- বইয়ের নামঃ ধ্বংসের কিনারে বসে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনুশোচনার গান
চৈত্রের আতশি রোদে দিনভর হেঁটে হেঁটে সর্বস্ব খুইয়ে
কায়ক্লেশে পৌঁছে যাই ভুতুড়ে বাড়িতে। ভয়ে চুল
খাড়া, যেন কাটা ধান গাছের তিরিক্ষি গোড়া; ভুল
ক’রে এসে গেছি, তাই মাথাটা নুইয়ে
ব’সে থাকি আরশোলা ইঁদুর এবং চামচিকে, বাদুড়ের
আস্তানায়। এভাবেই ঢের
ভুল ক’রে গেছি, যাচ্ছি ক্রমাগত; এখন কোথায়
যাব এই ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে? হায়, এখানেও থাকা দায়।
প্রায় জেতা খেলা
সামান্য ভুলের জন্যে হেরে গেছি ভর সন্ধ্যেবেলা
আনাড়ির ধরনে বস্তুত। বার বার।
শক্রদের করেছি নিবিড় আলিঙ্গন
মিত্র বিবেচনা ক’রে; বিভ্রমের দোলাচলে মৈত্রীর বন্ধন
বেবাক ফেলেছি ছিঁড়ে। নষ্ট যারা, তুখোড় নচ্ছার,
তাদের গলায় মালা দিয়েছি পরিয়ে ঘুরে ফিরে
ঢাক-ঢোল, পেটানোর মাঝে,
হেলাভরে ঈগলের চূড়া ছেড়ে ভীষণ কলহপ্রিয় বায়সের নীড়ে
খুঁজেছি আশ্রয়, এরকম শত কাজে
ভ্রান্তির পেরেক বিদ্ধ। যদি মগ্ন হই সংশোধনে,
তবে কি ধীমান সজ্জনেরা আমাকে দেবেন দীক্ষা নতুন বোধনে?
কুকুর, বেড়াল কিংবা হাঁস, মুরগি, কবুতর- কিছুই পুষি না;
আমার আরাধ্য সেই কবে থেকে ত্র্যাপোলের বাণী।
টেবিল ল্যাম্পের নিচে কত রাত সাজিয়েছি অনেক হরফ
নিদ্রাহীন, ভোরবেলা দেখি ভুল শব্দ ভেংচি কাটে;
কবিতার গায়ে শুধু বিকৃত, বেঢপ সাজ; হাত-পা বরফ
হ’য়ে যায়। যে তন্বীকে অক্ষরবৃত্তের ছাঁচে এনে শূন্য খাটে
সযত্বে বসাই, সে নিমেষে উগ্রচন্ডী স্তনের রাক্ষসী হয়;
বড় রকমের ভুল হ’য়ে গেছে কোথাও নিশ্চয়।
দেখ, দেখ, এ বয়েসে দেচ্ছি এ কেমন লাফ;
আগুনে, অথই জলে যেখানেই পড়ি, সাফ সাফ
ব’লে দিই, অনুশোচনার
কোন গান ইনিয়ে-বিনিয়ে আমি গাইবো না আর।
১৮।৩।৯১
অলৌকিক সেতু
কষ্ট হোক, এবার নিশ্চিত ফিরে যাব কোলাহল
ছেড়ে ছুড়ে নিজের গহনে। অতি তুচ্ছ, অস্পষ্টতা-
জড়ানো কারণে কাদা মেখে দেবে কেউ
আমার সত্তায়, ঠোঁট বেঁকিয়ে কেউবা দর্পভরে
যাবে চ’লে পার্টি কিংবা সমিতির ডাকে, তবু আমি
এখন সেখানে যাব, স্বচ্ছন্দে নিশ্বাস নেব, যেখানে শব্দেরা
বিভিন্ন রঙের মাছ, অবচেতনায়
সঞ্চরণশীল আর স্বপ্নের কিনারে
অত্যন্ত রহস্যময় জেলে জাল ফেলে ক্রমাগত
অবয়বহীন, কুয়োতলায় তরুণী
নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি
গেরস্তের ঘরে দেয় ঝংকৃত আগুন।
অগ্নিশিখা থেকে ধার নিয়ে উদ্দীপনা
গ’ড়ে নেব মর্ত্য আর অমর্ত্যের অলৌকিক সেতু।
১৩।১।৯১
অসমাপ্ত কবিতা
খরায় শব্দের চাষবাস বেজায় উচ্ছন্নে গেছে;
সুন্দরের পা কাটা এবং চোখে হলুদ পিচুটি,
তা ব’লে এভাবে দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে সারাক্ষণ
ব’সে থাকবার কী-যে মানে হয়! অসুখ তাড়াও,
আঙুলের ডগা দিয়ে জাগাও আবার ভালবাসা;
ভুল নাম শুনে তুমি জনপদে চুপচাপ থেকো।
ক’পোয়ালা কফি খেলে, স্পর্শ পেলে ক’জন রূপসী
রমণীর একটি কবিতা লেখা যায় নিরিবিলি?
ট্রাউজারে স্কচ কতবার চলকে পড়লে শব্দবোধ
রুপবান হতে পারে? নিশিন্দা পাতায় প্রতীকের
প্রজাপতি উড়ে এসে বসে কি কখনো? বাগানের
ছায়ায় দাঁড়ায় এক আহত হরিণ ভ্রমবশে।
একটি কবিতা অসমাপ্ত রয়ে গেছে বহুদিন
থেকে, এরকম হয়, হতে থাকে মাঝে-মাঝে কিছু
জরুরি শব্দের অকস্মাৎ গা ঢাকা দেয়ার হেতু;
একটি কবিতা অসমাপ্ত রয়ে গেছে দীর্ঘকাল।
জীবনযাপন অবসাদ মুখ্য হয়ে ওঠে, বাড়ে
রক্তচাপ, বিপন্নতা কী আয়েশে পাশে শুয়ে থাকে।
কখনও হবে না লেখা আর এই বিশেষ কবিতা
ভেবে মনোকষ্ট হয়-যেন কোনো বাড়ি নিরালায়
একটি দেয়াল নিয়ে বোবা, সেই কবে ক্ষয়ে গেছে
ইটের গাঁথুনি, বুনো ঘাস অবিরল খল খল
করে ভিটেমাটিতে এবং চামচিকা, ইঁদুরের
চাঞ্চল্য বাড়তে থাকে ক্রমাগত প্রহরে প্রহরে।
নিভৃতে বিষণ্ন থাকি, থাকি পদ্যের সংস্রব থেকে
দূরে, পরবাসে, তবু একটি দোয়েল টুপ করে
ফেলে যায় উপমা, কোত্থেকে ঝরা পাতা রূপটান
দেয় কোনো ছন্দের, কনকচাঁপা খুঁজে আনে মিল।
শব্দগুলি একে একে অপচয়ী পুত্রের মতন
ফিরে আসে, পুনরায় রুগ্ণ, ক্ষয়া কবিতা পূর্ণিমা।
দর্শনের খুঁট ধ’রে উদাসীন ঘোরঘুরি করি-
আমি কি নিজের কাছ থেকে ধু ধু দূরে সরে যাচ্ছি?
নিদ্রাহীন রাত্রিগুলি শুষে নেয় কত অশ্রুজল,
অমরত্ব মারবে বিপথে এনে, মুখে এক ফোঁটা
পানি দিতে থাকবে না কেউ ধারে কাছে; এ জীবনে
অসমাপ্ত কবিতার মতো দীর্ঘশ্বাস হয়ে যাবে।
৫।৫।৯১
আঙ্গিক
সহসা কৌতুকপ্রিয় আসমানে বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ,
দেবদূতদের নিরর্থক হাসি, মাংসাশী হাওয়ার হা-পিত্যেশ।
সেই কবে নির্গমন শ্রাবণ দুপুরে, ভেজা মাথা,
সপসপে জামা, রক্তশূন্য সেবালোভী
রোগীর মতন দশ আঙুল; যাইনি
তেমর কারুর কাছে তুর্কী তোয়ালের
চাঞ্চল্যে শুকিয়ে দেবে মাথা। উপন্যাস পাঠাশেষে সে ঘুমায়,
স্বপ্নরিক্ত খাট, ভবঘুরে প্রজাপতি মুগ্ধাবেশে চাটে তাকে।
নিরুত্তাপ কলহে অথবা নগ্ন ঘুমে কেটে গেছে
বেখবর কতকাল। কবিতার নতুন আঙ্গিক
অধরা; সরস পাতাকাঙ্খী জিরাফের
গলা আর জেব্রার দুরন্ত দৌড়ে, আফ্রিকার কালো
স্তনে, ক্রেমলিন-তারকায়
নতুন আঙ্গিক খুঁজে সান্নিপাতে লবেজান আমি।
ব্যর্থতা নিছক উট উপবিষ্ট বালির উপর ব্যথাতুর।
তবুও তো ইচ্ছে হয়, সফেদ কাগজে
শুভেচ্ছা শব্দটি লিখে শক্র মিত্র সকলের বুক-
পকেট ভরিয়ে দিই, হাত রাখি সব ফুটোময়
এতিম খানার ছাদে, নিঝুম প্রহরে একা ফনিমনসার
বনে বিদ্ধ হ’য়ে হু হু বুকের শোণিতে কিছু কুসুম ফোটাই।
ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি হারাই অরণ্যে পথরেখা।
অকস্মাৎ দারুণ খরায় এক ঘড়া টলটলে জল নিয়ে
কবিতার নতুন আঙ্গিক।
১৪।৯।৯১
আজ থাক
একজন কবি, সময়ের দাঁত-নখ
খুব গাঢ় আঁচড় কেটেছে তার অস্তিত্বের ভূমন্ডলে; কবি
হৃদয়ের নিভৃত গোলাপ
দিয়েছিল অনুরাগে সেই তরুণীকে গোধূলিতে,
চাঞ্চল্য অপর নাম যার। কবিতার
ঝোপঝাড়ে বসবাস তার।
একদিন কবি তরুণীকে বলে আবেগকম্পিত
কণ্ঠস্বরে, ‘ছোঁব কি তোমাকে?’
‘আজ থাক ব’লে সে বসলো স’রে দূরে।
অন্যদিন কবি প্রশ্ন করে যুবতীকে, ‘চুমো খাব?’
‘আজ থাক,’ ব’লে সে তাকায়
আকাশের চিলটির দিকে।
অনন্তর একদিন মৃত্যু যখন কবির ঠোঁটে ঝুঁকে
দিচ্ছিল চুম্বন, সেই তন্বীকে দোয়েল
জানালার কাছে
এসে বললো, ‘যাবে না দেখতে সেই ক্ষয়িষ্ণু কবিকে?’
‘আজ থাক’, ব’লে সে তরুণী
অভ্যাসবশত আর শেল্ফ থেকে টেনে নেয় কবিতার বই।
২৯।২।৯১
আদাব আরজ
এতবার বলেছি ব্যাকুলতা উজাড় ক’রে
বিশ্বাসই করতে চাওনি
আমার কথার মৌমাছিগুলোকে
তড়িঘড়ি তাড়িয়ে দিয়েছো আগুন দেখিয়ে
বলেছিলাম সময় আমাকে
দুমড়ে মুচড়ে আলোর গতিতে ছুটছে
আমার উপর অনস্তিত্বের গাঢ় ছায়া
টুকরো টুকরো স্বপ্ন এখন জাল গোটানো
নিরুত্তর তুমি ঘরকে অধিকতর
আলোকিত করলে হাসির আবীর ছড়িয়ে
যেন আজরাইল আমার জান কবজ ক’রে কখনো তার
কালো ডানা মেলে উড়ে যাবে না সফেদ অনন্তে
এই ক’দিন ধরে না-দেখা
আমার সত্তায় লাগাচ্ছে বিষাদের পোচ
কতকাল তোমাকে দেখবো না ভাবলেই
আমাকে ছেঁকে ধরে হাজার হাজার কাঁকড়া
রোজ কবিতা লিখেও নিস্তার নেই নাস্তির হাত থেকে
এই জন্যেই প্রত্যহ তোমাকে দেখার বাসনা
শত শত কদম ফুল
একটু স্পর্শ করার স্বপ্ন অনুপস্থিতির নিদান
ভ্রমবশত স্থগিত রেখেছো বাসনার উম্মীল ন
তোমার গোড়ালিতে চুমু খাচ্ছে অলৌকিক
জানতেও পারো না তোমার মুঠোর চাপে
ভালোবাসা দোয়েলের মতো ধুঁকে ধুঁকে মরছে দ্যাখো না তুমি
আমার না-থাকা তোমার হৃদয়ে
ধরিয়ে দেবে আগুন
কৃকলাস সংস্কারের শেকল ছিঁড়ে ছুটে আসবে তুমি
তখন অনুপস্থিতির কণ্ঠে নিঃশব্দ আদাব আরজ
৫।৫।৯০
আড়ালে
বাজিয়ে কলিংবেল দেখি তুমি তোমারই ধরনে
দাঁড়ালে দরজা খুলে। বৃষ্টিধোয়া বিকেলের তাজা
রোদ্দুরের মতো হাসি আমাকে জানায় অনাবিল
অভ্যর্থনা। বুঝিনি কিছুই, নিষ্পলক চেয়ে থাকি;
একটু আগেই বুঝি লোভাতুর চারটি দেয়াল
নিয়েছে বেবাক শুষে আর্ত হৃদয়ের অশ্রুজল।
১৮।৬।৯১
এই পংক্তিমালা
আমার কবিতা আজ নক্ষত্রের কাছে
নীরবে প্রার্থনা করে উজ্জ্বলতা আর
নদীর নিকট চায় ঊর্মিল সঙ্গীত।
আমার কবতা
তোমার চোখের কাছে ধার চায় কিছু গভীরতা,
তোমার স্তনের মতো রঙিন উত্তাপ অভিলাষী
আমার কবিতা। দোয়েলের
বুকের স্নিগ্ধতা, জনহীন দীর্ঘ কোনও
পথের ইঙ্গিত হ’তে চায়
এই পংক্তিমালা।
যতবার করি পাঠ তোমার দু’চোখ, ওষ্ঠ দীপ্র স্তনচূড়া,
ততবার মনে হয় তুমি, চোখ যার ভাবনায় মজ্জমান,
মরমিয়া কবিতার বই।
৫।১১।৯১
একটি কবিতা লিখত গিয়ে
একটি কি দু’টি শব্দ মেদুর বিকেলে সাদা চুলে
আঙুল বুলিয়ে দেয়, গুঞ্জরণ তোলে;
বহুদিন পর খাতা খুলে
বসে যাই নিরিবিলি, হট্ররোলে
মেতে আছে রাস্তা, থাক। পরুর খাটাল থেকে আসে
প্রসূতি গাভীর ডাক মাঝে-মাঝে কয়েকটি কাক
গোধূলি আমার আগে নিস্তব্ধ আকাশে
স্বরের আঁচড় কেটে দিতে চায়। ঐতো উন্মুক্ত বইয়ের তাক
আমাকে অভয় বাণী শোনায় নিঃশব্দে কল্যাণের; খোলা খাতার পাতায়
কলম চালাই দ্রুত, একটি কবিতা লিখে ফেলে
আগুনের আঁচ থেকে শান্ত শুভ্রতায়
বিলীন হবার আকঙ্খায়। তাল কাটে, বলপেন ঠেলে ঠেলে
ক্লান্ত হই, তবু কিছুতেই
বাকবিভূতির ছটা কাগজের বুকে নৃত্যপর
নয়, সুন্দরের কংকালেরও দেখা নেই;
যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো পড়ে থাকে কিছু বেখাপ্পা অক্ষর।
ঘর্মাক্ত চেয়ার ছেড়ে শীর্ণ বারান্দায় যাই, ঘরে
পায়চারি করি, চোখ রাখি আসমানে, অস্থিরতা
সত্তায় ফোটায় আলপিন, আমি ব্যর্থতার চরে
ব্যথিত প্রেতের মতো একা-একা ঘুরি, বিষলতা
ভীষণ জড়িয়ে ধরে, পথ চলা দায়
ব্যেপে-আসা কুয়াশায়, ঠোঁটে এ কেমন অহিফেন?
খাতায় এ কার ছায়া কাঁপে? ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায়,
সস্নেহে রবীন্দ্রনাথ আমার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
২৯।৪।৯১
একটি মানুষ কেন
একটি মানুষ কেন একা ব’সে আছে বারান্দায়
গালে হাত দিয়ে ভরসন্ধ্যেবেলা? বুঝি হাত বোমা
ফাটলেও নড়ে চড়ে উঠবে না কিংবা
ভড়কে দেবে না লাফ। উজাড় চায়ের কাপ, একট কি দুটি
নোনতা বিস্কুট
পিরিচে বিশ্রামরত। খুট খুট শব্দ ইঁদুরের? তার
চুলে মৃদু হাওয়ার আঙুল, সালোয়ার কামিজের
ঢেউ তুলে একজন তরণী রাস্তায় হেঁটে যায়।
এইমাত্র তরুণ কবিরা উঠে গেল তর্ক সেরে,
গূঢ় কবিত্বের কষ্টি পাথরে তুমুল ঘ’ষে পদ্যকারদের,
তৃতীয় প্রবাহ নিয়ে কিছু কথা হলো,
লাতিন আমেরিকার জাদু বাস্তবতা ছায়া ফেলে মাঝে-মাঝে
হয়তো ফের সাকুরার বারে
কিংবা দিশি মদের দোকানে যাবে ধুয়ে-মুছে নিতে
ঈর্ষা, ক্রোধ বাদ বিসম্বাদ; ওরা মাথা পেতে নেবে
অলৌকিক ঝর্ণাজল, মণিমুক্তো কত।
একটি মানুষ ব’সে আছে চুপচাপ, দপ ক’রে জ্বলে ওঠে
গোল চাঁদ চৈত্রের আকাশে। সে পেতেছে
যত ফাঁদ ছন্দ ও মিলের,
সব কিছু টপকিয়ে চলে গেছে কবিতার প্রকৃত সারস
কতবার। মগজের পথেরধনু, জোনাকিরা আসবে না
আজ রাতে, এখন পায়ের কাছে খবরের কাগজ লুটোয়।
জ্যোৎস্নার ভেতর থেকে কণ্ঠস্বর জেগে
ফিস ফিস কত কিছু ব’লে যায় তার কানে কানে শোনে কি না,
বোঝা দায়, শীর্ণ বাগানের পাতা ঝরে
মাথার উপর, অভ্যন্তরভাগে অনিবার্য গুউঞ্জরণ নেই।
৩।৪।৯১
এসেছে বেগানা চিল
এসেছে বেগানা চিল পুনর্বার আমার আকাশে
ছিঁড়ে নিতে নীল মাংস নখরের ক্ষ্যাপাটে আঘাতে।
কতকাল পর এল, কাটল চক্কর কতবার-
রাখিনি হিসাব তার। ঘরে ব’সে ভাবি বাল্মীকির
উত্তরাধিকার আর অবেলায় পথ্য নিয়ে যাই
শয্যাগতা রমনীর কাছে। শল্য চিকিৎসক তার
ব্যর্থতা পারেনি ঢেকে নিতে রবারের দস্তানায়।
ফেরিঅলা ডেকে ডেকে ফিরে যায়; আপাতত সাড়া
নেই এই বাসগৃহে। পদ্য লেখা শেষ হ’লে ছুঁই স্নেহভরে
শব্দরাজি, আজকাল আমার পদ্যের রূপটান
করে না কম্পন সৃষ্টি কোনও খানে; শব্দ মরা মাছি?
বেগানা চিলের ডাক মাঝে-মাঝে ব্যর্থতার বোধ
নিভৃতে জাগিয়ে তোলে। লাজুক যুবার মতো এই
পান্ডুলিপি নিজেকে আড়ালে রেখে ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।
৫।১১।৯১
কণ্ঠস্বর
হঠাৎ কখনও
কারও কণ্ঠস্বর বীতংসের
ছলনা এড়িয়ে
বয়সের পরপারে
মেদুর সময়হীনতায়
ছুঁয়ে যায় অশান্ত হৃদয়,
যেন মাছরাঙা-বুকে স্বপ্ন-গোধূলিতে
বিলের নগ্নতা।
কণ্ঠস্বর রাধা নীপবনে;
দ্বিধায় পা ফেলে স্তব্ধতায়,
কখনও বা ভিজে যায় গহন শ্রাবণে, নীল শাড়ি
নিঙাড়ি নিঙাড়ি
লাজনম্র চোখে চায় এদিক ওদিক।
হৃদয় মুরলীধর, ফোটে সহস্র কদম ফুল
স্বরের ছোঁয়ায়;
কী এক নিবিড় ঘ্রাণে সময়ের পাপড়ি ঝরে যায়।
৩০।৭।৯১
কথা ছিলো
কথা ছিলো, আমার আনন্দ-গানে ভরিয়ে তুলবো
অলিগলি, জনপথ, অবাধ প্রান্তর,
আমার ভরাট গলা ছোঁবে দিগন্তকে; কথা ছিলো,
পায়রা উড়িয়ে দেবো ভোরবেলা মেঘের কিনারে।
কথা ছিলো, উৎসবের উদ্দেশে কবিতা নিরুদ্বেগ
লিখে মুছে ফেলবো সকল দুঃখ শোক।
কণ্ঠে আনন্দের সুর তোলার সময় বেলাশেষে
বেজে ওঠে ব্যর্থতার করুণ রাগিণী, হাত জুড়ে
কবুতর নয়, কিছু নুড়ি দৃশ্যমান। মনে পড়ে, সেই কবে
কল্যাণের জন্যে এসো বলে শূন্যতায় খেলিয়েছি
কণ্ঠস্বর, অথচ চৌদিকে অকল্যাণ
পেঁচার নিখুঁত সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠার অন্ধকার জপে।
আমার ভেতর থেকে যাবতীয় আমোদ, উল্লাস
কারা যেন অতি দ্রুত ছিনতাই ক’রে নিয়ে যায়।
কথা ছিলো, প্রত্যেককে দেখাবো অনিন্দ্য সূর্যোদয়
মুক্ত মনে, অথচ এখন, এ মুহূর্তে, সূর্যাস্তের ছোপলাগা
কবরের দিকে অসহায় চেয়ে থাকি। অবেলার
কোকিল ছড়িয়ে দেবে সুরের নির্মল কিছু রেনু
কবরের ঘাসে, সেই প্রত্যাশা ফেরারী; বন্দীদশা
এলো বুঝি পুনরায়! নিধন লিপ্সায় মত্ত গুপ্ত ঘাতকেরা
ঘোরে খোলা পথে,
পথিক রবীন্দ্রনাথ কন্ঠে নিয়ে শান্তির ললিত বাণী বিষন্ন, বিব্রত।
২১।১।৯১
কবিতার জ্বর
মলিন কবির মুখ, কবিতার পেলব গা’ পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
রক্তিম কপালে তার পানি-পটি দেওয়া প্রয়োজন,
মাথাটা ধুইয়ে দিলে ভাল হয়, অদূরে কোথাও
প্যাঁচা ডেকে ওঠে বার বার। চোখ বোজা আর
দপ দপ করছে কপালের রগ, নড়ে ওঠে ঠোঁট,
রোগা প্রজাপতি; দাও কমলালেবুর রস ওকে
একটু একটু ক’রে। কবি পায়চারি করে ঘরে,
বারান্দায়, কখনও গলির মোড় থেকে ঘুরে আসে।
কবিতার জ্বর বাড়ে ক্রমাগত, লাবণ্য শরীর
থেকে ঝ’রে গেছে, তার বিছানায় যেন বা কংকাল
গচ্ছিত রেখেছে কেউ। রাত্রির তৃতীয় যামে ঘুম
পায় ক্লান্ত কবির, অথচ জেগে থাকে, যদি তার
ডাক আসে অকস্মাৎ। কী এক নিগূঢ় শুশ্রুষায়
কবিতার জ্বর সেরে যায়, শয্যা নেয় রুগ্ন কবি।
৮।৪।৯১
করোটির অন্তর্গত
করোটির অন্তর্গত তমসায় অকস্মাৎ চাঁদ ওষ্ঠ থেকে
ঝরায় ক ফোঁটা বিষ, অন্সরার নিবিড় কাঁচুলি
ছুঁড়ে ফেলে শহরের বস্তির তরুণী।
নোংরা বিছানায় বিকলাঙ্গ একজন বেকারত্ব
পোহায়, হাঁড়িতে ফুটবে না পানি, তণ্ডুলের ঘ্রাণে
উঠবে না জেগে কেউ; নক্ষত্র ফুটবে।
অন্সরা পারে না দিতে খাদ্য টাদ্য, পিপাসার পানি,
ভাঙা ঘরে জ্যোৎস্নার জোয়ার
আনার সামর্থ্য রাখে, সপ্তর্ষিমণ্ডল
হাতের চেটোয় নিয়ে কবিকে স্তম্ভিত
ক’রে দিতে পারে, মেঘ থেকে এনে দিতে পারে কিছু
পারিজাত; যুপকাঠে জল্লাদের মাথা, জনতার কোলাহল।
কবির অমর্ত্য কণ্ঠ বেয়ে নামে বিষ,
তবু তিনি ছন্দমিল বিষয়ে প্রখর
কৌতূহলী, বাড়ি তার ভাসমান বজরা, ঘুমঘোরে
আস্তে সুস্থের কাটেন স্বপ্নাদ্য পাউরুটি;
রুটির ভেতরে মণিমুক্তো, কাব্যকণা, কবি নিজে
হাবুডুবু অলৌকিক স্যুপের বাটিতে।
২৫।৩।৯১
কাঠগড়ায়
শেষতক কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো আমাকে
যদিও বুঝতে পারিনি মাথামুণ্ডু
কী আমার অপরাধ এবং কার কাছে
কাঠগড়ায় চারদিকে ঢেউয়ের ঝাপ্টা
নিরক্ষর চাঁদ সুরুজ আমার কৌসুলি
নক্ষত্র আর জোনাকি সাক্ষীসাবুদ
লতাগুল্ম সকল সুকণ্ঠ পাখি জানায় প্রতিবাদ
তবু টানাহ্যাঁচড়া অদৃশ্য হ্যাণ্ডকাফ
কোন মামলা দায়ের করেনি সে
আমার প্রতি বৃশ্চিক-বিরূপতা গরহাজির
বরং ওর চোখের তারায়
বুকের উদ্যানে আমার ভালোবাসার নীড়
তার গায়ে পড়া শুভার্থীরা অভিযুক্ত করেছে
আমি নাকি ওর সম্ভ্রম হানির কারণ
অথচ মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না কী ক’রে
আঁচড় কাটলাম তার সম্ভ্রমের মসলিনে
কোন উটকো লোকজন কিংবা পাড়াপড়শীকে
জড়ো করা সম্ভব হয়নি আমার বিপক্ষে
রাগী বরাগবৎ ওরা আমার কবিতাকেই
দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে
আমার বেলেহাজ পংক্তিমালা নাকি
তার ইজ্জতে ধাব্বা লাগিয়েছে
হতচকিত আমি চিৎকার ক’রে বলতে চাই
প্রমাণ কোথায় কিন্তু কণ্ঠ আমার নুড়িঠাসা
একচোখো খুচুটে লোকগুলো বলে
তোমার হাতের ছাপ হৃদয়ের নক্ষত্রছাপ
সহজলভ্য অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের ফাঁকফোকরে
শাস্তি-শজারু অপেক্ষমাণ
আসমানের দিকে নজর রেখে
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আমার উচ্চারণ
বয়সের দাঁতখিঁচুনি আমাকে নিরস্ত করেনি
বানিয়ে চলেছি শব্দের রামধনু
বসন্তোৎসব যেখানে ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত
পাখির নীড় যেখানে হামেশা ভস্মীভূত
বন্দনা এবং বদনামি যেখানে সমার্থ
অনিবার্য সেখানে কবির নির্বাসন
৫।৫।৯০
কার্যকারণ
‘দেখ, দেখ লোকটা কেমন কায়ক্লেশে
হেঁটে যাচ্ছে, রাস্তা পার হচ্ছে আস্তে সুস্থে রুক্ষ বেশে,
ভয়ানক নড়বড়ে, জোরে, হাওয়া বইলেই প’ড়ে খাবি খাবে
ধুলোয় নির্ঘাৎ’, কতিপয় তরুণ তরুণী অতিশয় মজা পাবে
আমার উদ্দেশে এই সব কথা ব’লে। সাদা চুল,
অবিন্যস্ত, নুয়ে পড়া অস্তিত্বের ক্লান্তির গাঢ় ছাপ, কী ব্যাকুল
বাঁচবার সাধ আজও; আমার নিজের লেখা কয়েকটি বই
থেকে যাবে কিছুকাল, মরণের পরে শুধু শূন্যতা অথই।
আমার মৃত্যুর পরে কোনওদিন তুমি র্যাপক
থেকে খুব আলগোছে নেবে তুলে
আমার পুরানো কোনও বই, অনেকেই যাবে ভুলে।
কোনও, পংক্তি, চিত্রকল্প অথবা উপমা
চকিতে তোমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে, প্রিয়তমা,
তোমার স্মৃতিকে দেবে ভিজিয়ে ক্ষণিক বৃষ্টিধারা; বুঝি তাই
বার্ধক্যের কালো বারান্দায় উবু হ’য়ে চুপিসাড়ে লিখে যাই
আজও কিছু পংক্তি, ফাটে সময়ের বিচিত্র বুদ্বুদ্
ক্রমাগত; অতৃপ্তির কারাগারে নিদ্রাহীন নিই ঘুমের ওষুধ।
২২।৪।৯১
কাল এবং আগামীকাল
আমার ক্ষণকালীন দাঁড়ানো সিঁড়ির ধাপে
তুমি উপরে কপাট ছুঁয়ে চৌকাঠে পা রেখে
কোথায় স্পন্দমান মুহূর্তগুলো
শূন্যতা ভূতুড়ে কুকুরের মতো চাটে আমাকে
মনে পড়লো তোমার চোখ পথ চলতে
পানির ঝাপটা লাগা দু’টুরো কাচ
শানবাঁধানো ফুটপাতে নয়
হেঁটে যাচ্ছি জলাশয়ের উপর পা ফেলে
ফ্ল্যাটে প্রত্যাবর্তন বিমর্ষ মনে
চার দেয়াল রক্তবমি করে বার বার
বুকশেলফের বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস
জানালার পান্ডুর গাল বেয়ে টপটপ অশ্রুপাত
জ্যান্ত কবর দিচ্ছি আবেগকে অলক্ষ্যে
অথচ ছটফটে মনে
কী-যে ঘটে তোমাকে ঘিরে আবেগ জিন্দা আবার
বানাতে শুরু করি তোমার জন্য জ্যোৎস্নার তোরণ
এই মুহূর্তে কেউ কি জানে
তোমাকে ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না
একবার শুধু একবার এসে দেখে যাও তোমাকে
কীভাবে বেঁধেছি আলিঙ্গনে বুঁদ হ’য়ে তোমার ঘ্রাণে
নিজের সঙ্গে নিজের ফেরেব্বাজি
একে বলা যাবে না
এসো দেখে যাও আমার রক্তের জোয়ারে
তোমার চিৎ সাঁতার ডুবসাঁতার
অসম্ভব তোমার ঠোঁট থেকে
আমার ওষ্ঠ বিচ্ছিন্ন করা
কে আছে এমন তোমার ছায়াকে আমার সত্তা থেকে
নেবে ছিনিয়ে
আবার দ্যাখো আমার উদ্বাস্তু হাত পায় না খুঁজে
তোমার কোমরের বাঁক উরুর মালভূমি
আমার আঙুল তোমার ঝল্সে-ওঠা শরীরে সন্ধ্যভাষায়
রোজনামচা লিখতে উন্মুখ
ঈদের চাঁদের মতো তোমার ভুরু
সেই সেতু যেখানে আমার আত্মার নিত্যদিনের
আসা-যাওয়া তোমার হাসি গতকাল
এবং আগামীকালের মধ্যে ঝরন্ত তারা।
৪।৫।৯০
কালবেলার সংলাপ
সুজাতা। কতকাল অন্ধকার আমাদের শাসাবে, গৌতম?
বলো, আর কতকাল? কেবলি হোঁচট খাই, ভয়
পাই প্রতি পদক্ষেপে; দূরন্ত বইলে হাওয়া, ভাবি-
এই বুঝি এলো তেড়ে মাস্তানের দল, পথ খুঁজি,
চৌকাঠে কপাল ঠেকে, পায়ে কালো পাথরের ভার।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত যেন আমি, পারি না কোথাও ছুটে
যেতে, এই অন্ধকার এত বিষ লুকিয়ে রেখেছে
নিজের থলিতে, আগে কখনো জানিনি। ভয় যাপি
সর্বক্ষণ; হবে কি সন্ত্রম লুট? হবে কি বিলীন
হলমায়্য সিঁথির সিঁদুরচিহ্ন? গৌতম, আমায়
বলে দাও। ওই শোন, ‘গৃহস্থের ঘোর অমঙ্গল’
শব্দ ছুঁড়ে উড়ে যায় ছন্নছাড়া পেঁচা।
গৌতম।
বিচলিত
হয়ো না সুজাতা অন্ধকার অধিপতি নয়, কিছু
আলো আমাদের অস্তিত্বের দিকে ঝুঁকে আছে আজো
গাঢ় চুম্বনের মতো; আছে সম্প্রীতির চন্দ্রাতপ।
সুজাতা। না, গৌতম, আশঙ্কার ভূতপ্রেত কী ভীষণ নাচে;
বাঘ-ভালুকের ভয় নেই, বিষাক্ত সাপের চেয়ে
ঢের বেশি বিষধর মানুষ এখন। আমাদের
বসতবাড়িকে ওরা বানিয়েছে চিতা; স্বপ্নগুলো
ভস্ম হয়ে ধূলায় মিশেছে। অসহায় মানবতা
কাঁটার মুকুট প’রে নুয়ে থাকে ক্রুশ কাঁধে নিয়ে;
অনেক হৃদয় আজ লাঞ্ছিত গোলাপ দিগ্ধিদিক।
গৌতম। থাক থাক সুজাতা, আগুনে ঘর পুড়ে গ্যাছে, যাক;
আত্মাকে পুড়িয়ে খাক করে দেবে এমন আগুন
নেই কোনো উন্মত্ত মশালে। বর্বরের হুঙ্কারের
মধ্যে জেগে থাকে কিছু মানুষের দীপ্ত বাণী, থাকে
তাদের গভীর চালচিত্র, যারা কখনো ধর্মের
অন্তরালে অধর্মের বাঘনখ সযত্বে পোষে না,
যারা ধ্যানে ও মননে মনুষ্যত্বকেই করে ধ্রুবতারা
চিরকাল। সুজাতা তোমার দুটি রাঙা পদতলে
চুমু খায় পুণ্য দুর্বাদল, তোমার আঁচল
ধরে রাখে চারাগাছ, মুখ ছোঁয় জবা। পুনরায়
নতুন আকাঙ্খা নিয়ে এসো ঘর বাঁধি দুজনায়।
ঘাতক শানাক তার ছুরি, মাথা নত করবো না,
শেখাবে বাঁচার মন্ত্র চিরদনকার পূর্বপুরুষের মৃত্তিকায়।
সুজাতা।। এসো হাতে হাত রাখি পূর্বপুরুষের মৃত্তিকায়,
ভাঙাচোরা স্বপ্নসমূহকে ভালোবেসে জড়ো করি।
২১।১১।৯০
কেমন বেঘোরে নিমজ্জিত
প্রকাশপ্রবণ ষড়ঋতুতে এবং ঘোরলাগা
আত্মাদর্শী; ‘হায় নিস্তব্ধতা, হায় নিস্তব্ধতা’ ধ্বনি
দিয়ে চক্রবাল ছুঁই। দূরবর্তী গোচারণ ভূমি, নদীতীরে,
ত্রস্ত পক্ষীযূথ, পথরেখা ক্রমশ ভৌতিক; যদি
এক হাঁড়ি নিথর দধির মতো চাঁদ হাতে এসে
ডাগর আহ্লাদ হতো, করজোড়ে দাঁড়াতাম আকাশের নিচে।
বস্তুত আমার কোনো পূর্বজন্ম নেই, তুব কেন
স্মৃতি এরকম জাতিস্বর? তেজী জ্যোৎস্নাবিচলিত
দীঘির প্রাচীনতায় পূর্বপুরুষের ছায়াবৎ প্রতিকৃতি
দেখে গরীয়ান; খুঁজি কার পাণ্ডুর অধরে শ্লোক
বিচ্ছুরিত, কার হাতে অচিন প্রকাশক্ষম এক
খাগের কলম শোভা? হায়, দীঘির রহস্য গূঢ় ঘনীভূত।
বিসদৃশ ধারাবাহিকতা মরীচিকা; হয়তো বা
জরাবৃত, অন্ধকার বাসগৃহে আগরবাতির
মোহাচ্ছন্ন ধোঁয়া, বিসর্পিল। বুঝি কারো পলকরহিত নগ্ন
চাহনিতে শিখা, তারার স্পন্দন, না-বুঝেই তাকে
অলোকসামান্য আপনার জন ভাবি আলিঙ্গনে।
চমকিত অতীতের ধূসরিত তবু মনোহারিত্ব অসীম
আপাতশোভন ডালা খুলে দ্যাখে এ বদনসীব-
জমেনি সঞ্চয় কিছু; নির্বোধের মুখ ব্যাদানের
মতো শূন্যতার উপহাসে কী-যে কম্পমান ক্ষয়িত শরীর।
হৃদয়ের তন্তুজালে মুণ্ডুহীদের তড়পানি;
‘সাড়া দও মেধা, শিল্প’ ব’লে নিঃশব্দ চেঁচাই;
গলার ভেতরে ধুলো, ছাই ওড়ে, রুদ্ধ ফিনিক্সের জাগরণ।
ঘাসঢাকা সিঁড়িতে নিবিষ্ট বসে ডায়েরিতে ঝুঁকে
পড়ন্ত বেলায় কিছু পংক্তি রচনার ধ্যানে থাকি,
শরীর হাওয়ার চাপে হৈমন্তিক স্বপ্নের ধনুক, ছিলা শত
টুকরো, তালু ফুঁড়ে বিষপায়ী কাঁটাতার, অকস্মাৎ
ছন্নছাড়া ঝড়, কালীদহে তোলপাড়, অবসাদ।
খসে যায়, অস্থির আঙুল থেকে কলম কেবলি খসে যায়।
এই আমি বানিয়েছি এসব অক্ষর? তবে কেন
এমন অচেনা লাগে? পংক্তির ভেতরে অন্য পংক্তি
সোহাগকাঙাল মদ্যপের মতো ঢুকে পড়ে। আমার স্বাক্ষরে
অন্য কারো স্বাক্ষরের অদ্ভুত আদল; দৌড়ে যাই,
জংলী লতাগুল্মে পা আটকে পড়ে থাকি, ন্যাবাধরা;
কেমন বেঘোরে নিমজ্জিত অবচেতনের মেঘময়তায়।
২৯।১০।৯০
খাকের পুত্তলি
মুর্গীর ডিমের মতো মোতির তালাশে পেরেশান
হইনি কখনো কিংবা লোকশ্রুত কোহে নেদা কাকে
বলা হয়, দানবের জান কোন পরেন্দায় থাকে
লুকানো, এসব প্রশ্ন নিয়ে আজ আর লবেজান
হই না; হৃদয়ে পূর্ণিমায় নামে কোটালের বান।
কোনো কাজে কামেয়াবি প্রার্থনায় খোদার আরশে
নুয়ে-থাকা ফেরেশতার চাইনি মদদ; রসে বশে
থাকার মুরোদ নেই, রমণীর প্রতি নেই টান।
ফেরেশতা তোমরা ভায়া খোদার রোবট বিলকুল;
ক্ষুধা আর তৃষাহীন; নিঃসীম অনন্তে শুধু জপে
যাও নাম; আমার এ বুকে লগ্ন বেদনা-করবী
সকল সময়, যার রঙে সকলেই মশগুল।
স্বেচ্ছায় দোজখে সেই কবে নিজেকে দিয়েছি সঁপে;
খাকের পুত্তালি, তবু পবিত্র আতশে গড়া কবি।
৩০।৪।৯০
গায়ে হলুদ
এই যে হলুদ রঙ বাড়িময় তরুণ তরুণী,
শিশুদের মাতিয়ে রেখেছে, তোমাকেও ক্রমাগত
আমার নিকট থেকে দূরে নিয়ে যাবে, বহুদূরে।
মনে পড়ে, এতটুকু তুমি চোখ বোজা, জননীর
পাশে শুয়েছিলে হাসপাতালের ধবধবে বেডে।
হঠাৎ তোমার কান্না শুনে চম্কে উঠেছিলাম
গোধূলিতে; ক’বছর পরে খুব ভোরবেলা তুমি
মৃত পোষা পাখিটাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় একা
বসেছিলে, চোখে অশ্রুজল সে কথা ভুলিনি এই
বয়সেও; হে আত্মাজা, আজ গায়ে হলুদ তোমার।
কান্নায় উথলে ওঠে অগোচরে সারা বাড়ি হৈ- চৈ
আনন্দের অন্তরালে, আমার নিজের কান্না মেশে
বারান্দা, রেলিং সিঁড়ি, আলমারি, বুক শেল্ফের
সারি সারি বই আর টেবিলের চোখের পানির
সঙ্গে বুক যেন হু হু খাঁচা। হৃদয়ের এত কাছে
ছিলে, কত দূরে চ’লে যাবে। মনে হয়, বহু শ্রুত
লোক কাহিনীর কোনো অধ্যায় উঠছে ভেসে আর
সারা বাংলার গায়ে হলুদ মাখছে একে-একে
সবাই আজকে কনে-দেখা আলোয় গানের সুরে,
আমার অন্তরে বিস্মিল্লাহ্ খান ডুকরে ওঠেন।
১৮।২।৯১
চার অধ্যায়
১
বাল্যকাল এখন বিশ্রাম করে কার করতলে
পক্ষী শাবকের মতো? নাড়ী-ছেঁড়া তাজা কান্না, দোলনা অথবা
ঘুম পাড়ানিয়া গান, স্তন্যপান, টবে গোসলের
স্মৃতি নেই; সহজ পাঠের রাঙা পথ,
গণিতের কাঁকর ছড়ানো পথ, ছড়ার মায়াবী ঘাট, কিছু
টক ফল, বৃষ্টির বিকেলে খোলা মাঠে
ছোটাছুটি, জ্বরোভাব নিয়ে দেখা চিলের চক্কর,
হাজ্জামের চকচকে খুরস্পৃষ্ট শিশ্ন থেকে রক্ত ঝরা হলুদ কাপড়ে-
মনে পড়ে বেলা অবেলায়।
মেলায় হারিয়ে-যাওয়া বালকের মতো গোধূলিতে
আমার বিহবল চোখে অশ্রুজল, জিভে লোনা স্বাদ, কতিপয়
অচেনা জিজ্ঞাসু লোক দাঁড়ানো আমাকে ঘিরে আর
ক্ষুৎপিপাসায় নিত্যসঙ্গী পরম নির্ভরশীল মরমিয়া একটি গর্দভ।
২
আজ নয়, রৌদ্রময় দুপুরপ্রতিম দূর যুবা
বয়সে সুগন্ধি ঘুমে স্বপ্নের নগরে হেঁটে হেঁটে,
সরোবরে ডুব দিয়ে, চুমো খেয়ে পাষাণ পুরীর
কোনও বিলাসিনী কিংবা অরণ্যবাসিনী যুবতীকে
জেগে উঠে দেখি, স্বপ্নচ্যুত শরীর জ্বলছে দাউ
দাউ-এই অগ্নি কোনও দেবদূত নাকি ইবলিস
দিয়েছে ছড়িয়ে শিরা উপশিরা জুড়ে? প্রশ্ন আজও
প্রশ্ন রয়ে গেছে ধু ধু, অপরূপ সাগ্নিক প্রহর
আমাকে প্রতিভাবান বানায় এবং পায়ে পায়ে
কে যেন নিঃশব্দে ঘোরে খাদ্যন্বেষী কুকুরের মতো।
নিয়ত অর্চনা করি রঙিন কুয়াশামোড়া কাকে?
ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি নিভে যায় স্বপ্নাদ্য আগুন।
৩
এখনও কল্পনা করি, সে ভালই আছে; থাক। কেন থাকবে না?
‘না, সে ভাল নেই,’ ব’লে যায়
দুপুরের রোদপোড়া পাখি। পাখি আমার কল্পনা
ডানায় জড়িয়ে নিয়ে মেঘ পাড়ি দেয়
জগৎ সংসার
বিষয়ে নিঃস্পৃহ, উদাসীন। দোতলার ঘর থেকে তার মুখ
ভেসে ভেসে চলে আসে আমার নিবাসে,
বলে ঠোঁট নেড়ে,
‘কেন বৃথা আমাকে তোমার কল্পনার
চোর-কুঠুরিতে বন্দী ক’রে
‘রেখে দিতে চাও? শোনো, আমাকে আমার
হালে ছেড়ে দাও; সন্তদের বুক-ছেঁড়া গান আসমান ফুঁড়ে
জল হ’য়ে ঝরে খরাক্লিষ্ট দীর্ণ মাঠে। তার মুখ
সিনেমার অন্তিম দৃশ্যের মতো শূন্যতায় মেশে।
৪
তুমিতো আসো না, তবু তোমাকেই মন্ত্র জ’পে জ’পে
ডেকে আনি খাতার পাতায়;
আমার ধূসরতায় আমি আছি, তোমাকে সাজাই
নানা রঙে সারা বেলা, বস্তুত পাঠিয়ে দিই সুখের দিঘিতে,
সেখানে সাঁতার কাটো, জল ঝরে চুল,
বাহু, গ্রীবা, স্তনচূড়া থেকে অবিরল,
হঠাৎ কোত্থেকে এসে কেড়ে নাও খাতা, বাক্যময় সে কাগজ
কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলো। তোমার চুলের
ঝাপটে বিমূঢ় আমি সুরদাস হই। তবু প্রস্তরিত চোখ
তোমার ভেতরকার অদৃশ্যকে দেখে নিতে চায়।
১০।১০।৯১
চুল টুল ঠিকই থাকে
চুল টুল ঠিকই থাকে, প্রতিদিন ব্লেড চষে গাল
দস্তুর মাফিক আর পোশাকও দুরস্ত বটে, ছেঁড়া
কাগজ অথবা নুড়ি কড়াই না রাস্তা থেকে, ডেরা
বেঁধেছি অনেক আগে, নই আমি বেহুঁশ মাতাল।
এ-কথা কবুল করি, বারংবার আকাশ পাতাল
এক হয় শব্দের তালাশে। যদি বলে, ভুলঘেরা
জীবন আমার, তবে কস্মিকালেও চুলচেরা
তকরারে হব না প্রবৃত্ত, খুশি থাক মেষপাল।
কারো সাতে পাঁচে নেই, তুব ওরা ধিক্কারের থুতু
ছিটোয় আমার মুখে। যেন সব কামেল ফকির
চারপাশে গিজ গিজ করে আর সকলেই নেক-
বান্দা আমি ছাড়া, প্রায়ই ফক্কড়ের কাতুকুত,
ইতরামি সহ্য করি! সেজে থাকি মূক ও বধির;
কলিজা দিইনি ছিঁড়ে, তবু আমি দিওয়ানা আশেক।
২৯।৪।৯০
জন্তু
কেন এই জেঁকে-বসা জন্তুটিকে ঘাড় থেকে পারি না নামাতে
কিছুতেই? আরশোলা, শুঁয়ো পোকা নয়
ঝেড়ে ফেলে দেবো
অথবা ফড়িং নয় মৃদু টোকা দিয়ে
নিমেষে উড়িয়ে দেবো, যেমন কামিজ থেকে ধুলো।
‘এবার সরিয়ে নাও তুষারের আস্তরণ’, যত
বলি তাকে, তত সে ছড়ায় হিম, এমন নাছোড়
পুরানো ত্র্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে পার্কে, চিড়িয়াখানায়
যাওয়ার বাসনা নুড়ি হ’য়ে প’ড়ে থাকে গৃহকোণে, ট্যাপ খুলে
পানি খাওয়া কিংবা চুলে চিরুনি চালানো,
এমন কি কবিতার বই চেখে দেখা
ক্লেশকর মনে হয়। দরজা না ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকি, বাতি জ্বালাবো কি জ্বালাবো না ভাবি বহুক্ষণ,
যেনবা আটকে আছি ঊর্ণাজালে; এদিক ওদিক নড়াচড়া
সাধ্যাতীত। জন্তুটির মুখোমুখি সোফায় ঝিমানো
চিন্তাহীন, বিছানায় শুয়ে-থাকা আমার নিয়তি?
দুঃস্বপ্ন শাসায় মধ্যরাতে একনায়কের মতো,
আমাকে পোড়ায় জ্বরোভাব নিত্যদিন;
সকল যৌবনগাথা শৌচাগারে খাচ্ছে লুটোপুটি।
জন্তুটি বেজায় জবুথবু, তুব তাকে
কমলালেবুর রস, হরলিক্স দেবো না কখনো। ‘যাও তুমি,
এক্ষুণি বেরিয়ে যাও’, বলি উচ্চস্বরে, অথচ সে
নির্বিকার ব’সে ব’সে লোল ঠোঁট চাটে।
১৩।১১।৯০
জবাবদিহি
শীতসন্ধ্যায় একা-একা হেঁটে যাচ্ছিলাম ফুটপাতে
সুপার মার্কেটের ধার ঘেঁষে। কোথাও
জনমানুষের সাড়া নেই; দোকানপাট, পেট্রোল পাম্প,
ঘরবাড়ি, লেক, গাছপালা
সবকিছু ভারী নিদ্রাতুর। একস্মাৎ কী-যে একটা
ছুঁয়ে গেল আমাকে।
চমকে দেখি, কেউ কোথাও নেই, বাতাসও নয়
সঞ্চরণশীল; আমার ভেতর
এক কম্পন, গুনীর আঙুলে সেতারের তার।
কিছু কথা আমাকে স্পর্শ করার বাসনায় কম্পমান।
শহদীদের কি স্পষ্ট কোনও কণ্ঠস্বর আছে?
কোন্ ভাষায় কথা বলে ওরা?
যে ভাষায় ভাসমান মেঘের টুকরো শহুরে পথে
দাঁড়ানো বিরল গাছের পাতা, ডাগর
নদীর বাঁক অথবা কুয়াশা কথা বলে,
সেই ভাষাই কি ভর করে শহীদদের কণ্ঠহীন কণ্ঠে?
কী ওরা বলতে চায়? কান পেতে থাকি,
হাঁটার ছন্দ হোঁচট খায়। নক্ষত্রের গুলজার আড্ডায়
চোখ রাখি, ফিস্ফিসানি
গর্জন হ’য়ে ফেটে পড়ে ফুটপাতে, ভড়কে
থমকে দাঁড়াই। শহীদদের জোরালো কোরাস
শুনতে পাই, “পথচারী, জবাব দাও। আমাদের যারা
হত্যা করেছে দিনদুপুরে,
তাদের বিচার কেন ঘুমিয়ে আছে লাশকাটা ঘরে?
আমাদের স্বপ্ন যারা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে বুলেটে,
আমাদের আপনজনের চোখ আজো ভাসছে শোকাশ্রুতে
যাদের তাণ্ডবে,
তারা কেন থাকবে বিভোর সুখনিদ্রায়?
জবাব দাও পথচারী, জবাব দাও।
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের, যারা
মৃত্যু-খচিত নক্শা তৈরি করেছে,
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের, যারা
আমাদের ঘরে ভ’রে দিয়েছে অন্তহীন মাতম।
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের,
যারা মনুষ্যত্বের গা’ থেকে তুলে নিয়েছে চামড়া।
জবাব দাও, কেন শাস্তি হবে না সেই অপরাধীদের?’
নিরুত্তর আমার দাঁড়িয়ে থাকা শীতসন্ধ্যায়
একঠায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবি,
শহীদদের একরোখা কোরাস আমাকে চাবকাবে
কতকাল? অসহায় কবিকে কেন করতে হবে জবাবদিহি?
শহীদদের কণ্ঠস্বর সহজে আমাকে
ছেড়ে যায় না, লেপ্টে থাকে প্রতিটি নিশ্বাসে,
আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেসব সড়কে,
যেখানে ব’য়ে গেছে প্রতিবাদী রক্তধারা।
জেগে গেছি, হত্যাকারীরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত
শহীদদের কণ্ঠস্বর পথচারীকে শান্তি দেবে না।
২৬।১।৯১
জাহাজডুবির পর
অকস্মাৎ বজপাত; বুকে লগ্ন তক্তা, ভাসমান;
ধুধু আসমান, ক্লান্ত দেহমন, কোথায়্য সৈকত?
ঢেউগুলি সর্পফণা; নিজ নাম অর্থহীন, কেউ
ডাকলেও পারবো না দিতে সাড়া। এখনও যে কোনো
হাঙর নেয়নি কেটে পা আমার, করেনি সাবাড়
অন্য কোনো জলচর প্রাণী, এ এক বিস্ময় ঝলমলে।
জালের সুতোর মতো কিছু স্মৃতি ঝুলে আছে, হাড়ে
তিন মাথা-অলা কুকুরের দন্তশলাকার ক্রমে
ভীষণ প্রবিষ্ট; মনে হয়, এক্ষুণি দু’হাত তক্তা
থেকে খ’সে যাবে আর পাতালের কবর হবে সেই
করুণ নাবিকদের মতো। রকমারি অছিলায়
নিজেকে জাগিয়ে রাখি, বার বার খুঁজি তীরভূমি।
জীবনের চেয়ে বেশি মৃত্যুর দিকেই যাচ্ছি ভেসে
একা, দ্রুত; আমার ব্যাকুল ডাক বুদ্বুদের মতো।
সঙ্গীদের আর্তনাদ মনে পড়লেই নিঃসঙ্গতা
অধিক দাঁতাল হ’য়ে ওঠে; হীনবল দুটো হাত
মর্চে-পড়া তরবারি, চোখে-মুখে লবণাক্ত ঝাপ্টা,
মাঝে-মাঝে ফেলে-আসা শহরের আলোর তামাশা।
গোধূলিবেলায় যদি প্রায়-মৃত ভেসে উঠি তীরে,
আবার বানাতে হবে জলযান বন থেকে কাঠ
কেটে এনে; কায়ক্লেশ সইবো সব স্মিত মুখে আর
খাটাবো স্পর্ধিত পাল পুনরায়। অভিযানে মেতে
তরঙ্গে সওয়ার হ’য়ে বাজাবো নিজস্ব দিলরুবা;
জীবন রেখেছি জমা সুরের গভীর মর্মমূলে।
২০।৯।৯০
জিন
আমাকে ধরেছে জিন, মনে হয়, ঘন সন্ধেবেলা,
যখন ছিলাম শুয়ে অন্ধকার ঘরে। কলিজার
ভেতরে চিৎকার শুনি, যেন কোনো লাউডস্পীকার
মাতমের প্রতিধ্বনি। জ্যোৎস্না নাড়াচাড়া প্রিয় খেলা
ঝুলে-থাকা বারান্দায়; নেচে বলি, ‘আমি কার চেলা?’
আসলে কারোরই নই, অবহেলে বিষাক্ত কাঁটার
উপর কখনো হাঁটি, কখনো-বা জলন্ত অঙ্গার
হাতের তালুতে নিয়ে কাছে পিঠে ছুঁড়ে মারি ঢেলা।
কোথায় শক্তির উৎস আমার, জানি না। জাদুগর
ব’লে নেই পরিচিতি, উন্টাপান্টা ক’রে কত কিছু
হো-হো হাসি, আমি অন্য কারো দৃষ্টি আর কণ্ঠস্বর
পেয়ে যাই রাতারাতি। দর্পণ নাদান, মুখ নীচু;
কপোতের ঘাড় ভেঙে ব’সে থাকি একা, গমগীন,
হঠাৎ উল্লাসে মত্ত আমার ভেতরকার জিন।
২৯।৪।৯০
তা হ’লে নির্ঘাত বজ্রপাত
আমাকে কি ছেড়ে যাবে সে হঠাৎ এই গোধূলিতে?
তা হ’লে নির্ঘাৎ বজ্রপাত,
পুড়ে হব ছাই; ভয়ে-ভয়ে থাকি দিনরাত। নিদ্রাহীন
কত যে প্রহর কাটে; চোখে চোখে রাখি
তাকে, রক্ত শুষে তৃপ্ত থাকে। তবু তার ছলনার
অন্ত নেই, আমার নিকট স্পষ্ট দাবি করে সন্তের জীবন।
মাঝে মাঝে কী এক খেয়ালে চলে যায়, মিশে যায়
হাওয়া, দেয়ালে মাথা ঠুকি
বার বার; আহার রোচে না মুখে, ঝুঁকি নিয়ে যাই
উত্তপ্ত তামাটে পথে, জলাভূমি আর
খাদের কিনারে খুঁজি তাকে, খুঁজি সাপের ফণায়;
এভাবেই পরমায়ু-পুঁজি দ্রুত শেষ হতে থাকে।
‘দাঁড়াও, আমাকে বর্জ্য ভেবে কুম্ভীপাকে
ফেলে যাও কেন, আমাকে কি করেছে দখল কুষ্ঠ’,
বলতে পারি না তাকে অভিমানে। কী এক ভাটার
টানে চলে যায়, যেন তার
ঘুঙুরবিহীন পদযুগ কোনোদিন নেচে নেচে
এই বোবা দেয়ালকে করেনি সঙ্গীত।
এরকম অন্তর্ধান তার কতবার,
রাখিনি হিসের; উদ্বেগের কাঁটা বুকে নিয়ে শুধু
মুহূর্তে, মিনিট, ঘন্টা চিবিয়ে খেয়েছি,
এবং নিদ্রার রেণু চোখ থেকে সরিয়ে প্রচ্ছন্ন দরজায়
আমার দু’চোখ শত চোখ হ’য়ে গাঁথা,
যদি তার ছায়া এসে বলে, ‘ওঠো।‘
৪।৪।৯১
তার আসতে-থাকা
প্রত্যুষে নীড়াশ্রয়ী পাখির ডানায়
শস্যদানার মতো ঘুম ভানার উপর দিয়ে
আলোর উন্মীলনের মধ্য দিয়ে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
নিঃশব্দতার বেড়ি ছুঁড়ে ফেলে
ট্রাফিকের কর্কশতায়্য পা ডুবিয়ে
ভর দুপুরে পথচারীর এক বুক তৃষ্ণায় ঢেউ তুলে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
পাতার মর্মর ধ্বনিকে সঙ্গী ক’রে
অপরাহ্নের আয়েশী রোদের মসলিনে পা ফেলে
কোকিলের গান-চিহ্নিত পথে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
এক নাগাড়ে আপন সৌন্দর্য বলয়ে ঘুরে ঘুরে
সন্ধ্যার সীমানায় নিজেকে ঝংকৃত ক’রে
জোনাকির মালা গলায়
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
নিঃসঙ্গতার পিঠে সওয়ার হয়ে
কত ছায়ার ফিসফিসানি গায়ে মেখে
আমার নিদ্রাহীনতাকে মন্থিত শিহরিত করে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা।
২৩।১০।৯০
দুই বুড়ো
একজন জেদী বুড়ো অন্য এক বুড়োকে বিছানা
থেকে টেনে তুলে
বলে, ‘চল যাই, এই বিকেলের রঙ
মগজের অভ্যন্তরভাগে
ভ’রে নিয়ে আসি, চল যেখানে যুবক যুবতীরা
গল্প ক’রে, তর্ক ক’রে ভালবেসে সময় কাটিয়ে
দেয়, আজ সেখানেই যাই। তবু তাকে আলসেমি,
অবসাদ ধ’রে রাখে ঘরে।
‘শোনো বন্ধু,’ চটপটে বুড়ো অন্য বুড়োটিকে
বলে অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বরে, ‘বসো গিয়ে
লেখার টেবিলে
এখনই, নচেৎ কবিতার ছুটিষ্কাল কাটবে না
কস্মিকালেও, দেখছ না
বাঁধানো খাতার সাদা পাতাগুলি খরা
পীড়িত চোখের মতো তাকিয়ে রয়েছে
প্রতীক্ষায়, না হয় লিখেই ফেলো চিঠি দয়িতার কাছে।
‘কে দয়িত? কে আমাকে তার যৌবনের
সরোবরে ডুব দিতে দেবে
অবেলায়? কে আছে এমন এ শহরে
বৃদ্ধের চুম্বন আর আলিঙ্গনে পাবে সুখ, আমার ভেতরে
জাগিয়ে তুলবে যুবককে?’ অবসাদগ্রস্ত বুড়ো
নিশ্চুপ ঝিমোয় নিশ্চেতন অন্ধকারে, ডোবে মৃত্যু ভাবনায়। জেদী বুড়ো
প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে সুহৃদকে নিজেই বৃদ্ধের
ভেতরে প্রবেশ করে। পাতা ফুঁড়ে আদিম কোকিল স্বতঃষ্ফুর্ত ডেকে ওঠে।
দুপুরে ব’সে
দুপুরে আছেন ব’সে শিমূলের ডালে একজন
পাখি আলেমের মতো। মনে হয়, এখনই ওয়াজ
করবেন শুরু স্মিত কণ্ঠস্বরে। তার সে আওয়াজ
বুঝিবা গচ্ছিত কল্যাণের জন্য; চকিতে বিজন
পথ স্নাত সুরে আর দুপুরের জরির বসন
ঝলমলে, কম্পমান। দশদিক কী মোহন সাজ
পরে, পান্থ কবি চমৎকৃত নৈসর্গিক কারুকাজ
দেখে; শূন্যতায় কবিতার বীজ করেন রোপণ।
একদিন মৌতের গুহায় তাকে চ’লে যেতে হবে
অনিচ্ছায়; প্রতিধ্বনি, মেঘের নেকাবে-ঢাকা চাঁদ,
বান্ধবীর মেধাবিনী চক্ষুদ্বয়, হ্লদের আহ্লাদ
ক্রমশ বাজতে-থাকা টেলিফোন, বারান্দার টবে
প্রষ্ফুটিত গোলাপ-কিছুই পারবে না আটকাতে,
অসিত ডানায় ঢেকে মৌত পৌঁছে দেবে আখেরাতে।
৩০।৪।৯০
দ্রাক্ষাবন
বেশতো এখন ঘরে গেরস্থালি নিয়ে আছ, আছ
ভিতর মহলে নিয়ে গুপ্তধন, দ্রাক্ষাবন। বেলা
যায় নানা তুচ্ছতায়, মাঝে-মাঝে পেকে ওঠে কোনো
নিটোল আঙুর, রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে খুব
নিরালায়; খিটিমিটি, বিসম্বাদ, আপদ বিপদ
তোমাকে সরিয়ে রাখে দ্রাক্ষাবন থেকে। এভাবেই
দ্বৈরথের মুখোমুখি। পোকা গুচ্ছ গুচ্ছ ফল কুরে
কুরে খায়, বুঝি তাই বিষাদের ছায়ায় ঘুমাও।
জাগরণে পৃথিবীকে তোমার নিকট কী রকম
মনে হয়? মৃত্যু নয়, জীবনেরই আকর্ষণে সব
বাধার পাথর কেটে হেঁটে যাও দ্রাক্ষাবনে একা।
বেশিদিন দেখব না তোমাকে এবং জানব না
আমার মৃত্যুর পরে কী হবে তোমার; আঙুরের
ফলন সবার বন্দনীয় হবে কিনা, জানব না।
১৬।২।৯১
ধ্বংসের কিনারে ব’সে
(১)
সূর্য, দেবতার মুকুটের মতো সূর্য, তুমি কেন
আজও তুল্লে মাথা, হায়, অন্ধকারে, হে মঙ্গলময়?
তুমি কি পাওনি লজ্জা এতটুকু এই দৃশ্যাবলি
দেখে, কেন চোখ অন্ধ হলো না তোমার? উপকূলে
প’ড়ে-থাকা রমণীর মৃত স্তনে তোমার সোনালি
চুম্বন দিয়েছ এঁকে কামুকের মতো দ্বিধাহীন;
দুধের বাচ্চার বুকে পারলে না জাগাতে স্পন্দন
জীবনের; কেন তুমি ফুঁসে-ওঠা বঙ্গোপসাগর থেকে সব
জল শুয়ে নাওনি সে রাতে সীমাহীন তীব্রতায়?
কোনও কথা না ব’লেই রক্তরঙ পাথর খন্ডের
ধরনে আবার ডুবে গেলে ভয়ঙ্কর হন্তারক
সমুদ্রের গর্ভ জলে। এ কেমন আত্মসমর্পন?
তাহ’লে কী ক’রে ব’লো আমার হৃদয়ে উঠবে জেগে
সূর্যস্তোর ধ্বংসের কিনারে ব’সে বিচূর্ণ বেলায়?
(২)
এই দেখ কে যেন জটায় বেঁধে সমুদ্রকে আজ
জলঢোঁড়া বানিয়ে রেখেছে, অগণিত চোখ মুখ
থেকে মুছে গেছে লোনা পানির হুষ্কার। জলরাশি
পারেনি ছিনিয়ে নিতে সপ্তর্ষিমন্ডল, জেলেদের
ডিঙি নাচে ঢেউয়ের চূড়ায় পুনরায়, বালকেরা
এক্কা দোক্কা খেলে আর সূর্যাস্তের কণা চতুর্দিকে
ছড়িয়ে দিগন্ত থেকে হাঁস নামে গৃহীর উঠোনে,
ন্যাংটো শিশু দাওয়া ছেড়ে ধাওয়া করে হাঁসের পংক্তিকে;
শিস দিতে দিতে গোধূলিতে হেঁটে যায় একা একা
উপকূলে স্বাস্থ্যবান, সাহসী যুবক, অন্তরালে
জাদু-বাস্তবতা-টানে দয়িতার খোঁপায় পরায়
হৃদয় রঙের ফুল। কৃষকের বুকে ধানচারা
গান হ’য়ে ধায় সমুদ্রের দিকে, জননী কিশোরী
মেয়েটিকে ডেকে বলে, ‘আয়, তোর চুল বেঁধে দিই।
১২।৫।৯১
না স্বর্গ না নরক
দীর্ঘকাল নরকবাসের পর যাব কি আবার দলে দলে
অন্য নরকের দ্বারে? নাকি
স্বর্গীয় বাতাস ছুঁয়ে যাবে? আশঙ্কার
ছুরি বিদ্ধ বুকে সারাক্ষণ। বার বার
স্বপ্নের কপোত সমুদয় পিশাচের পদতলে
ধূলি হয়ে গেছে। ছুঁড়ে-দেওয়া তেজাবের
দহনে ঝল্সে যাওয়া মুখ নিয়ে ফের
হেঁটে যাব চিরন্তন সবুজের দিকে।
অন্তত না স্বর্গ নরকে পেলে ঠাঁই শুদ্ধ হব
নদীতে সাঁতার কেটে খানিক সময়।
২৬।৩।৯১
পুরানো শহর
পুরানো শহরে আমি বস্তুত যাই না বহুদিন।
মনে পড়ে, একদা ছিলাম প্রাচীনতা ভালোবেসে
সেখানে; অজস্র বর্ষা ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে কত
অসমাপ্ত কবিতার মতো কথা ও কাহিনী, চিল
কেটেছে চক্কর আসমানে, রুগ্ন বালকের চোখে
বিচিত্র আল্পনা এঁকে; আজও ছন্নছাড়া গলি ঘুঁজি
স্বপ্নের ভেতর খুঁজি। দ্বিপ্রহরে অথবা বিকেলে,
রাত্তিরে আমার ডাক নাম ধ’রে ডাকে লুপ্ত মাঠ।
পুরানো গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে শৈশব অভিমানে
মুখ ভার করে থাকে; চৈত্র সংক্রান্তির কাটা ঘুড়ি
ভেসে ভেসে যায়, তবু ছোটে না পেছনে। বাতি-অলা
দেয় হাতছানি, চলে যায় গায়ে বিষন্নতা মেখে;
তোবড়ানো গালের বয়েসী শিল্পী ধুকছে যক্ষ্মায়,
মধ্যরাতে আর্ত কণ্ঠ ডেকে যায় কৈশোর, যৌবন।
৮।৪।৯১
প্রত্যাখ্যাত
এখন এখানে কেউ চেনে না আমাকে। দূর প্রান্তে প’ড়ে আছি
পালকের গৌরববিহীন ঈগলের মতো একা; যে সেতারে
প্রত্যহ উঠত বেজে রঙধনু, রৌদ্র-জ্যোৎস্না, স্বপ্ন সমুদয়,
তাকে স্পন্দনের দ্যুতি নেই। ভূলুণ্ঠিত,
আরশোলা নিত্যদিন। মাঝে-মধ্যে আমার ক্ষণিক
দৃষ্টিপাত, নিদ্রাতুর; চোখ
ফেটে পানি; বুকজোড়া হু হু দীর্ঘশ্বাস।
একদা মাথায় হাত রেখেছেন অনিন্দ্য ফেরেশ্তাগণ স্নেহে,
আজ তারা কোথায় উধাও? কী আমার
অপরাধ? কেন রুক্ষ আক্রোশে তিমিরে ছুঁড়ে ফেলে
আমার পরীক্ষা নিতে দিলেন গা’ ঢাকা
মেঘ-বাগিচায়? হায়, তবে কি নিষ্ঠুর,
আফলা জমিনে
ফসলের যৌবন আনার ব্রত এখন আমার? জলধারা
নেই, বুঝি তাই দিনরাত্রি এই শোণিত সিঞ্চন।
বর্বরের হুঙ্কারে, দাপটে ওষ্ঠাগত প্রাণ, প্রিয়
সুহৃদেরা বহুদূরে। বাচাল বৃদ্ধের
তিরস্কার জোটে নিয়মিত; স্বেচ্ছাচারী তরুণেরা
দেবে অর্ঘ অকাতরে, করি না প্রত্যাশা। আত্মলোপী
ঈগলের আচরণে নিভৃত চূড়ায়
আমৃত্যু থাকতে হবে নৈঃসঙ্গ্যের হিমেল ঝাপটে;
বেলাশেষে এই দন্ড সহজে নিয়েছি মেনে; রূঢ়
প্রত্যাখ্যানে অচঞ্চল, বিনম্র বিবাগী।
১২।১।৯১
বউ
বয়স ক্রমশ বাড়ে, বাড়তে থাকে মেঘে মেঘে, নানা
ঘাটে পদচ্ছাপ রেখে এই আনাগোনা। মুছে যাবে,
তবু দেখে নিই বার বার, সহজে কাটে না মায়া।
যেতে হবে, সকলেই যায়; তাড়াহুড়ো ক’রে যেতে
মন নয় রাজি, গোছাবার কত কিছু আছে বাকি।
প্রেমিকার কাছে যাই কখনও সখনও, নিরুপায়
দেখি তার নিরুত্তাপ অবহেলা। খেলাচ্ছলে বলে
মাঝে মাঝে-ইদানীং পদ্য টদ্য লিখি কি না, যেন
কোনও শ্রমনিষ্ঠ জেলে জালে তার মাছ টেনে তুললো,
না কি হা-পিত্যের ক’রে কাটে তার বেল। ধূলিম্লান
শরীর ক্লান্তির চাপ স’য়ে যায়, মন বড় জেদী,
তাকে ‘বউ’ ডাকে অন্তর্গত সবুজের টানে।
৫।১১।৯১
বাংলা শব্দতত্ত্ব
ভোরবেলা আমার প্রসন্নতার সঙ্গী
রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’, কিছুক্ষনের মধ্যেই
বই ঘরময় পাখির কণ্ঠস্বর,
ঘরের চতুঃসীমায় সুরের সোনালি পাড়
আর সুরের ভাঁজে ভাঁজে
বাংলা শব্দের রহস্য তন্বীর মতো
দেয় গড়াগড়ি। আমার সত্তায় হঠাৎ
মার্কোপোলের জাগরণ।
একেকটি বাংলা শব্দ আমাকে কী এক সম্মোহনে
কখনো অকূল সমুদ্রে,
কখনো দুর্গম অরণ্যে, কখনো মরুভূমি,
কখনো-বা মেরু প্রদেশের তুষার ঝড়ে আহ্বান করে আবার সেই আহ্বান
বিশাল জলচর প্রাণীর পিঠের মতো
পদ্মার চরে অথবা বিবাদরহিত মাছের গন্ধ লেপ্টে-থাকা
জেলেপাড়ায়, ঢাকার ঘিঞ্জি বস্তিতে
মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধ নোঙর-করা জাহাজের মতো কলোনীতে
আমার আমন্ত্রণের রেশমি নিশান।
যখন অভিভুত আওড়াই আনন্দ, আমার দৃষ্টিকে
আপ্লুত ক’রে উদ্ভাসিত
এক মধ্যবিত্ত ঘর, যেখানে ভর দুপুরে
আয়নার সামনে আঁচড়াও তুমি দীর্ঘ চুল,
গান গাও গুনগুনিয়ে;
সেই মুহুর্তে ইলিশের চকচকে মিছিল
ডাগর নদীতে কম্পমান ঝালর,
প্রজাপতির পিছনে
ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি।
যখন আমার নিঃশ্বাস সুন্দরের
ধ্বনির ধারক, মনে পড়ে
বারান্দায় তোমার দাঁড়ানো, হাতের রুলিতে
বিকেলের স্তব্ধ অসীমতা এবং
স্বৈরাচারের ভয়ঙ্কর মুখোশ-খশানো মিছিলে
অগনিত মুখ, শাড়ির আঁচল আর মুষ্টিবদ্ধ হাত।
যখন বিশালতা আমার ওষ্ঠে দপ দপ করে,
বাংলাদেশ সন্তান-হারা প্রসূতির মতো বুক খুলে
দেখায় আমাকে, আমি দু’চোখ ঢেকে ফেলি
আবহমানকালের অসংখ্য কাটা মুন্ডুসমেত রক্তপ্রবাহ দেখে।
চোখ খুলে দেখি, রবীন্দ্রনাথ
আমার হাত থেকে তুলে নিচ্ছেন ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’
এবং তাঁর সৌম্য হাতে একরাশ ফুল;
পুস্পগুচ্ছ শান্তিনিকেতনের না শহীদ মিনারের
ঠাহর করতে পারিনি।
শব্দের কাঙাল আমি, অন্ধের মতো আমার পথ হাতড়ানো।
২৫।১১।৯০
ব্যাজস্তুতি
একবার যে শোনে প্রকৃত গান, ভেসে যায় সুরে
সুরে দূর থেকে দূরে, তার জন্যে নয় স্বাভাবিক
জীবন যাপন আর কোথাও বেসুরো কিছু শোনা
দুঃসহ যন্ত্রণাময়, ভীষণ বেখাপ্পা লাগে সব।
সে কবে ছেড়েছি ঘর সুরের অমিত আকর্ষণে,
বর্ষণে অথবা খরতাপে, শীতে ও বসন্তে ঘুরে
ঘুরে বেলা গেছে, আনন্দে বিষাদে পৌঁছে গেছি ঠিক
প্রায় অস্ত গোধূলিতে, তবু কেন ব্যাকুলতা যাপি?
শুধু শোনা নয়, সুর সৃজনের দায় নিয়ে স্তব
করেছি অদৃশ্য আর অশ্রুতের; রহস্যের ঝাঁপি
খুলে লহমায় সর্পমণি দেখে নিয়ে তপোবনে
হেঁটে গেছি একা-একা, মরুধূলি মেখেছি আত্মায়।
এই পথে পড়ে চামেলীর ট্রাকপিষ্ট শব
কেমন বে-আব্রু, হায়। তবু রাধাচূড়া হাসে, মাপি
সঙ্গোপনে তার আহলাদের বহর এবং মনে
বেদনা লুকিয়ে নিরপেক্ষ চাঁদ মেঘে ডুবে যায়।
আমাকে খোঁজে না কেউ আর। লোকটার অন্তঃপুরে
কী কী ঘটে, সে কি অর্ধাহারে থাকে, না কি দিগ্ধিদিক
জ্ঞানশূন্য? পথ্য পায় ঠিকঠাক? সে কি আনাগোনা
করে চির দুঃখীরূপে? এ বিষয়ে সবাই নীরব।
জলকন্যাদের স্বপ্ন দেখি উপদ্রুত এলাকায়;
আমি কি ত্রাণের দ্রব্য চেয়ে নেব ভিক্ষুকের বেশে
দাতা দেবদূতদের কাছে? বিকৃতমস্তিষ্ক সাঁঝ
নামে আর জেগে ওঠে শবাহারী দুঃস্বপ্নের বন।
সর্বস্ব উড়িয়ে দিয়ে প্রখর হাওয়ায় অবেলায়
আকাশ, প্রান্তর, নদী আমাতেই করেছি ধারণ
অগোচরে, অথচ শাকান্ন সংগ্রহের আলোড়ন
গৌণ কাজে লিপ্ত রাখে, দুর্ভাবনা নিত্যসঙ্গী আজ।
আমি কি নিভন্ত খুব? নইলে কেন অতিশয় ক্লেশে
ধোঁয়াচ্ছে জীবন? এখনও তো সাধ হয় অকারণ
গান হ’য়ে জ্বলে উঠে। গলায় সুরের কারুকাজ
লুপ্ত বহুদিন; অপমানে দগ্ধ চলে যাব শেষে?
১২।৬।৯১
বড় বেশি বাইরে ছিলে
বড় বেশি বাইরে ছিলে, ঘরে ফেরা দরকার এবার।
এক গা’ ধূলোর সর, কায়ক্লেশ
দেহমনে ঊর্ণাজাল বুনে দিয়ে স্থির; মুখ ধুয়ে
নাও তাড়াতাড়ি, ফিরে পেতে হবে শুদ্ধতা। মুঠোর
নাছোড় কাঁকর সুমুদয়
ফেলে দাও, মৃত্যুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে,
ছুঁতে হবে বিশুদ্ধ গোলাপ। অন্তর্গত
ছাইচাপা সুরের ষ্ফুরণ চাই আজ।
টানা-হ্যাঁচড়া, ঠেলাঠেলি বারবর অকাম্য তোমার,
দুর্ভাগ্যজনক, তবু হয়েছ শিকার, অনেকেই
ডেকে নিয়ে নাকে মুখে
দিয়েছে জুতোর কালি মেখে; মাদল বাজিয়ে জোরে
রটিয়েছে অপবাদ। কুকুরেরা ঠ্যাঙ উঁচু ক’রে
ছিটিয়েছে প্রস্রাব তোমার গায়ে। শাখামৃগগণ
চৈতালী জ্যোৎস্নায়
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিকট লাফালাফি
করেছে অনেক, যাতে তুমি রাতারাতি
সহজে নাকাল হও। ফাঁদ পাতা আছে
সবখানে, বুঝে-সুঝে পা বাড়াও। ভাল হয়, যদি
ঘরে ফিরে কবিতার খাতা খুব কাছে টেনে নাও।
প্রকৃত সুফীর মতো মগ্ন হও অমোঘ শব্দের
অন্বেষণে; কবিযশঃ প্রার্থীদের নিকট তোমার
কানাকড়ি মূল্য নেই ব’লে আর বিষাদের ছায়ায় থেক না,
বাচালতা রাজত্ব করুক, তুমি বাক্সংযমে দীক্ষিত হও।
১৫।২।৯১
ভাস্বর পুরুষ
তুমি কি মিলিয়ে গেলে শূন্যতায় ভাস্বর পুরুষ?
না, তুমি নিদ্রিত দ্বিপ্রহরে;
যেন যুদ্ধ বিরতির পর কোনো পরিশ্রান্ত সেননী বিশ্রামে
ভরপুর। তোমার নিদ্রার মসলিন
কিছুতে হবে না ছিন্ন চিলের কান্নায়, প্রতিবাদী
মানুষের যৌথ পদধ্বনিতে অথবা
রক্তগোলাপের মতো পতাকার জাগর স্বননে,
জোয়ারের প্রবল উচ্চাসে।
তোমার নিস্পন্দ, প্রাজ্ঞ চোখের পাতায়
ঘুমিয়ে রয়েছে আমাদের স্বপ্নসমুদয় আর
অনেক আকাঙ্খাস্তব্ধ তোমার বাহুতে, শপথের
বাক্যগুলি নিদ্রিত ওষ্ঠের তটে পুনরায় জেগে
উঠবার প্রত্যাশায়। দশদিক থেকে
নম্র পায়ে লোক আসে অর্ঘ্য দিতে আজ
তোমারই উদ্দেশে হে নন্দিত কিংবদন্তি। সকলের
মাঝে ছিলে; কৃষক, মজুর, ছাত্র—সবার হৃদয়ে
করেছো রোপণ
মানবিক বীজ নিত্য কর্মিষ্ঠ চাষীর মতো। জাগো,
জেগে ওঠো স্বতন্ত্র মানব
পৃথিবীর রৌদ্রে ফের ঝেড়ে ফেলে মৃত্যুর তুষার।
ভাস্বর পুরুষ, সংগ্রামকে জীবনের সানসত্য
জেনে তুমি নিয়ত হেঁটেছো পথে। যেখানে তোমার পদচ্ছাপ
পড়েছে প্রগাঢ় হয়ে, সেখানেই সাম্যবাদ চোখ মেলবার
অভিলাষ করেছে প্রকাশ। কী ব্যপক মমতায়
তাকিয়েছো বার বার ভবিষ্যের দিকে। প্রগতির
প্রসিদ্ধ চারণ জাগো, জেগে ওঠে, চেয়ে দ্যাখো-
করোনি শাসন কোনোদিন তবু বাংলাদেশ আজ
তোমাকেই গার্ড অব অনার জানায়।
২।১।৯১
মগ্ন হও
নিজেই নিজেই বিরোধিতা করি ইদানীং আর
মাতি আত্মপীড়নে, অসুখে বিতৃষ্ণায় প্রায়শই
আহার রোচে না মুখে। ইতিহাস, তাবৎ দর্শন
মতিচ্ছন্ন; কবিতাও অভ্যর্থনাহীন, আলুথালু।
সন্ত্রান্ত পথিক হেঁটে গেলে রৌদ্রে, গাছের ছায়ায়
একা একা, অকস্মাৎ কুকুর চিৎকার করে ওঠে,
কখনো কামড়ে দেয়। মাঝে-মধ্যে জন্তুর জিহ্বায়
ধ্যানে জ্ঞানে ঝলসিত পংক্তিমালা লালাসিক্ত হয়।
এটাই ওদের রীতি। নিরর্থক উষ্মা, ক্ষোভ আর
বিষ্ফোরণ; মূঢ়ের অস্থির পদাঘাতে মেধাবীর
মাথা চূর্ণ হয় বার বার। হিংস্র কটুকাটব্যের
বদলে গভীরভাবে সুন্দরের মুখ তুলে ধরো।
যে যাই করুক তুমি দেহ থেকে কাদা মুছে ফেলে
রিল্কের মতোই কবিতায় নিত্যদিন মগ্ন হও।
১৮।৬।৯১
মৃতেরা কি করবে ক্ষমা
ক্রোধান্ধ দৈত্যের মতো গর্জে-ওঠা বঙ্গোপসাগর
ভয়ঙ্কর মধ্যরাতে লক্ষ লক্ষ দীন সংসারের
পায়ের তলার মাটি টেনে নেয়; হাহাকার ডোবে
তমসায়, জীবন ও ধর্মাধর্ম সমুদ্রে উধাও।
বুভুক্ষা-বিদীর্ণ নিঃস্ব মানুষেরা কাদায়, বালিতে
কিসের সন্ধানে ঘোরে? স্বজনের? কৃপণ খাদ্যের?
উদ্ভান্ত হৃদয়ে জ্বলে দাউ দাউ কান্নার আগুন
দিনরাত; গির্জের মোমের আলো বয়সিনী চোখে
নিয়ে ছুটে এসেছেন মাদার টেরেসা ছেঁড়া খোঁড়া
বাংলাদেশে। তিনি কি অপার করুণায় কোলে তুলে
কিংবা বুকে পারবেন জড়িয়ে নিতে লাশময় এই
দীর্ঘ উপকূলটিকে তাঁর নিবেদিত শুশ্রুষার হাতে?
চৌদিকে ‘কবর দাও’ আর্তনাদ, সৎকারবিহীন
মৃতেরা কি করবে ক্ষমা আমাদের মাদার টেরেসা?
৭।৫।৯১
যদি কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়
যদি কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়
এখন আমার দিকে, ‘বলো, তুমি কী বলতে চাও
আজকের জন সমাবেশে? এ দেশের
প্রতি কতটুকু ভালবাসা রেখেছ সঞ্চিত বুকে,
দিতে হবে তার
বিশদ প্রমাণ’, আমি রাঙা ধুলো ওড়া
পথ, গাছে চুপ ব’সে থাকা বাদামি পাখির দিকে
কেবল ছড়িয়ে দেবো বৃষ্টি, থাকব নিরুত্তর, একা।
ধানশীষ, প্রবাসী স্বামীর জন্যে রমণীর গাঢ় মমতার
মতো টলটলে দিঘি, পানি ছুঁই ছুঁই
ডাল ছেড়ে চকিতে উড্ডীন মাছরাঙা,
সন্ধ্যায় নির্জন ঘাটে মাঝিহীন নৌকোর গলুই, গোধূলিতে
নিঝুম লাঙল কাঁধে কৃষকের ঘরে-ফেরা, রাত্রির কুটিরে
কুপির আলোয় রাঙা কৃষাণীর মুখ,
কিশোরগঞ্জের পথে গাড়ি থেকে দেখে নেওয়া ছায়াচ্ছন্ন পানের বরজ
আমার হৃদয়ে তোলে ঢেউ আজ, এই বয়সেও।
শহরের ফ্ল্যাটের চূড়ায়
জেগে-থাকা পূর্ণ চাঁদ শোনায় পাঁচালি
শ্বেত স্তব্ধতার;
পিচের মসৃণ পথে গড়ানো কাগজ মধ্যরাতে,
এবং উদ্ভিন্ন রাধাচূড়া
কুণ্ঠিত গলিকে দেয় অন্য মানে। বাণিজ্যিক কোলাহল থেমে
গেলে মধ্যত্তির ঘরে ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ঝরে
সরোদের সুর আর ডাগর দুপুরে
বারান্দায় পড়ে থাকে সদ্য যৌবনের মতো, বন্দনীয় পলাশের লাল,
পথে আঁকা ডালিম গাছের ছায়া, দেখি
চোখ ভ’রে। এখন কোথায় যাব? দূরবর্তী মেঘমালা আমাকে বানায়
রাখাল নিভৃতে মাসোহারা ছাড়া, পথ থেকে পথে
চরাই স্বপ্নের পাল। থাক,
আর কোনও কথা নয়, স্বদেশ প্রেমের প্রতিযোগিতায় এই নিভন্ত বেলায়
খেলোয়াড়ি ভঙ্গিমায় চাপিয়ে রঙিন জার্সি গায়ে
মুখর পংক্তিতে দাঁড়াবার সাধ নেই, বিশেযত
যখন নিয়ত শুনি ভন্ড ভক্ত মন্ডলীর
বেলেল্লা আসরে
হে স্বদেশ, তোমার উদ্দেশে টগবগ ক’রে ফোটে
স্তুতির বুদ্বুদ।
ওদের বন্দনা থেকে শুধু অশ্লীলতা ভেজাল তেলের মতো
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে; ইচ্ছে হয়, বমি ক’রে ফেলি।
সে ভিড়ে আমার কোনো ভূমিকা থাকার
কথা নয়, আমি শুধু একা-একা কাকডাকা ভোরে,
নির্ঘুম রাত্তিরে
করে যাব অক্ষরের চাষ, হে স্বদেশ,
কিল, ঘুষি, লাথি যত খেতে হয় খাব,
তুমি এই অভাগার মাথায় নিভৃতে
রেখ হাত, তোমার গভীর নেত্রপাত
ঝরাক অমেয় স্নেহধারা।
৪।৭।৯১
যুবক যুবতী
পুরানো বাড়ির দোতলার ছোট ঘরে ওরা দু’জন শয্যায়
তুমুল মৈথুনে লিপ্ত যুবক-যুবতী। মুছে যায়
বারান্দা, পাশের ঘর, গোলাপের টব, গ্রন্থরাজি,
সপ্তর্ষিমন্ডল; নিদ্রামগ্ন গুরুজন,
শিশুরা স্বপ্নের কোলে রূপকথা শোনে।
জ্যোৎস্নায় বিভ্রান্ত কাক অকস্মাৎ ডেকে ওঠে, নারী
বাথরুমে যাবে, কাঁদবে কি? বিছানায় পড়ে থাকে
বিস্রস্ত চুলের ক্লিপ, যুবক বালিশে খোঁজে তার
ঘ্রাণ; বিচ্ছেদের কথা ভেবে হৃদয়ে প্রবল ঝরে
কী আর্ত শিশির, রাত্রি গাঢ় হয় আরও, উন্মাদের অট্রহাসি।
অনেক বছর পরে প্রৌঢ়তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যুবক
সুদূরের সেই যুবতীর
মৃত্যুর খবর শুনে এমনকি স্তন্তিত হবে না, উদাসীন
চলে যাবে ভালেরির কবিতার দিকে।
১।৪।৯১
যে পাখিকে আব্বা
সে এসে বসলো খোলা বারান্দায়
তাঁর সৌন্দর্য সকল বর্ণনার মাপজোককে
নাকাল করে
দৃশ্যমান আশ্চর্যের চৌহদ্দিতে কবিতাসদৃশ
নিখুঁত পক্ষী অস্তিত্বে আব্বার সেই কবেকার
লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলির ঝাপটার অস্পষ্ট দাগ
আমাকে উপহাসের খোরাক বানায়
কী ক’রে সম্ভব এত যুগ পরেও কী করে সম্ভব এই উপস্থিতি
খটকার কুয়াশায় আচ্ছন্ন আমি
একটি পুরানো কাহিনীকে নতুন ক’রে ঢেলে সাজাই
হঠাৎ মনে পড়ে আমাদের পরিবারের ওষ্ঠে
উড়ে বেড়ায় এক কুসংস্কারের কালো প্রজাপতি
মরহুম আব্বা তাঁর তল্লাটের নামজাদা পক্ষী শিকারী
শিকারে গিয়ে হরিয়াল বেলে হাঁস চখা আর
শোরখাবের রক্তাক্ত ভার হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরেননি
এমন কোনও দিনের কথা জানা নেই
পার্থ দৃষ্টির অধিকারী তিনি একবারই শুধু ফিরে এসেছিলেন
শূন্য হাতে গোধূলিতে যেদিন সবচেয়ে আশ্চর্য পাখিটি
তাঁর অনুপম দক্ষতাকে বিদ্রুপ ক’রে মেঘে উধাও
যদিও ছররার ধমকে বিচলিত
এখন আম্মা কখনও সখনও কণ্ঠে রূপকথার সুর এনে বলেন
আমাদের পরিবারে যত অঘটন ঘটে
সবকিছুর সঙ্গে জড়িত আব্বার দোনলা বন্দুকের
ফসকানো টিপ ঈষৎ আহত পাখির বেদনার ছায়া
পাখিটির মুখের কাছে
তুলে ধরি শস্যের দানা রুটির টুকরো
কিন্তু চঞ্চু উন্মোচিত হয়নি পানির পেয়ালাও স্পর্শ রহিত
আমার শুশ্রুষা প্রত্যাখ্যানে শস্যের খোসার মতো অসার
এসেছি তোমার হাতে গুলীবিদ্ধ হ’তে
পাখিটি বলে ভাবলেশহীন মানুষের কণ্ঠস্বরে
আমার শিরায় পিতৃরক্তের তোলপাড়
অথচ পক্ষীবধের তালিম আব্বার কাছহ থেকেও নিইনি
যে পাখিকে আব্বা শিকার করতে পারেননি
সে আবছা ক্রোধ এবং অভিমানের ছায়া থেকে
স’রে দাঁড়িয়ে আনন্দের স্বর্গীয় বিন্দু
এবং আমার কবিতায় চিরন্তনতার উদ্ভাসন
২৪।৫।৯১
যে-ঘরে আমার বসবাস
যে ঘরে আমার বসবাস, তার সঙ্গে সূর্যালোক
বেজায় কার্পণ্য করে। ফলত মনের ঘাটে বিষাদের ছায়া
প্রত্যহ বিস্তৃত হয়, যেন কেউ মৃত্যুর খবর
শোনাবার ব্যাকুলতা নিয়ে ব’সে থাকে সারাক্ষণ
আমার শয্যায় ঠিক মর্মর মূর্তির মতো; তাকে
হেলায় হটিয়ে দেবো, শিখিনি এমন মন্ত্র আজও।
কখনও কখনও সুন্দরীর রূপ ধরে, অধরের তাপ দেয়
আমার তৃষিত ঠোঁটে, বুকে
টেনে নেয় মোহন ভঙ্গিতে, অকস্মাৎ
বিস্মিত নিজেকে দেখি এক পিশাচীর আলিঙ্গনে
বিমূঢ় কয়েদী আর মুখের ভেতর
সীসার, দস্তার গন্ধ, মেরুদন্ড হিম হ’য়ে আসে।
মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নের শ্বাসরোধকারী চাপ থেকে খুব ঘেমো
অশক্ত শরীরে জেগে উঠি। পাশে নেই
জীবন সঙ্গিনী; সে এখন
হাসপাতালের বেডে। সফেদ হাঁসের মতো নিঝুম সেবিকা
হয়তো বড়ি দিয়ে তাকে ঘুম
পাড়িয়ে নিজস্ব ডেস্কে ব’সে দেখছেন হাতঘড়ি।
এখন যে নেই পাশে তার
অভাব কামড়ে ধরে নিয়ত আমাকে উন্মাদিনী
বেড়ালের মতো; মনে পড়ে ফুলশয্যা কবেকার, থরথর
বিবাহিত ঠোঁটে
প্রথম চুম্বন আর মিলনের উন্মথিত রাত;
অনেক বছর আগে রতিতৃপ্ত তার মুখে ভোরবেলাকার প্রসন্নতা
মনে পড়ে, প্রায় তিন যুগ আগে
প্রথমবারের মতো তার উদরের ষ্ফীতি, বিবমিষা, বমি;
অনন্তর একদিন ম্যাডোনার ধরনে নতুন
খাটে বসে থাকা পরিজনদের মাঝে,
সন্তানের দিকে স্মিত তাকানো এবং অন্তরালে
স্তন্যদান, কত দ্রুত কালো ঘোড়সওয়ার সর্বদা ধাবমান।
এইতো সেদিন গেল আরোগ্য নিবাসে, মনে হয়
কতিপয় শতকের হাওয়া ছুঁয়ে যায়,
আমার বুকের মধ্যে হৈমন্তিক ঝরা পাতাদের হাহাকার।
সে কবে আবার পার্শ্ববতী ধু ধু শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলবে
পরিচিত ঘ্রাণে আর আলোছুট ঘরে এসে বাদ বিসম্বাদে
আমাকে নাজাত দেবে পিশাচীর বাহুপাশ থেকে?
১৭।৩।৯১
লাল স্কার্ফ
ভোরবেলা কেউ জেগে ওঠার অনেক আগেই
বিজয়-উদ্যানের মাথায় পরিয়ে দেবো
একটা লাল স্কার্ফ
যা দেখে পথচারীরা পারবে না
ফিরিয়ে নিতে চোখ
থামতে ওদের হবেই বেশ কিছুক্ষণের জন্য
সেই লাল স্কার্ফ এমন একটি কবিতা
যার আটপৌরে হরফগুলোকে ছাপিয়ে
গভীর উপলব্ধির উন্মীলন
কিংবা যা’ সঙ্গীত সাধকের সুরাতীত সুর
আমার যৌবন এবং প্রৌঢ়ত্বের
বিভৃততম অনুভূতির নীলিমাকে স্পর্শ করা উচ্চারণ
অনেক বিঘাজেড়া বাদুড়-ছায়ার নিচে
হাওয়ায় দুলতে থাকবে
রক্তজবার মতো তাক লাগানো স্কার্ফ
পূর্বপুরুষদের হাসি উঠবে ঝলমলিয়ে
স্কার্ফটি বানিয়েছি বসন্ত আর
চিরন্তনতার রেশমি বসন কিঞ্চিৎ কাটছাট ক’রে
লাল স্কার্ফ কখনো
রক্তের ছোপ-লাগা হার কখনো রামধনু
অনেক মৃত্যুর নিস্তব্ধতার দুর্মর স্বপ্নতরঙ্গ
সেসব মৃত্যুর মধ্যে প্রত্যক্ষ করি নিজের মৌত
বুকের ভেতর বরফের বোবা চিৎকার আর
অনেকের নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় আমার বেঁচে থাকা
৭।৫।৯০
লড়াই
ডাকাত-মার্কা লোকগুলো আমার দু’হাত
বেঁধে ফেলছে, যাতে স্বপ্নের মতো নৌকো ভাসাতে না পারি নদীতে,
যাতে গন্তব্য হ’য়ে ওঠে অপ্রাপনীয়।
ওরা আমার গলা চেপে ধরেছে আজরাইলের ধরনে,
যাতে আমার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত
না হয় কোনও গান কিংবা কবিতার পংক্তিমালা,
যাতে আর নিশ্বাস নিতে না পারি।
ওরা আমাকে ক্রমাগত টেনে হিচঁড়ে পিছনের দিকে
নিয়ে যাচ্ছে গহীন জঙ্গলে,
আমার চুলের মুঠি জোরে
টানছে কেউ কেউ, লাথি মারছে পাঁজরে, মাথায়;
আমি তরুণ বাঘের মতো লাফিয়ে উঠে
এক ঝটকায় ওদের কব্জা থেকে মুক্ত হ’তে চেস্টাশীল।
১৮।২।৯১
শামসুর রাহমানের সঙ্গে
সে এখন বহুদূরে, একা একা থাকে সারাদিন,
এভাবেই বেলা যায় এবং ঈষৎ ভাঙা গালে
গজায় সফেদ তৃণ, নিয়মিত চুল ঝরে; হায়,
অবসিত দূরন্ত কেশর। বহুদিন
পর তার সঙ্গে দেখা করবার সাধ হ’লো। বাড়িতেই ছিল,
প্রায়-প্রেত, গানে-পাওয়া, খানিক বিব্রত।
‘এখন কেমন আছ,’ শুধারেই, বলে সে হাসার
চেষ্টায় অধিক স্লান, ‘ভাল, বেশ ভাল, তুমি? কণ্ঠস্বরে
নিস্পৃহতা, যেন রুক্ষ সান্ন্যাসী, তবুও
তার খোল থেকে তাকে বের ক’রে আনার ইচ্ছায়
বলি, ‘ভাই চল যাই, কোথাও বেড়িয়ে আসি।‘ ভাবলেশহীন
দাঁড়ানো, প্রস্তাবে উদাসীন।
অনন্তর ব’সে থাকা; চা খাওয়া, অতীত
টেনে আনা লাটাইয়ের সুতোর মতন, লেখা না লেখার
অর্থহীনতায় নিমজ্জিত
কণ্ঠস্বর তার; বলে এক ফাঁকে ‘কবির, প্রতিভা
মুছে যায় হাজার হাজার মূর্খ আর উন্মাদের হট্ররোলে, অট্রহাসি
বেজায় নাকাল করে দরবারী কানাড়াকে আজ।‘
শুনি তার সমাচার আর
ভাবি, যাকে জানি স্বল্পবাক বরাবর,
সে কেন এখন এত বেশি কথা বলে
সূর্যোস্তের দিকে মুখ রেখে? কতিপয়
ক্ষিপ্র যুবা, জিনস্-এর ট্রাউজার, বুক-খোলা শার্ট, গলায় সোনালি চেন,
হোন্ডায় সওয়ার, ভুল স্লোগানের মোহে আত্মাহারা।
ব’সে আছি আমরা দু’জন মুখোমুখি; অন্ধকার
ডানা মেলে। ‘এইসব যুবা
আত্মপরিচয় ছিনতাই ক’রে মশগুল খুব, উপরন্তু
জন্তুর চেয়েও হিংস্র ভ্রাতৃহননের মহড়ায়
দক্ষতার চূড়া স্পর্শ করে, ওরা পিতৃঘ্ন সবাই।‘ তার কথা
পাথরের চাপ, অস্বস্তির কাঁটায় অস্থির হই।
এখনও কবিতা তাকে মাঝে-মাঝে পাঠায় মদির পত্রাবলী,
কে এক নিভৃত ডাক পিয়ন, উড্ডীন,
বিলি করে বেলা অবেলায়; পাড়টা যখন কোনও
আফিমখোরের মতো ঝিমুনিতে বিহ্বল, তখন
নিজের সঙ্গেই তর্ক করে, যেন আমি নেই পাশে। দু’একটি
পাতা উড়ে আসে অন্ধকার ক্রমশ দাঁতাল হয়।
কেমন বদলে যায় চেয়ার বারান্দা, ছবি, বই; যেন দেবোপম ব্লেক
অদূরে আছেন ব’সে রাধাচূড়া গাছটির মগডালে। পেঙ্গুইন পাখি
অকস্মাৎ; শব্দেরা মাছের মতো ঘিরে
ধরে তাকে, ত্র্যাসট্রে কোকিল, ডাকে। এত দূরে থাকে
শহরে এক প্রান্তে, তার কাছে তবুও আসব বার বার।
১০।৩।৯১
শিল্পের হরিণ
ছোটাছুটি, হুটোপুটি, ঘষটানি ঘড় ঘড়, গোঁ গোঁ,
শিল্প-হরিণের গলা ফাঁক। কবি আর চিত্রকর
নিশ্চুপ থাকবে তবু? শকুনের ঝাঁক চোখ ছিঁড়ে
নেয়, পাঁজরের মাংস বেবাক গায়েব। ভয়ঙ্কর
খুবলানি লাগাতার; মোচড়ানো ছায়া প’ড়ে থাকে।
ক’জন হুতুশে লোক ঢাকঢোল ফেলে রেখে ধোঁয়া চেখে
শ্মশান-সুহৃদ, বিস্মৃতির খেয়া সুদূর কোথায়
নিয়ে যায় শিল্পহীনতায় বোধের ওপারে। ভাবি,
খুনীদের জব্দ ক’রে কোন্ ইন্দ্রজাল মৃগছাল
আর কিছু হাড়ে পুণ্যজল ছিটিয়ে ফিরিয়ে দেবে
নান্দদিক স্পন্দন মূলতঃ নইলে দরবেশ হ’য়ে
বিয়াবান বনে ঘোরা সমীচীন। নদী-বিছানায়
বিপুল সূর্যাস্ত নিদ্রাতুর, স্বপ্নে তার মাঝে মাঝে
শিঙ থেকে জলকণা ঝেড়ে ফেলে শিল্পের হরিণ।
১৩।১।৯১
শুদ্ধতার জন্য
আর নয় কটুবাক্য বান্ধব, নিদেন পক্ষে দু’ এক বিঘৎ
পবিত্রতা থাকুক বজায়, স্মিত তিনি
বললেন চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে সিদ্ধার্থের চেনা
মুদ্রা ধার ক’রে, সুহৃদের সুবচন
অর্চনার অন্তর্গত, ধুপ-ধুনো জ্বালি। চেয়ে থাকি
নিষ্পলক, যেন আমি হাতকড়া পরা অপরাধী।
শুধু সুরে দোয়েল করাচ্ছে স্নান নিঝুম বাড়িকে
অবিরত, এরকম জন্মে শুনিনি; মনের ঘাটে
টলটলে জল ছল্কে ওঠে
বার বার। চড়চড়ে দুপুরের বুক চিরে
রিকশা-অলা চলেছে কোথায়,
তার স্নানাহার
স্থগিত এখন ভেজা পিঠে ছন্দিত প্রশ্নের মৃদু
ওঠা, পড়া, বিশুদ্ধতা কতদূর? ‘কাছে ধারে
পুষ্করিনী পেয়ে গেলে গা’ ধুয়ে পবিত্র হব’ ব’লে
সে দ্বিগুণ গতিবেগে চালায় প্যাডেল।
পরীবাগে বাগিচার ঘ্রাণ চুরি ক’রে নিয়ে গেছে
ক’জন মেথর, যারা থর থর কাঁপে
সমার্জনী হাতে পৌরসভার মেজাজ
পারদের মতো চ’ড়ে গেলে। গলা অব্দি আবর্জনা
আমার, উৎকট গন্ধ, ভন্ভনে মাছি; লগবগে
নীতি টুটি চেপে ধরে, উঠে এসে পা পিছলে পড়ি
পরীদের হাম্মামে হঠাৎ, হাবুডুবু খাই, পারি না নিশ্বাস
নিতে, তবু শরীর ভেজে না।
বেজন্মা রাস্কেল ব’লে বিষম চেঁচাই প্রায়শই,
ভাঙাই পাড়ার ঘুম, বন্ধুর সদুপদেশ মাঠে
মৃত; একবার বাগে পেলে হয়, কোনও স্কাউন্ড্বেল
ঝর্ণা তলে এক ফোঁটা পানিও পাবে না
কিছুতেই। লোকে বলে, একরোখা কুলাঙ্গার আমি;
শ্যামলিমা আমার নিকট থেকে দূরে
চলে গেছে ভিতরের ঘরে,
প্রিয়ম্বদা কেউ নেই, যে আমার দায়ভাগ ব’য়ে
পাঠাবে শোধনাগারে আর মিষ্টি মুখ
করাবে পালা পার্বণে। নিরক্ষর চাঁদ
খিস্তি খেউড়ের মেঘে অকৃপণ মাধুর্য ছড়ায়;
আমি তো পতনশীল, কী ক’রে অস্থির হাতে শুদ্ধতার পারাবত ছোঁব?
২৫।৩।৯০
শেষ হবার নয়
বুঝেছ বাছাধন আছে সবই আমাদের আছ ঠগ
চোর ছ্যাঁচোড় পেটমোটা বাটপাড়
ঘোল খাওয়ানো ঠিকাদার দুঁদে
বদমাশ খুদে শয়তান বড় মাপের ইবলিস জাঁহাবাজ
মাস্তান ধান্দাবাজ বিপ্লবী আলখাল্লার
আড়ালে কাঠামোল্লা তল্লিবাহক কবি
কী নেই আমাদের আছে রঙ বেরঙের
লোভনীয় মন্ড ভন্ড পীর
আছে গলা-ফোলা ব্যাঙের মতো
ভাড়াটে স্তাবক তুখোড় নিন্দুক ঘুষখোর
আমলা মহাজনের সিন্দুক
সামনে মুখ করে প্রবল পিছনে হাঁটার নসিহৎ খয়রাতের
বাতাসা প্রাগৈতিহাসিক গুহা
অন্ধকারসদৃশ হতাশা আছে আরো আছে
আছে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস
দেশ ডোবানো বন্যা প্রাণ-কাঁদানো হাহাকার
আর উড়ে-আসা ত্রাণ সামগ্রী
মহামারীবৎ দুর্নীতি নকল দ্রোহ
মুমূর্ষ অর্থনীতি দারুণ ব্যবসায়ী লম্পট নিগ্রহপরায়ণ
ঠান্ডা মাথার খুনী শূন্য-কলস বিগ্রহ ঘূণে ধরা
গুণী নিশ্চরিত্র বুদ্ধিজীবী রাস্তার মোড়ে
মোড়ে উই ঢিবি
বলতে ভারি আহ্লাদ হচ্ছে এই সবকিছুই
অতিশয় উদ্বৃত্ত রপ্তানীযোগ্য ছোটখাটো
হত্যাযজ্ঞ আছে তাছাড়া আছে
বাছা-বাছা ব্যক্তিদের বেশুমার টাকা
ধার দেওয়ার ব্যাঙ্ক স্বদেশেরই মানুষ মারার এল-এম-জি
এস-এল-আর বোমারু বিমান ঝকঝকে ট্যাংক আছে
ইয়া শানদার সব পদক আরো
আছে ফর্দ শেষ হবার নয়
২৪।৬।৯০
সংখ্যালঘু
নড়বড়ে ঘরে ওরা ক’জন জিরোয়া। কারো কারো
নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়,
কেউ হাই তোলে, কেউ বাঁশিটিকে পাশে রেখে রুখু
চুল টানে অভ্যসবশত; কারো হাতে
দোতারা নিদ্রিত, কেউ তার বীণা বুকে
চেপে চোখ রাখে দরজার দিকে, তার
ঠোঁট ছুঁয়ে যায় প্রজাপতি, মনে পড়ে,
ক্ষণিকের চুমো খাওয়া। কেমন শূন্যতা-ছাওয়া হৃদয় এখন।
দত্যি-দানো রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে ভেবে তারা
স্বস্তিতে জিরিয়ে নিচ্ছে, অথচ এখনও
রুক্ষ পথে স্লান মুখে হেঁটে যায় বিপন্ন সুন্দর।
যে ব্যাপক অমাবস্যা নেমেছিলো, তার
বুকে জাগেনিতো মুকুটের মতো পূর্ণিমার চাঁদ;
ছন্নছাড়া পথে ছোটে প্রেতায়িত ঘোড়ার কংকাল।
ঢুলুনির আঠা চোখে, মাঝে-মাঝে এ ওর গায়ের
ওপর গড়িয়ে পড়ে, মালগাড়ির সামগ্রী যেন।
হঠাৎ বাতিটা উস্কে দিয়ে একজন
বলে বিচলিত কণ্ঠস্বরে,
‘জাগো, জেগে থাকো;
ভাল করে পরস্পর মুখ দেখে নিই।
অনন্তর এ ওকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
‘আমাদের সহযাত্রী বেশি বাকি নেই। স্নায়ু রোগে
কাতর হলে কি চলে? অসমাপ্ত পর্যটন; কায়ক্লেশে
হেঁটে চলা, বেঁচে থাকবার সাধ আছে, আছে আরও কত কিছু,
জাগো, জেগে থাকো, বিশেষত কৃষ্ণপক্ষে
লাল কমলের সঙ্গে জেগে থাকা চাই।
কে লাল কমল? সকলের চোখে মুখে আকুলতা;
এ ওর মুখের দিকে তাকায়, প্রত্যেকে জিজ্ঞাসার
প্রতিকৃতি; মীমাংসায় পৌঁছার আগেই আসমান
পিচকারি মেরে পথে ছড়ায় আবীর।
৪।৪।৯১
সতীদাহ
আমাকে বিশ্বাস করতেই হচ্ছে কোম্পানির আমলের
দু’জন গতায়ূ বর্ষীয়ান জ্যান্ত এক
যুবতীকে ধরে বেঁধে নিয়ে চলেছেন
ডিঙি নৌকায়। নদীতীরে
উন্মাদের দলের
আকাশ ফাটানো চিৎকার, বদরাগী
ঢেউয়ের চড়চাপড়ে
নৌকা টলমাটাল।
যুবতী হঠাৎ এক লাফে নদীর অগাধ পানিতে,
খড়ি-ওঠা কটমটে চারটি হাত
অবয়বহীন ওর দিকে ধাবিত; পার্থিবতা
গোধূলিবেলায় তাকে টেনে তুলে
পুনরায় ঢেউয়ের আছড়ায়। সে এখন
জলজ ফ্লেমে খুব আলু থালু,
দূরের বাঁশি তার উদ্ধার হয়েও
বিলীন অসারতায়।
জলন্ত চিতা থেকে পালিয়ে আখেরে টলটলে
শীতল চিতায়; কয়েকটি পাখি, মাছের ঝাঁক,
নৌকার গলুই, সন্ধ্যারাগ অবাক হয়ে দ্যাখে
চিরন্তন সতীদাহ।
২১।১১।৯০
আমাকে বিশ্বাস করতেই হচ্ছে কোম্পানির আমলের
দু’জন গতায়ূ বর্ষীয়ান জ্যান্ত এক
যুবতীকে ধরে বেঁধে নিয়ে চলেছেন
ডিঙি নৌকায়। নদীতীরে
উন্মাদের দলের
আকাশ ফাটানো চিৎকার, বদরাগী
ঢেউয়ের চড়চাপড়ে
নৌকা টলমাটাল।
যুবতী হঠাৎ এক লাফে নদীর অগাধ পানিতে,
খড়ি-ওঠা কটমটে চারটি হাত
অবয়বহীন ওর দিকে ধাবিত; পার্থিবতা
গোধূলিবেলায় তাকে টেনে তুলে
পুনরায় ঢেউয়ের আছড়ায়। সে এখন
জলজ ফ্লেমে খুব আলু থালু,
দূরের বাঁশি তার উদ্ধার হয়েও
বিলীন অসারতায়।
জলন্ত চিতা থেকে পালিয়ে আখেরে টলটলে
শীতল চিতায়; কয়েকটি পাখি, মাছের ঝাঁক,
নৌকার গলুই, সন্ধ্যারাগ অবাক হয়ে দ্যাখে
চিরন্তন সতীদাহ।
২১।১১।৯০
সর্বত্র কাঁটার ক্রোধ
একা আছি বহুক্ষণ খন্ড খন্ড বৈভবরহিত
চিহ্ন নিয়ে প্রয়াসের, যেমন বালক অসহায়
ব’সে থাকে নৌকা বানাবার অভিলাষে দোমড়ানো
মোচড়ানো কাগজের স্তুপে। আমি কি ভুলেছি মন্ত্র?
একা আছি নিদ্রাহীন খরার উত্তাপে, বর্ষণের
প্রতীক্ষায়; পুড়ে যায় মুখ, গাছের সবুজ আর
দগ্ধ পক্ষী কণ্ঠ, স্বেদ জমে পাথরের বুকে, হাওয়া
হঙ্কা, ধোঁয়া ওঠে কর্দমাক্ত জলাশয়ে অবিরত।
আমি শূন্য এতকাল পর প্রৌঢ়তার প্রান্তসীমা
ছুঁয়ে, কোন্ শাপে লুপ্ত মনোমুগ্ধকর রঙধনু
কণ্ঠের ভেতর? না কি নই আর ক্ষিপ্র চেষ্টাশীল?
ফুলের সংসর্গে কেটে যাবে বেলা, এ বিশ্বাস ছিল
প্রষ্ফুটিত, অথচ কাঁটার ক্রোধ সর্বত্র, শব্দেরা
উচ্চারণযোগ্য নয়, স্তব্ধতাই আরাধ্য এখন।
১৮।৬।৯১
সারমেয় সমাচার
ইদানিং কুকুর এবং মানুষের মধ্যে জোর
প্রতিযোগিতার স্পৃহা বেড়ে গ্যাছে অতিশয়, কেউ
কেউ নেড়ী কুকুরের চেয়েও অনেক বেশি ঘেউ
ঘেউ করে, কামড়াতে আসে, নোংরা করে ঘরদোর।
লেজ নাড়া আর পা চাটার কাজে এখন কুকুর
মানুষ অপেক্ষা ঢের পেছনে রয়েছে, লজ্জা পেয়ে
কুকুরেরা মধ্যপথে থেমে গিয়ে ‘মনুষ্য হুজুর
অনেক কামেল আপনারা’, ব’লে ঠুংরি ওঠে গেয়ে।
জগতে প্রসিদ্ধ বটে কুকুরকুলের প্রভুভক্তি;
প্রভুর জীবন রক্ষা করার তাগিদে অকাতরে
প্রাণ দ্যায় ওরা, কিন্তু মানুষেরা হুজুরের শক্তি
থাকে যতদিন ততদিন তাঁবেদার, তোলে ঘরে
সোনা দানা, আরো কত কিছু; প্রভুর গর্দান গেলে,
পেছন দরজা দিয়ে পালায় কৌশলে লাশ ফেলে।
১।৫।৯০
সিতমের ঘরে
কতকাল হলো গত, তবু আজো হৃদয় বেতাব
সর্বক্ষণ; কী যেন তালাশ করি, একা-একা ঘুরি,
মধ্যে-মধ্যে বিড় বিড়, আসমানে সুতোহীন ঘুড়ি
ওড়াই মস্তির ঝোঁকে। জেগে জেগে বেশুমার খাব
দেখা, বলো, এ কেমন বিমারী আমার? কত গাব
মেখে জাল তৈরি খাটা খাটুনিতে, মাছ বুড়বুড়ি
কাটে, কিন্তু নিরাপদ; কখনো করিনি কিছু চুরি
তবু বাটে মনচোরা অপবাদরটে বেহাসাব।
পরীগ্রস্ত, একা-একা সাত সওয়ালের জবাবের
উদ্দেশে সফররত, কত বনবাদাড়ে, নগরে
ঘুরি, ফিরি; প্রশ্ন ভুলে খুঁজি তাকে, যাকে কোনোদিন
দেখিনি, শুনিনি কণ্ঠস্বর। অদৃশ্য রূপের জের
স্বপ্নের পরেও থাকে, বসে না কিছুতে মন ঘরে;
কী ক’রে যে কাটে দিব জলহীন জলাশয়ে মীন।
২৯।৪।৯০
সুধাংশু যাবে না
লুণ্ঠিত মন্দির আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো-
‘আখেরে তুমি চলে যাবে?’ বেলাশেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।
স্বর বলে, ‘লুটেরা তোমাকে জব্দ ক’রে
ফেরে আশে পাশে,
তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে
পশুর চেহারাসহ ঘাতকের ছায়া,
আতংকের বাদুড়-পাখার নিচে কাটাচ্ছো প্রহর,
তবু তুমি যেও না সুধাংশু।‘
আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারী, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজো সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।
১১।১১।৯০
সেদিন তোমাকে
যখন প্রথম দেখি অপরাহ্নে পুরানো বাড়িতে
তোমার পরনে ছিল প্রিন্টের কামিজ সালোয়ার।
ক্রমশ সন্ধ্যায় ঠোঁট শহরকে ছুঁলো, কে ফাঁকে
দুলিয়ে ডাগর বেণী পড়লে তুমি নিজের কবিতা।
তোমার শরীরে কৈশোরের কুমারীর ঘ্রাণ খেলা
করছিল, ঠোঁট থেকে ঝরে গেল অজস্র রঙিন
প্রজাপতি, ভাল লেগেছিল অনাবিল আচরণ;
কবিতার কিছু ছেলেমানুষি, হাতের নড়া, কথা।
আবার যখন দেখি আরেক বিকেলে, গায়ে শাড়ি,
বিবাহের আভা ছিল তোমার সত্ত্বায়, বুক ভরা
দুধের ঝাঁঝালো গন্ধ, চোখে কিছু বিষাদের দাগ;
বিষাদের আলাদা সৌন্দর্য আছে, তন্ময়তা আনে;
হাতে ভানুসিংহ ঠাকুরের ক্যাসেট, হৃদয় ধু ধু;
সেদিন তোমাকে মেয়ে বড় বেশি ভালবাসলাম।
৪।৪।৯১
হঠাৎ কখন
ভোরবেলা চা খেয়েছি পর পর তিন পেয়ালা। এক ফাঁকে
দুটো টোস্ট আর একটা
কুসুমহীন ডিম খাওয়া গেল তৃপ্তি সহকারে।
খবরের কাগজের হেডলাইনে
চোখ বুলানো কিছুক্ষণ; বারান্দায় দাঁড়ানো;
গাছপালা, টুকরো টুকরো মেঘ, নির্বাচনী পোস্টার,
কয়েকটি পাখি, শাকশজি বহনকারী ঠেলাগাড়ি আর
উস্কো খুস্কো রিক্শাযাত্রীকে দেখা;
কবিতার খসড়া নিয়ে বসা,
তার কথা ভাবা, টেলিফোনে আলাপ।
একটা চামচিকের বিরক্তিকর ওড়াউড়ি,
হঠাৎ কখন গোধূলি আমার উপর ঝুঁকে পড়ল, খেয়াল করিনি।
১৮।২।৯১
হয়তো
ইতিমধ্যে গৃহপরিচারিকা চায়ের সরঞ্জাম
নিয়ে গ্যাছে, দিনের ফার্নেস খানিকটা কমজোর,
এক্ষুণি বেরুবে তুমি সেজে-গুজে ঘরবাড়িদোর
ছেড়ে আর অকস্মাৎ তোমার কনিষ্ঠ পুত্র, নাম
উহ্য থাক, লাল পরী আর শাহজাদা গুলফাম
থেকে ছুটি নিয়ে এসে করবে জিগ্যেশ, ‘সেই কবি,
আসতেন যিনি মাঝে-মাঝে, এ বাড়িতে যার ছবি
দেয়ালে টানানো নেই, কী হয়েছে তেনার আঞ্জাম?’
চমকে তাকাবে তুমি ওর দিকে কিছুক্ষণ, যেন
জিন করে ভর, নিস্তব্ধতা তোমাকে করবে গ্রাস।
ঘোর থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে কথার বিনুনি
করবে রচনা, ‘কার কথা তুই, অবাক, এখনো
রেখেছিস মনে? কে সে? আচ্ছা, সে লোকটা? মৃত্যু-ত্রাস
ছিলো তার, ম’রে গ্যাছে’ ব’লে চুলে চালাবে চিরুনি।
২।৫।৯০