ্গ
বিশ্বের নানান দৃশ্যে চোখ রেখে, খণ্ড খণ্ড ঘটনাকে নাগর দোলার
লাল নীল ঘোড়া ভেবে কিছুদিন আমার নিজস্ব জগতের
আনাচে কানাচে তুমি উড়িয়ে আঁচল
অকস্মাৎ একদিন হলে অন্তর্হিতা আর আমি
রইলাম পড়ে শূন্য নিশীথের বিজন পার্কের মতো নিঃস্ব।
আমার বিদ্বেষ, ঘৃণা, অভিমান, গনগনে ক্রোধে, এমনকি ভালোবাসা
কিছুই পারে নি ধরে রাখতে তোমাকে।
আমার গণ্ডিতে কোনো লতাপাতা ছিল না কোথাও-বুঝি তাই
গুল্মের ক্রন্দন পথ করেনিকো রোধ।
ছিল না হরিণ তাই আঁচল করে নি আকর্ষণ কেউ, শুধু
দরজা জানালাগুলি হাহাকার হলো আর আসবাবপত্রের বার্ণিশ
কেমন নিষ্প্রভ মনে হয়েছিল তোমার প্রস্থানে।
যেন আমি চোরাবালি, সেখানে পা দিলে
ভীষণ তলিয়ে যাবে ভেবে তুমি
স্থির ভূভাগের দিকে প্রাণপণে পালালে সুদূরে।
যেন আমি মহামারী-বিধ্বস্ত শহর-
হাওয়াকে নিশ্বাসযোগ্য করবার ছলে
পালালে অনেক দূরে, একবারও প্রেতায়িত শহরের দিকে
তাকালে না ফিরে, আমি রইলাম পড়ে। চৌরাস্তায়
অসংখ্য শিশুর মতো কোলাহল করে
আলোমালা উঠলো না দুলে, আমার সত্তাকে ঘিরে
বাজলো না জ্যোৎস্নারাতে সুনীল গিটার।
যেন আমি বদ্ধ কালা, কোনোদিন শুনি নি বেহালা
কিংবা অর্গানের সুর। দেখলাম ডালির ঘড়ির বিগলিত
প্রবাহ গড়িয়ে যায় আমার সতৃষ্ণ অস্তিত্বের নগ্নতায়।
শৌখিন চায়ের সেট নও তুমি, কৌচ নও, নও ফুলদানি,
ছবি নও ফ্রেমে আঁটা, আলমারি-কবলিত কাঠের নর্তকী নও কোনো-
প্রত্যহ বাসায় ফিরে দেখবো রয়েছে সবকিছু যথাস্থানে!
এখনো তোমাকে চাই যেমন ব্যাকুল স্বরে দুর্ভিক্ষের দেশে
আর্ত জনসাধারণ চায় শুধু শস্যের সম্ভার।
কী যেন পাখির মতো গেল উড়ে মাথার ওপর-
আমি ওকে ছেলেবেলা ভেবে অন্তরঙ্গ স্বরে কাছে
ডাকলাম হাত নেড়ে; অজস্র টিয়ের কলরবে
হারালো আমার কণ্ঠস্বর।
সেও তো দিলো না ধরা আমার একান্ত প্রিয় স্মরণ বিলাসে।
আমি বুড়ো ক্লাউনের মতো পরিত্যক্ত, এবং তুষারে ঢাকা।
নিষ্পত্র গাছের মতো গীতার্ত, নিঃসঙ্গ-শুয়ে আছি
শূন্যতায় কোনোমতে ঠেকিয়ে চিবুক অতীতের স্তূপে আর
কেবলি পড়ছে মনে, কিছুতেই তোমাকে আমার করে রাখতে পারি নি।