প্রুফ
বয়োধর্ম অনুসারে ইচ্ছার সি-গাল ভাসা ভাসা
ওড়ে বহু ক্রোশ।
মধ্যবয়সের ভেলা লগি ঠেলে ঠেলে
চমৎকার শান্ত তীরে নিয়ত ভেড়াতে চাই, ছাড়ি আইমুশা,
আর ভাবি যদি এই জীবনের প্রুফ দেখা যেতো, তবে
কয়েক গ্যালির
কিছু দাঁড়ি কমা উল্টে পাল্টে নিলে আক্শি বাক্শি
নিরুপম সংশোধিত হতো।
জীবনের যে-ভাগ মেঘলা তার চারপাশে সযত্নে দিতাম
বুনে বোদ্দুরের পাড় স্রেফ
কম্পিউটারের দক্ষতায়, ডোবার কচুরিপানা
আহ্লাদে আটখানা হতো নীলপদ্ম। রঙ-ফাউন্ডের
গভীর সঙ্কেতে ক্ষুদ্র চাপাতো শরীরে বৃহতের জামেয়ার।
নির্ঘাৎ ডিলিটি করে অপ্রেমের ‘অ’টা
ভাসতাম চোখ বুজে আ’মরি প্রেমের সরোবরে।
কিছু শব্দ কেটে ছেঁটে ভিন্নতর, শব্দাবলি বসালেই, দ্যাখো,
গলির বসতবাটি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি হবে,-
সামনে বাগান, গাড়ি বারান্দায় সর্বদা নিদেনপক্ষে, টয়োটা প্রস্তুত।
অধিকন্তু বেবাক খবর নেবো জাহাজের, অথচ আদার
ব্যাপারির অপবাদ থাকবে না কোনো।
আরো কিছু হেরফের করা যায়, যতটুকু চাই,
‘সি কপি’র মহিমায়; প্রতিভার হর্স পাওয়ারটা
দিব্যি উস্কে দেয়া যায় অন্তত সহস্রগুণ আর
পয়মন্ত ব্যবসায় ঘন ঘন দাঁও মারলেই সর্বক্ষণ
লুটোবে পায়ের কাছে প্রভুভক্ত কুকুরের মতো
নানান পদবী। তৎক্ষণাৎ ঊনপঞ্চাশ ফর্মার
জীবন চরিতে জানি জন্মাবে আমার অধিকার।
কালের সজাগ চৌকিদার
হেঁকে যাক প্রাণপণে, তুলো গুঁজে কানের বিবরে
খানিক স্পেসিং করে নিয়ে
গৃহিণীর মেদ আর বয়স কমিয়ে একালে আমিও হবো
প্রেমার্ত প্রোজ্জ্বল ক্যাসানোভা।
বস্তুত ড্যাশের পুল পেরুলেই সপ্তম স্বর্গের
সিঁড়ি আলোজ্বলা, স্বপ্ন-ধলা।
আপাতত মধ্যবয়সের তোবড়ানো, রস ফতুর এক
ভেলায় চেঁচাই তারস্বরে, মুহুর্মুহু “ওগো প্রভু, দয়াময়
তাড়াতাড়ি অধমের জীবনের এক তাড়া প্রুফ পাঠাবেন?”
প্রেম তুমি এলে
বুনো হংসের পেছনে ছুটেই
কেটেছে সকাল এবং বিকেল।
চোখ মেলে দূর আকাশের নীলে
শূন্য হস্তে ফিরছি যখন,
প্রেম তুমি এলে করুণ পায়ে।
ভেলার স্বপ্নে বদ্ধ জলায়
ভরা আলস্যে সারা দিনমান
আকণ্ঠ ডুবে মজা অতীতের
সাধের জাবর কাটছি যখন,
প্রেম তুমি এলে অধীর পায়ে।
আড্ডা-পিয়াসী ক্লান্ত শরীরে
রিফু-সাপেক্ষ জামাটা চাপিয়ে,
বোদলেয়ারের জীবন-ভাষ্য
মনে মনে ফের ভাঁজছি যখন,
প্রেম তুমি এলে নগ্ন পায়ে।
চায়ের কাপের বিবর্ণ গায়ে
চোখ রেখে সেই দারুণ হলুদ
নব্বুই-এর গোধূলিপ্রবণ
যুগকে স্মরণ করছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ভ্রষ্ট পায়ে।
মুণ্ডবিহীন লোকটাকে দেখে
‘ওরে মাঝি তোর বৈঠা কোথায়?
বজ্রপাতের ভয়ে সচকিত
কণ্ঠে হঠাৎ বলছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ত্রস্ত পায়ে।
দু’বেলা পিতার সরাইখানায়
চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়ের
সরোবরে ভেসে জীব-জগতকে
থোড়াই কেয়ার করছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ক্লান্ত পায়ে।
নিজের চরকা বিকল ভেবেই
মনকে চালাই নানা কৌশলে।
নবযুবতীর দৃষ্টি কুড়িয়ে
বিরাট শহরে ঘুরছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ব্যগ্র পায়ে।
চোত-বোশেখের ঝড় বয়ে গেলে
আ-মরি সারাটা দেশের ওপর,
খড়পাতা নেড়ে অসীম ধৈর্য্যে
নড়বড়ে ঘর বাঁধছি যখন,
প্রেম তুমি এলে ক্ষিপ্র পায়ে।
রুষ্ট কালের প্রবল দাপটে
অন্ধ গুহায় লুকিয়ে আমিও
আহত পশুর মতো ভয়াবহ
নিজের ক্ষতটা চাটছি যখন,
প্রেম তুমি এলে শান্ত পায়ে।
ঢেকে রেখে মুখ ঘন ঝোপঝাড়ে
এই ইতিহাস-চুল্লীতে শুধু
নিজেকে শুক্নো বড় জোর এক
জ্বালানির কাছ ভাবছি যখন,
প্রেম তুমি এলে দীপ্ত পায়ে।
অনেক লাজুক খর্ব আশাকে
কবরে শুইয়ে, গত শতকের
বহু স্বপ্নের লাশের গন্ধ
কলমে খুঁচিয়ে তুলছি যখন,
প্রেম তুমি এলে নগ্ন পায়ে।
জীবনকে রাজহংস ঠাউরে
তার পশ্চাতে চৌরাস্তায়,
কারখানা আর কলোনীতে, শেডে
উদ্ধাহু, আমি ছুটছি যখন,
প্রেম তুমি এলে সান্ত পায়ে।
সবার সুখের খরদারির
কাজে মেতে বুকে তপ্ত, উদার
পুস্তিকা সব লুকিয়ে, বাঁচিয়ে
ঘরে ঘরে কড়া নাড়ছি যখন,
প্রেম তুমি এলে দৃপ্ত পায়ে।
প্রেমের কবিতা
যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখা
লেকের ধারে সঙ্গোপনে,
বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়
চলছে লড়াই উলুর বনে।
যখন তোমার পায়রা-হাতে হাতটা রেখে
ডুবে থাকি স্বর্গসুখে,
তখন কোনো গোলটেবিলে দাবার ছকে
শ্বেত পায়রাটা মরছে ধুঁকে।
আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,
পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে!
বংশধর
যেদিন আমার পিতামহের কাফন-মোড়া শরীরের ওপর
নশ্বর নক্সার মতো চাংবাঁশটায় পুঞ্জ পুঞ্জ শোক হয়ে কেবলি
ঝরে পড়ছিল কালো মাটির দলা,
তখনও আমি পৃথিবীর কেউ নই।
পিতামহের ডাক নদীর এক তীর থেকে অন্য তীরে
সহজে করতো যাত্রা, শুনেছি।
তাঁর সেই গম্গমে ডাক কবিতার সুরে যেতো মিশে-
এমন কোনো কিংবদন্তীর জন্ম হয়নি আমাদের পরিবারে।
পিতামহীর কথা যখনই ভাবি, শুধু একটি দৃশ্য
ভেসে ওঠে পুরোনো দিনের আরশি ছেড়ে বর্তমানের আয়নায়
ছায়াচ্ছন্ন ঘরে বার্নিশ-চটা পালংকে এগিয়ে-থাকা
বর্ষিয়সী এক মহিলা, চোখ দুটো ভরা দুপুরে
হারিকেনের আলোর মতো নিষ্প্রভ।
তাঁর সেই অনুজ্জ্বল এক-জোড়া চোখ
কোনোদিন কবিতার পংক্তির আভায় জ্বলজ্বলে
হয়েছিল কিনা, জানি না।
আমার মাতামহ সকালের চঞ্চল বেলায় বারংবার
বুক-পকেট থেকে চেন-বন্দি ঘড়িটা দেখতেন
আর দশটার আগেই ছাতা হাতে ছুটতেন
কাচারির দিকে-সেখানে প্রায়-অনুল্লেখ্য কোনো
কাজ করতেন তিনি। একটা টাইপরাইটার ছিল তাঁর;
মাঝে-মাঝে দেখতাম কয়েকটি অভিজ্ঞ আঙুল
ব্যালে নর্তকের মতো নেচে চলেছে কী-বোর্ডে।
যতদূর জানি, মাতামহের সেই অতি-পুরাতন শব্দসমূদয়
কাব্যের পাড়ার কেউ ছিল না।
আমার মাতামহী, সবার অলক্ষ্যে যিনি শাদা অথচ সুদীর্ঘ
চুল আঁচড়াতেন মধ্যদিনে কাঠের চিরুনি দিয়ে আর
সন্ধ্যা হলেই মুরগির বাচ্চাগুলোকে দর্বায় পোরার জন্যে
অস্থির পায়ে করতেন ছুটোছুটি-যত আন্দোলিত হতেন আমার
মাতামহের ডাকে ততটা আর কিছুতেই নয়।
বুঝি তাই কবিতার ডাক তাকে কখনও কাছে টানেনি।
আমার পিতা, সেই অমিতবিক্রম সিংহপুরুষ,
জীবনের দুটো শিং ধরে লড়তে লড়তে নিজেকে যিনি
ক্লান্ত করেছিলেন, যিনি ভালোবাসতেন হেঁটে যেতে
সুঘ্রাণ ভরা শস্য-ক্ষেতের আলের ওপর,
কোনোদিন পা বাড়াননি কাব্যের প্রান্তরে।
না, তাঁরা কেউ পা রাখেননি নিঃসঙ্গতার উথালপাথাল
সমুদ্র-ঘেরা কবিতার দ্বীপপুঞ্জে! কিন্তু ঐ পুণ্যজনের
স্মৃতির অজর শরীরে
কবিতার সোনালি রূপালি জল ছিটোচ্ছে
তাঁদেরই এক ফ্যাকাসে বংশধর
সময়ের হিংস্র আঁচড়ে ক্রমাগত জর্জর হতে হতে।