মুখ খোলা আর না খোলা
সব সময় মুখ বন্ধ রাখাটাই
ভয়ের ব্যাপার। আমার মুখে কেউ কোনো
কুলুপ এঁটে দেয়নি। এই তো দিব্যি আমি মুখ খুলে
আমার দু’পাটি দাঁত দেখাতে পারি,
আর এ-ও দেখানো যায়,
ইচ্ছে হলে ঘর কাঁপিয়ে হাসতেও পারে লোকটা।
তাহলে কেন মুখ বুজে থাকবো দিনরাত্রি? কেন আমি
কথা বলবো না, আমার বাকশক্তি যখন অটুট?
সবসময় মুখ বন্ধ রাখাটাই
ভয়ের ব্যাপার! ভয় হয়, এভাবে অষ্টপ্রহর
নিশ্চুপ থাকলে, আমার ভেতরে ক্রমাগত
একটা গোরস্তান তৈরি হতে থাকবে
যদি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
নিজস্ব কণ্ঠ আমি কুয়াশাময় পাথর করে রাখি,
যদি সেখানে সূর্যোদয় না হয়,
তাহলে হয়তো একদিন
খুব সকালবেলা ঘুম থেকে
জেগে উঠে দেখবো, আমি একেবারে বোবা হয়ে গেছি।
কারো সঙ্গে কথোপকথন না হোক
অন্তত দেয়ালের কানে
কিছু কথা বলার দরকার,
যখন বলবার এত কিছু আসে।
না, দেয়ালের কানেও
ফিস্ ফিস্ করা চলেনা আজকাল। এবং
দেয়ালও গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না।
যদি আমি বলি বনদোয়েলের কথা,
বসন্ত দিনে কোকিলের গান আর কৃষ্ণচূড়ার
বিস্ফোরণের কথা,
আমার শহুরে শীর্ণ নদীটির কথা
অথবা জুড়ে দিই মাতাল নাবিক আর জলকন্যার কাহিনী,
কেউ মুখে তর্জনী তুলে বলবে না ‘চুপ রও!’
যদি বলি মারিজুয়ানা একালের উদ্ধার,
যদি সস্তা আদিরসাত্মক গল্প ফেঁদে বসি, ব্লু ফিল্মের
সাতকাহন বর্ণনা শোনাই আর
বেশ্যাপল্লীকে সন্তদের আস্তানা বলে রটিয়ে দিই,
তখন অনকেই আমার কাঁধ ঘেঁষে
বসবে, ঢুলু ঢুলু চোখে বলবে, ‘তারপর?’
অথচ আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হলে
শূন্য শানকির কথা, তৃতীয় বিশ্বের
অপুষ্টিগ্রস্ত উলঙ্গ শিশুদের কথা আর
ম্লান, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃস্বপ্নের কথা,
ছাঁটাই-হওয়া শ্রমিকের কথা,
রাহুগ্রস্ত সমাজের কাঠামোয় প্রবল কম্পন জাগানো
গণআন্দোলনের কথা, এলাহি
নিষেধ কর্তব্যরত দ্বাররক্ষীর মতো
বন্দুক উঁচিয়ে হারেরে হারেরে করে তেড়ে আসে।
ম্যানিলা, শোনো
ম্যানিলা, শোনো, কোনোরকম ভণিতা বিনাই বলি-
বারবনিতার খদ্দের-জোটানো চটকিলা
হাসির মতো তোমার জ্যোৎস্না
কোনো কোনোদিন অবিরত জ্বালা ধরায়
আমার স্মৃতিতে। ভোর গড়ায় দুপুরে, বিকেল রাত্রিতে।
দিনের পর দিন যায়, দিন যায়। মাঝে-মধ্যে কে যেন
অন্তর্গত কী একটা উস্কে দ্যায়;
কখনো কখনো যায় এমন দিনও,
যখন শুধু রক্তে আমার বাজে ফিলিপিনো, ফিলিপিনো!
ম্যানিলা, মনে পড়ে, ঝলমলে সকালে কফিশপে
খাচ্ছিলাম ব্রেকফাস্ট, টলটলে সোনালি
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
দেখছিলাম তাকে, মানে আইরিন নাম্নী তরুণীকে।
কাউণ্টারে দাঁড়ানো সে। তার মুখে দক্ষিণপূর্ব রশীয় মাধুর্য,
সূর্য এবং মেঘসমন্বিত মায়া। কী সুন্দর তুমি,
তোমার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না,
বলেছিলাম তাকে। সহজ মাদকতাময় দৃষ্টি হেনে
ঠোঁটে ছড়িয়ে দিলো সে
পুষ্প বিকাশের আভা; মনে পড়ে, তার কমনীয় গ্রীবা, স্বপ্নিল
চিবুক আর রমনীয় বুক।
মনে পড়ে, তার কোমল ছিল ক্ষীণ,
আজো রক্তে আমার বাজে ফিলিপিনো, ফিলিপিনো!
ম্যানিলা, আমার আপন শহরের পথে রাত্তিরে
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি তোমার কথা
এই অস্পষ্ট ভিড়ে ভেসে যেতে-যেতে। ভাবছি, তুমি
কতদিন মার্কিন সৈনিকের কোলে বসে, হে নগ্নিকা,
ফষ্টিনষ্টি করেছো, তোমার ক্ষুধার্ত শিশুদের পাশে শুইয়ে রেখে
ভিনদেশী বণিকের যৌনসঙ্গিনী হয়ে
নিজেকে ক্লান্ত করেছো কত মৌন রাতে। তোমার ঊরু
আর স্তন নিয়ত নিষ্পিষ্ট হাজার হাজার বিদেশী হাতে।
না, ম্যানিলা, তুমি অমন তাকিও না আমার দিকে,
রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি। বিশ্বাস করো,
লোকে তোমাকে ছেনাল অথবা বেশ্যা বললে
আমার মন ভারি খারাপ হয়ে যায়। তখন নিরালায়
তোমার স্মৃতির বীয়ার পান করতে করতে
পদ্য লিখে মনোভার হাওয়ায় লঘু মিলিয়ে দিতে চাই।
ম্যানিলা, আকণ্ঠ কাদায় ডুবেও তুমি রঙিন ও
জ্বলজ্বলে আর রক্তে আমার বাজে ফিলিপিনো, ফিলিপিনো!
ম্যানিলা, তোমার যন্ত্রণা ও কান্নার কথা ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরে
বলেছিলেন দীর্ঘকায় অধ্যাপক আরমান্দো মালয়, বলেছিলেন
সলিদারিদাদ বইঘরে পেঙ্গুইন পকেটবুক
দেখার ফাঁকে ফাঁকে। শোকার্ত তাঁর বাক্যের সেতুর ওপর
আমি একটি মৌন মিছিল দেখলাম, দেখতে পেলাম
এমন কিছু মানুষ, যারা বালিতে তৈরি যেন, যারা
বাঙ্ময় হতে চায়,
অথচ ওদের কণ্ঠনালী কেমন পাথুরে হয়ে গ্যাছে, সেখানে
উচ্চারণের কোনো ডানাঝাপটানি নেই।
হঠাৎ চমকে উঠে শুনি রিজালের মূর্তি আর স্মৃতিসৌধের তৃণ
হাওয়ায় ইতিহাসের রেণু উড়িয়ে বলে ফিলিপিনো ফিলিপিনো!
মৎসকন্যার কাহিনী
রক্তের সমুদ্র থেকে উঠে এল, যেন মৎস্যকন্যা জ্বলজ্বলে,
এল আশ্চর্যের ঘ্রাণ নিয়ে
সমস্ত শরীরে অপরূপ। কী নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন
আবির্ভাব। আসে লোক দশদিক থেকে দলে দলে
ছুটে আসে, অনেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে
আসে ক্রমাগত রাত্রিদিন।
কাগজে ফুলের তোড়া জড়িয়ে অনেকে
আসে অনাবিল সম্মোহনে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে,
এবং শহুরে যারা তারা গলায় পরায়
মালা, বাদ্যরবে পথঘাট
কেমন ভরাট
হয়ে যায়। বিলায় মিষ্টান্ন কেউ, কেউবা ছড়ায়
ফুলের পাপড়ি সারাক্ষণ,
ওড়ায় নিশান ঘরে ঘরে। কেউ কেউ
হয় নতজানু, হয় বিহ্বল স্বপ্নের করতলে। কী বিপুল জাগরণ
ব্যাপক খোয়ারিগ্রস্ত দেশে। দূর সমুদ্রের ঢেউ,
জলজ উদ্ভিদ, শুক্তি, রঙিন ঝিনুক আর প্রবালের স্মৃতিময় তার
সত্তা থেকে ঝরে গান মুক্তির মাতৃভাষায়। মুগ্ধ জনতার
মধ্য থেকে কেউ কেউ আড়চোখে অশ্লীল তাকায়,
শিটি দ্যায়, কেউ কেউ খুব
সুখ পায় তার স্তন এবং নিতম্বের চুরুটের ছ্যাঁকা দিয়ে মাঝে মাঝে,
যেমন নেরুদা লিখেছেন কবিতায়।
অথচ সে ভাষাহীন অভিমানে যায় না সমুদ্রে ফিরে, ডুব
দিয়ে জলে হয় না অদৃশ্য। অবিচল সে দাঁড়িয়ে থাকে, বাজে
সত্তাময় দীপ্ত বাঁশি ইতরজনের অশ্লীলতা
নির্যাতন নোংরামির প্রতি সর্বদা সে উদাসীন, স্বাধীনতা।