- বইয়ের নামঃ নিরালোকে দিব্যরথ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অধর্মণের গান
সাধের তবিলদারি নিশ্চিত ঠেকেছে তলানিতে,
উপরন্তু দেনায় ডুবেছে মাথা, তবু হু-হু আভিজাত্যে মজে
মাকড়সা, আরশোলাময় অন্ধকার ঘরে বসে
মন উচাটন। ওরে আমি অসময়ে কোথা যাবো?
আমিতো দাসানুদাস, খাস তালুকের প্রজা, জানি
রতন মাণিক্য কতো প’ড়ে আছে সেই জলে, অথচ কখনো
পারিনি তুলতে একরত্তি। বাজারে বাজার করো মন বলে
এ-পাড়া ও-পাড়া করি, আদা কাঁচকলা কিনে থলির দীনতা
সযত্নে লুকোই আর কোনোমতে আধপেটা খেয়ে শতচ্ছিন্ন
কম্বল সম্বল করে শোধনবাদের ছিদ্র খুঁজি, গুলতাপ্পি,
কটুকাটব্যের ঝড় তুলি নিত্য ধারের বুলির ভরসায়।
আর কী মজার কাণ্ড, দু’হাতে রোখেন যারা ক্ষিপ্র আগামীকে,
তারাই সহজে আজ মাথায় বুলিয়ে হাত প্রগতির পথ বাৎলান।
পুরোনো কুকুর-ঘরে গুমনাম স্বপ্ন কতিপয়
রেখেছি গচ্ছিত, তারই প্ররোচনা হৃদয়ের চোরকুঠরিতে
চৈত্ররজনীর স্মৃতি আনে মধ্যে মধ্যে-দেখি, তুমি আছো এই আটত্রিশ
বছরের অভিজ্ঞ পাঁজর ঘেঁষে, উন্মোচিত শরীরের দীপ্ত রাজধানী।
চোখের পাতায় জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্না চুল, স্নিগ্ধ বাহু, মিনার-গ্রীবায়-
জ্যোৎস্নায় বাসনা চরে, যেন রাজহাঁস,
রক্তিম চঞ্চুর আভা ছড়িয়ে হাওয়ায় লীলায়িত।
সোনালি বৃক্ষের ডাল থেকে পাখি নেমে এসে
গান গায় হৃদয়ের উন্মুক্ত খাঁচায়,
বাঁচায় অতনু অতীতকে। অথচ ফেরালে মুখ
চাঁদের ফালিটি দেখি হৃদয়ের ভরা
ক্ষতকে খোঁচায় কৌতুকের বক্রতায়।
প্রচুর আদর খেয়ে প্রকৃতির বসন্তের পেছনে পেছনে
করি ধাওয়া, খুঁজি তাকে দিনমজুরের
খুপরিতে, রেশনের দোকানের দীর্ঘ পাঁচমিশেলী কাতারে,
মুদীর চালায়, কারখানায়,
আর ঢেউ-খেলানো টিনের ছাদে, ডোবার কিনারে।
সেখানে বসন্ত কৈ? বস্তুত অধুনা
বসন্ত প্রতিষ্ঠা খোঁজে তারুণ্যের উদ্দাম মিছিলে,
সংস্কৃতির উচ্চকিত স্বাধিকারে, পর্বত-টলানো হরতালে।
ধরনি ন জাই অনীতি ঘোর নিশাচর জো করহিঁ,
হিংসা পর অতি প্রীতি তিন্হ কে পাপহি করনি মিতি।
বাঢ়ে খল বহু চোর জুআরা।
যে লম্পট পর ধন পর দারা।।
মানহিঁ মাতু পিতা নহি দেবা।
সাধুন্ হ সন কব্রারহিঁ সেবা।।
আমাদের শতকের শোক, জরা, ব্যাধি বড় বেশি
ভাবিত, বিপন্ন করে। দীর্ঘদেহী ইতিহাস অবেলায়
ছায়া ফেলে যায় যুগান্তের করিডরে। প্রত্যুষের শাদা
মোরগের কিরীটের মতো সূর্য আমরা দেখিনি
কতকাল, কতকাল নৈঃসঙ্গ্যের ক্রুশকাঠ বয়ে
ফুটিয়েছি কতো রক্তগোলাপ পাথুরে মৃত্তিকায়
ওরা পা রাখবে বলে। অথচ এখনো স্পষ্ট কোনো
পদধ্বনি এ শহরে আমরা শুনিনি। চাঁদটাকে
কে যেন করবে গ্রাস, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুগুলি
দলে দলে তৃণহীন মাটি ফুঁড়ে অতৃপ্ত ক্ষুধায়
আবার জেগেছে যেন।
ত্রাসের রথের চাকা দ্রুত
দলিত খণ্ডিত করে, আমাদের নগ্ন কাঁধে কোনো
দেবদূত ভুলক্রমে মহিমার হাত রাখলেও
ভাসে না আনাড়ি চোখে স্বর্গোদ্যান আজ।
সেদিন দেখেছি স্বপ্নে আবার এলেন তিনি ম্লান
জটিল পাঁচিল ঘেঁষে-এলেন আমার পিতা, মৃত,
ক্রুদ্ধ, অনুযোগে কম্পমান। তবে কি বেয়াড়া কিছু
ঘটেছে শহরে?
তবে কি আমার কাছে চান কোনো প্রতিকার অশরীরী পিতা?
তেমন যোগ্যতা নেই, বুঝি তাই ভয়ার্ত ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি
চকিতে উঠলো কেঁপে রাত্রির হাওয়ায়,
কেবলি প্রেতের সঙ্গে জমাই আলাপ।
কারাগারে, কখনো-বা চোরকুঠরিতে
ভাঁড় আর ঘাতকের, কপট বন্ধুর কাঁধ ঘেঁষে
লুকিয়ে বুকের ক্ষত হাঁটি একা নিদ্রাতুর এই
শহরের অলিতে-গলিতে। দৃশ্যান্তরে
উন্মাদিনী কাঁদে, ভাসে জলের ভিতরে,
লতাগুল্মে নিদ্রায় নিথর!
শবাকীর্ণ মঞ্চে আমি ভীষণ দোমনা, নিরুপায়।
তবে কি কৃপার পাত্র আমি? পাদপ্রদীপের নিচে
চিরদিন অভ্যর্থনাহীন?
এখানে কোথাও কেউ কারো প্রতি নয় মনোযোগী,
অথচ বচসা করে অবোধ্য ভাষায়, রাতারাতি বাচম্পতি
হতে চায় দায়িত্বের চন্দচর্চিত ললাটের মহিমায়।
আপন-বাঁচার যোগী এখানে সবাই
আজকাল। জীবনের উঁচু উঁচু ডালের অতীব
পুরুষ্ট ফলের গুচ্ছে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে
ক্লান্ত হলে ঘরে ফেরে, করে খুনসুটি
খানিক স্বপ্নের সঙ্গে। অথচ এদিকে
দেনায় ডুবেছে মাথা, ঘরের খুঁটিতে ঘুণ, ভিত টলোমলো।
আমার স্বরের ডালে
আমার স্বরের ডালে কুড়ি ধরার দিনগুলি
এখনো জাগিয়ে তোলে আমাকে সমস্ত আচ্ছন্নতা থেকে আর
মনে পড়ে, সেই কুড়ি প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই
অনেকগুলো নোংরা নখ, কালো তারকাঁটার মতো,
ঘিরে ধরলো আমার স্বরের ডালটাকে।
সেদিন থেকে আমার হৃদয় ঝরনার মতো রক্ত ঝরায়,
সেদিন থেকে আমার কণ্ঠস্বর এক তীব্র আর্তনাদ।
লোর্কার মতো শিল্পের আবেগে বাতাসে গোলাপের পাপড়ি হয়ে,
গিটারে গিটারে গুঞ্জরিত গীতিকবিতা হয়ে,
আন্দালুশীর মাল্লাদের গান হয়ে
কেঁপেছি থরোথরো, অথচ তাঁর মতো অজর কবিতা-যে কবিতা
স্পেনের নিশ্বাস হয়ে বয়ে চলেছে আজো পাহাড়ে, সমুদ্রতটে,
রমণীর পুষ্পিত বুকে, পুরুষের কম্পিত ঠোঁটে-
লিখতে পারবো না কোনদিন।
তপ্ত গোলাপের মতো লোর্কার একেকটি কবিতা
আমাকে অন্ধকার থেকে করেছে উদ্ধার, একেকদিন
শুধু কয়েকটি শব্দ কণ্ঠে ধারণ করে, লালন করে ঝাঁঝালো আদরে
কেটে গেছে প্রহরের পর প্রহর,
সেদিন থেকে মৃত্যুকে ঘেন্না করতে শিখেছি আমি।
লোর্কার উচ্চারণে গোলাপের গভীর নাম ধরে ডেকে ডেকে
সুঘ্রাণ করতে চেয়েছি সত্তা। আমার শয্যার বাগানে
যে-পাখি ব্যাকুল এক গান থেকে আরেক গানের দিকে করে যাত্রা,
তার কণ্ঠে গোলাপ-গজলের সুর ধ্বনিত হোক, চেয়েছিলাম।
অথচ আমার সত্তার ডালপালায়
ঝটিতি বয়ে গেল শুধু কনকনে আর্তনাদ।
চোখের পাতায় কিংবা অক্ষি-গোলকের পরপারে
চিরকাল এক স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে
আমি দয়িতাকে আলোয় গলে যেতে দেখেছি।
যতবার সেই গলে-যাওয়া আলো
আঁজলা ভরে পান করার জন্যে অধীর হয়েছি, ততবার
সূর্য ‘আমার পুচ্ছে’
চাঁদ আমার গলায়
তোর কবর বলে চেঁচিয়ে উঠেছে আর
আমার সমস্ত ভালোবাসা আর্তনাদ হয়ে ঝরে গেছে
খুরে খুরে মাটি খুঁড়ে তোলা এক কালো ঘোড়ার পায়ে।
লোর্কার কণ্ঠ ওরা চিরতরে স্তব্ধ করবে ভেবেছিল
কবির রক্তে রাঙিয়ে শূন্য, হাঁ করা প্রান্তর,
কিন্তু ঐ দ্যাখো তাঁর ক্ষত গোলাপের মতো জ্বলছে,
দুলছে কালকণ্ঠে। শৃন্বন্তু অমৃতস্য পুত্রা
লোর্কার কণ্ঠ সেকালের সব পাহাড়, উপত্যকা, আপেলের বন,
প্রান্তর পেরিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে একালে।
মৃত্যুর কালো আলখাল্লায় মুক্তো হয়ে
ঝলমল করছে লোর্কার একেকটি বালাদ, গোলাপের কাসিদা।
আমি কর্ডোভার ঘোড়সওয়ার নই,
দিনের সোনালি ঝরনায় অবগাহন করে হেঁটে যাই
চেনা অচেনা বহু সোজা, বহু ঘোরানো রাস্তায়,
তবু লোর্কার বালাদ মিশে যায়
আমার স্বরের ডাল থেকে ঝরে-পড়া আর্তনাদে।
না, আমরা কেউ সুখী নই।
ভাড়াটে বাচস্পতির বাছা বাছা বাক্য
আমাদের কানের বিবরে গিরগিটি সেজে সুড়সুড়ি দেয় শুধু।
শিশুরা খেলাঘর ছেড়ে গোরস্থাএ যায় বড় বেশি,
মেয়েরা পৃথিবীতে সন্তান আনতে আনতে ফৌত হয়ে যায়,
যুবকেরা সুদিনের চৌকাঠে কখনো পা না রেখেই
একদিন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে গলির মোড়ে, পার্কের ধারে
আর চশমার পুরু কাচ-ঢাকা চোখ দিয়ে
চাটতে থাকে শৈশব-স্মৃতিকে,
যেমন খড়-ঠাসা বাছুরের গা চাটে ধবলী।
ভদ্রমহোদয়গণ,
এই গাছপালাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,
ঘরের এক কোণে-রাখা ভাঙা হারিকেন,
সেজো-অধ্যুষিত গলির কানা বেড়াল
অথবা মেথরপট্রির নেড়ী কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,
আমরা সুখী নই কেউ।
বিশ্বেস করুন,
এদেশের পোকা-মাকড়, জীবজন্তুগুলোসুদ্ধ ভীষণ অসুখী।