আমি কী করে কাজ পাবো
যেহেতু আদিতে ছিল কর্ম, তাই কর্ম চাই আজো। আপনারা
দয়া করে আমাকেও কাজ দিন। শয়তান দিনরাত মগজে বানাক
যাচ্ছে তাই কারখানা, তা চাই না। আপনারা দেয়ালে দেয়ালে
প্রত্যহ লটকে দেন কর্মক্ষম ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট তালিকা।
নানা কাজে দড় তারা, তাইতো জাজ্জ্বল্যমান তালিকায় ওরা
প্রধান, দ্রষ্টব্য নম। হাতে-হাতে চার্ট ঘোরে, ম্যাপ, দিগদর্শনের কাঁটা,
জরুরি ফাইল কতো-দেখে তাক লাগে। এত কৃতী পুরুষের
ঠেলাঠেলি নিষ্প্রাণ শহরে-গ্রামে, ইতোপূর্বে কখনো জানিনি।
আমার নিষ্প্রভ নাম কখনো পাবে কি ঠাঁই সেই তালিকায়,
ঝুলন্ত প্রাচীরপত্রে? আমি কি আপনাদের কাজে,
যা-হোক তা’- হোক কাজে, পারি না লাগতে?
কী বললেন? মগজের সারবান অংশটুকু বাজে কাগজের
ঝুড়িতে হেলায় ছুঁড়ে হুকুম পেলেই
বড়ো, মেজো, সেজো প্রমুখের নাচের ফ্লোরের মতো ঝকঝকে তৃপ্ত মুখে
পারি কি বাড়িয়ে দিতে হুঁকো?
তৎপর আঙুলগুলো ডুবিয়ে চকিতে বারংবার
জল ঘোলা করা নানা ঘাটে সম্ভব আমাকে দিয়ে?
অভাজন আমি তাই এ-যোগ্যতা করিনি অর্জন।
কখনো ধর্মের কল বাতাসে না নড়লেও দু’দান নিজেই
নাড়িয়ে সরলমতি লোকদের তুখোড় আফিমখোর বানানোর কোনো
তেলেসমাৎ জানি কিনা সঠিক জানতে চান হে ধর্মাবতার?
তেমন সুকৃতি এই অধমের কিছুই জমেনি।
পাড়ায় পাড়ায় দাউ দাউ আগুন লাগিয়ে দিব্যি
প্রফুল্ল মেজাজে নরখাদকের আখড়ায় বখরা বাগানো
কিংবা রক্ত ঠাণ্ডা রেখে শিশুর পাঁজর ভেঙে আর
নারীকে ভাসিয়ে দিয়ে রক্তের প্লাবনে
হো-হো-হেসে উঠবার, পৃথিবীকে নরকের মতো
স্রেফ ঢেলে সাজানোর যোগ্যতার নির্ভুল প্রমাণ
দিতে হবে রাতারাতি?
তাহলে লজ্জার মাথা খেয়ে
বলে ফেলি-কস্মিনকালেও আমি নরমেধে পাকাইনি হাত।
হে ধর্মাবতার যদি একটু অভয় দেন তবে এই দীন অভাজনও
দাখিল করতে পারে ভিন্নতর যোগ্যতার বিনীত দলিল
প্রকৃতির নিদ্রাতুর পাড়ায় হঠাৎ পীত শীতের ডাকাত
পড়লে গাছের প্রাণে কী কী অনুভূতি তোলে সাড়া, তার
শিহরণ চৈতন্যে মেলাতে পারি। ছাদে,
দেয়ালে কার্নিশে আর বারান্দায় বছরের পর
বছর বর্ষায় বৃষ্টি কী-যে ঘোর কাজল অতল গান গায়,
সে গানের ভাষা জানবার সাধ নিয়ে কান পেতে থাকি আর
পাখিরা কী করে মরে ঝাঁক ঝাঁক কোন্ অজানায়,
সে খবরও জানা চাই। ট্রফিকের বাজখাঁই হুল্লোড় স্তিমিত হলে মধ্য-রাত্রির শহর
এই শ্লথনীবী শহর কেমন করে হাই তোলে
কোলে নিয়ে বিশাল বেড়াল, তা দেখার জন্যে আজো সর্বস্ব খোয়াতে রাজি
খুন হলে কেউ, হোস পাইপের জলোচ্ছ্বাসে তার
রক্ত ধুয়ে ফেললেও সেখানে মৃতের কোনো ছায়া
পড়ে থাকে কিনা-তা-ও করে আনাগোনা ভাবনার প্রদেশে আমার।
কোথাও অন্যায় করে যদি কেউ, অপরাধবোধে
ভারাক্রান্ত আমার এ-মাথা নত হয়ে আসে।
কোথাও কারুর কণ্ঠ রোধ করা হলে আমি মূক হয়ে যাই,
কোথাও নির্দোষ কেউ ঘাতকের হাতে
বেঘোরে হারালে প্রাণ অলিতে-গলিতে, জনহীন
প্রান্তরের কর্কশ মাটিতে কিংবা চোরকুঠরিতে,
মৃত্যুর ক্ষুধার্ত মিশমিশে নিস্তব্ধতা আমাকেও করে গ্রাস।
মানুষ উন্মত্ত হলে চক্রান্তে ঘৃণায় দ্বেষে ক্রোধে কারা যেন
আমার শরীর জুড়ে সজোরে ঠুকতে শুরু করে
দজ্জাল পেরেক রাশি রাশি, অন্ধ, কী-ভীষণ কালো!
উঠোনে শিশুর খেলা দেখে দুন্ধুভি বাজাতে পারি
আনন্দের, দূর্দশার ডাকিনীরা চৌকাঠ আগলে
বসে থাকলেও
প্রবল আঁকতে পারি পথরেখা প্রেমের তারায়।
লুণ্ঠিত শস্যের ঝাঁ-ঝাঁ শূন্যতায় দাঁড়িয়ে আবার
নিতে পারি প্রাণ ভরে সুদূর শস্যের ঘ্রাণ কিছু।
মহাপ্লাবনের সেই পুণ্যাতমার পায়রার মতো
একটি সবুজ শীষ এখনো আনতে পারি কিংবা জীবনের
দারুণ খরায় শ্রমে, প্রেমে হতে পারি সন্তাড়িত ভগীরথ।
ঝুলন্ত প্রাচীরপত্রে চোখ রেখে সারাক্ষণ তবু কি ঘুরতে
হবে টো-টো ধূ-ধু বনহংসদের পেছনে পেছনে শুধু ‘কর্ম চাই’ বলে?
আমি হই বর্তমান
আমি হই বর্তমান, আমি হই আদিকাল। যদিও পরি না
বাঘছাল,তুকতাক ফুঁকিনা মন্তর, চাঁপা রঙ
হাওয়াই শার্টের অন্তরালে হৃদয় একান্ত ঝাঁ-ঝাঁ,
দৃষ্টি চাননিমার পর। তোমরা গকুলে আছো আর
আমিতো জলহস্তীর পাকে পড়ে অপটু সাঁতারে
গংগিমার কাছে যেতে চাই। মগজের কোষে কোষে
আউলা ঝাউলা স্মৃতি, মাঝে-মাঝে, রৌদ্রে রৌদ্রে ঝলসিত,
মাথার ওপরে
ওড়ে গিরোবাজ। ভাবি, এ বেলা গহীন গাঙে সূর্যাস্তের আগে
স্বপ্নের মন্থনে কোনো চাচ্রা জেগে উঠলে বলবো,
“নটী তুই পারলিনে কিছুতেই গিলতে আমাকে।“
পৌঁছে যাবো ঠিক
কিছু মুক্তো-ঝলমল শরীরে গকুলে।
গাভীন গাইয়ের
উদরের মতো মেঘ হেলে দুলে যাবে, চিকচিকে
ঘাশুয়া মাটিতে আমি মাথা রেখে অতিল ঘুমাবো।
আছে কি স্বপ্নের ঋতু এখনো কোথাও? আজ বড়ো
প্রয়োজন স্বচ্ছতম স্বপ্নকে আমার। জুগ জুগ্ পায়রার
বুকের কোমল তাপে লুকিয়ে রয়েছে নাকি, নাকি
কারো আঁচলের খুটে এক মুঠো জুঁই হয়ে স্তব্ধ, ম্লান রয়েছে ঘুমিয়ে?
ইচ্ছে হয় এস-ও-এস সর্বত্র পাঠাই।
তোমরা জানো না কেউ, স্বপ্নের মাটিতে নামলাম
খালি পায়ে, চাঁদশাদা প্রান্তরের আনাচে কানাচে
গোলাপী শিখার মধ্যে নেচে নেচে চাইলশ্যা হলো
বালকের চোখ,
গিচসু উঠলো ভরে রঙিন মার্বেলে।
আমাকে দেখেই ঊর্ধ্ববাহু গাছগুলি
সবুজ চীৎকারে আন্দোলিত ঘন ঘন,
দিগন্তের চিবুকের নিচে চাঁদ ডোবে
অন্ধকারে-মনে হলো, জহুরীর নিপুণ আঙুল
কালো মখমল-বাক্সে বন্ধ করে রাখে মুক্তোটিকে।
কখনো নিঃশব্দে হাঁটি অতিকায় গোলাপের গাঢ় বারান্দায়,
কখনো-বা ভাসি
সবচেয়ে প্রবীণ মসজিদের গম্বুজের অনেক ওপরে,
সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার
ছাদের ওপরে, ফ্যাক্টরীর চিম্নি ঘেঁষে।
দূরে
ফোঁটা
ফোঁটা
আলো
যেন
অশ্রু-
মালা আনন্দের।
ব্যাকুল গাছের
ডালপালা ক্ষিপ্র ডানা ঝাপটায় গোধূলিপ্রবণ
মগজে আমার, চেতনায় অগণন সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আসা-যাওয়া,
আমি হই বর্তমান, হই আদিকাল।
কানপট্রি ঘেঁষে গেল; কতিপয় সুনীল কংকাল
হঠাৎ পেরুলো দেখি সুদূরের সাঁকো।
বহুদিন থেকে
মৃত্যু পেয়ে বসেছে আমাকে।
পাওয়াটা বিচিত্র নয়, জীবনের প্রতিটি বছর কম্শম্
মৃত্যুর তুহিন গন্ধে ভরপুর। তাইতো মাংসের অন্তরালে
ব্যক্তিগত হাড় সব কখনো সবুজ হয়, কখনো-বা নীল।
ফ্যালফ্যাল দেখি চেয়ে, মৃত্যুর পাথুরে ধলা স্তন
পান করে করে
কী এক সৌন্দর্য বাড়ে ক্রমাগত নানা বিন্যাসে লোকায়তিক।
‘স্বপ্নের বাজারদর কমেছে সম্প্রতি’-বলে গেল
নব্য খিরকা-পরা বংশধর। খড়িদোর খুলে দেখি
কেউ নেই। পণ্যময় দোকানের পাট খোলা, কোথাও গাহাক্
নেই কোন; অন্যমনে খাউয়া বাউয়া পথে হাঁটি
গোপাট ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে, বুঝি কানাঅলায় পেয়েছে।
মন তুমি কৃষিকাজ জানো না বলেই
করুণ কাহাতে বিদ্ধ কাট্টি মারি উজাড় বস্তিতে, তারপর
খিস্তির মস্তিতে মাতি, কামানি ঘুরিয়ে নিতে চাই
অস্তিত্বের; ডাঁই ডাঁই জমে ওঠে রঙিন গহন ক্যালেন্ডার
সত্তার বেকুব ভিতে। বিবেক ফতুর করে ভাবি যদি আনকোরা শিশু
নতুন বিবেক নিয়ে এসে যায় আমাদের পুরোনো দঙ্গলে…
এমন মানব জমি রইলো পতিত,
অনাবাদে ফলে নাকো সোনা।
হয়তো কোথাও
চাংবাশ মৃন্ময় হলে চাত্রি জ্বলে, মাটির চাপ্পান
পায়ে পায়ে চূর্ণীকৃত; দ্যাখো আমি হই বর্তমান, হই আদিকাল।