কবির কুকুর
যখন লেখেন তিনি অথবা পড়েন কোনো বই
ভোরবেলা গহন দুপুরে মধ্যরাতে, তখন সে
শুয়ে থাকে নিরিবিলি মেঝেতে একাকী ভারি খুব
কাছ ঘেঁষে, বলা যায়, পায়ের কাছেই। মাঝে মাঝে
হাই তোলে, কৌতূহলী চোখে চেয়ে দ্যাখে কী অস্থির
তিনি করছেন পায়চারি ঘরময়, কখনোবা
ঘাঁটছেন অভিধান, যেমন বালক ঝিনুকের
লোভে খোঁড়ে বালি নদীতীরে; দ্যাখে কবির ওপর
কে যেন করেছে ভর, বুঝি তাই পাতায় পাতায়
নিমিষে উঠছে ফুটে গোলাপের গহনতা, গূঢ়
রজনীগন্ধার গ্রীবা, ভেজা বালিতে চিত্রল কিছু
হরিণের পদচ্ছাপ, চিতাবাঘের অত্যুগ্র রঙ
জ্বলজ্বলে, যুথচারী হাতির সফেদ দাঁত, যেন
পুরুষ্টু চাঁদের ফালি। আর কল্পনায় খরা এলে
ব্যেপে, তিনি নিঃসাড় থাকেন বসে একা, চুপচাপ-
শব্দের মৃগায় স্তব্ধ জটিল অরণ্যে অকস্মাৎ।
যখন ঘুমোতে যান তিনি খাটে বাতিটা নিভিয়ে,
তখন সে নড়েচড়ে ওঠে, মাথাটা ঝাঁকিয়ে মাছি
তাড়াবার সঙ্গে ক্ষিপ্র দাঁড়ায় সটান, তার চোখ
থেকে ঝরে ক্রমাগত মণিরত্ন, রাশি রাশি, আর
হঠাৎ উৎকর্ণ হয়, যেন এই মাত্র রেডিওতে
শুনেছে বিপজ্জনক আবহাওয়া বার্তা কোনো বুঝি
এল ঝড় ভয়ঙ্কর কাঁপিয়ে দুনিয়া, যেন তার
জঠরে পড়েছে ঢুকে হাওয়াময় অন্ধকার, যেন
এখুনি ঘরের ছাদ ধসে পড়ে মাথার ওপর,
প্রেতের দঙ্গল করে ফিসফিস ঘরের চৌকাঠে।
ঘোরে সে কিসের ঘোরে কবির শয্যার চারপাশে,
ডেকে ওঠে বারংবার জীবনের মতো কণ্ঠস্বরে
বিনিদ্র কুকুর।
কী সঞ্চয় রেখেছো
কালের কামড়-খাওয়া ছন্নছাড়া হে বংশীবাদক
তুমি কি নিজেই হবে নিজের খাদক
আত্মনাশী প্রাণীর মতন আজ? এখন, এখন কেন আর
আক্ষেপের সুর শুধু বাজাও একাকী বারবার?
বস্তুত এই তো চেয়েছিলে…
এই মতো গাছপালা দেখে দেখে, আসমানী নীলে
চোখ রেখে, কখনো উদাস
প্রান্তরে পথিক হয়ে মনের মোহন ফরমাশ
খেটে খেটে হৃদয়ের অন্ধকারে অজস্র কুসুম
ফুটিয়ে নেপথ্যে বেঁচে থাকা; খড়কুটোময় অত্যন্ত নিঝুম
দ্বিপ্রহরে খরগোশের দৌড়, হরিণের আনন্দিত লাফ মনে
তুলে নেয়া আর গৃহকোণে
বিড়ালের নিরিবিলি ঘুমের ভিতরে
বসবাস, ফেরেশতার পাখার ছায়ায় বুক ভরে
সুগন্ধি বাতাস নেয়া-এর চেয়ে বেশি কিছুর উদ্দেশে
কখনো গায়নি গান আকাঙ্ক্ষা তোমার। মেঘে ভেসে
ভেসে সারাদিনমান তুমি কি আপনার বংশী ধ্বনি শুনে
কিংবা তারা গুণে
গুণে মধ্য রাতে খুব ক্লান্ত হয়ে গ্যাছো? বুঝি তাই পূর্ণিমার,
ফুলের পাখির সঙ্গে রাগ করে অন্ধকার
কুঠরিতে রক্ত তুলে গলায় নিজের
ওপরই ভীষণ প্রতিশোধ নিতে চাও। কেউ টের
পাক আর নাই পাক, তুমি নিজে জানো
কী জটিল নিষ্করুণ আত্মপ্রতারণা-জাল রয়েছে জড়ানো
জীবনের পাকে পাকে। অথচ এই তো চেয়েছিলে…
কখনো হাঁসের বিলে,
কখনো বা ফ্যাক্টরির চিম্নির ধোঁয়ায়
চোখ রেখে অলৌকিক কিসের ছোঁয়ায়
বেঁচে থাকা। তবে কেন স্মৃতির সৈকতে
প্রেতের মতন হাঁটো, হঠাৎ হারিয়ে যাও নিঃস্ব চোরা পথে
অভিমানে? মওয়া শরীরের ভার টেনে
নিজেকে ধিক্কার দাও আজ ঘন ঘন? কার কাছে হার মেনে
তুমি হবে নতজানু, বাঁশি ফেলে দাঁড়াবে হে দীন
প্রত্যাশাবিহীন উদ্ভিদের মতো ভাবলেশহীন?
নাকি তুমি একালের দারুণ নিষ্ঠুর
বিলুপ্তির সুর
তুলবে বাঁশিতে? কিন্তু দেখি, অকস্মাৎ
সুরের জগতে নামে ক্রুর পক্ষাঘাত।
ভৈরবী কি পূরবীকে আত্মসাৎ করে
ব্যাপক স্তব্ধতা অগোচরে।
তুমি ঠায় থাকবে দাঁড়িয়ে,
মরীচিকাময়, পথে নিরাশ্রয়, চকিতে হারিয়ে
তমার নিজস্ব সুর? এদিকে তমসা আসে ব্যেপে
দেশে দেশান্তরে; স্বাপদেরা ওঠে ক্ষেপে,
দিকে দিকে কেবলি রক্তাক্ত হয় প্রাণের প্রতিমা।
লক্ষ্যহারা বিপর্যয়ে অগাধ নীলিমা,
প্রগাঢ় সবুজ মুছে যায়, কী ধূসর
জঞ্জালে আচ্ছন্ন মনে হয় চরাচর।
হে বংশীবাদক কী সঞ্চয়
রেখেছো অন্তরে, যার বলে এ প্রলয়ে হবে তুমি মৃত্যুঞ্জয়।
প্রথম লেখন : ৭ মার্চ, ১৯৭৬
পরিমার্জনা :১২ জানুয়ারি, ১৯৮৩
ডন জুয়ান
১
আবার আমার মন নীলিমামাতাল ঈগলের
মতোই চঞ্চল হয়ে ওঠে, পর্বতের এক চূড়া
থেকে দূরবর্তী অন্য চূড়ায় স্বপ্নের দীপ্র গুঁড়া
ব্যাকুল ছড়িয়ে দিতে চায়। এ স্থবির বিশ্রামের
জাল ছিঁড়ে নতুনের সন্ধানে মেতেছি বলে দোষ
ধরো যদি, তবে আমি নিরুপায়। এ পোষ-না-মানা
গতিরোধ আমাকে তাড়িয়ে ফেরে, তাই তো অজানা
সর্বদা আমাকে ডাকে, কারো মিনতি কি রোষ
কখনো পারে না দিতে বাধা যাত্রাপথে। কোনো নারী,
যতই সুন্দরী হোক, হোক মোহময়ী, নয় সে আমার
তৃপ্তির পরমা কেউ। অকূল তৃষ্ণায় বারংবার
ছুটে যাই এক রমনীর আলিঙ্গনে থেকে অন্য
তন্বীর মদির বুকে। ভালোবেসে যাকে পাই, ছাড়ি
স্বেচ্ছায় তাকেই, ফের নতুন তৃষ্ণায় হই বন্য।
২
আমার নরকবাস সকলের কাম্য। রূপসীর
স্বামী, তরুণীর পিতা, সবাই আমাকে অভিশাপ
দেয় দিনরাত, যেন আমি চিতাবাঘ কিংবা সাপ
খোপ, বরাহের, খাদ্য হই, হই দুধারী অসির
বলি ক্ষমাহীন শেষ দ্বৈরথে অথবা মায়াবীর
ইঙ্গিতে পাথুরে মূর্তি হয়ে যাই। কোনো মনস্তাপ
আমাকে করে না ম্লান, তাইতো আমার পদচ্ছাপ
অনেক উঠোনে পড়ে, প্রতি রাত্রি উচ্ছল মদির।
কেন থাকতেই হবে নরকের সান্ত্রীর অধীন?
পরমার অন্বেষণে কেউ যদি ছোটে দিগ্ধিদিক,
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে এক হ্রদ ছেড়ে অন্য হ্রদে
রাখে মুখ, তবে তাকে পাপী ভেবে ধিক্ তোকে ধিক্
বলে দূরে সরে যাওয়া কখনো কি হবে সমীচীন?
ছুঁড়বে পাথর তুমি আমার নিঃসঙ্গ মুখচ্ছদে?
৩
ছিল না অনুশোচনা, ছিল না আমার ভয়ভীতি
কোনোদিন, ছুটে গেছি দেশদেশান্তরে, অভিযান
আমার শিরায় নিত্য পেয়েছে গতির স্তবগান।
বন্দরে বন্দরে ঘুরে নানান দেশের রীতিনীতি
জেনেছি এবং বহু অনুপম রমণীয় স্মৃতি
করেছি সঞ্চয় যাত্রাপথে। কোনোদিন পিছুটান
পারেনি পরাতে বেড়ি মনে, আমি করেছি আহ্বান
তাঁকে নৈশভোজে, যিনি বর্মাবৃত পাথুরের অতিথি।
যেহেতু কৌতুকী রৌদ্র এ-আমিকে করেছে লালন
অকৌশোর, বুঝি তাই তাঁকেই এনেছি কাছে ডেকে
পরিহাস ছলে, যাঁর হাতে নাচে আমার মরণ।
স্মৃতির বমনে ভাসি, কে রহস্যময় মাঝি হেঁকে
যার ঘন কুয়াশায়। একান্ত আমারই নির্বাচন
এ জীবন, যা গড়েছি লোকশ্রুত পাপপুণ্য ছেঁকে।