কখনো কখনো
কখনো কখনো সত্য ঘটনা গল্পের, বলা যায়,
চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্যজনক
মনে হয়। এই তো ইঞ্জিন এসে চকিতে নিছক
উন্মাদের মতো
আচরণ করে দিব্যি বসে রইল; শত
সাধ্য সাধনার
পরেও সেখান থেকে এতটুকু নড়বার নাম
করল না। গোধূলিতে সতেজ হাওয়ার
আরাম পাবার বাসনায় প্ল্যাটফর্মে নামলাম
আর ক’জনের মতো। কী নীরব চতুর্দিকে, শুধু
একটি দুটি কণ্ঠস্বর, গলায় গ্রামীণ টান,
শোনা যায় ইতস্তত, ধু-ধু
মাঠ আর অদূরে ডালিম গাছ, ট্রাঞ্জিস্টারে লালনের গান।
কী অবাক কাণ্ড, মনে হয়
বহুদিন পরে ফের তোমাকে ট্রেনের জানালায়
দেখলাম কী সুন্দর, জীবন এ-ও এক পরম বিস্ময়।
যাব কি যাব না ছুটে, এই দোটানায়
মুহূর্ত গড়িয়ে যায়, মাথার ওপরে
নীড়গামী পাখি ওড়ে।
ফুরফুরে কোমল হাওয়া, বহু স্মৃতি পাড়ি-দেয়া, ছুটে যায় তোমার উদ্দেশে
ক্লাস থেকে ছুটি পাওয়া বালকের মতো। তুমি হেসে
তাকালে সে কার দিকে? তুমিই তো ঠিক
ট্রেনের জানালা ঘেঁষে বসে আছে? নাকি অন্য কেউ?
অমন দিঘিতে ভোরবেলার ঝিলিক-
দেয়া চোখ আর কত হতে পারে? আমার হৃদয়ে এই ঢেউ
অপর কাউকে দেখে জাগতে পারে না। নাকি পারে?
পা বাড়াতে গিয়ে শুনি তোমার ট্রেনের গার্ড বাঁশি
বাজায় হঠাৎ। ট্রেন ছাড়ে,
দূরীভূত মূর্তির মতোই স্থাণু আমি; রাশি রাশি
ধোঁয়া প্ল্যাটফর্ম অন্ধকার করে ওড়ে।
তুমিই কি ছিলে ট্রেনে? কিছুতেই কাটে না ধন্দ। মনুষ্যজীবন
এরকমই; ভাগ্যিস আমার ট্রেন করেছিল বিকারের ঘোরে
উন্মাদের মতো আচরণ।
কতকাল পরে
কতকাল পরে কণ্ঠে তোমার মেয়ে
বইয়ে দিয়েছ চকিতে ঝরনাধারা,
যেন শীতার্ত প্রহরে পেয়েছে ফিরে
প্রাণের শিহর মৃত পুষ্পের চারা।
কী করে তোমার রূপ বর্ণনা করি?
তোমার দু’চোখ কী-যে সুন্দর, ভাবি।
স্তনের ডৌল স্বর্গেয় উদ্ভাস,
সোনালি চূড়ায় আমার কি আছে দাবি?
ক্রমে যাবে বেড়ে অন্যের প্রাণবীজ
হয়তো আচরে তোমার গর্ভাশয়ে।
বন্ধ্যা সময়ে তুমি বসন্ত-ফুল,
আমার জীবন চিহ্নিত শুধু ক্ষয়ে।
আমার বাগান মুমূর্ষ ইদানীং
কর্কশ সব ঘাতকের তাণ্ডবে;
সত্তায় বয়ে দুঃস্বপ্নের ছায়া
বড় এক ঘুরি শহুরে এ রৌরবে।
শ্বেত সন্ত্রাস ঘরে ঘরে দেয় হানা,
রঙিন পুতুল ভেঙে যায় পদাঘাতে।
শুভ অশুভের দ্বন্দ্ব প্রবল আজ,
শত কংকাল হত্যাযজ্ঞে মাতে।
তুমি নেই পাশে, শূন্য এ ঘর মরু,
হৃদয় আমার শোকের অমিতাচার।
তোমার চোখের পাতায়, উষ্ণ ঠোঁটে
অশরীরী হয়ে চুমো দিই বারবার।
আমি যে রকম তোমার জন্যে আজও
করি ছটফট কৈ মাছটির মতো,
আমার জন্যে তুমি কি তেমন হও?
হও না বলেই আমি যে ভাগ্যহত।
বলো এ কেমন যুগ-সংকটে হলো
তোমার আমার অস্ফুট পরিচয়।
অতীতের শত স্বৈরাচারীর প্রেত
বর্তমানের শিরায় ছড়ায় ভয়।
আমাদের এই প্রেমের মধ্যদিনে
নামে প্রত্যহ মেশিনগানের ছায়া;
কাঁদানে গ্যাসের ব্যাপক ধূম্রজালে
কোথায় উধাও আয়ত চোখের মায়া!
একনায়কের বুটের তলায় পড়ে
থেঁতলে যাচ্ছে ক্রমশ স্বপ্নগুলি,
তার বোম্বেটে সহচর কতিপয়
ছুড়ে দেয় দূরে শূন্যে মড়ার খুলি।
চৌদিক আজ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা,
বর্বরদল ঘুরছে সগৌরবে;
অন্য কোথাও আশ্রয় খোঁজা বৃথা,
তোমাকে না দেখে আমার মৃত্যু হবে?
কারো একলার নয়
অকস্মাৎ লেখার টিবিল থেকে যদি
আমাকে উপড়ে নেয়, ঘর গেরস্থালি, প্রেমিকার একরাশ
চুলের সৌরভ, সন্তানের চুমো জনপথ, কবিসভা থেকে
ঝোড়ো হাওয়া এক ফুঁয়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়
পালকের মতো, হাতলে কি এ শহর হয়ে যাবে
ধনুকের প্রোজ্জ্বল টংকার?
এ রকম কিছুই হবে না। যে মচ্ছব সালঙ্করা
গণিকার অঙ্গভঙ্গি, তাতে ভাটা
গড়বার লক্ষণ দুর্লক্ষ্য আপাতত। কত নির্ঘুম রাত্রির
স্মৃতি আনে কর্কশ অস্বস্তি। সর্বদাই
নির্ঘুম কবির চোখ, অবসাদে, ক্লেশে
দু’চোখের পাতা জোড়া লাগলেও অন্য চোখ
জেগে থাকে, দ্যাখে
রাত্রির তৃতীয় যামে চাঁদ হাঁটে নীলিমার দবিজ কার্পেট,
ফুটপাতে ঘুমন্ত শিশুর
কপালে নিবিড় টিপ দিয়ে যায় খুব চুপিসারে।
তোমার সৌন্দর্য, হে স্বদেশ, আকৈশোর মুগ্ধ আমি
অনিন্দ্য ফুলের মতো তোমার এ মুখ
উন্মীলিত, যেখানেই যাই
তোমার মুখশ্রী সঙ্গী আমার এবং
দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের ঘোর কেটে গেলে
তোমার রূপের টানে ফিরে আসি তোমার কাছেই।
আমাকে কখনো যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে দূরদেশে
কী ক’রে বাঁচব আমি তোমাকে না দেখে? ভাবি খুব
উদাসীনতায় ডুবে থাকব, অথচ
দুখিনী তোমার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।
হে অনিন্দ্য ফুল,
তোমার ভেতরে ওরা ছড়িয়ে দিয়েছে মুঠো মুঠো
কীট, কালিমার গাঢ়ঝ, পোঁচড়া পড়েছে
তোমার চোখের নিচে, তবু কী সুন্দর
তুমি, রোগ শোক অর্ধাহারে। কত নোংরা
হাত সাপ হয়ে নাচে ডোরাকাটা শাড়ির চৌদিকে,
চায় দরবারি স্খলিত বসনে দেখে পেতে লালসার যৌথ বাহারের ভাগ।
তোমাকে বন্ধক রেখে পেট্রোডলারের খাদেমেরা
নিটোল মুক্তোর মতো নিজেদের আখেরকে সাততাড়াতাড়ি
পৌঁছে দেয় সাত আসমানে। স্থিতি নেই
কোনোখানে, আঙনের কোলাহলে দিশেহারা মানুষ, বনের
পশুপাল আমার জীবন ঘূর্ণিজলে
পাতা যেন, ডোবে আর ভাসে।
এই ডামাডোলে
যার রাজবেশ তার প্রত্যাবর্তনের উপলক্ষে
অসংখ্য তোরণ তৈরি হয় প্রধান শহরে, তাকে
বরণ করার জন্যে সভাসদদের
তুমুল উদ্দীপনায় শূন্য হয়ে যায় সব ফুলের নার্সারি।
জনসাধারণ বিস্ময়ের
চূড়ায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে, কবি দ্যাখে তার
কবিতার ছন্দ ভুলে, শোনে
একটি তোরণ থেকে ভুখা শিশুদের
কান্না ভেসে আসে,
আরেকটি থেকে রাজবন্দিদের দীর্ঘশ্বাস স্বৈরাচারীদের
বিরুদ্ধে ঘৃণার উচ্চারণ,
কোনো কোনো তোরণের চিত্রিত গা বেয়ে
চুইয়ে চুইয়ে পড়ে গত ধর্মৎটে শহীদের
পবিত্র শোণিত। এরই মধ্যে নানা ডৌলে
শব্দ লিখি, ছন্দ গেঁথে যাই আর দশদিকব্যাপী
অন্ধকার থেকে
একমুঠো কালো তুলো নিয়ে
ব্যাজ পড়ি, যা নয় কখনো পরবশে,
কিংবা কারো একলার নয়।