উত্তরের জন্যে
বিকেলবেলা
আমি একা বসে আছি তোমাদের ড্রইং রুমে
সময় কাটতে চায় না, মুহূর্তগুলি
বিকল ট্যাপের পানির মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।
সাপ্তাহিক টাইমের পাতা উল্টিয়ে এলেবেলে
আমি সময় কাটাতে চাইলাম,
সময় কাটে না। দেয়ালে চোখ রেখে কবিতার
ভুলে-যাওয়া পংক্তি মনে করতে চাই, অনেকক্ষণ
তাকিয়ে থাকি টেরাকোটার যুগল মূর্তির দিকে, দীর্ঘস্থায়ী
শিল্পির চুম্বনে অপেক্ষার ক্লান্তি মুছে ফেলার আশায়।
দরজার পর্দা সরিয়ে তুমি এলে;
পরনে তোমার টাঙ্গাইলের শাড়ি, খোলা চুল
আশ্রয় নিয়েছে পিঠে, সারা মুখে
দুপুরের ঘুমের লাবণ্যময় ছাপ। তোমার যৌবনের তরঙ্গ
মেরুন রঙের সোফায়।
গৃহভৃত্য চায়ের সরঞ্জাম রেখে যায়, তুমি
আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে সধূম চায়ের কাপ।
‘আমি চা খাইনা’, বললাম এখানে আমি চা খেতে আসিনি,
উচ্চারণ করি মনে মনে।
আরেক বিকেলে তুমি তোমার উদ্যানের
একটি ফুল উপহার দিলে আমাকে। ফুল আমি ভালোবাসি,
কিন্তু বাগানের ফুল নিতে আমি আসিনি, এ-কথা
আমার ঠোঁটে স্তব্ধ হয়ে রইলো।
একদিন আমি দ্বিধায় উথাল-পাথাল স্বরে
তোমাকে বললাম, ‘আমি তোমার বুকের ভেতরকার
ঘ্রাণ নিতে চাই’। তুমি নিরুত্তর; সোফার
হাতলে আঙুলে তাল বাজাচ্ছিলে, যেমন পিয়ানিস্ট
রিডে রিডে আঙল নাচায়।
আমার জীবন কবরের মোমবাতির মতো
দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ উত্তর আজো পাইনি।
এখন তোমার ছুটি নেই
একদা সেই কোন্ খেয়ালে খুব আড়ালে
একলা তুমি বেলাবেলি পা বাড়ালে।
বৃথাই এখন খুঁজছো ডেরা আশেপাশে,
বৃথাই তুমি ঘুমোতে চাও শান্ত ঘাসে-
ছুটতে হবে, আরো অনেক ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।
কখন থেকে বের করে জিভ ছুটছো। শুধু
ছায়াবিহীন পথের কায়া করছে ধুধু;
একটু গেলেই পথের সীমা যাচ্ছে বেড়ে,
ভয়-দেখানো জন্তুগুলি আসছে তেড়ে,
সামনে তবু ছুটতে হবে, ছুটতে হবে;
এখন তোমার ছুটি নেই।
ক্লান্তি হঠাৎ কির্কী হ’য়ে তোমার গালে
ওষ্ঠ রেখে বাঁধতে পারে কুহক-জালে;
ধুলোর ঝড়ে অন্ধ হ’য়ে ঘুরতে পারো,
বন্ধ হ’তে পারে সাধের সিংহদ্বারও,
তবু ভীষণ ছুটতে হবে, ছুটতে হবে;
এখন তোমার ছুটি নেই।
পেছন ফিরে তাকাও যদি বারেবারে,
একটু তুমি জিরোও যদি পথের ধারে,
রুক্ষ পথে চক্ষু যদি আসে বুজে,
সামনে পথের সীমানা আর না পাও খুঁজে,
একলা পথে ছুটতে হবে, ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।
মিনার টিনার দেখতে তুমি পাচ্ছো না কি?
পড়লো চোখে অচিন বাগের স্বর্ণ পাখি?
দৃষ্টি যদি আহত হয় নেই-এর ঘায়ে,
তীক্ষ্ম কাঁটা বিঁধতে থাকে যুগল পায়ে,
ব্যগ্র পায়ে ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।
খাদের পাশে পৌঁছে শুধু থাকবে চেয়ে?
ভয় পেলে কি ক’খানা হাড় দেখতে পেয়ে?
লক্ষ্য তোমার ক্রমাগত যাচ্ছে সরে?
পাথুরে সব মূর্তিগুলি থাকুক পড়ে;
ছুটতে হবে, দ্বিধাবিহীন, ছুটতে হবে,
এখন তোমার ছুটি নেই।
এখনো খুঁজছি
সেই কবে তুলে নিয়েছিলাম হাতে,
এখনো আছে;
আমি আমার কলমের কথা বলছি।
তার চাঞ্চল্যের মাধুর্য এখনো অস্ত যায়নি,
তাই, এখনো গাধার খাটুনি খেটে দিনের পর দিন
বিস্তর আগাছা উপড়ে ফেলে
অলৌকিক ফুলের কেয়ারি বানাই।
এই আমার কলম প্রত্যহ শোনে
সপ্তকাণ্ড কাহিনী
যার মুখে যা আসে শুনিয়ে যায়,
অনেকে পায়ে পড়ে করে নসিহত
কেউ কেউ চৌরাস্তায় চোখ রাঙায়,
আবার কেউবা বলে স্নেহার্দ্র চোখে-
আহা, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
যা বলতে চাই, আমার কলম, কম-বেশি,
তারই প্রতিধ্বনি, কখনো স্পষ্ট,
কখনোবা অস্পষ্ট,
স্বপ্নে-শোনা কোনো গুঞ্জনের মতো।
আমার সৌভাগ্য, এই যে কলম আমার,
যাকে আমি প্রাণপণ আঁকড়ে রয়েছি দিনরাত্তির,
তার ভাষা উদ্ভাসিত দেবদূতের হাসি,
যা আমি দেখেছিলাম এক বর্ষাগাঢ় রাত্রে।
সে ভাষায় ছায়া ফেলে সমুদ্র থেকে উঠে-আসা
জলকন্যার চোখের রহস্যময়তা;
যে-জন সর্বস্ব আমার,
তার অস্তিত্বের কলতান সে ভাষায়।
বজ্রপাতে দগ্ধ হয়েছে যে পাখির নীড়
তার আর্তনাদ আমার কলমাশ্রিত।
গহন অরণ্যে হরিণের খুশির লাফ
সোনালি সাপের সুন্দর প্রস্থান,
কিংবা শববাহকদের উদাস বসে থাকা
কবরে পুষ্পার্পণ,
স্নিগ্ধ ঝরণার ধারে বনজ প্রাণীর সংসর্গে
অর্ফিয়ুসের বংশীধ্বনি,
চাঁদ সদাগর আর মনসার অপোসহীন বিবাদ,
নহর নির্মাণকালে পাথর আর লতাগুল্মের সঙ্গে
ফরহাদের আলাপ,-
সবকিছুই সাবলীল ফোটে আমার কলমের আঁচড়ে।
আজ আমি কলমের চোখে চোখ রেখে অকুণ্ঠ
বলতে পারি ধন্যবাদ, বন্ধু, ধন্যবাদ।
ব্যাপারটা, মানে কবি হিসেবে, মোটামুটি তৃপ্তিকর।
অথচ আবার প্রায়শঃই একটা ব্যর্থতাবোধ
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভয়ানক ক্লান্ত করে আমাকে,
বিপন্ন করে। কেননা, বলিভিয়ার জঙ্গলে
গুলীবিদ্ধ চেগুয়েভারার স্বর্গীয় নিদ্রার ভাষা
আমার অনায়ত্ত
এবং
মাতৃভাষার জন্যে, স্বদেশের জন্যে যে তরুণ বুকের খুন
ঝরিয়েছে রাস্তায়, সে রক্তের ভাষার কাছে
কী অসহায় আর আনাড়ী রয়ে গেলাম এখনো,
কেমন ভাষাহীন। সে ভাষার মতন
একটা কিছু আমি খুঁজছি, এখনো খুঁজছি।
এতদিনে জেনে গেছি
এতদিনে স্রেফ জেনে গেছি,
অনেকের অনেক কিছুই করবার কথা নয়,
তবু করে। কারো কারো ঠিক
যে-পথে যাবার কথা,
সে পথে যায় না তারা ভুলেও কখনো।
সাজ্জাদ গেরস্তমন নিয়ে জন্মেছিল, বলা যায়;
অথচ সে একটি মুখর ঘর আর
নিকানো উঠোন
ছেড়েছুড়ে কোথায় যে গেল, তার
হদিশ মেলেনি আজো। কখনো কখনো
উড়ো কথা শোনা যায়, সে নাকি সুদূর
পীরের মাজারে ঘোরে, সিন্নি খায়, ঘুমায় বেগানা
আস্তানায়।
মাশুক নির্ভুল অঙ্ক কষতে পারেনি কোনোদিন,
এখন সে প্রত্যহ দরকারী
হিশেব মেলাচ্ছে অতিশয় মনোযোগ সহকারে
সরকারি দপ্তরে।
আঝাস নিশ্চুপ ছিল বড়, ওর মুখে
বিষাদের মেঘ
ভাসতো সর্বদা, মনে হতো
আড্ডা থেকে বেরিয়েই আত্মঘাতী হবে
যে-কোনো রহস্যময় রাতে একা ঘরে
অথবা সকালে। অথচ সে
পেতেছে সংসার আর ছোট পরিবার
সুখী পরিবার শ্লোগানের মুখে দিব্যি তুড়ি মেরে
সাত সন্তানের হয়েছে জনক।
আর যাকে নঈমকে, আমরা বেজায়
চুলবুলে বাচাল যুবক ভাবতাম
এবং খানিক স্থূল; কী অবাক কাণ্ড, একদিন
সে-ই খেলো বড় বেশি ডোজে নিদ্রাবড়ি।
হাশমত, প্রায়শই যে দেখতো স্বপ্নে সূর্যমুখী
ফুল,
কাটতো সময় যার দিবাস্বপ্ন দেখে,
দেশের বিপন্ন ডাকে
সে দিলো প্রবল সাড়া, গেল
মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরে।
দেশ ভ্রমণের খুব শখ ছিল তার,
এখন সে নিত্যদিন হুইল চেয়ারে বসে সূর্যাস্তের রঙ
দ্যাখে, মাঝে মাঝে ফ্যালে চাপা দীর্ঘশ্বাস
দেশের দশের কথা
এবং নিজের কথা ভেবে।
এবং আমার কথা ছিল
ছবি আঁকবার,
যদিও আমার জনকের বিবেচনা
ছিল বিপরীত কিছু, ভাবতেন তিনি স্বপ্নঘোরে-
আমি হবো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
জেদী আমি তার স্বপ্নগুলি
গুঁড়িয়ে কাচের দামী বাসনের মতো,
একটু আলাদাভাবে রেখেছি আমার কথা; আমি
ছবি লিখি অক্ষরে অক্ষরে।