বুড়িমা
লাল নীল আর হলদে ফ্রকের অপ্সরী
চাঁপা-রঙ রোদে নেচে নেচে হলে টুকটুকে।
বুড়ি ছুতে গিয়ে হেসে ওঠো কেন ফিক করে?
থুত্থুরে ঐ বুড়িমাকে দেখে পায় হাসি?
তোবড়ানো তার গলা দেখে,
শণের মতন চুল দেখে,
ছানি-পড়া দুটো চোখ দেখে,
নড়বড়ে সব দাঁত দেখে,
লোলচর্মের ভাঁজ দেখে
হাসছো তোমরা মুখ টিপে?
জানি তোমাদের কোমল ত্বকের উদ্যানে
মেতে ওঠে পাখি অলীক ফুলের সৌরভে।
চোখ নয় যেন ঝলোমলো সব হ্রদগুলো,
হাতটা সাজানো পাঁচটি হলুদ চম্পকে।
সময়ের পট বড়ো দ্রুত যায় পাল্টিয়ে।
যাকে দেখে হাসো আজ বটে তিনি থুত্থুরে;
এই তো সেদিনও তিনি শোনো নীল লাল পরী
তোমাদের চেয়ে ছিলেন না কম সুন্দরী।
ভালোবাসা তুমি
ভালোবাসা তুমি অনাবৃষ্টিতে
কেমন রুক্ষ্ম, কী দগ্ধ আজকাল।
তারা-পাতা নেই, পাখিরা উধাও;
ভীষণ রিক্ত তোমার সলাজ ডাল।
কতদিন তুমি বৈশাখী রোদে
ভেবেছি শ্যামল ছায়ার আদর দেবে।
কিন্তু পালিয়ে বেড়ালাম শুধু
ছায়াকে তোমার প্রেতায়িত ছলা ভেবে।
চক্ষু কোটরে নিশীথ অশ্ব
রেখে গেছে কত দুঃস্বপ্নের আঁধি।
লিবিড়ো-তাড়িত সুনীল গুহায়
নিজেকে সোনালি সাপের শরীরে বাঁধি।
হৃদয়ের ঢের কাঞ্চন মেঘ
বৈরী হাওয়ায় কোথায় পালালো দূরে।
সংশয় যেন কৃষ্ণ বাদুড়,
ওড়ে অবিরত চিত্ত বলয় জুড়ে।
সমৃদ্ধির মায়ামারীচের
সংজ্ঞা-হরণ দারুণ আকর্ষণে
ধনিক যুগের গোধূলিতে ভাসি
যূথছুট ম্লান, নরমুণ্ডের বনে।
যেসব ভাবনা অবচেতনের
পরাণ-ঋদ্ধ গুহার তিমিরে লোটে,
কখনো হঠাৎ আলোর খোঁচায়
আর্তকণ্ঠে তারাও চেঁচিয়ে ওঠে।
স্বপ্ন এখন ছড়ে যাওয়া-দুধ,
আতঙ্কময় সময়ের জের টানি।
সুবিশ্ব মৃত, পাইনিকো টের
হয়ে গেছি কবে সংশয়-বেধা প্রাণী।
ভালোবাসা তুমি ক্ষয়-চিহ্নিত,
পত্রালিছুট, তোমার কী দোষ বলো?
ব্যাপক খরায় বহুদিন আমি
তোমার শিকড়ে ঢালি নি ঈষৎ জলও!
মাছ
মাছ তুমি প্রতিপলে করতলে হচ্ছো ম্লান। যতদূর জানি,
জল ছেড়ে শালুকের স্পর্শ ছেড়ে হাতের চেটোয়,
রোদের সোনালি কাঁটাতারে
শুয়ে থেকে মাথাটা তোমার
দিলো চাকদানা।
মেঘের গোযোর নেই একটু আকাশে, মাছ তুমি
হচ্ছো ম্লান; নৌকো যাচ্ছে রোদের ভেতর দিয়ে ফুলো
পাল তুলে। চোখ দেখি অপলক, হয়তো সেখানে
এখন জলজ স্মৃতি স্থিরচিত্র। মাছ তুমি সাঁতার জানোনা
হাতের ডাঙায়, তবু সকালবেলার তারা হয়ে
আছো স্বপ্নে, দুঃস্বপ্নে অংশত। জীবনের প্রতিষ্ঠিত
সোনালি কামানি থেকে যাচ্ছো সরে। এখন তোমাকে
অথৈ শূন্যতায়, নীলিমায়
কিছুতেই ওড়ানো যাবে না
ওগো মাছ, হাতের ডাঙায়-পড়া মাছ।
কোথাকার খোয়াইল্যা পাখি
মগজে নোয়ানো
জল-ছোঁয়া তীক্ষ্ম কঞ্চেটায় বসে বুঝি মাছরাঙা হয়ে এলো
তোমার জীবনহর। দেখছো মরীয়া হয়ে, খোলা
চোখে চমকালো চান্নি উয্যালা এবং শরীরের
নক্সী ত্বক ক্রমাগত হারাচ্ছে তীক্ষ্ণতা।
মাছ তুমি ডগা ডগা রোদের ভেতরে আছো, আমি
তোমার ভেতরে যাই, অকাতরে হই
রঙিন ঘুড়ির মতো ত্বক, হই কারুকাজময় শ্বেত কাঁটা
ওগো মাছ, হে বন্ধু আমার।
প্রথম যখন হাতে তুলে নিয়েছিলাম তোমাকে
আলগোছে-প্রতিদিন কত কিছু তুলি বইপত্র, ছেঁড়া মোজা,
জুতোর কালির ডিবে, আলপিন, শার্টের বোতাম, এরকম
অনেক কিছুই তুলি কাজে বা অকাজে-
মনে হয়েছিল যেন তুমিও তেমনি কোনো জিনিশ বস্তুত।
জাপানি সিল্কের মতো চামড়ার আদরে চমকিত
দেখলাম, তস্বী-দানা চোখ নিয়ে চেয়ে আছো রোদের ভিতরে
আমারই চোখের দিকে, আছো হাতের জায়নামাজে, স্থির,
অনবোলা। অকস্মাৎ আমাকে বিঁধলে তুমি মাছ, ওগো মাছ,
হে বন্ধু আমার, অলৌকিক বড়শিতে।
নির্জন কিনারে হাঁটু গেড়ে কাটাল পাখির বুলি শুনি, ভাবি-
তোমাকে ছাড়বো আমি নাকি তুমি আমাকে দয়ালু?
মেঘের নীল ইজিচেয়ারে
মেঘের নীল ইজিচেয়ারে শুয়ে ভাবি
জীবন নয় নেশাখোরের মাতলামি।
অথবা নির্বোধ তর্ক নয় কোনো,
জীবন স্পন্দিত মহৎ রূপাভাসে।
হাতের মুঠো ভরে সূর্যোদয় নিয়ে
মামুলি নক্সায় স্বর্গ পেতে চাই।
অথচ সময়ের সখ্য চেয়ে আজ
কালের কলহের অন্ত নেই দেখি।
সময় উৎকোচ নিয়েছে মানবের,
অন্ধকারে তবু উধাও অমরতা।
জ্ঞানীকে জনরব ব্যঙ্গ করে বলে
জীবনে জটিলতা থাকবে চিরদিন!
ভাবনাগুলি যেন রঙিন কটি বল,
অন্ধকারে যেতে খেলতে ভালোবাসি।
নষ্ট পৃথিবীকে জানিয়ে সাধুবাদ
কখনো নির্জন মনের দ্বীপে যাই।
নিয়তি বিবর্ণ প্রাচীর থেকে বলে
শূন্যতায় ফুল ফোটাতে চেয়ে সব
সুখকে অকাতরে জলাঞ্জলি দিবি?
তবু কি দেখা পাবি অন্তে মিনারের?
ঘটনারণ্যের কালোয় মুখ ঢেকে
আমিও ভৌতিক হরিণ হয়ে যাই।
বর্তমান কাঁপে চূর্ণ দর্পণে,
ব্যাধেরা হননের নেশায় অস্থির।
ময়নামতীর মূর্তিগণ
ময়নামতীর মাটিপ্লুত মূর্তিগণ গোলাপী রঙের রেলগাড়ি চেপে
সটান এলেন রাজধানীতেই সিটি-চমকিত স্টেশনের আস্তানায়।
মাননীয় গার্ড তার হুইসিল বাজাতে বাজাতে নিয়ে যান
বগী ভরে শৈবালিত, মেদুর বছরগুলি সুশীতল শেডে
সকরুণ দিব্যতায়। দুদ্দাড় পড়েন নেমে প্ল্যাটফর্মে ময়নামতীর
স্বপ্নপরায়ণ মূর্তিগণ-
কেউবা পটের বিবি, আকর্ণ বিস্তৃত চোখ, সুন্দর বগল,
উচ্ছল পানের রসে টসটসে ঠোঁট, যেন পাকা জাম; মসৃণ পাম্পসু পায়ে
আহ্লাদিত চতুর নাগর কেউ ফিটফাট, হয়তো কিণ্নর কুলোদ্ভব-
হন্হন্ হেঁটে গিয়ে মূর্তিগণ মেশেন নির্মুখ ভিড়ে। রাস্তায় রাস্তায়
কেমন বিকট চেল্লাচেল্লী, ঠেলাঠেলি, চতুর্দিকে দুঃস্বপ্নের পঙ্গপাল।
শহর এমন তপ্ত পারেনা আলতো হাত রাখতে কোথাও
কেউ, দপ্তরের
পাপোষে জমায় ভিড় দশজন শতজন প্রতিবেশী, দী
উমেদার। মাঝে-মাঝে তিল ধারণের ঠাঁই-নেই শহরকে ভয় পায়
পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই, চায় কোনোমতে
হাতের রৈখিক মাঠে চকিতে আসুক সুশোভন আমলকি। কখনো-বা
চাকারিতে এতল বেতল খেলে অবসাদ এলে
সখেদে দাখিল করে হাকিমের এজলাসে হলুদ দলিল।
কবেকার অব্দে সেই সুখদ বেলায়
বলো ছিল নাকি ভালো গোচরণ? বন দোয়েলের
শিস্ ঠুক্ ঠুক্ নুড়ি ঝুরু ঝুরু, আমের পাতার ঝিরিঝিরি,
এবং ঝাউয়ের আইমুশা
ইত্যাকার শব্দের মস্তকে মৃদু দুদণ্ড ফিরিয়ে হাত
ব্যাকুল আদর করা, লৈতন গাছের ফল কোঁচড়ে কুড়ানো,
অথবা সজল চোখে নৌকোর গলুইয়ে শুয়ে শুয়ে হাট-কারা আকাশের
লাউয়ের জালির মতো চাঁদ দেখা ছিল না কি ভালো?
শহরে নানান লোক, মধ্যবিত্ত প্যাণ্ডার সর্বত্র ঘোরে আর
চুটিয়ে ব্যবসা করে। কেউ কেউ পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে
উৎসবে বিলোচ্ছে হৈ-হৈ জিলিপি বাতাসা। অন্যদিকে
মেঘমৃদু হাত নড়ে জানালায়, অপর্রাবি ফেলছে চটুল দৃষ্টিজাল
রাস্তায় গলিতে পার্কে, সিনেমায়, কাফেতে অতিল্।
‘কী মজা কাফে-র দিবা বর্ণচ্ছটা এবং বানান ভুলে ভর্তি
হে আমার পরম লুকোনো পত্রপাঠ’
পকেটের ছুঁচো হাৎড়ে বলে পথস্থ গেঁজেল, আউগারি যুবা।
ময়নামতীর মাটিপ্লুত মূর্তিগণ অবিরাম ইকর বিকর চলাফেরা
করছেন ফুটপাতে, রুক্ষ চুল, উস্কো-খুস্কো নীলাম্বরী,
পাদুকা ধুলোয় ম্লান। ওড়ের বিগড়া কেউ পা ধোবেন বলে
কোথায় আমার স্থান, কোন আঘাটায়?’- এমন স্বপ্নোজ কিছু
উচ্চারণে যান চলে কামিজের হাতা মুড়ে শহুরে অলীক সরোবরে।
রক্তে তার জলকিণ্নরীর গান, সন্ধ্যালোকে ঘোরেন কেবল
দিগ্ধিদিক, পাতালের বর্ণোচ্ছাসে, জাতিস্মর দোটানার পাকে।