- বইয়ের নামঃ নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অভিশাপ যতই জ্বলন্ত হোক
আমি কাউকেই কাঠগড়ায় কখনও
করাবো না দাঁড় নিরর্থক
আমার হালের জন্যে।কারও নামে নালিশ করার
বিন্দুমাত্র অধিকার নেই এই লোকটার, মানে
আমার, কেননা আমি নিজেরই বিরুদ্ধে
বারবার করেছি ফুলুম, অপরাধ।
নিয়ত আমার হৃৎপিণ্ড, প্লীহা ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে
জাঁহাবাজ এক বাজপাখি।
অসহায় আমি বড় অপারগ বাধা দিতে ওকে।
আমি যে অন্যায় করে কাটিয়েছি যত দিনরাত্রি,
তার পরিণাম এরকমই হতে হবে-
কী করে এড়াবো শাস্তি? রক্তাক্ত প্রহর?
সামান্য পাখিও নীড় সাজায় গোছায়
নন্দনতত্ত্বের অ আ ক খ না জেনেও,
নিজ শাবকের যত্ন নেয় যথারীতি।
আর এই আমি সভ্যভব্য মনুষ্য সমাজে নিত্য
বসবাস করেও আপন সংসারের, গৃহিণীর,
সন্তানের যথাযথ লালন পালন থেকে সরিয়ে দু’হাত
আমার সাধনালব্ধ শিক্ষার খানিক কণা দিতে
ব্যর্থতাকে বরণ করেছি। ওরা আমার অনেক কথা বোঝে না বলেই
শোনার আগ্রহ স্রেফ হারিয়ে ফেলেছে।
আর আমি শুধু বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে ছুটে
কাটিয়েছি সারা বেলা, সংসারে নেমেছে খাঁ খাঁ ধস,
বস্তুত হুমড়ি খেয়ে কোনওমতে রুখেছি বিচ্ছিরি পরিণতি
কুড়িয়েছি বদনাম কত; খামাকা লোকেরা ডাস্টবিনভরা
আবর্জনাগন্ধী গুচ্ছ গুচ্ছ কল্পকথা রটিয়েছে।
অনেকেই উদাসীন পদাতিক আমার উদ্দেশে
তাকিয়েছে আড়চোড়ে, যেন আমি চিড়িয়াখানার
একটি কিম্ভূত কিমাকার জীব, হাসির হুল্লোড়
ওঠে অলিগলি, চৌরাস্তায়।
উপরন্তু দেবকুল অতিশয় ক্ষিপ্ত আজ আমার ওপর,
কেননা তাদের কণ্ঠ থেকে সুর নিয়ে অনুপম পদাবল্মী
রচনা করেছি নিশীথের কত নিস্তব্ধ প্রহরে,
যার ধ্বনি গুঞ্জরিত মানুষের মনে প্রাণে গ্রামে ও শহরে।
তবে কি সঙ্গীতময় দেবতার প্রতিযোগী হওয়ার কসুরে
অভিশপ্ত আমি আজ? তারই পরিণামে
এরকম রোগক্লিষ্ট পড়ে আছি একা অসহায়?
অভিশাপ যতই জ্বলন্ত হোক, পোকাক্রান্ত কাঠ হোক শরীর, জীবন,
তবু আমি প্রতিযোগিতার পথ ছেড়ে
শব্দের, ধ্বনির রূপ থেকে দূরে সরে থাকব না।
নিভুক চোখের জ্যোতি, কাঁপুক দু’হাত অবিরত,
আমার কবিতা তবু সাজাবে জমিন, সীমাহীন আসমান।
১৫.১১.৯৯
অস্তর্গত রোদ
কোনও কোনও দুপুররোদের দিকে তাকিয়ে অনেক
দিনের পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। রোদের ভেতর থেকে
গূঢ় রোদ জন্ম নিয়ে আমার অন্তরে
খেলা করে খুব নিরিবিলি। সেই রৌদ্রসুরা ঢক
ঢক পান করে বুঁদ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ, দেখি কারা যেন
আমার ভেতরে হেঁটে যায়, ফিরে আসে ভিন্ন চেহারায় আর
হঠাৎ আমার পিঠা চাপড়ে হুল্লোড়ে মেতে ওঠে। কেউ কেউ
জুয়ো খেলা শুরু করে, দূরে বসে নিঃসঙ্গ, বিবাগী
একজন নীরবে কবিতা লেখে রোদের অক্ষরে। জুয়াড়িরা
তাকে ঘিরে হৈ চৈ করে কবিতার পাতাগুলি ব্যাঙ্কনোট ভেবে
পুলকিত, ভ্রম দূর হলে কুটি কুটি
ছিঁড়ে ফেলে হাওয়ায় ওড়ায়। অনন্তর জুয়াড়িরা
কবির ভেতরকার রোদ কেড়ে নেয় ক্রোধে। চুপচাপ
প্রতিবাদহীন কবি, জুয়াড়িরা গলে হাওয়ায় মিলায়।
৭.৪.৯৯
আমাকে থাকতে হবে
এখানেই আমাকে থাকতে হবে ঘটি বাটি আর
বইপত্র, কাগজ কলম নিয়ে মাথাটা বাঁচিয়ে যদ্দিন না
মৃত্যুর সাঁড়াশি এসে আমাকে নিশ্চিত টেনে নেয় অন্তহীন
অন্ধকারে; এখনতো দাউ দাউ আগুনের বাড়িতেই আছি
তপ্ত মাটি কামড়ে। তোমরা
থাকবে আমার পাশে, এই বিশ্বাসের লাল পদ্ম
প্রস্ফুটিত আমার অন্তরে। অনেকেই
যাচ্ছে সরে, চতুর্দিকে ঝুমুনির আসর বসেছে যেন।
এখন এমন এক সময় এসেছে অতিকায়
দাঁতাল জন্তুর মতো, হিংস্র অতিশয়, দাঁতে যার লেগে আছে
নরমাংস, তাজা রক্ত। আমি তার চোয়ালে বসেই
কবিতার নানা চিত্রকল্প মনোনীতা মানবীর কথা ভাবি,
ভাবি দেশ থেকে বহুরূপী সন্ত্রাসের অমাবস্যা লুপ্ত হয়ে
পূর্ণিমা জাগবে কবে! স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাঁচি।
এই ঘাস, এই মাটি, এই নদী, গাছপালা ছেড়ে কোনওদিন
যাব না কোথাও, বাঁধব না নাও ভিনদেশী ঘাটে।
আকাশ পড়ুক ভেঙে মাথার ওপর আর অস্ত্রের উলঙ্গ
জয়োল্লাস চিরুক হাওয়ার বুক যখন তখন, তবু এই এখানেই
আমাকে থাকতে হবে ঘটি বাটি আর বইপত্র,
কাগজ কলম নিয়ে আর হৃদয়ের ধু ধু খরায় অথই ভালোবাসা।
১৯.৩.৯৯
আমার কেন যে শুধু
আমার কেন যে শুধু ভুল হয়ে যায়, নিজেকেই
বোঝাতে পারি না কোনওমতে। ফুল গাছ
থেকে ফুল তুলে আনতে গিয়ে
কাঁটা তুলে আনি আর এক গাছা দড়ি
সংগ্রহের জন্যে পা বাড়িয়ে কিছু দূর
এগোবার পর রাগী সাপের মসৃণ লেজ ধরে ফেলি। হায়,
প্রিয়তমা রমণীর মনে শতরঙা
তরঙ্গ তোলার বাসনায় তাকে বেদনায় নীল করে দিই।
ভুলের মাশুল দিতে দিতে বড়ই ফতুর হয়ে
এখন বসেছি পথে। যন্ত্রণার দাঁত আমাকে নিয়ত কাটে,
অসংখ্য অদৃশ্য ক্ষত দেহ মনে কী করুণ সঞ্চিত হয়েছে। দিন যায়,
রাত কাটে; বয়সের ছাপ পড়ে ক্রমাগত অবয়বে, চোখ
দ্রুত দৃষ্টিহীনতার দিকে যাচ্ছে চলে,
কানের শ্রবণশক্তি ভাটার কবলে আর নানা ব্যাধি বজ্রঅঁটুনির
ফাঁদে ফেলে নিচ্ছে প্রতিশোধ নানাবিধ
প্রাক্তন অপরাধের। হয়েছি সওয়ার ভুলে উন্মত্ত ঘোড়ায়।
বাস্তবিক আমার জীবন ভুলে কণ্টকিত বলেই নিয়ত
জোড় হাতে ক্ষমাপ্রার্থী অনেকের কাছে, বিশেষত
যারা হৃদয়ের বড় কাছে, তাদেরই করেছি দগ্ধ ঢের বেশি
কখনও না জেনে কখনওবা জেনে। আমার নিজের
জীবন পুড়ছে নিত্যদিন শক্র কবলিত এক
লুণ্ঠিত, রক্তাক্ত, আর্ত, অসহায় নগরীর মতো
১১.৪.৯৯