গুন খুন
এখনো আমার নামে কোনো গেরেপ্তারী
পরোয়ানা নেই,
আমি অপরাধী তার কোনো সাক্ষী-সাবুদ কোথাও
কখনো পাবে না খুঁজে কেউ। তবু কেন
হাতকড়া, কয়েদখানার
কালো শিক চোখে ভেসে ওঠে বারবার। চারপাশে
শুনি কত চোখে ভেসে ওঠে বারবার। চারপাশে
শুনি কত গুঞ্জরণ, মনে হয় যেন
সবাই আমাকে নিয়ে নানা কথা বলাবলি করে
আমার আড়ালে-আবডালে। তাহলে কি
হাড়কাঠে গলা দিয়ে বসে আছি? নইলে
কেন আজ খামকা নিজের
ছায়া দেখে ভয় পাই? কথা বলি ঘুমের ভেতরে?
সেদিন রাস্তার ধারে একটি কাফেতে নিরিবিলি
কফি খেতে লাগছিল ভালো; অকস্মাৎ
খালি সিটগুলো ফিটফাট
যুবকেরা নিমিষে দখল ক’রে নিয়ে মেতে ওঠে
গালগল্পে। কান পেতে থাকি,-
একটি যুবক সিগারেট নিখুঁত ধরিয়ে, ধোঁয়া
ছেড়ে আড়চোখে
তাকায় আমার দিকে। তার নজর সরিয়ে
কাঠের টেবিলে ঠোকে তাল; একজন
সুরূপা তরুণী ঠোঁট থেকে ঠোঁটান্তরে ভাসমান
মর্গে-শুয়ে থাকা কোনো তন্বীর মতন। তরুণীর
একা-একা পথ হাঁটা, বই পড়ার ধরন আর
দেহের গড়ন,
চুলের কী রঙ দৈর্ঘ্য কীরকম, কণ্ঠস্বর
সুরেলা বাঁশির প্রতিধ্বনি কিনা, ওর দুটি চোখে
হরিণীর চোখের আদল আছে কিনা,
মুখের লাবণ্য আর স্বভাবের নম্রতা অথবা
বন্যতার চর্চা হলো বেশ কিছুক্ষণ।
সে নাকি হঠাৎ নিরুদ্দেশ
কিছুকাল থেকে, না যায়নি সে বিদেশে;
এই শহরেই আছে, যদিও সম্প্রতি
কাউকে কিছু না বলে দিয়েছে গা ঢাকা। সকলেই
জানে তার খেয়ালীপনার পরিচয়
কম-বেশি, যুবকেরা বলাবলি করে তাকিয়ে আমার দিকে।
যুবাদের বাক্যালাপ শুনে আমার হৃৎপিণ্ড শুধু
খাঁচার পাখির মতো ডানা ঝাপটায়
ঘন ঘন। কী করে সবাই ওরা চেনে
তাকে, যাকে উন্মত্ততাবশে খুন ক’রে
দিয়েছি কবর
আমার খাটের নিচে। কখনো কখনো মধ্যরাতে
সে হেঁটে বেড়ায়
স্বপ্নচারিতায় ঝুল বারান্দায়, ছাদের কার্নিশে।
ঘরের মাঝখানে
এরকম চমকে থমকে দাঁড়ালাম
যেমন নাবিক খুব একলা দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে ডেকে থেকে
স্তিমিত জ্যোৎস্নায় দেখেফেলে
কোনো জলকন্যার আশ্চর্য উদ্ভাসন।
তরঙ্গের পর
তরঙ্গ গড়ায় বিছানায় ক্রমাগত
তোমার ঘুমের কী নিঝুম কিনারায়। হে নিদ্রিতা,
তোমার পা ছুঁয়ে রঙ-বেরঙের মাছ
মোহন সাঁতার কাটে, ছায়ার পাখিরা
তোমার কপালে-ঠোঁটে আলতো ছুঁইয়ে চলে যায়।
নাছোড় ঘোরের মধ্যে কোন চিত্রকর মুগ্ধাবেশে
নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিনরাত
এঁকেছেন তাঁর
নিমগ্ন অস্তিত্ব থেকে ঠিকরে বেরুনো
আলো অন্ধকার দিয়ে? কৃত্রিম আলোর ছটা নয়,
তোমার ত্বকেরই আভা করেছে দখল ঘরটিকে।
তোমার সান্নিধ্যে যাব না কি দূর থেকে জ্ঞান যোগে
দু’চোখের পিপাসা মিটিয়ে
বিষাদে বিদায় নেব? একটি তুফান
আমার বুকের মধ্যে বে-লাগাম
বুনো ঘোড়া, তার
খুরের ঝাপট
লাগলে নিমেষে তুমি অভ্রের মতোই
গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়বে বিছানার চারপাশে অথবা মিলিয়ে
যাবে সুবেসাদিকের স্বপ্নের ধরনে।
এই তো এখন ক’পা এগোলেই আমার দু’হাত
অনাবৃত তোমার শরীরে
হতে পারে চকিতে পিয়ানো বাদকের
সুরেলা চাঞ্চল্য। তুমি জেগে
উঠবে এই ভয়ে আমি দূরত্বকে কাঙ্ক্ষনীয় ভেবে নিথর দাঁড়িয়ে থাকি।
তোমার
নিদ্রিত
আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে কনক চাঁপার
বিচ্ছুরণ, শব্দহীন স্তোত্রপাঠ হয়,
চৈত্ররাত্রি গান গায় তোমার শরীরে। নক্ষত্রের
যমজ সুচারু তোড়া নিতম্ব তোমার নিশীথের কাফ্রি-ঠোঁট
অক্লান্ত লেহন করে, তোমার অলস এলানো
স্তনটিকে, ঈষৎ স্ফুরিত রক্তিমাভ
ঠোঁটে স্বপ্নভাষা স্মৃতি তৈরি করে, পদ্মের মতন
পেটে কতিপয় অলৌকিক আঙুলের খেলা, তুমি
যেন কোনো দূর-দ্বীপে সদ্যোজাত স্বপ্নের মতন শুয়ে আছ
একাকিনী সেই কবে থেকে।
তোমার অত্যন্ত কাছে গেলেই শুনতে
পাব নিঃশ্বাসের মৃদু ধ্বনি, সুরভিত, দেখব বুকের
ওঠা-নামা। তোমার শরীর থেকে উৎসারিত উষ্ণতা আমাকে
জড়িয়ে ধরবে সাবলীল
মালার মতন, দূর থেকে
তোমার মধ্যেই দেখি স্বর্গীয় উদ্যান নিরিবিলি,
নিষিদ্ধ ফলের আভা জায়মান চতুর্দিকে, অথচ এখনো
কম্পিত হৃদয়ে আমি দাঁড়ানো ঘরের মাঝখানে।
চলেও আসতে পারে
কী-যে হলো, কোলাহল শুনে নিভাঁজ নিভৃতি ছেড়ে
বেরিয়ে পড়েছিলাম খোলা পথে একদা আমিও,
দীর্ঘকাল বিষাদে বাঁশিটি ফেলে রেখে এক কোণে
ঘুরপথে কায়ক্লেশে এসেছি বলে কি প্রত্যাখ্যাত
ফিরে যাব ম্লান মুখে? তাকাবে না পথভ্রষ্ট এই
পথিকের দিকে একবারও? সভাকক্ষে হয়েছেন
জড়ো যাঁরা, তাঁরা সগৌরবে করেছেন নিবেদন
রকমারি জড়োয়া গয়নাগাঁটি, প্রফুল্ল কাতান,
কেউ কেউ শিল্পিত গ্রামীণ কাঁথা তোমার উদ্দেশে,
গ্রহণ করেছ হেসে সেসব প্রসিদ্ধ উপহার।
আজীবন ভীষণ উড়নচণ্ডে আমি, পরিণামে
আমার গচ্ছিত ধন, যা দিয়ে তোমার জন্যে কিছু
উপহার আনব ভেবেছি বহুদিন, বহুরূপী
ছলনায় উড়িয়ে দিয়েছি সব খোলামকুচির
মতো; ফলে আজ শুধু একটি ফুলের মালা নিয়ে
এসেছি তোমার কাছে অবহেলিত বাঁশির সুর
শোনাতে আবার। শুনবে তো? নাকি মুখমণ্ডলীর
গুঞ্জরণে কান পেতে আমাকে নিছক উপেক্ষার
ধূসরতা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখবে। মাথানত
করে চলে যাব তবে তাচ্ছিল্যের কাঁটাবন থেকে?
অবশ্য আমার ধড়াচূড়ো নেই, গায়ে ধুলো, পায়ে
ক্রমাগত ঘুরে বেড়ানোর রক্তিম প্রসূন, ক্ষত।
তোমার অত্যন্ত সমাদৃত অতিথিরা অট্রহাসি
হাসবেন আমার সামান্য বাঁশি দেখে, আর এই
আমাকে ভিখিরি ভেবে তড়িঘড়ি আনবেন ডেকে
যমমুখো সশন্ত্রদ্বারীকে। তবু তুমি গরীয়সী
দয়া করে খানিক সময় দাও আমাকে, যাচাই
করে নাও বাঁশি থেকে সুর মঞ্জুরিত হয় কিনা-
চেয়ে দ্যাখো, আমার সুরের তালে লয়ে সভাঘরে
চলেও আসতে পারে, লতাগুল্ম পাথর, হরিণ।