যদিও নাস্তিক আমি
রোদপোড়া, বৃষ্টিভেজা যে-কৃষক জানে বানভাসি
জানে খলখলে জলে ভাসমান খোড়ো চার আর
মহিষ, মুনিষ, আর শিশুদের কথা, বারংবার
হারায় তৈজসপত্র, হারায় ফসল রাশি রাশি,
তারই মতো শুনি পুনরায় দূর দিগন্তের বাঁশি,
ধানের মঞ্জুরী হয়ে জ্বলে ভবিষ্যৎ রিক্ত মাঠে;
আবার নিজস্ব স্বপ্নে দেখি আমি নক্শাময় খাটে
শুয়ে আছি একা দয়িতার পাশে সঙ্গমপ্রত্যাশী!
যদিও নাস্তিক আমি, তবু প্রার্থনায় নতজানু
এ প্রহরে, করি উচ্চারণ, চিরকাল যেন থাকে
স্বপ্নের পালক তার শরীরের ঋদ্ধ বাঁকে বাঁকে
প্রিয় কিছু স্মৃতির মতন। সেই নারী আয়ুষ্মতী
হোক, যার ওষ্ঠে আমার আয়ুর অণু পরমাণু
রেখেছি গচ্ছিত, ভাবি না সে সতী না অসতী!
শেখ লুৎফর রহমান যখন
শেখ লুৎফর রহমান যখন
শহীদ মিনারের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন,
তখন
সূর্য তার শেষ রশ্নি উপহার দিলো তাঁকে, সমগ্র
সত্তা তাঁর উদ্ভাসিত। সুগন্ধি বনচ্ছায়
থেকে ভেসে আসা বনদোয়েলের গান লুটিয়ে পড়ে
তাঁর পায়ে এবং একটি কোরাস,
তরুণের রক্তের মতো টগবগে আর
বিদ্রোহীর চোখের মতো জ্বলজ্বলে,
তাঁকে জানায় স্বাগত।
শেখ লুৎফর রহমান, দরাজ গলায় গায়ক, যখন
শহীদ মিনারের সিঁড়ি বেয়ে
উঠছিলেন আস্তে আস্তে; তখন আমরা যারা
বসেছিলাম দূরে, দেখলাম-
তিনি আসছেন,
তিনি আসছেন,
তিনি আসছেন,
সতেজ পদক্ষেপে
কোনো যুবরাজের মতো।
যেন খাটো নন তিনি, এক দীর্ঘকায় পুরুষ;
তার চুল শাদা নয় আর, বার্ধক্যের দবিজ ধুলো
ঝরে গেছে, কারো চওড়া কাঁধে কিংবা ক্রাচে
ভর দিয়ে হাঁটছেন না তিনি,
বিপ্লবীর গুলিবিদ্ধ পায়ের মতো।
নয় তাঁর পা,
তিনি উঠে আসছেন, এক তেজী তরুণ।
বার্ধক্যের ভরে নুয়ে ছিল যারা পরাস্ত সৈনিকের মতো
মাথা নত করে ছিল যারা, তাদের
উদ্দেশে তিনি গেয়ে উঠলেন গমগমে গলায়,
‘বল বীর চির উন্নত শির’।
সমাধি ফলক
মনে হয় খুব কায়ক্লেশে
কাঁটা গুল্মময় বহু দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখন
দাঁড়িয়েছি উদাসীন গাছের ছায়ায়। সে গাছের
ডালে রঙ-বেরঙের পাখি
আছে, আছে ফলমূল আর পাতার আড়াল থেকে
গোপন ঝরনার মতো ঝরে গান, যেন
সুদিনের তান বয়ে যায়। গোধূলিতে মনে হয়
কল্পনার গ্রামে
ডানাঅলা ঘোড়া নামে মহাশ্চর্য ফসলের লোভে,
ছোটে দিগ্ধিদিক, ক্রুর খুরের আঘাতে
কত যে প্রতিমা
ধুলায় গড়ায়, তপ্ত নিঃশ্বাসে ওদের
পুড়ে যায় ঘর গেরস্থলি। পারে না ওদের মুখে
লাগাম পরাতে কেউ।
বড় একা লাগে এই গাছের ছায়ায়। বারংবার
ব্যাকুল রুমাল নাড়ি, যদি কেউ আসে, এসে যায়
এখানে, অথচ কারো পদশব্দ শুনি না কোথাও
আশপাশে। নতুন শাড়ির
খসখসানির মতো শব্দ হলে ঝরা পাতাদের
ভিড়ে কান পাতি, ভাবি এই
এল বুঝি দুর্গম পথের সাথী কোনো। কিন্তু কেউ
প্রকৃত দেয় না সাড়া। শুধু ছায়া-অবছায়া ছাড়া
এখনো কিছুই নেই আর, মনে হয়। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে
পাঁশুটে জ্যোৎস্নায়
হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ি ভবঘুরে উদ্বাস্তুর মতো!
স্বপ্নের চত্বরে দেখি পড়ে আছে লাল মখমলে
কোষবদ্ধ তরবারি, বঙ্কিম, প্রাচীন আর নিঃস্ব কৃষকরা
সুগন্ধি সাবান মেখে আপাদমস্তক
ভুস্বামীর জ্বলজ্বলে বেশ পরে নেয় ক্ষিপ্র প্রতিযোগিতায়।
স্বপ্নের ভেতরে
অনেক অনেক লোক নতজানু নদীতীরে, বিধ্বস্ত বাগানে,
পাথুর সিঁড়িতে, চৌরাস্তায় বটমূলে,
বকুল তলার আর অলিতে গলিতে। অকস্মাৎ
অনেক মুখোশ খুলে পড়ে
দুরন্ত হাওয়ায়। রাগী পদাতিক উদ্ধত ঘোড়সওয়ার দ্রুত
আমাকে মাড়িয়ে যায়, হাজার হাজার ওরা করে তছনছ
স্বপ্নের মতন সব সম্পন্ন বাজার। পড়ে থাকি
রক্তিম ধুলোয় আমি অত্যন্ত একাকী,
যেন মনস্তাপময় হু হু এক সমাধি ফলক।
সায়োনারা
দূর ওসাকায় সন্ধ্যাবেলায়
প্লাটফর্মের আনাচে কানাচে তাড়া;
কেউ বলে এলে এতদিন পরে,
কেউ বা ব্যাকুল সায়োনারা, সায়োনারা।
তোমাকে সেখানে দেখবো ভাবিনি,
দেখেই শিরায় জাগলো বিপুল সাড়া।
প্রথম দেখার নিমেষেই হাওয়া
বলে কানে কানে সায়োনারা, সায়োনারা।
ট্যাক্সিতে রাতে তুমি আর আমি,
নেচে উঠেছিল তোমার চোখের তারা।
ওসাকা-রাতের দৃশ্যাবলীতে
লেখা ছিল বুঝি সায়োনারা, সায়োনারা।
সুন্দরীতমা দৈবদয়ায়
এসেছিলে কাছে, হৃদয় আত্মহারা।
চোখের পলকে সময় ফুরায়,
রটে চরাচরে-সায়োনারা, সায়োনারা।
ওসাকার সেই শহর-মরুতে
বস্তুত তুমি মরুদ্যানের চারা,
আমার তামাটে সত্তা তোমার
ছায়ায় শুনেছে সায়োনারা, সায়োনারা।
আমরা দু’জন করেছি ভ্রমণ;
তুমি হিরোশিমা, তুমিই কিয়োতো, নারা,
পায়ের তলায় হলদে পাতারা করে
ফিস্ ফিস্-সায়োনারা, সায়োনারা।
মন্দিরে দেখি বুদ্ধ মূর্তি,
শিল্পিত হাতে বইছে পুণ্যধারা,
তোমার ও-হাতে হাত রাখতেই
পাখি গেয়ে ওঠে সায়োনারা, সায়োনারা।
কথায় কথায় বলেছিলে তুমি
কখনো দু’পাতা মিশিমা পড়েনি যারা,
তারা জানবেনা জাপানী নারীকে;
তোমার দু’চোখে করি পাঠ সায়োনারা।
শেষ রাত্রির কেটেছে আলাপে,
শরীর তোমার যেন স্বপ্নের পাড়া।
লিফ্ট-এ নামার কালে, মনে পড়ে,
বলেছিলে তুমি সায়োনারা, সায়োনারা।
তোমার স্বদেশে প্রবাসী ছিলাম,
ছিলাম উদাস, কিছুটা ছন্নছাড়া।
হৃদয়ে আমার পরবাস আজ,
প্রাণে বাজে শুধু সায়োনারা, সায়োনারা।
সিঁড়িতে ভীষণ ভিড়
সিঁড়িতে ভীষণ ভিড়। ট্রাউজার, পাজামা এবং লুঙ্গি পরে
ঠেলাঠেলি, হেঁটে যায়, দ্রুত যায়, দৌড়ে যায়।
ট্রাউজার পাজামার পা মাড়িয়ে দ্যায়,
লুঙ্গি পাজামাকে গুতো মেরে ছুটে যায়,
পাজামা এগোয় ঊর্ধশ্বাস ট্রাউজারের কণুই
নিপুণ এড়িয়ে
সিঁড়িময় অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায়
যায় ওরা ছুটে যায়। এই সিঁড়ি
অনেক উঁচুতে গেছে। কেউ কেউ অভীষ্ট উপরে উঠে যায়
সার্কাসের অতিশয় দক্ষ ত্র্যাক্রোব্যাটের মতন,
কেউ কেউ দৌড়ে যায়, উড়ে যায়, যেন ইকারুস নীলিমায়।
নিস্তব্ধ বসন্তে লতা-গুল্ম মুখে নিয়ে
এবং শরীরময় কাঁটা নিয়ে অনেকেই নিচে পড়ে যাচ্ছে।
সুদৃশ্য মোটরকার-লাল, নীল, সাদা, কালো, হলদে, সর্ষে রঙ,
ছুটে যায়,
ছুটে যায়,
কখনো দু’দিক থেকে তেড়ে-আসা দু’টি গাড়ি ষাঁড়ের মতন,
ক্ষ্যাপাটে সংঘর্ষে মাতে। কখনো বা ঝিমোনো ট্রাফিক
দূরন্ত ঊর্মিল হয়; উত্তরে দোকান-পাট দক্ষিণে দোকান-পাট,
মধ্যে
জনসাধারণ।
একজন প্রৌঢ় চৌরাস্তায় গোধূলিতে কী উদ্ধ্রান্ত কণ্ঠস্বরে
“আমার সর্বস্ব গেছে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন সুপার মার্কেটে”
বলে পড়ে যায় ক্লিন্ন নর্দমায়। কেউ বা সর্বত্র সর্বক্ষণ রক্তপায়ী
বাদুড়ের ভিড় দেখে অবসন্ন; পাথরের মতো অন্ধ
হয়ে যায় অনেকেই। দরজার কাছে গিয়ে দরজা দ্যাখে না,
তাই কেউ কেউ করে আত্মহত্যা। ভেনাসের লুপ্ত বাহুদ্বয়
পেয়ে গেছে ভেবে কেউ
প্রচণ্ড চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে অকস্মাৎ ফের
বেঘোরে ঘুমোয় অবেলায়।
সংবাদপত্রের ঝকঝকে
প্রথম পাতায় মাঝে মাঝে
নেতাদের চকচকে জুতো শোভা পায়।
উচ্চরিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সকলেই দৈর্ঘে
প্রায় সাড়ে চার ইঞ্চি হচ্ছে, হচ্ছে হচ্ছে।
একটি ধূসর স্যুট ঢোকে ক্লাবে, সিগারেট ফোঁকে
সুনীল হাওয়াই শার্ট, চকোলেট শাড়ি
কোকের স্ট্র ওষ্ঠে খুব আলতো লাগায়,
কারো কারো জলপাই পল্লবের স্পর্শ-লাগা প্রিয় স্মৃতি ওড়ে
রাঙা পতঙ্গের মতো ফ্যানের হাওয়ায়।
আড়ালে নেভী ব্লু স্যুট কালো শিপনের
কানে কানে কী-যে আওড়ায়, হুইস্কির মায়া টানে
শুনতে পায় না কালো শিফন কিছুই,
নেভী-ব্লু-র ঠোঁটে কাঁপে শুধু…
বারান্দায় কালো শিফনের ওষ্ঠ নড়ে
সাফারি স্যুটের দিকে, বোঝেনা সাফারি স্যুট কিছু
যেন কেউ কারো ভাষা বোঝে না কিছুই।
রাত্তিরে রেকর্ড বাজে প্লেয়ারে কোথাও বেজে চলে
হায় এলভিস প্রেসলি
হায় এলভিস প্রেসলি
হায় এলভিস প্রেসলি
কখন যে তুমি
মরাল সঙ্গীত গেয়ে ভীষণ নিথর হয়ে গেলে…
হায় এলভিস প্রেসলি
তবুও তোমার কণ্ঠে ষাট দশকের ছটফটে
আনন্দ, সুতীব্র আর্তি উঠেছিল বেজে কী মোহন কলরোলে।
সিঁড়িতে অনেক ভিড়। অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায়
লোক আসে, লোক যায়; পুরোনো কাগজ, শূন্য ঠোঙা
বিধ্বস্ত পাখির বাসা সিঁড়িতে গড়ায়, উড়ে যায়। সিঁড়ি ছেড়ে
অকস্মাৎ কেউ কেউ স্বপ্নের মতন এলাকায় ম্যান্ডোলিন
বাজাতে বাজাতে হেঁটে চলে, কতিপয় অন্ধ পথ
হাতড়াতে থাকে সারাক্ষণ, তাসের ঘরের মতো পড়ে যায়।