- বইয়ের নামঃ না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ নিজেই আমি
একদিন সন্ধ্যেবেলা ফ্ল্যাটে ফিরে দেখি
থমকে-দাঁড়ানো অন্ধকার বারান্দায়
দাঁড়ের সবুজ টিয়ে পাখিটার ঘাড় কী নিখুঁত
মটকে পালিয়ে যাচ্ছে একজন লোক, তাকে খুব চেনা চেনা
লাগল আমার। কিছুদিন
শুধু সবুজাভ ছোপ চারপাশে বারংবার ভেসে
বেড়াল আমাকে ঘিরে। খুন হয়ে যাওয়া টিয়েটার
কথা ভেবে মন ভারি খারাপ থাকল কিছুকাল।
এই তো সেদিন
মাঝ রাত্তিরের বুক শিল্পিত আঁচড়ে চিরে চিরে
বিলায়েত খান
ক্যাসেটে নিশুত দরবারি কানাড়া হচ্ছেন ক্রমে,
হঠাৎ আমার পোষা বেড়ালের, যে আমার
চেয়ারে শয্যায় আর কখনো সখনো
লেখার টেবিলে ঘুমে থাকে, কান্না শুনে
ছুটে গিয়ে দেখি গলা টিপে আক্রোশে মারছে একজন
লোক, হাতে নাতে তাকে ধরে ফেলতেই
সে তাকাল আমার চোখের দিকে, ওর চোখ দুটো
দেখে ভয়ে পেছিয়ে গেলাম
তিন হাত। লোকটা নিহত বেড়ালের
শব ঝুল বারান্দায় ফেলে
চলে গেল অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে। বাষ্পাকুল চোখে
সে রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকলাম
উঠোনে মাটির নিচে নিষ্প্রাণ বেড়ালটিকে
গুপ্তধনের মতন চুপিসারে
গচ্ছিত রাখার পর।
অন্যদিন আমার সবচেয়ে প্রিয় দেশ-বিদেশের
কবিতার বইগুলো দিয়ে
সাজালো জ্বলন্ত চিতা সেই একই লোক। অসহায় চক্ষুদ্বয়
অসহ্য আটকে থাকে ভস্মীভূত অক্ষরমালার দিকে, যেন
অপরূপ একটি সভ্যতা লুপ্ত হলো
আমার চোখের নিচে ঘটা করে। কেমন নিশ্চুপ বসে থাকি
পোড়া গন্ধময়
একলা ঘরের মধ্যে অতিশয় বিস্ফোরিত চোখে।
আকাশ যাচ্ছিল ভেসে চাঁদের যৌবনে আর আমি
ছিলাম নিবিষ্ট ঝুঁকে লেখার টেবিলে।
অকস্মাৎ অমাবস্যা গ্রাস
করে আকাশকে, সে লোকটা
বলা কওয়া নেই
ঘরে ঢুকে আমার নিজস্ব কবিতার খাতা কেড়ে
নিয়ে কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে
সবগুলো পাতা, তার ক্রূর ক্রিয়াপরায়ণ হাত
থেকে খাতা ছিনিয়ে নেয়ার
সাহস হলো না, আমি শুধু নির্বাসিত
কবির মতন
অশ্রুপাত করি ধু-ধু বিদেশ বিভুঁইয়ে।
পড়েছি ভীষণ ধন্দে লোকটাকে নিয়ে; একে একে
আমার সকল প্রিয় বস্তু নষ্ট করে
সে এখন ভয়ানক উল্লাসে প্রমত্ত আর আমি নামহীন
আতঙ্কে সেঁধিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর ক্রমাগত। মনে হয়,
যে কোনো মুহূর্তে এসে লোকটা আমার
মুখের ভেতর ঠেসে দেবে অসংখ্য ঘুমের বড়ি। বড় ভয়ে
ভয়ে থাকি, হে দীপিতা, যদি
আমাদের আর দেখা না হয় কখনো কোনো দিন।
পদধ্বনি শুনি, কার? লোকটা কি আসছে আবার? রোমকূপ
কাঁটা হয়; অথচ নিজেই আমি বানিয়েছি তাকে।
একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব
আজ ফুরফুরে হাওয়ার বিকেলে সদ্য প্রেস থেকে
বেরিয়ে-আসা আমার একটি কাব্যগ্রন্থের
প্রকাশনা উৎসব। কোথায়?
জায়গাটার নাম অকথিত থাক, যদিও
ভূতলবাসী নয় আমার কবিতার বই। গ্রন্থে
ঠাই-পেয়ে-যাওয়া
রচনাগুলি কবিতা না পদ্য, এ নিয়ে বাছা-বাছা
গুণীজনের মধ্যে
বিস্তর মতভেদ লক্ষ্য করা গেছে, যখন এগুলি
প্রকাশিত হচ্ছিল কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিনে কিংবা
প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায়।
একে একে অতিথিরা এলেন ধরাচূড়া নিয়ে,
যাবে বলে আসন গ্রহণ করলেন। দু’চারজন জবরদস্ত
সমালোচক, যাঁরা মনে মনে
শানিয়ে নিচ্ছিলেন তাঁদের প্রিয় বাক্যগুলি,
পরখ করছিলেন সেই ঝকঝকে
তূণ, যেখান থেকে ছুড়বেন কবির হৃদয় লক্ষ্য করে
বিষমাখানো তীর আর
নিজেদের অর্জুন ভেবে পার্শ্ববতী বনোয়ারির
দিকে তাকাবেন প্রশংসাকাতর
দৃষ্টিতে, তাঁরাও বসলেন আয়েশী আঙ্গিকে
যে যার আসনে।
কারো ঠোঁটে স্মিত হাসি, কেউবা
ঈষৎ গম্ভীর, যেন খালে গলা-ডোবানো
মোষ; একটা চাপা গুঞ্জন ঘরময়। কতিপয়
রাগী ছোকরা খিস্তি ছুড়ে দিচ্ছিল
টেবিলে সাজিয়ে-রাখা আমার অতিশয় লাজুক
কাব্যগ্রন্থটির উদ্দেশে। সভাপতি
তাঁর নির্ধারিত আসনটি অলংকৃত করলেন
ঘোষকের আমন্ত্রণে। প্রধান অতিথি
আর বক্তা মহোদয়গণ অনুসরণ
করলেন তাঁকে।
ঘোষক কী যেন বলতে চাইলেন তার মখমল-কোমল
কণ্ঠস্বরে মাইক্রোফোনের
খুব কাছে মুখ নিয়ে। আর সে মুহূর্তেরই
আমার কাব্যগ্রন্থের অন্তঃপুর থেকে
কবিতার অক্ষরগুলো বেরিয়ে এসে সারা ঘরে
উড়তে শুরু করল এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো।
কেউ এসে বসে পড়ল সভাপতির মোগল সম্রাটের
দাড়ির মতো দবিজ দাড়ির ডগায়, কেউ
কোনো সুন্দরীর রঙিন ঠোঁটে চুমু খেল
অনেকক্ষণ ধরে। কেউ কেউ
সুড়সুড়ি দিল প্রধান অতিথির কানের ভেতর,
কেউবা হঠাৎ প্রজাপতি থেকে দূরন্ত বোলতায়
রূপান্তরিত হয়ে হুল ফোটাতে লাগল
সমালোচকদের বাঙির মতো ভুঁড়ি আর ডাগর
পাকাপোক্ত পাছায়। আহারে উহুরে শব্দে
সভাঘর বনে গেল
মেছো বাজার খদ্দের বিহনে।
আমার কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবটাই
ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে ভেবে
দিগ্ধিদিক ছুটতে শুরু করি আর উড়ন্ত অক্ষরগুলোকে
বইয়ের ভেতর ফিরিয়ে আনার জন্যে
কখনো মিনতি জানাই এবং কখনো বজ্রে ধার করে
অনবরত ধমকাতে থাকি জেহোভার মতো।
এখনো নিজেকে
এখন যেখানে আছি, কস্মিনকালেও এখানে
আসতে চাইনি।
একটা ঘোরের মধ্যে এখানে আমার আসা।
ভাবি, কোনো দিন মনের মতো একটা জায়গায়
গিয়ে দাঁড়াব, যেখানে ইঁদুর দৌড় নেই, কলহ,
খিস্তি-খেউড় নেই, দুস্থ ভিড়ের মধ্যে একে অন্যকে
কনুইয়ের গুঁতোয় হটিয়ে পায়ে মাড়িয়ে
যাবার মতো মনোবৃত্তি কারো নেই।
এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত,
একটা সাঁড়াশি চেপে ধরেছে কণ্ঠনালি,
কিছুতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না,
কেবল ক্লান্তি আমাকে চাদর দিয়ে মুড়ে রেখেছে,
স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আশপাশে,
অসুস্থ চোখ জড়িয়ে আসে অবেলায় ঘুমে।
আমি কি স্বস্তি পাব কেতাদুরস্ত কপট মিত্রের
সঙ্গে একটানা আড্ডা নিয়ে?
শান্তি খুঁজব পচা টোমাটোর মতো গণিকার
ক্ষীণায়ু আশনাইয়ে? দু’নৌকায়
পা রেখে আর কতকাল
ঝোড়ো হাওয়ায় চাল সামলে চলব?
এবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার,
এ-কথা কতবার
মনে মনে আউড়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার
চেষ্টা করেছি, অথচ
পুরোনো বৃত্তের বাইরে পা রাখা হ’য়ে ওঠেনি কখনো।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়,-
এই প্রবাদ বারবার আমার জীবনে,
সত্যতা যাচাই করে নিয়েছে। পাঁকে থেকে থেকে
পঞ্জক হবার স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু শেষ অব্দি।
ক্লেদমুক্ত হ’তে পারিনি। আমার অনুভূতিগুলো
গান হ’তে গিয়ে আতর্নাদ হ’য়ে উঠেছে।
আজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছুতে চাই,
যেখানে ঘাসে শুয়ে আকাশের তারা দেখে দেখে রাত ভোর
করে দিতে পারব, নির্বিঘ্নে আঁজলায়
ঝর্ণার পানি তুলে নিতে পারব, দেখতে পারব
খরগোশের দৌড়, হরিণের লাফ, যেখানে বকধার্মিকের
বকবকানি নেই, রাজনৈতিক টাউটদের
ধূর্তামি নেই,
নেই নিষ্কর্মা, দাম্ভিক প্রশাসকদের আস্ফালন।
কিন্তু নিজেকে বিশুদ্ধ করার জন্যে এখনো
যথেষ্ট পুড়িনি রৌদ্রে, ভিজিনি বৃষ্টিতে।
কখনো কখনো
কখনো কখনো সত্য ঘটনা গল্পের, বলা যায়,
চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্যজনক
মনে হয়। এই তো ইঞ্জিন এসে চকিতে নিছক
উন্মাদের মতো
আচরণ করে দিব্যি বসে রইল; শত
সাধ্য সাধনার
পরেও সেখান থেকে এতটুকু নড়বার নাম
করল না। গোধূলিতে সতেজ হাওয়ার
আরাম পাবার বাসনায় প্ল্যাটফর্মে নামলাম
আর ক’জনের মতো। কী নীরব চতুর্দিকে, শুধু
একটি দুটি কণ্ঠস্বর, গলায় গ্রামীণ টান,
শোনা যায় ইতস্তত, ধু-ধু
মাঠ আর অদূরে ডালিম গাছ, ট্রাঞ্জিস্টারে লালনের গান।
কী অবাক কাণ্ড, মনে হয়
বহুদিন পরে ফের তোমাকে ট্রেনের জানালায়
দেখলাম কী সুন্দর, জীবন এ-ও এক পরম বিস্ময়।
যাব কি যাব না ছুটে, এই দোটানায়
মুহূর্ত গড়িয়ে যায়, মাথার ওপরে
নীড়গামী পাখি ওড়ে।
ফুরফুরে কোমল হাওয়া, বহু স্মৃতি পাড়ি-দেয়া, ছুটে যায় তোমার উদ্দেশে
ক্লাস থেকে ছুটি পাওয়া বালকের মতো। তুমি হেসে
তাকালে সে কার দিকে? তুমিই তো ঠিক
ট্রেনের জানালা ঘেঁষে বসে আছে? নাকি অন্য কেউ?
অমন দিঘিতে ভোরবেলার ঝিলিক-
দেয়া চোখ আর কত হতে পারে? আমার হৃদয়ে এই ঢেউ
অপর কাউকে দেখে জাগতে পারে না। নাকি পারে?
পা বাড়াতে গিয়ে শুনি তোমার ট্রেনের গার্ড বাঁশি
বাজায় হঠাৎ। ট্রেন ছাড়ে,
দূরীভূত মূর্তির মতোই স্থাণু আমি; রাশি রাশি
ধোঁয়া প্ল্যাটফর্ম অন্ধকার করে ওড়ে।
তুমিই কি ছিলে ট্রেনে? কিছুতেই কাটে না ধন্দ। মনুষ্যজীবন
এরকমই; ভাগ্যিস আমার ট্রেন করেছিল বিকারের ঘোরে
উন্মাদের মতো আচরণ।
কতকাল পরে
কতকাল পরে কণ্ঠে তোমার মেয়ে
বইয়ে দিয়েছ চকিতে ঝরনাধারা,
যেন শীতার্ত প্রহরে পেয়েছে ফিরে
প্রাণের শিহর মৃত পুষ্পের চারা।
কী করে তোমার রূপ বর্ণনা করি?
তোমার দু’চোখ কী-যে সুন্দর, ভাবি।
স্তনের ডৌল স্বর্গেয় উদ্ভাস,
সোনালি চূড়ায় আমার কি আছে দাবি?
ক্রমে যাবে বেড়ে অন্যের প্রাণবীজ
হয়তো আচরে তোমার গর্ভাশয়ে।
বন্ধ্যা সময়ে তুমি বসন্ত-ফুল,
আমার জীবন চিহ্নিত শুধু ক্ষয়ে।
আমার বাগান মুমূর্ষ ইদানীং
কর্কশ সব ঘাতকের তাণ্ডবে;
সত্তায় বয়ে দুঃস্বপ্নের ছায়া
বড় এক ঘুরি শহুরে এ রৌরবে।
শ্বেত সন্ত্রাস ঘরে ঘরে দেয় হানা,
রঙিন পুতুল ভেঙে যায় পদাঘাতে।
শুভ অশুভের দ্বন্দ্ব প্রবল আজ,
শত কংকাল হত্যাযজ্ঞে মাতে।
তুমি নেই পাশে, শূন্য এ ঘর মরু,
হৃদয় আমার শোকের অমিতাচার।
তোমার চোখের পাতায়, উষ্ণ ঠোঁটে
অশরীরী হয়ে চুমো দিই বারবার।
আমি যে রকম তোমার জন্যে আজও
করি ছটফট কৈ মাছটির মতো,
আমার জন্যে তুমি কি তেমন হও?
হও না বলেই আমি যে ভাগ্যহত।
বলো এ কেমন যুগ-সংকটে হলো
তোমার আমার অস্ফুট পরিচয়।
অতীতের শত স্বৈরাচারীর প্রেত
বর্তমানের শিরায় ছড়ায় ভয়।
আমাদের এই প্রেমের মধ্যদিনে
নামে প্রত্যহ মেশিনগানের ছায়া;
কাঁদানে গ্যাসের ব্যাপক ধূম্রজালে
কোথায় উধাও আয়ত চোখের মায়া!
একনায়কের বুটের তলায় পড়ে
থেঁতলে যাচ্ছে ক্রমশ স্বপ্নগুলি,
তার বোম্বেটে সহচর কতিপয়
ছুড়ে দেয় দূরে শূন্যে মড়ার খুলি।
চৌদিক আজ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা,
বর্বরদল ঘুরছে সগৌরবে;
অন্য কোথাও আশ্রয় খোঁজা বৃথা,
তোমাকে না দেখে আমার মৃত্যু হবে?
কারো একলার নয়
অকস্মাৎ লেখার টিবিল থেকে যদি
আমাকে উপড়ে নেয়, ঘর গেরস্থালি, প্রেমিকার একরাশ
চুলের সৌরভ, সন্তানের চুমো জনপথ, কবিসভা থেকে
ঝোড়ো হাওয়া এক ফুঁয়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়
পালকের মতো, হাতলে কি এ শহর হয়ে যাবে
ধনুকের প্রোজ্জ্বল টংকার?
এ রকম কিছুই হবে না। যে মচ্ছব সালঙ্করা
গণিকার অঙ্গভঙ্গি, তাতে ভাটা
গড়বার লক্ষণ দুর্লক্ষ্য আপাতত। কত নির্ঘুম রাত্রির
স্মৃতি আনে কর্কশ অস্বস্তি। সর্বদাই
নির্ঘুম কবির চোখ, অবসাদে, ক্লেশে
দু’চোখের পাতা জোড়া লাগলেও অন্য চোখ
জেগে থাকে, দ্যাখে
রাত্রির তৃতীয় যামে চাঁদ হাঁটে নীলিমার দবিজ কার্পেট,
ফুটপাতে ঘুমন্ত শিশুর
কপালে নিবিড় টিপ দিয়ে যায় খুব চুপিসারে।
তোমার সৌন্দর্য, হে স্বদেশ, আকৈশোর মুগ্ধ আমি
অনিন্দ্য ফুলের মতো তোমার এ মুখ
উন্মীলিত, যেখানেই যাই
তোমার মুখশ্রী সঙ্গী আমার এবং
দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের ঘোর কেটে গেলে
তোমার রূপের টানে ফিরে আসি তোমার কাছেই।
আমাকে কখনো যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে দূরদেশে
কী ক’রে বাঁচব আমি তোমাকে না দেখে? ভাবি খুব
উদাসীনতায় ডুবে থাকব, অথচ
দুখিনী তোমার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।
হে অনিন্দ্য ফুল,
তোমার ভেতরে ওরা ছড়িয়ে দিয়েছে মুঠো মুঠো
কীট, কালিমার গাঢ়ঝ, পোঁচড়া পড়েছে
তোমার চোখের নিচে, তবু কী সুন্দর
তুমি, রোগ শোক অর্ধাহারে। কত নোংরা
হাত সাপ হয়ে নাচে ডোরাকাটা শাড়ির চৌদিকে,
চায় দরবারি স্খলিত বসনে দেখে পেতে লালসার যৌথ বাহারের ভাগ।
তোমাকে বন্ধক রেখে পেট্রোডলারের খাদেমেরা
নিটোল মুক্তোর মতো নিজেদের আখেরকে সাততাড়াতাড়ি
পৌঁছে দেয় সাত আসমানে। স্থিতি নেই
কোনোখানে, আঙনের কোলাহলে দিশেহারা মানুষ, বনের
পশুপাল আমার জীবন ঘূর্ণিজলে
পাতা যেন, ডোবে আর ভাসে।
এই ডামাডোলে
যার রাজবেশ তার প্রত্যাবর্তনের উপলক্ষে
অসংখ্য তোরণ তৈরি হয় প্রধান শহরে, তাকে
বরণ করার জন্যে সভাসদদের
তুমুল উদ্দীপনায় শূন্য হয়ে যায় সব ফুলের নার্সারি।
জনসাধারণ বিস্ময়ের
চূড়ায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে, কবি দ্যাখে তার
কবিতার ছন্দ ভুলে, শোনে
একটি তোরণ থেকে ভুখা শিশুদের
কান্না ভেসে আসে,
আরেকটি থেকে রাজবন্দিদের দীর্ঘশ্বাস স্বৈরাচারীদের
বিরুদ্ধে ঘৃণার উচ্চারণ,
কোনো কোনো তোরণের চিত্রিত গা বেয়ে
চুইয়ে চুইয়ে পড়ে গত ধর্মৎটে শহীদের
পবিত্র শোণিত। এরই মধ্যে নানা ডৌলে
শব্দ লিখি, ছন্দ গেঁথে যাই আর দশদিকব্যাপী
অন্ধকার থেকে
একমুঠো কালো তুলো নিয়ে
ব্যাজ পড়ি, যা নয় কখনো পরবশে,
কিংবা কারো একলার নয়।
কিংবদন্তি হয়ে
অকস্মাৎ এ কেমন নিস্তব্ধতা এল ব্যেপে দেশে?
এ কেমন সূর্যাস্তের ছটা
বিলাপের মতো
আকাশে ছড়িয়ে পড়ে? বেদনার্ত পাখি নীড়ে ফেরা
ভুলে যায়, ফুল
উন্মীলনে পায় না উৎসাহ,
নদীতে জোয়ারভাটা থেমে যায়; মনে হয়, পঞ্চান্ন হাজার
বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি কী ভীষণ বাষ্পাকুল।
না তোমাকে মানায় না এ রকম কাফনের সাদা
মোড়কে সাজানো শুয়ে থাকা
মাটির গভীরে, না তোমাকে মানায় না;
এ গহন স্তব্ধতায় মিশে-থাকা সাজে না তোমাকে।
রেডিও সংবাদপত্র বলে, তুমি নেই।
গাছপালা, নদীনালা, মাঝিমাল্লা, ক্ষেতমজুরেরা
বলে, তুমি নেই; গ্রাম্য পথ, শহুরে সড়ক দ্বীপ
বলে, তুমি নেই
প্রতিটি নদীর বাঁক, পদ্মার রুপালি ইলিশের
ঝাঁক বলে, তুমি নেই, গোলাপ বাগান, পাহাড়ের
পাকদণ্ডি, উদার গৈরিক মাঠ বলে, তুমি নেই
বাউলের একতারা বলে, তুমি নেই,
তোমার নিজস্ব ঘর গেরস্থালি বলে নেই, তুমি নেই,
পাখিদের ক্লান্ত ডানা বলে, তুমি নেই, তুমি নেই।
তুমি থাকবে না
শহর-কাঁপানো মিছিলের পুরোভাগে,
তুমি থাকবে না
শ্রমিকের কৃষকের, ছাত্রদের বিপুল উজ্জ্বল সমাবেশে, তুমি থাকবে না
পার্টির ব্যাপক সম্মেলনে,
ক্ষুধার্তের সারিতে তোমাকে দেখব না,
রৌদ্র-ধোয়া এ পবিত্র শহীদ মিনারে
ফুলের স্তবক তুমি করবে না অর্পণ কখনো
স্বৈরাচারীদের হিসহিসে চাবুকের
আঘাতে আঘাতে
গণতন্ত্র গোঙাবে যখন,
তখন তোমার কণ্ঠস্বর গর্জে উঠবে না কোনো দিন আর
সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়ে
মেঘে মাথা ঠেকিয়ে কখনো তুমি আর
হাতে নিয়ে ভবিষ্যর সোনালি পতাকা
উদ্দাম যাবে না ছুটে, নেবে না বুকের কাছে তুলে
গুলিবিদ্ধ যুবার শরীর,
কী করে আমরা মেনে নেব অবেলায়
রৌদ্রদগ্ধ পথে যেতে যেতে
হঠাৎ তোমার হাঁটা চৌরাহায় বন্ধ হয়ে যাবে?
এখন তোমার করোটিতে পুষ্পসার,
এখন তোমার চক্ষুদ্বয় স্বপ্নহীন
এখন তোমার কণ্ঠ প্রগতির উচ্চারণহীন
এখন তোমার হাত যুদ্ধোত্তর মাটিলেপা নিষ্ক্রিয় বন্দুক।
যখন আটক ছিলে জেলে, দুপুরে ভাতের পাতে
সর্বদা উঠত ভেসে স্বদেশের মুখ,
যখন নীরন্ধ্র সেলে আসত না ঘুম
দেশবাসীর দুর্গতির কথা ভেবে,
বাঘের চোখের মতো কিছু তারা কী যেন তোমার
কানে কানে
বলে যেত, যখন নিঃশব্দে
পালিয়ে বেড়াতে তুমি ডালকুত্তাদের
ঘ্রাণশক্তি থেকে,
তখনো তোমার বুকে হীরের ধরনে
জ্বলত নিবিড় ভালোবাসা
দূর আগামীর জন্যে, তোমার সত্তায় ছিল লেখা
মুক্তির অক্ষর।
তোমার প্রদীপ্ত কণ্ঠস্বর চকিতে হারিয়ে গ্যাছে
কী বিষণ্ন কুয়াশায়,
যদিও এখন তুমি মেঘে ভাসমান,
এক গুচ্ছ ফুল,
বিরান প্রান্তরে জীবনের বীজ, অথচ এও তো জানি মৃত্যুর জঠর
ফুঁড়ে লোকগাথার মতন
কিংবদন্তি হয়ে তুমি
থাকবে বাংলায় আমাদের পাশে অগণিত হৃদয়ে হৃদয়ে।
কোমল গান্ধার
স্ফটিক সকালবেলা সে কী জন্ম কান্না দশদিক
জাগানো আমার
এবং কৈশোরে কোনো এক দ্বিপ্রহরে
আমার নেহার
বোনকে হারিয়ে বুকফাটা চিৎকারে আকাশটিকে
চিনেমাটি বাসনের মতো খানখান
করে দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সবার অলক্ষ্যে সন্ধ্যেবেলা।
যৌবন আমিও গলা ফাটিয়েছি মিছিলে মিছিলে
আর বর্ণমালাকে কী ক্ষিপ্র মুড়ে ঘৃণা
আর অঙ্গীকারে
দিয়েছি পরায়শ ছুড়ে শক্রর শিবিরে। এতদিনে
বড় ধ’রে এসেছে আমার গলা, প্রায়
বুজে গেছে পানা পুকুরের
মতো, আমি চাই
এখন আমার কণ্ঠে উঠুক নিছক বেজে কোমল গান্ধার।
গাঁও গেরামের কথা
গাঁয়ের নাম অনুক্ত থাক। সে গাঁয়েরই এক যুবক,
নাম তার, ধরা যাক, আক্কাস আলী।
সে তাদেরই একজন যারা অতিশয়
আলসে আর অকর্মার ধাড়ি। প্রায়শই তাড়ি গেলে
এবং সুযোগ পেলেই কোনো
তন্বীর শাড়ির আঁচল ধরে টানে
তবে হঠাৎ কী করে যে সেই যুবকের মধ্যে
এক মজাদার পালাবদলের খেলা
শুরু হয়ে গেল,
গাঁয়ের কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
অনেকেই একে তেলেসমাতি কাণ্ড বলে
মনে করে, কেউ কেউ আড়ালে বলে আঙুল ফুলে কলাগাছ।
যুবকটি কেমন চটপটে হয়ে উঠেছে রাতারাতি,
লুঙ্গির বদলে ওর গায়ে এখন
পাৎলুন, ছেঁড়া গেঞ্জিকে হটিয়ে জায়গা করে নিয়েছে
চক্রাবক্রা কামিজ আর পায়ের হাজা
ঢাকা পড়েছে একজোড়া সিল্কের মোজা আর চকচকে
জুতোর আড়ালে। অষ্টপ্রহর ওর চোখে থাকে
রঙিন চশমা, কব্জিতে ঝলমল করে ঘড়ি।
ইদানীং ওর বোলচালও ভোপাল্টানো মানুষের
মতো। ওর হতশ্রী ছনের ঘর
এখন রূপসীর মতো দালান আর সেখানে চালান
করেছে টুকটুকে বউ
কন্যাদায়গ্রস্ত এক বাপ। যুবক বউ আর
কখনোসখনো ফাউ মেয়েমানুষ,
ট্রানজিস্টার আর টিভি নিয়ে ধুমসে করছে
জীবনযাপন। আপন বলতে তার
তেমন কেউ নেই, তবে ওকে ঘিরে নানা জন
ভন্ভন্ করে, যেমন গুড়ের আড়তে মাছি। উড়ো কথা কানে আসে,
আক্কাস আলীর নাকি প্রধান শহরের
উপর-অলাদের সঙ্গে বেজায় দহরম মহরম।
ফলত ওর পোয়া বারো।
সে গাঁয়েরই এক বর্ষীয়ান লবেজান কৃষক মধ্যরাতের
গভীর অন্ধকারে দু’চোখ মেলে ভাবেন,
আক্কাস আলীর এই আচানক পরিবর্তনের মাজেজা কী?
খটকা লাগে তার মনে। এই গেরামে
শহর থেকে আসা যে নওজোয়ানরা ক্ষেতমজুরদের
শোনাত নয়া দুনিয়ার কথা, বোঝাত
গরিব গুর্বোদের সুদিন আনার তরিকা, তাদের কেউ কেউ
গায়েব হয়ে গেছে, কারো কারো বিকৃত লাশ
পাওয়া গেছে বনবাদাড়ে।
আচ্ছা, সেই বর্ষীয়ান কৃষক ভাবেন,
এই হাদেশার সঙ্গে আক্কাস আলীর তাক্-লাগানো
তরক্কির কোনো সম্পর্ক নেই তো?
এই কথার ঢিল কি তিনি ছুড়বেন পানাপুকুরের মতো
নিস্তরঙ্গ গেরামে? তাহলে কি তিনিও একদিন
গুমখুন হয়ে যাবেন না? মুখে কুলুপ এঁটে
কারও সাতে পাঁচে না থাকাই ভালো।
কী দরকার ফ্যাঁসাদ বাড়িয়ে? আগামীতে তিনি কী করবেন,
কিছুতেই মনস্থির করতে পারলেন না।
সিদ্ধান্তহীনতায় শুধু তিনি ভোরের অপেক্ষায়
পুরোনো বিছানায় পড়ে রইলেন, দু’চোখে ধ্বকধ্বকে জ্বালা
গুন খুন
এখনো আমার নামে কোনো গেরেপ্তারী
পরোয়ানা নেই,
আমি অপরাধী তার কোনো সাক্ষী-সাবুদ কোথাও
কখনো পাবে না খুঁজে কেউ। তবু কেন
হাতকড়া, কয়েদখানার
কালো শিক চোখে ভেসে ওঠে বারবার। চারপাশে
শুনি কত চোখে ভেসে ওঠে বারবার। চারপাশে
শুনি কত গুঞ্জরণ, মনে হয় যেন
সবাই আমাকে নিয়ে নানা কথা বলাবলি করে
আমার আড়ালে-আবডালে। তাহলে কি
হাড়কাঠে গলা দিয়ে বসে আছি? নইলে
কেন আজ খামকা নিজের
ছায়া দেখে ভয় পাই? কথা বলি ঘুমের ভেতরে?
সেদিন রাস্তার ধারে একটি কাফেতে নিরিবিলি
কফি খেতে লাগছিল ভালো; অকস্মাৎ
খালি সিটগুলো ফিটফাট
যুবকেরা নিমিষে দখল ক’রে নিয়ে মেতে ওঠে
গালগল্পে। কান পেতে থাকি,-
একটি যুবক সিগারেট নিখুঁত ধরিয়ে, ধোঁয়া
ছেড়ে আড়চোখে
তাকায় আমার দিকে। তার নজর সরিয়ে
কাঠের টেবিলে ঠোকে তাল; একজন
সুরূপা তরুণী ঠোঁট থেকে ঠোঁটান্তরে ভাসমান
মর্গে-শুয়ে থাকা কোনো তন্বীর মতন। তরুণীর
একা-একা পথ হাঁটা, বই পড়ার ধরন আর
দেহের গড়ন,
চুলের কী রঙ দৈর্ঘ্য কীরকম, কণ্ঠস্বর
সুরেলা বাঁশির প্রতিধ্বনি কিনা, ওর দুটি চোখে
হরিণীর চোখের আদল আছে কিনা,
মুখের লাবণ্য আর স্বভাবের নম্রতা অথবা
বন্যতার চর্চা হলো বেশ কিছুক্ষণ।
সে নাকি হঠাৎ নিরুদ্দেশ
কিছুকাল থেকে, না যায়নি সে বিদেশে;
এই শহরেই আছে, যদিও সম্প্রতি
কাউকে কিছু না বলে দিয়েছে গা ঢাকা। সকলেই
জানে তার খেয়ালীপনার পরিচয়
কম-বেশি, যুবকেরা বলাবলি করে তাকিয়ে আমার দিকে।
যুবাদের বাক্যালাপ শুনে আমার হৃৎপিণ্ড শুধু
খাঁচার পাখির মতো ডানা ঝাপটায়
ঘন ঘন। কী করে সবাই ওরা চেনে
তাকে, যাকে উন্মত্ততাবশে খুন ক’রে
দিয়েছি কবর
আমার খাটের নিচে। কখনো কখনো মধ্যরাতে
সে হেঁটে বেড়ায়
স্বপ্নচারিতায় ঝুল বারান্দায়, ছাদের কার্নিশে।
ঘরের মাঝখানে
এরকম চমকে থমকে দাঁড়ালাম
যেমন নাবিক খুব একলা দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে ডেকে থেকে
স্তিমিত জ্যোৎস্নায় দেখেফেলে
কোনো জলকন্যার আশ্চর্য উদ্ভাসন।
তরঙ্গের পর
তরঙ্গ গড়ায় বিছানায় ক্রমাগত
তোমার ঘুমের কী নিঝুম কিনারায়। হে নিদ্রিতা,
তোমার পা ছুঁয়ে রঙ-বেরঙের মাছ
মোহন সাঁতার কাটে, ছায়ার পাখিরা
তোমার কপালে-ঠোঁটে আলতো ছুঁইয়ে চলে যায়।
নাছোড় ঘোরের মধ্যে কোন চিত্রকর মুগ্ধাবেশে
নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিনরাত
এঁকেছেন তাঁর
নিমগ্ন অস্তিত্ব থেকে ঠিকরে বেরুনো
আলো অন্ধকার দিয়ে? কৃত্রিম আলোর ছটা নয়,
তোমার ত্বকেরই আভা করেছে দখল ঘরটিকে।
তোমার সান্নিধ্যে যাব না কি দূর থেকে জ্ঞান যোগে
দু’চোখের পিপাসা মিটিয়ে
বিষাদে বিদায় নেব? একটি তুফান
আমার বুকের মধ্যে বে-লাগাম
বুনো ঘোড়া, তার
খুরের ঝাপট
লাগলে নিমেষে তুমি অভ্রের মতোই
গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়বে বিছানার চারপাশে অথবা মিলিয়ে
যাবে সুবেসাদিকের স্বপ্নের ধরনে।
এই তো এখন ক’পা এগোলেই আমার দু’হাত
অনাবৃত তোমার শরীরে
হতে পারে চকিতে পিয়ানো বাদকের
সুরেলা চাঞ্চল্য। তুমি জেগে
উঠবে এই ভয়ে আমি দূরত্বকে কাঙ্ক্ষনীয় ভেবে নিথর দাঁড়িয়ে থাকি।
তোমার
নিদ্রিত
আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে কনক চাঁপার
বিচ্ছুরণ, শব্দহীন স্তোত্রপাঠ হয়,
চৈত্ররাত্রি গান গায় তোমার শরীরে। নক্ষত্রের
যমজ সুচারু তোড়া নিতম্ব তোমার নিশীথের কাফ্রি-ঠোঁট
অক্লান্ত লেহন করে, তোমার অলস এলানো
স্তনটিকে, ঈষৎ স্ফুরিত রক্তিমাভ
ঠোঁটে স্বপ্নভাষা স্মৃতি তৈরি করে, পদ্মের মতন
পেটে কতিপয় অলৌকিক আঙুলের খেলা, তুমি
যেন কোনো দূর-দ্বীপে সদ্যোজাত স্বপ্নের মতন শুয়ে আছ
একাকিনী সেই কবে থেকে।
তোমার অত্যন্ত কাছে গেলেই শুনতে
পাব নিঃশ্বাসের মৃদু ধ্বনি, সুরভিত, দেখব বুকের
ওঠা-নামা। তোমার শরীর থেকে উৎসারিত উষ্ণতা আমাকে
জড়িয়ে ধরবে সাবলীল
মালার মতন, দূর থেকে
তোমার মধ্যেই দেখি স্বর্গীয় উদ্যান নিরিবিলি,
নিষিদ্ধ ফলের আভা জায়মান চতুর্দিকে, অথচ এখনো
কম্পিত হৃদয়ে আমি দাঁড়ানো ঘরের মাঝখানে।
চলেও আসতে পারে
কী-যে হলো, কোলাহল শুনে নিভাঁজ নিভৃতি ছেড়ে
বেরিয়ে পড়েছিলাম খোলা পথে একদা আমিও,
দীর্ঘকাল বিষাদে বাঁশিটি ফেলে রেখে এক কোণে
ঘুরপথে কায়ক্লেশে এসেছি বলে কি প্রত্যাখ্যাত
ফিরে যাব ম্লান মুখে? তাকাবে না পথভ্রষ্ট এই
পথিকের দিকে একবারও? সভাকক্ষে হয়েছেন
জড়ো যাঁরা, তাঁরা সগৌরবে করেছেন নিবেদন
রকমারি জড়োয়া গয়নাগাঁটি, প্রফুল্ল কাতান,
কেউ কেউ শিল্পিত গ্রামীণ কাঁথা তোমার উদ্দেশে,
গ্রহণ করেছ হেসে সেসব প্রসিদ্ধ উপহার।
আজীবন ভীষণ উড়নচণ্ডে আমি, পরিণামে
আমার গচ্ছিত ধন, যা দিয়ে তোমার জন্যে কিছু
উপহার আনব ভেবেছি বহুদিন, বহুরূপী
ছলনায় উড়িয়ে দিয়েছি সব খোলামকুচির
মতো; ফলে আজ শুধু একটি ফুলের মালা নিয়ে
এসেছি তোমার কাছে অবহেলিত বাঁশির সুর
শোনাতে আবার। শুনবে তো? নাকি মুখমণ্ডলীর
গুঞ্জরণে কান পেতে আমাকে নিছক উপেক্ষার
ধূসরতা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখবে। মাথানত
করে চলে যাব তবে তাচ্ছিল্যের কাঁটাবন থেকে?
অবশ্য আমার ধড়াচূড়ো নেই, গায়ে ধুলো, পায়ে
ক্রমাগত ঘুরে বেড়ানোর রক্তিম প্রসূন, ক্ষত।
তোমার অত্যন্ত সমাদৃত অতিথিরা অট্রহাসি
হাসবেন আমার সামান্য বাঁশি দেখে, আর এই
আমাকে ভিখিরি ভেবে তড়িঘড়ি আনবেন ডেকে
যমমুখো সশন্ত্রদ্বারীকে। তবু তুমি গরীয়সী
দয়া করে খানিক সময় দাও আমাকে, যাচাই
করে নাও বাঁশি থেকে সুর মঞ্জুরিত হয় কিনা-
চেয়ে দ্যাখো, আমার সুরের তালে লয়ে সভাঘরে
চলেও আসতে পারে, লতাগুল্ম পাথর, হরিণ।
ছিলেন এক কবি
এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন এক কবি, দিলখোলা,
আড্ডাবাজ, কথাবার্তায় তুখোড়, দীর্ঘকায়।
মনে হতো, উঠে দাঁড়ালেই তাঁর
একরাশ লম্বা চুল চকিতে নিয়ে আসবে
মেঘের ঘ্রাণ। সন্ধেবেলা ঢকঢকে সুরা পান, শেষ রাতে
বালিশে বুক চেপে ডুকরে ডুকরে কাঁদা
স্নেহশীলা জননীর জন্যে, বাংলা যার নাম।
বড় কষ্ট, বড় কষ্ট, বুকের ভেতর শ্বাসের টান নিয়ে
চলত লেখা লাগাতার কবিতা ও গান;
অথচ দিনদুপুরে হাসি-খুশি চায়ের আসরে প্রতিদিন।
দুর্নীতি নাম্লী বারবনিতা ঘামে-ভেজা বগল,
দূরভিসন্ধিময় ঊরু আর নাভিমূলের
সন্ধান রাখতেন তিনি গোয়েন্দার ধরনে এবং
মিথ্যাগুলো যে-কোনো ঢঙে রঙিন কাঁচুলি
আর ঘাগরা আর বাহারি দোপাট্রা প’রে এলেও
তাঁর তীক্ষ্ম চোখে পড়ত ধরা ওদের স্বরূপ।
টেরিকাটা, স্যুট-সজ্জিত পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়ানো
ফেরেব্বাজ লোকগুলো কাছে এলেই
গলির লাশের দুর্গন্ধে
তাঁর নাড়িভুঁড়ি আসত উল্টে নিমেষে।
একবার তিনি লিখলেন এক পদ্য আতশবাজির মতো
জ্ব’লে ওঠে। আমি তখন কলাকৈবল্যবাদীদের
ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয়
সুবচনে ভরপুর, মনে মনে বললাম
তাজা একটা গোলাপ শুঁকতে শুঁকতে-ছিঃ,
এ-ও কি কবিতা?
আজ যখন জনগণনন্দিতা দুই বন্দিনীকে
মুড়ে রেখেছে নিঃসঙ্গতা,
স্বৈরাচারীদের লোহার হাত স্বদেশকে দিচ্ছে ঠেলে
ক্রমাগত জাহান্নামের আগুনে,
ঘাতকদের মসৃণ পথে-প্রান্তরে, মুখে শান্তির বুলি
আর ড্রাগনের দাঁতের মতো অশান্তির বীজ বপন করছে
অষ্টপ্রহর, তখন আমার অতীতের মূঢ়তা
ভেংচি কাটে আমাকে।
এখন মনে হয়, সেই কবির
জনতার সংগ্রাম চলবেই পঙ্ক্তিটি তেজী মাছের মতো
লাফিয়ে উঠছে ঘন ঘন, কবিতার
দাঁড়িপাল্লা আর বাটখারার অনেক
ওপরে উঠে
প্রবল হাসছে, যেন সূর্যমুখী।
আগুনের ডানাঅলা পাখির ভর্ৎসনায় নিজেই
আমি নিজের কুশপুত্তলিকা পোড়াই।
এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন এক কবি, দিলখোলা,
আড্ডাপ্রিয় আর আমুদের, গুরুজন অথচ সুহৃদ।
তাঁর কথা আজ মনে পড়ে বারবার,
মনে পড়ে দীর্ঘকায় সেই পুরুষকে,
যিনি লেখার টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেই, ভাবতে ভালো লাগে,
তাঁর একরাশ দীর্ঘ চুল এক ঝটকায় নিয়ে আসবে মেঘের ঘ্রাণ
তিনটি স্তবক
এই তো বৃষ্টি ছাঁট আর ঝোড়ো হাওয়া
ময়লা আকাশটাকে ঝাঁট
দিয়ে গেল। বসে আছি ঘরে
বড় একা; নিজের ভেতরে এক আরশিনগরে কারো ছায়া
পড়ে বলে মনে হয়। পড়শির সঙ্গে দেখা।
যথারীতি জমে যাবে মাদারির খেল। ন্যায়নীতি
নিয়ে কানামাছি খেলি, ভয়ভীতি বিসর্জন দিতে
পেরেছি কি? বিবেকের আঁশ
এখনো আছে কি কিছু লেগে অস্তিত্বের তন্তুজালে?
কালে কালে কী যে হবে। অলীক বৈভবে
সতৃষ্ণ নজর রেখে মরমিয়া চাদরে গা ঢেকে ঘুর ঘুর
করে যায় যারা যুগে যুগে
ছুঁৎমার্গে ভুগে ঘোর রাজনীতিবিদ্বেষী এবং
কাচ ঘেরা গা বাঁচিয়ে তাদের হিসেব নেবে যারা
একদিন, তারা জানি বাড়ছে গোকূলে সুনিশ্চিত
সেদিন বুঝবে ওরা কত ধানে কত হয় চাল।
একদা বিপ্লবী নেতা, আজকাল টাউকো টাউট, সাড়ম্বরে
ব্যাঙ্গের মতন গলা ফুলিয়ে দরাজ
কণ্ঠস্বরে খাল কেটে কুমির আনার বেমিসাল
মন্ত্রণা ঢালেন
প্রভুর লোহার তৈরি কানে, সে মন্ত্রণা
কী পুলক আনে তাঁকে ঘিরে-থাকা মৌমাছির মতো
চেলা-চামুণ্ডার মনে আর
সূক্ষ্ম কলা কৈবল্যবাদের গোধূলির
উদ্যান সভায়
চাটুকার স্ফীতোদর পদ্যকার ভণে,
‘অমৃত সমান
আমার সকল
আমার সকল শ্লোক গজদন্ত মিনারে রচিত
প্রভুর কৃপায়, জয় হোক, জয় হোক মহাত্মার।
চতুর্দিকে সামাল সামাল ভাই রব,
বানে ভাসে দেশ, রিলিফের মাল আসে ঝকঝকে
বিদেশী জাহাজে, কারো বলিহারি পৌষমাস আর
কারো সর্বনাশ,
বন্যার পানিতে খেলা করে মৃত্যু, সূর্যাস্তের সোনা।
মুশকিল আসান হবে কবে?
দুঃখীদের দুর্দশায়
বিজ্ঞাপনী কুম্ভীরাশ্রু দেখি
কী রঙিন। মন্দিরে বাজছে ঘণ্টা, গির্জায় অর্গান,
মসজিদে ধ্রুপদী আজান।
৩
দেশ কি উইয়ের ঢিবি? নইলে
কেন এই মোচ্ছব চৌদিকে বল্মীকের? নৈঃসঙ্গের
মৌতাতে বিভোর বুদ্ধজীবী
কফিন পেয়ালা হাতে স্তব্ধ হয়ে আছেন এবং
উদভ্রান্ত বেকার যুবকের দম মারে ঘন ঘন
গাঁজার ছিলেমে, রাজবন্দিরা যখন
দিন গুনছেন
জেলের চোয়াল থেকে তাঁরা
জনতার হ্যাঁচকা টানে
কখন পাবেন ছাড়া জনতার হ্যাঁচকা টানে আর
লঙ্কাকাণ্ড বাধবে কখন,
তখন অনেকে খোশহাল দস্তখত
মগজে দেয়ালি জ্বেলে দিন দুপুরেই। কী দরকার সর্বক্ষণ
খাঁড়ার ছোয়ায় বেঁচে? নিজে
বাঁচাল বাপের নাম। ঝুঁকিটুকি নিয়ে
লাভ নেই, তার চেয়ে এসো
অন্তত জলসাঘরে বিশুদ্ধ কবিতা নিয়ে মেতে সন্ধ্যেবেলা
নিয়ত নরক গুলজার করি, মডকেও, বন্ধু, হেসে মরি।
দেখব কুড়ানো
এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও এখন চলে যাওয়া
ঠিক হবে কিনা ভাবি।
আট দশ দিন ধরে জ্বরোভাব, বিপন্ন মাড়িতে
জীবাণুর সংক্রমণ, কুষ্টিয়ায় কবি সম্মেলন, লালনের
উৎসবে এবার যাওয়া হবে না আমার। বিছানায়
শুয়ে শুয়ে দেখি বিকেলের গায়ে-হলুদ এবগ্ন ‘গেরস্তের খোকা হোক’ বলে
একটি অদৃশ্য পাখি বিকেলের থুতনি নাড়িয়ে
সন্ধ্যার সন্ধ্যানে চলে যায়। চকিতে তোমার কথা
মনে পড়ে, প্রাণোচ্ছল হাসি খেলা করে আমার এ শূন্য ঘরে।
সেদিনের বিকেল ছিল কি
যে-কোনো বিকেল? হাওয়া ছিল, পাতাগুলো কম্পমান,
শারদ রোদ্দুর জানালায়
নীরব কথক। টেলিফোন বেজে ওঠে;
মদন ভস্মের বহু আগেকার স্বর
ফোটে জ্যোৎস্নাছায়াময় ঝরনার ঝলক নিয়ে, বলে-
‘যদি চাই একটি কবিতা, দেবে তুমি?
হবে কি সময়? নিরুত্তর বসে থাকি
কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ আমার ভেতর থেকে কেউ,
খাপছাড়া, নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে বসে সোফাটায়
তোমার একান্ত মুখোমুখি,
দু’চোখে স্বপ্নের বীজ রুয়ে তুলে নেয় দ্বিধাহীন
তোমার নরম হাত। স্পর্শের আবেশে
লোকটা রূপান্তরিত, গোঙানির মতো শব্দ কিছু
করে উচ্চারণ,
‘তোমাকে ফেরাতে পারি, শিখিনি সে মন্ত্র কোনো দিন’
সত্যি বলতে কী লোকটার আচরণে
ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে থাকি। ক্ষমা করো,
উন্মাদের বুলি
উপেক্ষার চেয়ে বেশি কিছু
আদায়ের যোগ্য নয়, তুমি তার দোষে
আমাকে দিও না শাস্তি। তোমার আয়ত্ত
চোখের মায়ায় ছেয়ে যাক
স্বপ্নজাত আমার আকাশ। এ কেমন দোটানায়
পড়ে গেছি; নিজেই কবিতা তুমি, তবু কেন চাইলে কবিতা,
যখন অসহ্য দাহে পুড়ে যাচ্ছি আপাদমস্তক। এই নাও,
আমার যেমন ইচ্ছে রুপালি পালক কিছু তুলে
নাও, আমি শুধু আগুনের মধ্যে বসে নিরিবিলি
দেখব কুড়ানো।
পথে যেতে যেতে
আজ ভোরবেলা থেকে মন ভালো নেই। কিছুতেই
পড়াশুনা লাগছে না ভাল, এমনকি পদ্য লিখে
মন খারাপের ঘন মেঘ পারি না উড়িয়ে দিতে।
রিকশায় চলেছি লেক সার্কাসের মোড়ে; অভ্র-গুঁড়ো
ঝরায় আকাশ, সন্ধ্যা হয় হয়, বেপরোয়া ঢঙে
ক’জন যুবক হাঁটে ফুটপাতে, বেজে ওঠে শিস
মাঝে মাঝে। মনে পড়ে হৃদয়ের উঠোনে আমার
এখনো পূর্ণিমা জ্বলে, জ্বলবে কি আরও কিছুকাল?
সে কেমন আছে? কি করছে ভেজা ধোঁয়াটে সন্ধ্যায়?
আমাকে কি মনে পড়ে তার, যখন সে বসে থাকে
বারান্দায় খুব একাকিনী, হাতে আধপড়া বই,
কিংবা কাঠবিড়ালির খেলা দেখে কাটায় সময়,
দাঁতে চেপে আঙুল অতীত নিয়ে বোনে তন্তুজাল?
যেন আমি হাড়কাঠে গলা দিয়ে বসে আছি, কাকে
জানাব আমার কথা? কে বুঝবে ভাষাহীন ভাষা?
রাস্তায় ঝিমোচ্ছে বসে লোলচর্ম অসুস্থ মহিষ।
বন্ধু তুমি অকম্পিত হাতে
ডাকতে হয় না, নিজেই সে আসে, টোকা দেয়
মনে, স্মৃতি যার নাম। কখনো কখনো
মুখোমুখি বসে,
পা দোলায় শিস দেয় দোয়েলের মতো কখনোবা
চোখের পানির মতো কী অপ্রতিরোধ্য এসে পড়ে
সবকিছু এলোমেলো করে, এমনকি
পীড়নের ভয়কে তফাৎ যাও বলে। মনে পড়ে,
সেলিম তোমার কথা মাঝে মাঝে খুব
মনে পড়ে। সে কবে প্রথম দেখা হয়েছিল আমাদের?
সেই উনিশশো আটান্নোয়
পুরানো ঢাকায়, অতি পুরাতন বেতার ভবনে।
মনে পড়ে বহুদিন গল্পচ্ছলে সিগারেট পুড়ে ছাই হ’তে
দেখেছি আঙুলে
তোমার এবং কত কিছুই তো ছাইয়ের গাদায় ঠাঁই নেয়
ক্রমান্বয়ে, এমনকি অমৃতের সন্তানও সহজে।
যে হাসি তোমার ঠোঁটে প্রায়শই বেলা-অবেলায়
দেখেছি ঝিকিয়ে উঠতে, তাতে
বিষাদে করেছি লক্ষ্য দ্রুত পুড়ে-যাওয়া
মানুষের কাহিনীর ঈষৎ ঝলক। অনেকেই, বিশেষত
শিল্পীরা পোড়ায় নিজেদের;
কিন্তু এরকম সাততাড়াতাড়ি কেউ আমার ধরনে
করে না আগুনে সমর্পণ। বন্ধু, তুমি
অকম্পিত হাতে
মোমবাতিটার দু’দিকেই খেলাচ্ছলে
তৈরি করেছিলে শিখা।
বাড়িটা
বাড়িটা গভীর রাতে দেখেছিল বৃষ্টিপাত।
ওর সারা গায়ে বর্ষার তুমুল ছাঁট, খুব
হিসহিসে হাওয়া ক্রমাগত
ক্ষ্যাপাটে ছোবল মারে। মাঠের ভেতরে
অন্ধকারে একলা বাড়িটা আরও বেশি
বাড়ি হয়ে ওঠে,
যেন পৃথিবীর আদি বাড়ি
কংক্রিটের অরণ্যের সংসর্গ ছাড়িয়ে
এই মাঠে থিতু।
এ-বাড়ি ছোঁবে না কাউকেই;
কোনো গূঢ় কথা, কারো ছায়া
ধরে রাখবে না কোনো দিন।
কতকাল থেকে বৃষ্টি, রৌদ্র আর বাতাসে বাড়িটা
পারিপার্শ্বিকের প্রতি উদাসীন আর
সন্ন্যাসীর মতো ধ্যানী।
কখনো সে কারো কারো শৈশব অথবা যৌবনের নিমগাছ
এ বাড়িটা কার? জানা নেই। ডুমুরের
গাছটা এখনও
আছে কি দাঁড়ানো এক কোণে? বাসিন্দারা
লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে,
কেউ কেউ হয়তো খাচ্ছে কফি, কেউবা পুরানো কথা
টেনে আনে,
অন্যজন দেয়ালের দিকে চোখ রেখে
চেয়ারে ভাস্কর্য এক চুপচাপ, পায়ে রাগ টানা,
কান পেতে বৃষ্টি শোনে একা,
বলার কিছুই নেই তার।
বুকের অসুখ
তিন-চার মাস ধরে সমগ্র সত্তায় জ্বরোভাব। মুখ তেতো
সারাক্ষণ, খুক খুক কাশি।
ফুসফুস থেকে অবিরাম মিলকভিটা
মাখনের মতো কফ পড়ে,
যদিও খাই না টোস্ট মাখন লাগিয়ে কতকাল,
সে কবে পঞ্চাশ পেরিয়েছি বলে। বন্ধুদের কেউ
কেউ বলেছেন
অনেক আগেই,
‘তোমার কাশিটা ভাই সুবিধের নয়, ভয় হয়,
ভালো করে চিকিৎসা করাও।
অন্তর্গত তেজে কারো পরামর্শে এতদিন তেমন করিনি কর্ণপাত।
এমনই ছিলাম, আছি; থাকব কি বহুদিন?
এখন শরীরটাকে নিয়ে পারছি না
আর, ডাক্তারের
পরামর্শ নিয়ে
যাই গ্রিন সুপার মার্কেটে এক্স-রে করাতে বুকের,
রক্ত পরীক্ষাও হলো; সব
খুঁটিয়ে অভিজ্ঞ চোখে দেখেশুনে ডাক্তার বললেন,
‘আপনাকে, শুনুন, করেছে
দখল ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, তারপর
কাগজে দিলেন লিখে প্রেসক্রিপশান। অকস্মাৎ
মনে পড়ে গ্রিন
সুপার মার্কেটে দোতলায় সন্ধ্যেবেলা
এক্স-রে ঘরে একজন তরুণীকে দেখে
চম্কে উঠেছিলাম। সে কেন এখানে এল? তার পূর্ণিমায়
কোন অমাবস্যা বাসা বেঁধেছে হঠাৎ?
অচেনা সে যুবতীকে দেখে কেবলি তোমার কথা
মনে পড়ছিল বারবার,
আর দ্রুত বেড়ে গেল আমার এ বুকের অসুখ।
তোমার স্পর্শের জন্যে বুক
কাঙালের মতো
অত্যন্ত করুণ চোখ মেলে চেয়ে থাকে অন্তহীন প্রতীক্ষায়।
বেশি বাকি নেই
দেখতে দেখতে ফ্ল্যাটে, গাছগাছালিতে খোলা মনের ভেতরে
হেমন্ত দিনের ছায়া, যাবার সময় হয়ে এল।
সে কখন থেকে তাড়া দিচ্ছে, অথচ এখনো
সুটকেস গোছানো হয়নি।
হ্যান্ডব্যাগ খালি পড়ে আছে। তাড়াহুড়ো
ক’রে খুঁটিনাটি সব জিনিসপত্তর
হ্যান্ডব্যাগে পুরে দিতে গিয়ে
রাজ্যের ঝামেলা।
বাদামি ফ্লাস্কটা কই? পুতুলেরা মেঝেতে গড়ায়।
বড় ঘরে একা, বৃষ্টি ভেজা গন্ধ, কার দীর্ঘশ্বাস
ঘাড় ছুঁয়ে যায়?
তড়িঘড়ি সুটকেসে শার্ট, ট্রাউজার, পাণ্ডুলিপি
ইত্যাদি ভরার পরে সুটকেস কিছুতেই বন্ধ
করতে পারি না আর সবচেয়ে মুশ্কিলে
পড়েছি পুতুল নিয়ে। কাকে ছেড়ে কাকে নেব? তাছাড়া হঠাৎ
জুতো জোড়া কী করে যে এরকম ছোট হয়ে গেল,
অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে আছি
সমাপ্তি ঈষৎ উঁকি দিয়ে যায় কৌতূহলে ধুলো ওড়ে।
‘তোমাকে যেতেই হবে? কণ্ঠস্বর শুনে
পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটি তরুণী
বড় বড় চোখ মেলে দেখছে আমাকে।
মনে পড়ে, কতকাল দেখিনি তন্বীকে, লাল টিপ
স্মৃতির মতোই জ্বলে, সমগ্র সত্তায় তার মেঘমেদুরতা।
বাঁধা-ছাঁদা কী নিপুণ সেরে
ময়ূরপঙ্খীর মতো সে এগিয়ে এসে বলে-‘কত তুচ্ছ কাজে
বেলা গেল, অথচ কিছুই বলা হলো না আমার।
আমারও কি বলবার মতো ছিল কোনো কথা? চুলে
চিরুনি চালিয়ে ছুটি, সময় তো বেশি বাকি নেই।
মঞ্চের মাঝখানে
ভয়ানক ভয় পেয়ে গেছি। এরকম পরিস্থিতি
হবে, যাকে বলে
স্বপ্নেও ভাবিনি কোনো দিন। আমাকে সবাই মিলে
করিয়ে দিয়েছে দাঁড়। এ ব্যাপারে সত্যি বলতে কী,
প্রস্তুতি ছিল না এতটুকু।
এই চোখ ধাঁধানো আলোয়
মনে হলো আমি যেন সুদূর নূহের আমলের জালার ভেতর থেকে বেরিয়ে
এসেছি
অকস্মাৎ,
যেমন ডিমের
সাদাটে খোলস ভেঙে বড় কোন পাখির শাবক
এসে যায় রোদে। চুলে
চিরুনির আঁচড় পড়েনি কতকাল, নখগুলো
দীর্ঘ আর নোংরা, শার্ট বোতামবিহীন। সেই কবে।
স্বপ্নের ভেতর এক জোড়া মোকাসিন
হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন থেকেই নাঙা পায়ে
কেবলি ঘুরছি দিগ্ধিদিক। ট্রাউজার
ঊর্ণনাভ জাল দিয়ে তৈরি, দোমড়ানো-মোচড়ানো।
আমাকে বলতে হবে কিছু কথা শ্রোতার উদ্দেশে,
যারা বসে আছেন সমুখে,
বাগানের কেয়ারির ফুলের মতন সারি সারি। কী বলব
এমন যা শুনে তাঁরা মুগ্ধতার ঘোরে
বাহবা দেবেন ঘন ঘন? হলঘর
করতালিময় হয়ে উঠবে নিমেষে? অতিশয়
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকি, ঠোঁট
শিলীভূত বহু আগেকার মৃতদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে,
সেসব প্রাচীন কণ্ঠস্বর আজ ঠাঁই পেতে চায়
আমার গলায়। আমি কান
বন্ধ করে বোধহীনতায় ডুবে থাকি। কিছুক্ষণ।
এবং উইংস-এর অন্তরালে প্রম্পটার সাজবার ভীষণ হিড়িক
পড়ে যায়। কে কার ওপরে
টেক্কা দিয়ে জোগাবে আমার মুখে নিজেদের কথা,
এ নিয়ে বিস্তর
কিচিরমিচির শোনা গেল। কিন্তু আমি
যদি বলি কোনো কথা তাহলে করব উচ্চারণ
আমার আপন কথা, যতটুকু পারি
নিজেরই ধরনে।
আমি মুখ খুলতেই দেখি হলঘরে কোনো সিটে কেউ নেই, কবরখানার
নিস্তব্ধতা ভর করে আছে চতুর্দিকে। নিরর্থক
ভয়ে আমি কাঠ হয়ে ছিলাম এ মঞ্চে সারাক্ষণ।
যার যার কাজ
তোমরা যে কাজ করো দশজনে মিলে তাতে জিত
হলে ভালো, হার
হলেও কারোর লাজ নেই, এ কথাটা সুনিশ্চিত
জানি, তাই তোমাদের সব চমৎকার ধুন্ধুমার
বাজে নাক গলাতে আসি না। পথেঘাটে
যাত্রীভরা বাসের ভেতর
যদি বোমা ফাটে
হঠাৎ, বলি না ঘরে বসে এ এ খবর
মনঃপূত নয় মোটে। প্রতিদিন শহরে মিছিল
বের হলে, যানজট যেখানে সেখানে
বাধলে হামেশা চিড়বিড়ে বিরক্তির রাগী চিল
প্রশান্তির গাঢ় নীলিমাকে, মন জ্ঞানে,
আঁচড়িয়ে চঞ্চু দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে এক সা করে না
কস্মিনকালেও; যদি জ্বালাও-পোড়াও
দাবি আদায়ের জন্যে, করো ঘেরাও কর্তাকে কোনো, বলবে না
এ বান্দা কাজটা মন্দ হলো,
সে-পথে চলেছ ঠিক সেই পথে চলো।
তোমাদের কোনো কাজে বাগড়া দেবার অভিলাষে
যদি কেউ দলে
আমাকে ভেড়াতে চায়, চোখ মেলে দূরের আকাশে
উদাসীন তাকে কথা দেবার বদলে
স্রেফ সাত হাত দূরে সরে
যাব আমি কিছুই না বলে। বলে রাখি,
তোমাদের সঙ্গে আছি, যতই দোরে
খিল ত্রঁটে বসে থাকি গহন একাকী।
কারো সাতে পাঁচে নেই আমার নিজের কাজ যাতে
করে যেতে পারি নিজ মনে চিরদিন
বাধাবন্ধহীন,
সেদিকে নজর রেখো, তাহলেই আনন্দের ভেলা।
আমাকে ভাসিয়ে নেবে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে।
সারাবেলা
কী কাজ আমার, যদি চাও জেনে নিতে, তবে ঘরে
এসে দেখে যাও-
পায়রা উড়িয়ে দিই যখন তখন, টবে ফুল
ফোটাই সযত্নে ফ্ল্যাটে নিমেষে ময়ুরপঙ্খী নাও
আর জলকন্যাদের ডেকে আনি, তুলি
বিনা ছবি আঁকি সারাক্ষণ, স্বপ্নের বসতবাটি ফঁড়ে
ধ্বনির ফোয়ারা জেগে ওঠে। সোনালি কপাট খুলি
রহস্যের আর ঘুরে ঘুরে
কেবলি পাল্টাতে থাকি সবকিছু। বিরহিণী রাধা
বসে থাকে আমার চেয়ারে ফরহাদ
নহর বানায় ঘরে, তানসেন চকিতে আনেন পূর্ণ চাঁদ,
মেঘমালা। দোহাই, আমার এই কাজে কখনো দিও না বাধা।
শুচি হয়
কখনো দূর থেকে কখনো খুব কাছে থেকে
আমাকে আমার কবিতা সঙ্গ দ্যায়। অপরূপ গোসলের
পানি শীতল ধারায় ধুঁইয়ে দ্যায়
দেহমনের ক্লেদ নীল পদ্ম হয়ে ফুটি। আমার এই
জন্মান্তরকে কেমন করে নিরাপদে
রোদ বৃষ্টি অথবা আগুনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব?
আজ মধ্যরাতে, চাঁদ যখন নির্বাসনে
তারামণ্ডলী গা ঢাকা দিয়েছে বামপন্থী রাজনৈতিক
কর্মীদের মতো, যখন স্বৈরাচারীরা
ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করে কিংবা নাক ডেকে ঘুমায়,
তখন আমি মনস্থির করে ফেলেছি
আমার কবিতা বিষয়ে। এতকাল
যে ধারণার সঙ্গে লদকা লদকি করেছি অষ্টপ্রহর,
তাকে অন্ধকার স্রোতে বন্যা উপদ্রুত এলাকার,
লাশের মতো ভাসিয়ে দিতে
এতটুকু দ্বিধা করিনি।
আমার কবিতায় থাকবে না সেই ভঙ্গি, যা
ভড়কে দেখে পাঠককে, যার ধাক্কায় পা হড়কে পড়বে
কবিযশঃ প্রার্থীরা কিংবা যার মর্মোদ্ধার
করার প্রাণান্তকর, চেষ্টা হোঁৎকা সমালোচকগণ
শেষটায় মাথা চুলকোতে চুলকোতে
ঘা করে ফেলবেন এবং এমন এক জগাখিচুড়ি, ফিসফিসে
থিসিস দাঁড় করাবেন,
যারা মাথামুণ্ড তারা নিজেরাও বুঝতে পারবেন না।
আমার কবিতার ভাষা কস্মিনকালেও
বিজ্ঞাপনের ন্যাকা বুলির মতো হবে না, এমন শব্দাবলী
তাতে থাকবে না যাতে বারবার তাক থেকে
নামাতে হয় স্ফীতোদর অভিধান। আমার কবিতার ভাষায়
বেজে উঠবে দিনানুদৈনিক
জীবনযাপনের ছন্দ। আমার কবিতা অশালীন।
চলচ্চিত্রের নায়িকার কোমর আর নিতম্বের দুলুনি
অথবা লম্বা ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ
কিংবা কালো বোরখা ঢাকা জবুথবু ঢঙের বিরোধী,
আমার কবিতা সবে কামরুল হাসানের সেই
তন্বীর মতো যে ঢেঁকিতে ধান কোটে,
গভীর ইঁদারা থেকে শক্ত হাতে রশি টেনে
বালতি ভরা পানি তোলে গ্রীষ্মের দুপুরে
হাড়-কাঁপানো শীতের সকালে।
আমার কবিতা, আমি ঘোষণা করছি,
কখনো স্বৈরাচারী শাসক, নষ্ট মন্ত্রী, ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ,
কালোবাজারি আর চোরাচালানিদের
সঙ্গে ফুলের তোড়া সাজানো এক টেবিলে ডিনার খেতে
প্রবল অনাগ্রহী, বরং গরিব গেরস্তের ঘরে
ভাগ করে খাবে চিড়ে গুড়। জেনে রাখুন
আমার কবিতা পুলিশের লাঠি আর
বন্দুকের উদ্যত নল দেখে দেবে না চম্পট।
আমার কবিতা নয় গালে ঘাড়ে পাউডার-বুলানো
বিদূষক কিংবা বিশুদ্ধ গোলাপি আমেজে মশগুল
বুলবুলের সুরমুগ্ধ ফুলবাবু,
আমার কবিতা জয়নুল আবেদিনের গুণ টানা মাঝি।
যার বেঁকে যাওয়া পিঠে ছড়িয়ে পড়ে
ঘামমুক্তো আর সূর্যাস্তের রঙ।
আমার কবিতা গণঅভ্যুত্থানের চূড়ায় নূহের
দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে
চেগুয়েভেরার বয়ে যাওয়া
রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে
যারা ডুগডুগি বাজিয়ে
যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর-নাচ নাচায়
তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আবার কবিতা ফুঃ বলে
উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।
আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র
কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আত্মজীবনী।
আমার কবিতা বেঈমান অন্ধকারের বুকে ঈগলের মতো
নখর আর চঞ্চু বসিয়ে ঠুকরে ঠুকরে
বের করে আনে ফিনকি-দেয়া আলো এবং
সেই আলোর ঝরনাধারায় শুচি, হয় শুচি হয়, শুচি হয়।
সাক্ষাৎকার, মধ্যরাতে
উনিশশো ছিয়াশির মার্চ মাসে রাত বারোটায় কী উদ্বেল
কে যে কড়া নেড়ে
ভাঙাল আমার ঘুম, যদিও সুইচ টিপে বেল
বাজালেই হতো; প্রায় তেড়ে
এসে দেখি সুপ্রাচীন ধরাচূড়া নিয়ে একজন
আছেন দাঁড়িয়ে একা, আমার ফ্ল্যাটের দরজায়। আমি তাঁকে
‘ভেতর আসুন’ বলে সোফায় আসন
গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানালাম। পথের কুকুর ডাকে
নির্জন রাস্তাকে চমকিয়ে। ‘ঘোর কলি মহাশয়,
ছিনতাই হয়ে গেছে সর্বস্ব আমার’ বলে রাতের অতিথি
আড়চোখে আমার দৃশ্যমান যা বিষয়-আশয়
নিলেন নিপুণ দেখে। ভীতি
জাগে মনে, তিনি কি আমাকে শেষে তুখোড় তস্কর
ঠাউরে এলেন ফ্ল্যাটে? রত্নহার নাকি গজমোতি
হারালেন, অনুগ্রহ করে বলুন তো মান্যবর?
‘ওসব কিছুই নয়, সম্ভ্রমের সবুজিমা’, বলেন বিমূঢ় বিদ্যাপতি।
হৃদয় তোমার অপরাধ
হৃদয় তোমার অপরাধ নিয়ে কানাঘুষো চলে
নানান পাড়ায়, কলোনির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, অপবাদ
দেয় অনেকেই, কারো কারো মনের জ্বলুনি বেড়ে
যায়, তেড়ে আসে মাস্তানেরা আর প্রকাশ্যে শাসায়
কেউ কেউ। কিছু তোমার বোধগম্য নয়, যদি
বলো, কারো হবে না বিশ্বাস, কেউ ছাড়বে না পিছু,
উপরন্তু চাঁই যারা, তারা তোমাকে সর্বদা মাথা
নিচু করে থাকবার দেবেন নির্দেশ। শেষমেশ
জলচল বন্ধ হবে; ক্রমে ‘ওর নির্বাসন চাই’
বলে স্লোগানের ধুম পড়বে রাস্তায় পুরো দমে।
আকাশে ফুটলে তারা বাগানে রক্তজবা,
হে হৃদয়, তোমার দু’চোখ জ্বলে ওঠে; অকস্মাৎ
কোনো তরুণীর মুখ দেখে শিরায় শিরায় জাগে
ঢেউ, তীব্র অনুরাগে তুমি পুড়ে যেতে যেত গান
গাও দীপকের সুরে-এটাই তো কসুর তোমার,
যতদূর জানি; নাকি খুব একা-একা থাকে, তাই
বরাদ্দ তোমার জন্যে কাঠগড়া! যেন সমাজের
ভরাডুবি তোমার সকল কাজে ভর করে আছে!
নিজের ভেতর থেকে কস্মিনকালেও মুছে যেতে
পারো না বলেই ক্রুদ্ধ তর্জনীর হয়েছ শিকার।