সমান্তরাল
পাঠ শুনুন, সেই গল্পে-পড়া বিষণ্ন, অধীর
বুলবুলিটার কথা মনে পড়ে? বসন্ত-মদির
বাগানের খয়েরী ডালের শাদা গোলাপকে লাল
বানানোর অভিলাষে অস্তিত্বের সূক্ষ্ম তন্তুজাল
কাঁপিয়ে অমোঘ ছন্দে সারারাত গেয়েছিল গান
সতৃষ্ণ কাঁটায় ঝোড়ো বুক পেতে। ভোরে সে বাগান
কবরের মতো স্তব্ধ, চতুর্দিকে আশ্চর্য সৌরভ
রইলো জেগে, ফ্যাকাশে গোলাপ পেলো রক্তাক্ত গৌরব।
পাঠক গল্পের সেই
বুলবুলিটাকে মনে পড়ে?
মনে পড়ে রক্তস্নান? সেইমতো আমিও এ ঘরে
জ্বর-তপ্ত, স্বর-মত্ত, বুক রেখে বালিশের মেঘে
আবেগের পালতোলা নৌকোর গলুইয়ে রাত জেগে
কাগজের শুভ্রতায় শব্দের নক্ষত্রপুঞ্জ আনি
শূন্য ছেনে। আপনারা সেসব শব্দের রাজধানী
হয়তোবা দেখবেন সুশীতল ছাপার অক্ষরে
কোনোদিন। পাঠক, তখন পাতা-জোড়া থরে থরে
সাজানো শব্দের গায়ে, বলুনতো, অধীর আমার
হৃৎপিণ্ডের রক্তকণা পড়বে কি চোখে আপনার?
সাক্ষী
এইতো দেখছি দিব্যি টব আলো করে আছো আর
তন্বী ডাল নড়ে চড়ে; অনবোলা পাতার বাহার।
উপরন্তু কী খেয়ালে সুঘ্রাণ বিলাও মাঝে-মাঝে;
যখন দাঁড়াই এসে বারান্দায় কাজে কি অকাজে
অথবা চেয়ার টেনে বসি, দেখি দিয়েছো বাড়িয়ে
চিকন সবুজ বাহু, যেন যাবে এ-টব ছাড়িয়ে
আকাশের নীলে, ভাবি-কী করে সহজে রাখো
বাতাসের তোড় আর এমন নির্জলা মাটিকুনো
হয়েও কী করে বাঁধো রঙিন বিন্দুর সাঁকো এই
হাঁ করা বেবাক শূন্যে? বারংবার দেখি তোমাকেই
তার মধ্যে, যে তোমার পাতায় বুলোয় হাত, যার
আঁচল আটকে গেলে হঠাৎ কাঁটায়, চমৎকার
নুয়ে পড়ো, যেন যেতে দেবেনা কিছুতে তাকে, বুঝি
তাই আকর্ষণে এত নিবিড় আকুতি। সোজাসুজি
বলি, যারা কুটি কুটি ছেঁড়ে পাতা, তারা বটে পশু
কেননা তোমারও আছে প্রাণ, সাক্ষী জগদীশ বসু।
সেই একই দোষ
সেই কবে দাওয়ায় বসে শীতের রোদ্দুরে জ্ঞানবান
ময় মুরুব্বির মুখে শুনতাম মধ্যে-মধ্যে, “শোনো হে বোবার
শক্র নেই। চল্তি পথে লোকজন হাইকোর্ট দেখাতে চাইলে
মুখ বুজে থেকো আর কস্মিনকালেও সাত চড়ে করো না রা,
বোঝোই তো শুধু রোদে চুলদাড়ি হয়নি রূপালি।
কিন্তু কী জানেন, অদৃষ্টের ফেরে নই অনবোলা,
তাই বেলা অবেলায় আত্কা মুখ থেকে ফেটে পড়ে
কথা, মানে কোদালকে কোদাল বলেই
বেজায় নাড়িয়ে দিই তল্পি তল্পা উদ্বেল বাজারে।
মেলার উচ্ছিষ্ট নিয়ে কখনো চলে কি হাট? তদুপরি দিনদুপুরেই
স্পষ্ট দেখি, ডাকাত দোকানপাট করে তছনছ।
কেউ বা সাম্যের গান গেয়ে কারবারে হচ্ছে লাল রাতারাতি,
পক্ষান্তরে দেনায় বিকোয় বাস্তুভিটা কারো কারো।
যেহেতু ছিলনা হাতে সাবধানী হ্যাজাক লণ্ঠন,
পড়েছি হোঁচট খেয়ে খানা খন্দে। অতঃপর ভরাট আঁধারে
বাঁচান নগদ মূল্য সঠিক বুঝিয়ে দিতে চায়
চামচিকে লাথি মেরে। বেগতিক, তবুও তো মুখ খুলি স্বভাবদোষেই।
সেই কবে থেকে
কখনো পিতার চোখে টলটলে জলের বুদ্বুদ
দেখি নি আমরা কেউ। মনে পড়ে, একদা সন্ধ্যায়
বারান্দায় পোষা পাখিটার শূন্য খাঁচার সম্মুখে
দাঁড়িয়ে বিষণ্ন তাঁর তৃতীয় পুত্রকে বললেন
‘ছি কাঁদে না! পুরুষের চোখে কান্না বড্ড বেমানান।
তখন পিতাকে ঠিক নূহের মতোই হয়েছিল
মনে, যেন অতিদূর দিগন্তের বুড়ি ছুঁয়ে ফের
সপ্তম পায়রা তাঁর প্রতীক্ষা-কাতর হাতে এসে
বসবে সবুজ ঠোঁটে, চোখ তাঁর নির্মেঘ দুপুর।
প্রিয়তম পুত্র তাঁর অর্থাৎ কিশোর সুলেমান
মড়কের দাবাগ্নিতে চিরতরে হারালো যেদিন,
সেদিন সে ধীরোদাত্ত পুরুষের পাঁজর-খাঁচায়
কী শূন্যতা করেছিল দাপাদাপি বুঝতে পারি নি।
সেদিনও পিতার চোখ ইতিহাস বইয়ের পাতায়
দেখা কোন মূর্তির চোখের মতো হয়েছিল মনে-
কেমন সুদূর আর শুক্নো বড় বেশি নিষ্পলক।
কখনো পিতার চোখে টলটলে জলের বুদ্বুদ
দেখি নি আমরা কেউ। গতায়ূ পুত্রের কুকুরটা
যেদিন উঠোনে রইলো পড়ে স্তব্ধ, নিঃসাড় কঠিন,
‘সুলেমান’ বলে পিতা আর্তকণ্ঠে এলেন বেরিয়ে
ঘর থেকে বেসামাল। আজো দেখি, সমস্ত শরীরে
পুরোনো ফটোগ্রাফের বিবর্ণতা নিয়ে তিনি কালো
উঠোনের মাঝখানে মুষল বৃষ্টিতে নগ্ন পায়
সেই কবে থেকে ভিজছেন, ভিজছেন, ভিজছেন……
স্বপ্নহীনতায়
বুড়োটা বিরাট এক মাছের কংকাল টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে
জলজ স্মৃতির ভারে স্বপ্ন দেখেছিল
সমুদ্রের তীরে তীরে ঘুরে-বেড়ানো সিংহের।
এমন একটি স্বপ্ন চাই, অভ্রঝরা বিশাল প্রান্তরে যার
তুমিই থাকবে শুধু, তুমি।
অথচ আমার স্বপ্ন হায়রে সে কোন্ চোরা নিয়ে গেছে
সিঁদ কেটে অকস্মাৎ। আমি স্বপ্ন-তাড়ুয়ার পেছনে পেছনে
ঘুরে মরি দিনরাত; তোমাকে দেখার জন্যে ভাদ্রের রৌদ্রেও
ফেঁপে-ওঠা জনসমুদ্রের প্রতিটি তরঙ্গে ভাসি,
স্বপ্নে সমুদ্রের তীরে সোনালি বালিতে
সিংহের পায়ের ছাপ খুঁজি না কখনো।
নিদ্রার বাগানে কোনো হরিদ্রাভ ডাল ধরে তুমি
ইমন কল্যাণে ভরে ওঠো কানায় কানায়, চাই।
আপাতত আমি স্বপ্ন-তাড়ুয়ার হাড্ডিসার হাতে
খাচ্ছি মার বারবার। কখনো-সখনো
ঘুমঘোরে আওড়াই স্বপ্নহীনতায়
কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?
আমি টোটো কোম্পানির একজন, ঘুরি ফুটপাতে,
কুলীন রাস্তায় ব্যাপ্ত চৌমাথায়, কলোনিতে, শেডে;
পকেটের উজাড় বিবর থেকে দুমড়ানো, ম্লান
প্যাকেটটা বের করে বগা ফুঁকে বিরক্তিকে হাওয়ায় ওড়াই,
কখনো আবার
ভিড়ে যাই বাস-ভাড়া-কমানোর দাবির মিছিলে,
কখনোবা খবরের কাগজের অন্তঃস্তল ফুটো করে গোল
চাঁদ দেখি চুপিসারে। মনে পড়ে অতীতের মুখ; দিনগুলি
সাহানা দেবীর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের
গানের মতোই মনে হয়, কেমন সুদূর, হু-হু-
মীড়ে মীড়ে, কখনো গমকে ভরপুর। মনে পড়ে,
ভোরবেলাকার হাসপাতালের করিডরে
নার্সদের আগাগোনা, শাদা হাঁস কজন ব্যস্ততা-ঝলসিত।
কী করে নিজের দেখাশোনা করা চলে
ভালোমতো, তাওতো শিখিনি।
অথচ পাখিও বাসা আজীবন গোছগাছ করে
রাখে আর রৌদ্রের ছটায়
খড়কুটো দিব্যি মুকুটের মতো হয়ে যায়। দ্যাখো আমি শুধু
থপথপে ফুটপাতে ঘুরি, নির্জন পার্কের মতো এই বুক
খবর কাগজে ঢেকে বিবর্ণ চাটাইয়ে শুই আর
মধ্যে মধ্যে ঘুমঘোরে আওড়াই স্বপ্নহীনতায়
কে বাঁচিতে চায় হে বাঁচিতে চায়?