বাক্স উপাখ্যান
মনে হয়, কোম্পানির আমলের কারুকাজময়
সেগুন কাঠের বাক্সে আমি আছি সকল সময়।
বড় বেশি শান্ত, হয়তো কবরের ভিতরে এমন লাগে বলে
অনুভূত হয়, যদি কেউ ভাবে আমার নিজস্ব কৌতূহলে
মর্চে পড়ে গেছে বাক্সটির অভ্যন্তরে
বসবাসহেতু, তবে তাকে ধিক্কারের ধূলি-ঝড়ে
অন্ধ করে দিতে
পারবো না কিছুতেই। যদিও আমার শ্বাস নিতে
কষ্ট হয় অতিশয়, যদিও হাঁপাই বারংবার
আমি হৃদরোগীর মতন ক্লেশে আর
অল্প হাতপা ছড়িয়ে ঘুমোনো অসম্ভব
অন্ধকারময়তায়; দেখি আমার নিজেরই শব
কেমন আড়ষ্ট পড়ে থাকে এক কোণে, তবু আমি,
জানে অন্তর্যামী,
দূর আকাশের আমন্ত্রণকারী বিশিষ্ট নীলিমা,
শহরের প্রান্তসীমা,
কালপুরুষের তরবারি, বুনোঘোড়ার উদ্দাম
কেশরের ঢেউ আঁর চায়ের বিশদ সরঞ্জাম
দেখার প্রবল সাধ নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকি এবং শুনতে চাই কান পেতে
বনভোজনের গুঞ্জরণ, সর্ষেক্ষেতে
পতঙ্গের উত্তীর্ণ সঙ্গীত আর বৃক্ষদের নিশ্বাস প্রশ্বাস।
কোম্পানির আমলে কারুকাজময় বাক্সে এখন আমার বসবাস।
শ্বাসরোধী বাক্সের ভিতরে জ্বর হয়, বার বার,
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে, এবং জোহরা নাম্লী মহিলার
সঙ্গে থাকি; প্রণয় মরণশীল জেনেও সুদূর সুচেতার সঙ্গে বেশ
ভালবাসাবাসি হয় প্রধানত কল্পনায়। এই মতো আছি যেন দেশ
কাল সন্ততির লেশমাত্র নেই, কালেভদ্রে লুপ্ত সভ্যতার
আলো-অন্ধকার
চকমকি-ঠোকা স্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরিত হয়
হিমায়িত মনে, আর যখন নিদ্রায় কতিপয়
স্বপ্নের চিত্রল সর ভেসে ওঠে, শুনি
আহত হৃদয়ে গোলাপের গান গায় গুল সানোয়ার গুণী,
মোগল সম্রাটদের উত্থানের কাল,
যমুনাতীরের বংশীপ্রিয় জাতিস্মর কোনো খেয়ালী রাখাল
অথবা কবন্ধ কণিঙ্কের দণ্ডায়মান ভঙ্গিমা, অবেলায়
মনে পড়ে যায়,
তাজমহলের আদি নকশা এঁকেছেন যে স্থপতি
ভাবনার একাগ্র সারস তার প্রতি
উড়ে যায়। সতত অসুস্থ আমি, সন্তপ্ত বটে, মাঝে মাঝে
সুর ওঠে, মনে হয়, গায়েবী এস্রাজে;
তখন চিকিৎসা হয়, ভালো লাগে, যেমন ক্ষুধার্তদের দলে
অকস্মাৎ খাদ্যদ্রব্য বিতরিত হলে
ওরা ঘ্রাণে মেতে ওঠে। বাক্সের ভিতরে
ক্রমশ রহস্য বাড়ে, বঙ্গোপসাগরে
কিংবা মেঘে ভেসে কোম্পানির আমলের বাক্স তার বাশিন্দাসমেত
যায় নিরুদ্দেশে
ক্লেশ পাই, কখনো বিপন্ন ভাবি আমিতো প্রেতের গলগ্রহ
কখনো-বা চেঁচিয়ে উঠতে চাই অস্থিমজ্জাহস।
আদি রচনা-২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬
পরিমার্জনা-৩ ফেব্রুয়ারি১৯৮৩
বাস
কারখানায় পড়ে আছে একপাশে চোট-খাওয়া বাস,
ভূতপূর্ব যাত্রীদের সজীব নিঃশ্বাস বাসি হয়ে
লগ্ন তার আহত পাঁজরে। সন্ধ্যায় চন্দ্রার পথে
গিয়েছিল পড়ে খাদে মাতালের মতো
স্খলিত চরণে। হাহাকার
উঠেছিল অন্ধকার বায়ুস্তরে, বনভোজনের
হল্লাবাজ দল হলো মরণের ভোজ। বাস আজ
পড়ে থাকে একা হাসপাতালের রুগীর মতন
দিন-রাত, জানে না সে জন্ম কাকে বলে, মরণের
মানেও জানে না।
বেড়ালের জন্য কিছু পঙক্তি
একটি বেড়াল ছিল ক’বছর আমার বাসায়
কুড়িয়ে আদর, বিশেষত আমার কনিষ্ঠা কন্যা
ওর প্রতি ছিল বেশি মনোযোগী, নিয়মিত ওকে
দেখাশোনা করা, ওর প্রতীক্ষায় থাকা প্রতিদিন,
নাওয়ানো, খাওয়ানো, ওর জন্যে নিজের ভাগের মাছ
তুলে রাখা ছিল তার নিত্যকার কাজ। একদিন
বলা-কওয়া নেই, সে বেড়াল কোথায় উধাও হলো,
কিছুতে গেল না জানা, খোঁজাখুঁজি হলো সার আর
আমার কনিষ্ঠা কন্যা ভীষণ খারাপ করে মন
খেল না দুদিন কিছু চুপচাপ নিলো সে বিছানা,
উপরন্তু বলেনি আমার সঙ্গে কথা অভিমানে,
যেন বেড়ালের এই অন্তর্ধান আমারই কসুর!
কী করে বোঝাই তাকে? ‘আচ্ছা এবার তাহলে আসি
আবার কখনো হবে দেখা’ বলে দিব্যি কোনো কোনো
মানুষও তো এভাবেই চলে যায় বিপুল শূন্যতা
দিয়ে উপহার, তার সঙ্গে দেখা হয় না কখনো।
ভালো মানুষ
আমরা সবাই হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ ভাই
ভালো মানুষের দল।
তাস পিটি আর কী চমৎকার
খেলা দেখি ফুটবল।
পুতুলের মতো চলি অবিরত
সারাদিন, কেয়াবাৎ।
নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
কাটে আমাদের রাত।
মাটির মানুষ ওড়াই ফানুস,
হল্লায় নেই মন;
নেই বেশি পুঁজি, চুপচাপ খুঁজি
পুরানো গুপ্তধন।
আখের গুছিয়ে ছানাপোনা নিয়ে
করি সুখে বসবাস;
মারি হরদম কল্কেতে দম,
তালে তালে ফেলি শ্বাস।
মাথার পোকাটা ওহো সে বোকাটা
কবেই হয়েছে সাফ,
দশজনে মিলে যাইনা মিছিলে,
করি না ওসব পাপ।
বিনা খরচায় পরচর্চ্চায়
কাটাই, নিত্যদিন
ঘরে খিল দিয়ে বগল বাজিয়ে
নাচছি তা ধিন ধিন।
আমরা সবাই হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ ভাই
ভালো মানুষের দল।
নিষ্ফল শোকে নামে না দু’চোখে
মেকী কান্নার ঢল।
মাত্রাবৃত্তে
উৎসবে নয়, পালাপার্বনে নয়,
বস্তুত কোনো উপলক্ষেই নয়,
এমনকি মৃদু চায়ের বিকেলে আমি
হঠাৎ কখনো তোমার অতিথি নই।
জনপথে নয়, প্রাচীরছায়ায় নয়,
ব্লেড-চকচকে ঝিলের কিনারে নয়,
কিংবা পুষ্প নার্সারিতেও নয়,
কোনো সীমান্তে পাই না তোমার দেখা।
ইদানীং খুবই ফুলের আকাল, তবু
আমার কোটের নিভৃত বাটন-হোলে
এখনো সতেজ গোলাপি ছদ্মবেশে
জেগে রয় স্মিত তোমার হাসির স্মৃতি।
ওষ্ঠ আমার চুম্বনসন্ধানী-
কাকে পাবো আজ ব্যাপক শূন্যতায়?
তুমি কি আমাকে মেঘের আড়াল থেকে
স্পর্শাতীতের স্পর্শ চেয়েছো দিতে?
হলুদ বৃষ্টি ঝেপে আসে চরাচরে,
ঈষৎ আড়াল খুঁজে খুঁজে বেলা যায়।
ঠিকানাবিহীন ঠিকানা ঠাউরে নিয়ে
মাত্রাবৃত্তে তোমার কাছেই যাই।