Site icon BnBoi.Com

নায়কের ছায়া – শামসুর রাহমান

নায়কের ছায়া - শামসুর রাহমান

অচেনা শহরে

স্বপ্নে দেখি পর্যটন বিভাগ অথবা
অন্য কারো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ভিনদেশী কী এক অচেনা
শহরে প্রবেশ করি আমি বেলাবেলি
অবলীলাক্রমে, দেখি সেখানেও ফোটে রক্তজবা,
জুঁই ও চামেলি।
সেখান করে দেনা লোকজন? দোকানপাটের জ্বলজ্বলে শোভা আর
অত্যন্ত বনেদী ক্লাব, শিশু পার্ক, স্টেডিয়াম, পৌরসভা আছে
সেখানেও, আছে ব্যাংক আর সিনেমার কাউণ্টার।

আমাকে চেনে না কেউ অচেনা শহরে। কারো কাছে
গিয়ে আমি দাঁড়ালেও, হাত
বাড়ালেও কোনো সাড়া পাই না। যদিও সকলেই
স্বাভাবিক চোখ মুখ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী। অকস্মাৎ
মনে হয়, বুঝি বা ওদের কোনো সাধ আহলাদ নেই।

বেজায় অটোমেটিক ওরা ঘোরে, হাঁটে
ভাবলেশহীন,
রা’ কাড়ে না কেউ, কিংবা চকিত পাখির পাখসাটে
পলক পড়ে না কারো চোখে। রাত্রিদিন
একাকার, কেউ কারো সঙ্গে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা
বলে কিংবা কুশল জিজ্ঞেশ করে হেসে,
পাইনি প্রমাণ তার। কোনো ব্যাকুলতা
নেই কারো বুকের ভেতর। ভালোবেসে
পরস্পর কেউ এক লহমাও তাকায় না কারো
দিকে, ওরা ঘোরে শুধু ঘোরে
চক্রাকারে গাঢ়
অন্ধকারে আর কখনো পথের মোড়ে
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, যেমন পুতুল
থেমে যায় হঠাৎ চাবির দম ফুরোলে। নিকটে
গিয়ে ছু’য়ে দেখি, কারো মধ্যে নেই প্রাণের স্পন্দন। নাকি ভুল
করে ভাবি মৃত ওরা। সেখানে যা ঘটে,
কেমন অলীক সবই। সেখানে কবির খাতা থেকে
বেবাক অক্ষর
মুছে যায় প্রবল অদৃশ্য ফুঁয়ে, দবিজ ধুলোয় যায় ঢেকে
অসহায় গায়কের ফুল্ল কণ্ঠস্বর।
স্বপ্নের ভেতরে আমি নিজেকে চিমটি কেটে দেখি
সত্যি নিজে বেঁচে আছি কিনা, এ কেমন মরশুম
অচেনা শহরে দেখি। ভীষণ শীতল সব, এ কি
সেখানে আমিও মরহুম!

অন্যরকম যুদ্ধ

তবে কি আখেরে আমি মাথা নত করে চলে যাবো
এমন জাজ্বল্যমান দ্বিপ্রহরে নামিয়ে উষ্ণীষ? যদি যাই,
গাছপালা, নদীনালা, উদাস প্রান্তর, আর ধূসর পাথর
নীল আসমান, রোদ্দুরের
চমকিলা বদ্বুদ পায়রা, বাজপাখি , এমন কি
মালিক, চড়ুই আর শেয়াল-কুকুর
কাপুরুষ বলে দেবে তুমুল ধিক্কার।

প্রতিপক্ষ ডান দিক থেকে ঘনঘন বুক ঠুকে
দিচ্ছে ডাক, ছাড়ছে হুঙ্কার,
বাজে রণঢাক, শুনি অবিরত তুলছে ধনুকে
প্রবল টঙ্কার। অশ্বক্ষুরে
পায়ের নিচের মাটি কম্পমান, মত্ত কেশরের
ঢেউ নাচে দিগ্ধিদিক, জান্তব নিশ্বাস আগুনের
হল্কার মতন এসে লাগে
চোখে-মুখে। পিপাসার্ত মাটি
আমার গরম রক্ত শুষে নেবে বলে সর্বক্ষণ
চাটে শুক্‌নো ঠোঁট।

অথচ এখনো আমি রয়েছি দাঁড়িয়ে
প্রবল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি, মানে বামদিকে
অবিচল। চারদিক থেকে
আসুক তীরের ঝড়, নামুক বিরোধী ঢল, তবু,
মাথা নত করে আমি হবো না উধাও
রণে ভঙ্গ দিয়ে, পরাজিত
মানুষের মতো ঘষবো না মুখ ধুলায় অথবা
বিপর্যস্ত ঘাসে। জানি, সপ্তরথী ক্রুর অবেলায়
আমাকে ফেলেছে ঘিরে, দিচ্ছে হাঁক; অসি,
বল্লম ঝলসে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, কিন্তু আমি অভিমন্যু নই;
ভয়ংকর ব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসার
গূঢ় মন্ত্র এখনো ভুলিনি। উপরন্তু কী অটল
রয়েছে আমার হাতে জ্বলজ্বলে মৌলিক ধনুক।

আমার নিজস্ব তূণ থেকে সহজে আনবো আমি
হিংসার বদলে ভালোবাসা,
আমার রথের চাকা ধ্বংসের প্রান্তরে
করবে কর্ষণ মৈত্রী বৈরিতার কালে,
স্বপ্নের কেয়ারি হবে তৈরি দিকে দিকে। নিত্য ফুল
ফোটাবো ব্যাপক শূন্যে, সে পুষ্পশোভায়
অন্ধ হবে রক্তজবা-চোখে এবং বাঁচার গানে
স্তব্ধ করে দেবো প্রতিপক্ষের হুঙ্কার।

আবার কখন তুমি

তুমি টেলিফোন রেখে দেবার পরেই আচমকা
নিজেকে রবিনসন ক্রুশো মনে হলো।
আমার বুকের
ভেতরটা খুব ক্ষত বিক্ষত এখন এই সকাল বেলায়
ঝাঁক ঝাঁক কাক আর খুব রাগী বকের নখের হামলায়।

‘নির্বাসন, নির্বাসন’ বলে হয় অতিশয় বিদ্রূপপ্রবণ
ঘরের চৌকাঠ, জানালার পর্দা, একাকী চেয়ার,
যাবতীয় পুরোনো দলিল দস্তাবেজ,
আর জুতোজোড়া, যারা সময়ের চুমোয় চুমোয়
বয়স্ক হয়েছে খুব, যাদের বেকুব মুখ একবিংশ শতাব্দীর দিকে
সারাক্ষণ,
রবীন্দ্ররচনাবলী, ডাস ক্যাপিটাল,
এবং অস্তিত্ববাদী দর্শনের বই।

পূর্ণিমার কাছ থেকে পেয়েছি আত্মার রঙ আর
যে-গোলাপ স্বপ্নে দেখি রবীন্দ্রনাথের
করতলে, তাকে জানি প্রেম বলে, প্রেম
প্রেমই, তার বেশি কিংবা কম কিছু নয়।
আমি তো প্রেমের গূঢ় পাঠ নিই হরিণের কাছে,
কখনো বা জ্যোৎস্নাস্নাত নেকড়ের কাছে
এবং শিখেছি ঘৃণা মানুষের ব্যাপক সৌজন্যে বহুদিন।

তুমি টেলিফোন রেখে দেবার পরেই
মমতাবিহীন দীর্ঘ দিপান্তরে আছি।
তুমি কি জানোনা
নানা দিকে উল্টোপাল্টা ছুটতে ছুটতে
বহু কাঁটাবন

বহু বালিয়াড়ি আর দুঃস্বপ্ন-বিমূঢ় অলিগলি
পেরিয়ে এসেছি
তোমার দিকেই আমি এসেছি আখেরে?
তুমি কি জানোনা
আমার গলার
ঈষৎ-কুচকে যাওয়া চামড়া পুনরায়
আশ্চর্য মসৃণ হয় তোমার চুম্বনে?
তুমি কি জানোনা
তোমার সান্নিধ্য পেলে কেমন আপ্লুত, এলোমেলো
হয়ে যায় আমার এ মোতাজিলা মন?

তোমার চোখের মতো এমন গভীর চোখ দেখিনি কখনো,
তোমার সুরেলা কষ্ঠস্বরে যে-মাধুর্য সঞ্চরণশীল, তার
উপমা দুর্লভ আর অনুপম শরীরের আশ্বিন তোমার
এবং তোমার মতো এমন সংস্কার ছিঁড়ে ভালোবেসেছে কি
কখনো আমাকে কেউ?
তবে কেন জেনেশুনে এত ধুধু যোগাযোগহীন
করো বসবাস এই কোলাহল-বিহ্বল শহরে
এমন নিঃসাড়।
আবার কখন হাওয়া, মেঘমালা হবে ভালোবাসা,
প্রতীক্ষায় আছি
প্রতীক্ষায় আছি
প্রতীক্ষায় আছি।

উত্তরের জন্যে

বিকেলবেলা
আমি একা বসে আছি তোমাদের ড্রইং রুমে
সময় কাটতে চায় না, মুহূর্তগুলি
বিকল ট্যাপের পানির মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।

সাপ্তাহিক টাইমের পাতা উল্টিয়ে এলেবেলে
আমি সময় কাটাতে চাইলাম,
সময় কাটে না। দেয়ালে চোখ রেখে কবিতার
ভুলে-যাওয়া পংক্তি মনে করতে চাই, অনেকক্ষণ
তাকিয়ে থাকি টেরাকোটার যুগল মূর্তির দিকে, দীর্ঘস্থায়ী
শিল্পির চুম্বনে অপেক্ষার ক্লান্তি মুছে ফেলার আশায়।

দরজার পর্দা সরিয়ে তুমি এলে;
পরনে তোমার টাঙ্গাইলের শাড়ি, খোলা চুল
আশ্রয় নিয়েছে পিঠে, সারা মুখে
দুপুরের ঘুমের লাবণ্যময় ছাপ। তোমার যৌবনের তরঙ্গ
মেরুন রঙের সোফায়।

গৃহভৃত্য চায়ের সরঞ্জাম রেখে যায়, তুমি
আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে সধূম চায়ের কাপ।
‘আমি চা খাইনা’, বললাম এখানে আমি চা খেতে আসিনি,
উচ্চারণ করি মনে মনে।

আরেক বিকেলে তুমি তোমার উদ্যানের
একটি ফুল উপহার দিলে আমাকে। ফুল আমি ভালোবাসি,
কিন্তু বাগানের ফুল নিতে আমি আসিনি, এ-কথা
আমার ঠোঁটে স্তব্ধ হয়ে রইলো।
একদিন আমি দ্বিধায় উথাল-পাথাল স্বরে
তোমাকে বললাম, ‘আমি তোমার বুকের ভেতরকার
ঘ্রাণ নিতে চাই’। তুমি নিরুত্তর; সোফার
হাতলে আঙুলে তাল বাজাচ্ছিলে, যেমন পিয়ানিস্ট
রিডে রিডে আঙল নাচায়।

আমার জীবন কবরের মোমবাতির মতো
দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ উত্তর আজো পাইনি।

এখন তোমার ছুটি নেই

একদা সেই কোন্‌ খেয়ালে খুব আড়ালে
একলা তুমি বেলাবেলি পা বাড়ালে।
বৃথাই এখন খুঁজছো ডেরা আশেপাশে,
বৃথাই তুমি ঘুমোতে চাও শান্ত ঘাসে-
ছুটতে হবে, আরো অনেক ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।

কখন থেকে বের করে জিভ ছুটছো। শুধু
ছায়াবিহীন পথের কায়া করছে ধুধু;
একটু গেলেই পথের সীমা যাচ্ছে বেড়ে,
ভয়-দেখানো জন্তুগুলি আসছে তেড়ে,
সামনে তবু ছুটতে হবে, ছুটতে হবে;
এখন তোমার ছুটি নেই।

ক্লান্তি হঠাৎ কির্কী হ’য়ে তোমার গালে
ওষ্ঠ রেখে বাঁধতে পারে কুহক-জালে;
ধুলোর ঝড়ে অন্ধ হ’য়ে ঘুরতে পারো,
বন্ধ হ’তে পারে সাধের সিংহদ্বারও,
তবু ভীষণ ছুটতে হবে, ছুটতে হবে;
এখন তোমার ছুটি নেই।

পেছন ফিরে তাকাও যদি বারেবারে,
একটু তুমি জিরোও যদি পথের ধারে,
রুক্ষ পথে চক্ষু যদি আসে বুজে,
সামনে পথের সীমানা আর না পাও খুঁজে,
একলা পথে ছুটতে হবে, ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।

মিনার টিনার দেখতে তুমি পাচ্ছো না কি?
পড়লো চোখে অচিন বাগের স্বর্ণ পাখি?
দৃষ্টি যদি আহত হয় নেই-এর ঘায়ে,
তীক্ষ্ম কাঁটা বিঁধতে থাকে যুগল পায়ে,
ব্যগ্র পায়ে ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।

খাদের পাশে পৌঁছে শুধু থাকবে চেয়ে?
ভয় পেলে কি ক’খানা হাড় দেখতে পেয়ে?
লক্ষ্য তোমার ক্রমাগত যাচ্ছে সরে?
পাথুরে সব মূর্তিগুলি থাকুক পড়ে;
ছুটতে হবে, দ্বিধাবিহীন, ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।

এখনো খুঁজছি

সেই কবে তুলে নিয়েছিলাম হাতে,
এখনো আছে;
আমি আমার কলমের কথা বলছি।

তার চাঞ্চল্যের মাধুর্য এখনো অস্ত যায়নি,
তাই, এখনো গাধার খাটুনি খেটে দিনের পর দিন
বিস্তর আগাছা উপড়ে ফেলে
অলৌকিক ফুলের কেয়ারি বানাই।

এই আমার কলম প্রত্যহ শোনে
সপ্তকাণ্ড কাহিনী
যার মুখে যা আসে শুনিয়ে যায়,
অনেকে পায়ে পড়ে করে নসিহত
কেউ কেউ চৌরাস্তায় চোখ রাঙায়,
আবার কেউবা বলে স্নেহার্দ্র চোখে-
আহা, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

যা বলতে চাই, আমার কলম, কম-বেশি,
তারই প্রতিধ্বনি, কখনো স্পষ্ট,
কখনোবা অস্পষ্ট,
স্বপ্নে-শোনা কোনো গুঞ্জনের মতো।

আমার সৌভাগ্য, এই যে কলম আমার,
যাকে আমি প্রাণপণ আঁকড়ে রয়েছি দিনরাত্তির,
তার ভাষা উদ্ভাসিত দেবদূতের হাসি,
যা আমি দেখেছিলাম এক বর্ষাগাঢ় রাত্রে।

সে ভাষায় ছায়া ফেলে সমুদ্র থেকে উঠে-আসা
জলকন্যার চোখের রহস্যময়তা;
যে-জন সর্বস্ব আমার,
তার অস্তিত্বের কলতান সে ভাষায়।

বজ্রপাতে দগ্ধ হয়েছে যে পাখির নীড়
তার আর্তনাদ আমার কলমাশ্রিত।
গহন অরণ্যে হরিণের খুশির লাফ
সোনালি সাপের সুন্দর প্রস্থান,
কিংবা শববাহকদের উদাস বসে থাকা
কবরে পুষ্পার্পণ,
স্নিগ্ধ ঝরণার ধারে বনজ প্রাণীর সংসর্গে
অর্ফিয়ুসের বংশীধ্বনি,
চাঁদ সদাগর আর মনসার অপোসহীন বিবাদ,
নহর নির্মাণকালে পাথর আর লতাগুল্মের সঙ্গে
ফরহাদের আলাপ,-
সবকিছুই সাবলীল ফোটে আমার কলমের আঁচড়ে।
আজ আমি কলমের চোখে চোখ রেখে অকুণ্ঠ
বলতে পারি ধন্যবাদ, বন্ধু, ধন্যবাদ।
ব্যাপারটা, মানে কবি হিসেবে, মোটামুটি তৃপ্তিকর।

অথচ আবার প্রায়শঃই একটা ব্যর্থতাবোধ
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভয়ানক ক্লান্ত করে আমাকে,
বিপন্ন করে। কেননা, বলিভিয়ার জঙ্গলে
গুলীবিদ্ধ চেগুয়েভারার স্বর্গীয় নিদ্রার ভাষা
আমার অনায়ত্ত
এবং
মাতৃভাষার জন্যে, স্বদেশের জন্যে যে তরুণ বুকের খুন
ঝরিয়েছে রাস্তায়, সে রক্তের ভাষার কাছে
কী অসহায় আর আনাড়ী রয়ে গেলাম এখনো,
কেমন ভাষাহীন। সে ভাষার মতন
একটা কিছু আমি খুঁজছি, এখনো খুঁজছি।

এতদিনে জেনে গেছি

এতদিনে স্রেফ জেনে গেছি,
অনেকের অনেক কিছুই করবার কথা নয়,
তবু করে। কারো কারো ঠিক
যে-পথে যাবার কথা,
সে পথে যায় না তারা ভুলেও কখনো।

সাজ্জাদ গেরস্তমন নিয়ে জন্মেছিল, বলা যায়;
অথচ সে একটি মুখর ঘর আর
নিকানো উঠোন
ছেড়েছুড়ে কোথায় যে গেল, তার
হদিশ মেলেনি আজো। কখনো কখনো
উড়ো কথা শোনা যায়, সে নাকি সুদূর
পীরের মাজারে ঘোরে, সিন্নি খায়, ঘুমায় বেগানা
আস্তানায়।

মাশুক নির্ভুল অঙ্ক কষতে পারেনি কোনোদিন,
এখন সে প্রত্যহ দরকারী
হিশেব মেলাচ্ছে অতিশয় মনোযোগ সহকারে
সরকারি দপ্তরে।
আঝাস নিশ্চুপ ছিল বড়, ওর মুখে
বিষাদের মেঘ
ভাসতো সর্বদা, মনে হতো
আড্ডা থেকে বেরিয়েই আত্মঘাতী হবে
যে-কোনো রহস্যময় রাতে একা ঘরে
অথবা সকালে। অথচ সে
পেতেছে সংসার আর ছোট পরিবার
সুখী পরিবার শ্লোগানের মুখে দিব্যি তুড়ি মেরে
সাত সন্তানের হয়েছে জনক।

আর যাকে নঈমকে, আমরা বেজায়
চুলবুলে বাচাল যুবক ভাবতাম
এবং খানিক স্থূল; কী অবাক কাণ্ড, একদিন
সে-ই খেলো বড় বেশি ডোজে নিদ্রাবড়ি।

হাশমত, প্রায়শই যে দেখতো স্বপ্নে সূর্যমুখী
ফুল,
কাটতো সময় যার দিবাস্বপ্ন দেখে,
দেশের বিপন্ন ডাকে
সে দিলো প্রবল সাড়া, গেল
মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরে।
দেশ ভ্রমণের খুব শখ ছিল তার,
এখন সে নিত্যদিন হুইল চেয়ারে বসে সূর্যাস্তের রঙ
দ্যাখে, মাঝে মাঝে ফ্যালে চাপা দীর্ঘশ্বাস
দেশের দশের কথা
এবং নিজের কথা ভেবে।

এবং আমার কথা ছিল
ছবি আঁকবার,
যদিও আমার জনকের বিবেচনা
ছিল বিপরীত কিছু, ভাবতেন তিনি স্বপ্নঘোরে-
আমি হবো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
জেদী আমি তার স্বপ্নগুলি
গুঁড়িয়ে কাচের দামী বাসনের মতো,
একটু আলাদাভাবে রেখেছি আমার কথা; আমি
ছবি লিখি অক্ষরে অক্ষরে।

 কবির কুকুর

যখন লেখেন তিনি অথবা পড়েন কোনো বই
ভোরবেলা গহন দুপুরে মধ্যরাতে, তখন সে
শুয়ে থাকে নিরিবিলি মেঝেতে একাকী ভারি খুব
কাছ ঘেঁষে, বলা যায়, পায়ের কাছেই। মাঝে মাঝে
হাই তোলে, কৌতূহলী চোখে চেয়ে দ্যাখে কী অস্থির
তিনি করছেন পায়চারি ঘরময়, কখনোবা
ঘাঁটছেন অভিধান, যেমন বালক ঝিনুকের
লোভে খোঁড়ে বালি নদীতীরে; দ্যাখে কবির ওপর
কে যেন করেছে ভর, বুঝি তাই পাতায় পাতায়
নিমিষে উঠছে ফুটে গোলাপের গহনতা, গূঢ়
রজনীগন্ধার গ্রীবা, ভেজা বালিতে চিত্রল কিছু
হরিণের পদচ্ছাপ, চিতাবাঘের অত্যুগ্র রঙ
জ্বলজ্বলে, যুথচারী হাতির সফেদ দাঁত, যেন
পুরুষ্টু চাঁদের ফালি। আর কল্পনায় খরা এলে
ব্যেপে, তিনি নিঃসাড় থাকেন বসে একা, চুপচাপ-
শব্দের মৃগায় স্তব্ধ জটিল অরণ্যে অকস্মাৎ।

যখন ঘুমোতে যান তিনি খাটে বাতিটা নিভিয়ে,
তখন সে নড়েচড়ে ওঠে, মাথাটা ঝাঁকিয়ে মাছি
তাড়াবার সঙ্গে ক্ষিপ্র দাঁড়ায় সটান, তার চোখ
থেকে ঝরে ক্রমাগত মণিরত্ন, রাশি রাশি, আর
হঠাৎ উৎকর্ণ হয়, যেন এই মাত্র রেডিওতে
শুনেছে বিপজ্জনক আবহাওয়া বার্তা কোনো বুঝি
এল ঝড় ভয়ঙ্কর কাঁপিয়ে দুনিয়া, যেন তার
জঠরে পড়েছে ঢুকে হাওয়াময় অন্ধকার, যেন
এখুনি ঘরের ছাদ ধসে পড়ে মাথার ওপর,
প্রেতের দঙ্গল করে ফিসফিস ঘরের চৌকাঠে।
ঘোরে সে কিসের ঘোরে কবির শয্যার চারপাশে,
ডেকে ওঠে বারংবার জীবনের মতো কণ্ঠস্বরে
বিনিদ্র কুকুর।

কী সঞ্চয় রেখেছো

কালের কামড়-খাওয়া ছন্নছাড়া হে বংশীবাদক
তুমি কি নিজেই হবে নিজের খাদক
আত্মনাশী প্রাণীর মতন আজ? এখন, এখন কেন আর
আক্ষেপের সুর শুধু বাজাও একাকী বারবার?
বস্তুত এই তো চেয়েছিলে…
এই মতো গাছপালা দেখে দেখে, আসমানী নীলে
চোখ রেখে, কখনো উদাস
প্রান্তরে পথিক হয়ে মনের মোহন ফরমাশ
খেটে খেটে হৃদয়ের অন্ধকারে অজস্র কুসুম
ফুটিয়ে নেপথ্যে বেঁচে থাকা; খড়কুটোময় অত্যন্ত নিঝুম
দ্বিপ্রহরে খরগোশের দৌড়, হরিণের আনন্দিত লাফ মনে
তুলে নেয়া আর গৃহকোণে
বিড়ালের নিরিবিলি ঘুমের ভিতরে
বসবাস, ফেরেশতার পাখার ছায়ায় বুক ভরে
সুগন্ধি বাতাস নেয়া-এর চেয়ে বেশি কিছুর উদ্দেশে
কখনো গায়নি গান আকাঙ্ক্ষা তোমার। মেঘে ভেসে

ভেসে সারাদিনমান তুমি কি আপনার বংশী ধ্বনি শুনে
কিংবা তারা গুণে
গুণে মধ্য রাতে খুব ক্লান্ত হয়ে গ্যাছো? বুঝি তাই পূর্ণিমার,
ফুলের পাখির সঙ্গে রাগ করে অন্ধকার
কুঠরিতে রক্ত তুলে গলায় নিজের
ওপরই ভীষণ প্রতিশোধ নিতে চাও। কেউ টের

পাক আর নাই পাক, তুমি নিজে জানো
কী জটিল নিষ্করুণ আত্মপ্রতারণা-জাল রয়েছে জড়ানো
জীবনের পাকে পাকে। অথচ এই তো চেয়েছিলে…
কখনো হাঁসের বিলে,
কখনো বা ফ্যাক্টরির চিম্‌নির ধোঁয়ায়
চোখ রেখে অলৌকিক কিসের ছোঁয়ায়
বেঁচে থাকা। তবে কেন স্মৃতির সৈকতে
প্রেতের মতন হাঁটো, হঠাৎ হারিয়ে যাও নিঃস্ব চোরা পথে
অভিমানে? মওয়া শরীরের ভার টেনে
নিজেকে ধিক্কার দাও আজ ঘন ঘন? কার কাছে হার মেনে
তুমি হবে নতজানু, বাঁশি ফেলে দাঁড়াবে হে দীন
প্রত্যাশাবিহীন উদ্ভিদের মতো ভাবলেশহীন?

নাকি তুমি একালের দারুণ নিষ্ঠুর
বিলুপ্তির সুর
তুলবে বাঁশিতে? কিন্তু দেখি, অকস্মাৎ
সুরের জগতে নামে ক্রুর পক্ষাঘাত।
ভৈরবী কি পূরবীকে আত্মসাৎ করে
ব্যাপক স্তব্ধতা অগোচরে।
তুমি ঠায় থাকবে দাঁড়িয়ে,
মরীচিকাময়, পথে নিরাশ্রয়, চকিতে হারিয়ে
তমার নিজস্ব সুর? এদিকে তমসা আসে ব্যেপে
দেশে দেশান্তরে; স্বাপদেরা ওঠে ক্ষেপে,
দিকে দিকে কেবলি রক্তাক্ত হয় প্রাণের প্রতিমা।
লক্ষ্যহারা বিপর্যয়ে অগাধ নীলিমা,
প্রগাঢ় সবুজ মুছে যায়, কী ধূসর
জঞ্জালে আচ্ছন্ন মনে হয় চরাচর।
হে বংশীবাদক কী সঞ্চয়
রেখেছো অন্তরে, যার বলে এ প্রলয়ে হবে তুমি মৃত্যুঞ্জয়।

প্রথম লেখন : ৭ মার্চ, ১৯৭৬
পরিমার্জনা :১২ জানুয়ারি, ১৯৮৩

ডন জুয়ান


আবার আমার মন নীলিমামাতাল ঈগলের
মতোই চঞ্চল হয়ে ওঠে, পর্বতের এক চূড়া
থেকে দূরবর্তী অন্য চূড়ায় স্বপ্নের দীপ্র গুঁড়া
ব্যাকুল ছড়িয়ে দিতে চায়। এ স্থবির বিশ্রামের
জাল ছিঁড়ে নতুনের সন্ধানে মেতেছি বলে দোষ
ধরো যদি, তবে আমি নিরুপায়। এ পোষ-না-মানা
গতিরোধ আমাকে তাড়িয়ে ফেরে, তাই তো অজানা
সর্বদা আমাকে ডাকে, কারো মিনতি কি রোষ

কখনো পারে না দিতে বাধা যাত্রাপথে। কোনো নারী,
যতই সুন্দরী হোক, হোক মোহময়ী, নয় সে আমার
তৃপ্তির পরমা কেউ। অকূল তৃষ্ণায় বারংবার
ছুটে যাই এক রমনীর আলিঙ্গনে থেকে অন্য
তন্বীর মদির বুকে। ভালোবেসে যাকে পাই, ছাড়ি
স্বেচ্ছায় তাকেই, ফের নতুন তৃষ্ণায় হই বন্য।


আমার নরকবাস সকলের কাম্য। রূপসীর
স্বামী, তরুণীর পিতা, সবাই আমাকে অভিশাপ
দেয় দিনরাত, যেন আমি চিতাবাঘ কিংবা সাপ
খোপ, বরাহের, খাদ্য হই, হই দুধারী অসির
বলি ক্ষমাহীন শেষ দ্বৈরথে অথবা মায়াবীর
ইঙ্গিতে পাথুরে মূর্তি হয়ে যাই। কোনো মনস্তাপ
আমাকে করে না ম্লান, তাইতো আমার পদচ্ছাপ
অনেক উঠোনে পড়ে, প্রতি রাত্রি উচ্ছল মদির।

কেন থাকতেই হবে নরকের সান্ত্রীর অধীন?
পরমার অন্বেষণে কেউ যদি ছোটে দিগ্ধিদিক,
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে এক হ্রদ ছেড়ে অন্য হ্রদে
রাখে মুখ, তবে তাকে পাপী ভেবে ধিক্‌ তোকে ধিক্‌
বলে দূরে সরে যাওয়া কখনো কি হবে সমীচীন?
ছুঁড়বে পাথর তুমি আমার নিঃসঙ্গ মুখচ্ছদে?


ছিল না অনুশোচনা, ছিল না আমার ভয়ভীতি
কোনোদিন, ছুটে গেছি দেশদেশান্তরে, অভিযান
আমার শিরায় নিত্য পেয়েছে গতির স্তবগান।
বন্দরে বন্দরে ঘুরে নানান দেশের রীতিনীতি
জেনেছি এবং বহু অনুপম রমণীয় স্মৃতি
করেছি সঞ্চয় যাত্রাপথে। কোনোদিন পিছুটান
পারেনি পরাতে বেড়ি মনে, আমি করেছি আহ্বান
তাঁকে নৈশভোজে, যিনি বর্মাবৃত পাথুরের অতিথি।

যেহেতু কৌতুকী রৌদ্র এ-আমিকে করেছে লালন
অকৌশোর, বুঝি তাই তাঁকেই এনেছি কাছে ডেকে
পরিহাস ছলে, যাঁর হাতে নাচে আমার মরণ।
স্মৃতির বমনে ভাসি, কে রহস্যময় মাঝি হেঁকে
যার ঘন কুয়াশায়। একান্ত আমারই নির্বাচন
এ জীবন, যা গড়েছি লোকশ্রুত পাপপুণ্য ছেঁকে।

তুমি আমার সুরে

এতকাল পরে তুমি কি অক্ষর সমুদ্র থেকে এক-গা ফেনা সমেত
উঠে এসেছো? না কি প্রকৃতই
একজন মানবীর অবয়ব আছে তোমার?

বাস্তবিকই তোমার চোখের অমন সুন্দর তারা নেচে ওঠে কিনা
দেখে নিতে চাই, দেখে নিতে চাই
স্পর্শ করলে তুমি হাওয়ায় মিলিয়ে যাও কিনা
অথবা মাখনের মতো গলে গলে নিশ্চিহ্ন হও কিনা।
আহত হলে তোমার মুখ
কতটা আর্ত হয়ে ওঠে,
দেখে নিতে চাই।

পড়ন্ত বেলায় দৈবদয়ায়
হঠাৎ হলো আমাদের জানাজানি।
আমাদের দৃষ্টিতে
চোখের নিমেষে দীঘল দূরত্ব-পেরুনো
বিস্ময়ের বিদ্যুচ্চমক ছিল।
সে মুহূর্তে আমি বলতে পারতাম সহজেই-
আরে কী কাণ্ড, কতকাল পরে দেখা,
ভালো আছো তো?

ইদানীং আমি ভালো আছি কি নেই, তা নিয়ে
তেমন মাথা ঘামাই না আর।
আমার সামনে আততায়ী, পেছনে আততায়ী,
ডান-বাম দু’দিকই অরক্ষিত আমার।
ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র আমার নেই।

অনেকটা দিন-আনি দিন-খাই ধরনের
জীবন যাপন করছি
আর তোমাকে নিয়ে প্রহরে প্রহরে নির্ঘুম
গড়ছি এক অক্ষর জগত,-
যেখানে নিমেষে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করা যায়।
এই যেমন এখন তুমি আমার পাশে নেই, অথচ
দিব্যি তোমার হাতে হাত রেখে বসে থাকতে পারি,
তোমাকে পাশে নিয়ে টপকে যেতে পারি খানা খন্দ,
তোমাকে বিহ্বল করতে পারি চুম্বনে চুম্বনে।

ভালো কথা, তোমার কি মনে পড়ে
আমাদের সেই প্রথম মিলন আদিম গুহায়,
চর্বির আলোয় বড় বেশি রহস্যময় যুগ্মতা?
আমাদের গায়ের বাকল এক কোণে পড়ে ছিল,
কোনো কবির বাতিল স্তোত্রের মতো,
তোমার মনে পড়ে?

পথ চলতে প্রত্যহ কত নাম শুনি আশে পাশে,
কিন্তু তোমার নাম ছাড়া
এমন মধুর আবৃত্তিযোগ্য আর কোনো নাম আছে এ শহরে?
এ শহরে বসবাস করে হাজার হাজার রমণী,
শুধু তোমার ওষ্ঠের জন্যে জমিয়ে রাখি আমার সকল চুমো।

তুমি আমার,
এ-কথা ভাবতে পারি বলেই
আনন্দ আমার কাঁধে হাত রাখে এখনো।
কিন্তু যে জমিনে দাঁড়ানো আমরা দু’জন
তাই ইজারা নিয়েছে শয়তান।

সে আমাদের দুজনকে দু’দিকে
ঠেলে দিতেই ব্যস্ত সারাক্ষণ;
এরই মধ্যে প্রত্যহ সকালবেলা শরীরময় নিউজপ্রিণ্টের গন্ধ নিয়ে
বাংলাদেশ বিলি হয় গেরস্ত ঘরে, ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে
দপ্তরে দপ্তরে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি
এই হতচ্ছাড়া সময়কে তুমুল দুয়ো দিতে দিতে
নৈরাশ্যের কাদাভরা গর্তগুলি
টপকে যেতে যেতে
গলায় সরোদের ঝংকার তুলে
যদি আমার যাবতীয় শুভেচ্ছা
প্রত্যহ পৌঁছে দিতে পারতাম ঘরে ঘরে।
তুমি আমার সুর মেলাবে সুচেতা?

তোমাকেই দেখি

যে-তুমি আমার কাছে আসো চায়ের পেয়ালা নিয়ে
ভোরবেলা, বসো পাশে, সে কি প্রকৃতই
তুমি? প্রায় পানিভরা মশকের মতো
তোমাকে দেখতে আর ত্বকের মোহন কোমলতা,
নমনীয় দৃষ্টির কুহক,
কোথায় উধাও, চুলে পাক
ধরেছে বিস্তর, এমনকি কলপের
মায়াও পারে না আর লুকিয়ে রাখতে
শাদার দস্যুতা। মনে হয়, তুমি নেই কোনোখানে!
কে এক পুরুষ্ট প্রেত করে আসা-যাওয়া চারপাশে,-
কখনো ড্রইংরুমে, কখনো শোবার ঘরে আর কখনোবা
ড্রেসিং টেবিলে দ্যাখে মুখশোভা
এবং ফ্রাইং প্যানে ভাজে ডিম, বাথরুমে করে
গুন্‌ গুন্‌ কখনো সখনো আর কখনো শিশুকে
শোনায় হাট্রিমা টিম টিম।

আমিও বদলে গেছি। সর্বাঙ্গে কালের
থাবার জখম নিয়ে আছি।
এখন আমাকে দেখে কাক
অথবা শালিক উড়ে দূরে চলে যায়, গিরগিটি
তাকায় অবাক।
ট্রেঞ্চের ভিতরে সৈনিকের
ভুরুর ওপরে, কানে, যুদ্ধার্ত গ্রীবায়
যেমন বিষাক্ত ধুলো জমে ওঠে, তেমনি আজ
আমার অস্তিত্বে পুঞ্জীভুত কাদাকার
ধুলো, ধুলো, ধুলো।

ইদানীং যখন কোথাও কোনো তরুণীকে দেখি
কোনো জন্মদিনের পার্টিতে কিংবা বিয়েবাড়িতে নতুন
শাড়িতে সজ্জিতা, বেণী-দোলানো সুস্মিতা,
শরীর আশ্চর্য দীপান্বিতা, তখন নিভৃতে আমি
তাকে নয়, একদার তোমাকেই দেখি।

 তোমার জন্যে মশাল

যখন তুমি যাত্রা করেছিলে, তখন কী খেয়ালে
একটি নৌকাও তীরে বেঁধে রাখোনি,
বরং পুড়িয়ে এসেছিলে প্রতিটি নৌকা।

এখন তুমি ফিরে যেতে চাও,
অথচ তোমার সামনে খল খল করছে
বিপুল জলরাশি। কী করে তুমি পার হবে মারমুখী নদী?

তুমি নও কোনো গ্রিকদেবতা, অথবা সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান,
বিদ্যাসাগরও নও যে ঝড়ের রাতে
উত্তাল তরঙ্গমালা উপেক্ষা করে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সকালবেলা
পৌঁছে যাবে নিরাপদ তীরে।

তুমি খুব সাধারণ একজন মানুষ,
ঘড়ি ন’বার বাঁশি বাজাবার আগেই পড়ি কি মরি রাধার মতো
ব্যাকুলতায় তড়িগড়ি তুমি ছোটো, ছোটো, ছোটো
সেই বিরাট দালানের দিকে, যেখানে
তুলি লেখো খাতা। কাজের ফাঁকে খবর কাগজের
পাতা ওল্টাও, ব্যাপক খরার কথা ভাবো, কখনো সখনো
ঝিমোতে ঝিমোতে ছড়া কাটো আবোল তাবোল,
ছেলেবেলার ছড়া,
তকরার করো তোমারই-মতো আরেকজনের সঙ্গে কোনো কোনো
পরাশক্তির পক্ষে অথবা বিপক্ষে আদার ব্যাপারীর ধরনে;
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে
মাথা গুঁজে খাতা লিখতে থাকো,
যতক্ষণ না ছুটির বাঁশি বাজে তোমার বুকের ভেতর!

কেরানী স্রোতে গা ভাসিয়ে হঠাৎ তোমার হয়তো।
মনে পড়ে যায় সেই নিঝুম মন-কেমন-করা
ঝোপের কথা, যেখানে একদা, হায়রে একদা
তোমার বুকের মধ্যে ফুটেছিল ভালোবাসার
প্রথম বকুল। হঠাৎ তুমি দুত্তোর বলে ছুটে যাও
ঠাঁই নেই বাসের দিকে।
প্রায় শূন্য ট্যাঁকে ভাবো ক্লান্ত মনে
সেই যে আছে না বিপুল সুদুর আন্তর্জাতিক
অর্থভাণ্ড, তার কানা উপচে-পড়া প্রসাদকণা কখন আবার
ঝলমলিয়ে উঠবে তোমার হাতের তালুতে।

তুমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, পালকছাঁটা শীর্ণ
পাখির মতো, পায়ে জীর্ণ জুতো, বয়েসী পাঞ্জাবি
যাই যাই করছে সারাক্ষণ, বস্তুত তুমি
ছা-পোষা; ফলের পুরনো খোসার মতো
অস্তিত্ব নিয়ে বিব্রত প্রায় অষ্টপ্রহর, আপাতত তৃতীয় বিশ্বদরদী
দাতা, বিশ্বত্রাতা ম্যাকনামারা তোমার স্বপ্নের চাতালে
(ভিয়েতনামে তাঁর দয়ার কথা কিংবদন্তী হয়ে আছে আজো)
মুঠো মুঠো মোহরের মতো ডলার ছড়ালেও,
পরাবাস্তবের ঈগল হয়ে তিনি উড়ে যাবেন
দূর নীলিমায়, তোমার দিকে ফিরে তাকিয়ে
সমস্ত নষ্ট করবার মতো সময় তাঁর নেই।
তুমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ।

কখনো আশার রৌদ্রে, ঝলসে উঠে, কখনো
নৈরাশ্যে স্নান করে আখেরে কী জানলে তুমি?
সন্ধ্যা নামলে প্রতিদিন গেরস্ত তার নিজের ঘরে
ফিরে যেতে চায়। বারান্দায় শিশুর দৌড় হুটোপুটি,
রান্নাঘরে গৃহিণীর খুচরো ব্যস্ততা, অথবা
পুরনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চুল বাঁধা
ইত্যাদি দেখার আশায় বড় সাধ করে
বাসায় ফিরে আসে একাকী মানুষ, ভাড়াটে ক্লান্ত
শরীরটাকে টানতে টানতে। এভাবে, এভাবেই চলতে থাকে
কিছুকাল, তারপর একদিন অনেকের কাঁধে চেপে
রাজার মতো বড় উদাসীন মৃগয়াযাত্রা অনন্তের অরণ্যে।
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজেউন,
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজেউন,
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজেউন

যখন তোমার যাত্রা হলো শুরু তখন তুমি একটি নৌকাও
তীরে বেঁধে রাখোনি,
বরং পুঁড়িয়ে এসেছিলে প্রতিটি নৌকা।

তোমার সামনে এখন দিগন্ত-ডোবানো উত্তাল তরঙ্গমালা।
যত হিংস্রই হোক এই খলখলে জল,
হোক যত অন্তহীন, পার তোমাকে হতেই হবে।
বড় বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড় অভীক,
ঐ তো দূরে কে হাতে ধরে আছে তার লকলকে মশাল।

 দাড়ি কামাবার মুহূর্তে

দাড়ি কামাতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলো কেন তোমার
সেফটি রেজর? ইতোমধ্যেই সাবানের ফেনা
শুকিয়ে গ্যাছে, চড়চড় করছে গাল। সাত সকালে
কী ভাবছো তুমি? রেশনের চাল?
বাজারের ডাল? বীমার কিস্তি? ছেলেবেলার ভিস্তি?
নাকি মরা ইলিশ মাছের মতো
আঁশটে প্রেমকথা? বার্ধক্যের ফিকে
সুবে সাদিকে তুমি কি ভাবছো
তাকে, যে আবার হলো অন্তঃসত্ত্বা
সুদূর ঝিলিমিলি প্রবাসে।

বাইরে চমৎকার রোদ উঠেছে
প্রিয় স্মৃতির মতো। গৃহিণীর সিঁথি
ক্রমাগত চওড়া হচ্ছে। তোমার নিজের মাথায় খুশ্‌কি,
মুখে মেচেতা। এই মনোরম সকালে এখন
কোথায় সুচেতা?

নাও, ঝটপাট দাড়ি কামিয়ে ফেলো, দেখছো না
বাড়ছে বেলা, অফিসে কলম পিষে
শ্লথগতি রিক্‌শার মতো দিচ্চো জীবন কাবার করে,
ক্রমাগত এদিকে আবার পদ্য লেখার বাতিক
মজ্জাগত, দিস্তা কাগজে তুমি সাজাও কবিতার গুল্‌দস্তা।
টালমাটাল দু’ নৌকায় পা দিয়ে উত্তাল
ভবসাগর দিচ্ছো পাড়ি বরাবরই। উনুনে হাঁড়ি
চড়ুক আর না-ই চড়ুক, সন্ধ্যার আড্ডায়
সাত তাড়াতাড়ি যাওয়া চাই, থাকা চাই
হররোজ ধেনো মদ, নইলে মেজাজ
শরীফ রাখা দায়। জাঁহাবার মারী ও মড়কে
অলিতে-গলিতে, সড়কে, বস্তিতে, কলোনিতে
উঠলে কান্নার রোল, তোমার খানদানী মস্তিতে
চিড় ধরে; মাঝে মধ্যে তার চিহ্ন বটে তোমার পদ্যে
মৃতের চোখের মতো নাছোড় গেঁথে থাকে।

যত রটে, তত ঘটে না, মাথা নেড়ে নেড়ে
বলেন বিজ্ঞজন।

এবার পাঞ্জাবি চাপাও গায়ে কিছু নাকে-মুখে গুঁজে
ধাও, তুমি ধাও দপ্তর-বন্দরে, হে পথচারী,
মিশে যাও জনস্রোতে। এখনো
কী ভাবছো চোখ বুঁজে? ভাবছো কি কূপমণ্ডূক এ সমাজকে
কে শোনাবে সমুদ্র-কল্লোল? কে আনবে ইন্দ্রধনুচ্ছটা
সংস্কারের বদ্ধ ডোবায়?

এসব কেতাবী কথা
বস্তুত বাচালতা, আপাতত
তোলা থাক মনের কুলুঙ্গিতে। তোমার নিজের ঘরের ভিতে
ভাঙ্গন বাজাচ্ছে ঢাক গুড় গুড়, শুনতে
পাচ্ছো কি? দিনে খাচ্ছো ডালভাত, শাক-সবজি,
মাঝে মাঝে মাছ কিংবা গোস্ত, রাতে চাপাতি;
বেশতো আছো
দোস্ত, তাহলে খামোকা কী কাজ
দাড়ি আমাতে গিয়ে আজ হঠাৎ রেজর নিস্ক্রিয় রেখে
আকাশ পাতাল ভাববার?
দিও না কান
প্রেতের ফিসফিসানিতে, বরং পুরোনো দিনের
গান গাও গুনগুনিয়ে এবং
রেজর চালাও গালে সুখে। আয়ুর
মরীচিকা করুক ধুধু,
তুমি শুধু কোনোমতে কষ্টে সৃষ্টে বাঁচিয়ে রাখো
বুকের সেই কোকিলটিকে, যার কোনো আগ্রহ নেই
কারুর বাঁধা মাসোহারার প্রতি।

নায়কের ছায়া

বরাবর তিনি দূর গ্রামেই থাকেন। পাড়াতলি
গ্রাম, নদী চিরে জেগে-ওঠা, গাছপালা, ইঁদারা পুকুর, হাট
বাজার নিঝুম গোরস্তান নিয়ে আছে। তাকে মেঘনার অঞ্জলি
বলা যায়; আশি বছরের দেহমন জানে সোনার কপাট
এ গ্রামে কোথাও নেই, নেই কোনো কামধেনু হতশ্রী বাথানে,
বিলক্ষণ জানে
কোন্‌ ঘরে কার বাস, কার গরু বিয়োয় কখন, কোন্‌ দোষে
কাকে ধরে নিয়ে যায় থানার পুলিশ।
যে-পাখিটা মগডালে বসে দেয় শিস্‌
জর্দার রঙের মতো বিকেলবেলায় তার নাম
বলে দিতে পারেন নিমেষে। বসে বসে
দ্যাখেন পশ্চিমে সূর্য রঙিন পোশাক
কেমন আড়লে ছেড়ে উধাও সন্ন্যাসে।
মাঝে মাঝে রাতে ঝাঁ ঝাঁ কাশির দমক
দেয় না ঘুমোতে তাঁকে, তখন শোনেন তিনি প্যাঁচা কিংবা শেয়ালের ডাক।
নাকি মধ্যরাতে নিশি ডাকে
তাঁকে নদীতীরে ঝোপঝাড়ে, জোনাকির ঝাঁকে?
কখনো হাঁটেন ঘুমে, এ কেমন বেহুদা ব্যারাম?

একমাত্র ছেলে তাঁর বিবাহিত, শহরে পড়ায় ছাত্র, বাড়ি আসে
গ্রীষ্মের ছুটিতে সঙ্গে আনে ইস্পাহানী গ্রীনস্পট, এই একটাই শখ
রয়ে গেছে তাঁর আর গৃহিনীর পড়ন্ত বেলায়।
বৈঠকখানায় নাতি পড়ে ইতিহাস, কিছু তাঁর জানা, কিছুরা অজানা
কেমন ধোঁয়াটে লাগে মাঝে মাঝে
সবকিছু, চোখে রোশ্‌নি নেই বেশি, তবুও রোজানা
খুব ভোরে পড়েন কোরান, আয়াতের ধ্বনি বাজে
সত্তাময়, কখনোবা দ্যাখেন নাতনি মাতে পুতুল খেলায়।
ফজরের নামাজের পর লাঠি হাতে যখন হাঁটেন তিনি
পুকুরের পাড় ঘেঁষে, ঋণী
ভাবেন নিজেকে গাছপালা, দিঘি, ধানের সম্পন্ন জমি, বাবুই পাখির
চারু বাসাটির
কাছে; প্রতিদিন থানকুনি পাতা, শাপলা শালুক, ধুধু মাঠ
এবং লাউয়ের ডগা, মোরগের ঝুঁটি, ঘাসফুলের বাহার
গাছের পাতায় বসবাসকারী পোকা গভীর করেন পাঠ,
যেমন পড়েন তিনি খুব মনোযোগে বার বার
শিক্ষক পুত্রের পত্র। ছিল না আমীরী

তাঁর ধাতে কোনোদিন, যদিও প্রাচীন বংশে জন্ম, আজ আর
যে-বংশের নেই কোনো ছিরি,
এখন যে-বংশ ক্ষয়রোগীর মতই রক্তময় হাহাকার
নিয়ে করে দিনগত পাপক্ষয়। নিজে
তিনি দুমড়ানো কাগজের মতো সংকুচিত সকল সময়।
অথচ একদা তাঁর হাঁকডাকে কী-যে
সাড়া পড়ে যেত মেঘনাতীরে গ্রামময়।
সেদিনের কথা,-তিনি পাগলা ষাঁড়ের শিং ধরেন মুঠিতে
চেপে আর কাটেন সাঁতার
নিরলস গহন নদীতে লাগাতার,
অমাবস্যা-রাতে যান একা প্রেতায়িত, বিলুপ্ত নীলকুঠিতে,
দেশজোড়া দাঙ্গাহাঙ্গামায় দোনলা বন্দুক হাতে
নিঃশঙ্ক দাঁড়ান এসে মৃত্যুসন্ধানী ভিড়ের মুখে
গোক্ষুরের তাড়া-খাওয়া খরগোশের মতো কিছু কৈবর্ত বাঁচাতে।

এখন দ্যাখেন তিনি ছায়াছন্ন চোখে-ক্রমশ বদলে যায়
আমল-মামুল, সারা জাহান পড়ছে ঢাকা কামানে বন্দুকে
আর রূপকথার দানোর চিৎকারের মতো ট্যাঙ্কের ঘর্ঘরে
কানে লাগে তালা, এ কেমন জমানায়
এখনো আছেন বেঁচে তিনি? দ্যাখেন দু’চোখ মেলে, কে যুবক
পা চালিয়ে যাচ্ছে একা আগামীর অত্যন্ত বিরান মাঠ, খাদ
এবং মড়ার খু’লি পেরিয়ে , অভুক্ত নিচ্ছে তুলে
খাদ্যের ভাণ্ডার থেকে জহরিলা তন্দল নিছক।
কে এই অচেনা যুবা বার বার পথ ভুলে
অন্য হিমযুগে, হাড়-ক্ষয়কারী শীতে
যাচ্ছে চলে ভস্ম-ঢাকা নিসর্গ ও নগরীতে?
তাঁরই আওলাদ?

 নীরবতার শতবার্ষিকী

দীর্ঘকাল আমি খুব চুপচাপ আছি।
যতদিন বাঁচি
টুঁ শব্দটি করবো না, করেছি শপথ মনে মনে,
আজ থেকে, বলা যায়, একশো বছর আগে, রণে
ভঙ্গ আমি দিয়েছি যখন।
তিনটি জোয়ান ছেলে আচানক হয়েছে নিখোঁজ, অগণন
রাত আমি হ্যারিকেন নিয়ে
ঘুরেছি নদীর পাড়ে, মাঠে, নাম ধরে ডাক দিয়ে
উদ্ভ্রান্ত ঘুরেছি কত আদাড়ে-বাদাড়ে।
দু’টি মেয়ে মারী মড়কের অন্ধকারে
হয়েছে বিধবা
অকালে; হৃদয়ে টকটকে রক্তজবা
নিয়ে আমি অত্যন্ত নিশ্চুপ রয়ে গেছি। সর্বনাশ
বানে বারবার ভেসে গেছে জমি, বাবুই পাখির বাসা,
পশু পাখি, আমার নিজের গেরস্থলি।
ফেলি নি চোখের পানি, খালি
ফেটেছে আমার বুক, তবু মুখ ফুটে

বলিনি কাউকে কোনো কথা, দীর্ঘশ্বাস মাথা কুটে

মরেছে হাওয়ায় শুধু। গৃহিনী ঘুমান
কবরে শান্তিতে, আমি লাঠি হাতে শুনশান
উঠোনে প্রেতের মতো ঘুরি আমি নিবু চোখে
কোনো বংশধরের সতেজ মুখ খুঁজি, শোকে
পাথর আমার বুক চায়
আজো তারুণ্যের ছোঁয়া, দূর বনচ্ছায়
থেকে ভেসে আসুক শিশুর কলতান,
চায় এই ধুকপুকে প্রাণ।
মনে পড়ে আমার জেদী সে পৌত্র, যার
চোখে ছিল আগুনের পবিত্র ঝলক, অক্ষরের পতাকার
ছায়ায় দিয়েছে প্রাণ শহর ঢাকার রাজপথে
তিরিশ বছর আগে। ঊনসত্তরের আন্দোলনে ক্রুর ক্ষতে
হয়েছে রক্তাক্ত ফুল দৌহিত্রের বুক।
একাত্তরে কাঁধে নিয়ে বিদ্রোহী বন্দুক
আরেক দৌহিত্র গ্যাছে মুক্তিযুদ্ধে, ফেরেনি সে ঘরে
আজো, মনে পড়ে।

এখন ভীষণ একা আমি, অসহায়,
আমার অসহ্য বেলা যায়
স্নেহপরায়ণ কলরব আর বংশধর বিনা।
ইদানীং দেখেও দেখিনা কিছু, শুনেও শুনিনা;
সর্বোপরি বলিনা কাউকে কোনো কথা,
কেবলি বেড়াই বয়ে ধুধু বুকজোড়া বোবা ব্যথা।

নোটবুক থেকে

এক

সে-রাতে ছিলাম বসে আমি একা কাঠের চেয়ারে।
হাতে ছিল কবিতার বই, পংক্তির গুঞ্জন ছিল
মগজের কোষে কোষে। এবং কুয়াশাময় দূর
শতাব্দীর বেদনায় ছায়া নামে হৃদয়ে আমার;
শুনতে চেয়েছি বুঝি কীট্‌সের মতো আমি সেই
হৈমন্তিক অনশ্বর পাখিটির গান, সুর যার
পাতার আড়ালে বয়ে যায় চিরদিন, হয়ে ওঠে
কীর্তনের যোগ্য আর সে সুরের বিশ্রুত কম্পন
কেমন সৃজনশীল প্ররোচনা দ্যায়, অবিনাশী
ওড পুর্নজন্মে মুঞ্জরিত হয় মগ্ন চেতনায়,
অথচ খাতার পাতা শস্যহীন ক্ষেতের মতন
থেকে যায় খুব কাছে ছায়াচ্ছন্নতায় যেন কার
উপস্থিতি টের পাই, অথচ যায়না দেখা তাকে,
অন্তরালে ক্ষয়রুগী দীপ্ত কবি মুচকি হাসেন।

দুই

পুরোনো দেয়ালে শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরে
অবিরল, সেই কবেকার কারো পতিগ্ররহে-যাত্রা মনে পড়ে।

তিন

মাঝে-মধ্যে মধ্যরাতে কামনার ধুলি
ব্যাকুল ওড়াই,
কোজাগরী পূর্ণিমায় দেহাত্মবাদের টানে চার্বাকের খুলি
এল কি আমার ঘরে? ওড়ে কিছু দর্শনের ছাই?

চার

একালে হাফিজ মহাকবি হলে,
তোমাকে দেখলে নতুন গজলে
বলতেন তিনি, বলতেন স্রেফ-
দয়িতা আমার তুমিতো আলেফ।

পাঁচ

আমার মননে ব্যাপ্ত বস্তুত ছিলেন
মহান লেনিন, বুদ্ধ, বনলতা সেন।

ছয়

এখানে রোজ বসি কিসের টানে?
শুক্‌নো পাতা, পাথর এবং কণ্টকিত বেড়ার ধারে
পাইনা খুঁজে বসে থাকার মানে।
চক্ষু বুজে দিই কাটিয়ে নিমেষগুলি।
কখন সূর্য ওঠে কিংবা কখন যে যায় অস্তপারে,
পাইনাকো টের, অঙ্গে ঝরে স্বপ্নধূলি।
দিগন্তের ঐ গভীর করুণ গানে
প্রাণ ডুবিয়ে আছি বসে জাগর অন্ধকারে
ট্রেন-না-থানা অচিন ইষ্টিশানে।

সাত

মনের ভেতর নিত্য জমে
কত কথকতা।
তোমার দিকে মুখ ফিরিয়ে
বলতে গেলাম কথা।

কিন্তু আমার কথকতার
হারিয়ে গেল খেই।
তোমার দিকে চোখ ফিরিয়ে
দেখি তুমি নেই।

আট

চঞ্চুতে গোলাপ গুঁজে, শাদা গম্বুজের ছায়া ছেড়ে নিরালায়
কে এক অঁচিন পাখি খুব একা উড়ে যায় সদর রাস্তায়।

নয়

সব কিছু আমি খুব কাছ থেকে দেখতে চেয়েছি
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে,
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে,
যেমন স্যাঁকরা দ্যাখে কোনো অলংকার।

এত কাছ থেকে
স্পষ্ট কিছু দেখা যায় কিনা,
তা’ নিয়ে চায়ের কাপে তর্কের তুফান;
বস্তুত দৃশ্যের চেয়ে অদৃশ্যই থেকে যায় বেশি।

তবু চোখ তীক্ষ্ম করে ঈগলের মতো
অথবা দর্জির মতো
দেখিছে অনেক কিছু বেশ কাছ থেকে বারংবার।
চৈত্রের দুপুরে কিংবা মাঘের সন্ধ্যায়
আমিতো দেখেছি তাকে গাঢ় অনুরাগে,
অথচ প্রকৃত দেখা হয় না কখনো।

দশ

এখন আমার হাতে ফুলের স্তবক নেই, নেই অনুপম
পাখির পালক,
তবু কী বিস্ময় নিয়ে চোখে আমারই হাতের দিকে চেয়ে থাকে
একটি বালক।
আমার চোখের জ্যোতি আগের মতন নেই আর, আমি ক্ষয়ে-
যাওয়া তরবারি,
তবুও অগাধ পানি নিয়ে চোখে আমাকেই দেখে বারংবার
একজন নারী।

এগারো

যখন তোমার দিকে বাগানের সবচে’ সুন্দর ফুলগুলি
এগিয়ে দিলাম, বিষপিঁপড়ে ভেবে তুমি
চকিতে সরিয়ে নিলে হাত;
নীরবে তাকিয়ে দেখি আভাময় ধূলি।
তোমার নরম ওষ্ঠে কিছু স্বর্গ শিশির ছড়াতে
চাইলাম, কালকূট ভেবে অকস্মাৎ
হে নারী সরিয়ে নিলে তুমি ঠোঁটের সুস্নিগ্ধ ভূমি
ভালোবাসাময় এই দীপান্বিতা রাতে।

প্রেম

ইদানীং চা-খানায় বসে থাকি অনেকক্ষণ।
রাজা উজির মেরে, ইয়ার্কি করে
ইয়ার বক্সিরা উঠে যাবার পরও সামনে শূন্য কাপ নিয়ে
বসে থাকি নড়বড়ে চেয়ারে। দেখি ঝাঁকা মুটে যাচ্ছে
হনহনিয়ে সতেজ
সব্জির বোঝা বয়ে, রেডিওতে বাজে সস্তা ফিল্মি গান
এবং লজ্‌ঝড় ঘোড়ার গাড়ি রাস্তায়
মোড় নেয় ইতিহাস ছিটোতে ছিটোতে। স্বপ্নের
খোয়ারিতে কখনো কখনো সূর্যাস্ত দেখে
বনেদি বংশের-গৌরব-লুপ্তির কথা মনে পড়ে,
মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের জাগর শটে
নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের গোধূলি রঙিন মুখ।

এবং আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না
আমার ছা-পোষা পেরেশান জনক আর
বেকার ভায়ের মুখ, আমার হাড়ি-ঠেলা মায়ের
উনুনের ছাইয়ের মতো স্বপ্নচূর্ণ,
অত্যন্ত দ্রুত বেড়ে-ওঠা বোনের সাধ আহলাদের ছাঁটাই;
মনের ভেতর বারংবার গুমরে ওঠে
লাঞ্ছিত মধ্যবিত্ত মনের বিলাপ।

তোমাকেও ভোলা অসম্ভব, সুচেতা। একদা তোমার
মাধুর্যে ভরে উঠেছিল আমার হৃদয়।
তুমি বলেছিলে, ভালোবাসি এবং
তোমার সেই উচ্চারণের মধ্যে পেয়েছিলাম বিশ্রাম।

অনেক ঝড়ঝাপ্টার পর রোদে পিঠ দিয়ে
জেলে যেমন তার জাল সারায় গভীর অভিনিবেশে,
তেমনি আমি আমার ছেঁড়া ছঁড়া
ভাবনাগুলিকে জোড়া দিই, ভাবি এ এমন এক সময়,
যখন অবিশ্বাসের ফণিমনসায়
ছেয়ে গ্যাছে সবার জীবনযাপন, মেধা ও মনন।
আমি আর আমার হাতকে বিশ্বাস করতে পারছি না,
বিশ্বাস করিনা নিজের চোখ ও নিশ্বাসকে!
নিজের শরীরের চেয়ে দেয়ালের ছায়াকে
মনে হয় অধিকতর সত্য।

শুধু তোমার প্রেম এবং আমার কবিতাকে
মুক্ত রাখতে পেরেছিলাম
অবিশ্বাসের রাহুগ্রাস থেকে। কিন্তু আজকাল
চা-খানায় নড়বড়ে চেয়ারে বসে
সামনে শূন্য পেয়ালা নিয়ে মনে হয়-
মেয়ে, সরকারি প্রেসনোটের মতো মিথ্যা তোমার প্রেম।

বস্তুত গাছপাথর নেই

বস্তুত গাছপাথর নেই কোনো তার বয়সের,
তার কোনো নির্ধারিত বর্ণ নেই, নেই
সাজগোশাকের অভিন্নতা। কেউ শাদা, কালো কেউ,
কেউ পীত; কেউ-বা বাদামি অতিশয়।
তার কোনো সুনির্দিষ্ট জন্মস্থান নেই,
দ্বীপ কি বদ্বীপ
কিংবা মালভূমি, মরুভূমি, পাহাড়ি এলাকা, তুমি
যেখানেই যাও, সেখানেই পেতে পারো
পদচ্ছাপ তার, আর কী-যে মহিমার
তিলক ললাটে তার, মানুষ ভীষণ সম্মোহিত
নতজানু হয় তারই কাছে বারংবার।
সংহারের নেশা তাকে কেবলি মাতিয়ে রাখে, হাতে
উঠে আসে ভয়ংকর ভাঙার কুড়াল।

কোনো কোনো শীতে রটে, তার শবযাত্রা শুরু হবে
দ্বিপ্রহর বারোটায়, অথচ প্রকাশ্যে দেখা যায়
কচ্ছপের মতো বলিরেখাময় মুখ তার, চোখে
কিসের ঝলক।

তার মস্ত হাতের তালুর আশ্রয়ের
বাপক বাহারে
মানুষ সন্ত্রস্ত বড় সকল সময়, নিসর্গের খুব কাছে
পৌঁছেও কাটে না তার ভয়। নিভৃত উঠোন,
শান্ত কুটিরের কথা ভেবে শান্তি পেতে চায়,
কিন্তু চোখে ভেসে ওঠে বন্দি-শিবিরের কাঁটাতার,
কাঁটাতারে বিদ্ধ শাদা পাখি;
মেষপালকের মুখচ্ছবি ভেবে জল্লাদের মুখ দেখে ফেলে।

ফুলে স্তবকে কোনো প্ররোচনা নেই,
পক্ষান্তরে পৃষ্ঠপোষকতা আছে সুন্দরের,
অথচ নিমেষে সেখানেই বারে বারে দু’লে ওঠে
হাইড্রার মাথা।

তার বসন্তের, তার হেমন্তের স্তোত্র বরাভয়
আনে চরাচরে, তার করুণা অপার।
বুঝি তাই কতকাল গোঠে কেউ শোনেনি দুপুরে
কিংবা অপরাহ্নে কোনো রাখালের বাঁশি।
যেখানে প্রকৃতি তম্বী বেদিনীর মতো
সুঠাম, চিকন, কেউ যায়নি সেখানে কতকাল।
তার সমর্থনে খুব ধোঁয়াটে শ্মশানে
চণ্ডাল মাটির ভাঁড়ে আর্ত ওষ্ঠ রেখে খোয়ারিতে
অদৃশ্য স্তনের দিকে বাড়ায় বিশীর্ণ হাত আর
সুরছুট রাখালেরা ইদানীং পোষে শুধু নেকড়ের পাল।
বর্মাবৃত কৃষ্ণকায় ঘোড়সওয়ারের
উড়ন্ত পায়ের নিচে রাশি রাশি থাম, লোকালয় চুর্ণ হয়।

তার পদধ্বনি শুনে প্রতিটি গোলাপ
মৃত মাকড়সা হয়, আনন্দ-কাসিদা
কেবলি মর্সিয়া হয়ে যায়; সবাই বাড়ায় ভিড়
অজ্ঞতার বিবাহবাসরে!
অনেকেই উদ্যানের সন্ধানে বেরিয়ে ক্লান্ত পায়ে
ফিরে আসে ঘরে কালো কুকুরের মতো। মাঝে মাঝে
নৈরাশের তটে মাথা রেখে
জেগে উঠবার ভয়ে কেঁদে ওঠে ঘুমের ভেতরে।
কখনোবা সুতীব্র চিৎকারে ওরা আকাশ কাঁপিয়ে
মাইল মাইলব্যাপী রুদ্ধ খাঁচা থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে যেতে চায়, জেনে নিতে চায় পথ তার কাছে,
যে নিজেই পথভ্রষ্ট খুব দিকচিহ্নহীনতায়।

বাংলাদেশ গান গায় তাদের অক্ষয়-শোণিতের

তাদেরও একান্ত ব্যক্তিগত
পরিচয় ছিল কোনোদিন রৌদ্রময়, জ্যোৎস্নামাখা।
বুঝিবা তাদের একজন অস্তিত্বের
সব তন্ত্রী বাজিয়ে বাজিয়ে
তন্ময় গাইতো গান কারো ওষ্ঠের, স্তনাভার;
অন্যজন সঙ্গোপনে ভরে তুলেছিল
সাতটি সুনীল খাতা রাশি রাশি গন্তব্যবিহীন
জবুথবু পক্ষাগাতগ্রস্ত পদ্যে, কেউ কতিপয়
স্বপ্ন এঁকেছিল
আপন চৌকাঠে,
ঘরের দেয়ালে আর বিবর্ণ মেঝেতে কিছু লোকজ মটিফে,
কোনো কোনো স্বপ্নে ছিল মিশরীয় ধাঁচ।

মেজাজ তিরিক্ষি ছিল কারো, প্রায়শই
দেখা যেতো তাকে বিবাদের ঘূর্ণিপাকে;
কারো রক্তে ছিল ফেরেশতার ছায়া, কেউ সারাক্ষণ
ভাবতো দ্বীপের কথা, যার তটে-দেখতো সে স্বপ্নময়তায়-
পড়ে আছে জলকন্যা, তীরবিদ্ধ, মৃতা।
একজন দপ্তরের টেবিলকে ইথাকা ঠাউরে নিয়ে খুব
ক্লান্ত হ’য়ে দেখতো অদূরে
উদ্যানের পাশে শুয়ে একটি কুকুর, ক্রমাগত হচ্ছে বুড়ো।
কখনো মৃত্যুকে ওরা আপ্যায়ন করেনি এবং
নৃপতির মতো ছুটে গেছে বারবার মরণের মৃগয়ায়।
স্মৃতিতে পলাশ ছিল, ছিল সাঁকো, বাগানে বেড়া,
ওষ্ঠের আর্দ্রতা আর অক্ষরের বিভা। একজন ত্র্যানাটমি
পড়ে করোটির ব্যাখ্যা খুঁজেছিল, জেনে নিতে চেয়েছিল
করোটি কখনো সত্য ধারণ করতে পারে কিনা

সাবলীলভাবে।
সত্যের আঁজলা থেকে জল খাবে বলে অপরাহ্নে
ধুলায় গড়িয়েছিল হুহু তার নিজেরই করোটি।
মরণের করতলে ওরা, তবু জীবনের পাশাপাশি দীপ্র থেকে যায়।

কখনো হাওয়ায় ভেসে আসে কিছু কণ্ঠস্বর, যেন
কবেকার গ্রামোফোন বাজে বকুল বিছানো পথে।
নিউজপ্রিণ্টের স্তূপ থেকে স্বপ্ন উঠে এসে স্তব্ধ
মধ্যরাতে পতাকার মতো কাঁপে প্রধান সড়কে,
নগরবাসীকে ডেকে নিয়ে যায় পার্কে, নদীতীরে,
নিউজপ্রিণ্টের মধ্যে ঢেলে দেয় বসন্তের রঙ।

সভার শরীর থেকে কিছু
উদাসীন একাকী শরীর,
মালা, ফটোগ্রাফ আর শ্যামল নস্টালজিয়া কেমন অলক্ষ্যে ঝরে যায়।

তাদের নামের
ওপরে সূর্যের চুমু ঝরে, পড়ে নক্ষত্রের ছায়া,
বাংলাদেশ গান গায় তাদের অক্ষয় শোণিতের।

বাকবাকুম বাকবাকুম

যেখানে তোমাকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়,
ইদানীং সেখানেই তোমার আনাগোনা।
বলতে পারো,
‘আমার কোনো ঠিকঠিকানা নেই,
যখন যেখানে খুশি নির্মাণ করি আস্তানা
নদীতীরে, পাহাড়ে জঙ্গলে, জনগণমনগুঞ্জরিত
বসতিতে।
প্রথম যখন তোমার কথা ভেবেছিলাম সেই
সুদূর কৈশোরে, মনে পড়ে, তখন
তোমার একটা ছবি ফুটে উঠেছিল মনের গভীরে।
প্রমোথিউস, হ্যাঁ, সেই অতিকায় পুরুষ
যে দেবতাদের চোখে ধুলো দিয়ে
মর্ত্যের জন্যে এনেছিল আগুন, তার সঙ্গে একাত্ম করে
দেখতে শিখেছিলাম।

ভাবতে অবাক লাগে, লেনিন যার চোখে চোখ রেখে
হয়ে গিয়েছিলেন অন্যরকম মানুষ,
যার হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে গেছেন
চেণ্ডয়েভারা বলিভিয়ার জঙ্গলে, যার উদ্দেশে
স্তোত্র রচনা করেছেন নেরুদা, যার প্রতীক্ষায় অত্যন্ত জাগর
এক কিশোর কবি ক্লান্ত হতে তার পোকা-খাওয়া
ফুসফুস নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো হাসপাতালের বেডে,
সে আজ বেপাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, মহজনদের
পাপোশে পা ঘষছে,
হেঁ হেঁ করতে করতে মায়াবী চেক পুরছে
নিজস্ব পকেটে। শোখিন ড্রইংরুমে মদের গেলাশ হাতে
গোলাপি ছন্দে বাকবাকুম বাকবাকুম করছে।

বাক্স উপাখ্যান

মনে হয়, কোম্পানির আমলের কারুকাজময়
সেগুন কাঠের বাক্সে আমি আছি সকল সময়।
বড় বেশি শান্ত, হয়তো কবরের ভিতরে এমন লাগে বলে
অনুভূত হয়, যদি কেউ ভাবে আমার নিজস্ব কৌতূহলে
মর্চে পড়ে গেছে বাক্সটির অভ্যন্তরে
বসবাসহেতু, তবে তাকে ধিক্কারের ধূলি-ঝড়ে
অন্ধ করে দিতে
পারবো না কিছুতেই। যদিও আমার শ্বাস নিতে
কষ্ট হয় অতিশয়, যদিও হাঁপাই বারংবার
আমি হৃদরোগীর মতন ক্লেশে আর
অল্প হাতপা ছড়িয়ে ঘুমোনো অসম্ভব
অন্ধকারময়তায়; দেখি আমার নিজেরই শব
কেমন আড়ষ্ট পড়ে থাকে এক কোণে, তবু আমি,
জানে অন্তর্যামী,
দূর আকাশের আমন্ত্রণকারী বিশিষ্ট নীলিমা,
শহরের প্রান্তসীমা,
কালপুরুষের তরবারি, বুনোঘোড়ার উদ্দাম
কেশরের ঢেউ আঁর চায়ের বিশদ সরঞ্জাম
দেখার প্রবল সাধ নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকি এবং শুনতে চাই কান পেতে
বনভোজনের গুঞ্জরণ, সর্ষেক্ষেতে
পতঙ্গের উত্তীর্ণ সঙ্গীত আর বৃক্ষদের নিশ্বাস প্রশ্বাস।
কোম্পানির আমলে কারুকাজময় বাক্সে এখন আমার বসবাস।

শ্বাসরোধী বাক্সের ভিতরে জ্বর হয়, বার বার,
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে, এবং জোহরা নাম্লী মহিলার
সঙ্গে থাকি; প্রণয় মরণশীল জেনেও সুদূর সুচেতার সঙ্গে বেশ
ভালবাসাবাসি হয় প্রধানত কল্পনায়। এই মতো আছি যেন দেশ
কাল সন্ততির লেশমাত্র নেই, কালেভদ্রে লুপ্ত সভ্যতার
আলো-অন্ধকার
চকমকি-ঠোকা স্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরিত হয়
হিমায়িত মনে, আর যখন নিদ্রায় কতিপয়
স্বপ্নের চিত্রল সর ভেসে ওঠে, শুনি
আহত হৃদয়ে গোলাপের গান গায় গুল সানোয়ার গুণী,
মোগল সম্রাটদের উত্থানের কাল,
যমুনাতীরের বংশীপ্রিয় জাতিস্মর কোনো খেয়ালী রাখাল
অথবা কবন্ধ কণিঙ্কের দণ্ডায়মান ভঙ্গিমা, অবেলায়
মনে পড়ে যায়,
তাজমহলের আদি নকশা এঁকেছেন যে স্থপতি
ভাবনার একাগ্র সারস তার প্রতি
উড়ে যায়। সতত অসুস্থ আমি, সন্তপ্ত বটে, মাঝে মাঝে
সুর ওঠে, মনে হয়, গায়েবী এস্রাজে;
তখন চিকিৎসা হয়, ভালো লাগে, যেমন ক্ষুধার্তদের দলে
অকস্মাৎ খাদ্যদ্রব্য বিতরিত হলে
ওরা ঘ্রাণে মেতে ওঠে। বাক্সের ভিতরে
ক্রমশ রহস্য বাড়ে, বঙ্গোপসাগরে
কিংবা মেঘে ভেসে কোম্পানির আমলের বাক্স তার বাশিন্দাসমেত
যায় নিরুদ্দেশে
ক্লেশ পাই, কখনো বিপন্ন ভাবি আমিতো প্রেতের গলগ্রহ
কখনো-বা চেঁচিয়ে উঠতে চাই অস্থিমজ্জাহস।

আদি রচনা-২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬
পরিমার্জনা-৩ ফেব্রুয়ারি১৯৮৩

বাস

কারখানায় পড়ে আছে একপাশে চোট-খাওয়া বাস,
ভূতপূর্ব যাত্রীদের সজীব নিঃশ্বাস বাসি হয়ে
লগ্ন তার আহত পাঁজরে। সন্ধ্যায় চন্দ্রার পথে
গিয়েছিল পড়ে খাদে মাতালের মতো
স্খলিত চরণে। হাহাকার
উঠেছিল অন্ধকার বায়ুস্তরে, বনভোজনের
হল্লাবাজ দল হলো মরণের ভোজ। বাস আজ
পড়ে থাকে একা হাসপাতালের রুগীর মতন
দিন-রাত, জানে না সে জন্ম কাকে বলে, মরণের
মানেও জানে না।

বেড়ালের জন্য কিছু পঙক্তি

একটি বেড়াল ছিল ক’বছর আমার বাসায়
কুড়িয়ে আদর, বিশেষত আমার কনিষ্ঠা কন্যা
ওর প্রতি ছিল বেশি মনোযোগী, নিয়মিত ওকে
দেখাশোনা করা, ওর প্রতীক্ষায় থাকা প্রতিদিন,
নাওয়ানো, খাওয়ানো, ওর জন্যে নিজের ভাগের মাছ
তুলে রাখা ছিল তার নিত্যকার কাজ। একদিন
বলা-কওয়া নেই, সে বেড়াল কোথায় উধাও হলো,
কিছুতে গেল না জানা, খোঁজাখুঁজি হলো সার আর
আমার কনিষ্ঠা কন্যা ভীষণ খারাপ করে মন
খেল না দুদিন কিছু চুপচাপ নিলো সে বিছানা,
উপরন্তু বলেনি আমার সঙ্গে কথা অভিমানে,
যেন বেড়ালের এই অন্তর্ধান আমারই কসুর!

কী করে বোঝাই তাকে? ‘আচ্ছা এবার তাহলে আসি
আবার কখনো হবে দেখা’ বলে দিব্যি কোনো কোনো
মানুষও তো এভাবেই চলে যায় বিপুল শূন্যতা
দিয়ে উপহার, তার সঙ্গে দেখা হয় না কখনো।

ভালো মানুষ

আমরা সবাই হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ ভাই
ভালো মানুষের দল।
তাস পিটি আর কী চমৎকার
খেলা দেখি ফুটবল।

পুতুলের মতো চলি অবিরত
সারাদিন, কেয়াবাৎ।
নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
কাটে আমাদের রাত।

মাটির মানুষ ওড়াই ফানুস,
হল্লায় নেই মন;
নেই বেশি পুঁজি, চুপচাপ খুঁজি
পুরানো গুপ্তধন।

আখের গুছিয়ে ছানাপোনা নিয়ে
করি সুখে বসবাস;
মারি হরদম কল্কেতে দম,
তালে তালে ফেলি শ্বাস।

মাথার পোকাটা ওহো সে বোকাটা
কবেই হয়েছে সাফ,
দশজনে মিলে যাইনা মিছিলে,
করি না ওসব পাপ।

বিনা খরচায় পরচর্চ্চায়
কাটাই, নিত্যদিন
ঘরে খিল দিয়ে বগল বাজিয়ে
নাচছি তা ধিন ধিন।

আমরা সবাই হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ ভাই
ভালো মানুষের দল।
নিষ্ফল শোকে নামে না দু’চোখে
মেকী কান্নার ঢল।

মাত্রাবৃত্তে

উৎসবে নয়, পালাপার্বনে নয়,
বস্তুত কোনো উপলক্ষেই নয়,
এমনকি মৃদু চায়ের বিকেলে আমি
হঠাৎ কখনো তোমার অতিথি নই।

জনপথে নয়, প্রাচীরছায়ায় নয়,
ব্লেড-চকচকে ঝিলের কিনারে নয়,
কিংবা পুষ্প নার্সারিতেও নয়,
কোনো সীমান্তে পাই না তোমার দেখা।

ইদানীং খুবই ফুলের আকাল, তবু
আমার কোটের নিভৃত বাটন-হোলে
এখনো সতেজ গোলাপি ছদ্মবেশে
জেগে রয় স্মিত তোমার হাসির স্মৃতি।

ওষ্ঠ আমার চুম্বনসন্ধানী-
কাকে পাবো আজ ব্যাপক শূন্যতায়?
তুমি কি আমাকে মেঘের আড়াল থেকে
স্পর্শাতীতের স্পর্শ চেয়েছো দিতে?
হলুদ বৃষ্টি ঝেপে আসে চরাচরে,
ঈষৎ আড়াল খুঁজে খুঁজে বেলা যায়।
ঠিকানাবিহীন ঠিকানা ঠাউরে নিয়ে
মাত্রাবৃত্তে তোমার কাছেই যাই।

মুখ খোলা আর না খোলা

সব সময় মুখ বন্ধ রাখাটাই
ভয়ের ব্যাপার। আমার মুখে কেউ কোনো
কুলুপ এঁটে দেয়নি। এই তো দিব্যি আমি মুখ খুলে
আমার দু’পাটি দাঁত দেখাতে পারি,
আর এ-ও দেখানো যায়,
ইচ্ছে হলে ঘর কাঁপিয়ে হাসতেও পারে লোকটা।

তাহলে কেন মুখ বুজে থাকবো দিনরাত্রি? কেন আমি
কথা বলবো না, আমার বাকশক্তি যখন অটুট?
সবসময় মুখ বন্ধ রাখাটাই
ভয়ের ব্যাপার! ভয় হয়, এভাবে অষ্টপ্রহর
নিশ্চুপ থাকলে, আমার ভেতরে ক্রমাগত
একটা গোরস্তান তৈরি হতে থাকবে

যদি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
নিজস্ব কণ্ঠ আমি কুয়াশাময় পাথর করে রাখি,
যদি সেখানে সূর্যোদয় না হয়,
তাহলে হয়তো একদিন
খুব সকালবেলা ঘুম থেকে
জেগে উঠে দেখবো, আমি একেবারে বোবা হয়ে গেছি।

কারো সঙ্গে কথোপকথন না হোক
অন্তত দেয়ালের কানে
কিছু কথা বলার দরকার,
যখন বলবার এত কিছু আসে।

না, দেয়ালের কানেও
ফিস্‌ ফিস্‌ করা চলেনা আজকাল। এবং
দেয়ালও গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না।
যদি আমি বলি বনদোয়েলের কথা,
বসন্ত দিনে কোকিলের গান আর কৃষ্ণচূড়ার
বিস্ফোরণের কথা,
আমার শহুরে শীর্ণ নদীটির কথা
অথবা জুড়ে দিই মাতাল নাবিক আর জলকন্যার কাহিনী,
কেউ মুখে তর্জনী তুলে বলবে না ‘চুপ রও!’
যদি বলি মারিজুয়ানা একালের উদ্ধার,
যদি সস্তা আদিরসাত্মক গল্প ফেঁদে বসি, ব্লু ফিল্মের
সাতকাহন বর্ণনা শোনাই আর
বেশ্যাপল্লীকে সন্তদের আস্তানা বলে রটিয়ে দিই,
তখন অনকেই আমার কাঁধ ঘেঁষে
বসবে, ঢুলু ঢুলু চোখে বলবে, ‘তারপর?’

অথচ আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হলে
শূন্য শানকির কথা, তৃতীয় বিশ্বের
অপুষ্টিগ্রস্ত উলঙ্গ শিশুদের কথা আর
ম্লান, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃস্বপ্নের কথা,
ছাঁটাই-হওয়া শ্রমিকের কথা,
রাহুগ্রস্ত সমাজের কাঠামোয় প্রবল কম্পন জাগানো
গণআন্দোলনের কথা, এলাহি
নিষেধ কর্তব্যরত দ্বাররক্ষীর মতো
বন্দুক উঁচিয়ে হারেরে হারেরে করে তেড়ে আসে।

ম্যানিলা, শোনো

ম্যানিলা, শোনো, কোনোরকম ভণিতা বিনাই বলি-
বারবনিতার খদ্দের-জোটানো চটকিলা
হাসির মতো তোমার জ্যোৎস্না
কোনো কোনোদিন অবিরত জ্বালা ধরায়
আমার স্মৃতিতে। ভোর গড়ায় দুপুরে, বিকেল রাত্রিতে।
দিনের পর দিন যায়, দিন যায়। মাঝে-মধ্যে কে যেন
অন্তর্গত কী একটা উস্‌কে দ্যায়;
কখনো কখনো যায় এমন দিনও,
যখন শুধু রক্তে আমার বাজে ফিলিপিনো, ফিলিপিনো!

ম্যানিলা, মনে পড়ে, ঝলমলে সকালে কফিশপে
খাচ্ছিলাম ব্রেকফাস্ট, টলটলে সোনালি
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
দেখছিলাম তাকে, মানে আইরিন নাম্নী তরুণীকে।
কাউণ্টারে দাঁড়ানো সে। তার মুখে দক্ষিণপূর্ব রশীয় মাধুর্য,
সূর্য এবং মেঘসমন্বিত মায়া। কী সুন্দর তুমি,
তোমার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না,
বলেছিলাম তাকে। সহজ মাদকতাময় দৃষ্টি হেনে
ঠোঁটে ছড়িয়ে দিলো সে
পুষ্প বিকাশের আভা; মনে পড়ে, তার কমনীয় গ্রীবা, স্বপ্নিল
চিবুক আর রমনীয় বুক।
মনে পড়ে, তার কোমল ছিল ক্ষীণ,
আজো রক্তে আমার বাজে ফিলিপিনো, ফিলিপিনো!

ম্যানিলা, আমার আপন শহরের পথে রাত্তিরে
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি তোমার কথা
এই অস্পষ্ট ভিড়ে ভেসে যেতে-যেতে। ভাবছি, তুমি
কতদিন মার্কিন সৈনিকের কোলে বসে, হে নগ্নিকা,
ফষ্টিনষ্টি করেছো, তোমার ক্ষুধার্ত শিশুদের পাশে শুইয়ে রেখে
ভিনদেশী বণিকের যৌনসঙ্গিনী হয়ে
নিজেকে ক্লান্ত করেছো কত মৌন রাতে। তোমার ঊরু
আর স্তন নিয়ত নিষ্পিষ্ট হাজার হাজার বিদেশী হাতে।
না, ম্যানিলা, তুমি অমন তাকিও না আমার দিকে,
রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি। বিশ্বাস করো,
লোকে তোমাকে ছেনাল অথবা বেশ্যা বললে
আমার মন ভারি খারাপ হয়ে যায়। তখন নিরালায়
তোমার স্মৃতির বীয়ার পান করতে করতে
পদ্য লিখে মনোভার হাওয়ায় লঘু মিলিয়ে দিতে চাই।
ম্যানিলা, আকণ্ঠ কাদায় ডুবেও তুমি রঙিন ও
জ্বলজ্বলে আর রক্তে আমার বাজে ফিলিপিনো, ফিলিপিনো!

ম্যানিলা, তোমার যন্ত্রণা ও কান্নার কথা ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরে
বলেছিলেন দীর্ঘকায় অধ্যাপক আরমান্দো মালয়, বলেছিলেন
সলিদারিদাদ বইঘরে পেঙ্গুইন পকেটবুক
দেখার ফাঁকে ফাঁকে। শোকার্ত তাঁর বাক্যের সেতুর ওপর
আমি একটি মৌন মিছিল দেখলাম, দেখতে পেলাম
এমন কিছু মানুষ, যারা বালিতে তৈরি যেন, যারা
বাঙ্‌ময় হতে চায়,
অথচ ওদের কণ্ঠনালী কেমন পাথুরে হয়ে গ্যাছে, সেখানে
উচ্চারণের কোনো ডানাঝাপটানি নেই।
হঠাৎ চমকে উঠে শুনি রিজালের মূর্তি আর স্মৃতিসৌধের তৃণ
হাওয়ায় ইতিহাসের রেণু উড়িয়ে বলে ফিলিপিনো ফিলিপিনো!

মৎসকন্যার কাহিনী

রক্তের সমুদ্র থেকে উঠে এল, যেন মৎস্যকন্যা জ্বলজ্বলে,
এল আশ্চর্যের ঘ্রাণ নিয়ে
সমস্ত শরীরে অপরূপ। কী নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন
আবির্ভাব। আসে লোক দশদিক থেকে দলে দলে
ছুটে আসে, অনেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে
আসে ক্রমাগত রাত্রিদিন।
কাগজে ফুলের তোড়া জড়িয়ে অনেকে
আসে অনাবিল সম্মোহনে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে,
এবং শহুরে যারা তারা গলায় পরায়
মালা, বাদ্যরবে পথঘাট
কেমন ভরাট
হয়ে যায়। বিলায় মিষ্টান্ন কেউ, কেউবা ছড়ায়
ফুলের পাপড়ি সারাক্ষণ,
ওড়ায় নিশান ঘরে ঘরে। কেউ কেউ
হয় নতজানু, হয় বিহ্বল স্বপ্নের করতলে। কী বিপুল জাগরণ

ব্যাপক খোয়ারিগ্রস্ত দেশে। দূর সমুদ্রের ঢেউ,
জলজ উদ্ভিদ, শুক্তি, রঙিন ঝিনুক আর প্রবালের স্মৃতিময় তার
সত্তা থেকে ঝরে গান মুক্তির মাতৃভাষায়। মুগ্ধ জনতার
মধ্য থেকে কেউ কেউ আড়চোখে অশ্লীল তাকায়,
শিটি দ্যায়, কেউ কেউ খুব
সুখ পায় তার স্তন এবং নিতম্বের চুরুটের ছ্যাঁকা দিয়ে মাঝে মাঝে,
যেমন নেরুদা লিখেছেন কবিতায়।

অথচ সে ভাষাহীন অভিমানে যায় না সমুদ্রে ফিরে, ডুব
দিয়ে জলে হয় না অদৃশ্য। অবিচল সে দাঁড়িয়ে থাকে, বাজে
সত্তাময় দীপ্ত বাঁশি ইতরজনের অশ্লীলতা
নির্যাতন নোংরামির প্রতি সর্বদা সে উদাসীন, স্বাধীনতা।

যদিও নাস্তিক আমি

রোদপোড়া, বৃষ্টিভেজা যে-কৃষক জানে বানভাসি
জানে খলখলে জলে ভাসমান খোড়ো চার আর
মহিষ, মুনিষ, আর শিশুদের কথা, বারংবার
হারায় তৈজসপত্র, হারায় ফসল রাশি রাশি,
তারই মতো শুনি পুনরায় দূর দিগন্তের বাঁশি,
ধানের মঞ্জুরী হয়ে জ্বলে ভবিষ্যৎ রিক্ত মাঠে;
আবার নিজস্ব স্বপ্নে দেখি আমি নক্‌শাময় খাটে
শুয়ে আছি একা দয়িতার পাশে সঙ্গমপ্রত্যাশী!

যদিও নাস্তিক আমি, তবু প্রার্থনায় নতজানু
এ প্রহরে, করি উচ্চারণ, চিরকাল যেন থাকে
স্বপ্নের পালক তার শরীরের ঋদ্ধ বাঁকে বাঁকে
প্রিয় কিছু স্মৃতির মতন। সেই নারী আয়ুষ্মতী
হোক, যার ওষ্ঠে আমার আয়ুর অণু পরমাণু
রেখেছি গচ্ছিত, ভাবি না সে সতী না অসতী!

শেখ লুৎফর রহমান যখন

শেখ লুৎফর রহমান যখন
শহীদ মিনারের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন,
তখন
সূর্য তার শেষ রশ্নি উপহার দিলো তাঁকে, সমগ্র
সত্তা তাঁর উদ্ভাসিত। সুগন্ধি বনচ্ছায়
থেকে ভেসে আসা বনদোয়েলের গান লুটিয়ে পড়ে
তাঁর পায়ে এবং একটি কোরাস,
তরুণের রক্তের মতো টগবগে আর
বিদ্রোহীর চোখের মতো জ্বলজ্বলে,
তাঁকে জানায় স্বাগত।

শেখ লুৎফর রহমান, দরাজ গলায় গায়ক, যখন
শহীদ মিনারের সিঁড়ি বেয়ে
উঠছিলেন আস্তে আস্তে; তখন আমরা যারা
বসেছিলাম দূরে, দেখলাম-
তিনি আসছেন,
তিনি আসছেন,
তিনি আসছেন,
সতেজ পদক্ষেপে
কোনো যুবরাজের মতো।
যেন খাটো নন তিনি, এক দীর্ঘকায় পুরুষ;
তার চুল শাদা নয় আর, বার্ধক্যের দবিজ ধুলো
ঝরে গেছে, কারো চওড়া কাঁধে কিংবা ক্রাচে
ভর দিয়ে হাঁটছেন না তিনি,
বিপ্লবীর গুলিবিদ্ধ পায়ের মতো।
নয় তাঁর পা,
তিনি উঠে আসছেন, এক তেজী তরুণ।
বার্ধক্যের ভরে নুয়ে ছিল যারা পরাস্ত সৈনিকের মতো
মাথা নত করে ছিল যারা, তাদের
উদ্দেশে তিনি গেয়ে উঠলেন গমগমে গলায়,
‘বল বীর চির উন্নত শির’।

সমাধি ফলক

মনে হয় খুব কায়ক্লেশে
কাঁটা গুল্মময় বহু দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখন
দাঁড়িয়েছি উদাসীন গাছের ছায়ায়। সে গাছের
ডালে রঙ-বেরঙের পাখি
আছে, আছে ফলমূল আর পাতার আড়াল থেকে
গোপন ঝরনার মতো ঝরে গান, যেন
সুদিনের তান বয়ে যায়। গোধূলিতে মনে হয়
কল্পনার গ্রামে
ডানাঅলা ঘোড়া নামে মহাশ্চর্য ফসলের লোভে,
ছোটে দিগ্ধিদিক, ক্রুর খুরের আঘাতে
কত যে প্রতিমা
ধুলায় গড়ায়, তপ্ত নিঃশ্বাসে ওদের
পুড়ে যায় ঘর গেরস্থলি। পারে না ওদের মুখে
লাগাম পরাতে কেউ।

বড় একা লাগে এই গাছের ছায়ায়। বারংবার
ব্যাকুল রুমাল নাড়ি, যদি কেউ আসে, এসে যায়
এখানে, অথচ কারো পদশব্দ শুনি না কোথাও
আশপাশে। নতুন শাড়ির
খসখসানির মতো শব্দ হলে ঝরা পাতাদের
ভিড়ে কান পাতি, ভাবি এই
এল বুঝি দুর্গম পথের সাথী কোনো। কিন্তু কেউ
প্রকৃত দেয় না সাড়া। শুধু ছায়া-অবছায়া ছাড়া
এখনো কিছুই নেই আর, মনে হয়। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে
পাঁশুটে জ্যোৎস্নায়
হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ি ভবঘুরে উদ্বাস্তুর মতো!

স্বপ্নের চত্বরে দেখি পড়ে আছে লাল মখমলে
কোষবদ্ধ তরবারি, বঙ্কিম, প্রাচীন আর নিঃস্ব কৃষকরা
সুগন্ধি সাবান মেখে আপাদমস্তক
ভুস্বামীর জ্বলজ্বলে বেশ পরে নেয় ক্ষিপ্র প্রতিযোগিতায়।

স্বপ্নের ভেতরে
অনেক অনেক লোক নতজানু নদীতীরে, বিধ্বস্ত বাগানে,
পাথুর সিঁড়িতে, চৌরাস্তায় বটমূলে,
বকুল তলার আর অলিতে গলিতে। অকস্মাৎ
অনেক মুখোশ খুলে পড়ে
দুরন্ত হাওয়ায়। রাগী পদাতিক উদ্ধত ঘোড়সওয়ার দ্রুত
আমাকে মাড়িয়ে যায়, হাজার হাজার ওরা করে তছনছ
স্বপ্নের মতন সব সম্পন্ন বাজার। পড়ে থাকি
রক্তিম ধুলোয় আমি অত্যন্ত একাকী,
যেন মনস্তাপময় হু হু এক সমাধি ফলক।

সায়োনারা

দূর ওসাকায় সন্ধ্যাবেলায়
প্লাটফর্মের আনাচে কানাচে তাড়া;
কেউ বলে এলে এতদিন পরে,
কেউ বা ব্যাকুল সায়োনারা, সায়োনারা।

তোমাকে সেখানে দেখবো ভাবিনি,
দেখেই শিরায় জাগলো বিপুল সাড়া।
প্রথম দেখার নিমেষেই হাওয়া
বলে কানে কানে সায়োনারা, সায়োনারা।

ট্যাক্সিতে রাতে তুমি আর আমি,
নেচে উঠেছিল তোমার চোখের তারা।
ওসাকা-রাতের দৃশ্যাবলীতে
লেখা ছিল বুঝি সায়োনারা, সায়োনারা।

সুন্দরীতমা দৈবদয়ায়
এসেছিলে কাছে, হৃদয় আত্মহারা।
চোখের পলকে সময় ফুরায়,
রটে চরাচরে-সায়োনারা, সায়োনারা।

ওসাকার সেই শহর-মরুতে
বস্তুত তুমি মরুদ্যানের চারা,
আমার তামাটে সত্তা তোমার
ছায়ায় শুনেছে সায়োনারা, সায়োনারা।

আমরা দু’জন করেছি ভ্রমণ;
তুমি হিরোশিমা, তুমিই কিয়োতো, নারা,
পায়ের তলায় হলদে পাতারা করে
ফিস্‌ ফিস্‌-সায়োনারা, সায়োনারা।

মন্দিরে দেখি বুদ্ধ মূর্তি,
শিল্পিত হাতে বইছে পুণ্যধারা,
তোমার ও-হাতে হাত রাখতেই
পাখি গেয়ে ওঠে সায়োনারা, সায়োনারা।

কথায় কথায় বলেছিলে তুমি
কখনো দু’পাতা মিশিমা পড়েনি যারা,
তারা জানবেনা জাপানী নারীকে;
তোমার দু’চোখে করি পাঠ সায়োনারা।

শেষ রাত্রির কেটেছে আলাপে,
শরীর তোমার যেন স্বপ্নের পাড়া।
লিফ্‌ট-এ নামার কালে, মনে পড়ে,
বলেছিলে তুমি সায়োনারা, সায়োনারা।

তোমার স্বদেশে প্রবাসী ছিলাম,
ছিলাম উদাস, কিছুটা ছন্নছাড়া।
হৃদয়ে আমার পরবাস আজ,
প্রাণে বাজে শুধু সায়োনারা, সায়োনারা।

সিঁড়িতে ভীষণ ভিড়

সিঁড়িতে ভীষণ ভিড়। ট্রাউজার, পাজামা এবং লুঙ্গি পরে
ঠেলাঠেলি, হেঁটে যায়, দ্রুত যায়, দৌড়ে যায়।
ট্রাউজার পাজামার পা মাড়িয়ে দ্যায়,
লুঙ্গি পাজামাকে গুতো মেরে ছুটে যায়,
পাজামা এগোয় ঊর্ধশ্বাস ট্রাউজারের কণুই
নিপুণ এড়িয়ে
সিঁড়িময় অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায়
যায় ওরা ছুটে যায়। এই সিঁড়ি
অনেক উঁচুতে গেছে। কেউ কেউ অভীষ্ট উপরে উঠে যায়
সার্কাসের অতিশয় দক্ষ ত্র্যাক্রোব্যাটের মতন,
কেউ কেউ দৌড়ে যায়, উড়ে যায়, যেন ইকারুস নীলিমায়।
নিস্তব্ধ বসন্তে লতা-গুল্ম মুখে নিয়ে
এবং শরীরময় কাঁটা নিয়ে অনেকেই নিচে পড়ে যাচ্ছে।

সুদৃশ্য মোটরকার-লাল, নীল, সাদা, কালো, হলদে, সর্ষে রঙ,
ছুটে যায়,
ছুটে যায়,
কখনো দু’দিক থেকে তেড়ে-আসা দু’টি গাড়ি ষাঁড়ের মতন,
ক্ষ্যাপাটে সংঘর্ষে মাতে। কখনো বা ঝিমোনো ট্রাফিক
দূরন্ত ঊর্মিল হয়; উত্তরে দোকান-পাট দক্ষিণে দোকান-পাট,
মধ্যে
জনসাধারণ।

একজন প্রৌঢ় চৌরাস্তায় গোধূলিতে কী উদ্ধ্রান্ত কণ্ঠস্বরে
“আমার সর্বস্ব গেছে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন সুপার মার্কেটে”
বলে পড়ে যায় ক্লিন্ন নর্দমায়। কেউ বা সর্বত্র সর্বক্ষণ রক্তপায়ী
বাদুড়ের ভিড় দেখে অবসন্ন; পাথরের মতো অন্ধ
হয়ে যায় অনেকেই। দরজার কাছে গিয়ে দরজা দ্যাখে না,
তাই কেউ কেউ করে আত্মহত্যা। ভেনাসের লুপ্ত বাহুদ্বয়
পেয়ে গেছে ভেবে কেউ
প্রচণ্ড চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে অকস্মাৎ ফের
বেঘোরে ঘুমোয় অবেলায়।
সংবাদপত্রের ঝকঝকে
প্রথম পাতায় মাঝে মাঝে
নেতাদের চকচকে জুতো শোভা পায়।
উচ্চরিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সকলেই দৈর্ঘে
প্রায় সাড়ে চার ইঞ্চি হচ্ছে, হচ্ছে হচ্ছে।

একটি ধূসর স্যুট ঢোকে ক্লাবে, সিগারেট ফোঁকে
সুনীল হাওয়াই শার্ট, চকোলেট শাড়ি
কোকের স্ট্র ওষ্ঠে খুব আলতো লাগায়,
কারো কারো জলপাই পল্লবের স্পর্শ-লাগা প্রিয় স্মৃতি ওড়ে
রাঙা পতঙ্গের মতো ফ্যানের হাওয়ায়।
আড়ালে নেভী ব্লু স্যুট কালো শিপনের
কানে কানে কী-যে আওড়ায়, হুইস্কির মায়া টানে
শুনতে পায় না কালো শিফন কিছুই,
নেভী-ব্লু-র ঠোঁটে কাঁপে শুধু…
বারান্দায় কালো শিফনের ওষ্ঠ নড়ে
সাফারি স্যুটের দিকে, বোঝেনা সাফারি স্যুট কিছু
যেন কেউ কারো ভাষা বোঝে না কিছুই।
রাত্তিরে রেকর্ড বাজে প্লেয়ারে কোথাও বেজে চলে
হায় এলভিস প্রেসলি
হায় এলভিস প্রেসলি
হায় এলভিস প্রেসলি
কখন যে তুমি
মরাল সঙ্গীত গেয়ে ভীষণ নিথর হয়ে গেলে…
হায় এলভিস প্রেসলি
তবুও তোমার কণ্ঠে ষাট দশকের ছটফটে
আনন্দ, সুতীব্র আর্তি উঠেছিল বেজে কী মোহন কলরোলে।
সিঁড়িতে অনেক ভিড়। অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায়
লোক আসে, লোক যায়; পুরোনো কাগজ, শূন্য ঠোঙা
বিধ্বস্ত পাখির বাসা সিঁড়িতে গড়ায়, উড়ে যায়। সিঁড়ি ছেড়ে
অকস্মাৎ কেউ কেউ স্বপ্নের মতন এলাকায় ম্যান্ডোলিন
বাজাতে বাজাতে হেঁটে চলে, কতিপয় অন্ধ পথ
হাতড়াতে থাকে সারাক্ষণ, তাসের ঘরের মতো পড়ে যায়।

হাতে দোলে নিশান

লোকটার ঘুরে ফিরে দিন যায়, রাত
কাটে
রাস্তায় ঘুমিয়ে।
হাঁটে, হাঁটে, হাঁটে
সে প্রত্যহ নানা পথে, কখনো কখনো
চাখানায় ঢোকে একরাশ ধুলো নিয়ে
গায়ে।
পায়ে
জুতো নেই এবং রা নেই তার মুখে।
কী অসুখে
ভুগে তার
শরীর কঙ্কালসার
কে বলবে বলো?
চোখ ছলো ছলো,
উসকো খুস্‌কো চুল ঘাড় বেয়ে নামে,
রাত্রির গভীর যামে
কুকুরের সঙ্গে কথা বলে,
কিন্তু খাদ্যকণা কুড়িয়ে আনার ছলে
নোংরা নখে তুলে আনে মাটি,
মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলে, ‘তুই খাঁটি,
চন্দ্রসূর্য সাক্ষী, কীট পতঙ্গ সবাই খাঁটি আর
গাঢ় পূর্ণিমার
ভেতরে যে মায়া থাকে, তাও
বড় খাঁটি; তারপর সে শরীরটাকে টেনে টেনে
নিয়ে যায় নিঝুম পাড়ায়।
কীযে হাতড়ায়
সারাক্ষণ আশেপাশে। আঁধারকে খুব ছু’য়ে ছেনে
কী একটা জ্বলজ্বলে আঙ্গুলে নাচায়,
যেন বা খাঁচায়
দূরের অচিন পাখি অলৌকিক নাচে মেতে ওঠে।
তার ঠোঁটে ফোটে
সজীব গোলাপ আর অলৌকিক ঘ্রাণে
ভরপুর সে ঘুমায় দুঃখের বাগানে।
হঠাৎ শহরে
প্রহরে প্রহরে
বাজে পদধ্বনি, অগণন। সে শোনে এবং
দ্যাখে চতুর্দিক জবার মতন রঙ
ফেটে পড়ে; দূর্বার মিছিলে
সেও মেশে, রুক্ষ হাতে তার দোলে নতুন নিশান,
কণ্ঠে জাগে গান।
গানের গৌরবে,
কিসের সৌরভে
লোকটা চিমনির চোঙ ছুঁয়ে উড়ে যায় দূর নীলে।
মেঘে মেঘে তার যাওয়া-আসা,
হস্তধৃত সে নিশানে আছে লেখা অলিখিত কথা-
‘সকল মানুষ, পশু পাখি, গুল্মলতা
সবাই জন্যই ভালোবাসা।

হে আমার স্বপ্নের প্যাগোডা

কবিতা হে প্রিয় আকৈশোর সহচরী,
হে আমার স্বপ্নের প্যাগোডা,
বাংলাদেশে ঘরে ঘরে যত পাত শূন্য পড়ে আছে,
তুমি কি পারবে তাতে জুঁই ফুলের মতন ভাত
নিয়ত ছিটিয়ে দিতে? খরায় পুড়ছে
যে-ক্ষেত ভীষণ দাউ দাউ, পারবে কি
ফোটাতে সেখানে
ফসলের ডাগর যৌবন? যারা ধুলায় গড়ায়
অত্যন্ত শৈশবে আর ক্ষুধার কামড়ে
হঠাৎ কামড়ে ধরে মায়ের উজাড় স্তন, তাদের পিপাসা
মেটানোর ধারা বইয়ে দেবে কি তুমি
কোনো ইন্দ্রজালে? চকচকে আশ্চর্য সোনালি,
তাকে ফের গহন নদীতে নিয়ে যেতে পারো কিনা
দেখি, দেখি হে আমার স্বপ্নের প্যাগোডা।
সেসব বেকার যুবা পথে-বিপথে ঘুরছে শুধু
ধুধু প্রান্তরের হরিণের
পেছনে পেছনে,
তাদের তদ্বিরহীন দরখাস্তে পারবে কি লিখে দিতে
মঞ্জুর নামক
অভীষ্ট মঞ্জল শব্দ? অথবা এখন যারা বানে
যাচ্ছে ভেসে চাল-চুলোসহ গরু-ছাগলের সঙ্গে,
নিমেষে, তাদের পারবে কি তুলে নিতে
মায়াবী হেলিকপ্টারে?

কবিতা হে প্রিয় আকৈশোর সহচরী,
হে আমার স্বপ্নের প্যাগোডা,
তুমি কি এখন অন্ধ তন্বীর মতন
দিনের আলোয় কিংবা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পথ হাঁটো?
হুইল চেয়ারে বসে একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকিয়ে আছেন
সুর্যাস্তের দিকে, তুমি তাকে
দেখতে পাছো না? আজ উদারনৈতিক
মানবতা মৃত; তুমি কালো ব্যাজ পরে
পারবে কি যেতে ঠিক পথ চিনে সে শবযাত্রায়?
এও কি সম্ভব-শরণার্থী শিবিরের শত শত
বিবর্ণ তাঁবুর ক্ষত চকিতে সারিয়ে দিচ্ছো তুমি?
নির্বাসিত যারা, তারা তোমারই কোদালে কাটা পথে
ফিরে যাচ্ছে অনেক বছর পরে দলে দলে নিজ বাসভূমে…
এও কি সম্ভব? হে কবিতা আকৈশোর সহচরী,
পারবে কি তুমি
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হয়ে দীপহাতে প্রতিরাতে
আর্তের শিবিরে ঘুরেঘুরে জীবন কাটিয়ে দিতে?

নাকি তুমি শীয়ামিজ বেড়ালের মতো
কুড়াবে আদর চোখ বুজে অতিশয় সম্পন্ন ড্রইংরুমে
কোনো রূপসীর কোলে অথবা শৌখিল লতা হয়ে
দুলবে দেয়ালে কারো কারো,
কেমন নিরীহ ফণা-তোলা, যেমন সাজানো থাকে মানিল্প্যাণ্ট।

-ম্যানিলা, ৮.১১.৮২

Exit mobile version