যাদুকাঠি
খাটো সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শহরে হাঁটছি একা,
বুকের ভিতর স্পন্দিত ঢের অলীক কথার ঝাড়।
বড়ো রাস্তায় নেমেছে এখন ভীষণ অন্ধকার,
পার্শ্ববর্তী পথচারীকেও সহজে যায় না দেখা।
চেনা পথ আজ অচেনা ঠেকছে, গা ঘেঁষে দাঁড়ায় ভয়;
চম্কে তাকাই, কে যেন অদূরে সজোরে কড়াটা নাড়ে।
নীল পাহাড়ের অগম চূড়ায় নয়,
নয়কো অনেক হাঁস-ঝলসিত প্রাচীন হৃদের ধারে,
ল্যাম্পোষ্টের চূড়ায় লগ্ন একজন কালো লোক
হাতে নিলো তুলে এলোমেলো কিছু ইলেকট্রিকের তার।
আঁধারে দোকান, রাস্তা, মানুষ, যান, সব একাকার-
যেন কে ডাইনি নাড়ছে পাচন তেপান্তরের পারে!
একটু পরেই বড়ো রাস্তায় পাচন অন্ধকারে
কালো লোকটার যাদুকাঠিতেই ফুটলো আলোর চোখ,
যেমন হঠাৎ বিপুল সাড়ায় কবির অধীর মনে
না-লেখা কবিতা চোখ মেলে চায় নিবিড় উন্মীলনে।
যে-কোনো সকালে
ট্রে হাতে সে এল ঘরে, রাখলো সংক্ষিপ্ত প্রাতরাশ
পাশের টিপয় জুড়ে। টোস্ট আর চায়ের সুরভি
খেলা করে সারাঘরে, না-লেখা শব্দের আঁভালাস
থেকে জেগে তাকে দেখি। রেডিয়োতে ব্যাকুল ভৈরবী।
বসলো গা ঘেঁষে, তার যৌবনের সূর্যাস্ত শরীরে
এনেছে বর্ণাঢ্য ছবি। একটি কি দুটি পাকা চুল
বাতাসে নড়ছে মৃদু, অকস্মাৎ সকালকে চিরে
টিয়ের চীৎকার বেজে ওঠে বারান্দায়; কী নির্ভুল
ঘড়িটা রটায় বেলা। ‘আরেকটা টোস্ট নাও’ বলে
সামনে বাড়ায় থালা, ‘ডিম তো ছুলে না একেবারে।
ফেরাতে পারিনা চোখ, অলীক আগুনে জ্বলে জ্বলে
চেয়ে থাকি তার দিকে, নিমগ্ন স্মৃতির ঘনভারে-
এই কি তরুণী সেই একদা দিতো যে এনে রোজ
গোপন গোলাপ আর সচকিত আনন্দো ভোজ?
রাজা
যেন সব কালো মানুষের এক আলাদা আকাশ,
ওদের রোদের রঙ কালো আর নিত্য যে-বাতাস
চালায় তাদের তপ্ত বুকের হাঁপর যেন কালো
তা-ও; বুঝি তাই মেমফিসে প্রশান্ত চোখের আলো
দপ্ নিভে গেল তাঁর। সুবিশাল প্রেইরীর মতো
বিস্তুত উদার বুক ভাসলো নিমেষে রক্তে। নত
মুখে দ্যাখে আমেরিকা-জবার মতোই তাঁর খুন
ঝরে সেই হোটেলের বারান্দায়। সুনিশ্চিত ঘুণ
ধরে গেছে নিবার্টির পাদপীঠে, নইলে কেন আজ
মার্টিন লুথার কিং লুটোন নিহত? জাঁহাবাজ
ঘাতকের থাবা কেন কম্পমান নিশ্চিত প্রহরে?
কেন অহিংসার মুখ ঢাকা পড়ে অসিত কাপড়ে?
মিশিয়ে মার্কিনী স্বপ্নে আপন সত্তার স্বপ্ন তিনি
দেখালেন বাঁচবার পথ, পর্বতে দাঁড়িয়ে ঋণী
করলেন মানুষকে। ভবিষ্যের দিকে মুখ রেখে
হৃদয়ের খুব কাছে ওদের নিলেন হেসে ডেকে
সোনালি ভূগোলময় ভ্রাতৃত্বের প্রতিশ্রুত দেশে
অচিরে পৌঁছুনো যাবে বলে। লাঞ্ছিতের কাঁধ ঘেঁষে,
ত্যাগে, প্রেমে করেছেন অগণিত হৃদয় শাসন,
যদিও ছিল না রাজদণ্ড, মুকুট কি সিংহাসন।
শঙ্খচূড়
ঝোপেঝাড়ে ঝল্সে ওঠে, কান্তিমান নর্তক যেমন
মুহূর্তে মুহূর্তে তার স্বচ্ছন্দ গতির নক্সা আঁকে
শূন্যতায়; রূপে তার বদ্লে যায় জলা, কাঁটাবন।
প্রকৃতির রঙ্গালয়ে ভ্রাম্যমাণ, কোনো দুর্বিপাকে
সহজে কাতর নয়। এড়িয়ে ব্যাধের ফলা আর
সাঁপুড়ের তীব্র বাঁশি অস্তিত্ব ডুবিয়ে রাখে সে-ও
নিঃসঙ্গতায়। কখনো বা হয়ে যায় ক্রোধের অঙ্গার,
জ্বলন্ত দুর্বাসা যেন। ভয়ার্ত পাখিটা কে ও? কে ও?’
বলে ত্রস্ত উড়ে যায়।
যদিও সে অতি বিচক্ষণ,
তবু এক ক্রূর ভ্রান্তি পরম শক্রতা সাধে তার।
জঠরে চুল্লির দাহ, কাঁদায় বঞ্চনা; কিছুতেই
ব্যস্ততায় ত্রিসীমায় খুঁজে পায় না শিকার।
দ্বিপ্রহর অমাবস্যা-কালো; কেবলি হারায় খেই
ভ্রান্তির সিমুমে ঘুরে, ব্যর্থতার, রুক্ষ্ম যন্ত্রণায়
চেনেনা নিজেরই মুখ। অকস্মাৎ কার মন্ত্রণায়
মেটাতে সুতীক্ষ্ণ ক্ষুধা নিজেকেই করে সে আহার।
শবাহারী কীটের কোরাস
বিশ্বজোড়া অন্ধকারে ধুঁকছে কারা?
কান পাতিনা খবরে।
আলো ছাড়াই দিব্যি জানি দিন চলে যায়,
আমরা থাকি কবরে।
এই যে এখন আমরা যাকে খাচ্ছি কুরে
ছিলেন তিনি সুন্দরী।
মজ্জা মেদের স্বাদের ঘোরে কবর তলায়
অলীক গানের সুর ধরি।
তারই নামে ঊর্ধ্বশ্বাসে লিখেছে কেউ
আধুনিক গীত-গোবিন্দ।
নানা ঢঙের সুবেশ যুবার গুঞ্জরণে
ভরতো মনের অলিন্দ।
বাইরে বটে ঝল্সে ওঠে রোদের জরি,
পাখির গানে গাছ মাতাল।
জীবিতদের বাঁচার ছটায় পাচ্ছে মানে
সপ্ত স্বর্গ, পাঁচ পাতাল।
রোদের জরির ধার ধারি না, পক্ষীকুলের
সুমিষ্ট সুর যাক চুলোয়।
যে রূপসী রোদ পোহাতো, শুনতো যে গান,
এখন সেতো চুপ ধুলোয়।
ভালো তাকে বাসতো যারা, জুটতো যারা
তারই রূপের উৎসবে,
প্রশংসাতেই অষ্টপ্রহর মুখর হতো,
ধরতো তারা খুঁত কবে?
কেউবা তাদের জুয়োয় মাতে, কেউবা এখন
অন্য নারীর শয্যায়।
আশা শুধু তৃপ্তি ভরে মুখ রাখি আজ
এই রূপসীর মজ্জায়।
কবরে তার কেউ নীরবে ফুল রেখে যায়,
মাটি মাতে সৌরভে।
আমরা শুধু বেড়াই নেচে কবর তলায়
শবাহারের গৌরবে।
সকল প্রশংসা তাঁর
সকল প্রশংসা তাঁর কেননা প্রবল জনমতে
আদ্যিকাল হতে
প্রকৃতই তিনি জানি প্রবীণ ওস্তাদ খেলোয়াড়
এবং ইচ্ছায় তাঁর নিমেষেই হতে পারে গ্রাম কিংবা শহর উজাড়।
পথের বান্ধব বৃক্ষ, লতাপাতা, ঘর-বাড়ি, সরল সড়ক
দেশে কি বিদেশে
লুপ্ত হয় চিরদিন তাঁরই অদৃশ্য নির্দেশে।
রাখেন হাতের পাঁচ মধ্যে-মধ্যে-দুর্ভিক্ষ, মড়ক,
যেমন ঐন্দ্রজালিক আস্তিনের আড়ালে কৌশলে রাখে তাস,
রঙিন রুমাল, ফুল খরগোশ; হতবাক দর্শকেরা চকিতে বিশ্বাস
করে সব, অলৌকিকে দিব্যি মজে, কোনো কিছু করে না পরখ।
সকল প্রশংসা তাঁর, কেননা ইংগিতে তাঁর নামে সর্বনাশ
সোনার সংসারে আর রূপসীর শরীর সহসা হয়ে যায় পচা, গলা মাস।
সকল প্রশংসা তাঁর, করুণা অপার-
বুঝি তাই যুগে যুগে সোৎসাহে পাঠান বিশ্বে জনসন আর সালাজার।