Site icon BnBoi.Com

নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে – শামসুর রাহমান

অভিশাপ যতই জ্বলন্ত হোক

আমি কাউকেই কাঠগড়ায় কখনও
করাবো না দাঁড় নিরর্থক
আমার হালের জন্যে।কারও নামে নালিশ করার
বিন্দুমাত্র অধিকার নেই এই লোকটার, মানে
আমার, কেননা আমি নিজেরই বিরুদ্ধে
বারবার করেছি ফুলুম, অপরাধ।

নিয়ত আমার হৃৎপিণ্ড, প্লীহা ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে
জাঁহাবাজ এক বাজপাখি।
অসহায় আমি বড় অপারগ বাধা দিতে ওকে।
আমি যে অন্যায় করে কাটিয়েছি যত দিনরাত্রি,
তার পরিণাম এরকমই হতে হবে-
কী করে এড়াবো শাস্তি? রক্তাক্ত প্রহর?

সামান্য পাখিও নীড় সাজায় গোছায়
নন্দনতত্ত্বের অ আ ক খ না জেনেও,
নিজ শাবকের যত্ন নেয় যথারীতি।
আর এই আমি সভ্যভব্য মনুষ্য সমাজে নিত্য
বসবাস করেও আপন সংসারের, গৃহিণীর,
সন্তানের যথাযথ লালন পালন থেকে সরিয়ে দু’হাত
আমার সাধনালব্ধ শিক্ষার খানিক কণা দিতে
ব্যর্থতাকে বরণ করেছি। ওরা আমার অনেক কথা বোঝে না বলেই
শোনার আগ্রহ স্রেফ হারিয়ে ফেলেছে।
আর আমি শুধু বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে ছুটে
কাটিয়েছি সারা বেলা, সংসারে নেমেছে খাঁ খাঁ ধস,
বস্তুত হুমড়ি খেয়ে কোনওমতে রুখেছি বিচ্ছিরি পরিণতি

কুড়িয়েছি বদনাম কত; খামাকা লোকেরা ডাস্টবিনভরা
আবর্জনাগন্ধী গুচ্ছ গুচ্ছ কল্পকথা রটিয়েছে।
অনেকেই উদাসীন পদাতিক আমার উদ্দেশে
তাকিয়েছে আড়চোড়ে, যেন আমি চিড়িয়াখানার
একটি কিম্ভূত কিমাকার জীব, হাসির হুল্লোড়
ওঠে অলিগলি, চৌরাস্তায়।

উপরন্তু দেবকুল অতিশয় ক্ষিপ্ত আজ আমার ওপর,
কেননা তাদের কণ্ঠ থেকে সুর নিয়ে অনুপম পদাবল্মী
রচনা করেছি নিশীথের কত নিস্তব্ধ প্রহরে,
যার ধ্বনি গুঞ্জরিত মানুষের মনে প্রাণে গ্রামে ও শহরে।

তবে কি সঙ্গীতময় দেবতার প্রতিযোগী হওয়ার কসুরে
অভিশপ্ত আমি আজ? তারই পরিণামে
এরকম রোগক্লিষ্ট পড়ে আছি একা অসহায়?
অভিশাপ যতই জ্বলন্ত হোক, পোকাক্রান্ত কাঠ হোক শরীর, জীবন,
তবু আমি প্রতিযোগিতার পথ ছেড়ে
শব্দের, ধ্বনির রূপ থেকে দূরে সরে থাকব না।
নিভুক চোখের জ্যোতি, কাঁপুক দু’হাত অবিরত,
আমার কবিতা তবু সাজাবে জমিন, সীমাহীন আসমান।
১৫.১১.৯৯

অস্তর্গত রোদ

কোনও কোনও দুপুররোদের দিকে তাকিয়ে অনেক
দিনের পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। রোদের ভেতর থেকে
গূঢ় রোদ জন্ম নিয়ে আমার অন্তরে
খেলা করে খুব নিরিবিলি। সেই রৌদ্রসুরা ঢক
ঢক পান করে বুঁদ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ, দেখি কারা যেন
আমার ভেতরে হেঁটে যায়, ফিরে আসে ভিন্ন চেহারায় আর
হঠাৎ আমার পিঠা চাপড়ে হুল্লোড়ে মেতে ওঠে। কেউ কেউ
জুয়ো খেলা শুরু করে, দূরে বসে নিঃসঙ্গ, বিবাগী
একজন নীরবে কবিতা লেখে রোদের অক্ষরে। জুয়াড়িরা
তাকে ঘিরে হৈ চৈ করে কবিতার পাতাগুলি ব্যাঙ্কনোট ভেবে
পুলকিত, ভ্রম দূর হলে কুটি কুটি
ছিঁড়ে ফেলে হাওয়ায় ওড়ায়। অনন্তর জুয়াড়িরা
কবির ভেতরকার রোদ কেড়ে নেয় ক্রোধে। চুপচাপ
প্রতিবাদহীন কবি, জুয়াড়িরা গলে হাওয়ায় মিলায়।
৭.৪.৯৯

 আমাকে থাকতে হবে

এখানেই আমাকে থাকতে হবে ঘটি বাটি আর
বইপত্র, কাগজ কলম নিয়ে মাথাটা বাঁচিয়ে যদ্দিন না
মৃত্যুর সাঁড়াশি এসে আমাকে নিশ্চিত টেনে নেয় অন্তহীন
অন্ধকারে; এখনতো দাউ দাউ আগুনের বাড়িতেই আছি
তপ্ত মাটি কামড়ে। তোমরা
থাকবে আমার পাশে, এই বিশ্বাসের লাল পদ্ম
প্রস্ফুটিত আমার অন্তরে। অনেকেই
যাচ্ছে সরে, চতুর্দিকে ঝুমুনির আসর বসেছে যেন।

এখন এমন এক সময় এসেছে অতিকায়
দাঁতাল জন্তুর মতো, হিংস্র অতিশয়, দাঁতে যার লেগে আছে
নরমাংস, তাজা রক্ত। আমি তার চোয়ালে বসেই
কবিতার নানা চিত্রকল্প মনোনীতা মানবীর কথা ভাবি,
ভাবি দেশ থেকে বহুরূপী সন্ত্রাসের অমাবস্যা লুপ্ত হয়ে
পূর্ণিমা জাগবে কবে! স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাঁচি।

এই ঘাস, এই মাটি, এই নদী, গাছপালা ছেড়ে কোনওদিন
যাব না কোথাও, বাঁধব না নাও ভিনদেশী ঘাটে।
আকাশ পড়ুক ভেঙে মাথার ওপর আর অস্ত্রের উলঙ্গ
জয়োল্লাস চিরুক হাওয়ার বুক যখন তখন, তবু এই এখানেই
আমাকে থাকতে হবে ঘটি বাটি আর বইপত্র,
কাগজ কলম নিয়ে আর হৃদয়ের ধু ধু খরায় অথই ভালোবাসা।
১৯.৩.৯৯

আমার কেন যে শুধু

আমার কেন যে শুধু ভুল হয়ে যায়, নিজেকেই
বোঝাতে পারি না কোনওমতে। ফুল গাছ
থেকে ফুল তুলে আনতে গিয়ে
কাঁটা তুলে আনি আর এক গাছা দড়ি
সংগ্রহের জন্যে পা বাড়িয়ে কিছু দূর
এগোবার পর রাগী সাপের মসৃণ লেজ ধরে ফেলি। হায়,
প্রিয়তমা রমণীর মনে শতরঙা
তরঙ্গ তোলার বাসনায় তাকে বেদনায় নীল করে দিই।

ভুলের মাশুল দিতে দিতে বড়ই ফতুর হয়ে
এখন বসেছি পথে। যন্ত্রণার দাঁত আমাকে নিয়ত কাটে,
অসংখ্য অদৃশ্য ক্ষত দেহ মনে কী করুণ সঞ্চিত হয়েছে। দিন যায়,
রাত কাটে; বয়সের ছাপ পড়ে ক্রমাগত অবয়বে, চোখ
দ্রুত দৃষ্টিহীনতার দিকে যাচ্ছে চলে,
কানের শ্রবণশক্তি ভাটার কবলে আর নানা ব্যাধি বজ্রঅঁটুনির
ফাঁদে ফেলে নিচ্ছে প্রতিশোধ নানাবিধ
প্রাক্তন অপরাধের। হয়েছি সওয়ার ভুলে উন্মত্ত ঘোড়ায়।

বাস্তবিক আমার জীবন ভুলে কণ্টকিত বলেই নিয়ত
জোড় হাতে ক্ষমাপ্রার্থী অনেকের কাছে, বিশেষত
যারা হৃদয়ের বড় কাছে, তাদেরই করেছি দগ্ধ ঢের বেশি
কখনও না জেনে কখনওবা জেনে। আমার নিজের
জীবন পুড়ছে নিত্যদিন শক্র কবলিত এক
লুণ্ঠিত, রক্তাক্ত, আর্ত, অসহায় নগরীর মতো
১১.৪.৯৯

 আমার স্বপ্নগুলো

এক ঘুম থেকে আলাদা ঘুমে মিশে যেতে যেতে
তিন হাজার বছরের কিছু স্বপ্নকণা
আলগোছে কুড়িয়ে নিই হাতে। বাইসনের চোখ,
ভালুকের মাথা, ঘোড়ার পা, গোটা গণ্ডার
ঝলসে ওঠে নিদ্রার প্রান্তরে। গুহার দেয়ালে
আঁকতে থাকি নানা চিত্র, আমার পরনে সিংহের চামড়ার
নেংটি। চিত্র থেকে চিত্রে ঘুমের পর্দার রেশম
সময়হীনতার স্তর রচনা করে পশুর চর্বির তৈরি আলোয়।

আমার স্বপ্নগুলোকে গুছিয়ে রাখি
স্মৃতির কন্দরে, অথচ ওলট পালট হয়ে যায় সব,
একটির গলায় আরেকটি পা রাখে
জল্লাদের ভঙ্গিতে, একটি ভবঘুরের মতো হঠাৎ উধাও
অজানা বন্দরে। দু’তিনটি অসুস্থতায়
ধুঁকে ধুঁকে মরে যায় ঘোর অমাবস্যায়। ওদের
কবর দেয়ার মতো কেউ কোথাও থাকে না; ওরা
বাজে পদ্যের মতো স্মৃতির উদার দাক্ষিণ্য থেকেও বঞ্চিত।

কখনও কখনও স্বপ্নলোকে নিয়ে আর পারি না।
বলা কওয়া নেই অবাঞ্ছিত অতিথির মতো হাজির,
বকবকিয়ে আমার সময় খায়, স্ফীত হতে থাকে
কপালের দু’পাশের রগ, এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে
আমার বিছানায়। ওদের তাড়াতে পারলে বাঁচি,
অথচ দূর দূর করে হটিয়ে দেয়াও মুশকিল, এমনই
বেআক্কেল, বেহায়া। কোনও কোনও স্বপ্ন যখন ডানা দোলাতে দোলাতে
কবিতা হয়ে ওঠে, কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ টলটলে হ্রদ।
১.৭.৯৯

এ কোথায়

এ কোথায় পড়ে আছি ভাবলেশহীন? কারা আমাকে
নিয়ে এসেছে এখানে? গুচ্ছের ঘাস
আমার নাকের ভেতর ঢুকছে, পিঁপড়ের ঝাঁক
চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। হরেক রকমের
শব্দ আসছে কানে। কারা কী বলছে
মাথামুণ্ডু কিস্‌স্‌ বুঝতে পারছি না।

আমার সত্তর বছরের অস্থিচর্মসার শরীরে
এক রত্তি প্রাণ আছে কি নেই,
এ নিয়ে বড়ই ধন্দে পড়েছি। চিৎ হয়ে পড়ে-থাকা
আমি দেখি, আমার বাবা কালো শেরওয়ানি আর
সফেদ পাজামা পরে বসে আছেন আমার পাশে। তাঁকে
বলতে চাইলাম জালে আট্‌কে পড়া মাছের ভাষায়,
আপনি তো অনেক অনেক বছর আগে দুনিয়াকে
সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন, তাহলে এখানে
এলেন কী করে? তবে কি আমি মৃত্যুপুরীতে পড়ে আছি?
বাবা নিরুত্তর, আমার পরলোকবাসিনী মাকে কাছে ডেকে
আনলেন তাঁর দৃঢ়, ঋজু হাতের ইশারায়। আবছা পূর্ণিমা
এবং ঘোর অমাবস্যায় দুলতে থাকি ঝড়ে-পড়া নৌকার মতো।

অন্ধকারের জটিল জাল ছিঁড়ে কয়েকটি ঝাপসা
শব্দ আমার বন্দী শরীরের
চৌদিকে চক্কর কাটে। অনেক পুরোনো একটা
ডোবার পচা, দুর্গন্ধময় লতাপাতার ভেতর থেকে
শামসুর রাহমান নামটি জলপোকার মতো তাকায়।
কে এই শামসুর রাহমান? ঘাসফড়িং
গুবরে পোকা আপন মনে উড়ে, ঘরে বেড়ায়, পরস্পর
কথা কয়, ‘কোন্‌ দেশী লোক সে? কোথায় নিবাস?’

মনে হয়, অন্ধকারের বর্ষা নয়, অনেক
শতাব্দীর সোনালি বৃষ্টির মতো আলোর বান ডেকে যায়,
বসে আছি বোধিদ্রুমতলে, ন্যাড়া মাথা, কঙ্কালসার
পেটপিঠ একাকার, চারদিকে প্রণত
নানা জন, আমি উপবিষ্ট ঠায়
ধ্যানী গৌতম বুদ্ধের মুদ্রায়।

অন্ধকার ভয়ানক পিচ্ছিল পথে সেই কবে থেকে
ক্রশ টেনে চলেছি। আমার পিঠে
চাবুকের হিংস্রতার রক্ত ঝরানো অগণিত দাগ।
আমার মাথায় কাঁটার মুকুট, মুকুটের
প্রতিটি কাঁটা সকল আর্তজনের হয়ে অশ্রুপাত
করছে। আমার বেদনার আলোয় উদ্‌ভাসিত সারা পথ।

আমার বেডের চারপাশে দাঁড়ানো এরা কারা?
কেউই তো আমার চেনা নয়। তবে কি
আমি এক গহন ষড়যন্ত্রের শিকার? চকিতে
একটি কি দু’টি মুখ কেমন আপন মনে হয়। অথচ
ওদের কিছু জানাবার মতো ভাষা আমার অজানা। অথই
জলের স্রোতে কাঠের তক্তা আঁকড়ে ধরে, নাকে মুখে
পানির চড় চাপড় খেয়ে ভাসছি, ডুবছি। কয়েকটি অচেনা,
হিংস্র, ক্ষুধার্ত পাখি আমার ওপর কেবলি চক্কর কাটছে।
৩১.১০.৯৯

 একজন নদীর উদ্দেশে

একজন নদীর ভেতরকার নদী
আমার সুদূর ছেলেবেলা,
প্রখর যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের ধূসরিম ভেজা
মাটি ছুঁয়ে ছেনে
কাহিনীকাতার হয় খুব। আমি তার গল্প শুনি
কোনও কোনও ভোরবেলা, দুপুরে অথবা
গোধূলিবেলায় আর কখনও কখনও
সন্ধ্যারাত পেরিয়ে নিশীথ হয়ে যায়।

একজন নদীর ভেতরকার নদী
মেঘনা নামের অন্তরালে বয়ে যায়, রূপ যার
আমার বালক পিতা, যুবা পিতামহ, মাতামহ,
প্রবীণ প্রপিতামহ, তাঁহাদের পূর্বপুরুষেরা
দেখেছেন চোখ ভরে কতকাল, দেখবেন আরও
আমার দু’চোখ দিয়ে, যতদিন আমি বেঁচে আছি।

মাতামহ, পিতা নব্য জীবিকার টানে গ্রাম বাংলার ছোট
পাড়াতলী ছেড়ে, থই থই ধানশোভা,
মেঘনার তটভূমি, তরঙ্গে তরঙ্গে রৌদ্র-চাঁদিনীর ব্যালে
অনেক পেছনে রেখে ইট পাথরের
বেগানা শহরে ডেরা বাঁধলেন। শর্ষেখেতময় প্রজাপতি, ঘুঘু,
মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গীত রক্তে দিয়েছে অদম্য কত দোলা।

কখনও দুপুরবেলা ভৈরবের বিস্তীর্ণ কিনার থেকে আর
কখনওবা আমার আপন গ্রাম পাড়াতলীর ঘনিষ্ঠ কাছাকাছি
আলুঘাটা থেকে মেঘনার মন-নাচানো রূপের
ইন্দ্রজাল বিমুগ্ধ দেখেছি বাল্যকালে আর তুমুল যৌবনে।

একজন নদীর ভেতরকার নদী মেঘনাকে
বারবার দেখেছি তন্ময় হয়ে, এখনও তো দেখি,
যেন সে রূপসী নারী। কখনও কখনও রূপ তার
এমনই মধুর প্রতারক যে হাজার হাজার হীরার
ঝলসানি দ্বিপ্রহরে অথবা জ্যোৎস্নার বর্ষা গহন রাত্তিরে
অবিকল একই মনে হয় ইচ্ছে জাগে ওকে
পৌরুষ উজাড় করে বাঁধি আলিঙ্গনে।
মেঘনা আমার প্রিয়া কেন এমন ব্যাকুল ডাকো বারবার?
মেঘনা আমার শৈশবের, যৌবনের কতদিন করেছ হরণ
অনায়াসে, আমার ভেতরে
জাগিয়েছ কী বিপুল অগণিত ঢেউ,
আজও এই আমার নবীন বার্ধক্যের নানান প্রহরে,
ঝলসে উঠছ তুমি, কখনও কখনও
তোমার নিকট যাই, ছুঁই
তোমার শরীর গাঢ় অনুরাগে, জানি
মৃত্যুর পরেও আমি দেখব তোমাকে ভাবীকালে
যুগ যুগান্তরে বংশধরদের উৎসুক দৃষ্টিতে!
৪.১১.৯৯

একটি কলমের পথযাত্রা

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই আমার কলম
চোখ কচলাতে কচলাতে টেবিল থেকে গলিপথে
নেমে গেলো। কী খেয়াল হলো ওর, সে
হেঁটে হেঁটে একটা পুরোনো দিঘির কিনারে পৌঁছে
পদ্মকে প্রশ্ন করলো, ‘পদ্ম, তুমি কি আমার কেউ হবে!’
পদ্ম মাথা নেড়ে সাফ জবাব দিলো,
‘অসম্ভব, তুমি আমার কেউ নও। আশাহত
কলম ধরলো অন্য পথ।

হাঁটতে হাঁটতে কলম হাজির হলো
রূপসী এক গাছের কাছে। কলমের ব্যাকুল সওয়াল,
‘তুমি কি আমাকে নিবিড় ভালবাসবে ? গাছ
মৃদু হেসে বলে, ‘আমার ভালোবাসা তোমাকে
ছায়ায় রূপান্তরিত করবে। তুমি সইতে পারবে সেই
রূপান্তরের যন্ত্রণা?’ কলম সেখান থেকে বিদায় নেয় নীরবে।

আমার কলম এবার ক্লান্ত শরীরে গিয়ে বসলো
নদীর কিনারে। নদীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে
সে প্রশ্ন করে, ‘ওগো নদী, তুমি কি
আমার হতে পারবে?’ নদী প্রখর ধারায় বয়ে
যেতে যেতে বলে, ‘আমি কারও জন্যে অপেক্ষা করতে জানি না।
ক্লান্ত কলম সত্তায় নৈরাশ্য নিয়ে শুরু করে পথ চলা।

আখেরে পথের ধুলোকে জিজ্ঞেস করে আমার
পথচারী কলম, ‘ওগো ধুলো তুমি কি আমার
প্রিয়তমা হবে?’ ধুলো জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, হতে
পারি এক শর্তে, যদি আমাকে স্বর্ণচূড় বানাতে পারো। সেই থেকে
আমার পরিশ্রমী কলম দিনরাত ধুলোকে সোনা
বানানোর সাধনা করছে। সফল হচ্ছে কি হচ্ছে না, বোঝা দায়!
১২.১২.৯৯

একটি প্রাচীন গ্রস্থ

একটি প্রাচীন গ্রন্থ কী নিঝুম শুয়ে আছে একা
নিশীথে টেবিলে, যেন তার
দু’চোখে ছিল না ঘুম বহুকাল। পুরোনো নিদ্রার গাঢ় ঘ্রাণ
বুঝি বা ছড়ানো সারা ঘরে; সে কি ক্ষণিক তুলেছে
হাই কিংবা আড়মোড়া ভাঙলো খানিক
না কি কিছুক্ষণ
আছাড়ি পিছাড়ি করে ঢলে পড়ে ঘুমে। অকস্মাৎ
প্রাচীন গ্রন্থটি যেন কারও মুখ হয়ে তীক্ষ্ণ
তাকায় আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে। পুস্তকের
পাতাগুলি কোথায় গায়েব হলো চোখের পলক
পড়তে না পড়তেই? বই থেকে জেগে-ওঠা মুখমণ্ডলের
জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে চতুর্দিকে।

টেবিল টেবিল নয় আর, যেন কানও সাধকের
ধ্যানমগ্ন উদার আসন, যাতে ঠাঁই পেয়ে যাবে
সারা বিশ্বাব্রহ্মান্ড এবং
যদি স্বর্গ সত্য হয়, তা-ও। জ্যোতির্ময় সেই মুখ
রেখেছে আয়ত দৃষ্টি তার বিস্মিত আমার দিকে, ধীরে
আওড়ায় কিছু উদাত্ত নিবিড় কণ্ঠস্বরে
আর কোনও নির্দেশ ছাড়াই
আমার নিজের উচ্চারণ তার উচ্চারিত শ্লোক
হয়, হয় প্রতিধ্বনি। ক্ষণকাল পরে
টেবিলের দিকে যাই, যা এখন সাধকের বিমূর্ত আসন।

প্রাচীন গ্রন্থটি খুঁজি তন্ন তন্ন করে। ক্লান্ত চোখে দেখি
হঠাৎ কোত্থেকে সেই পুশিদা পুস্তক
আমার কম্পিত হাতে এসে যায়, পাতা উল্টে পাল্টে
পড়তে ভীষণ ব্যর্থ হই, বর্ণমালা, ভাষা, সবকিছু
অচেনা, রহস্যময় আগাগোড়া অনন্তর কেতাব উধাও,
শুধু এক অপরূপ সুর গুঞ্জরিত হতে থাকে ঘরময় মধ্যরাতে।
৩০.১২.৯৯

একটি হারিয়ে যাওয়া কবিতার জন্যে

একটি কবিতা আজ হারিয়ে ফেলেছি গোধূলিতে, যাকে আর
পাবো না কখনও খুঁজে কোনওদিন। এসেছিল সবুজাভ পাতা
যেমন গাছের ডালে আসে সাবলীল। আমি তার
আবির্ভাবে নক্ষত্র বৃষ্টিতে ভিজে আপাদমস্তক
যেন চলে গেছি উড়ে সব পেয়েছির দেশে। আনন্দ, আনন্দ
ধ্বনি বুকে বেজে উঠেছিল আর কবিতার খাতা
অপরূপ, অনিবার্য শব্দাবলী পাওয়ার আগেই
কোথায় হারিয়ে গেল ক্ষুধিত তিমিরে। গোধূলির
রঙ মুছে গেল সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীর রাত্রি এল,
আমার মগজ শূন্য করে লব্ধ শব্দাবলী প্রত্যাবর্তনের
রীতি ভুলে গেছে ফের বহুদিন পর। অকস্মাৎ চিত্তপটে
ঝড় ওঠে, মনে জাগে পুরোনো দিনের কথামালা।

ঢের আগে পুরোনো ঢাকার গলিবাসী বহুকাল
ছিলাম মনের সুখে। শৈশব, যৌবন, আদি প্রৌঢ়ত্বের ঋদ্ধ
কিয়দংশ কেটেছে সেখানে। যৌবনের এক মধ্যরাতে
চকিতে আমার খুব কাছে এসে, হঠাৎ কোথায়
আন্ধারে হারিয়ে গেল অপরূপ একটি কবিতা। জানি না তো
কী করে ফিরিয়ে আনা যায় তাকে; সমস্ত শরীরে
ফুটছে অজস্র কাঁটা, অনুশোচনায় হতবুদ্ধি বললেন
অশ্রুপাত করে আর কিছুক্ষণ পরে, কী আশ্চর্য, কাগজের শূন্য
পাতা জুড়ে ফুটে ওঠে পলাতকা কবিতার রূপ।
অথচ এখন এই শহরতলিতে মাথা খুঁড়ে মরলেও
আমার হারিয়ে-যাওয়া কবিতাকে কোথাও পাবো না,
শুধু অতিদূর থেকে অস্পষ্ট আসবে ভেসে কারও ক্রূর হাসি।
২৯.১১.৯৯

এখনও জানি না

সেই কবে থেকে পথ চলছি, কখনও
চলছি সমঝে সুমঝে, কখনও বেপরোয়া
আমার পা ফেলার ছন্দ। হোঁচট যে খাচ্ছি না,
এমন নয়। কখনও কখনও অতর্কিতে
কাঁটা বিঁধে রক্তাক্ত আমার পা। তখন মনে হয়,
কোথাও গাছতলায় বসে খানিক
জিরিয়ে নিই। কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। খোঁড়াতে
খোঁড়াতে চলতে থাকে আমার পদযাত্রা।

ওপরের দিকে তাকিয়ে এক সময়
আকাশকে দেখতে পাই নীল সমুদ্রের মতো।
মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হয়
হাত বাড়িয়ে ছুঁই দূরের আকাশকে। কখনও
হঠাৎ আবার চোখে পড়ে আকাশের
আলাদা চেহারা, যেন এক রাগী দেবতা
মেতে ওঠে অপ্রত্যাশিত হিংস্রতায়। মনে হয়,
এক্ষুণি আমাকে অজস্র খণ্ডে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে
জ্বলন্ত বর্শা কিংবা নির্দয় পাথর। কেন যেন
ভাবি, তার ফুৎকারে ছেঁড়া কাগজের একরত্তি
টুকরো মতো একরোখা হাওয়ার চড়চাপড়
খেতে খেতে অজানা কোথাও গায়েব হয়ে যাবে।

আমার এই চলার পথে ক্ষণে ক্ষণে
কত কিছুইতো আচমকা ভয় দেখায়
আমাকে। দুঃস্বপ্নের পর দুঃস্বপ্ন কামড়ে ধরে, আজব
দৈত্য-দানো আমার বিপন্ন অস্তিত্ব নিয়ে প্রায়শ
লোফালুফি করে। আমি কি সব সময়
ওদের অসহায় ক্রীড়নক হয়ে থাকবো? আশ্চর্য আমার
এই মন! কোনও বিরূপতাই ওকে যাত্রা থেকে
থামিয়ে রাখতে পারে না, এমনই অদম্য এই মন।

এক গা ছমছম করা জায়গায় এসে
থমকে দাঁড়াই। রোদ চুমো খাচ্ছে চতুর্দিকে ছড়ানো
অনেক মাথার খুলি এবং হাড়গোড়কে। আমার
আগে যারা অনেক বাধাবিপত্তি, অনেক জুলুম সয়ে
এখানে এসে পৌঁছে ছিলেন, তাদের
সংহার করা হয়েছিল এখানে হায়,
কাঙ্ঘিত গন্তব্যে তারা পৌঁছতে পারেননি
অগ্রগতির শক্রদের হিংস্রতায়।

আমি কি এই ক্ষতবিক্ষত পা কাছের হ্রদের
স্বচ্ছ পানিতে ধুয়ে আমার যাত্রা
শেষ করতে পারবো? পৌঁছতে পারবো
সেই স্থানে, যেখানে প্রতিটি ভবন ধারণ করছে
স্বর্ণচূড়া, যেখানে শান্তি ও কল্যাণের জয়গাথা
সবার কণ্ঠে। আমি কি শেষ অব্দি পৌঁছতে
পারবো সেখানে? জানি না তার আগেই
বন্য হিংস্রতার শিকার হবো কিনা এখনও জানি না।
১৯.১২.৯৯

 এত অন্ধকারময়

আবদুল গাফফার চৌধুরী বন্ধুবরেষু

প্রতি বর্গমাইলেই ঢের ভস্মস্তূপ; হতস্তত কত
বিষণ্ন করোটি পড়ে আছে; ধুলোবালি, রৌদ্র জ্যোৎস্না,
বৃষ্টি ঝরে ওদের ওপর। মনে হয়,
বিভ্রমবশত, হয়তোবা কোনওদিন
ধুয়ে মুছে যাবে
অগণিত ভুল মানুষের ঝাড়ফুঁকে স্বদেশের
অনেক গৌরবগাথা, শত স্মৃতিসৌধ,
শহীদ মিনার আর সদ্য আবিষ্কৃত বধ্যভূমি!

প্রগতি হোঁচট খেতে খেতে এখন ভীষণ খোঁড়া
ঘোড়া যেন, কেবলি ঝিমোয়
জীর্ণ আস্তাবলে আর কল্যাণ কী দ্রুত
হয়েছে বিলীন অস্তাচলে সেই কবে একজন দীর্ঘকায়
মহান পুরুষ এক ঝাঁক
ষড়যন্ত্রপরায়ণ বামনের ক্রূর নিচতায়
হারিয়েছিলেন প্রাণ, অনন্তর জন্মভূমি থেকে
দীপ্তি দেশান্তরী আর শান্তিও ফেরারী।

যদি সে মহান পুরুষের হয় আবির্ভাব দৈবাৎ আবার,
তাহলে নিশ্চিত তিনি স্বগত ভাষণে বিড়বিড়
করবেন অন্তরালে বড় একা-‘এ দেশ আমার নয়, এই
চেনা সহচরবৃন্দ আমার এমন
আশ্চর্য অচেনা কেন? এ কেমন রূপ করেছে ধারণ
দলে দলে? আমার আত্মজা
চাটুকার আর স্তাবকের বন্দনায় মেতে
হাঁটছে আমারই মতো ফাঁদপাতা কোনও
কোনও ভুল-কন্টকিত পথে। আমার স্বপ্নের দেশ
এমন উধাও হবে, ভাবিনি কখনও। আর কত
আত্মাহুতি চায় এই পোড়া মাটি? হায়,
এত অন্ধকারময় বাংলাদেশ অচেনা আমার!’
১৪.৮.৯৯

কবির খাঁ খাঁ ঘর শুধু অশ্রুপাত করে

বেগম সুফিয়া কামালের প্রতি শ্রব্ধাঞ্জলি

সতেজ ভোরের অনুরাগী আমি বরাবর, রোদ
বারান্দায় রেশমি চাদর হয়ে কেমন ছড়িয়ে
পড়ে, একটি কি দু’টি পাখি গান গায়। ভালো লাগে,
গাছের পাতার স্নিগ্ধ নাচে দোলা লাগে প্রাণে, অথচ আজকে
সকাল কেমন এক অন্ধতার হাহাকার নিয়ে
এলো চতুর্দিকে, সারাদেশে। হাজার হাজার কালো
কালো পাখি নিয়েছে দখল করে রাজপথ, জনপদ অলিতে গলিতে
অন্ধকার হাহাকার হয়ে যায়। চতুর্দিকে ওঠে রব, কান্না
অবিরল, ‘এখন কোথায় তিনি? এখন কোথায়
কবি, আমাদের কবি? হায়,

অন্ধকারে যিনি বারবার হেঁটেছেন রাজপথে
জ্বলন্ত মশাল হয়ে, নির্ভুল দেখিয়েছেন সাধের কাঙ্ঘিত
দিকগুলি, তিনি আজ আলোর উৎসব ফেলে,
শক্রদের ভিড়ে ছেড়ে আমাদের
গেলেন কোথায় কোন্‌ জন্মন্ধ তিমিরে? আমাদের
শহরের প্রতি গাছে, প্রতি ফ্ল্যাটে, মাঠে, প্রতিটি পাড়ায়,
কত বুদ্ধিজীবীর স্টাডিতে, কবিদের আস্তানায়, বস্তিতে বস্তিতে
আলোকিত পদ্মের মতোই ফুটে ওঠে তাঁর মাতৃমুখ।

আজ এই নির্বাপিত দিনে মনে হয়
নির্বাসিত আছি, বারবার দীপ জ্বালাতে গিয়েও
দেখি বৈরী ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার সবখানে ফণা তুলে আছে।
একটি অনুচ্চ কণ্ঠস্বর আমাদের জাগিয়ে তোলার জন্যে ডেকে যায়,
শূন্য ধানমণ্ডির একটি বাড়ি বড়ই নিঝুম, বাগানের গাছপালা
এবং কবির খাঁ খাঁ ঘর শুধু অশ্রুপাত করে
২০.১১.৯৯

কাগজে প্রজাপতি

রাতটাই ছিল খুব আলাদা, মদির। বাতাসের
ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন বা বৈষ্ণব পদাবলী কিছু সুর ঢেলে দিয়ে
নিশীথের মধ্যযামে নীরবে যাচাই করে নিচ্ছিল ঈষৎ
প্রভাব আপনকার। মধ্যরাতে কলম উতলা
অকস্মাৎ, উন্মাতাল, থরথর বসে
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা কাগজের পাশে, স্পর্শ করে উন্মোচিত
স্তন, ঠোঁট, তলপেট, চোখের পল্লব
আর গাঢ় ঘুমের ভেতর কাগজের
নিভৃত সত্তায় জাগে শিহরন। আধো-আধো চোখ মেলা স্মিতা
কুমারী কাগজ শুষে নেয়
শ্রমনিষ্ঠ, বিশদ অভিজ্ঞ লেখনীর সঙ্গমের ঝড়, শেষে
দু’জন দু’দিকে মুখ রেখে শ্বাস ফেলে পাশাপাশি।
কলম খোওয়াবে হেঁটে যায় কোন্‌ রহস্যপুরীতে। মনে হয়
তার আগে কোথাও দেখেছে যেন এই
মর্মর প্রাসাদ এই হাতির পায়ের মতো থাম,
এই রঙ্মহল, খিলান, তৈলচিত্র, এই উদ্যানের মূর্তি। অকস্মাৎ
লেখনী নিজেকে দেখে মাঠের কিনারে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে
প্রত্যাশী চাষীর মতো, আর থৈ থৈ হলুদ ধানের ক্ষেত যেন
চুম্বনের রেখাময় তার প্রিয়তমা দীপ্ত ভরাট কাগজ। পরক্ষণে
ধন্দ লাগে, বুঝি এ ফসল মৃত, পরিণামহীন।

ভোরবেলা কলমের ঘুম ভেঙে গেলে দেখে ভরাট কাগজে
মরা পোকা নয়, দু’টি নবীন নবীনা প্রজাপতি বসে আছে।
২৪.৩.৯৯

 কুরসিনামা

হায় কুরসি, হায় চেয়ার, এই চেয়ারের জন্যে কত
কুকুর-কাজিয়া কত খেয়োখেয়ি অতীতে দেখেছি,
হাল আমলেও দেখতে হচ্ছে। চেয়ারের প্রতি কোনও আর্কষণ
আমার ছিল না কোনও কালে। একবার আমার
ঢের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক’বছরের জন্যে বসতে হয়েছিল
মোটামুটি জাঁদরেল কুরসিত। হ্যাঁ,
তখন পদে পদে দেখতে হয়েছে চেয়ারের
কী মহিমা! কত লোককে আমার সামনে বসে
অথবা দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে দেখেছি, দেখেছি লোভের
লকলকে জিভের চমক-লাগানোর প্রদর্শনী,
আমার র্নিরর্থক ভুল প্রশংসার মালা গাঁথাবার
অপপ্রয়াস। জানতাম, আমি যে কুরসিতে সমাসীন,
তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলে সেই একই
লোকজন আমার মুণ্ডুপাত করে, কাদা ছিটোয় আমার নামে।

একদিন স্বেচ্ছায় আমি ত্যাগ করি জাঁদরেল
চেয়ারটিকে। কুরসিটি ছেড়ে এসেছিলাম বলে
মনে একরত্তি খেদ নেই। এখন আমি আমার ব্যক্তিগত
চেয়ার বিষয়ে বলবো, যে আমাকে এক যুগ ধরে
বসতে দিচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমার
একান্ত অনুরোধে যিনি চেয়ারটি তৈরি করিয়ে
এনেছিলেন আসবাবপত্রের দোকান থেকে,
তিনি এখন কবরে। ব্যক্তিগত চেয়ারটিকে দিকে চোখ পড়লে
কিংবা বসতে গেলে কালেভদ্রে ভদ্রলোকটির মুখ
মনে পড়ে । আমার এই চেয়ারটিকে খুবই ভালোবাসি।

চেয়ারটি ওর প্রাক্তন শ্রী অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে,
কেমন বিবর্ণ, অথচ সামর্থ্য তেমন
ক্ষুণ্ণ হয়নি, নড়বড়ে তো নয়ই। ধকল
ওকে কম পোয়াতে হয়নি, আজ
অব্দি হচ্ছে। এই ব্যক্তিগত চেয়ারের প্রতি প্রখর
আমার আকর্ষণ। সে আমার জীবনের
অপরিহার্য সপ্রাণ অংশ। ওর সঙ্গে কখনও
কোনও বিবাদ হয় না আমার, সখ্য এমনই প্রবল।

মনে পড়ে, মা যখন কখনও সখনও আমার
আপন এই চেয়ারটির আতিথ্য গ্রহণ
করতেন, বর্তে যেত সে, যেন পুষ্পিত উদ্যান,
ওর বিবর্ণ চেহারা উদ্ভাসিত হতো,
হাজার চেরাগের আলোয়। আমার এই চেয়ারে
অনেক মধ্যরাতে এসে বসেছেন দান্তে, শেক্সপীয়ার,
রবীন্দ্রনাথ, গ্যয়েটে, মধুসূদন দত্ত, শার্ল বোদলেয়ার,
এলুয়ার, চণ্ডীদাস, লালনশাহ, গালিব, জীবনানন্দ,
বসেছেন খুব দয়াপরবশ হয়ে। তাঁদের অমৃত সমান কত
কথা শোনার দুর্লভ সুযোগ হয়েছে
আমার চেয়ারের। কতবার প্রেরণাপরিত্যক্ত প্রায়
নিভু নিভু আমি জ্বলে উঠেছি শিখার ধরনে,
বন্ধ্যা কাগজ ভরে উঠেছে নানা চিত্রকল্প সংবলিত
পঙ্‌ক্তিমালায়, যখন খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি
ভালোবাসায়, আবদ্ধ হয়েছি নিবিড় আলিঙ্গনে। যখন
কখনও কখনও সে অচিমান করে, তখন আমি বন্ধ্যা মাটির স্তূপ।
১৯.১২.৯৯

 কেবলি হারিয়ে যাচ্ছে

নিরন্তর গলিত রূপোর স্রোত বয়ে যায় আমার ভেতর,
টের পাই। আমার শৈশব,
কৈশোর যৌবন নানা রূপে মিশে আছে
সেই স্রোতে; আমার অপটু
সাঁতার, বিস্তর ডুব, ভেসে-থাকা
আমাকে এখনও কিছুকাল কেমন মাতিয়ে রাখে, নিয়ে যায়
কে জানে কোথায় অজানায়। রঙিন দুপুর
বিষণ্ন গোধূলিবেলা, সন্ধ্যারাত গল্প জুড়ে দেয়।

নিরন্তর গলিত রূপোর ছোট ছোট ঢেউ এসে
আমাকে মসৃণ ছুঁয়ে যায়, যেন বন্ধুদের ছোঁয়া
কানামাছি খেলার সময়, ঢেউগুলি
খিলখিল হেসে ওঠে, আমার সুদূর কৈশোরকে
নাচায় অবাধ সুখে যেন। হঠাৎ হারিয়ে যায়
আমাকে পিছনে রেখে। আমি কি বেগানা তবে, হায়,
শৈশবের, কৈশোরের, যৌবনের নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়?
গলিত রূপোর স্রোত, আমার মিনতি রাখো, হারিয়ে যেও না।

মনে পড়ে, কখনও কখনও ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যারাতে
রূপবতী জলকন্যা, মুখ যার মানবীর, স্তনচূড়া আর নাভিমূল
থেকে যার শুরু হয় মৎস্যরূপ, দেখা দিয়ে চকিতে মিলিয়ে
যেত কারও নিরুচ্চার অথচ অপ্রতিরোধ্য নির্দেশে কোথাও
অজানায়। ঘাটে বাঁধা নৌকোগুলোর বাতিরা যেন
জোনাকির মতো দপ্‌ জ্বলে, নেভে।
আমার কেমন যেন মনে হয়, জলকন্যা চলে যাওয়ার পরে
একটি রূপোলি স্রোত, একটি ডাগর নদী এই শহরের
কেবলি হারিয়ে যাচ্ছে কতিপয় শহরবাসীর বেলাগাম লুণ্ঠনের,
রাক্ষুসে শোষণ আর তান্ডাবের ফলে।
আমার ভেতরে লুপ্ত গলিত রূপোর ধারা, কেবলি হারিয়ে
যাচ্ছে দ্রুত কবেকার রূপসী নদীর উচ্ছলতা।
১২.১২.৯৯

চলেই যেতাম

চলেই যেতাম;
আয়োজন ছিল ঠিকঠাক,
বেবাক নিখুঁতই বলা চলে।
তবে কোনও লটবহর ছিল না,
কিয়দ্দূরে জন্মদিন খুব মুখ ভার করে ছিল
দাঁড়ানো নীরবে এক কোণে,
যেন তাকে অতিশয় কালো মেঘ বানাবার লোভে
মরণের ফেরেশ্‌তা তার
হিংস্র হিম ডানা
সফেদ অপরিসর বেডে দিয়েছে ছড়িয়ে
চিৎ-হয়ে-থেকে অচেতন
আমার ওপর।

যেখানে যেতাম চলে কাউকে কিছু না বলে বড়ই নিশ্চুপ,
সেখানে, নিশ্চিত জানি, কেউ
নেই, কিছু নেই, আছে শুধু
অন্তহীন বোবা অন্ধকার, চির স্তব্ধতার হিম দীর্ঘশ্বাস।

আখেরে হয়নি যাওয়া। মিশকালো মেঘ
থেকে ঢের ধূসর মেঘের
আস্তরণ ভেদ করে ভাসতে ভাসতে
এক ঝাঁক তারা ছুঁয়ে, বিস্তর সাঁতার কেটে হ্রদে,
মেঘনা নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে গইন্তা ঘাটের
ভেজা মাটি ছুঁয়ে
শ্যামলীর শান্ত গলি, রাধাচূড়া নিমেষে দৃষ্টিতে পুরে নিয়ে
কী করে যে সিঙ্গাপুরে বিরাট আরোগ্য নিকেতনে
কাশফুল্প্রায় ধবধবে বেডে প্রত্যাবর্তনের
কোমল আরামে কিন্তু বেগানা ডেরায় ফিরে এলাম, বুঝিনি।

কী আনন্দ চেনা ভুবনে আমার ফিরে এসে
চোখ মেলে তাকাবার এদিকে সেদিকে। পুনরায়
ভোরবেলা তরতাজা মাখনের মতো রোদ, আকাশের নীল,
শ্যামলীতে আমার আপন ঘরে বইয়ের মিছিল, বারান্দায়
লেজঝোলা পাখি দেখে, নয়না, দীপিতা আর অন্তরের অজস্র চুমোর
স্বাদ নিয়ে, জীবনসঙ্গিনী, তিন কন্যা, পুত্র এবং টিয়ার,
ভাইবোন সকলের দৃষ্টিতে চিত্তের প্রস্ফুটিত ফুল আর
অন্তরতমার অনুপস্থিতির বিরানায়
গুণীর তানের মতো ণ্ডঞ্জরিত অস্তিত্বে আমার।

কোথায় আমার চেনা বলপেন? কোথায় লুকালো
অভিমানে? কোথায় রয়েছে পড়ে কবিতার খাতা?
প্লিজ, খঁজে এনে দাও কাছে-
ওদের সান্নিধ্য বড় প্রয়োজন আজ।
১০.১১.৯৯

চাঁদের বিকল্পের জন্যে প্রস্তাব

গোধূলিবেলায় চায়ের আসর বসেছে
পাঁচজন যুবকের। পাঁচ রকম বিষয় নিয়ে
চলেছে আলোচনা আর মাঝে মাঝে
টেবিলে চলে আসছে গরম সিঙাড়া আর
চায়ের সধূম পেয়ালা। আলোচনা, খাদ্য আর পানীয়
সবকিছুই উপভোগ্য ঠেকছে যুবাদের কাছে।

ইতোমধ্যে হরিণের পাটল-রঙ চামড়ার মতো
গোধূলি সন্ধ্যার কাজল রঙের সঙ্গমস্পৃহায়
সমর্পিত। কিছুক্ষণ পরে আকাশে পদ্মফুলের মতো ফুটে ওঠে
গোল চাঁদ। চায়ের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে
একজন যুবক বলল, ‘চাঁদের সৌন্দর্যের কথা এত
বিজ্ঞাপিত সারা বিশ্বে কবিদের কল্যাণে, এতে বিন্দুমাত্র
সন্দেহ নেই, তবু বলল, বড়ই একঘেয়ে, ক্লান্তিকর এই রূপ।
আমার ইচ্ছে হয়, একে ত্রিকোণ এবং বেশ
লাল রঙের আকার দিই’। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা
ঝুলে থাকে টেবিল।
দ্বিতীয় যুবক একটু কেশে জানায়, ‘আমার ইচ্ছে
অন্যরকম-আমি চাই চাঁদের বদলে
হংস-হংসীময় একটি হ্রদ তৈরি করতে। এই প্রস্তাব
মনঃপূত হলো না তৃতীয় যুবার, সে ঘোষণা করে, ‘চাঁদকে
চিরদিনের মতো অর্ধচন্দ্র দিয়ে সরিয়ে তার জায়গায়
সৃষ্টি করবো কম্পিউটারখচিত এক মনোহর চিত্র। চতুর্থ যুবক
সলাজ হাসির ঢেউ তুলে বলে, ‘না হে, তোমাদের কারও
পরিকল্পনা মনঃপূত হচ্ছে না। যদি আমার বাসনার খবর
জানতে চাও, তবে বলি, আমি চাঁদকে নির্বাসনে
পাঠিয়ে তার স্থলে আঁকবো আমার
সুন্দরীতমা প্রিয়তমার মুখ। এই পরিকল্পনা মানবিক
বিবেচনা করে সবাই মাথা নাড়লো।

পঞ্চম যুবা চায়ের পেয়ালায় চামচ নাড়ছিল
নিঃশব্দে, যেন বোবা সে। বাকি চারজন
তাকে ক্রমাগত খোঁচাতে থাকে ওর প্রস্তাব শোনার
উদ্দেশ্যে। পঞ্চম যুবক দৃষ্টি অস্পষ্ট দিগন্তের দিকে ছড়িয়ে
স্বগতোক্তির মতো বলতে শুরু করে, ‘চাঁদের জায়গায়
এক পাশে স্মারকচিহ্ন হিসেবে থাকবে সদ্য আবিষ্কৃত
একাত্তরের বধ্যভূমির একটি মড়ার খুলি, যার উপরে উড়বে
অগণিত প্রজাপতি। চাঁদ রূপান্তরিত হবে এক শান্তিবাগে,
যেখানে থেকে লড়াই-ফ্যাসাদ, সহিংসতা
নির্বাসিত হবে চিরতরে। থাকবে না সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা,
রক্তচক্ষু মৌলবাদীদের হাতিয়ারের হুঙ্কার। সেখানে
সগৌরবে বিরাজ করবে মনুষ্যত্বের জয়ধ্বনি।
১৫.১১.৯৯

জংলী ঘাস থেকে ইট কুড়িয়ে

ক’মাস আগে এক দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় মফিদুল হক
আর শাহরিয়ার কবির বেদনাদীর্ণ কণ্ঠে জানালেন
এক শহরতলিতে সদ্য আবিষ্কৃত একাত্তরের একটি নিঝুম
ছায়াঘেরা বধ্যভূমির কথা। সেখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া
গেছে অনেক গাড়গোড়, মাথার খুলি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের
তত্ত্বাবধানে অনুসন্ধান চলছে, বিকশিত হচ্ছে
ঐতিহাসিক নির্দয়তা

ঝকঝকে দুপুর নিমেষে অমাবস্যার রাত। আড্ডা
আর এগোয়া না, একটা নিস্তব্ধতা আমাদের স্থবির করেছে,
যেন আমরা স্বজনদের লাশের সামনে বসে আছি বাক্যহারা,
শোকের শেকলে বন্দী, দিশেহারা। সেদিন বিকেলেই কাউকে
কিছু না বলে রওয়ানা হলাম শহরতলিতে সদ্য আবিষ্কৃত
সেই বধ্যভূমির উদ্দেশে। যখন সেখানে বুনো গাছপালা এবং
একটি পুরোনো দালানের ভগ্নাংশের কাছে পৌছলাম, প্রগাঢ়
গোধূলি আমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করেছে প্রিয়তমার মতো।
ঝোপঝাড় বুনো আচরণ বিসর্জন দিয়ে ‘এসো এসো’ বলে খুব
ঘনিষ্ঠ জনের মতো ডাকে প্রফুল্ল স্বরে। পুরোনো দালানের
ভগ্নাংশ যেন প্রণতা হয় আমাকে বিশিষ্টতা অর্পণের জন্যে।
অদৃশ্য পায়রা-যুগলের প্রণয়দৃশ্য আমাকে মোহিত করে।

এক পা দু’পা করে এগোই ওদের দিকে। একটা
অচেনা পাখি মানুষের ধরনে কী কথা বলে প্রায় আমার কান
ঘেঁষে উড়ে যায়। পুরোনো দালানের ভাঙাচোরা কঙ্কাল থেকে
হঠাৎ এক তরুণ কণ্ঠ কখনও আবৃত্তি করছে কাজী নজরুল
ইসলামের ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার হে’
কখনও জীবনানন্দ দাশের ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি
এই বাংলার পারে রয়ে যাবো। সেই পুরোনো দালানের ভাঙাচোরা
ইটে মাথা খুঁড়ে মরলেও সেই তরুণ কণ্ঠস্বরের অধিকারীকে
কোথাও খুঁজে পাবো না। জংলী ঘাস থেকে ইট কুড়িয়ে
নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে আসে অর্ধশতাব্দীর প্রবীণ,
ছোট দালানের ভগ্নাংশ থেকে এক তরুণী-কণ্ঠের মেদুর
রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/…
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-/ তখন আমায় না-ই বা মনে
রাখলে/তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে

সেই নাম-না জানা তরুণীকে নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে
তাকিয়ে আমার গ্লুকোমা-পীড়িত দৃষ্টি ভয়ানক অন্ধকার
হয়ে গেলেও তার নাম আমি জানব না কোনওদিন। তার
পায়ের চিহ্ন সেই কবে মুছে গেছে, হায় হানাবাড়িসদৃশ এই
নিশ্চিহ্নপ্রায় দালানের সব জায়গা থেকে, পাছদুয়ার কিংবা
সামনের মধ্যবিত্ত, বিনীত উদ্যান থেকে, কলেজে যাওয়ার
সরু পথ থেকে। ভাবতেই ইচ্ছে হলো না সদ্য আবিষ্কৃর
বধ্যভূমির হাড়গোড় এবং কয়েকটির মধ্যে রয়েছে
সেই তরুণীর মৃত অস্তিত্বের বিকৃত আদল। অথচ
আমার ভাবনাকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না নির্দয় সত্য!
২১.১১.৯৯

জন্মন্ধ পাতালে

তুমিতো বাঁচার মন্ত্র জপেছিলে প্রাণের গভীরে,
চেয়েছিলে সাজাতে জীবন
সুন্দরের অনুপম নীড়ে। শরীরে বসন্তরাগ
স্পন্দিত নিদ্রায়, জাগরণে, নিঝুম পূর্ণিমা ছিল।

তরুণী, তোমার শরীরের বাগানের
কায়েমি দখলীস্বত্ব চেয়েছিল কদাকার কেউ, প্রশ্নহীন
পিতার সম্মতি দ্রোহী করে তোলে বড় তেজী
তোমাকে এবং হলে ঠাঁইনাড়া।

অনন্তর আটজন স্বেচ্ছাচারী অস্ত্রবাজ যুবার লালসা
তোমাকে লোপাট করে নেয় রাজপথ
থেকে চারতলা কলোনির বিদঘুটে অন্ধকারে। রিরংসার
লকলকে জিভের পিপাসা মিটল না বলে ওরা
সজীব বসন্তরাগ আর পূর্ণিমার থৈ থৈ প্রতিরোধী
শরীরকে হিংস্র ক্রোধে দিল ছুড়ে জন্মন্ধ পাতালে।
২১.৩.৯৯

ডাইনোসর উঠে এলেও

আমি তো মাঝে মাঝে বাইরেই যেতে চাই,
অথচ ঘর আমাকে আটকে রাখে।
ঘরে বসে আমি দেখতে পাই
এক চিলতে আকাশ, নীলিমার বিশালতা
দৃষ্টির আগোচরে থেকে যায়। কখনও সখনও একটি কি
দু’টি পাখি চোখে পড়ে। পাশের বাড়ির
জানালার ওপরের কার্নিশে
যুগল পায়বার কোমল প্রণয় আমাকে মুগ্ধ করে,
কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক পাখি কি গোধূলি বেলা
নীড়পরায়ণ পাখির পঙ্‌ক্তিমালা
আমার উৎসুক দৃষ্টির আওতার
বাইরে রয়ে যায় মাসের পর মাস।

এ যেন নিঃসঙ্গ বন্দীর ক্লান্ত, দম আটকানো সুদীর্ঘ
প্রহর কাটানো, কিংবা তীব্র সাইনাসের
দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরুদ্ধকর বেহাল অবস্থা,
মাথার ভেতর ভীমরুলের অশেষ চক্কর। কখনও
মনে হয়, মাথার ভেতর, নাকে মুখে সূচালো কিছু ঘাস
গজিয়ে উঠেছে। জোরে জোরে ডেকে চলেছি,
কিন্তু কোনও শব্দই বেরুচ্ছে না। কণ্ঠনালীতে
মুঠো মুঠো বালির খসখসানি। আবার মুমূর্ষু দিনান্তে
দুটো চোখই আচ্ছন্ন হয়
মৃত কুয়াশায়; আক্রান্ত হই হঠাৎ
কতিপয় কঙ্কালের অদ্ভুত হিংস্রতায় এবং
ওরা আমাকে বাধ্য করে আমার নিজেরই রক্ত চেটে নিতে।

দুঃস্বপ্ন এবং বাস্তবের মধ্যে কোন্‌টি প্রকৃত সত্য, এ নিয়ে
কী-যে ধন্দে পড়ে যাই, বোঝানো খুবই মুশকিল।
এই যে আমি আটকে আছি গুহাসদৃশ ঘরে,
নিঃশ্বাস নিতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে আমার-
শরীরে বিষাক্ত কাঁটা ফুটছে, চোখের ভিতর
ঢুকছে ঝাঁক ঝাঁক লাল পিঁপড়ে, মেরুদণ্ড কারা
যেন উপড়ে নিতে চাইছে বাঁকা, আগুন-তাতানো
শিক দিয়ে। কী এমন অপরাধ করেছি যে, সবাই
এরকম শক্রতা সাধতে উন্মুখ? অথচ
বন্ধ্যা মাটি আমি উদ্যান বানাতে চেয়েছিলাম,
বালুময় জমিনে ফল্গুধারা
বইয়ে দেয়ার শপথ নিয়েছিলাম সুর্যোদয়ের
দিকে মুখ রেখে। নিজেকে শুদ্ধতার
আভায় ভাস্বর করার আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার।

কতিপয় মাংসাশী পাখির অন্ধকার-ছড়ানো
পাখার দাপটে অথবা এক পাল জন্তুর
তাণ্ডবে হকচকিয়ে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে খুরপি আর
কোদাল চালানো থামিয়ে দেবো? বাগান বানানোর
কাজ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো
সত্তায় হতাশায় কালো মেখে? ধূসর মাটি ফুঁড়ে
ডাইনোসর উঠে এলেও আমি পুষ্প বিকাশের
বীজ বপন করে যাবো কোনও সর্বনাশের তোয়াক্কা না করেই।
৩০.১২.৯৯

 তবে কি বাতিল, পরিত্যক্ত?

হানাবাড়ি নয় কিংবা উৎকট ওষুধগন্ধী মর্গও নয় কোনও
তবু কেন লাশকাটা ঘরের আদল ফুটে ওঠে? শ্যামলীতে
আমার আপন ছোট ঘরও এটি নয়, তবু কেন
আমার মতোই কেউ এই মেঘাচ্ছন্ন গৃহকোণে
মেঘের শয্যায় শুয়ে আছে প্রায় নিথর নিষ্প্রাণ?
দু’চোখের পাতা বোজা মাঝে মাঝে কাঁপে শুকনো ঠোঁট।

তবে কি বাতিল, পরিত্যক্ত এ লোকটা, মানে আমি?
কী আমার অপরাধ? এই তো যে ফেরেশ্‌তার আধিপত্যছুট
সুর আমি মানুষের কণ্ঠে
দৈব কণ্ঠস্বর নিয়ে আমার অক্লান্ত সাধনায়
বড় বেশি মেতে উঠেছিলাম যৌবনে, এমন কী প্রৌঢ়ত্বের
প্রখর প্রহরে। দুর্বিনীত আকাঙ্ঘা আমার বুঝি
সবুজ চোখের ঈর্ষাপরায়ণ ফেরেশ্‌তাকে খুব অপ্রসন্ন
করেছে বলেই আমি কণ্ঠস্বর প্রায় হারিয়ে নিঃশব্দ, রুক্ষ
কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। যতই জাগাতে চাই
কণ্ঠস্বর, কণ্ঠনালী তুষারের অজস্র কণায় ঢেকে যায়।

কী নিঃসাড়, নির্বাসিত মনে হয় ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে আমার।
এমন দুঃসহ একা কখনও লাগেনি আগে, যেন
কেউ নেই, অদূরে অস্পষ্ট কয়েকটি ছায়া নড়ে চড়ে না কি?
চোখ খুলি, চোখ বুজি, কবিতার পঙ্‌ক্তি
স্মরণে আনতে চাই। সব হিজিবিজি
মনে হয়। দ্বিপ্রহরে বিশ্রাম হেলায় ফেলে, বুকের শোণিত
পানি করে
অগণিত রাত্রিকে বানিয়ে ভোর লিখেছি কত না পদাবলী,
অথচ এখন এই ঘোর তমসায় কেউ আসছে না আমার নিকট,
দিচ্ছে না বুলিয়ে হাত কপালে অথবা অনুরাগে
আমার তৃষিত ওষ্ঠে চেপে ধরছে না ঠোঁট, শুধু
দূরে অন্ধকার গায়ে মেখে উড়ে উড়ে চলে যায়
সম্ভবত ঈর্ষান্বিত ফেরেশ্‌তার ভয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় আমার
অবসন্ন, মুমূর্ষ দুর্দশা দেখে। মনে হয়, শুধু
আমার প্রথমা কন্যা আর তার কর্মিষ্ঠ জীবনসঙ্গী ঝুঁকে
আছে এই শীর্ণ, প্রায় নিশ্চেতন অস্তিত্বের দিকে অসহায়
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে। দূর থেকে ক’জন ফেরেশ্‌তা, যারা দৈব
কণ্ঠস্বর হয়ে স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে বাতিল চিঠির মতো, অট্রহাসি
আমার সকল কাব্যগ্রন্থকে পাঠায় নিরুদ্দেশে?
১৪.১১.৯৯

তিমিরবিনাশী একজন

বস্তুত তিমিরবিনাশের ব্রত ছিল আজীবন
তার, বুঝি তাই মুখে আর
কলমের ডগায় ঝরাতো নিত্যদিন
আলোর অদম্য ঝর্নাধারা। নিজস্ব প্রাপ্তির কোনও মরীচিকা
বিভ্রান্ত করেনি তাকে কস্মিনকালেও। অন্তরের
দীপ্ত স্রোত দুর্নিবার টানে তাকে পৌছে
দিয়েছে নির্ভুল সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের খুব কাছে। সাধনার
পথে সে থামেনি বেশুমার প্রেতযোনির তাণ্ডবে।

তিমির লালন করে যাদের এবং যারা তিমিরের
হিংস্রতার উপাসক, তারা
তাকে হননের ক্ষিপ্ত অভিলাষে মেতে পাশব উন্মত্ততায়
যূপকাঠে ঠেলে দেয়। তিমিরবিনাশী
উদার প্রদীপ্ত প্রাণ রক্তাক্ত, নিস্পন্দ পড়ে রয়
নিশ্চতন, নির্বাক ধুলোয়।

তিমিরবিনাশী লোকটার বাসগৃহে বেধড়ক
অন্ধকার নেমে আসে, গৃহিণীর বুক চিরে ওঠে
বেদনা, কান্নার রোল। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধগণ
স্তম্ভিত, শোকার্তে, অতঃপর খবরের কাগজে বিশাল
শিরোনাম, ফটোগ্রাফ, বক্তৃতা, বিবৃতি, প্রতিবাদী
মিছিলের ক্ষুব্ধ ঢেউ নানা স্থানে। আখেরে সুস্থির
নীরবতা সবখানে। শুধু শব্দ সাধকের গৃহকোণে
মাঝে মাঝে চাপা কান্না, খেলায় নিমগ্ন তার তিন বছরের
পৌত্রীর কোমল গালে রৌদ্রছায়া নাচে আর তিমিরবিনাশী
লোকটার বিপন্ন বিধবা সংসারের অন্ধকারে আলো খোঁজে।
১৭.২.৯৯

তুমি যে বড়ই একা

আবেদ খান প্রিয়বরেষু

তুমি যে বড়ই একা, চাদ্দিকে প্রেতের আনাগোনা-
বুঝতে পারো কি? যতদূর জানি, ওরা
অভিন্ন ধাতুতে নয় গড়া; তবু একই ঘাটে এসে
জুটেছে চকিতে কিছু অঘটন ঘটাবার সাধে।

তোমাকে সতর্কবাণী শুনিয়েছি বারবার, অথচ কদাপি
কথায় পেতেছ কান। দেখলে না এখানে সেখানে
কত ফাঁদ পাতা আছে আর চোরাগোপ্তা হামলায়
নন্দি-ভৃঙ্গিগণ বিলক্ষণ নিত্য হাত
পাকায় সোৎসাহে। হায়, যতই ওদের
মিত্র বলে আলিঙ্গন করো দুই বেলা, তোমাকে পাঠাবে ঠিক
মজা পুকুরের তলে। তুমি নিম বামে হাঁটো, ওরা
অতি ডানে সর্বক্ষণ। সামনেই চোরাবালি প্রতারক শান্তি
নিয়ে আছে বেখেয়াল পথিককে গিলে খেতে নীরব ক্ষুধায়
দিনরাত। কে অজ্ঞাত জল্লাদ তোমার কাছে পাঠায় মিত্রের
কাটামুন্ডু পুরোনো সংবাদপত্রে মুড়ে ঘোর অমাবস্যা রাতে
এবং তোমার শোক বোবা আর্তনাদ।

তুমি যে বড়ই একা, নানা দিক থেকে ধেয়ে আসে
অগ্নিবাণ, কোথায় বাড়াবে হাত উদ্ধারের দড়ি
দৃঢ় হাতে ধরবার আকাঙ্ক্ষায় আজ
পড়ন্ত বেলায়? জানি তোমারই আসরে
উদার নিয়েছ ডেকে বহুরূপী ইয়ারবক্সিকে; দেখছ না
তোমার গলায় মালা দুলছে কেউটে হয়ে উচ্ছুসিত গোধূলি বেলায়?
ঢের প্রতীক্ষার পর, বহু শ্রমক্লান্তি সয়ে এই
আসন পেয়েছ তুমি ঢের ডামাডোল, অন্ধকার
উজিয়ে, অথচ দেখ তোমাকে আসন ছাড়া করবার সাধ
মানের পানির মতো খলখল করে
তাদের বিচিত্র মনে, ঊর্ণাজাল বোনা হয় টেবিলে বৈঠকে।
তুমি যে বড়ই একা, হে বান্ধব, ব্যূহের ভেতর। এই ব্যূহ
ভেদ করবার মন্ত্র ভুলেছ কি ব্যাপক সন্ত্রাসে? অতীতের
প্রেতগুলি তোমার স্বপ্নের বুকে বেজায় দিয়েছে জুড়ে নাচ।
২২.৩.৯৯

তোমার কাছ থেকে

মা, মা আমার, মা গো, কতদিন তোমার
কবরের কাছে যাই না আমার আশৈশব
সকল স্মৃতিকে আবৃত্তি করার উদ্দেশ্যে,
আলিঙ্গন করার জন্যে। এই আবৃত্তি, এই আলিঙ্গনের
আকাঙ্ক্ষায় আমার সামান্য পুঁজি উজাড় করে
বাঁধিয়েছিলাম তোমার নশ্বর অস্তিত্বের অন্তিম
আশ্রয়, যে অস্তিত্বের কপাল আর হাত ছুঁয়ে
পা দু’টি চুম্বন করে শান্তি পেয়েছি বহুবার।

আম্মা, অথচ কতদিন যাই না কবরস্থানে। কখনও
বৃষ্টিবাদল, কখনও নিহত হওয়ার আশঙ্কায়,
কখনওবা কুকুরের জিভ-বের-করা দৌড়ের মতো
ব্যস্ততা, হায়, তোমার অযোগ্য পুত্রের নিরর্থক, শোচনীয়
ব্যস্ততা আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। তোমার কবরের
পাশে এসে কিছুক্ষণ শান্তি লাভের সিদ্ধান্ত
কতবারই না ভেসে গেছে বানের খড়কুটোর মতো। নিশ্চিত
জানি, তোমার ভেতর জীবনের স্পন্দন থাকলে, কখনঅ
নারাজ হতে না তুমি, বরং হাত নেড়ে বারণ করতে
তোমার অসীম আদম যত্নের বাচ্চু’র কষ্ট হবে ভেবে।

মা, ধিক আমাকে, বৃক্ষ রক্ষার মিছিলে দাঁড়ানো, সকল
সন্ত্রাসের বিপক্ষে উচ্চস্বরে আমার প্রতিবাদ জানানো,
সদ্য মসজিদ সংলগ্ন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা
একাত্তরের ঘাতক দালালদের নির্যাতিত
নারী-পুরুষের কঙ্কাল, করোটি, হাড়গোড়,
শিশুর হাতের মৃত্তিকা-দংশিত রুলি, কাপড়-চোপড়,
কত অশ্রুত, রক্তাক্ত হাহাকার, আর্তনাদ, তুরস্কের
ভূমিকম্পের হাজার মানব-মানবীর
জীবন্ত কবর, হিরোশিমায় মানুষের বিরুদ্ধে
মানুষের প্রধান, ভয়ঙ্কর সংহারতাণ্ডব,
আজও যা শিরায় শিরায় বইয়ে দেয় শৈত্যপ্রবাহ-
আম্মা, তোমার সুন্দর, নিরীহ কবরের কাছ থেকে তোমার
অপদার্থ সন্তানকে কেবলি দূরে সরিয়ে রাখছে। মা গো,
আমি আমার অপরাধের এই পাহাড় কোথায় লুকাবো?
২৪.০৮.৯৯

তোমার চোখে স্বর্গ কাঁপে

এইতো অতি নিকট কালেও তোমার কাছে
ছুটে যেতাম নেচে ওঠা হৃদয় নিয়ে
হরহামেশা প্রীতিঘেরা এক নিবাসে।
তোমার পায়ের পাতা পড়তো আমার ঘরে,
ফুল্ল আমার হৃদয়পুরে।
তোমার দীপ্তি হাসির ছটায় স্টাডি আমার
প্রায় রোজনা ক্ষণে ক্ষণে
হতো নিবিড় উদ্ভাসিত।
তোমার স্নিগ্ধ চোখ-জুড়ানো রূপের জ্যোতি
পথ দেখাতো রুক্ষ এবং হিসহিসে সব অন্ধকারে।

কিছুকালের মধ্যে যেন একটি দেয়াল
উঠল গড়ে কার খেয়ালে,
তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না একটি দিনও
আমার ডেরায়, তুমি ভীষণ দূরে থাকো।
তোমায় দেখার তৃষ্ণা আমার বালির ঝড়ে,
তোমার নানা বিরূপতায় পায় যে আরও প্রখরত।
তবু তোমার পাই না দেখা কোনও মতে,
প্রেত-প্রেতিনী আমার মনের কবর থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে
হিঁচড়ে আনে ক’খানা হাড় মাথার খুলি।
পচা গন্ধে বমি আসে, মুখ ফিরিয়ে দিই উগরে কিছু স্মৃতি।

ভয়-দেখানো অনেক ছায়ার ভূতুড়ে সব খেলা দেখে,
শ্যামল ছায়ার বাগানজোড়া পুষ্পশোভার স্মৃতি এখন
নতুন করে বাঁচার তীব্র ইচ্ছেদ্যুতি আমার মতো
হৃদরোগীকে মাতাল ছন্দে নাচিয়ে তোলে বারংবার।
তোমার নরম হাতের ছোঁয়া আমার শিরায়
ফসলভরা নৌকা ভাসায়, নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন
জাগায় গুণীর জ্ঞানের মতো এবং দেখি
আমার মদির আলিঙ্গনে তোমার চোখে স্বর্গ কাঁপে।
২৪.১১.৯৯

ত্রঁদো ডোবা থেকে সামুদ্রিক মোহনায় যিনি

মহীয়সী সুফিয়া কামাল স্মরণে

আপনি প্রথম চোখ খুলে
পাড়াগাঁর আঁধার আঁতুড়্ঘরে দেখলেন না-জানা সামান্য
বস্তু কিছু। আপনার রাঙা
ক্ষুদে অস্তিত্বের নম্র রূপ নিমেষেই
কেড়েছিল মন সকলের। আপনার জন্মলগ্নে
কানের ভেতরে কোরানের সুরধরা যে মুরুব্বি তার
বিশ্বাসের দৃঢ়তায় বইয়ে দিয়েছিলেন, সেই সুর জেগেছিল
আপনার শেষ
চেতনাস্পন্দিত প্রহরেও, মনে হয়। ছিল না কি?

পাড়াগাঁর শ্যামনিমা, মধুর গোধূলি, জ্যোৎস্নারাত,
নদীর চঞ্চল ঢেউ, ঝোপঝাড় আপনার প্রিয় ছিল খুব।
যৌবনের ঊষালগ্নে সৌন্দর্যসন্ধানী দু’টি চোখ ঢাকা পড়ে
বোরখার আড়ালে, অথচ ব্যর্থ হয়
আপনার অন্তর্দৃষ্টি মুছে দিতে বোরখার কৃষ্ণ স্বৈরাচার। বাঙালির
ঘরে স্মিত ভূমিষ্ঠ হয়েও বহুদিন
মাতৃভাষা বনবাসে গেছে, উর্দুচর্চা
ছিল বটে আবশ্যিক! আপনি লুকিয়ে মাতৃভাষা
জপেছেন ক্ষণে ক্ষণে, গোপনে ফুটিয়েছেন রূপ
তার কিছু খাতার পাতায়। সেই থেকে
সাঁঝের মায়ার বীজ ক্রীড়াপরায়ণ
কিশোরীর ধরনে দিয়েছে উঁকিঝুঁকি।

নিজ গাঁয়ে প্রকৃতির বরিশালী রূপে অতিশয় মুগ্ধ হয়ে
কেটেছে জীবন কিছুকাল, বরং পশ্চাৎপদ পাড়াগাঁর
ছমছমে অন্ধকার মাথা কুটে মরেছে, পারেনি
কিছুতে দখল করতে আপনাকে কোনও ছলেবলে। ফুঁসে উঠে
এঁদো ডোবা আপনার যাত্রার উদ্যোগে ক্রুদ্ধ হয়ে
চেতনার দৃপ্ত ভেলা ভাসিয়েছিলেন ঝড়ক্ষুব্ধ
নদীতে, ভীরুতা আর সংকোচের বাধাগুলি গেছে উড়ে দূরে
দুরন্ত হাওয়ায় আর ভেলা ভিড়ে গেছে প্রগতির সামুদ্রিক
মোহনায়।
২২.১১.৯৯

দাঁড়ালে টলতে থাকি

দাঁড়ালে টলতে থাকি, খানিক হাঁটতে
চেষ্টা করলেই রুক্ষ ধূসর ধুলোয়
স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ি, আবার কখনও
খাবি খাই
থকথকে কাদায়, এখন
আমার এমনই হাল। শক্ররা চৌদিকে
ফেটে পড়ে ঠা ঠা অট্রহাসিতে এবং বন্ধু বান্ধব বেজায়
মনোকষ্টে ভোগেন আমার অবাঞ্ছিত
এ দুর্দশা দেখে।
লজ্জায় কুঁকড়ে থাকি, নিজেকে লুকোতে ইচ্ছে করে,
যেমন আহত জন্তু খোঁজে অন্ধকার গুহা। এই শারীরিক অক্ষমতা
জানিনা ভোগাবে কতদিন, কতকাল
আমাকে রাখবে ফেলে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হিংস্র
ঘোর অমাবস্যার দখলে। কারও করুণার পাত্র
হয়ে থাকা, বুকে হেঁটে পথ চলা, ব্যথিত দু’চোখে
তাকানো, কম্পিত ঠোঁটময়
করুণ অথচ তুচ্ছ আবেদন নিয়ে বেঁচে থাকা
আত্মায় গ্লানির ছাপ সেঁটে নিত্য হামাগুড়ি দেয়া
কেবল আপনকার মাংস নিজ দাঁতে ক্ষিপ্র ছেঁড়ারই শামিল।

যখন ভোরের আলো চুমো খায় আমাকে এবং
পূর্ণিমা সপ্রেম করে আলিঙ্গন
আমার ক্ষতের ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলো খসে যায়, কোথাও সরোদ
সুর বোনে, আমার সত্তার ঘটে রূপান্তর, আমার নমিত
কেশগুচ্ছ হয়ে ওঠে স্যামসনের কেশর এক লহমায়-
এবং মশকরা প্রিয় লোকজন পালাবার পথ খুঁজে মরে।
২.১.২০০০

দূর থেকে

দূর থেকে দেখা যায় সকল ঋতুতে
শহরের নাক উঁচু প্রান্তিক পাড়ায়
একটি দোতালা বাড়ি রূপসীর মতো নিরিবিলি
দাঁড়ানো বছর তিন। সে বাড়ির বাশিন্দা খুবই ছিমছমা
একটি যুগল, নাম উহ্য থাক, বর বধূ বটে। প্রায়শই
বেড়ায় মোটরকারে এদিক সেদিক
কখনও পার্টিতে যায়, ঘরে ফেরে মধ্যরাতে, বেঘোর ঘুমায়
একই বিছানায়।

সে বাড়িতে নীরবতা জুড়ে রয় প্রায় সারাক্ষণ,
সেখানে শোনে না কেউ শিশুর রঙিন কলরব
কোনওদিন। শুধু দু’টি শাদা খরগোশ, ভোরবেলা
অথবা বিকেলে খেলা করে বাড়িটার
পেলব সবুজ লনে। খরগোশ যুগল রোদ্দুর
আর ছায়া মেখে নেয় অস্তিত্বের ভাঁজে।

কলহের রেশ কেউ কখনও পায়নি টের। পরিচারিকার
মুখ থেকে খসেনি ওদের বিবাদের
কথা ও কাহিনী কোনও। তবু কেন একদিন বধূটি মর্গের
টেবিলে নিঃসাড় পড়ে থাকে গাঢ় অন্ধকারে?
অথচ নিবাসে তার খরগোশ যুগল সানন্দ খেলা করে
রোদ্দুর চুম্বন করে বাড়ির সবুজ লনটিকে।
১১.১২.৯৯

দূরত্ব

এ এক এমন কাল, অন্ধকার কালো হতে কালোতর হয়ে
কালোতম হয়ে যায়। দূরত্ব কেবলি বেড়ে যায় ক্রমান্বয়ে
মালী আর গোলাপের মধ্যে। উদাসীনতায় উদ্যানের শোভা
আজ পলাতক আর পুষ্পবিকাশের
আয়োজন ভয়াবহভাবে লোপ পায়
কাঁটাগুল্ম আর বুনো ঘাসের তাণ্ডবে।

আমিও ছিলাম মালী অপরূপ এক বাগানের। এখন সে
উদ্যান এবং
দণ্ডিত আমার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা হামাগুড়ি দেয়
শজারুর ধরনে, দেখছি ক্রোধী ভীমরুল আর বিষপোকা
কী দ্রুত ক্ষইয়ে দিচ্ছে ফুলের যৌবন, নিচ্ছে লুটে
প্রবল সন্ত্রাসে নিরুপমা বাগানের
স্মিত, স্নিগ্ধ রূপ আর আমার নিজেরই
প্রবেশাধিকার নেই, দূরত্ব বিপন্ন করে এই আমাকেই।

বসে থাকি চুপচাপ আপন ঘরের
চেয়ারে প্রায়শ, নিঃসঙ্গতা বয়ে যায়
আমার অস্তিত্ব তীব্র ছুঁয়ে, উপরন্তু বারবার
নির্দয় নির্ঘুম রাতে যখন ঝিমুনি আসে, কিছু
বিকট বীভৎস মুখ, লাশকাটা ঘরের গুমোট,
খুব ঠাণ্ডা বিভীষিকা নেচে ওঠে, কারা যেন আমাকে বল্লমে
খোঁচাতে খোঁচাতে অন্ধ, হাহাকারময়
কোনও বধ্যভূমিতে পশুর মতো দ্রুত নিয়ে যায়।

চতুর্দিকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেও
কেন জানি অকস্মাৎ অবচেতনের
মেঘালয়ে অভাজন আমার ভেতরে একজন,
যে আমার অন্তর্গত কেউ,
‘আনন্দ, আনন্দ’ বলে ফুলের নীরব উন্মীলন,
মানবীর অলোকসামান্য রূপ, জেদী প্রবীণের
বেঁচে থাকবার দীপ্র সংগ্রাম, শিশুর স্নিগ্ধ হাসি,
জ্যোৎস্না চমকিত সরোবর দেখে জেগে ওঠে আজও।
২২.৪.৯৯

নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি

আজকাল লোকজন কি আমার দিকে
করুণার ভঙ্গিতে তাকায়? আমার অস্তিত্বের
সকল অংশ জুড়ে ক্ষয়ের ক্ষতচিহ্ন এবং
অসাফল্যের ছেঁড়া ন্যাকড়া দেখে নাকে রুমাল চেপে ধরে?

ঠিক বুঝতে পারি না, কখনও মনের বিভ্রম
ভেবে নিজেকে সান্ত্বনার ছায়ায়
জিরোবার সুযোগ করে দিই । আবার কখনও
কারও ছদ্মবেশী সহানুভূতি এবং লুকানো অট্রহাসি
বিষাক্ত কাঁকড়ার মতোই কামড়ে ধরে আমাকে।
তখন কৃতার্থ হওয়ার অভিনয় করার গ্লানি সইতে হয় বলে
ধুলোয় মিশে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চকিতে
কে যেন আমাকে নাইয়ে দেয় আশ্চর্য রূপালী ধারায়
আর আমি নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।

এক আশ্চর্য পথ চলা আমাকে এগিয়ে নিয়ে
যেতে থাকে ক্রমাগত টুকরো টুকরো পাথর, রক্তপায়ী
কাঁটা জটলা পাকানো বৃশ্চিক কোনও কিছুই
আমার এই নিঃসঙ্গ ভ্রমণের পথ রোধ
করতে পারে না, নিষ্ঠুরতা যত প্রবলই হোক, ভ্রূক্ষেপহীন
এই আমি নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।
ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় ধাপ্পাবাজরা
নিরন্তর ধাপ্পা দিচ্ছে, দিক;
ষড়ঋতুতে সন্ত্রাসের দাপট বাড়ুক;
খোলা রাস্তায় হন্তারকেরা হাতিয়ার শানাচ্ছে শানাক;
মনীষার প্রোজ্জ্বল সৌধগুলি ধসে যাচ্ছে যাক;
তবু ঘোর অমাবস্যায়
অস্তিত্বে অজস্র ক্ষত এবং ক্ষয়চিহ্ন নিয়ে
এই অদম্য আমি নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।
৯.১২.৯৯

নাকি শুধু হিমযুগ

তাকে কি নিশুতি রাত ডেকেছিল? নাকি সমুদ্রের
তরঙ্গের ধ্বনি তার কানে ঢেলেছিল
জলকন্যাদের কোনও মোহময় গান?
নইলে কেন শহুরে বাড়ির সুসজ্জিত বড় ঘরে
কাউকে কিছু না বলে মধ্যরাতে কেমন নিশ্চুপ
নিঃসাড় শীতল হয়ে গেলেন হঠাৎ?

আঙুলের ফাঁকে ছিল আধপোড়া, নেভা সিগারেট,
টিপয়ে ফতুর গ্লাশ, ঈষৎ কুঞ্চিত নিরুপায়,
রাতের পোশাক গায়ে। নানান হুইস্কি ওয়াইন,
ভদকা, বীয়ার ইত্যাদির সারি সারি
সাজানো বোতল ছিল মাথার ওপারে-
পারেনি বাড়াতে ওরা সাহায্যের হাত তার দিকে,
এরকমই নৈর্ব্যক্তিক সহচর তারা।
বাড়ির বাশিন্দা যারা তারাও নিদ্রা
সাগরে ছিলেন ডুবে, কিছুতেই পাননি টের তার
প্রস্থানের নিঝুম প্রহর।

বিবাহিত সেই পুরুষের পুত্রেরাও বিবাহিত, কেউ কেউ
সন্তানের পিতা আর উপার্জনক্ষম।
নিশ্চুপ গেলেন যিনি গভীর নিশীথে,
সমর্থ শরীরে তার মিশেছিল গৃহিণী ছাড়াও
ভিন্ন নারীদের স্বেদকণা দিব্যি রমণের কালে। প্রকৃতই
সংসারে ছিলেন সুখী, নাকি
ভীষণ অসুখী-
বোঝা ছিল দায়। তার ঠোঁটে অনেকেই
দেখেছে হাসির রেখা খেলে যেতে বহুবার আর
প্রিয় বন্ধুমহলে আমুদে লোক বলে ছিল খ্যাতি।

যখন গেলেন তিনি অকস্মাৎ, তখন দু’চোখে তার কোন্‌
দৃশা উঠেছিল ভেসে? ভেসে উঠেছিল,
গৃহিণীর মুখ? কোনও সন্তানের মুখ?
তাকে কি অন্তিম ক্ষণে খুব আলোড়িত
করেছিল কোনও বান্ধবীর চুম্বনের স্মৃতি? নাকি
এসব কিছুই নয়, শুধু হিমযুগ এসেছিল নেমে চোখে?
৩.১.২০০০

নিজেকেই প্রশ্ন

ঢের হৈ চৈ, শোরগোল, হুটোপুটি হল। কনুইয়ের
গুঁতোগুতি, পা মাড়ানো কস্মিনকালেও
হয়নি আমাকে দিয়ে। অবশ্য করেছি
ছুটোছুটি সভায় মিছিলে, আর রক্তাক্ত পা নিয়ে
ফিরেছি আপন ঘরে পরিশ্রান্ত। বলেছেন কতিপয় গুণী,
সেসব ছিল না কাজ কখনও আমার। চুপচাপ
ঘরে বসে বই পড়া এবং কবিতা লেখা নিয়ে
ডুবে থাকাটাই
বস্তুত আমার কাজ, একথা জপিয়েছেন তারা। তবু আমি
সেসব কথার ভ্রমরকে দূরে ঠেলে অশুভের
প্রতিবাদে হাত তুলে আকাশের দিকে
প্রোজ্জ্বল মিছিলে দৃঢ় হাঁটি অদ্যাপিও।

এখন কি খুব ক্লান্ত আমি? ফুরিয়ে এসেছে দম?
সময়তো বেশি নেই। অপরাহ্নে খানিক জিরোনো প্রয়োজন,
পাখিদের সতেজ গমের দানা খেতে দিয়ে সকালে বিকেলে,
কাঠবিড়ালির খেলা দেখে, কখনওবা চুপচাপ
বসে থেকে নিখাদ শান্তিতে
সময় পোহানো আর নতুন কবিতা লেখা পুরোনো খাতায়
বড় কাঙ্ক্ষণীয় মনে হয়। টলটলে স্তব্ধতাই
চাই আজ, অথচ কোথায় শান্তি, কোথায় স্তব্ধতা?
২৪.৩.৯৯

 নিজের জীবন নিয়ে

নিজের জীবন নিয়ে বড়ই বিব্রত আছি, কত কিছু
ঘটে যাচ্ছে চারদিকে, কোনওখানে নেই
আমার কোনই নিয়ন্ত্রণ; এমনকি
নিজের সংসারটিকে গোছাতে পারিনি ঠিকঠাক। রয়ে গেছে
বেশ কিছু ফাঁক, কিছু ফাঁকি; পুত্র করেনি অর্জন
কোনও বিদ্যা, বয়সতো কম নয়, দু’কন্যার পিতা,
অথচ সংসার-নীড়ে খড় কুটোটাও
যোগতে সর্বদা ব্যর্থ। এ আমারই বিফলতা। কোন্‌
অমাবস্যা আমাকে নিয়ত
তাড়িয়ে বেড়ায়? কী বিমূঢ় তাকাই নিজের দিকে
কখনও সখনও; ফের হাল ছেড়ে শূন্যতার কাছে
আত্মসমর্পণ করি। জানি না জ্যোৎস্নার ঢেউ জাগবে কখন।
আমি কি আখেরে সব খুব অগোছালো
রেখে যাব? আমার চৌদিকে
তুমুল ভাঙন, আমি পারিনি সামলে নিতে কিছু। অসহায়,
নাবালক বংশধরগণ পারবে কি রুখে দিতে সর্বনাশ?
২৫.৩.৯৯

 নিষ্ঠুর প্রতারণা

দুপুরবেলা রোজ যেখানে শুয়ে শুয়ে বই পড়ি,
কিংবা আকাশপাতাল ভাবি অথবা
হঠাৎ কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়ি,
সেদিন সদ্যলেখা একটি কবিতাকে আমার ডান পাশে শুইয়ে
চশমাটা খুলে সেই পদাবলীর সান্নিধ্যে রাখি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি হলো
এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। তাকিয়ে দেখি,
কালো চশমাটা আড়চোখে কবিতার দিকে তাকিয়ে
ক্ষান্ত হচ্ছে না, ওর তরতাজা যৌবনের স্পর্শের লোভে
কবিতার কোমরে বাড়িয়ে দিলো ঈষৎ কম্পিত হাত।

ঈষৎ নড়ে চড়ে ওঠে কবিতা। চশমার কামাতুর হাত
ওর স্তন মুঠোবন্দী করার সঙ্গে সঙ্গে গা
ঝাড়া দিয়ে ওঠে তন্বী কবিতা। ওর ফুঁসে ওঠার ভঙ্গি
আমার দৃষ্টি এড়ালো না। আমার রাগী চোখ দুটো দেখে
ভড়কে যায় আমার নিত্যসঙ্গী চশমা। চটজলদি
শিথিল হলো ওর শক্ত মুঠি, পুরো হাত। কবিতাকে
আলগোছে সরিয়ে আমার বাঁ পাশে নিয়ে আসি।
নিমেষে কবিতা আকাশের নীল হ্রদের সুস্থির
জলরাশি, প্রান্তরের প্রশান্ত সবুজ। আমার চোখে
চোখ রেখে কী করে যে আমার দয়িতা
হয়ে গেল সে, ওকে বুকে টেনে নিয়েও
খর দুপুরে সম্মোহিত আমি বুঝতে পারিনি কিছুতেই।
এরপর থেকে আমার চশমা শেকসপীয়রের ওথেলো
নাটকের খলনায়ক ইয়াগোর মতোই আমার
চরম সর্বনাশের মতলবে নানা ফাঁদ পাততে শুরু করে
এবং আমি সহজে ওর শঠতার প্ররোচনায় নিরপরাধ, শুদ্ধতমা,
সুন্দরী ডেসডেমোনসুলভ কবিতাকে গলা টিপে হত্যা শুরু করি।
কবে আমি ইয়াগোর নিষ্ঠুর প্রতারণা থেকে মুক্ত হবো কে জানে?
১৬.১১.৯৯

পথের পাশে কিছুক্ষণ

সড়কের এক ধারে পড়ে আছে একজন লোক,
অসুস্থ, অত্যন্ত পিপাসার্ত। বিপন্ন দু’চোখে তার
সাহায্যের কাতরতা। ভিড়ের হৃদয়
উদাসীন। কেউ কেউ প্রশ্ন করে নানা ধরনের;
কোন্‌ ধর্মাবলম্বী এ বেগানা লোকটা, এই মতো বিবেচনা
গুঞ্জরিত খুব অনেকের মনে। উচ্চারণে অক্ষম লোকটা
করুণ দৃষ্টিতে জটলার দিকে চেয়ে থাকে; দু’টি
নীল মাছি স্থির ওর ঠোঁটে, যেন তার
ওষ্ঠ থেকে জীবনের সবটুকু রস
নিচ্ছে শুষে সিরিঞ্জে গোপনে।

হঠাৎ উজিয়ে ভিড় একজন এসে
তৃষ্ণার্তের ঠোঁট থেকে মাছি উড়িয়ে বলেন-
‘লোকটা মানুষ, তাকে বাঁচিয়ে তোলাই
দায়িত্ব সবার; কোন্‌ ধর্মে সমর্পিত
বিপন্ন এ লোক, সওয়ালটি
ক্রূর বিবেচনার নিক্তিতে মাপা অধর্ম নিশ্চিত’-
এই শব্দমালা উচ্চারিত যার কণ্ঠে,
তিনি তার ফ্লাস্ক ক্ষিপ্র উন্মোচন করেন আর্তের ঠোঁটে, মুখে।

অপ্রসন্ন ভিড়ে ভাটা পড়ে, কিছু উক্তি
কাঁটার মতোই বিঁধে যায়
আর্তের ত্রাতার মনে; তবু তিনি আনন্দিত দৃষ্টি
উপহার দেন তৃষ্ণার্তকে।
৪.৫.৯৯

বন্ধ্যা মাটিতেও মুক্ত মন

সংকীর্ণ গলিতে থাকি, অথচ প্রশস্ত রাজপথ
প্রতিদিন হাতছানি দেয়, মুমূর্ষু নদীর তীরে
বসে শুনি দূর সমুদ্রের গান। সামান্য আঁচড়ে
কেটে শাদা কাগজের বুকে স্বপ্ন দেখি পিকাসো কি
শাগালের প্রতিযোগী হওয়ার, তা বলে এই আমি
হবো কি সবার কাছে নির্বোধ অথবা হঠকারী
একজন? আকাশ তো অসীমের আকাঙ্ঘা জাগায়
মানবের মনে আর ছায়াপথ, রঙধনু আর
নক্ষত্রের সুদূর আসর নান্দনিক মুক্তি আনে
জীবনের বাঁকে বাঁকে। ক্ষুদ্রতার হাঁকডাক কিংবা
পৃথিবীর পথে নানা সংকীর্ণতা-পাতা ফাঁদ মূঢ়
পিছুডাক পারে না পোড়াতে কোনওদিন প্রগতির
ভাস্বর পতাকা দীপ্ত মানবের। নিশ্চিত জেনেছি,
বন্ধ্যা মাটিতেও মুক্ত মন ফোটায় অজস্র ফুল।
১৫.১২.৯৯

বৃষ্টির অধিক বৃষ্টি

আসমান প্রাচীন কালের কোনও রূপসীর মতো
আড়াল করেছে মুখ অসিত বেকাবে। আবরণ ছিঁড়ে ঝরে
রাধার নূপুর হয়ে বৃষ্টি অবিরত
মেটাতে অধীর তৃষ্ণা শহরের। বড় একা বসে আছি ঘরে
আমাকে বৃষ্টির জাল ঘিরে ধরে চারদিকে
কী মসূণ আর নানা রঙিন মাছের চঞ্চলতা বিছানায়,
বিস্মিত তাকিয়ে দেখি। কিছু লিকলিকে
প্রাণী এসে জোটে, বুঝি অতিশয় মজা পেয়ে যায়
হঠাৎ আমাকে দেখে, এবং কদম ফুল ছায়া-ছায়া ঘরে এসে
হাসে খিলখিল, জুড়ে দেয় নাচ শূন্যে ভেসে ভেসে।

বৃষ্টিও আলাপচারী, সন্ধ্যাভাষা জানা আছে
ভাল তারও, নয় তা অবশ্য রূপায়িত মনুষ্য-ভাষার ছাঁচে
নিজ সুরে এখন সে বলছে আমার কানে কানে,
‘বৃষ্টি যে অপরিসীম ভালবেসে। এমন গহন
বর্ষায় রহস্যময় এবং ব্যাকুল হতো মন
যার, সে মানবী আজ দূর পরবাসে। রবীন্দ্রনাথের গানে
অথবা বৈষ্ণব পদাবলী কিংবা এই আমার ধারায় তাকে
পাবে না তোমার কাছে এবং উত্তর-আধুনিক কবিতারও সাধ্যাতীত
তাকে ডেকে আনা গৃহকোণে। কৃষ্ণ নও যে বাঁশির ডাকে
আসবে সে বৃষ্টিমত্ত গাঢ় কালো মধ্যরাতে সমাজের ভিত
কাঁপিয়ে,’ বলেই জলধারা অকস্মাৎ স্তব্ধতায়
ডুবে যায়, ঘরময় নামল তুষার-যুগ, রক্ত হিমপ্রায়।
বৃষ্টির অধিক বৃষ্টি ঝরে জলহীন,
ঝরে নিরন্তর, খুঁজি তার ভাষা, অথচ নিমেষে
হায়, কোথায় যে সেই আদিভাষা হয়েছে নিলীন,
জানি না কী করে! কিছুক্ষণ পর ফের বৃষ্টিধারা এসে
আমার হৃদয়ে বলে ব্যাকরণ-বহির্ভুত ছন্নছাড়া কথা-
কিছু বুঝি, কিছু বা বুঝি না; বুক হু-হুময়, আমার দু’চোখ
থেকে বৃষ্টি ক্রোক করে নিয়ে গেছে জলধারা। ক্রূর বিষলতা
গায়ে মুড়ে শুধু ধু ধু বৃষ্টি দেখি, অধিক আড়ালে রাখি শোক।
৬.৭.৯৯

বৈশাখ বিষয়ক কয়েকটি পঙ্‌ক্তি

বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস, তোমাকেই
বলছি, শোনো-
যদি আমি রবীন্দ্রনাথ হতাম, তাহলে তো
কথাই ছিল না। হে বৈশাখ বলে শুরু করতাম
আর এক দীর্ঘ বন্দনাগীতি রচনা করে ফেলতাম
তোমারই উদ্দেশে। জীবনানন্দের পক্ষপাত ছিল হলুদ
হেমন্তের প্রতি। তবু জীবনানন্দ হতে পারার গৌরব
অর্জন করলেও তোমার অন্তর্গত রূপের, হে বৈশাখ,
একটি মায়াবী চিত্রকল্প ধানসিঁড়ি নদীর ঢেউ অথবা
শঙ্খ চিলের ডানার ঝাপটার সহযোগিতায়
ফুটিয়ে তুলতে পারতাম দুপুরের ঝিমধরা
আভার গভীর বর্ণনায়। হায়, আমার অদৃশ্য
মুকুটে গৌরবদীপ্ত কোনও মুক্তো অথবা
হীরে জহরত নেই। আমার দীপ্তি প্রায়শই বিপথে হারায়।

হে বৈশাখ, তোমার অনন্য রূপের গুণকীর্তনে আমার
দক্ষতা শূন্যের কোঠায় বলেই ক্ষমাপ্রার্থী। আমি শুধু
তোমাকে মিনতি জানাতে পারি। জোড় হাতে
বলতে পারি, হে বৈশাখ, দয়া করে তুমি
আমাদের আপন দরিদ্রজনের ছনের ছাদ-অলা ঘরবাড়ি,
পর্ণ কুটিরগুলো লণ্ডভণ্ড কোরো না, ভেঙো না
ফলবতী গাছ, নষ্ট কোরো না আমাদের প্রাণপ্রিয় ফসল।
বরং তোমার ঝোড়ো তাণ্ডব ধ্বংস করুক সন্ত্রাস দুর্নীতি,
ভণ্ডামি,কালো কুসংস্কার, প্রাম্প্রাদায়িক আগুন, মানবিক
ক্লেদ, উগ্র মৌলবাদীদের উন্মও হিংস্রতা ধ্বংস করুক,
লুপ্ত করুক চিরতরে। তাহলে রবীন্দ্রনাথ না হওয়া সত্ত্বেও
তোমার রুদ্র গলায় পরিয়ে দেব বন্দনার গীতিমালা।
১১.৪.৯৯

ভুলতে পারিনি তাই

ভুলতে পারিনি তাই বারবার সেই একই জায়গায় যাই
হৃদয়ের কিছু রেণু ছড়িয়ে, স্মৃতির
কণাগুলো ওড়ে ইতস্তত। মনে পড়ে এখানেই
পাঁচটি বছর আগে তাকে
বলেছি ব্যাকুল স্বরে,- তোমার জন্যেই ধু ধু মাঠ
পেরিয়ে এসেছি এই ঘাটে অবেলায়।

এখনই সূর্যের আলো নিভে যাবে বৃদ্ধের মতো,
‘তোমার সময় কম,’ বারবার যাচ্ছে বলে ধোঁয়াটে আকাশে
নীড়ে ফেরা পাখির ধূসর নেকলেস। গোধূলির
দিকে কী উদাস চেয়ে থাকি, তুমিও তো
গোধূলির মতো দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছ, করোটির সাথে
খেলায় মেতেছ, যার মোহ অচিরেই যাবে কেটে।

আমি নিজে অনুপম ঘাটের খোয়াব দেখে আঘাটায়
বসে আছি। চতুর্দিক থেকে
দুঃস্বপ্নেরা ঘিরে ধরে। কে যেন অদূরে কেঁদে ওঠে
জমির সকল ধান পুড়ে গেল বলে। একজন চন্দ্রাহ্‌ত কবি
আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলে, ‘পাঁচটি বছর আগে
পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছিলে যাকে, তার কাছ থেকে দূরে
সরে গিয়ে সভায় মিছিলে মেতে আছো। এও কি কবির কাজ?’
বলি তারে দূরে নয়, কিয়দ্দূরে আছি। কবিতাকে
অনায়াসে অধিকার দিয়েছি আমার হাড় মজ্জা
চিবিয়ে নেয়ার নিত্যদিন তার মহিমা বাড়াতে।
২৩.৩.৯৯

যখন অগাধ অন্ধকারে

যখন অগাধ অন্ধকারে হব বিলীন, তখন
দেখতে পাব না নীল আসমান, পায়রার ঝাঁক,
পারব না বলতে, ‘গোলাপ, তুমি অপরূপ রূপটানে আছ
কী সজীব। জোহরাকে মধ্যরাতে জ্বরতপ্ত স্বরে
কখনও হবে না বলা, ‘এক গ্লাস পানি দাও, গলা
ভীষণ শুকিয়ে যাচ্ছে। টিয়ার মধুর
হাসি দেখব না আর। নয়না, দীপিতা
আমার স্টাডিতে এসে কখনও আমাকে নয়, এক
খাঁ খাঁ শূন্যতাকে পাবে। দেয়ালের ফটোগ্রাফে টিকটিকি দেখে
দূরে সরে যাবে।

গৌরী, তুমি আমার নিষ্প্রাণ ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে শত চুম্বনের
তাপেও নিশ্চিত ব্যর্থ হবে, হায়, শৈত্যময় আমাকে জাগাতে।
৩.৩.৯৯

যাত্রার আগে

আমি তো শিগ্‌গিরই চলে যাব, বড় একা
যাব চুপচাপ, তোমাদের কাউকেই
সহযাত্রী করব না নিরুদেশ যাত্রায় আমার। জেদ করে
লাভ নেই, আমাকে যেতেই হবে তোমাদের ফেলে।

না আমি এখন কোনও কিছুই নেব না সঙ্গে
এই নিঃসঙ্গ যাত্রায়, খামোকাই স্যুটকেস
করছ বোঝাই এটা সেটা দিয়ে; আমার বাছাই-করা প্রিয়
পুস্তক দিও না গুঁজে পেটমোটা স্যুটকেসে; প্রয়োজন নেই,
একবার চোখও বুলাব না। পাসপোর্ট
ঘুমাক নিটোল রুদ্ধ দেরাজে আমার।

এখন একটিবার শুধু আমাকে দেখাও সেই শস্যরাশি
যা আমার নিরন্তর শ্রমে,
মেধায় ফলেছে নিরিবিলি। হা কপাল,
এই সব কী এনেছ সমুখে আমার? তবে আমি কি কেবলি
নির্জীব, হতশ্রী শস্য ফলিয়ে তৃপ্তির মদিরায়
বুঁদ হয়ে ছিলাম নিজের আস্তানায়? এই দৃশ্য চোখে নিয়ে
যেতে হবে ভেবে বোবা হাহাকার জেগে ওঠে প্রাণে। অনুরোধ,
তোমরা আমার এ যাত্রাকে ভারাক্রান্ত কোরো না কিছুতে আর।
৯.৪.৯৯

শ্রদ্ধেয়া সুফিয়া কামালের জন্যে পঙ্‌ক্তিমালা

গাছপালা, পাতাদের কাঁপন হাওয়ার
ভোরে কি দুপুরে অথবা রাত্তিরে, বাগানের
পুষ্পমেলা, খোলা পথ, উদার বিস্তৃত মাঠ, নদী,
কাছের সুরেলা পাখি, দূরের নক্ষত্র মেলা, নারী ও পুরুষ-
সবাই একান্ত প্রিয় ছিল জানি, নির্মল কবির।
তোমার প্রতিও ওরা ছিল অনুরক্ত সীমাহীন,
তবু ওরা কেউ
পারেনি ছিনিয়ে নিতে মৃত্যুর ছোবল থেকে সর্বশক্তি দিয়ে।

হেমন্ত-সকালে ক্রূর মৃত্যু তোমাকে ছিনিয়ে নিল, শুধু
তোমার বাহ্যিক সত্তা নিল আমাদের ফাঁকি দিয়ে
লক্ষ কোটি মানব ও মানবীকে প্রতারিত আর
প্রভূত বঞ্চিত করে, কিন্তু কবির প্রকৃত সত্তা আজও
রয়ে গেছে সবার স্মৃতিতে, চেতনায়
তাঁর যৌবনের
‘সাঝের মায়ায়,’ নারী জাগরণ আর প্রগতির
রৌদ্রোজ্জ্বল ইতিহাসে, মানবতাবাদী পতাকায়।
২১.১১.৯৯

সগীর বাউল এবং একটি পোড়ো জমির কথা

গভীর রাতে পোড়ো জমির কিনারায় বসে দোতারা বাজিয়ে আপন মনে
আশ্চর্য তন্মায়তায়
গান গাইছিলেন সগীর বাউল। হঠাৎ কী যে হলো, তার তন্মায়তাকে ছিন্ন
করে জেগে ওঠে
একটি দৃশ্য, যা তার সুরের তাল লয় সবকিছুকেই থমকে দেয়। তার
হাতের দোতারা
শিউরে ওঠে। পোড়ো জমির বুক ফুঁড়ে বের হতে থাকে অনেকগুলো
মাথার খুলি,
ভাঙাচোরা কঙ্কাল। মাথার খুলিগুলির কদর্মাক্ত ওষ্ঠে থেকে নিঃসৃত হয়
একের পর এক
অনেক কথা। সেসব কথা শুনে সগীর বাউল বারবার কেঁপে উঠছিলেন,
বেদনার্ত হয়ে
উঠছিলেন বিবরণের করুণ ভয়াবহতায়। মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে যায় নিজের
কাছেই হাতেই
দোতারা, সঙ্গীতের তরঙ্গমালা। যেন তিনি এক পাথরের মূর্তি।

কিছুক্ষণ পর পোড়ো জমির মাথার খুলিসমূহ, ভাঙাচোরা কঙ্কালগুলি যেন
হাওয়ায় মিলিয়ে
যায়। পরদিন ভোরবেলা সগীর বাউল কিয়দ্দূরবর্তী এলাকার প্রধান
ব্যক্তিদের কাছে গত
রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তার বিবরণ কেউ কেউ বিশ্বাস করল, কেউ
কেউ
বাউলের মাথা বিগড়ে গেছে ভেবে প্রচুর হাসাহাসি কতল। দমলেন না
সগীর বাউল।
তাদের সেই দৃশ্য দেখাতে না পারলে বিরান হয়ে যাবে তার সুরেলা কণ্ঠ
সেই জমিনের
মতো, উন্মাদ হয়ে যাবেন তিনি।

সগীর বাউল এবং দূরবর্তী এলাকার তার অনুগামীরা পৌষ রাত্তিরে সেই
পোড়ো জমির
কাছে পৌঁছেতেই মরা জ্যোৎস্না নেমে আসে চারদিকে থেকে। জমি ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসে
অনেক করোটি, ভাঙাচোরা কঙ্কাল। দূরবর্তী এলাকার লোকজন ভয়ার্ত
মূর্তি যেন। পোড়ো
জমির জাগ্রত করোটিসমূহ এবং কঙ্কালগুলি বহু মানব-মানবীর নিখুঁত
আকার ধারণ করে।
তাদের পাশে ঘনিষ্ঠ দাঁড়ানো অনেক শিশু-কিশোর। সেসব মানব-মানবীর
অনেকেই
যুবক-যুবতী, কিছু প্রৌঢ়, ক’জন বুড়োসুড়ো লোক এবং মধ্যবয়সী নারী।
অনেকেই
ধর্ষিইতা। পোড়ো জমির ভেতর থেকে উঠে আসা নরনারী বজ্রের আওয়াজ
ধার করে
একসঙ্গে উচ্চারণ করে-‘একাত্তরের নরঘাতকদের শিকার আমরা।
দখলদার,যুদ্ধবাজ

সেনারা এবং তাদের তাঁবেদার দালাল, রাজাকার, আলবদরেরা পৈশাচিক
নির্যাতন চালিয়ে
আমাদের হত্যা করেছে। সেই সব যুদ্ধপরাধী আর ওদের সহযোগী
নরপশুদের বিচার
চাই। ওদের বিচার না হলে, ওদের পাশবিক নির্যাতনের শাস্তি না হলে
একদিন সারা
বাংলাদেশ পোড়ো জমিনে রূপান্তরিত হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই,
বিচার চাই।

পৌষ-রাত্রির মরা জ্যোৎস্নায় মানব-মানবীর কণ্ঠে বজ্রপাততুল্য শব্দাবলী
সগীর বাউল এবং
দূরবর্তী এলাকার আগন্তুকদের বিস্ময় বিহ্বল, ভয়াবহভাবে প্রশ্নাতুর,
প্রত্যয় দৃঢ় করে
তোলে। নিমেষে পোড়ো জমিতে অনেক করোটি, ভাঙাচোরা কঙ্কালের
কোলাহল।
অনন্তর থমথমে নীরবতা, পোড়ো জমির বুক জুড়ে অদ্ভুত চাঁদিনীর খাঁ খাঁ!
৬.২১.৯৯

সাম্প্রতিক ভাবনা

আবু হাসান শাহরিয়ার প্রীতিভাজনেষু

এ শহরে চারজন অন্ধ চৌরাস্তায় পথনির্দেশক আজ
পথচারীদের; কে কোথায় যেতে চায়
না জেনেই অঙ্গুলি নির্দেশে সদা তৈরি কী নিখুঁত ভঙ্গিমায়,
অথচ বেজায় দিকজ্ঞানহীন ওরা নিজেরাই। অগণিত
বধির সাগ্রহে শোনে ইতস্তত তাকিয়ে প্রত্যহ চারবেলা
কতিপয় মূকের ভাষণ, মানে অব্যক্ত ভাষার
ফুলঝুরি! দেখে নেয় মজাদার অঙ্গ সঞ্চালন। হাসি ফোটে
ঠোঁটে, তবু হাসির হুল্লোড়
কখনও শোনে না কেউ। তিনজন ঘোর কৃষ্ণবেশী
ক্রূর ঘোড়সওয়ার ছড়ায় দশদিকে মারী আর মড়কের বীজ।

অসহায় চেয়ে থাকি, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ রাখি
মনের ভেতরকার দৃশ্যাবলী দেখার আশায়
কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ ধ্যান ভেঙে গেলে দৃশ্যপট
আড়মোড়া ভেঙে ভিন্ন রূপে প্রতিভাত; দেখি কোন্‌
অমাবস্যা থেকে জন্ম নিয়ে
সাতটি কংকল ঢাল তলোয়ার হাতে এঁকে বেঁকে
এগোয়া আমার দিকে। আমি প্রশ্নাকুল
হলে তীক্ষ্ণ, কর্কশ হাসিতে কেঁপে ওঠে সাতটি কংকাল আর
নিমেষে ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা খসে যায়। মনে
হঠাৎ ঝল্‌সে ওঠে শিশুর মধুর চিত্তহারী হাসি আর
চিরায়ত কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা। পলেস্তারা
ফিরে আসে দেয়ালে, ঘরের পরিবেশ হেসে ওঠে রূপসীর মতো।
সাতটি কংকাল, ঘোর কৃষ্ণবেশী তিন ঘোড়সওয়ার এবং
চারজন অন্ধ পথ নির্দেশক-সবাই গায়েব।
এইতো জীবন সুদর্শন তরুণের ধরনে পতাকা হাতে
দৃপ্ত হেঁটে যায় খোলা পথে
এবং আমার এই ধূসর, বিস্তর বয়সেও
মনের গহনে লাল পদ্ম হয়ে ফুটে ওঠে আরও বেশি বাঁচবার সাধ।
৫.৮.৯৯

 সিকান্‌দার আবু জাফর স্মরণে

হায়, কোথায় উধাও আজ সেসব ডানাঅলা
গভীর রাত? কোথায় সেই মদির মুহূর্তের জীবনচোঁয়ানো
বুদ্বুদ-সমুদয়? মনে পড়ে, কোনও কোনও প্রায় প্রত্যূষছোঁয়া প্রহরে
নিরিবিনি ঘরে ফেরা মগজময় কত অস্ফুট পঙ্‌ক্তি নিয়ে।
আপনার অপ্রতিরোধ্য আহ্বা, ভালবাসার বসন্তবাহার এমন
ঘরকুনো আমাকেও করেছে ঘরের বাহির, এনেছে
হার্দিক, বৌদ্ধিক জ্বলজ্বলে আসরে। সংগ্রাম, শান্তিকল্যাণ,
মানবতা, আকাশের গর্ভের নিমীলিত আকাশ
জপেছি আমরা ক’জন যে যার ধরনে। সুন্দরের ধ্যান
আমাদের সত্তায় গড়েছে অপরূপ বল্মীক।

আজও পড়ন্ত বেলায় নিষ্করুণ খরার পরে যখন
আমার শ্যামল অঙ্গনে নাচের নানা মুদ্রা এঁকে
দেখা দেয় চিত্ত মাতাল-করা কোনও কোনও রূপসী,
উঠে আসে আমার খাতার বিরান পাতায়
সুস্থির, অতল কালো দু’চোখে তার
রহস্য অপার, সমস্ত শরীরে স্বপ্নপুরীর নিরুপম আভা,
পায়ে নূপুরের ঝংকারহীন ঝংকার, নিটোল
আঙুরের মতো স্তনচূড়া, চেয়ে থাকি মুগ্ধাবেশে।

আমার এই অক্ষরচিত্রিত পাতা নিয়ে কালবেলায়
যাব কার কাছে? আপনার চেয়ার সেই কবে থেকে
ভীষণ খাঁ খাঁ। কোথায় আপনার চোখের আড়ালে আরেক চোখের দ্যুতি,
যার দাক্ষিণ্য আমার সামান্য কাগজের কামিনীর রূপ
করবে আবিষ্কার? কোথায় সে পাবে ঠাঁই? হায়,
কোন্‌ সাইমুমে হারিয়েছে পথ অবেলায় আপনার, আমাদের ‘সমকাল’?
৩১.৭.৯৯

 সৃষ্টির মুহূর্ত

ইদানীং গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়, যেন কেউ
হঠাৎ ধাক্কায় জাগিয়ে দেয় আমাকে
তামাশায় মেতে। আর ঘুম হতে চায় না। এপাশ ওপাশ করি,
মেঘ গণনায় মনোযোগী হই, তবু পলাতক নিদ্রার
প্রত্যাবর্তনের নাম নেই। আজ জ্বালা ধরা চোখ দুটো
কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে অন্ধকার উজিয়ে
আমার পড়ার ঘরে পা রাখি। স্যুইচ টিপে বাতি জ্বালাতেই
একলা সুনসান ঘরে নিজেকে কেমন অচেনা লাগে।

নিস্তব্ধতা একটা ঘোর কালো বাইসনের মতো যেন
চাপা ক্রোধে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। আমি-নই-অথচ আমি
চাবি দেয়া পুতুলের মতো হেঁটে যাই বুকশেলফের দিকে।
চেনা বইগুলোকে কখনও অচেনা, কখনও-বা ইটের সারি
মনে হচ্ছ। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? মাথার
শাদা চুলগুলো বেশ জোরে টানলাম, যেন
লুট-হয়ে যাওয়া সচেতনতাকে ফিরিয়ে আনার এই
নৈশ মুহূর্তে আমি প্রবল চেষ্টাশীল। সে গুড়ে
বালি ছড়িয়ে আড়াল থেকে কেউ আমাকে কখনও হুতোম প্যাঁচা
বানাচ্ছে, কখনও বাদুড়, আবার কখনও লেজঅলা ক্লাউন।

আমি যে একজন কবি, যার কবিতা দীক্ষিত পাঠকগণ
এখনও ভালবেসে পড়েন, এ-কথা কিছুতেই মনে
রাখতে দিচ্ছে না আড়ালে থাকা রহস্যময় সত্তা। আমি
ক্রমাগত গাড্ডায় পড়ে খাবি খাচ্ছি, কাঁটা-বিছানো
পথে হাঁটতে বাধ্য করা আমাকে, কখনও
ক্রূশে ঝুলিয়ে পেরেক ঠোকা হচ্ছে আমাকে কপালে,
বুকে, হাতে-পায়ে। আমি চোখে নক্ষত্রের ব্যালে-নৃত্য দেখছি
বলে ভাবছি। অথচ পিশাচের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি
চৌদিকে। পিপাসায় আমার বুক চৌচির, মুখের ভেতর
গিজগিজ করছে বালি। আমার কি নিস্তার নেই?

আমি কি পড়ার ঘরের চেয়ারে বসে ক্লান্তির ভারে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? চোখ মেলে দেখি, আমার ঘর
নীরবে পান করছে ভোরবেলার প্রথম আলোর শরবত।
আমার অন্তরে হাই তুলে মঞ্জরিত হল কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।
১০.৪.৯৯

স্বপ্ন গাঁথি

পদ্মপাতায় মাথা রেখে থাকবো শুয়ে,
নানা রঙের স্বপ্ন দেখবো, ইচ্ছে ছিলো।
নানা ঢঙের পদ্য লিখে কাটবে সয়ম
রঙধনুর সাঁকোয় বসে শান্তিপুরে, আশা ছিল।

হঠাৎ একি হারে রে রে আওয়াজ তুলে
চতুর্দিকে নেকড়েমুখো মানুষগুলো
আসে তেড়ে। স্বপ্নগুলো ছিঁড়ে খুঁড়ে দিনদুপুরে,
রাত দুপুরে রক্ত ঝরায় খোলা পথে, বন্ধ ঘরে।

ইচ্ছেগুলো স্বর্ণমৃগ, ঝলসে উঠে
হাওয়ায় মিলায়। আশা অন্ধ ডোবায় পড়ে
খাচ্ছে খাবি হরহামেশা দলে বলে।
পদ্মাপাতা পাই না কোথাও, রঙধনুর সাঁকো উধাও।

কিন্তু তবু স্বপ্ন দেখার সাধ মেটে না।
নেকড়েমুখো মানুষগুলোর মরণ-কামড়
সয়ে টয়ে ছেঁড়া কাঁথায় স্বপ্ন গাঁথি,
রঙিন সুতোয় ছবি আঁকি আশা-জাগর অগ্রগতির।
১০.১২.৯৯

Exit mobile version