নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি
আজকাল লোকজন কি আমার দিকে
করুণার ভঙ্গিতে তাকায়? আমার অস্তিত্বের
সকল অংশ জুড়ে ক্ষয়ের ক্ষতচিহ্ন এবং
অসাফল্যের ছেঁড়া ন্যাকড়া দেখে নাকে রুমাল চেপে ধরে?
ঠিক বুঝতে পারি না, কখনও মনের বিভ্রম
ভেবে নিজেকে সান্ত্বনার ছায়ায়
জিরোবার সুযোগ করে দিই । আবার কখনও
কারও ছদ্মবেশী সহানুভূতি এবং লুকানো অট্রহাসি
বিষাক্ত কাঁকড়ার মতোই কামড়ে ধরে আমাকে।
তখন কৃতার্থ হওয়ার অভিনয় করার গ্লানি সইতে হয় বলে
ধুলোয় মিশে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চকিতে
কে যেন আমাকে নাইয়ে দেয় আশ্চর্য রূপালী ধারায়
আর আমি নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।
এক আশ্চর্য পথ চলা আমাকে এগিয়ে নিয়ে
যেতে থাকে ক্রমাগত টুকরো টুকরো পাথর, রক্তপায়ী
কাঁটা জটলা পাকানো বৃশ্চিক কোনও কিছুই
আমার এই নিঃসঙ্গ ভ্রমণের পথ রোধ
করতে পারে না, নিষ্ঠুরতা যত প্রবলই হোক, ভ্রূক্ষেপহীন
এই আমি নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।
ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় ধাপ্পাবাজরা
নিরন্তর ধাপ্পা দিচ্ছে, দিক;
ষড়ঋতুতে সন্ত্রাসের দাপট বাড়ুক;
খোলা রাস্তায় হন্তারকেরা হাতিয়ার শানাচ্ছে শানাক;
মনীষার প্রোজ্জ্বল সৌধগুলি ধসে যাচ্ছে যাক;
তবু ঘোর অমাবস্যায়
অস্তিত্বে অজস্র ক্ষত এবং ক্ষয়চিহ্ন নিয়ে
এই অদম্য আমি নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।
৯.১২.৯৯
নাকি শুধু হিমযুগ
তাকে কি নিশুতি রাত ডেকেছিল? নাকি সমুদ্রের
তরঙ্গের ধ্বনি তার কানে ঢেলেছিল
জলকন্যাদের কোনও মোহময় গান?
নইলে কেন শহুরে বাড়ির সুসজ্জিত বড় ঘরে
কাউকে কিছু না বলে মধ্যরাতে কেমন নিশ্চুপ
নিঃসাড় শীতল হয়ে গেলেন হঠাৎ?
আঙুলের ফাঁকে ছিল আধপোড়া, নেভা সিগারেট,
টিপয়ে ফতুর গ্লাশ, ঈষৎ কুঞ্চিত নিরুপায়,
রাতের পোশাক গায়ে। নানান হুইস্কি ওয়াইন,
ভদকা, বীয়ার ইত্যাদির সারি সারি
সাজানো বোতল ছিল মাথার ওপারে-
পারেনি বাড়াতে ওরা সাহায্যের হাত তার দিকে,
এরকমই নৈর্ব্যক্তিক সহচর তারা।
বাড়ির বাশিন্দা যারা তারাও নিদ্রা
সাগরে ছিলেন ডুবে, কিছুতেই পাননি টের তার
প্রস্থানের নিঝুম প্রহর।
বিবাহিত সেই পুরুষের পুত্রেরাও বিবাহিত, কেউ কেউ
সন্তানের পিতা আর উপার্জনক্ষম।
নিশ্চুপ গেলেন যিনি গভীর নিশীথে,
সমর্থ শরীরে তার মিশেছিল গৃহিণী ছাড়াও
ভিন্ন নারীদের স্বেদকণা দিব্যি রমণের কালে। প্রকৃতই
সংসারে ছিলেন সুখী, নাকি
ভীষণ অসুখী-
বোঝা ছিল দায়। তার ঠোঁটে অনেকেই
দেখেছে হাসির রেখা খেলে যেতে বহুবার আর
প্রিয় বন্ধুমহলে আমুদে লোক বলে ছিল খ্যাতি।
যখন গেলেন তিনি অকস্মাৎ, তখন দু’চোখে তার কোন্
দৃশা উঠেছিল ভেসে? ভেসে উঠেছিল,
গৃহিণীর মুখ? কোনও সন্তানের মুখ?
তাকে কি অন্তিম ক্ষণে খুব আলোড়িত
করেছিল কোনও বান্ধবীর চুম্বনের স্মৃতি? নাকি
এসব কিছুই নয়, শুধু হিমযুগ এসেছিল নেমে চোখে?
৩.১.২০০০
নিজেকেই প্রশ্ন
ঢের হৈ চৈ, শোরগোল, হুটোপুটি হল। কনুইয়ের
গুঁতোগুতি, পা মাড়ানো কস্মিনকালেও
হয়নি আমাকে দিয়ে। অবশ্য করেছি
ছুটোছুটি সভায় মিছিলে, আর রক্তাক্ত পা নিয়ে
ফিরেছি আপন ঘরে পরিশ্রান্ত। বলেছেন কতিপয় গুণী,
সেসব ছিল না কাজ কখনও আমার। চুপচাপ
ঘরে বসে বই পড়া এবং কবিতা লেখা নিয়ে
ডুবে থাকাটাই
বস্তুত আমার কাজ, একথা জপিয়েছেন তারা। তবু আমি
সেসব কথার ভ্রমরকে দূরে ঠেলে অশুভের
প্রতিবাদে হাত তুলে আকাশের দিকে
প্রোজ্জ্বল মিছিলে দৃঢ় হাঁটি অদ্যাপিও।
এখন কি খুব ক্লান্ত আমি? ফুরিয়ে এসেছে দম?
সময়তো বেশি নেই। অপরাহ্নে খানিক জিরোনো প্রয়োজন,
পাখিদের সতেজ গমের দানা খেতে দিয়ে সকালে বিকেলে,
কাঠবিড়ালির খেলা দেখে, কখনওবা চুপচাপ
বসে থেকে নিখাদ শান্তিতে
সময় পোহানো আর নতুন কবিতা লেখা পুরোনো খাতায়
বড় কাঙ্ক্ষণীয় মনে হয়। টলটলে স্তব্ধতাই
চাই আজ, অথচ কোথায় শান্তি, কোথায় স্তব্ধতা?
২৪.৩.৯৯
নিজের জীবন নিয়ে
নিজের জীবন নিয়ে বড়ই বিব্রত আছি, কত কিছু
ঘটে যাচ্ছে চারদিকে, কোনওখানে নেই
আমার কোনই নিয়ন্ত্রণ; এমনকি
নিজের সংসারটিকে গোছাতে পারিনি ঠিকঠাক। রয়ে গেছে
বেশ কিছু ফাঁক, কিছু ফাঁকি; পুত্র করেনি অর্জন
কোনও বিদ্যা, বয়সতো কম নয়, দু’কন্যার পিতা,
অথচ সংসার-নীড়ে খড় কুটোটাও
যোগতে সর্বদা ব্যর্থ। এ আমারই বিফলতা। কোন্
অমাবস্যা আমাকে নিয়ত
তাড়িয়ে বেড়ায়? কী বিমূঢ় তাকাই নিজের দিকে
কখনও সখনও; ফের হাল ছেড়ে শূন্যতার কাছে
আত্মসমর্পণ করি। জানি না জ্যোৎস্নার ঢেউ জাগবে কখন।
আমি কি আখেরে সব খুব অগোছালো
রেখে যাব? আমার চৌদিকে
তুমুল ভাঙন, আমি পারিনি সামলে নিতে কিছু। অসহায়,
নাবালক বংশধরগণ পারবে কি রুখে দিতে সর্বনাশ?
২৫.৩.৯৯
নিষ্ঠুর প্রতারণা
দুপুরবেলা রোজ যেখানে শুয়ে শুয়ে বই পড়ি,
কিংবা আকাশপাতাল ভাবি অথবা
হঠাৎ কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়ি,
সেদিন সদ্যলেখা একটি কবিতাকে আমার ডান পাশে শুইয়ে
চশমাটা খুলে সেই পদাবলীর সান্নিধ্যে রাখি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি হলো
এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। তাকিয়ে দেখি,
কালো চশমাটা আড়চোখে কবিতার দিকে তাকিয়ে
ক্ষান্ত হচ্ছে না, ওর তরতাজা যৌবনের স্পর্শের লোভে
কবিতার কোমরে বাড়িয়ে দিলো ঈষৎ কম্পিত হাত।
ঈষৎ নড়ে চড়ে ওঠে কবিতা। চশমার কামাতুর হাত
ওর স্তন মুঠোবন্দী করার সঙ্গে সঙ্গে গা
ঝাড়া দিয়ে ওঠে তন্বী কবিতা। ওর ফুঁসে ওঠার ভঙ্গি
আমার দৃষ্টি এড়ালো না। আমার রাগী চোখ দুটো দেখে
ভড়কে যায় আমার নিত্যসঙ্গী চশমা। চটজলদি
শিথিল হলো ওর শক্ত মুঠি, পুরো হাত। কবিতাকে
আলগোছে সরিয়ে আমার বাঁ পাশে নিয়ে আসি।
নিমেষে কবিতা আকাশের নীল হ্রদের সুস্থির
জলরাশি, প্রান্তরের প্রশান্ত সবুজ। আমার চোখে
চোখ রেখে কী করে যে আমার দয়িতা
হয়ে গেল সে, ওকে বুকে টেনে নিয়েও
খর দুপুরে সম্মোহিত আমি বুঝতে পারিনি কিছুতেই।
এরপর থেকে আমার চশমা শেকসপীয়রের ওথেলো
নাটকের খলনায়ক ইয়াগোর মতোই আমার
চরম সর্বনাশের মতলবে নানা ফাঁদ পাততে শুরু করে
এবং আমি সহজে ওর শঠতার প্ররোচনায় নিরপরাধ, শুদ্ধতমা,
সুন্দরী ডেসডেমোনসুলভ কবিতাকে গলা টিপে হত্যা শুরু করি।
কবে আমি ইয়াগোর নিষ্ঠুর প্রতারণা থেকে মুক্ত হবো কে জানে?
১৬.১১.৯৯